আগুনমুখো সময়ের কবি শাহিদ আনোয়ার
এক
সময়টা আশির শেষদিকে। আন্দোলন সংগ্রামে মুখরিত দিন। প্রতিবাদী কবিতা উৎসব। প্রতিবাদী ছড়া উৎসব। সময়ের ফুলকিতে ভেসে আসা কয়েকজন মানুষের ছবি আজও বড় তীব্রতায় বিবশ রাখে আমাদের। তুমুল তীব্রতায় ভেসে যাওয়ার দিনে এক তীব্র কবি শাহিদ আনোয়ারের পঙ্ক্তি এনেছিল নতুন মাত্রা। এনেছিল আমাদের তীব্র রাগে ফেটে পড়া শ্লোগানে। আমাদের মিছিলের উচ্চকিত অনুপ্রেরণায়। কবি শাহিদ আনোয়ারকে নিয়ে কিছু লেখার সামান্য স্পর্ধা আছে। তবে মানুষ শাহিদ আনোয়ার সম্পর্কে অসংখ্য স্মৃতি জ্বলজ্বল করছে। আমি কোনটা রেখে কোনটা বলি প্রিয় শাহিদ ভাই আমার মাটির মানুষ। আজ মাটিতে মিশে গেলেন। এমত নিভৃতচারী স্বাপ্নিক অথচ অনুচ্চ স্বরের উদাহরণ খুব একটা নেই বিদ্যমান মানচিত্রে।
দুই
তাঁকে প্রথম দেখি আশির দশকের শেষে। যখন সদ্য বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের একজন সাধারণ কর্মি। লেখালেখির প্রতি এক ধরনের আগ্রহ কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি মোহ আবাল্য। ফলে ছাত্র ইউনিয়নের একুশে সংকলন জয়ধ্বনি, মহানগর ছাত্র ইউনিয়নের যুগান্তর ও উত্তর জেলা ছাত্র ইউনিয়নের পদাতিকে প্রকাশিত কবিতা গল্প প্রবন্ধের অমনোযোগী পাঠক হিসেবে কিঞ্চিত ভূমিকা রেখেছিলাম। এক সময়ে নিজেও লিখেছি। তখন যাদের দুর্দান্ত লেখা আমাকে চমকিত করত তাদের অন্যতম শাহিদ আনোয়ার। তাঁর কবিতা ছিল অতি মাত্রায় কৌতুহল জাগানিয়া। তার সেসব কবিতা ছিল সেইসব আন্দোলনের দিনে আমাদের জন্য অন্যরকম অনুপ্রেরণা। আশির শেষদিকে আমরা মিছিল-মিটিং করলে যেসব কবিতা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়াত তার ভেতর শাহিদ আনোয়ারের একটি কবিতা ছিল এমন—
আই হেইট
এই রক্ত পুঁজময়, কালো ফোসকাবৃত
ব্যথায় কঁকিয়ে কাতর এই স্বাভাবিক জীবনাবস্থা।
রজঃস্রাবের মতো, থুতু ও কফের মতো
ব্যথা–ভারাতুর জোড়া নীলাভ চোখের মতো
এই বাতিল জীবন
আমরা চাইনি ফেরৎ পেতে
চাই না ফেরত পেতে।
[আটচল্লিশ ঘণ্টা একটানা হরতালের পর ফিরে পাওয়া স্বাভাবিক জীবন]
এই বাতিল জীবন আমরা চাইনি ফেরৎ পেতে... এই রকম তীব্র প্রত্যাখ্যানের কবিতা ভীষণ আলোড়ন তুলেছিল আমাদের মগজে। একটি পরিত্যক্ত বাড়ির গল্পে দেশ রাষ্ট্র ধর্ম জাতিতত্ত্ব এভাবে প্রকাশ করা এক বিরল ঘটনা। খুব কম কবিই পেরেছেন তার সমকালীন বাস্তবতা নিয়ে এই রকম দুর্দান্ত কবিতা লিখতে। শাহীদ আনোয়ার বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে শুধু একটিমাত্র কারণে ব্যতিক্রম নন। তিনি প্রতিটি পদক্ষেপেই তার কবি সত্তার পরিচয় দিয়েছেন। আধুনিক বংলা কবিতায় শাহিদ আনোয়ার যেসব কারণে ব্যতিক্রম তার মধ্যে তার শ্রেণি চেতনাও এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।
শ্রী শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবন ১
খসে পড়ে পুরানো পাথর চুন, লোহিত মরিচা
রান্নাঘরের জাগ, থালাবাটি পুরোনো কড়াই
এবড়ে থেবড়ো হয়।
স্থূল ভোঁতা কিছু পাথরের পতন শব্দ শুনে জেগে উঠি শেষ রাত্তিরে
কোন অভাগার মস্তক ফেটে ফের রক্ত গড়ালো
ভাবতে ভাবতে পাশ ফিরে ফিরে শুই।
বুনো মহিষের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে গেলে লরী
বুকের পিঁজরাসহ কেঁপে ওঠে আমাদের পুরোনো ভবন।
কখনো স্বপ্নে দেখি, এ-ভবন ধসে পড়ে ভেঙ্গে চুরমার
কেউ বেঁচে নেই শুধু আমি একা
দু’হাতে সরিয়ে ধস-পানকৌড়ির মতো ঘাড় তুলে চাইছি বেরুতে
এ-ভবনে কোনো মেয়ে কখনোই ছাদে যায় নাকো
পাছে,
পাথরের অসভ্য গোঙানি জেগে ওঠে তেতলায়, অন্য কোনখানে।
দেয়ালে বাঁধুনি নেই, গাঁথুনির চুন আর সুরকীরা কবে গেছে ম’রে
পুরনো ইটের সাথে মৃত ইট আজো অছে দাঁড়িয়ে কী-করে
এ-এক বিস্ময়।
শুধু ভাঙ্গা-চোরা নিষিদ্ধ ছাদে
ক’টি নির্বাক ঘৃতকাঞ্চন
রোদ খায়, ঝড় বৃষ্টি খায়।
এই একটি কবিতা তখন আমাদের নিকট বিস্ময়! সময় পেলেই আওড়াতাম। শাহিদ আনোয়ার কবিতায় শুধু নয়, রাজনৈতিক মাঠেও সক্রিয় ছিলেন। তার জীবনাচার আর কাব্যজগত ভিন্ন ছিল না। এটাই তাঁকে সকল আশির কবি থেকে পৃথক করেছে। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে তাঁকে পেয়েছি মিছিলে মিছিলে। তিনি এতটাই স্বতন্ত্র ছিলেন যে কবিরা কবিতা লিখে তা প্রকাশের জন্য উদগ্রীব থাকে। এবং এহেন কোনো কর্ম নাই করে না তাদের কাব্য প্রতিভা দেখানোর বাসনায়। অত্যন্ত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শাহিদ আনোয়ার তিন দশক শুধু নিভৃতে কবিতা চর্চা করে গেছেন। একটা গ্রন্থ প্রকাশের মতো বিষয় তার নিকট অতিশয় তুচ্ছ মনে হয়েছে। এই ক্ষেত্রে শাহিদ আনোয়ার অনন্য ব্যতিক্রম। মানে সাহিত্য চর্চার জগত যে অসাধারণ নির্লোভ নিরাসক্ত সাধনার ব্যাপার থাকে তা তিনি করে দেখিয়েছেন। এখানে বহু রথীমহারথী কবি সাহিত্যিকদের পক্ষে এতটা নির্লিপ্ত থাকা সম্ভব হয়নি।
কবি শাহিদ আনোয়ারের সঙ্গে খোকন কায়সার, রোকন রহমান ও সেলিনা শেলী © ছবি: কবির পুত্র
আশির দশকের এই নিভৃতচারী কবি কাব্যগ্রন্থ বের করেন প্রথম ২০০০ সালে। শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে [২০০০], কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে [২০০২] এবং দাঁড়াও আমার ক্ষতি [২০০৫]—এই তিনটি গ্রন্থ ছাড়াও আগামী প্রকাশনী থেকে শাহিদ আনোয়ারের শ্রেষ্ঠ কবিতা নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। এত কম গ্রন্থের মধ্যে শাহিদ আনোয়ার নিজের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যেই উজ্জ্বল। এই নিরাসক্তি তাঁর কবিতায়ও উজ্জ্বল দ্যুতিতে বহমান—
পৃথিবী নামের নীল গ্রহটায় স্বর্গের চেয়ে
কয়েকটি স্বাদ বেশি।
এখানে মায়ামমতায় শেকড়, কাণ্ড, ডালপালা
লতা, বৃক্ষরাজি, বন উপবন, বনস্থালীর আঁকশি জন্মায়।
আমার শিশুপুত্র এখন বড় হচ্ছে পৃথিবীতে
স্বর্গে কোনো শিশু জন্মায় না।
স্বর্গে শৈশবে ফেরার কোনো সিস্টেম নেই
আমার শিশুর হাত ধরে আমি আবার
যৌবনে ফিরে আসব
স্বর্গে সেরকম কোনো ব্যবস্থা নেই।
আমার কবর ফুলে ফুলে ঢেকে দেবে
আমার পুত্র আমার স্ত্রী
স্বর্গে সেরকম কোনো ব্যব্যস্থা নেই।
শৈশব নেই বলে স্বর্গে তাঁর আগ্রহ নেই—শুধুমাত্র এই একটি বাক্যই পারে একটি কবিতাকে বহুমাত্রিক দ্যোতনা দিতে। যা শাহিদ আনোয়ারের তীব্র মাগজিক ঝংকারে আমাদের নাড়া দিয়ে যায়। দারাপুত্রপরিবারকে ভালোবেসে স্বর্গ প্রত্যাখান করার দুঃসাহস একমাত্র তিনিই দেখাতে পেরেছেন। কী কারণে তিনি আমাদের কবি—এই বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা না দিয়ে বলা যায়। যাপিত জীবনের প্রতিটি ধারায় তাঁকে আমরা দেখি এক বিস্ময়কর নির্মোহ বিশ্লেষণের শব্দ কারিগররূপে।
কবি শাহিদ আনোয়ার © শিল্পকর্ম: মাসুক হেলাল
তিন
চট্টগ্রামের সাহিত্য অঙ্গনের সঙ্গে যোগযোগ খুব একটা ছিল না। যোগাযোগের সূত্রধর খোকন কায়সার। তবে কয়েকজনকে আমি চিনেছি। যোগাযোগ না থাকলেও তাদেরকে জানতাম। মাঝখানে জীবন যন্ত্রণার ধারাবাহিক পীড়ণে একা হয়ে যাই। ঐ সময়টাতে একদিন রামপুর পানিরকল এলাকায় দেখি শাহিদ ভাই আনমনে হেঁটে যাচ্ছেন। আমি ডাক দেই। কিছুটা উদভ্রান্তের মত। স্মৃতি হাতড়াতে কষ্ট হল। আরেকদিন বিকেলে কথা হলো। চিনলেন। বিকেলে হেঁটে হালিশহর রামপুরা থেকে সেই পূর্বকোণ অফিসে যেতেন প্রতিদিন। আমি খুব অবাক হতাম। তারপর জানলাম দুটো চাকরি করেন। ইসলামিয়া কলেজে পড়ানো শেষে বাসায় এসে বিকেলে পূর্বকোণে। আমি বিস্মিত। প্রায় পথে দাঁড়িয়ে থাকি দুটো কথা বলার জন্য। হাঁটতে হাঁটতে ঈদগা পর্যন্ত যেতাম আর দেখতাম এক মনে হাঁটছেন। প্রায় সিগারেট খাওয়ানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠতেন। কিন্তু আমার অস্থিরতা অন্যত্র ছিল তাঁকে নিয়ে। এখানে আমি শব্দটা বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে বলে দুঃখিত। কিন্তু শাহিদ ভাইয়ের কেন এই জীবন সংগ্রাম? শেলী আপাকে চিনি ঐ একই সময় থেকে। একদিন জোর করে বাসায় নিয়ে গেলেন। সেটা ছিল পানিরকলের বাসা। মানুষ হিসেবে এত সহজ সরল মননের মানুষ আমি কম দেখিছি। তিনি চাইলেই অতি স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন যাপন করতে পারতেন। তাঁর সহকর্মি লেখক কবি বিপ্লবীদের দেখেছি আমেরিকার জীবনের জন্য ডিবি-ওয়ানে এপ্লিকেশন করতে। আর তিনি সেখান থেকে চলে আসেন বিকেলে চা সিগারেট খেয়ে আড্ডা দেয়া যায় না বলে। এইখানেই তিনি জয় করেছেন।
আমাকে একদিন চমকে দিয়ে বললেন: তুমি তো ভালো গল্প লেখো। তোমার নতুন বই কবে আসবে? আমি আসলে এতটা প্রস্তুত ছিলাম না। কারণ একমাত্র সিদ্দিক ভাই ছাড়া চট্টগ্রামের কেউ জানতো কিনা সন্দেহ যে আমার দুটি বই বের হয়েছে। তারপর জাগতিক টুকটাক আলাপের মাঝে তাঁর সাথে প্রায় দেখা হয়। চট্টগ্রাম গেলে তার কাছে যেতে চাইতাম। শেলী আপাকে ফোন করতাম। চুড়ান্ত অসুস্থ হওয়ার আগে একদিন শেলী আপা ফোন করে দ্রুত কলেজ থেকে চলে এলেন। আমি ও খোকন গেলাম। আড্ডা হল। কথা হলো। সেদিনই আমাদের পৌঁছে দেয়ার জন্য নিচে নেমে এসেছিলেন নানাভাবে নিষেধ করা সত্ত্বেও। সেদিনই তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা। শাহিদ আনোয়ার নিয়ে আমার আবার সে কথা বলতে হয়—
কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে
ধাত্রী আমায় মুক্ত কখন করবে?
স্বপ্ন ছিঁড়ে দোলনা কাছে আনো
ধাত্রী আমার দুহাত ধরে টানো....
বাংলা কবিতায় আপনাকে কেউ আর টানতে হবে না। আপনি বাংলা কবিতাকে টেনে নিয়ে গেছেন মুক্ত পৃথিবীতে। বাংলা কবিতার প্রকৃত ধাত্রী শাহিদ আনোয়ার। আপনার হাতে মুক্ত হয়েছে তথাকথিত কাব্য যশপ্রীত কবিগণের। আপনি দেখিয়ে গেছেন কিভাবে কবিজন্ম যাপন করতে হয়। কিভাবে এইসব খদ্দের পরা মাঠ কাঁপানো কবিদের বতিল করে দিতে হয় একমাত্র নির্লিপ্ত মগ্নতায় নিজস্ব ধ্যানে।
ভীষণ ভালো লাগলো রোকন।আসলে এখানে আরোপিত কোনো কথা নেই।সবই জীবনগাথা।প্রতিটি ঘটনা চোখে দেখতে পাচ্ছি! তোমরা হয়তো অবস্থানগতভাবে দূরে ছিলে,তবু তুমি,টিপু,খোকন,সুমন,মুনির---- এরকম বহু নাম করা যায়-- যারা ওর প্রাণের কাছে অথবা সে তোমাদের প্রাণের কাছে নিবিড় হতো।শাহিদের কোনো দাপট, ক্ষমতা কিচ্ছু ছিলো না বলেই-- তাকে যাঁরা ভালোবেসেছেন, তাঁদের ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। শাহিদের একাডেমিক জন্ম ১৯৬০ সাল।খুব ভালো লাগলো লেখাটা। ভালো থেকো,ভাই।
সেলিনা শেলী
নভেম্বর ০২, ২০২১ ১৮:৫৭