চাকমা ভাষার সিনেমা মাই বাইসাইকেল!

 

মাই বাইসাইকেল, অং রাখাইনের সিনেমা। ট্রেইলার দেখেই দেখার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। তরুণ কোনো নির্মাতার সিনেমা বলে না। চাকমা ভাষার প্রথম কোন সিনেমা বলে। চাকমা ভাষার সিনেমা বলে কেন? শুধু চাকমা না, আরও যারা এ রকম জাতিগোষ্ঠী আছে, যেমন: রাখাইন, মারমা, মুরং ও সাঁওতাল ইত্যাদি, এমনকি বিহারিদের ওপর নির্মিত হলেও আগ্রহ পেতাম। কারণ, বর্তমান বাংলাদেশে কড়া বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে খাঁড়া ঝুলে আছে, তার নিচে দাঁড়ানো সকল জাতিগোষ্ঠীকে অবলম্বন করে আঁকা ছবি, সাহিত্য, সিনেমা-গানই নজরে রাখার মতোন। এ রকম জাতিগোষ্ঠী তাদের নির্মিত শিল্পে আশপাশকে মোকাবিলা করে কীভাবে শ্বাস ফেলছে-নিচ্ছে, তা কতটুক তার, কার মতো, তা গুরুত্বপূর্ণই বটে। তাই এ ছবির প্রিমিয়ারেই দেখার সুযোগ নষ্ট করি নাই। পাবলিক লাইব্রেরি হলের সিনেমা দেখার অনুপযোগী পরিবেশেই সবান্ধবে শামিল হয়েছিলাম। পরে অজ্ঞাত(!) কারণে সিনেমাটি অঘোষিত নিষিদ্ধ হয়ে পড়লে নানাভাবে ছবিটি সুলভ হয়ে পড়ে। তখন আবারও দেখি। তা বেশ আগেই। সেই বেশ আগে দেখার স্মৃতি থেকে আমার এই মাই বাইসাইকেল পাঠ। বলা বাহুল্য, এ পাঠ আপেক্ষিক। সম্ভবত সব রকম পাঠই তাই। কারণ, প্রথমত আমি একজন বাঙালি। তা-ও সমতলের। সমতল না হলেও, যদি পাহাড়িও হতাম, পাহাড়ি বাঙালি, [ভূরাজনৈতিক পরিভাষায় যাদেরকে সেটেলার বলেও ডাকে কোনো কোনো রাজনৈতিক পক্ষ] তাহলেও আলাপটা যাও একটু পাত্তা পেত, এখন তার থেকে মেলা দূরে। আরও একটা সমস্যা আছে, যারা সিনেমাটা দেখেন নাই, তাদের কাছে এ সিনেমার কাহিনিসংক্রান্ত আলাপ, অনেক ক্ষেত্রেই, তা ঝাল-মিষ্টি যা-ই হোক পর-জিভে স্বাদ ভক্ষণ হয়ে যাবে।

ছবিতে কোনো দৃশ্যেই কোনো বাঙালি দৃশ্যমান হয় নাই। পরিচালক যদি বাঙালি শূন্য পাহাড় ইউটোপিয়া থেকে এ রকম ভাবেন, তা একরকম ভালোই। কিন্তু অন্যদিক থেকে তা পাহাড়ে বাঙালি নিয়ে গিয়ে বসানোর যে ঐতিহাসিক রাজনীতি, যেটা সেটেলার সমস্যা বলে খ্যাত, তাকেও আড়াল করে।

মাই বাইসাইকেল রাঙামাটি পার্বত্য অঞ্চলের অপরূপ দৃশ্যপটের দৃশ্যায়ন, ভালো অভিনয় এবং চাকমা জীবনের সহজ প্রতিচ্ছবি। এই চলচ্চিত্রকে দর্শকের নিকট প্রিয় করে তুলেছে। [উইকিপিডিয়ার তথ্য]

বাহ্‌! বেশ সুন্দর ভিজ্যুয়াল! প্রায় প্রতিটি ফ্রেমই সুন্দর। বিশেষ করে সুর্য ডোবার সময়কার যে দৃশ্যগুলো, আপনাকে আটকে ফেলবে। এ দৃশ্যগুলো আপনি ছবির ট্রেলারেও পাবেন। ট্রেলার দেখেই আপনি পুরো ছবিটা দেখার আগ্রহ পাবেন। কিন্তু পুরো ছবি যখন দেখবেন এবং আশঙ্কা করি, আপনি হতাশ হলেও হতে পারেন, যদি আপনি স্রেফ সুন্দর ভিজ্যুয়ালেই আটকে না থাকেন। কারণ, যে লেকের পানিতে নৌকায় ভেসে কমল [ছবির মূল চরিত্র] বাড়ি পৌঁছাচ্ছে, যে লেকের পানির মৃদু মৃদু ঢেউয়ে কমলকমলের সাইকেলের ছায়া কাঁপতেছে, আর তা সুন্দর একটা দৃশ্য হয়ে পর্দায় আমার মতোন দর্শককে আমোদিত করতেছে, মৃদৃ বাহ বাহ করতেছি, তা তো নিছক লেকের পানি না। এ পানি গাঢ় দুঃস্বপ্নের মতো একজন বয়স্ক চাকমা প্রাণের কাছে। বিশেষ করে, যিনি এক রাতেই লেকের পানিতে তার সমস্ত স্বজন ভেসে যাবার সাক্ষী। যার কাছে বিদ্যুৎ গেছে অনির্বচনীয় মৃত্যুর প্রতিদানে লেকের পানি বয়ে, যার কাছে সন্ধ্যায় পাহাড়ে নামা অন্ধকারের রং বিপদের রংও; সে কীভাবে স্বাভাবিক হবে? তার কাছে পাহাড়ে সস্তায় কেনা থামি কি নিছক বাহারি কাপড়? পাহাড় চিরে নেমে আসা ঝরনা কি নিছক সুন্দর ফ্রেম? যেটা ক্যালেন্ডারের নতুন বছরের পাতা ভরাবে? নিশ্চয় নয়। যদি হয়, তবে সে আমার মতোন ট্যুরিস্ট বাঙালি, যে ছুটিতে সাজেক-নীলাচল ঘুরতে যায়, পাহাড় তার কাছে নিতান্তই ঘোরার জায়গা। পাহাড়ের প্রাণ-প্রকৃতি-রক্ত তার কাছে ট্রেকিং-চেক ইনের জায়গামাত্র। আর কিছু না। এ রকমটা হলে মাই বাইসাইকেল দারুণ বিনোদন দেবেই। একটুও অস্বস্তি জাগাবে না। যা মনে হলো, নির্মাতা অংও চাননি আপনাকে এভাবে আমোদিত করতে, এটাও চাননি পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে আপনাকে কোনো রকম অস্বস্তিতে ফেলতে। তিনি শুধু একটা সাইকেলের গল্পই শোনাতে চেয়েছেন। যেটা শহর থেকে বয়ে আনা। পাহাড়ি জায়গা। এখানে সাইকেল কি স্বচ্ছন্দ?

শহর থেকে তার সাইকেল নিয়ে ফেরা কি কমলের বাস্তব জ্ঞানের ঘাটতি? সাইকেল দিয়েও সে কোনোমতে চলতেছিল। তাকে ঘাপলায় ফেলে পাহাড়ি মদতিরা [মাতাল]। যার ইঙ্গিত শুরুতেই পেয়ে যাই আমরা। মদতিরা তার কাছে টাকা চায়। সে দেয় না। আর এ কারণেই কি তারা তার সাইকেল ভেঙে ফেলে? পরিচালক দেখান না বটে, তবে বোঝা যায়। কমল যখন তার ভাঙা সাইকেল সারাতে যাচ্ছে বাইরে, তখন গ্রামে আরেকটা বোটে করে ঢুকতেছে মোটরসাইকেল। এখানে আমার মতোন স্মৃতিপ্রবণ দর্শকের ঋত্বিক ঘটকের অযান্ত্রিক মনে আসতেও পারে। তবে, যা মনে হলো পরিচালক এখানে মদকে গুরুতর সমস্যা হিসেবেই নিয়েছেন। কমল নিজেও মদতি না হলে অন্তত এ সমস্যাটা এড়ানো যেত। অবশ্য একটা দৃশ্যে কিছু বুট ঢুকে পড়ে। তারা কী জন্য আসে? কাউকে খুঁজতে? বোঝা যায় না অত ভালো। হুট করে এ রকম বুট ঢুকে পড়া ছবির কাহিনির সাথে পরম্পরাহীনও লাগে। এ পরম্পরাহীনতা মনে হওয়া কি আমি বাঙালি বলে, এ রকম অভিজ্ঞতায় নাই বলে? পাহাড়ি জীবনে কি এটা খুব স্বাভাবিক দৃশ্য, যে পরিচালকের অচেতনে পরম্পরা দেখানোর চিন্তাই আসে নাই? বলা কঠিন। অই বুটেরা যাবার সময় তারা উঠানের খেলনা মাড়িয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্য। একটু গতানুগতিকও বটে। তবে এ কয়েক সেকেন্ডের খেসারতেই কি আটকে আছে ছবিটা? আমরা জানি না। পরিচালকও বলেছেন, আপত্তিকর কিছুই নেই। আদতেই নাই। কিন্তু যা আছে, কয়েক সেকেন্ড, তা কি এ রাষ্ট্রে তার অপর-এর স্বাধীনতার সীমানা দৃশ্যমান করে দেয়?

এ সীমানা নিশ্চয় অং তার সমস্ত অভিজ্ঞতা দিয়েই জানেন। জানেন বলেই কয়েক সেকেন্ডের বেশি রিস্ক নিতে পারেন নাই। এই জায়গায় একটা কৌতূহল, প্রশ্নও; যদি এ কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপ্তি নানাভাবে কয়েক শ মিনিটে ছড়িয়ে পড়ত, তখন আমাদের [বাঙালি, পাহাড় বা সমতলের] প্রতিক্রিয়া কী হতো? মাই সাইকেল কি পাবলিক লাইব্রেরির অডিটোরিয়াম অব্দি পৌঁছাতে পারত? প্রিমিয়ার শোর গেস্ট হতেন কারা? অতটুক পরিসর কি অংদের জন্য রেখেছি কোথাও? এ পরিসর তো অনেক পরে, কল্পনা চাকমা বা এ রকম আরও যারা যারা, নানানভাবে নিখোঁজ আজকে, তাদের লিস্টিতে যে আরেকজন অং রাখাইনের নাম যুক্ত হতো না, তার নিশ্চয়তা কী? যদি হতো আমরা কী করতাম? একটা মিছিল-মানববন্ধন-কলাম-স্ট্যাটাস বা একটা আর্ট ইভেন্ট? কী হতো তাতে? কিছুই না। তার কারণ, আমাদের প্রতিটি প্রতিক্রিয়ার প্রতিধ্বনি যে কিছুই না তার প্রমাণ আমরাই নানাভাবে দিয়েছি। আর এটা কি অসত্য, এ বাস্তবতা আমাদের নিজ হাতেই তৈরি? তাই একজন অং রাখাইনের সিনেমা ঘোষিত-অঘোষিত নিষেধাজ্ঞায় [সেন্সর শব্দটিকে লিখলে অতিশয় নিরীহ শোনায়] আটকে গেলে তার দায়ভার আমাদেরও, নানাভাবে। সিনেমার আরেকটা লক্ষণীয় বিষয় ছিল বাঙালি-অনুপস্থিতি। ছবিতে কোনো দৃশ্যেই কোনো বাঙালি দৃশ্যমান হয় নাই। পরিচালক যদি বাঙালি শূন্য পাহাড় ইউটোপিয়া থেকে এ রকম ভাবেন, তা একরকম ভালোই। কিন্তু অন্যদিক থেকে তা পাহাড়ে বাঙালি নিয়ে গিয়ে বসানোর যে ঐতিহাসিক রাজনীতি, যেটা সেটেলার সমস্যা বলে খ্যাত, তাকেও আড়াল করে। আর ছবির যে আবহ সংগীত, তা কি চাকমা জীবন-সংস্কৃতি ঘনিষ্ঠ কোনো বাদ্যযন্ত্র নির্মিত? মনে হয়নি। উল্লেখও ছিল না, মিউজিকগুলো কিসের? কিন্তু, ধারণা করি, একটা পাহাড়ি-চাকমা জীবনের গল্প গিটার বা এ রকম কোনো বাদ্যযন্ত্রের চেয়ে তাদের নিজেদের সংস্কৃতির কোনো যন্ত্রেই বেশি মূর্ত হতো।

 

নিজে রাখাইন সম্প্রদায়ের হলেও তিনি চাকমা সম্প্রদায়ের ওপর এ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন; কারণ, তার কাছে মনে হয়েছে, চাকমা সম্প্রদায়ের জীবন-সংগ্রাম আরও বেশি প্রগাঢ়। [উইকিপিডিয়ার তথ্য]

উপরোক্ত র তথ্যটুকু না দিলেও বোঝা যেত, অং রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর। তার নামের সাথেই এ পরিচয় আছে। পার্বত্য এলাকায় এই রাখাইন সম্প্রদায় বাদেও চাকমা, মারমা, মুরং, চাকসহ আরও নানান জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। তার মধ্যে চাকমা জাতিই সবচেয়ে বেশি নগর সম্পৃক্ত, বাঙালি-সংশ্লিষ্টও। ফলে আধুনিক যে শিক্ষাব্যবস্থা, তার সাথে চাকমারাই বেশি সম্পৃক্ত। এসব কারণে তারাই বেশি সচ্ছল। তারা নিজেদের জাতিগত পেশার বাইরেও বাঙালিদের মতো সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পেশায় যুক্ত আছেন। নিশ্চয়ই তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নন। বেশির ভাগ চাকমাই পাহাড়বাসী এখনো। তারপরও তারা অনেকভাবেই অন্যান্য সম্প্রদায়ের চেয়ে এগিয়ে আছেন ধরা যায়। অং রাখাইন, মুরং ইত্যাদি জনগোষ্ঠী থেকে একটা চাকমা পরিবারের সমস্যাকে তুলে আনলেন কেন? পার্বত্য এলাকায় অন্যদের চেয়ে বেশি শিক্ষিত, সচ্ছল চাকমারা অন্য জাতিগোষ্ঠীদের উপর কি হেজিমনি তৈরি করেছে? যার প্রভাব অংয়ের এ সিনেমায়? এ প্রসঙ্গে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চাকমা উপন্যাস চাই প্রবন্ধটা মনে পড়তেছে। তিনি চাকমাদের কাছ থেকে এমন একটি উপন্যাস আশা করেছিলেন যে উপন্যাসের বেশির ভাগ লোক চাকমা, তাদের বাড়ি রাঙামটি কি খাগড়াছড়ি কি সুন্দরবনের কোনো পাহাড়ি জনপদে হোক সমস্যা নাই। কিন্তু উপন্যাসে তাদের বঞ্চনা, অপমান ও প্রতিরোধ এমন মিলেমিশে থাকবে যে একটি থেকে আরেকটি আলাদা করা যাবে না। আমরাও এমনটাই চাই। তবে শুধু চাকমা জীবন নয়, আরও যারা জাতিসত্তা আছে, ছোট-বড় সকলের শ্বাস-প্রশ্বাসই যেন মূর্ত হয়ে উঠুক তাদের সৃষ্টিকর্মে।

এখানে একটা প্রশ্ন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, যিনি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা সম্পর্কে কৌতূহলী ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের প্রতিবাদে শামিল থাকতে চাইতেন সাধ্যমতো; তিনি শুধু চাকমা উপন্যাস চাইলেন কেন? তিনি কি জানতেন না, চাকমাদের পাশাপাশি আরও অনেক জাতিসত্তা পাহাড়ে থাকে। নিশ্চয় জানতেন এবং এ-ও ভাবা নিশ্চয় অমূলক হবে না খুব, চাকমা বলতে উনি মূলত আরও যারা জাতিসত্তা তাদেরকেও বুঝিয়েছেন, সামগ্রিকভাবে। কিন্তু একজন রাখাইন বা চাক লেখক-কবি যদি ইলিয়াসের চাকমা পরিচয়ের নিচে গিয়ে দাঁড়াতে অস্বীকার করেন? তিনি যদি শুধু রাখাইন উপন্যাসই লিখতে চান, বা চাক-উপন্যাস, তবে? মজার ব্যপার হচ্ছে, একজন ইলিয়াস চাকমা বাদেও অন্যান্য জাতিসত্তার অস্তিত্ব সর্ম্পকে ওয়াকিবহাল থাকলেও, গড়পড়তা বাঙালি তা কমই জানেন, তাদের কাছে সকলেই মগ। আর মগ মানেই চাকমা। পার্বত্য এলাকার আর কোনো জাতির অস্তিত্ব এ গড় বাঙালির জ্ঞানে নাই। উল্লেখ্য, মগ হচ্ছে পাহাড়িদের প্রতি গড় বাঙালির বিশেষণ। যারা সাপ-ব্যাঙ সব খায়, যাদের গায়ে দুর্গন্ধ, এবং প্রকৃতিগতভাবে খুব হিংসাপরায়ণ। এ বাস্তবতার অং নিশ্চয় নিজেই ভুক্তভোগী। তাই অংয়ের মাই বাইসাইকেল যদি চাকমা জীবনের বদলে একটা রাখাইন জীবনের বা একটা চাক বা মুরং জীবনের ভাষ্য হতো, তা এই চাকমা হেজিমনির বিপক্ষে যেত। দরকারিই ছিল হয়তো।

নানা দেশের ছবি দেখা মোটেও সমস্যার না। ভালো বটে, তবে এসব ভালো ছবি যেন খারাপ ছবির যেন ক্যাটাগরি তৈরি না করে। খালি ভালো রুচি তৈরি না করে। দুর্ভাগ্য, আমি মাই বাইসাইকেল থেকে বাইসাইকেল থিভস হয়ে ফিল্ম ফোরাম-সোসাইটিতে ঢুকে গেলাম। যেখানে সবখানে খালি অলিভ পাতার সিল-ছাপ্পর। যেখানে সবকিছুই খুব মার্জিত!

পাঠক, এবার সিনেমার নাম-পোস্টার এ রকম কিছু বিষয়ে একটু তাকাতে চাই। প্রথমত ছবির নাম। ছবির নাম মাই বাইসাইকেল। এটা আমাদের ইতোমধ্যে জানা হয়ে গেছে। কিন্তু এ ইংরেজি নামটার সাথে সাথে আরও একটা নাম আছে, চাকমা ভাষায়র থেংগারি। যেটা ইংরেজি নামটার আড়ালে ঢাকা পড়েছে কিছুটা। কিন্তু এই চাকমা নামটিকেই আমার ভাষার রাজনৈতিক দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। যেটা ভালো হয়েছে, চাকমা ভাষার সিনেমায় বাংলা নাম না থাকাতে। কিন্তু আরও ভালো হতো, ছবির চাকমা নামটিই মূল ফোকাস পেলে। আরেকটা দিক যেটা, ছবির মাই বাইসাইকেল নামটা প্রথম পাঠেই আমাকে বাইসাইকেল থিভস সিনেমার নামের দিকে নিয়ে গেছে। [এটা কি শুধু আমার হয়েছে?] আর অবচেতনে বাইসাইকেল থিভস-এর সাথে সাথে মাথায় ইতালীয় ফিল্ম মুভমেন্ট, নিও-ওয়েভ ইত্যাদি ভারী ভারী জিনিসও ঢুকে পড়েছে। এ মনে আসাটা সমস্যার না নিশ্চয়। সমস্যা যেটা, এই মনে আসার প্রক্রিয়াটা, মানে যে পদ্ধতিতে আমরা এসব টার্মের সাথে পরিচিত হই। আমার ধারণা, এই পরিচিত হবার পদ্ধতিটাতে কিছুটা অন্তত রুচি-শাসন আছে। রুচি-শাসন বলতে, আমরা যেসব ফিল্ম ফোরাম-সোসাইটির সাথে যুক্ত হই, তাদের রুচিমাফিক তাবত সিনেমাই মোটামুটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে ভালো সিনেমা; যেগুলো দেশ-বিদেশের বড় বড় পরিচালকের তৈরি, যাদের নাম আমরা হামেশা শুনি। আর দ্বিতীয় ভাগে, এফডিসি বা হিন্দি-তামিল-তেলেগু ইত্যাদি ছবি; যাদের দর্শক মূলত শ্রমজীবী মানুষজন। রিকশাঅলা-মজুররা। যাদের রুচি বলতেই নাই। যারা খারাপ-খারাপ সিনেমা দেখে। [এ খারাপ সিনেমার উপর একদা এ দেশের সকল মেইনস্ট্রিম মিডিয়া থেকে শুরু করে নানাবিধ মহল সোচ্চার হয়েছিল, এত অশ্লীল সব সিনেমা চলে, সিনেমা হলেই আর যাওয়ার পরিবেশই নাই; এ অজুহাতে। এমনকি কোনো কোনো বাম দলের এসব খারাপ সিনেমার খারাপ পোস্টারে কাদা মেখে দেওয়ার ঘটনাও আছে, প্রতিবাদী কমসূচি হিসাবে] আর যাবতীয় ভালো ভালো সিনেমা দিয়ে দেশের সিনেমা এবং সমাজের মানবিকতাকে রক্ষা করেন ফিল্ম ফোরাম-সোসাইটিঅলারা, যেগুলার শো হয় পাবলিক লাইব্রেরি-শিল্পকলা-দূতাবাসগুলোতে!

নানা দেশের ছবি দেখা মোটেও সমস্যার না। ভালো বটে, তবে এসব ভালো ছবি যেন খারাপ ছবির যেন ক্যাটাগরি তৈরি না করে। খালি ভালো রুচি তৈরি না করে। দুর্ভাগ্য, আমি মাই বাইসাইকেল থেকে বাইসাইকেল থিভস হয়ে ফিল্ম ফোরাম-সোসাইটিতে ঢুকে গেলাম। যেখানে সবখানে খালি অলিভ পাতার সিল-ছাপ্পর। যেখানে সবকিছুই খুব মার্জিত! মনে হলো, এই মার্জিত রুচি মাই বাইসাইকেল-এর সবখানে প্রকাশিত। কি ফিল্ম, ফিল্মের পোস্টার, পোস্টারের ভাষাসবখানেই। এটাও না, সবার জন্যই সিনেমা বানাতে হবে। এক-দুজনের জন্যও পরিচালক চাইলে সিনেমা বানাবেন, তবে এসব সিনেমা, সিনেমা ভোক্তাদের রুচি যেন রুচি শাসন জারি না করে। এই সিনেমা আলোচনার সুযোগে এ লেখার পাঠকের প্রতি কিছু সম্পূরক প্রশ্ন: আমাদের তথাকথিত বিকল্প ছবি আমাদের জনসংস্কৃতি থেকে নিতে এত দ্বিধায় ভোগে কেন? আর নেওয়া মানে তারা খালি পূর্বনির্ধারিত কয়েকটা লালন গান-রবীন্দ্রসংগীত বোঝে কেন? বা ছবিতে গান না থাকা দিয়ে ছবিকে ভালো হতে হবে কেন? ইউরোপের ছবির গান না থাকার চর্চা আমাদের এখানেও চালু করতে হবে কেন? আর এত এত যেসব ভালো-বাস্তবসম্মত ছবি তৈরি হচ্ছে, এত এত ভালো-বাস্তবসম্মত সিনেমার ভালোত্ব মাপার গজফিতা কই থাকে, কারা মাপে? আখেরে কী হয় এত সব ভালো-বাস্তবসম্মত সিনেমা দিয়ে?

সিনেমায়ও তো এক-আধটু নৈরাজ্য দরকার। তাই না?