কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে কেন?
১
প্রায়শ শোনা যায় কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে। এ কথার সত্যতা যাচাই করার কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে বইমেলায় বিক্রি হওয়া গল্প, উপন্যাস ও চিন্তাশীল গদ্যগ্রন্থের সঙ্গে কাব্যগ্রন্থের কাটতি তুলনা করলে কবিতার পাঠক যে কমে যাচ্ছে, তা দৃষ্টিগোচর হয়। আবার কেউ কেউ পাঠকপ্রিয়তা ও জনপ্রিয়তার মাঝখানে একটা সূক্ষ্ম ভেদরেখা কল্পনা করে বলতে চান, কবিতার প্রকৃত পাঠক আগের মতোই আছে। কেবল এর জনপ্রিয়তার হেরফের হয়েছে। আর কবিতার পাঠক কম না বেশি, তা যাচাইয়ের জন্য জনপ্রিয়তা তো কোনো পরাকাষ্ঠা নয়। কিন্তু কোনো আলোচনাতেই এই বিতর্কের সুরাহা সম্ভব না। আমরা বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করতে পারি মাত্র। কবিতা ও পাঠকের আন্তসম্পর্কের বিষয়টা চূড়ান্তভাবে সাব্যস্ত করতে পারি না।
অতীতে কবিতা শ্রুতিনির্ভর ছিল। শুধু বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে নয়, প্রাচীনকালের সব সাহিত্যেই এই ওরাল ট্র্যাডিশনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। অন্ধ কবি হোমার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে ইলিয়াড মহাকাব্যের কাহিনি শোনাতেন। এই মতো মিথ প্রচলিত আছে। কাহিনিগুলো পরে সংকলিত হলে পাঠকের কাছে পৌঁছায়। অতীতে কবিতার বিষয়বস্তু হিসেবে দেব-দেবী ও স্বর্গ-নরকের কাহিনি অন্তর্ভুক্ত হতো। ফলে শ্রোতার মনে ধর্মীয় আবেগ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করত। আবার রাজা-বাদশার কাহিনিতেও বীর রসের উদ্দীপনা জোরালো থাকায় শ্রোতারা আবেগ আপ্লুত হবার যথেষ্ট সুযোগ পেত। সব মিলিয়ে যা বোঝা যায়, তখন বিষয়বস্তু হিসেবে এসব কাহিনি ছিল সব শ্রোতার জন্য সাধারণ উপভোগ্য বিষয়। বিষয়বৈচিত্র্য অতটা ছিল না। প্রায় একই রকম বিষয়বস্তুতে আনন্দের খোরাক পেতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। শ্রোতারা কাব্য শুনতে যেতেন নাকি ধর্ম বা কাহিনি শুনতে যেতেন, এই প্রশ্ন মুখ্য। কবিতা শুনতে গেলে কাব্যবোধ থাকা জরুরি। কিন্তু এই সাধারণ জনগোষ্ঠীর কাব্যবোধ কতটা সক্রিয় ছিল, সেটি একটি প্রশ্ন। আজকের নন্দনতাত্ত্বিক ধারণায় এই জনগোষ্ঠীর কাব্যবোধ বিচার করাও অনুচিত। ফিলিপ সিডনির ‘এপোলজি ফর পোয়েট্রি’ পড়লে জানতে পারি একটা সময় ইতিহাস, চিকিৎসাশাস্ত্র বা জ্ঞানের অন্যান্য শাখাও কবিতার আকারে লেখা হতো। কবিতা ছিল শাস্ত্র প্রকাশের মাধ্যম। ফলে একজন ইতিহাসবিদ কবিতার আকারে মূলত ইতিহাস পড়তেন। কবিতা নয়। চিকিৎসক পড়তেন চিকিৎসার বিষয়। স্বভাবকবির যুগে আমাদের দেশে দুই কবির মধ্যে কাব্য-লড়াই হতো। এই কবিগান এবং পুঁথিপাঠের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। কবিগান, পুঁথি বা এই মতো সব কাব্যই ছিল বক্তব্যধর্মী তথা বাণীনির্ভর। শ্রোতারা কাব্যবোধের চেয়ে বক্তব্যের রসবোধে তাড়িত হতেন বেশি। কাজেই কবিতা তখন পাঠ করা হতো দর্শকের শ্রবণপ্রিয়তার কারণে। কাব্য শ্রবণে তাঁরা পেতেন অমূল্য বিনোদন। তাই বলা যায়, কবিতা তখন ছিল শ্রোতাপ্রিয়। পাঠকপ্রিয় অবশ্যই নয়। তবে কবিতা যে ছিল অনেক বেশি গণসম্পৃক্ত, একথা নিশ্চিত। এই গণসম্পৃক্ততার অপর নাম হয়তো জনপ্রিয়তা। বর্তমানে আবৃত্তিযোগ্য কবিতাগুলো জনপ্রিয়তার সেই ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রেখেছে বলে আমার ধারণা।
কবিতার সঙ্গে কার আন্তসম্পর্ক নিবিড়? শ্রোতার, নাকি পাঠকের? ব্যাপারটা স্পষ্ট করতে বাংলামাটি অনলাইন পত্রিকার ফেব্রুয়ারি ২২ সংখ্যায় প্রকাশিত কবি মোহাম্মদ রফিকের উদ্ধৃতি উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন:
কখনও কখনও এমন কবিতাও রচিত হয় যা কিনা শিল্পসম্মত হয়েও মানুষের আকাঙ্ক্ষার সম্পদ হয়ে ওঠে। আমার বন্ধু অনুবাদক জন ফ্রেইস্টনার আমাকে একটা গল্প বলেছিল, আমি তখন আইওয়ায়। ফ্রেইস্টনার বলেছিল, সে পাবলো নেরুদার কবিতা অনুবাদে উদ্যোগী হয়ে চিলি যায়। সান্তিয়াগো শহরে রাস্তায় ঘুরছিল, এমন সময় সে শুনতে পেল এক বালক কবিতা আওড়াতে আওড়াতে তরমুজ বিক্রি করছে। অবাক না হয়ে উপায় ছিল না তাঁর। সে ছেলেটিকে কাছে ডাকল, একখণ্ড তরমুজ কিনল এবং ছেলেটিকে অনুরোধ করল কবিতার পঙ্ক্তি ক’টি আওড়াতে। সে শুনল এবং পরে পাবলো নেরুদার কবিতা অনুবাদ করার সময় সে আবিষ্কার করল যে, পঙ্ক্তি দুটি পাবলো নেরুদার ‘ওড’ থেকে নেওয়া।
ওই বালক হয়তো পাবলো নেরুদা নামে কোনো কবির নামই শোনেনি। পঙ্ক্তি কটি তরমুজ বিক্রেতাদের কণ্ঠে কণ্ঠে ঘুরছে। তবে এমন ঘটনা মানব ইতিহাসে দুর্লভ এবং দুর্লভ ঘটনাটি ঘটে পাবলো নেরুদার মতো কোনো কোনো দুর্লভ কবির রচনার ক্ষেত্রে। অবশ্য এই দিয়ে কোনো কিছুই প্রমাণিত হয় না।
কিছুই যে প্রমাণিত হয় না, এ ব্যাপারে কবি মোহাম্মদ রফিকের সঙ্গে আমি একমত। নেরুদার ওই কবিতা হয়তো বালকের মনে ধরেছে মুহূর্তের আবেগে। এতেই প্রমাণিত হয় না কবিতার সঙ্গে ওই বালক মনস্তাত্ত্বিকভাবে সংলগ্ন। তার কাব্যবোধ থাকার কথা তো প্রশ্নই ওঠে না। একই কথা খাটে আবৃত্তিযোগ্য কবিতার জনপ্রিয়তার প্রশ্নে। আবৃত্তি একধরনের পারফর্মিং আর্ট। কবিতার চাইতে আবৃত্তির গুণাগুণে শ্রোতার আকৃষ্টতা বেশি কার্যকর থাকে। কাজেই জনপ্রিয়তা দিয়ে কবিতার সত্যিকারের পাঠক নিরূপণ অসম্ভব প্রায়। দৃষ্টান্ত ছাড়াই একথা সহজেই বোধগম্য যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনপ্রিয় কবিতার শিল্পকুশলতা নিম্নমানের। ছোটবেলায় জীবনানন্দ দাশকে আমরা চিনতাম ‘রূপসী বাংলা’র কবি হিসেবে। পরে জেনেছি তাঁর গভীর, নিমগ্ন ও তীব্র আধুনিক কবিতাগুলোর তুলনায় ‘রূপসী বাংলা’র কবিতা অনেক লঘু। তবু ‘আবার আসিবো ফিরে, ধানসিড়িটির তীরে...’ জনপ্রিয়তায় ছাপিয়ে যায়। আর ‘অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়, আরও এক বিপন্ন বিস্ময়’ মহার্ঘ লাইন হিসেবে টিকে থাকে কিছু গভীর ও নির্বাচিত পাঠকের মনে।
এখন শিল্পগুণের যে বিষয়টি আলোচিত হলো, সেই ধারণাও আমরা পেয়েছি পশ্চিমাদের কাছ থেকে। আর নন্দনতত্ত্বের এই ইউরোপীয় ধারণায় আমরা বশীভূত তিরিশোত্তর কবিতার সময় থেকে। আরও পূর্বেকার মধুসূদন কিংবা রবীন্দ্রনাথকেই বাদ রাখি কেন? ইউরোপকে আত্মস্থ করেই মধুসূদনকে ফিরতে হয়েছে। আর রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক মনন গঠনে ব্রিটিশ রোমান্টিকদের প্রভাব কে না জানে! তবু এই দুই মহারথী পাঠকবিচ্ছিন্ন ছিলেন না কেন? মূলত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের অতল গহনে তাঁরা তলিয়ে যাননি। নজরুলকে তো এক অর্থে গণমানুষের কবিই বলা যায়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে প্রভাবিত আত্মগত বোধ চাঙা হয়ে ওঠে তিরিশোত্তর কবিতায়। নাম হয় আধুনিক কবিতা। কবিতায় আরও আগে থেকে দেব-দেবীর স্থান দখল করে মানুষ। রাজা-বাদশাহ নয়, সাধারণ মানুষ। সেই অর্থে মানুষ তো আরও বেশি কবিতা সংলগ্ন হওয়ার কথা। কবিতায় নিজের স্থানান্তর দেখে আহ্লাদিত হবার কথা। তা না হয়ে আধুনিক কবিতা হলো পাঠকবিচ্ছিন্ন।
এখানে একটা মনস্তাত্ত্বিক কার্যকারণ থাকতে পারে। দেব-দেবী বা রাজা-বাদশা প্রচল সমাজে অনেক দূরত্ববোধক চেতনা তৈরি করে। ‘অনেক দূরের হাতছানি’ মানুষকে যেভাবে মোহিত করে, সেই মোহনবিদ্যা কাজ করেছে এ ক্ষেত্রে। আবার প্রাচীন সেই লোকজ ধারার কবিতায় কাহিনির আবর্ত প্রায় সবই পরিচিত। পরিচিত আবর্তে নৈকট্য বোধ করত শ্রোতারা। সেই শ্রোতামণ্ডলীকে লোকপাঠক নাম দেওয়া যায়। কাব্যচেতনার যে দ্বৈরথ অর্থাৎ দূরত্ব নির্মাণ অথবা নৈকট্য নির্মাণ—
উভয়টাই মনোবৈজ্ঞানিক ধারা হিসেবে কবিতার জনপ্রিয়তার নিয়ামক হিসেবে সক্রিয় থাকতে পারে।
তিরিশোত্তর আধুনিক কবিতায় এলো অন্য রকম ভাঙন। ব্যক্তিনিষ্ঠ কবিতায় ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ পরিলক্ষিত হলো। বাংলা কবিতার যাত্রা শুরু হলো বিমূর্ততার দিকে। কবির হতাশা, মনোবিকলন, অবক্ষয়জনিত নৈরাশ্য, উচ্ছ্বাস, বিস্ময়বোধ, আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা—সবই ব্যক্তিবিশেষের অভিব্যক্তি হিসেবে কবিতায় জায়গা পেল। নির্বিশেষ বা সর্বজনীন হবার প্রবণতা আধুনিক কাব্যে কতটা প্রখর তা আবিষ্কারের দায় রয়ে গেল গবেষকদের কাঁধে। আর বিমূর্ত কবিতা দুর্বোধ্য হবে এটা স্বাভাবিক। এই দুর্বোধ্যতাই আধুনিক কবিতার পাঠক ঠেকিয়ে রাখছে। কেননা আধুনিক কবি বোদলেয়ার কথিত ‘অচেনা মানুষ’। পাঠক তার সঙ্গে নৈকট্য বোধ করে না। প্রাচীন কবিতার দেব-দেবীর সঙ্গে তার দাসত্বের সম্পর্ক ছিল। রাজা-বাদশার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল আনুগত্যের। ফলে দূর সম্পর্কীয় ‘আত্মীয়তা’র চেতনায় লোকপাঠক ওই কবিতায় জেঁকে বসত। বুদ্ধদেব বসু মনে করতেন, আধুনিক কবিতা দুর্বোধ্য নয়, দুরূহ। তাই টিএস এলিয়টের মতো তাঁরও ধারণা ছিল ‘দুরূহ’ কবিতার পাঠোদ্ধারে পাঠকেরও প্রয়োজন প্রস্তুতির। বাণীবদ্ধতা এবং বক্তব্যধর্মিতা পরিত্যাগ করে আধুনিক কবিতা হয়ে উঠেছে চিত্রকল্পনির্ভর, প্রতীকী এবং উপমায় অনন্য। সেই অনন্যতাকে স্পর্শ করতে পাঠকও দক্ষ হয়ে উঠবেন, এই দাবির যুক্তি উপেক্ষা করা কঠিন। কিন্তু প্রস্তুতিপর্ব শেষ করে কবিতার নিকটবর্তী হওয়া সব পাঠকের পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা এ সময়ের কবিতা গণমুখী নয়। ড্রয়িংরুমে একাকী পাঠকের উপজীব্য। তাই আধুনিক কবিতার পাঠক মানেই নির্বাচিত পাঠক। যার ইঙ্গিত আগেই দিয়েছি। নির্বাচিত পাঠক কখনোই গণপাঠকের কাতারে আসে না।
২
কবির কাজ পাঠকের রুচিকে মান্য করা নয় শুধু, বরং নতুন রুচির নির্মাণ। সে ক্ষেত্রে পাঠকপ্রীতির কথা সামনে রেখে আমরা কি কবিতায় ভারতচন্দ্রের পরবর্তী ধারাবাহিকতায় ফিরে যাব? নাকি বিশ্বকবিতার অনুবর্তী হয়ে এগিয়ে যাব যথারীতি? তখন পাঠক কোন মাত্রায় বিবেচিত হবে? এসব প্রশ্নের জবাব সহসা দেওয়া যায় না। তবে নিশ্চিত বলতে পারি একথা যে, গণদাবির অনুগামী হয়ে যেকোনো শিল্পের নন্দনতাত্ত্বিক মান অক্ষুণ্ন রাখা দুঃসাধ্য। কেননা জনচাহিদায় শিল্পচেতনা কাজ করে খুবই কম। আর শিল্পচেতনা সব সময়ই আভিজাত্যময়। তার মানে এই নয় কবিতা যত দূর গণবিমুখ, তত দূর অভিজাত। বরং বলা যায়, ঐতিহ্যবিমুখ যে-কবিতা জাতীয় সাহিত্যের চারিত্র্য নির্মাণে ভূমিকা রাখে না, শিল্পের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ধারণ করেও সেই কবিতার পাঠক নাই। জনপ্রিয়তাও নাই। তাহলে পাঠকের সঙ্গে কবিতার আন্তসম্পর্কের উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব? এটা নির্ভর করে কবির কৌশলের ওপর। একটা রূপসী বাংলা সাধারণ পাঠকের জন্য সহজসাধ্য ও বোধগম্য বলেই জনপ্রিয়। আর বোদ্ধা পাঠক ওই জনপ্রিয়তাকে ডিঙিয়ে যান বলেই ‘মহাপৃথিবী’র দেখা পান। যে-কবি দুই কূল রক্ষা করে চলেন, তিনি জনপ্রিয়ও হন, প্রকৃত পাঠকের কাছেও পৌঁছান। সাম্প্রতিক কালে জীবনানন্দ দাশকে আমি দুকূল রক্ষাকারী মহৎ কবি মনে করি। শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের জনপ্রিয়তাকে কে অস্বীকার করে? শামসুর রাহমান মূলত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও দেশাত্মবোধক কবিতার জন্য বেশি জনপ্রিয়। তাঁর এই কবিতাগুলো জাতীয়তাবোধের আকর। কিন্তু বোদ্ধা পাঠকের কাছে তাঁর এই কবিতাগুলো লঘু প্রকৃতির। বরং রুপালি স্নানসহ তাঁর আরও অনেক কবিতা আছে, যা শিল্পমানে ওসব কবিতাকে বহুদূর ছাড়িয়ে যায়। আল মাহমুদের কবিতা প্রশ্নাতীতভাবে পাঠকপ্রিয়। সোনালী কাবিন তৈরি করেছে তাঁর জনপ্রিয়তার অভিমুখ। একই সঙ্গে এই গ্রন্থের কবিতাগুলো গাঢ় ও শিল্পগভীর। তাঁর মৃত্যুর পর তরুণদের মাঝে তাঁর কবিতার জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয় মাত্রায় বেড়েছে। জাতীয় সাহিত্যের চারিত্র্য নির্মাণে তাঁর কবিতার ভূমিকাকে উপেক্ষা করবার উপায় নাই। কিন্তু একই কথা কি আমরা বলতে পারব ষাটের আবদুল মান্নান সৈয়দ কিংবা সিকদার আমিনুল হকের শিল্পনিষ্ঠ কবিতার বেলায়? সত্তরের কবিতা অনেক বেশি গণমুখী। কিন্তু দক্ষ পাঠকের কাছে অতিকথনে মেদবহুল এসব কবিতার চড়া মূল্য নাই। আবার নির্বিচার স্বেচ্ছাচার থেকে কবিতাকে রক্ষা করলেও বাংলাদেশের আশির দশকের কবিতা পশ্চিমবঙ্গের কবিতার অনুসারী। কেউ কেউ মনে করেন, আশির কবিরা কলকাতাকেই তাঁদের কেবলা মেনেছেন। ফলে প্রকরণচেতন কবিতার চর্চা করতে করতে তাঁরা পাঠক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। পাঠক কখনোই তাঁদের আরাধ্য হয় নাই। কাজেই অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগে জনপ্রিয়তা ও পাঠকপ্রিয়তার দ্বান্দ্বিক অভিপ্রায় কেবল বেড়েই চলে। কোনো সুরাহা মেলে না।
কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে বলে যে অভিযোগ, তা সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা নয়। ঘটনার পুনরাবৃত্তি মাত্র। পঞ্চাশে আবির্ভূত কবি বিনয় মজুমদার তাঁর আত্মপরিচয় গ্রন্থে লিখেছেন:
তখন ‘আরো কবিতা পড়ুন’ নামক আন্দোলন খুব জোর চলেছে। মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে ছোট মিছিল যেতো। শ্লোগান দিতো ‘আরো কবিতা পড়ুন’, হাতে থাকতো ফেস্টুন। যতদূর মনে পড়ে তখনকার সিনেট হলের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তরুণ কবিরা বক্তৃতাও দিতো, পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। দেখেশুনে আমি বলতাম, আমি এখন যা লিখছি সে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক। তার মানে ভবিষ্যতে আমার কবিতা ছাত্রছাত্রীরা পড়তে বাধ্য হবে। সেহেতু এখন আমার কোনো পাঠক না-থাকলেও চলে। এবং কবিবন্ধুদের বললাম যে মিছিল করে কিছু হবে না। আসল কথা হচ্ছে ভালো লেখা দরকার। যখন কবিতার বই ছেপে খাটের নিচে রেখে দেবে, কারো কাছে বেচতে যাবে না, তা সত্ত্বেও পাঠকেরা এসে খাটের নিচের থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে পড়বে তখনই বুঝবে কবিতা ঠিক লেখা হচ্ছে। আমার এ-মন্তব্য কিন্তু কবিবন্ধুদের ভালো লাগেনি।
‘কবিবন্ধুদের ভালো লাগেনি’ কারণ, এতে কবিদের ওপর ভালো কবিতা লেখার দায় চাপে। বিনয় মজুমদারের সেই দায় নিতে চাননি। আর নিজের কবিতা নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগা কবির সংখ্যাই বেশি। কবিতা জনপ্রিয় না হওয়ার পিছনে পাঠকের মূর্খতাকে দায়ী করে এই কবিরা তাই আত্মশ্লাঘায় ভোগেন। কিন্তু বিনয় মজুমদারের উদ্ধৃতি থেকে বুঝি ভালো কবিতার পাঠক কমে না। কবিতার পাঠক যদি কমেই থাকে, তবে ভালো কবিতা লেখা হচ্ছে না বলেই কমেছে। এর পরও বলব, আজকের এই অত্যুঙ্গ সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ভালো কবিতা বাছাই করাটাও রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং। এমনও দেখেছি বাণীবদ্ধ কয়েকটি লাইন, সামান্য স্ট্যাটাস অথবা উদ্ধৃতি ধরনের কিছু লিখেও কবিখ্যাতি পেয়ে যাচ্ছে অনেকে। ওসব লেখায় শত শত লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার দেখে দেখে একজন সত্যিকারের পাঠকও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। নান্দনিকতার ছিটেফোঁটাও হয় তো নেই, নেই শিল্পনিষ্ঠার সামান্য পরিচয়, তবু ওসব লেখাই বিখ্যাত করে তুলছে ওই তথাকথিত কবি বা লেখককে। এসব দেখে প্রকৃত পাঠক হয়তো খেই হারিয়ে ফেলেন। ক্লান্তিকর ঠেকে বলে ভালো কবিতা বাছাইয়ের নিরন্তর প্রচেষ্টা থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলেন। ফলত ভালো কবিও এভাবেই পাঠকবঞ্চিত। আমরা তখন সরল ধারণায় বলি, মানুষ কবিতাবিমুখ।
খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে একটা ঘটনার উল্লেখ করছি। আমি একসময় ‘মেইনরোড’ নামে একটা লিটলম্যাগ সম্পাদনা করতাম। দ্বিতীয় সংখ্যা বেরোলে কবি আবু হাসান শাহরিয়ার জানালেন আমার সম্পাদকীয়টা কবি শামসুর রাহমানের খুব পছন্দ হয়েছে। শাহরিয়ার ভাইয়ের পরামর্শেই ওই সংখ্যার সৌজন্য কপি দিতে কবির বাসায় দেখা করি। কবি তখন শ্যামলীতে থাকেন। আমার সঙ্গে ছিল সাঈফ ইবনে রফিক। কথার একপর্যায়ে শামসুর রাহমান বললেন:
এখন তো অনেক কবি। অনেক কবি থাকার সুবিধা হলো নানান স্বাদের কবিতা পড়া যায়। অসুবিধাও আছে। আগাছা থেকে ভালোদের আলাদা করা যায় না।
এখন ভাবি, কত প্রয়োজনীয় কথাই না কবি বলেছিলেন। শুধু ফেসবুক নয়, অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াতেও প্রচুর কবিতা লেখা হচ্ছে। আজকের অদক্ষ, আনকোরা কবিও নিজেকে ভাবছে বর্ষীয়ান, সুদক্ষ কোনো কবির কাতারে। কেননা সোশ্যাল মিডিয়ায় কবিতা প্রকাশের সহজ সুবিধা সে পাচ্ছে। তার ধারণায় অগ্রজ কবির মতো সেও পৌঁছুতে পারছে পাঠকের দোরগোড়ায়। ফলে সে আর কবিযশপ্রার্থী নয়, রীতিমতো কবি বনে যায়। কাজেই কবির সংখ্যাধিক্যকে কেউ কেউ কবিতার পাঠক কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে দেখেন। একটা অনলাইন পত্রিকায় কবি ফরিদ কবিরের অভিমত:
কবিতার পাঠক অনেক কমেছে। আশির দশকেও একটি কবিতার বই ছাপা হতো ১২৫০ কপি। এখনকার বইগুলো ৩০০ কপি করে! গত চল্লিশ বছরে দেশে লোকসংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু বইয়ের বিক্রি কমে গেছে! আগামীতে কারও কারও বই হয়তো ১০০ কপি ছাপানো হবে। দু-দুজন প্রকাশক আমাকে বলেছেন, কোনো কোনো কবির বই পুরো মেলায় ২০ কপিও চলেনি!
(মাটিবংলা, ফেব্রুয়ারি ২২)।
কিন্তু কবিতার এহেন দশা কেবল বাংলাদেশের নয়, সব দেশেরই কমন বিষয়। লোকনাথ ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন:
কবিতা বাজারে চলে না, চললেও খুবই অল্প চলে, এই রূঢ় সত্য সাধারণভাবে অন্যত্র যেমন, তেমনি ফ্রান্সেও কম প্রযোজ্য নয়। কবিরা যেন বানের জলে ভেসে-আসা অনাথের দল, তাদের দিকে কেউ তাকিয়েও দেখে না। মনে পড়ছে, আঁরি মিশোর মতো কবিও নাকি আড়ালে একবার আক্ষেপ করেন এই বলে যে, উপন্যাস যদি তিনি লিখতে পারতেন তো তাঁর স্বনামধন্য প্রকাশক গালিমার হয়তো তাঁকে আবারো একটু খাতির করতেন। ঐ মিশোরই একটি বই চোখে পড়ে সম্প্রতি, পারীর এক নামজাদা পুস্তকালয়ে, বইটি বেরোয় ১৯৭৮-এর মার্চে, ছাপা হয় আঠারশ কপি—আজও নিঃশেষিত হয়নি। অতীব প্রসিদ্ধ কবি না হলে হাজার কপি ছাপা হচ্ছে এক কবিতার বইয়ের, এমন ঘটনা ফ্রান্সের মতো সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগের জন্য বিশ্বনন্দিত একটি দেশেও বিরল। কবিতার বই যেহেতু একটু বিশিষ্ট শ্রেণীর এবং তার কাটতিও কম, তাই কতো কপি ছাপা হচ্ছে, সেটার উল্লেখ প্রায় সব ক্ষেত্রেই থাকে বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায়—ফ্রান্সে রীতি এই।
[প্রবন্ধ সংগ্রহ, লোকনাথ ভট্টাচার্য, প্রকাশক: এবং মুশায়েরা]
রেনেসাঁর পর থেকে আর্ট মূলত এন্টারটেইনমেন্টের উদ্দেশে সাধিত হয়। সে ক্ষেত্রে ইনভেস্টমেন্ট একটা বড় ভূমিকা রাখে। রেনেসাঁর শিল্পকর্ম এবং স্থাপত্যের বিকাশে মেদিচি পরিবার বিশেষত কসিমো মেদিচির আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। যেখানে বিনিয়োগ সেখানেই চাহিদা ও বাজারমূল্যের প্রসঙ্গ জড়িত। আমাদের দেশের প্রকাশকেরা কবিতার সেই বাজারমূল্য তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর কারণ হলো প্রকাশনাশিল্পটাও শক্তিশালী ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে এখনো দাঁড়ায়নি। ফলে এই শিল্পে প্রতিযোগিতাও নাই। কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পূর্বে পাণ্ডুলিপি বাছবিচারের চেষ্টাটাও নাই। একই প্রকাশক দেখা যাচ্ছে, ভিন্ন ভিন্ন কবির অনেকগুলো কবিতার বই প্রকাশ করছেন বইমেলায়। অর্থায়ন করছেন কবিরা নিজেই। কিন্তু ক্রেতা পাচ্ছেন না। অল্পসংখ্যক ক্রেতাদের অধিকাংশই আবার সেই অর্থে পাঠক নন। ফলস্বরূপ পণ্য হিসেবে নিজের স্বকীয় মূল্য জারি রেখে পাঠকের কাছে আবেদন সৃষ্টি করতে পারছে না কবিতার বই। আমি বিশ্বাস করি যুগের সব আবেদন মেনে নিলে যুগস্রষ্টা হওয়া যায় না। কিন্তু এ-ও তো ঠিক, যুগের সব আবেদন উপেক্ষা করলেও করপোরেট সমাজের পণ্যতালিকায় কবিতার চাহিদাকে সক্রিয় রাখা সম্ভব না। পণ্য হিসেবে কবিতার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আমাদের কবিদের মধ্যেও ছুঁৎমার্গ কাজ করে। তাঁরা মনে করেন, কবিতা এমন এক পবিত্র বয়ান, যাকে পণ্যের মর্যাদা দিয়ে কলুষিত করা অপরাধ। অথচ পেছনে বিনিয়োগ থাকলে ধর্মগ্রন্থও পণ্যের মহিমা নিয়ে বাজারে আসে। মানুষ পবিত্রজ্ঞানে কিনে নেয় সেই গ্রন্থ। সময়ের এই স্ফূর্ত প্ররোচনা বড় রহস্যময়। সেই রহস্য বুঝতে না পারায় কাব্যশিল্পের ক্ষতি হচ্ছে বলে আমি মনে করি। ফলে সৌজন্য কপির বাইরে কাব্যগ্রন্থের যে বিশেষ কোনো আর্থিক মূল্য থাকতে পারে, আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সেটা যেন জানেই না। ইংরেজি সাহিত্যের বিভিন্ন কালপর্ব ঘাটলে দেখা যায় সাহিত্যের একেক শাখা একেক সময় খবরদারি করেছে। শেক্সপিয়ারের যুগে কেবলি নাটকের জয়জয়কার। আলেকজান্ডার পোপের যুগে স্যাটায়ারই সর্বেসর্বা। জনাথন সুইফটের গালিভার্স ট্রাভেলস এ সময়েই লেখা। আবার রোমান্টিক যুগে কবিতাই মুখ্য। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, কিটস, শেলি, বায়রন এ সময়ের কবিকুল। আজকের পৃথিবীর দিকে তাকালে মনে হয় সময়টা ফিকশন ও নন-ফিকশন গদ্যের উপযোগী। ফলে কবিতাকে পাল্লা দিতে হবে গল্প, উপন্যাস ও চিন্তাশীল প্রবন্ধের সঙ্গে। যে করপোরেট সমাজ আমাদের অধিগ্রহণ করেছে, সে সমাজে বিনোদনও ভোগের খোরাক। এখানে বিনোদন তথা ভোগের এমন ব্যবস্থা জারি রয়েছে, যা কবিতার কল্পনাকেও হার মানায়। সোশ্যাল মিডিয়াও যেন সর্বস্তরে এক বিচিত্র সম্ভোগ ছড়িয়ে দিয়েছে। তাই আর্ট হিসেবে কবিতা যতই অভিজাত হোক, তার জাত্যভিমান থাকতে নেই। কবিকেও বুঝতে হবে সামান্য স্ট্যাটাস লিখে যার কবিখ্যাতি, বাণীবদ্ধ কিছু লাইন লিখে যার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী, বৃহত্তর সমাজে সে অধিকতর কমিউনিকেটিভ। বাজারব্যবস্থায় সবই আজ উন্মুক্ত। সবার সঙ্গেই আজ চেতন অথবা অবচেতন প্রতিযোগিতা। কাজেই প্রকাশনা শিল্প সত্যিকারভাবে প্রতিষ্ঠা পেলে সৎ প্রকাশক পাণ্ডুলিপি যাচাই-বাছাই করেন তাঁর বাণিজ্যিক সুবিধার্থে। তাই অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য পাণ্ডুলিপিই তিনি বেছে নেন। নিজের স্বার্থেই প্রচারণা চালান। মিডিয়ার দ্বারস্থ হয়ে লোকবল নিয়োগ করেন বিজ্ঞাপনে। পাঠককে আকৃষ্ট করতে এই বাণিজ্যিক সমারোহে পাপবোধের কিছু দেখি না। বিনয় মজুমদার যখন বলেন:
‘আমি এখন যা লিখছি সে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক। তার মানে ভবিষ্যতে আমার কবিতা ছাত্রছাত্রীরা পড়তে বাধ্য হবে। সেহেতু এখন আমার কোনো পাঠক না-থাকলেও চলে।’ তখন সংশয় জাগে কবিতাকে শিক্ষিত সমাজে জনপ্রিয় করতে একাডেমির যে ভূমিকা, সেটাকে তিনি বিদ্রূপ করছেন কি না। তিনি যা-ই বলুন একাডেমিক সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত হলে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত পাঠক হিসেবে তৈরি হয় কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ থাকতে পারে। কিন্তু কবিতার গুরুত্ব যে তৈরি হয় সেটা নিশ্চিত। সিলেবাসে যুক্ত করার আগে ন্যূনতম বাছাইপর্বও সম্পন্ন হয় কবিতার। আর প্রত্যেক বছর নতুন নতুন শিক্ষার্থীরা এসব কবিতার সংস্পর্শে এলে পড়াশোনার স্বার্থই শুধু দেখবে না, পাঠের নিরন্তর আনন্দের মধ্য দিয়ে নিজেকে পাঠক হিসেবে গড়ে তুলবার সুযোগও পাবে কেউ কেউ। এ ক্ষেত্রে একাডেমিশিয়ানরা উদার হলে বাছাইকৃত সাম্প্রতিক কবিতাকে সিলেবাসে জুড়ে দিতে পারেন। এতে করে সমসাময়িক কবিতার গতিপ্রকৃতি কিছুটা হলেও বুঝতে পারবে শিক্ষার্থীরা। পাঠক হিসেবে জানাশোনায় তারাও হয়ে উঠবে হালনাগাদ। কবিতায় নতুন রুচির দেখা পাবে।
আগেই বলেছি, এই আলোচনার কোনো সিদ্ধান্তমূলক উপসংহার সম্ভব নয়। লোকনাথ ভট্টাচার্যের একটি প্রশ্নের দিকে আমরা নজর দিতে পারি বরং। নিজের লেখা প্রবন্ধে তিনি প্রশ্ন করেন:
কবিতা পৌঁছাচ্ছে অল্প লোকের কাছে, এ-সত্য এড়ানো যায় না। তবু সেই কবিতা নিয়েই কিছু লোকের এতো কচকচি, এতো মাতামাতি কেন?
জবাবে তিনি নিজেই লেখেন:
এইখানে ফিরে আসা যাক আঁদ্রে ভেল্টেরে। তাঁর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কোনো সাংবাদিক একবার তাঁকে প্রশ্ন করেন, সমকালীন সংস্কৃতির জগতে কবিতার স্থান কোথায় বলে তিনি মনে করেন। সে-প্রশ্নের এই উত্তর আঁদ্রের:
স্থান কবিতার নেই, স্থানের অতীতে তার বাসা। কবিতা এক বিস্ময়, তা ঘর ভেঙে সিঁদ কেটে চুরি, এক ভাবাবেশ, পরমানন্দ বা এক ঢিঢিক্কার, অভিশংসা, বিদ্রোহী শক্তি। তার আকাশ যা, তা সত্যের বা প্রকৃতের শাস, জীবনের অদেখা ও অদৃশ্য এক জিনিস। আর সেই কারণেই যে গুরুত্ব তাকে সাধারণত দেয়া হয়, তার প্রভাব তা ছাড়িয়ে বহু দূরে চলে যায়, যতো কমই পঠিত হোক না কেন, সমকালীন কবিরা যে রকম গভীরভাবে এই শতাব্দীকে চিহ্নিত করেছেন, তা অন্য সব শ্রেণীর সাহিত্যকারেরা এবং তাত্ত্বিকেরা একযোগে মিলিত হয়েও কখনো করতে পারেন নি, পারবেনও না। লোকে যাকে ‘সংস্কৃতি’ বলে আখ্যা দেয়, তার মহামহিম মণ্ডপে সেই কবিদের রচনা স্থান পেল কি না পেল, সেটা অতি অকিঞ্চিৎকর এক প্রশ্ন। যে-ধাতে কবিতা সক্রিয়, যে-মেজাজ তার, তাতে সে হেলায় পাশ কাটিয়ে যেতে পারে সকল অভিধান বা জ্ঞানকোষ বা তথ্যপুস্তককে, দূরে থাকতে পারে সরকারি সব সভাসমিতি বা উৎসবের। তার যে রয়েছে একটা রহস্য, একটা গোপন কথা, এক ভয়ঙ্কর অনন্যতা, যেটাকে জিইয়ে না রাখলেই নয়। একটা প্রচণ্ড ডোন্ট-কেয়ার ভাব, অন্য সবকিছু যাক গে-মরুক গে, যেটার অর্থ নিশ্চয় এই নয় যে সে জগৎকে অস্বীকার করছে—বরং সেই ভাব তাকে পথ দেখায় জগতের এক অন্য ব্যবহারের, তা পরের সঙ্গে স্থাপন করে এক অন্য সম্পর্ক। এই পৃথিবীতে কবিতা কেবলই এক ভিন্ন দেশান্তরী, সে মেতেছে এক অন্য জাতের কাল-যাপনে।
সুন্দর প্রবন্ধ ????
সরোজ মোস্তফা
মে ০২, ২০২২ ১৪:৩৬