গতিমুখ হারানো গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন!

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে বিনোদনসর্বস্ব বাণিজ্যিক থিয়েটারের বিপরীতে সমাজমনস্ক সচেতন রাজনৈতিক থিয়েটার পরিচালনার মধ্য দিয়ে মূলত ভারতবর্ষে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সূচনা করে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ [আইপিটিএ]। গণনাট্য সংঘ ছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কালচারাল ফ্রন্ট। বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাস্তবতায় সমাজ ও তার সঙ্কটকে নতুন করে দেখা এবং সর্বব্যাপী সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অনুবর্তী করার লক্ষ্যেই ছিল মূলত গণনাট্য সংঘের তৎপরতা। গোটা ভারতে গণনাট্য সংঘের কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে এর বিস্তৃতি ও প্রভাব ছিল ব্যাপক। বাদল সরকার, বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, উৎপল দত্ত, সলিল চৌধুরী, ঋত্বিক ঘটক, রবিশঙ্করের মতো প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিদের হাতে এই আন্দোলনের সূত্রপাত। গণনাট্য সংঘের সমগ্র তৎপরতার মধ্যে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন ছিল অন্যতম প্রধান কর্মসূচি।

মানবমুক্তির লড়াইয়ে সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গকে হাতিয়ার করে একটা মতাদর্শিক লড়াই পরিচালনা, একটা সর্বব্যাপী সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটানোর উদ্দেশ্যে যে যাত্রা গণনাট্য সংঘ শুরু করেছিল, তার প্রভাবে গোটা ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল পেয়েছিল নতুন চোখ। চলচ্চিত্র, চিত্রকলা, নাট্যকলা, সঙ্গীত, নৃত্য, কবিতা, উপন্যাসশিল্পের সর্বত্র তার যুগপৎ প্রভাব রেখে গেছে। প্রাত্যহিক শিল্প-যাপনেও সমাজমনস্কতার সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে সেখানকার মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে। গণনাট্য সংঘের সাংস্কৃতিক প্রভাব অনুমান করতে হলে আমরা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ভারতীয় চলচ্চিত্রগুলোর দিকে নজর বোলাতে পারি। নজর বোলাতে পারি সে সময়ের সঙ্গীত ও সাহিত্যের দিকেও।

গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন মানে শুধু থিয়েটার আন্দোলন ভাববার সুযোগ নেই। থিয়েটার এমন এক মাধ্যম, যেখানে সব ধরনের কলা বা আর্টের সমন্বিত উপস্থাপন হয়। ফলে থিয়েটারের বিকাশ বা উন্নয়ন মানেই অন্যান্য শিল্পেরও উন্নয়ন। মূলত কলাভিত্তিক সমগ্র সাংস্কৃতিক তৎপতার নেতৃত্বে থাকে সব সময় থিয়েটার বা নাটক। সব থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাবেশ ও তৎপরতাও ঘটে থিয়েটারেই। গণনাট্য সংঘ গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাঝে যে রুচি, শিল্পবোধ, সমাজমনস্কতা, রাজনীতি-সচেতনতা এবং বুদ্ধিবৃত্তির শক্তিশালী আবহ তৈরি করেছিল, তার ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে আজকের পশ্চিমবঙ্গ, আজকের কলকাতা।

মনে রাখা দরকার, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এ দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে বিকশিত হয়েছে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্ম। এ দুই প্রজন্মের কমবেশি সবাই স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সংগঠক-কর্মী ছিলেন। ওই সময়ই মূলত তাঁদের নাট্য আন্দোলনে সম্পৃক্তি ও বিকাশ ও গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনে প্রস্তুতি গ্রহণের কাল। এ দুই প্রজন্মেরও রয়েছে বামপন্থী শিক্ষা, রাজনৈতিক সচেতনতা এবং সক্রিয়তা। রাজনৈতিক পরম্পরা মেনে এঁদের হাতে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন লক্ষ্যাভিমুখীনতা লাভ করার কথা থাকলেও তা ঘটেনি। উপরন্তু ধীরে ধীরে লক্ষ্যচ্যুত গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন গোটা সাংস্কৃতিক বলয় থেকে অপস্মৃতপ্রায় হয়ে গেল। আন্দোলন নয়, শুধু রয়ে গেল কিছু নাম

ভারতে বিশেষ করে কলকাতায় যে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, বাংলাদেশে সে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন শুরু হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ গোটা পৃথিবীকে একটা অখণ্ডতার বা আন্তর্জাতিকতার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। সে দৃষ্টিভঙ্গির ওপর দাঁড়িয়েছে ভারতের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন। আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রভাববিস্তারী চেতনা ছিল জাতীয়তাবাদ। ফলে এখানকার গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন গোটাটাই প্রভাবিত হয়েছে জাতীয়তাবাদী চিন্তা দ্বারা। সে জাতীয়তাবাদ ধীরে ধীরে পর্যবসিত হয়েছে স্থূল জাতীয়তাবাদে। কিন্তু এমনটা কথা ছিল না। বরঞ্চ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করা দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সর্বজাতিক মুক্তি, শোষণ-বৈষম্যহীন, সেক্যুলার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল সাধারণ মানুষ। এ স্বপ্ন তো মানুষ এক দিনে দেখেনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে ২৩ বছরের যে লড়াই-সংগ্রাম, তার চরিত্র বা গতিমুখই সে স্বপ্ন নির্ধারণ করে দেয়। ২৩ বছরের সে লড়াই সংগ্রামে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব ছিল এ দেশের প্রগতিশীল ও বামপন্থীদের হাতে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে যাদের হাতে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, তাদের নামগুলো একবার পড়ুনমমতাজ উদ্দিন আহমেদ, আবদুল্লাহ আল-মামুন, ফেরদৌসী মজুমদার, রামেন্দু মজুমদার, জিয়া হায়দার, আতাউর রহমান, আলী যাকের, সারা যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, সেলিম আল দীন, শিমূল ইউসুফ, ম. হামিদ, ফাল্গুনী হামিদ, ইনামুল হক, লাকী ইনাম, কেরামত মওলা, কামাল উদ্দিন নীলু...। তাঁদের হাতে জন্ম নিয়েছে নাগরিক, নাট্যচক্র, বহুবচন, থিয়েটার, আরণ্যক, ঢাকা থিয়েটারের মতো নাট্যদল। এঁদের প্রায় সকলেই বামপন্থী চিন্তা-চেতনার অনুসারী ছিলেন। অনেকেই ছিলেন সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী।

মনে রাখা দরকার, এই দেশের জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলও নির্মিত হয়েছে বামপন্থীদের হাতে। কিন্তু বামপন্থীরা জাতীয়তাবাদের হাত থেকে সাংস্কৃতিক আন্দোলন বা গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনকে আরও উচ্চতর চেতনা বা সর্বজাতিক মুক্তি বা শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিকতার দিকে ঘোরাতে পারেননি। ফলে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের আখেরে যে চরিত্র পাওয়ার কথা ছিল, তা পায়নি। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত এ দেশের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন সমাজতন্ত্র অভিমুখীনতা প্রদর্শন করলেও এখন গণতন্ত্রের আন্দোলনেও তারা অনুপস্থিত। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় পর্যন্তও গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন কদাচিৎ শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলেছে, কিন্তু এখন সচেতনভাবে শ্রেণিসংগ্রামকে এড়িয়ে চলে। এরা মাঝে মাঝে সমাজতন্ত্রের কথাও বলত, এখন সমাজতন্ত্রের কথা ঘুণাক্ষরেও কেউ উচ্চারণ করে না। গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের কর্মীদের কাছে মানব মুক্তির সংজ্ঞা নেই, শোষণ মুক্তির সংজ্ঞা নেই, শ্রেণি সংগ্রামের আলোচনা নেই, বিপ্লবমুখী নাট্য আন্দোলনের কথা তো দূর অস্ত। ১৯৮৯ সালের জানুয়ারিতে ভারতের উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদে শোষণবিরোধী নাটক করতে গিয়ে কংগ্রেস গুন্ডাদের হাতে খুন হয়ে যাওয়া তরুণ সফদার হাশমীর কথা জিজ্ঞেস করুন আমাদের এই সময়ের থিয়েটার কর্মীদের। তারা সফদার হাশমীর নামই শোনেননি। এ নামটি অন্তত নব্বইয়ের দশকেও নাট্যকর্মীদের মুখে মুখে শুনতাম আর দেখতাম একই আদর্শের শহীদ নাট্যকর্মী সফদার হাশমীর প্রতি কী অসীম দরদ তাঁরা অনুভব করতেন!

এই যে, এ বছর বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের ৫০ বছর চলছে। এই যে ৫০ বছরের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন তার লক্ষ্যবিস্মৃত হলো; ৫০ বছরের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের কর্মীরা জানেন নাশ্রেণিসংগ্রাম কী, শ্রেণিশত্রু কারা, মুক্তি কোন পথে; সাংস্কৃতিক সংগ্রামের স্বরূপই-বা কেমন হওয়া উচিত; এত সবের ব্যর্থতার দায় কারা নেবে?

খেয়াল করুন, ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন দেশে একদল মুক্তিযোদ্ধার হাতেই গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সূচনা। যে শ্রেণিসচেতন সাংস্কৃতিক জাগরণ মুক্তিযুদ্ধের আগে হওয়ার কথা ছিল, সে জাগরণ তারা ঘটাতে চাইলেন মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে তাকে রক্ষা করার যে কঠিন কাজ, সে কাজেই তাঁরা মনোনিবেশ করলেন। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বলয় থেকে এ সচেতন কর্মসূচি আসেনি, যা থিয়েটারকর্মীরা দিয়েছিলেন। সে সময় থিয়েটারকর্মীদের এমন তৎপরতা ছিল রীতিমতো বৈপ্লবিক। নাটক হোক গণমানুষের মুক্তির হাতিয়ার, নাটক হোক শ্রেণিসংগ্রামের সুতীক্ষ্ণ হাতিয়ার’—এ রকম অসাধারণ সব স্লোগান নিয়ে বিভিন্ন দল তাদের নাট্যতৎপরতায় ব্রতী হলো। একটা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে এ দেশের নানা বিচ্ছিন্ন নাট্য তৎপরতাকে এক তারে বেঁধে তাকে রাজনৈতিক লক্ষ্য দান করা হলো। থিয়েটারের পুরোনো ধারণাকে ভেঙে নাটকের বিষয়বস্তু, বক্তব্য, অভিনয় আঙ্গিক, প্রযোজনা পদ্ধতি এবং দলের সঙ্গে কর্মীদের সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও আনা হলো সচেতন রাজনৈতিক চিন্তা। ফলে নাটক হয়ে উঠল অধিকতর সমাজ ও জীবনঘনিষ্ঠ। নাটক হয়ে উঠল সত্যিকার অর্থেই সমাজবিপ্লবের আশাজাগানিয়া উপাদান। কী যেন এক দুর্নিবার ও অপ্রতিরোধ্য ভঙ্গিতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল থিয়েটার। গ্রুপ থিয়েটার।

প্রথম প্রজন্মের পাশাপাশি দ্বিতীয় প্রজন্মের গুরুত্বপূর্ণ কিছু নাম যুক্ত হলো গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনে। এস এম সোলায়মান [প্রয়াত], আহমেদ ইকবাল হায়দার, লিয়াকত আলী লাকী, মান্নান হীরা [সম্প্রতি প্রয়াত], সৈয়দ জামিল আহমেদ, রোকেয়া রফিক বেবি, নাদের চৌধুরী, আফরোজা বানু, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারিক আনাম খান, শিশির দত্ত, ঝুনা চৌধুরী, মিজানুর রহমান, মো. বারী, বাবুল বিশ্বাস, মলয় ভৌমিক, রতন সিদ্দিকী, মাসুম রেজা, বিপ্লব বালা প্রমুখের নাম পাওয়া যায় দ্বিতীয় প্রজন্মে। এঁরা এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও তার পরবর্তী গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনে প্রভাব বিস্তার করেছেন। দ্বিতীয় প্রজন্মের অধিকাংশই গড়ে উঠেছে প্রথম প্রজন্মের গর্ভে। তথাপি তাঁদের হাত ধরেও সত্তর ও আশির দশকে যাত্রা শুরু করে বেশ কিছু দল, যাঁরা গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের মতাদর্শকে অনুসরণ করেছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যলোকনাট্যদল, পদাতিক, থিয়েটার আর্ট, থিয়েটার আর্ট ইউনিট, নাট্যকেন্দ্র, সুবচন নাট্য সংসদ, তির্যক নাট্যদল [চট্টগ্রাম], অরিন্দম [চট্টগ্রাম], অনুশীলন নাট্যদল [রাজশাহী]। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীও তার নাটক নিয়ে যুক্ত থেকেছে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনে।

পরের প্রজন্মে বিশেষ করে ৯০-পরবর্তী সামগ্রিক নাট্য আন্দোলনেও প্রভাববিস্তারী কিছু নাম পাওয়া যায়। সমকালীন নাট্য আন্দোলনে সংগঠক, নাট্যকার, নির্দেশক হিসেবে এঁদের প্রতিশ্রুতিশীল ও মেধাবী তৎপরতা রয়েছে। এ তৎপরতার লক্ষ্য গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনকে সর্বব্যাপী করে তোলা। ফয়েজ জহির, আজাদ আবুল কালাম, আশীষ খন্দকার, কামালুদ্দিন কবীর, অনন্ত হিরা, নূনা আফরোজ, ত্রপা মজুমদার, জাহিদ রিপন, সামিনা লুৎফা নিত্রা, আলী হায়দার, সাইদুর রহমান লিপন, ইউসূফ হাসান অর্ক, হাসান শাহরিয়ার, অভিজিৎ সেন গুপ্ত অপু, আহমেদ গিয়াস প্রমুখের নাম তৃতীয় প্রজন্মে উল্লেখযোগ্য। এঁদের কয়েকজনের হাতেও পত্তন ঘটেছে কয়েকটি দল। যেগুলোর মধ্যে প্রাচ্যনাট, স্বপ্নদল, প্রাঙ্গণে মোর উল্লেখ করা যায়।

গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের নেতৃত্বের উল্লেখিত প্রথম প্রজন্মের প্রস্তুতি ও বিকাশ ঘটেছে গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে। এ দুই দশকেই মূলত এ বাংলায় পাকিস্তানি শোষণ ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্তের মাঝে জাতীয়তাবাদী চেতনার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে এবং জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে নানামুখী সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়। অবশেষে ছাত্র-কৃষক-মেহনতি মানুষের সশস্ত্র সংগ্রামমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ দেশ পাকিস্তানি শোষণ-শাসন থেকে মুক্তি পায় ১৯৭১-এ। এর মধ্য দিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিকশিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিটার হাতে একটা আস্ত রাষ্ট্র শাসনের দায়িত্ব এসে পড়ে, যাদের পূর্বসূরিদের এ ধরনের রাষ্ট্র পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে রাষ্ট্রক্ষমতা বা ক্ষমতার সঙ্গে সরাসরি বোঝাপড়ার ধরন-ধারণ কেমন হবে, তার কোনো ধারণাই ছিল না এ মধ্যবিত্ত শ্রেণিটার।

শোষণমুক্তির শপথে সমাজতন্ত্রের লড়াইয়ে প্রাণবাজি রাখার জন্য আসা তরুণ-প্রাণ নাট্যকর্মীদের অধিকাংশই রাতারাতি মুক্তবাজার অর্থনীতি ভোগবাদ, জাতীয়তাবাদী শ্রেষ্ঠত্ব, উন্নয়নের নাটক এনজিও তৎপরতায় গা ভাসিয়ে দিল কেবল সোভিয়েত পতনের বাহানায়। তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে দীর্ঘ বামপন্থী সক্রিয়তা, পঠনপাঠন, মতাদর্শিক চর্চা কি তবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো? নাকি সমস্যা নিহিত ছিল মধ্যবিত্তের চরিত্রের মধ্যে?

রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সঙ্কটবিশেষ করে পরাজিত রাষ্ট্রদর্শন, জাতি-চেতনা ও সাংস্কৃতিক সঙ্কটকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ করাটা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। বামপন্থী রাজনৈতিক দর্শনের একটা ব্যাপকভিত্তিক চর্চা ও পঠন-পাঠনের ফলে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিটাই এ সঙ্কটে ত্রাতার ভূমিকা নিল। সক্রিয় হয়ে উঠল স্বাধীন বাংলাদেশকে একটা প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আবহ দেওয়ার লক্ষ্যে। শুধু সাংস্কৃতিক আবহই নয়, একটা সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শিখাকে অনির্বাণ করার প্রতীতি ঘোষিত হলো সাংস্কৃতিক বলয়ে। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক দর্শনের অনুবর্তী শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে ধারণ করে ১৯৭২ সালে শুরু হওয়া গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত গোটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়।

মনে রাখা দরকার, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এ দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে বিকশিত হয়েছে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্ম। এ দুই প্রজন্মের কমবেশি সবাই স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সংগঠক-কর্মী ছিলেন। ওই সময়ই মূলত তাঁদের নাট্য আন্দোলনে সম্পৃক্তি ও বিকাশ ও গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনে প্রস্তুতি গ্রহণের কাল। এ দুই প্রজন্মেরও রয়েছে বামপন্থী শিক্ষা, রাজনৈতিক সচেতনতা এবং সক্রিয়তা। রাজনৈতিক পরম্পরা মেনে এঁদের হাতে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন লক্ষ্যাভিমুখীনতা লাভ করার কথা থাকলেও তা ঘটেনি। উপরন্তু ধীরে ধীরে লক্ষ্যচ্যুত গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন গোটা সাংস্কৃতিক বলয় থেকে অপস্মৃতপ্রায় হয়ে গেল। আন্দোলন নয়, শুধু রয়ে গেল কিছু নাম। এর কারণ হিসেবে অনেকেই চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন নব্বই দশকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে। সে পতনের জের ধরে এ দেশে কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙন বড় ধরনের বিপর্যয় নিয়ে আসে বামপন্থী আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক বলয়ে। দীর্ঘদিন বামপন্থী জৌলুশের ছায়ায় আশ্রয় নেওয়া সেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিটাই রাতারাতি ভোল পাল্টে পুঁজিবাদের খেদমতগার হয়ে গেল; রাষ্ট্রের উচ্ছিষ্টভোগের জন্য মরিয়া হয়ে গেল; দলবাজ, দলকানায় পরিণত হলো কেউ কেউ।

শোষণমুক্তির শপথে সমাজতন্ত্রের লড়াইয়ে প্রাণবাজি রাখার জন্য আসা তরুণ-প্রাণ নাট্যকর্মীদের অধিকাংশই রাতারাতি মুক্তবাজার অর্থনীতি ভোগবাদ, জাতীয়তাবাদী শ্রেষ্ঠত্ব, উন্নয়নের নাটক এনজিও তৎপরতায় গা ভাসিয়ে দিল কেবল সোভিয়েত পতনের বাহানায়। তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে দীর্ঘ বামপন্থী সক্রিয়তা, পঠনপাঠন, মতাদর্শিক চর্চা কি তবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো? নাকি সমস্যা নিহিত ছিল মধ্যবিত্তের চরিত্রের মধ্যে? গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন তো মূলত মধ্যবিত্তের মধ্যে সাংস্কৃতিক জাগরণ তৈরির প্রয়াসে মধ্যবিত্তেরই আরেক উচ্চতর সাংস্কৃতিক যাত্রা। তবে কি সত্যিকার অর্থেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, সারা বিশ্বে সমাজতন্ত্রের সম্ভাবনা নিঃশেষ(?) হয়ে যাওয়ার মধ্যে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের স্তিমিতির কারণ নিহিত? এ স্থূল বাহানাকে অনেকেই মূল সমস্যা বলে অভিহিত করতে খুব আরাম বোধ করেন।

সোভিয়েতের পতন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলন এবং বামপন্থীদের হাতে গড়ে ওঠা বৃহত্তর সাংস্কৃতিক বলয়ে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। কিন্তু সেটা এ দেশের জাতীয় সাংস্কৃতিক বিকাশ বা উচ্চতর সাংস্কৃতিক রুচি গঠনের কর্মসূচিকে স্তব্ধ করে দিতে কোনো ধরনের ভূমিকা রাখার কথা না। গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের চলচ্চিত্র, টেলিভিশন নাটক, সঙ্গীত, নৃত্যকলা এমনকি ক্ষেবিশেষে সাহিত্য ও চিত্রকলার মতো প্রধান প্রধান শিল্পও গতি হারিয়েছে, মান হারিয়েছে, রুচি ও জন-আগ্রহ হারিয়েছে। ফলে গণমানুষের পক্ষে উচ্চতর সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে ওঠার পরিবর্তে সর্বব্যাপী একধরনের অশ্লীল মধ্যমেধার যজ্ঞই দৃশ্যমান। সোভিয়েতের পতন, কমিউনিস্ট আন্দোলন বা বামপন্থী রাজনীতির দুর্বলতার দোহাই দিয়ে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের গতিমুখ পাল্টে যাওয়াকে হয়তো জাস্টিফাই করা যাবে, কিন্তু জাতীয় সংস্কৃতির ক্রম দারিদ্র্যাভিমুখকে জাস্টিফাই করা হবে কীভাবে? শ্রেণিসচেতন বামপন্থী চিন্তার প্রভাবপূর্ণ সাংস্কৃতিক আন্দোলন-গ্রুপ থিয়েটারকে একটা স্থূল জাতীয়তাবাদী চরিত্র দিয়ে কাদের স্বার্থে লড়াইবিমুখ, নতজানু, শক্তিহীন ও একটা বিশেষ শ্রেণির সুবিধালাভের ক্লাবে পরিণত করা হয়েছেএ প্রশ্ন অনেক দিন ধরেই উঠছে। কিন্তু উত্তর দিচ্ছে না কেউ।

আমরা ভেবেছিলাম, যে জাতীয়তাবাদীদের হাত ধরে এ দেশে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সে জাতীয়তাবাদীরা নিজেদের চিন্তা ও চর্চাকে দিন দিন উচ্চতর স্তরে উন্নীত করবে। একটা উচ্চতর ও মানবিক শিক্ষাও যদি তাদের মধ্যে জন্ম নেয়, তাহলেও গ্রুপ থিয়েটার একটা দিশা পেতে পারেএমনটা ভেবে আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে-বালি। নিজ জাতির মুক্তি ও মানবিক বিকাশের প্রশ্নেও এদের অবস্থান বরাবরই প্রতিপক্ষ শিবিরে। কারণ, জাতীয়তাবাদী হিসেবেও এদের ঈমান দুর্বল। মুক্তবাজার অর্থনীতির হাত ধরে এ মুলুকে যত ধাপ্পাবাজি নৈতিকতা ও মুক্তি প্রলম্বিতকরণের (অপ)সাংস্কৃতিক উপাদান আমদানি হয়েছে, সব উপাদানকেই এরা ব্যবহারিক জীবনে আরাধ্য করেছে। ফলে যে গতি ও প্রেরণা নিয়ে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটা নাবালক অবস্থাতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। গ্রুপ থিয়েটারের ময়দানে যে তরুণ-প্রাণ গত কয়েক দশকে ভিড় করেছে, শ্রম ও মেধা দিয়ে নিজেদের স্বাক্ষর রেখেছে, এরা অনেকে এখনো গ্রুপ থিয়েটারের মৌলিক দর্শনের অনুসারী হয়ে ওঠেনি। ক্ষেত্রবিশেষে তারা গ্রুপ থিয়েটারের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল নয়। কিন্তু তাদের অনেকের তৎপরতার মধ্যেই রয়েছে গ্রুপ থিয়েটারের চরিত্র। তবে কি গোটা গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনটার মৃত্যু হতে যাচ্ছে? এ প্রশ্নও সম্প্রতি অনেককে করতে শুনি। আমি নিজেও এর উত্তর জানি না। খুঁজছি।