স্ত্রাভিনস্কির বিকেন্দ্রীকরণের সংগীত
২০১২ সালের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগে একটি নাটকের সংগীত নির্দেশনার সাথে যুক্ত হই। জার্মান নাট্যকার বার্টল্ট ব্রেখট-এর ‘দ্য মেজারস টেকেন’-এর সুরকার সম্পর্কে জানতে গিয়ে হ্যান্স আইসলারের মিউজিক থিওরি পড়তে হয়েছিল। কারণ, তিনিই ব্রেখটের নাটকের সংগীত নির্দেশনা দিয়েছিলেন। নাটকটি মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার বিশুল থিয়েটারে একটি আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসবে অংশগ্রহণের জন্যই প্রস্তুতি চলছিল অধ্যাপক ইসরাফিল শাহীনের নির্দেশনায়। হ্যান্স আইসলারের সংগীত সমালোচনা পড়তে গিয়ে আরেকজন বিস্ময়কর প্রতিভা অথবা আরও দৃঢ়তার সাথে বললে এযাবৎকালের সব থেকে প্রভাবশালী কম্পোজার এইগর স্ত্রাভিনস্কি সম্পর্কে টুকটাক জানতে পারি। এরপর ২০১৮ সালে ঢাকাস্থ আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে জার্মান সংগীতশিল্পী সিমন কিয়ের্স্পেল-এর উদ্যোগে একটি অনুষ্ঠানে স্ত্রাভিনস্কির ফায়ারবার্ড সম্পর্কে আমার একক বক্তৃতার ব্যবস্থা করে। তখন প্রশ্ন জেগেছিল, অ্যাবসলিউট মিউজিক বা বিশুদ্ধ সংগীত বলতে আসলে কী বোঝায়? যা নিয়ে বিশ শতকের সংগীত সমালোচকগণ পুরোদস্তুর মত্ত ছিলেন। নিখাদ বা খাঁটি সংগীত বলতে অনেকে বুঝে নেবেন যে যেখানে কোনো গীতি থাকবে না, অর্থাৎ শুধু সুর থাকবে—তা একস্বরিক বা বহুস্বরিক যা-ই হোক না কেন।
পশ্চিমাদের সংগীত নিয়ে ভাবনার যে পালাবদল—সেখানে তারা একসময় ভেবেছিল, সংগীত হতে হবে অলংকার ও কারুকার্যময়, রেনেসাঁ যুগের [১৪৫০-১৬০০] মেড্রিগাল সংগীতে তার নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যাবে। এরপর ভাবতে শুরু করল কারুকার্য যেন হয়ে ওঠে দক্ষতার পাশাপাশি অজস্র আবেগের উৎসারণ। ব্যারোক যুগের [১৬০০-১৭৫০] গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যনির্ভর সংগীতে তা তারা ফুটিয়ে তুলল সাফল্যের সাথে। তারপর তারা চিন্তা করল, শুধু দক্ষতা দিয়েই তো চলবে না, সেখানে থাকতে হবে বিশালত্ব বা ঐশ্বর্যের রূপায়ণ এবং আবেগের যেহেতু তাৎক্ষণিকতা রয়েছে, ফলে সংগীতকে চিরায়ত হতে হলে আনতে হবে আবেগের পরিমিতি। ক্লাসিক্যাল যুগে [১৭৫০-১৮২০] তা স্বরূপে উদ্ভাসিত হলো সিম্ফনি মিউজিকের সুবাদে। এরপর তারা ভাবল, সংগীত হতে হবে মানবিক, সেই মানবিকতা ও প্রীতি শুধু স্বজাতির জন্য নয়, তা সারা বিশ্বের মানুষের জন্য প্রযোজ্য হবে, রোমান্টিক যুগের [১৮২০-১৯০০] সংগীতকারগণ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রকাশের মাধ্যমে মানবিকতার জয়গান করল, নিসর্গ ও মানুষ হয়ে উঠল একে অপরের অনুগামী। এভাবে অজস্র ভাবনা ও দর্শন তাঁদের শিল্প-অভিযাত্রাকে সমৃদ্ধ করেছে। বিশ শতকের শিল্পীরা দেখতে পেল, এত অজস্র সংগীত জমেছে, আবার প্রতি কম্পোজিশনে জমেছে অনেক তত্ত্ব ও সূত্রের মেদ। বিশেষ করে রোমান্টিক শিল্পীরা তাঁদের ব্যক্তির-স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যথেচ্ছাচারও কম করেনি। তারা কর্ডের বৈচিত্র্য আনতে গিয়ে পুনরাবৃত্তিও করেছে প্রবল। এ থেকে মুক্তির জন্য আনতে হবে বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ অর্থাৎ বিশ শতকের সংগীত মূলত জ্ঞান ও বিচক্ষণতার জগৎ নির্মাণ করেছে।
থিয়োডর অ্যাডোর্নো বিশ শতকের প্রবণতা সম্পর্কে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘সংগীতকে হয়ে উঠতে হবে জ্ঞান’ অর্থাৎ সংগীত শুধু আইডোলজি বহন করে বেড়াবে না, এমনকি নন্দনতত্ত্ব ও ঐতিহ্যের ওপরও দাঁড়িয়ে থাকবে না।’ এই চিন্তার সূচনা ঘটিয়েছেন আর্নল্ড শোয়েনবার্গ [১৮৭৪-১৯৫১]। স্ট্রাভিনস্কি সেই ভাবনাকে বিপুল সম্পদে পরিণত করেছেন। সেই কাজ করতে গিয়ে তিনি ফায়ারবার্ড [১৯১০] ব্যালেতে ডায়াটনিক স্কেলের বাইরে ক্রোমাটিক স্কেলের নোট ব্যবহার করেন, যা দিয়ে শ্রুতি-মাধুর্য অপেক্ষা আরও রহস্যময়, বহিরাগত এবং অপ্রত্যাশিত করে তোলার চেষ্টা ছিল, তখন মঞ্চের চরিত্রগুলোকে অন্য জগতের মনে হয়েছিল। স্ত্রাভিনস্কি সম্পর্কে প্রথমে সংক্ষেপে কিছু বলা যাক। ১৮৮২ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন রাশিয়ার অরানিয়ানবাম শহরে। পরবর্তী সময়ে ফ্রান্স ও আমেরিকার নাগরিকত্ব লাভ করেন। তাঁর পুরো নাম ইগর ফিওদরভিচ স্ত্রাভিনস্কি। ফায়ারবার্ড [১৯১০], পেত্রুস্কা [১৯১১], দ্য রাইট স্প্রিং [১৯১৩]সহ অজস্র সুর রচনা করেছেন। তিনি সিরিয়ালিজমের রূপকা।
স্ত্রাভিনস্কির প্রথম স্কুলজীবনের শুরু সেন্ট পিটার্সবুর্গের গৌরেভিচ জিমনেসিয়ামে, সেখানে তিনি ইতিহাস, গণিত ও ল্যাটিন, গ্রিক, স্লাভ, ফরাসি, জার্মানি এবং রাশিয়ান ভাষা শেখেন। শৈশব থেকেই তাঁর স্কুলে পড়ালেখার প্রতি অরুচি প্রকাশ করেন। কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন: 'আমি কখনো এমন কাউকে দেখিনি যে আমার প্রতি কেউ আকৃষ্ট।’ অল্প বয়সেই তিনি সংগীত ভালোবাসতে শুরু করেন এবং নয় বছর বয়সে নিয়মিত পিয়ানো বাজানো শুরু করেন, তারপরে তিনি সংগীততত্ত্ব ও রচনায় মনোযোগ দেন। পনেরো বছর বয়সে মেন্ডেলসনের পিয়ানো কনসার্টো নং-১ আয়ত্ত করেছিলেন এবং আলেকজান্ডার গ্লাজুনভের একটি স্ট্রিং কোয়ার্টেটের একটি পিয়ানো বাজানো শেষ করেছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, তাঁকে সবাই অসাংগীতিক বলেই মনে করতেন।
সংগীতে উৎসাহ ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও বাবা-মা তাকে আইন পড়াতে চেয়েছিলেন, এই ঘটনা রবীন্দ্রনাথের সাথেও অনেকটা মিলে যায়। ১৯০১ সালে স্ত্রাভিনস্কি সেন্ট পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফৌজদারি আইন এবং আইনি দর্শন অধ্যয়ন করতে শুরু করেন, কিন্তু ক্লাসে অমনোযোগী থাকায় আর এগোতে পারেননি। ১৯০২ সালে নিকোলাই রিমস্কি-করসাকভের ছেলে ভ্লাদিমিরের সাথে পরিচয় হয়, সেও সেন্ট পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। রিমস্কি-করসাকভ তখন সেই সময়ের শীর্ষস্থানীয় সুরকার ও সেন্ট পিটার্সবুর্গ কনজারভেটরি অব মিউজিকের অধ্যাপক। ১৯০৮ সালে রিমস্কি-করসাকভের মৃত্যুর পর তিনি একটি শোক-সংগীত রচনা করেন। ১৯০৯ সালে স্ত্রাভিনস্কি আরও দুটি সংগীত রচনা করেছিলেন—শেরজো ফ্যান্টাস্টিক ও ফেউ দারতিফিস [আতশবাজি]। ১৯১০ সালে রাশিয়ান অপেরা এবং ব্যালে মেশানো সংগীত সৃষ্টি করেন যে ‘দ্য ফায়ারবার্ড’-এর কথা আগেই বলেছি। এ বছর ২৫ জুন অপেরা ডি প্যারিসে ব্যাপক প্রশংসা পায়, স্ত্রাভিনস্কি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ১৯১১ সালে দিয়াঘিলেভ স্ত্রাভিনস্কিকে দ্বিতীয় ব্যালে রচনার জন্য অনুরোধ করেন। তখন তিনি রাশিয়ান লোককাহিনির ওপর ভিত্তি করে পেত্রুশকা রচনা করেন। এরপর লেখেন ‘দ্য রাইট অব স্প্রিং’—এতে তিনি নতুন ধরনের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন—যা টোনালিটি, তাল-ছন্দ, চাপ বা তীব্র ঝাঁজালো একটা ভাব আনলেন। অস্বস্তিকর স্বরের প্রয়োগে জীবনবোধের ভিন্ন বাস্তবতা তুলে আনেন। এখান থেকেই অভিনব সাংগীতিক যাত্রা শুরু হলো, অর্থাৎ অসঙ্গতিপূর্ণ স্বর প্রয়োগের মাধ্যমে অদ্ভুত সব ঐকতান তুলে আনতে শুরু করলেন তিনি। এ সময়ের সুরের অদ্ভুত ভঙ্গি কোরিওগ্রাফিকেও প্রভাবিত করতে শুরু করল। এই আমূল পরিবর্তনের সমাজতাত্ত্বিক কারণ মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অস্থিরতা-বিভীষিকা ও ভয়। এই সংগীত যেন তারই প্রতিচ্ছবি। ২৯ মে ১৯১৩ থিয়েটার দেস চ্যাম্পস-এলিসিসের প্রিমিয়ারে ‘দ্য রাইট অব স্প্রিং’ মঞ্চস্থের পড় প্রায় দাঙ্গা বেধে গিয়েছিল। দর্শক যেন মেনেই নিতে পারেনি এ ধরনের অসঙ্গতিময় অর্কেস্ট্রা। তাঁর আরও বিখ্যাত অপেরার মধ্যে ‘দ্য নাইটিংগেল’, এই ধরনের অভিনব সুর সৃষ্টির পেছনে আর্নল্ড শোয়েনবার্গের অবদান অনস্বীকার্য। কারণ, তার সৃষ্ট অ্যাটোনাল মিউজিক থিওরি তত দিনে সংগীত কম্পোজারদের মনে দারুণ প্রভাব ফেলেছে।
ব্যক্তিজীবনে তাঁর দারিদ্র্য, প্রবঞ্চনা ও যাযাবর জীবনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল, কখনো সুইজারল্যান্ড, কখনো ফ্রান্স, ইতালি, লন্ডন, কখনো ভিয়েনা কিংবা আমেরিকা বিভিন্ন দেশে থিতু হতে ছেয়েছিলেন। তা ছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পৃথিবী টলটলায়মান পরিস্থিতি অনেকটা দায়ী। তারপরও তিনি অবিরত সংগীত নির্মাণের দিকেই ঝুঁকেছেন। জীবনের মধ্যগগন পার হবার পর তিনি ফিল্ম মিউজিকের সাথে যুক্ত হতে শুরু করেন; তাঁর সংগীত ব্যবহার করা প্রথম প্রধান চলচ্চিত্রটি ছিল ওয়াল্ট ডিজনির অ্যানিমেটেড ফিচার ফ্যান্টাসিয়া [১৯৪০]। সেই থেকে সুরের দৃশ্যায়নের ধারণা প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে।
স্ত্রাভিনস্কির সংগীত রচনার বৈশিষ্ট্যে তিনটি কালের ধারণা পাওয়া যায়, একটি রাশিয়ান সময়কাল, আরেকটি নিওক্লাসিক্যাল এবং শেষ কালটি হলো সিরিয়ালিজমের দর্শন। রাশিয়ান সময়কালকে মোটামুটি ১৯০৭ থেকে ১৯১৯ সাল ধরা যায় যে সময় তিনি নিকোলাই রিমস্কি-করস্কভের অধীনে অনুশীলন ও রচনা করেছিলেন, সেই সময়ের রচনায় পূর্ববর্তীদের ছাপ পাওয়া যায়; তাঁদের মধ্যে চাইকোভস্কি, ওয়াগনার, ডেবুসি উল্লেখযোগ্য তবে স্ত্রাভিনস্কির কাজের স্বাতন্ত্র্য পরিষ্কার হতে থাকে। নিওক্লাসিক্যাল সময়কালে [১৯২০-১৯৫৪] তিনি যেন ধ্রুপদি যুগের সংগীতে প্রত্যাবর্তন নয় বরং প্রাচীন ধ্রুপদি জগতের বিষয়বস্তু যেমন গ্রিক পুরাণে তাঁর অন্বেষণের উদাহরণ মেলে। এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে অক্টেট [১৯২৩], পিয়ানো এবং কনসার্টো [১৯২৪], সেরেনাড ইন-এ [১৯২৫], এবং সিম্ফনি অব সাল্মস [১৯৩০]। এ সময়ের প্রবণতা দেখে স্ত্রাভিনস্কিকে সংগীতের সত্যিকারের যুগের উদ্ভাবকদের একজন টের পাওয়া যায়। স্ত্রাভিনস্কির কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তাঁর প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং সৃষ্টির স্বাতন্ত্র্য। যেখানে শুধু কর্ড থেকে কর্ডের অগ্রগতিই শিল্প ও নান্দনিকতার আদর্শ হতে পারে না, নান্দনিকতায় অবগাহনের চর্চা হলো একধরনের মেদ—যা সংগীতের বুদ্ধিবৃত্তিক অভিযাত্রাকে ব্যাহত করে। এই চিন্তার সূচনা হয়েছিল শোয়েনবার্গ থেকে। তাঁরই বিকশিত ও সার্থক রূপ স্ত্রাভিনস্কির মধ্যে পাওয়া যায়। এর আগে রোমান্টিক যুগে ওয়াগনারের মিউজিক্যাল ড্রামাতে যে হারমনিক পদ্ধতির প্রতি যে অকুণ্ঠ সমর্থন তৈরি হয়েছিল, তা যেন অবিরাম এক কর্ডের ওপর আরেক প্রভাবশালী কর্ডের প্রতিস্থাপনমাত্র। এই ধারণাকে স্ত্রাভিনস্কি অন্তঃসারশূন্য মনে করেন; কারণ, তাঁর সময়ে বা চিন্তায় নন্দনতত্ত্বের ধারণাই পাল্টে গেছে। তাঁর শিল্পভাবনা অভিব্যক্তিবাদ থেকে আরও একটু বিশেষায়িত রূপে দেখা হয়। কারণ, অ্যাটোনালিটিতে (বিকেন্দ্রীকরণ অর্থে যাকে স্কেল-এর ডিসেন্ট্রালাইজেশন বলা যেতে পারে) যেখানে সুনির্দিষ্ট স্কেলের কিংবা নির্দিষ্ট কোনো স্বর (Key) অথবা কী-সিগনেচারকে সমর্থন করে না। এমনকি দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত মেজর মাইনরের ব্যবহার অপ্রয়োজনীয় করে তোলে। কারণ, ডায়াটনিক স্কেলে যে স্বর চেনার ক্ষেত্রে টোন ও সেমিটোন-এর গাণিতিক অবস্থান দেখা হয়, অ্যাটোনাল হারমনিতে তা ক্রোমাটিক হয়ে ওঠে। অ্যাটোনাল মিউজিকের কোনো কেন্দ্র বা গ্রহস্বর নেই, অথবা সব স্বরই গ্রহস্বর অর্থাৎ ১২টি স্বরই স্বাধীনভাবে কাজ করে। সে কারণে এই ধরনের সংগীতকে টুয়েলভ নোট পদ্ধতিও বলা হয়। সংগীত রচয়িতা তাহলে এই রীতিকে কীভাবে মিউজিক বানাবেন? সেখানে নিয়ম হলো ১২টি নোটের মধ্যে যেকোনো একটি নোট থেকে যে ধারাক্রম বেছে নেবেন, অন্যস্বর থেকেও একই ধারাক্রম বেছে নিলে প্রতিনিয়ত বদলে যাবে টোনাল হারমনির পূর্ব ধারণা।
স্ত্রাভিনস্কির সংগীতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পারকিউসিভ অর্কেস্ট্রা অর্থাৎ তালবাদ্য দিয়ে হারমনিক মিউজিক তৈরি করা। এ ক্ষেত্রে তিনি পলিরিদমিক বা বহুস্বরিক তালের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, যেখান থেকে ব্যক্তিস্বাধীনতার পাশাপাশি ব্যক্তিপরাধীনতাও সমান্তরালে বাস করে, অর্থাৎ রোমান্টিক যুগে যে অভিব্যক্তিবাদের বিকাশ ঘটেছিল সেখানে বীরত্ব, সাহস, প্রেম, অবসাদ এমনকি স্বেচ্ছাচারের প্রকাশও ঘটেছিল, কিন্তু বিশ শতকের অ্যাটোনাল হারমনিতে এসে ভয়, আতঙ্ক ও গগনবিদারী কান্না এসে ধরা দেয়। এ সময়ের চিত্রকলা-ভাস্কর্যও একই প্রভাবে উত্থিত, অভিব্যক্তিবাদ (এক্সপ্রেশনিজম) ও বিকেন্দ্রীকরণ (অ্যাটোনালিটি) তত্ত্ব নিয়ে ক্রেইগ রাইট বলেন, ‘Its aim was not to depict objects as they are seen but to express strong emotion that the object generated in the artist; not to paint a portrait of an individual but to creat an expression of the subjects innermost feelings, anxieties, and fears.’। সংগীতে বিকেন্দ্রীকৃত অভিব্যক্তিবাদ নিয়ে শোয়েনবার্গের বক্তব্য ‘Art is the cry of despair of those who experience in themselves the fate of all mankind’।
বাংলাদেশের সংগীতে স্ত্রাভিনস্কি এমনকি শোয়েনবার্গ অথবা বিশ শতকের শিল্পদর্শন এখনো এসে ধরা দেয়নি। সংগীতকে প্রভাবিত করার কথাটি দিল্লি বহুদূরের মতো প্রবাদেই আটকে থাকবে, এমনকি অজানাই থেকে গেছে এপথ; যদিও চিত্রকলা, সাহিত্য এবং নাটকে কিঞ্চিৎ পা বাড়ানোর দৃশ্যাবলি চোখে পড়ে। কিন্তু সমাজবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে পৃথিবীর সবাই কমবেশি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাস্তবতা টের পেয়েছে, এবং অজ্ঞাতসারে তাঁদের চিন্তার প্রভাব বিচ্যুত হয়ে নতুন কোনো শিল্পনির্মাণের চেষ্টা প্রায় অসম্ভব। এই মহান সংগীতকার স্ত্রাভিনস্কি ১৯৭১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সৃষ্টির বিপুল ও বৈচিত্র্যের ঐশ্বর্য বাঙালির শিল্পবোধকে ধারণ করবার মধ্য দিয়েই সংগীতের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়োগ শুরু হতে পারে। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ জাগরণে যেমন একদিকে দেশজ শিল্পধারার বিকাশ ঘটাতে হবে, সমান্তরালে বিশ্বসংগীতের স্বরূপকে অনুধাবন করবে, তখনি দেশজ শিল্পভাষা খুঁজে পাবে অগ্রসরমাণতার দিকচিহ্ন।
সংগীত নিয়ে আমাদের দেশের - যাঁদেরকে আমরা সংগীতকার বা সংগীতজ্ঞ বলে থাকি, সংগীতের বিশ্বজনীনতা নিয়ে তাঁরা ভাবেন কি না সন্দেহ আছে। তবে, আমার মনে হয়- " সংগীতকে হতে হবে জ্ঞান" এর কোন বিকল্প নেই। সময়ের সাথে সেই জ্ঞানকে শ্রোতাগ্রাহ্য করতে উপযুক্ত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।সংগীতের বিস্তৃতি তথা জ্ঞানের বিস্তৃতির জন্যে এর সহজীকরণেরও প্রয়োজন্যিয়তা রয়েছে। আমাদের সংগীত নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি গবেষণাকে কার্যকর করার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য বোধকরি আমাদের জনমানস, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখে গীতের সাথে তালযন্ত্রের সমন্বয় আনতে হবে। থিয়েটারের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টির প্রতি খেয়াল রাখা প্রয়োজন। সংগীত নিয়ে আমার কোন পড়াশোনা নেই। নিজের যেটা মনে হল তাই বললাম। তবে আমাদের বাংলাদেশের সংগীত আমাদের জ্ঞানমানসের তথা আমাদের সমাজের মাংগলীক পরিবর্তন আনুক এ আমি আন্তরিকভাবে চাই।
মো: বক্তিয়ার হোসেন
মে ০১, ২০২২ ১৫:০৮