বিংশ শতাব্দীর হারিয়ে যাওয়া এক প্রতিভাবান শিল্পী
এক
১৯০৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর প্যারিসের রেলস্টেশনে পা রাখলেন বিশ বছরের এক নবীন শিল্পী। ফ্রান্সে আসার আগে পারিবারিক পদবি ‘পিনকাস’ বদলে নতুন নাম ধারণ করলেন। এখন তাঁর নাম জুলস প্যাসিন।
জন্মভূমি বুলগেরিয়ার ভিদিন ছেড়ে একে একে কাটিয়েছেন বুখারেস্ট, ভিয়েনা, বার্লিন ও মিউনিখ শহরে। যাযাবর জীবনে ছবি আঁকা এখন অন্যতম লক্ষ্য।
শস্য ব্যবসায়ী ইহুদি ধনী পিতার সন্তান হিসেবে অল্প কিছুদিন পারিবারিক ব্যবসায় জড়িত হলেও মন টেকেনি। বয়স যখন ষোলো, ভিয়েনা আর্ট স্কুলে পড়তে গেলেন। সেখানে বয়সে বড় একজন শিক্ষিকার সাথে প্রেমজনিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন। এই ‘স্ক্যান্ডাল’ প্যাসিনের পরিবার সহজভাবে নিতে পারেনি।
১৯০১ সালে ব্যবসায়িক মতবিরোধের জেরে পিতার সাথে বনিবনা না হওয়ায় পরিবার পরিত্যাগ করলেন। স্বাধীন জীবিকার আশায় জার্মানিতে আশ্রয় নিলেন।
আঁকাআঁকির কারণে মূলত পারিবারিক উপাধি ‘পিনকাস’ ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া। মিউনিখে থাকা অবস্থায় বেছে নিলেন নিশ্চিত জীবন ছেড়ে শিল্পী হবার একাকী কঠিন সংগ্রামের পথ।
প্যারিসে আসার আগে প্যাসিন মিউনিখ ও ভিয়েনার পত্রিকার জন্য স্কেচ এবং কার্টুন আঁকতেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মিউনিখ থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত রম্য পত্রিকা ‘সিম্পলিসিসিমাস’। নোবেলজয়ী লেখক থমাস মান এবং কবি মারিয়া রিলকে তখন সেই পত্রিকায় নিয়মিত লিখছেন। সেখানে ইলাস্ট্রেশন করার পাশাপাশি ছবি আঁকার ক্ষেত্রে প্যাসিনের প্রিয় বিষয় ছিল পতিতালয়। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত এই বিষয়ের ওপর তিনি এঁকে গেছেন। প্যারিসে পরবর্তীকালে এই বিষয়ে তাঁকে বাড়তি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন তুলুজ লোত্রেক।
প্যাসিনের প্রিয় শিল্পী ছিলেন এল গ্রেকো, অ্যাগর, গয়া, ফ্রেগোনার্ড ও রেনোয়া। তাঁদের কাজে অনুপ্রাণিত বোধ করলেও কখনো অনুকরণ করেননি। বিশেষ করে ড্রইং ও ইলাস্ট্রেশনে প্যাসিনের ঘরানা ছিল নিজস্ব। কিউবিজম ও ফভিজম ঘরানায় আকৃষ্ট হলেও সেই আন্দোলনে যোগ দেননি। তেলরং মাধ্যমে দেহজ বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ ছিল স্পষ্ট। বিমূর্ত ধারার প্রতি প্যাসিনের আগ্রহ ছিল না।
ওয়েস্টার বার [১৯০৭]
প্যাসিন যখন প্যারিসে এলেন, তখন সেখানে চলছিল ইমপ্রেশনিস্ট এবং পোস্টইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের রাজত্ব। দেগা, সেজান, রেনোয়া, ভ্যান গঘ, পল গঁগা, পিসারো এবং ক্লদ মনে’র শিল্পভাষা সারা বিশ্ব আত্তীকরণ করছিল। শিল্পবাজারে তাঁদের কাজের মূল্য তখন ঊর্ধ্বমুখী। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার ধনী শিল্পসংগ্রাহকগণের দৃষ্টি ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্পীদের কাজের প্রতি।
একই সময় প্যারিসের মোমার্তে ছবি আঁকছিলেন পিকাসো, মাতিস, হুয়ান গ্রিজ, ভ্লামিক, দেরাইন। প্যাসিন খুব কাছ থেকে তাঁদের কাজ দেখেছিলেন; পাশাপাশি সামান্য দূরে মনতারপাসে এলাকায় বাস করতেন মদিগলিয়ানি, শাগাল, স্যুটিন, কিসলিং প্রমুখ। কিউবিজম, ফভিজম, আফ্রিকান আর্ট, পোস্টইমপ্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম বিবিধ ধারায় তখন প্যারিসে শিল্পচর্চা বিকশিত হচ্ছিল। ১৯০০ সালের পর থেকে প্রায় প্রতিটি প্রদর্শনীতে নিত্যনতুন শিল্পভাষা নিয়ে নবীন শিল্পীরা উদয় হচ্ছেন।
ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও লাতিন আমেরিকা থেকে আগত শিল্পীদের আনাগোনায় মুখর ছিল মোমার্ত এবং মনতারপাসে এলাকা। প্যাসিনের প্রিয় আড্ডাস্থল ছিল মনতারপাসে’র ‘ক্যাফে দোম’ রেস্তোরাঁ। অভিবাসী শিল্পীদের ভিড়-হট্টগোলে সেখানে মোটামুটি সবাই একে অপরের আঁকাআঁকির খবর রাখতেন। বিশেষ করে প্যারিসে প্যাসিনকে যারা স্বাগত জানিয়েছিলেন বিভিন্ন সময়ে, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শিল্পীদের তালিকা বেশ দীর্ঘ।
জার্মানিতে থাকা অবস্থায় প্যাসিন শিল্পমহলে পরিচিত হয়ে ওঠেন। অল্প বয়সে মিউনিখ, বার্লিন ও ভিয়েনার স্টুডিওগুলোতে কাজ শেখার সুযোগ পান। জার্মানির বিখ্যাত ‘সিম্পলিসিসিমাস’ পত্রিকায় নিয়মিত জলরং, কার্টুন ও ইলাস্ট্রেশনের সুবাদে প্যাসিনের শিল্পী পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। ফ্রান্সে আসার আগেই প্যারিসে অভিবাসী জার্মান শিল্পীরা তাঁর নাম জানতেন এবং সহজে আপন করে নিয়েছিলেন আমুদে স্বভাবের প্যাসিন’কে।
অন্যান্য দেশের অভিবাসী শিল্পীদের সঙ্গেও প্যাসিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। হাঙ্গেরির বেলা জোবেল, হল্যান্ডের লুদউইক শেফহট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মরিস স্টার্ন এবং ম্যাক্স ওয়েবার, সুইডেনের জলিন ফোগস্টেড, নরওয়ের পার খ্রগ, অস্ট্রিয়ার অস্কার গ্রোজ, চেক প্রজাতন্ত্রের জর্জ কার এবং এমিল অরলিক, ইতালির ভাস্কর আর্নেস্টো দ্য ফিওরি প্রমুখ ছিলেন তাঁর কাছের মানুষ। তবে জার্মান বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো যোগাযোগ ছিল দিমিত্রি গ্যালানি এবং হেনরি বিং-এর সাথে।
প্যারিসের মোমার্ত এলাকায় জীবনের উল্লেখযোগ্য সময়গুলো কাটলেও ১৯০৫ থেকে ১৯০৮ সাল অব্দি রুম ভাড়া করে থাকতেন ‘দ্য ইকোল’ হোটেলে। এটির বর্তমান নাম হোটেল দেলাম্বে। উল্লেখ্য, ১৮৯১ সালে পল গঁগা তাহিতি ভ্রমণের আগে এই হোটেলে ছিলেন।
পোর্ট্রেট অব হার্মিন ডেভিড [১৯০৮-১০]
দুই
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পাঁচ বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান প্যাসিন। ১৯১৩ সালে নিউ ইয়র্কে প্রথম প্রদর্শনীর পর প্যাসকিনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে শিল্পী হিসেবে অবস্থান দৃঢ় হয়।
ফিলাডেলফিয়ার আলোচিত শিল্পসংগ্রাহক ড. বার্নস ছাড়া এককভাবে প্যাসিনের কাজ সংগ্রহ করেছিলেন বিখ্যাত আইরিশ-আমেরিকান শিল্পসংগ্রাহক আইনজীবী জন কুইন। যিনি প্রথম মার্কিন কংগ্রেসকে রাজি করিয়েছিলেন ইউরোপিয়ান শিল্পকলা যুক্তরাষ্ট্রে প্রদর্শন এবং ক্রয়ের ওপর আরোপিত আইনি জটিলতা নিরসন করতে। ফলে ১৯১৩ সালে নিউ ইয়র্কে প্রথমবারের মতো প্রদর্শিত হয়েছিল ইউরোপের আধুনিক শিল্পীদের চিত্রকলা। ‘আর্মরি শো’ নামের যা পরিচিত।
সেই প্রদর্শনীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো দেলাক্রোয়া, কামিল কোরো, কুবার্ত, দেগা, রেনোয়া, ক্লদ মনে, এদুয়ার মানে, পিসারো, স্যুরাট, ম্যারি কেসেট, ভ্যান গঘ, সেজান, পিকাসো, মাতিস, জর্জ ব্রাক, কান্দিনাস্কি, রুয়াল্ট, সিগনাক, অগাস্ত রঁদা, হেনরি রুশো, সিসলি, রবার্ট হেনরি, সিঙ্গার সার্জেন্ট, হুইসলার প্রমুখ দিকপালের সাথে বুলগেরিয়ান-আমেরিকান শিল্পী জুলস প্যাসিনের কাজ প্রদর্শিত হয়।
১৯২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর প্যাসিন মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করার সময় যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে তাঁকে বিশেষভাবে সহায়তা করেছিলেন প্যারিসে ক্যাফে ডোমে আড্ডার সঙ্গী আলফ্রেড স্টিগলিজ, মরিস স্টার্ন ও ম্যাক্স ওয়েবার। তাঁদের সূত্রে শিল্পসমালোচক হেনরি ম্যাকব্রাইডের সাথে প্যাসিনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। নিউ ইয়র্কের সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে ওয়ান্ট কুন, হোরেস ব্রজকি, পপ হার্ট ছিলেন গ্রিনউইচ ভিলেজ, হার্লেমের নিগ্রো থিয়েটার কিংবা ইস্ট ফিফটিনথ স্ট্রিটে অবস্থিত প্যাঙ্গুইন ক্লাবের নিয়মিত সঙ্গী।
১৯২২ সালে ড. বার্নস যখন স্যুটিনের কাজ দেখতে আর্ট ডিলার গ্যুলিয়ামের সাথে আর্ট ডিলার বোরস্কি’র স্টুডিওতে যাচ্ছিলেন, প্যাসিন সঙ্গ দিয়েছিলেন। এর অন্যতম কারণ ছিল ড. বার্নস যেহেতু ফরাসি ভাষায় দুর্বল ছিলেন এবং জার্মান ভাষা জানতেন, প্যাসিন মধ্যস্থতা করেছিলেন। জার্মানিসহ আরও কয়েকটি ভাষায় দক্ষ থাকায় স্যুটিনের ছবি বিক্রিতে সহায়তাকারী হিসেবে প্যাসিনের ভূমিকা ছিল অনুমেয়। যদিও ড. বার্নস তখনো শিল্পী হিসেবে প্যাসিনের কাজের প্রতি আগ্রহ দেখাননি। তাঁর চোখে প্যাসিন ছিলেন স্রেফ একজন দক্ষ ড্রইং শিল্পী এবং পত্রিকার কার্টুনিস্ট।
এর আগে ১৯২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র অবস্থানকালে প্যাসিন একবার অর্থাভাবে ফিলাডেলফিয়ায় ড. বার্নসের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন তাঁর ছবি বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু ড্রইং খাতা উল্টেপাল্টে দেখে বার্নস সরাসরি অনাগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন প্যাসিনের কাজ সংগ্রহ করতে। পরে কয়েক বছরের মধ্যে ড. বার্নস উপলব্ধি করেন, তিনি ভুল করেছিলেন। প্যাসিনের শিল্প প্রতিভা অনুধাবন করার পর তাঁদের দুজনের বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বিশেষ করে প্যাসিনের কাজের মধ্যে তিনি এল গ্রেকো, ব্রুগেল, সেজান এবং রেনোয়ার সংমিশ্রণ খুঁজে পান। রুক্ষ পেলবতা এবং সাধারণ মানুষের আটপৌরে জীবনের সরাসরি অভিব্যক্তি মেশানো ছবিগুলো অগ্রাহ্য করা সম্ভব হয়নি। অভিজ্ঞ শিল্প-সমঝদার ড. বার্নস তাঁর প্রিয় শিল্পী রেনোয়া, সেজান, ভ্যান গঘ, পিকাসো, মাতিসের কাজের পাশাপাশি ‘স্কুল অব প্যারিস’ গ্রুপের এই ব্যস্ততম শিল্পীর সেরা কাজগুলো ১৯২৩ সালের পর থেকে মূলত সংগ্রহ করা শুরু করেন।
ড. অ্যালবার্ট বার্নস যখন স্যুটিন’কে নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন, প্যাসিন শিল্পমহলে এক পরিচিত নাম; বিখ্যাত লেখক-শিল্পীদের সাথে বন্ধুত্বের সুবাদে তত দিনে প্যাসিন ইউরোপের আধুনিক শিল্প আন্দোলনের অন্যতম চরিত্র হয়ে উঠেছেন।
১৯৩০ সালের মার্চ মাসে নিউ ইয়র্কে একক প্রদর্শনীর সময় ড. বার্নস তাঁর সদ্য প্রতিষ্ঠিত মিউজিয়ামে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্যাসিন’কে। এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে প্যাসিন’কে তিনি সম্বোধন করেছিলেন ‘সর্বকালের সেরা নকশাবিদ’ হিসেবে। সরাসরি শিল্পী সম্বোধন না করায় প্যাসিন কিছু মনে করেননি।
শিল্পের সব মাধ্যমেই তিনি কাজ করেছেন। ড্রাই পয়েন্ট, পেন্সিল, কালি, এচিং, প্যাস্টেল, উড কাট, এনগ্রেভিং, জলরং, তেল রং, ভাস্কর্য—সব মাধ্যমে এঁকে গেছেন।
বর্তমানে বার্নস ফাউন্ডেশন মিউজিয়ামে ড্রইং, প্রিন্ট, জলরং, তেলরং মিলিয়ে প্যাসিনের প্রায় ষাটটি কাজ সংরক্ষিত আছে।
নিউ ইয়র্ক ছাড়াও প্যাসিন বিশ ও ত্রিশের দশকে ছবি এঁকে বেড়িয়েছেন নিউ অর্লিয়েন্স, সাউথ ক্যারোলাইনা, টেক্সাস ও ফ্লোরিডায়। সেই সাথে প্যারিসের বাইরে প্রদর্শনী করেছেন কোলন, বার্লিন, ডুসেলডর্ফে।
আক্ষরিক অর্থে পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে ছবি আঁকার জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন কিউবা, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, স্পেন, ইতালি ও পর্তুগালে।
প্যাসিনের আঁকা ড্রইং, জলরং ও তেলরঙের সংখ্যা কত, তা নিয়ে মতভেদ আছে। যতক্ষণ সজাগ থাকতেন, কিছু না কিছু আঁকতেন। হাতের কাছে যা পেতেন, তাতেই কলম বা পেন্সিলে স্কেচ করতেন অথবা স্বভাবসুলভ কায়দায় কার্টুন আঁকতেন। যে যখন চেয়েছে, তাকে ছবি উপহার দিয়েছেন কিংবা অযত্নে নষ্ট করে ফেলেছেন। সারা পৃথিবীতে প্যাসিনের কাজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।
তার চেয়ে বড় বিষয় সমসাময়িক শিল্পীদের মতো প্যাসিনের নির্দিষ্ট কোনো আর্ট-ডিলার ছিল না। পত্রিকায় ছবি এঁকে কিংবা বিভিন্ন প্রদর্শনীতে তাঁর ছবি বিক্রির পরিমাণ ভালো থাকায় গড়পড়তা শিল্পীদের মতো অর্থাভাব ছিল না। কেবল নিজের তাড়নায় অবিশ্রামভাবে এঁকে যেতেন। রাতে পানশালার আড্ডা কিংবা সকালে কফি পানের টেবিলে সর্বত্র ছবি আঁকতেন। তবে স্টুডিওতে ক্যানভাসে সামনে নিয়ে বসলে ধরন বদলে ফেলতেন। স্কেচ খাতায় আঁকা ঋজু কাঠিন্য বিষয়গুলো জলরং ও তেলরং মাধ্যমে হয়ে উঠত শিল্পীর অন্তর্গত দর্শনের আয়না।
সমসাময়িক শিল্পীদের ঘরানার ছোঁয়া প্যাসিনের কিছু ক্যানভাস স্পর্শ করলেও কখনো ইম্পেস্টো আবার কখনো রঙের পেলবতায় ছিল একান্ত ‘প্যাসিন’। রেনোয়া, সেজান, মাতিসকে ঘিরে তখন ফরাসি চিত্রকলায় তোলপাড় চলছিল। প্যাসিন তাঁদের আত্তীকরণ করেও ফিরে এলেন। বিমূর্ত আধুনিকতা গ্রহণ করলেন না।
বিশেষ করে মাতিসের ঘরানা কিছুদিন অনুসরণের পর প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে সরে এসেছিলেন তাঁর প্রভাব থেকে। সঙ্গী হারমাইনকে ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘আপাতত মাতিসকে নিয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বন্ধুরা মেতে থাকুক।’
১৯০৫-০৮ সালের দিকে আঁকা কিছু প্রতিকৃতিতে সেজানের প্রভাব স্পষ্ট হলেও খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে বদলে ফেললেন। ১৯০৮ সালে ‘থ্রি গ্রেসেস’ (তিন দেবী) নামের বহুল চর্চিত বিষয়বস্তু নিয়ে আঁকা ছবিতে জার্মান এক্সপ্রেশনিজম ধারার প্রভাব ছিল। তিনটি ভিন্ন বর্ণের ভিনদেশি তিনজন নগ্নিকার আধা মূর্ত দেহবল্লরি ছাপিয়ে রেখা ও রঙের কম্পোজিশনে বিষয়বস্তু ফুটিয়ে তোলার ভাষা ছিল প্যাসিনের নিজস্বতা। আরেকটু পরিণত বয়সে ১৯২১-২৩ সালে তিন নগ্নিকাকে কেন্দ্র করে আঁকা ক্যানভাসে প্যাসিন আবার ফিরে গেছেন ইতালি রেনেসাঁ এবং বারোক রীতিতে, কিন্তু প্যাসিনের নগ্নিকাগণ সেখানে ক্যাবানেল কিংবা রুবেন্সের ছবির মতো রোমান্টিক ফিগারের বিপরীতে আধুনিক যান্ত্রিকতায় ক্ষণস্থায়ী বিনোদনের অংশ। তাদের শারীরিক ভাষায় নেই কোনো পৌরাণিক অভিব্যক্তি কিংবা আকুতি।
একইভাবে প্রতিকৃতি আঁকার ক্ষেত্রে শারীরিক প্রকাশভঙ্গিতে প্যাসিন বাড়তি কোনো অনুষঙ্গ আরোপ করেননি। কাঠিন্য এবং নির্লিপ্ততার আড়ালে নিঃশব্দ একাকিত্বের রং-পোশাকে প্যাসিনের ছবির চরিত্রগুলো।
প্রতিকৃতি আঁকার ক্ষেত্রে প্যাসিনের নিজস্ব শিল্পভাষার দার্শনিক অন্তর্দহন এবং বৈশিষ্ট্য সমসাময়িক শিল্পীদের চেয়ে কতটা ভিন্নতর ছিল, তা বোঝার সুবিধার্থে দেখতে হবে ১৯০৯ সালে আঁকা ‘উইলিয়াম হাওয়ার্ড’, ১৯০৮ থেকে ১৯১০ সাল অব্দি আঁকা ‘হারমাইন ডেভিড’, ১৯২২ সালে আঁকা ‘মাদাম স্যামন’, ১৯২৪ সালে আঁকা ‘পিয়ের ম্যাক অরলান’, ১৯২৫ সালে আঁকা ‘ন্যুড উইথ গ্রিন হ্যাট’ কিংবা ‘লিটল গার্ল’, ১৯২৬ সালে আঁকা ‘গার্ল উইথ গার্লেন্ড অব ফ্লাওয়ারস’ অথবা ১৯২৭ সালে আঁকা ‘হিলডা’ এবং ‘লুসি উইথ আ ফার পিস’ শিরোনামের কাজগুলো।
শিল্পী বন্ধু, পৃষ্ঠপোষক, পরিচিত বা অপরিচিত মডেলদের প্রচুর প্রতিকৃতি আঁকলেও আত্মপ্রতিকৃতি আঁকার ক্ষেত্রে প্যাসিনের ছিল অনীহা। শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতির অংশ বিশেষ পাওয়া যাবে ১৯১০ সালে আঁকা ‘দ্য আর্টিস্ট অ্যান্ড দ্য মডেল’ তেলরং’টিতে। সোফায় বসা অর্ধনগ্নিকার পেছনে আয়নায় শিল্পী প্যাসিনের প্রতিবিম্ব। সম্ভবত এটাই শিল্পীর একমাত্র আত্মপ্রতিকৃতি। প্যারিসে পিয়ের দুবরিলের সংগ্রহে আছে কাজটি।
প্যাসিনের বিশিষ্ট কাজের মধ্যে আরও দুটো ছবির কথা উল্লেখ করতে হয়। ১৯১৫ সালে কিউবা ভ্রমনের পর এঁকেছিলেন ‘রাইডার ইন কিউবা’। বলা হয়ে থাকে, রঙের রহস্যময়তা এবং লোকজ ফিগারের বৈশিষ্ট্যে সেজান ও রিভেরার মিলিত সৌন্দর্য ছাপিয়ে গেছে প্যাসিনের এই ক্যানভাসে। আধুনিক ফিগারেটিভ চিত্রকলায় এমন বৈশিষ্ট্য তখন কেবল প্যাসিনের দখলে। একই শক্তিমত্তায় পৌরাণিক-আধুনিকতার মিলিত ভাবনায় আঁকলেন বলিষ্ঠ নগ্নিকাদের ফিগার উপজীব্য করে ১৯২১ সালে ‘দ্য প্রোডিগাল সান’। একজন শিল্পী পথ ভুলে যেন ঢুকে পড়েছেন নিষিদ্ধ হেরেমখানায়।
ইয়াং গার্ল সিটেড [১৯২৯]
তিন
সমালোচকদের চোখে প্যাসিনের আঁকা শহুরে জীবনের প্রতিকৃতিগুলো ছিল চোখে দেখা পার্থিব নান্দনিকতার গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপীয় চিত্রকলার শতবর্ষী ঘরানার মিলিত প্রতিচ্ছবি। কাছ থেকে দেখা প্যাসিনের কাজগুলো তাঁর শিল্পী বন্ধুরা বিরল প্রতিভার স্বাক্ষর হিসেবে স্বীকার করতেন।
সমসাময়িক শিল্পসংগ্রাহকেরাও চোখ ফেরাতে পারতেন না। বিশেষ করে সেমি-ন্যুড নগ্নিকারা ছিল আলোচনা এবং আকর্ষণের কেন্দ্রে। প্যাসিনের ক্যানভাসে নানা ভঙ্গিতে বসে থাকা পুরুষ এবং শুয়ে-বসে-দাঁড়িয়ে থাকা নারীরা শিল্পপ্রেমীদের চোখকে কখনো ক্লান্ত করেনি। অথচ সমসাময়িক শিল্পীদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে থেকেও রহস্যজনকভাবে প্যাসিন আজ ইউরোপের সেরা শিল্পীদের সাথে এক কাতারে আলোচিত নন। তাঁকে ঘিরে ভ্যান গঘ, সেজান, পিকাসো অথবা মাতিসের মতো উচ্ছ্বাস উচ্চকিত নয়।
প্যাসিনের জ্বলে উঠে নিভে যাবার পেছনের কারণগুলো এখন আবার নতুন করে ভাবাচ্ছে। একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা উল্লেখ করলে বোঝা যাবে, প্যাসিন কেন মৃত্যুর পর ক্রমশ হারিয়ে গেলেন।
১৯১৩ সালে নিউ ইয়র্কের ‘আর্মরি শো’ প্রদর্শনীতে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের বিশটি ক্যানভাস প্রদর্শিত হলেও মার্কিন মুলুকে এই কিংবদন্তি পোস্টইমপ্রেশনিস্ট শিল্পী জনপ্রিয় চরিত্র হয়ে ওঠেন আরও বিশ বছর পর। কিন্তু প্যাসিন তাঁর জীবদ্দশাতেই বিখ্যাত ছিলেন। অন্যদিকে নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট মিউজিয়াম এবং যুক্তরাষ্ট্রের নয়টি রাজ্যে ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত আয়োজিত ভ্যান গঘের একক প্রদর্শনীগুলো তুমুলভাবে সফল হয়। এর নেপথ্যে ছিল ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত ভিনসেন্টের জীবনীভিত্তিক আরভিং স্টোনের বিখ্যাত উপন্যাস ‘লাস্ট ফর লাইফ’। বইটির ব্যবসায়িক সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে ১৯৫৬ সালে হলিউডে মুক্তি পেয়েছিল একই নামের সিনেমা। ভ্যান গঘের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কার্ক ডগলাস।
ভ্যান গঘের মতো করুণ মৃত্যু কিংবা তুলুজ লোত্রেকের মতো বোহিমিয়ান জীবন যাপন করলেও প্যাসিন শিল্প-প্রপাগান্ডা থেকে বঞ্চিত ছিলেন প্রাগুক্তদের মতো, কিংবা প্যাসিনের শিল্পসমালোচনা একটা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিল। একই ধরনের পরিণতি ঘটেছিল সমসাময়িক শিল্পী হাইম স্যুটিনের ক্ষেত্রে। এরা ছিলেন প্রচারের আলোর বিপরীতে জ্বলতে থাকা দুর্ভাগা প্রতিভা।
প্যাসিনের অসময়ে মৃত্যুর অন্যতম কারণ ছিল শিল্প আলোচনার পাদপ্রদীপ থেকে তাঁকে দূরে ঠেলে দেওয়ার জন।
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পাশ্চাত্য শিল্পকলার জগতে একাধারে ফভিজম, কিউবিজম, পোস্ট এক্সপ্রেশনিজম, সুররিয়ালিজম, অ্যাবস্ট্রাক্ট, ইনস্টলেশন, অপ-আর্ট, পপ-আর্ট নানামুখী ঘরানার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্যাসিন ক্রমশ অনুচ্চারিত রয়ে গেলেন। ১৯০৫ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত তেলরং কিংবা জলরং মাধ্যমের চেয়ে বেশি এঁকেছেন ড্রইং-স্কেচ-এচিং মাধ্যমে। তাঁর ঘরানা আবদ্ধ ছিল মূলত ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর ঘেরাটোপে। তা ছাড়া কেবল দক্ষ প্রিন্টমেকারের খ্যাতি ছাড়া নগ্ন এবং অর্ধনগ্ন ছবির শিল্পী হিসেবে প্যাসিনকে চিহ্নিত করবার প্রবণতা পারতপক্ষে ক্ষুণ্ন করেছে তাঁর শিল্প-সক্ষমতা।
বিলাসী জীবন এবং রাতভর আমোদ ফুর্তিতে অভ্যস্ত প্যাসিন’কে আড়ালে সবাই ‘প্রিন্স অব মনতারপাসে’ নামে ডাকত। তাঁর মোমার্তের বিশাল স্টুডিও ছিল যেন আরব্য রজনী উপন্যাসের অংশ।
সেখানে রাতভর বন্ধুরা মদ পান করে হল্লা করত, কেউ প্রকাশ্যে ভালোবাসাবাসিতে ব্যস্ত থাকত, কেউ নেশাসক্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত এবং এত কিছুর মাঝে প্যাসিন নির্লিপ্তভাবে নিজের মনে ছবি আঁকতেন।
১৯২০ সালে ক্যাফে দোমে বসে যখন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ‘মুভেবল ফিস্ট’ লিখছিলেন, তখন প্যাসিন ছিলেন লেখকের আড্ডার মধ্যমণি। দুজনের বন্ধুত্বের সূচনা তখন থেকে। হেমিংওয়ের চোখে প্যাসিন ছিলেন ‘চমৎকার শিল্পী’।
রোমানিয়ন ফোক সং [১৯০৫-৮]
চার
সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে প্যাসিন যখন ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলেন এবং আন্তর্জাতিক মহলে সফল ছিলেন, ঠিক সেই সময় নাটকীয়ভাবে আত্মহত্যা করে বসলেন।
১৯১৭ সালে দীর্ঘদিনের সঙ্গী হারমাইন ডেভিডকে বিয়ে করার পর থেকে অন্তর্গত হতাশায় অতিরিক্ত মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন। লেখা চিঠি এবং আচরণে বোঝা যাচ্ছিল, জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। ১৯০৭ সালে হারমাইনের সাথে পরিচয়ের পর ১৯১১ সালে প্রেমে পড়লেন লুসি ভিদিলের। সেই সময় থেকে মূলত শুরু হয়েছিল ব্যক্তিজীবনে প্রেমঘটিত বিষয়ে জটিল দ্বান্দ্বিকতা। একদিকে প্রিয়তমা স্ত্রী হারমাইনের প্রতি আনুগত্য, অন্যদিকে প্রেমিকা লুসির প্রতি আকর্ষণ। পরবর্তী সময়ে লুসি যখন শিল্পীবন্ধু পার খ্রগ’কে বিয়ে করলেন, মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়লেন প্যাসিন।
১৯২৮ সালে নিউ ইয়র্কে লুসির সাথে সম্পর্কের চরম অবনতির পর ১৯২৯ সালে একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেও সফল হননি। তত দিনে জেনে গেছেন শরীরে বাসা বেঁধেছে একসাথে সিফিলিস এবং যকৃতের ক্যানসার। ইচ্ছাকৃতভাবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন না।
১৯৩০ সালের ২ জুন প্যারিসের মোমার্তে নিজের স্টুডিওতে বসে ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে হাতের রগ কেটে রক্ত দিয়ে দেয়ালে বড় করে প্রেমিকার উদ্দেশে লিখলেন,
‘লুসি, ক্ষমা করো।’
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেও মৃত্যু নিশ্চিত হচ্ছিল না।
চেয়ার ছেড়ে উঠে গলায় ইলেকট্রিক তার পেঁচিয়ে ঝুলে পড়লেন দরজার চৌকাঠে।
জুনের ৩ তারিখ প্যারিসের ‘পেতিত গ্যালারি’তে প্যাসিনের একক প্রদর্শনীর উদ্বোধন হবার কথা। কিন্তু প্যাসিনের অনুপস্থিতিতে শিল্পীবন্ধু কিসলিং দুর্ঘটনার আশঙ্কা করে লুসিকে খবর দিলেন। স্ত্রী হারমাইন তখন পৃথকভাবে থাকতেন মনতারপাসের অ্যাপার্টমেন্টে।
অবশেষে আত্মহত্যার তিন দিন পর স্টুডিওর তালা ভেঙে মরদেহ উদ্ধার করলেন লুসি নিজেই।
মৃত্যুকালে এই রোমান্টিক ট্র্যাজিক শিল্পীর বয়স হয়েছিল পঁয়তাল্লিশ বছর।
৭ জুন প্যাসিনের মরদেহ প্যারিসের সেইন্ট ওয়া সমাধিস্থলে নেওয়ার পথে পুরো শহর থমকে গিয়েছিল। প্যারিসবাসী গভীর শোকে বিদায় জানিয়েছিল শিল্পীকে। প্যারিসের সকল গ্যালারি এক দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সেই সঙ্গে মোমার্ত এবং মনতারপাসে এলাকায় ক্যাফে এবং রেস্তোরাঁগুলো সেদিন প্যাসিনের সম্মানে বন্ধ ছিল। সেই এলাকার ক্যাফে ও হোটেলের কর্মীরা যোগ দিয়েছিলেন শবযাত্রায়।
প্যাসিনের কফিনের পাশে হেঁটেছিলেন প্যারিসের শিল্পীরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জর্জ ব্রাক, মার্ক শাগাল, ফুজিটা, কিসলিং, জেডকেইন প্রমুখ। শবযাত্রায় আরও ছিলেন প্যাসিনের শুভানুধ্যায়ী ড. বার্নস। যিনি চেয়েছিলেন সমাধিস্থলে প্যাসিনের একটি মূর্তি স্থাপন করতে। কিন্তু নানা কারণে সেটি সম্ভব হয়নি।
সবকিছু ছাপিয়ে প্যাসিনের শবযাত্রায় এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। কফিনের সাথে চোখ মুছে কাঁদতে কাঁদতে যোগ দিয়েছিলেন প্যাসিনের গত এক দশকের সব মডেল। তাঁরা হলেন মার্সেলি, ক্লদিন, আন্দ্রে, হেনরিটা, মাদো, ক্লারা, লাইডিস, সিমন, জেনভিভ, হিলডা, মারিন, জেনেট, আইশকা ও এলিন। উপস্থিত সাধারণ ব্যক্তিরা তখন অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, প্যাসিনের ক্যানভাসে দেখা নগ্ন, অর্ধনগ্ন মডেলদের সাথে শিল্পীর পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং ভক্তির সম্পর্ক কতটা সুগভীর ছিল!
প্যাসিনের কফিনের পাশে সবার নজর কেড়েছিলেন কালো পোশাকে পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া স্ত্রী হারমাইন এবং লুসি খ্রগ। শিল্পসমালোচক আন্দ্রে স্যামন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পরিচালনার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। গভীর শোকে মুহ্যমান করেছিলেন উপস্থিত সবাইকে।
পরবর্তী সময়ে শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে লিখেছিলেন, ‘প্রিয় প্যাসিন! সুকঠিন বিকৃত অত্যাচারের কষাঘাতে যার হাত থেকে তুলি খসে পড়েছে। যেভাবে এক অনন্য আলোর বাতি নিভে যায় অথবা অনুপম সৌন্দর্য নিয়ে সাজানো বাগান ঝরে পড়ে, ঠিক সেভাবে তোমার রঙের প্যালেট শুকিয়ে গেছে।’
পাঁচ
মৃত্যুর দুই দশক পর ১৯৫২ সালে নিউ ইয়র্কে প্যাসিনের প্রথম একক প্রদর্শনী উপলক্ষে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়, ‘আধুনিক চিত্রকলায় অন্যতম আন্ডাররেটেড এবং হারিয়ে যাওয়া প্রতিভাবান শিল্পী’।
মৃত্যুকালে প্যাসিন তাঁর যাবতীয় অর্থসম্পদের সাথে তাঁর আঁকা সমস্ত তেলরং, জলরং, ড্রইং ইত্যাদি হারমাইন ও লুসির নামে সমানভাবে দান করে গিয়েছিলেন। তাঁরা দুজন প্রিয় মানুষের কাজগুলো স্মৃতি হিসেবে দীর্ঘদিন আগলে রেখেছিলেন।
লোকচক্ষুর আড়ালে জুলস প্যাসিনের হারিয়ে যাবার এটাও একটা কারণ হতে পারে।
আন্দ্রে স্যামন শিল্পীর মৃত্যুর পর সঠিক বলেছিলেন, ‘আমরা প্যাসিনকে আর কখনো খুঁজে পাব না।’