সাংস্কৃতিক উন্নয়ন কোথায়?


আধুনিক জ্ঞানচর্চায় সংস্কৃতিকে এমন এক পর্যায়ে চিন্তা করা হয়, যা জাতীয় হয়েও বহুজাতিক আকর্ষণের বস্তু হতে হবে। বহির্বিশ্বের সৌন্দর্য পিপাসু মানুষের জন্য তা আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে; পরিবেশনা শিল্পকলা হোক বা প্রাকৃতিক চিকিৎসা হোক, অথবা লোক ক্রীড়া যাই হোক না কেন, তা জ্ঞান রশ্মি ছড়াবে অন্দরে-বাহিরে সর্বত্র। এজন্য প্রথমে ভাবতে হবে ভিনদেশের বা ভিন্নভাষার মানুষের কাছে সেই উপাদান কী উপায়ে সমঝদারিত্ব অর্জন করবে। এমনকি তা সম্পৃক্ততামূলক এবং কখনো কখনো অংশগ্রহণমূলক হয়ে উঠবে কী প্রক্রিয়ায়? বিষয়টি খুব কঠিন কারণ এই ধরনের পদক্ষেপে প্রত্যেক ঐতিহ্যিক শিল্প তার স্বকীয়তা থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু উন্নত বিশ্বে দীর্ঘদিনের পরিচর্যার মাধ্যমে এমন কিছু উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে ধারণা গ্রহণ করে অন্য দেশও আলোকিত হতে পারে। সেই ধরনের দু-একটি দৃষ্টান্ত দিতে চাই।

পরিবেশনা শিল্পের ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার জাঙ্গু বাদনের কথা বলা যেতে পারে। প্রতিবছর ন্যাশনাল গুগাক [ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা] সেন্টার বিদেশি অতিথিদের নিয়ে আধা মাসের জন্য একটি কর্মশালা করে থাকে। সেখানে বিশ্বের সেরা সেরা মিউজিক কম্পোজারকে আমন্ত্রণ জানানো এবং বৃত্তি প্রদান করা হয়। কালচারাল পার্টনারশিপ ইনিশিয়েটিভ সিপিআই শিরোনামে কোরিয়ান সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয় প্রায় প্রত্যেক সেক্টরে এই প্রকল্প পালন করে আসছে। ২০১৫ সালে আমার সেই কর্মশালায় অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। প্রশিক্ষণের বৈশিষ্ট্য হলো—যে কোনো একটি ঐতিহ্যবাহী কোরিয়ান বাদ্য নির্বাচন করা ও তা প্রশিক্ষকের মাধ্যমে শেখা। একটি মিউজিক কম্পোজিশন নির্মাণ করে তা কোরিয়ান শিল্পীদের দিয়ে নির্দেশনা প্রদান ও মঞ্চ পরিবেশনা। আর কোরিয়ান বাদ্য নিয়ে বিদেশিদের সমবেত বাদন পরিবেশনা। সব মিলিয়ে দিনরাত ধরে প্রচণ্ড অনুশীলন, চিন্তা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অফুরন্ত আনন্দময় যাত্রা ছিল। প্রতিবছর অন্ততপক্ষে ৫০ জন বিশ্বসঙ্গীতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির মাধ্যমে সারা বিশ্বে কোরিয়ান সঙ্গীত পরিচিত হয়ে উঠছে, অন্যদিকে বিশ্বসঙ্গীতের বিচিত্র আইডিয়া তারা নিজেদের সঙ্গীতে যুক্ত করে চলেছে। সবচেয়ে বড় যে ঘটনা, কোরিয়ান সঙ্গীতকার ও শিল্পীদের সাথে বহির্বিশ্বের সঙ্গীত শিল্পীদের নিবিড় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে চলেছে নিয়মিত।

আরেকটি দৃষ্টান্ত হিসেবে থাইদের রামায়ণ নৃত্যনাট্যের কথা বলি। ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে তাদের প্রাচীন ঐতিহাসিক মেলবন্ধন রয়েছে। তবে আধুনিককালে দক্ষতা, নান্দনিকতা ও পোশাক-পরিচ্ছদের ঐশ্বর্য দিয়ে তারা এমন এক স্বতন্ত্র পরিবেশনারীতি তৈরি করেছে যে, তা থাইদের আত্মীকৃত হয়ে গেছে, রামায়ণের মহাকাব্যিক প্রাচীন যুদ্ধক্ষেত্র যেন দর্শক সরাসরি মঞ্চে থেকে দেখতে পাচ্ছে। রামায়ণ পড়া ব্যক্তি বা না-পড়া অন্য যে-কোনো দেশের দর্শক কারও পক্ষেই তাদের উপস্থাপনের অর্থ বুঝতে অসুবিধা হয় না। ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ব্যাংককের চুলালংকর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ দিনের কর্মশালায় অংশগ্রহণ করি। সেখানে আমাদের নিজেদের পরিবেশনা ছিল ‘বৃহৎ ব-দ্বীপের নদীমাতৃক সঙ্গীত’। আমাদের দলের বাদ্য ব্যবহার ছিল তুলনামূলক বেশি এবং আকষর্ণীয়, কিন্তু নৃত্য ছিল না। অন্যদেশের সবাইকে মুভমেন্ট-এর মাধ্যমে অনেক বেশি ভাব প্রকাশ করতে দেখা গেল। সবচেয়ে বড় আনন্দ হয়েছিল লোক ক্রীড়ায় অংশগ্রহণের সময়। তখন আগমনকারী সকল দেশের সকল সদস্যের জড়তা কিংবা দ্বিধা এক ঘণ্টার অনুশীলনের মধ্যদিয়ে কেটে গেল। আটটির মতো দেশ এই কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছিল, কিন্তু চারদিন ধরে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে একে অপরের সাথে বন্ধুত্বের সৌহার্দ্য প্রদর্শন করে অনেকগুলো ইভেন্টে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। অদ্ভুত সব থাই লোক ও এথনিক বাদ্য নিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা শিখতে শুরু করলো থাই প্রশিক্ষকের কাছে। শেষদিনে সবাই মিলে একটি থাই অর্কেস্ট্রায় বাদ্যশিল্পীর ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হলাম, তাদের অর্কেষ্ট্রায় আমাদের অংশগ্রহণের সময় থাই পোশাক ও মেকআপের কারণে আমাদের কাউকেই বাঙালি মনে হচ্ছিল না। নানান দেশের মানুষ কিছুক্ষণের জন্য যেন থাই হয়ে গিয়েছিল ।

এই লোকশিল্প কিংবা নাট্য যে-অঞ্চল থেকে এসেছে, সেখানে নিশ্চয় এতটা জাকজমকপূর্ণ নয়। সেই সকল পরিবেশনায় সভ্যতার বিবর্তনের আলো হয়তো এখনো পৌঁছেনি এবং দীর্ঘকাল ধরে একই ধরনের স্টাইল বহন করে চলেছে তারা। বাংলাদেশেও এই ধরনের অসংখ্য নমুনা রয়েছে, মারমা, চাক, ম্রো প্রভৃতি আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক জীবন। সারা বাংলায় অজস্র ইউনিক চরিত্র আছে যেমন পালাকার, কীর্তনীয়া, বয়াতি, বাউল। এরা প্রত্যেকেই নিজস্ব একটা চারিত্রিক প্রতিনিধি হয়ে বংশপরম্পরায় বাহিত হয়ে চলেছে। কিন্তু থাইল্যান্ডের এবং কোরিয়ার মতো উদাহরণ এদেশে বিরল, তারা লোকাল কাঠামোকে জাতীয় কাঠামোয় রূপান্তর ঘটিয়েছে। আবার ভুটানের বৌদ্ধিক মুখোশ নৃত্যকে শহুরে বা গ্রামীণ বলে আলাদা করা যাবে না। সুদীর্ঘকাল ধরে সমগ্র জনপদে তারা একই ধরনের পরিবেশনারীতি বহন করে আসছে। তাদের এই অতুলনীয় সামষ্টিক লোকশিল্প বিদেশি পর্যটকের কাছেও ভীষণ আগ্রহের বস্তু হয়ে রয়েছে। পক্ষান্তরে, বাংলার অতুলনীয় লোকশিল্প নিয়ে পর্যটকদের জন্য কোনো আকর্ষণীয়তার গল্পই বলার সময় এখনো আসেনি; বিদেশিদের সম্পৃক্তি ও অনুশীলন তো পরের কথা। বাংলার নগর জীবনে এমন কোনো দলের দেখা এখনো মেলেনি যারা হাজার বছরের প্রাচীন সংস্কৃতিকে বা তার ঐতিহ্যকে উন্মোচন করে চলেছে। অভিনেতা বা শিল্পী ইতিহাসের একেকটা চরিত্র হয়ে ঘুরে বেড়ায়। দক্ষিণ কোরিয়ার জাঙ্গুর মত এদেশেও ঢোল-ঢাক বা মৃদঙ্গ-মাদলের দল তৈরি হতে পারত। ঐতিহাসিক চরিত্রসমূহ দেখেই সাধারণ মানুষ জেনে যেতে পারত স্বদেশভূমির ঐশ্বর্যের ইতিকথা। 

টোকিওর ট্রেন স্টেশনে পেরুলিয়ানদের প্যান-বাঁশি বাদন দেখে মনে হয়েছে স্ট্রিটের ওই অংশটুকু যেন একটুকরো পেরু, কিংবা লুবলিয়ানা শহরের প্রাণকেন্দ্রে এক কালো যুবকের ডিজাম্বে বাদন দেখে আফ্রিকার চিত্র ভেসে উঠেছে, বার্লিন শহরের ব্রান্ডেনবুর্গ স্কয়ারে ব্রাজিলিয়ানদের এ্যাক্রেবেটিক অর্কেস্ট্রা মিউজিক দর্শকদেরকে কিছুক্ষণের জন্য ল্যাটিন আমেরিকার শারীরিক ভঙ্গির ভেতর ডুবিয়ে রেখেছিল। এসব দেখে মনে হয়েছে, পৃথিবীর প্রত্যেকেই যাযাবর এবং যে যেখানেই অবস্থান করুক না কেন, সে তার জাতিসত্তাকেই বহন করে চলেছে। মানব জনমের এই সিল-ছাপ্পর মেরে দেয়া বৈশিষ্ট্য থেকে কেউ বেরিয়ে আসতে পারে না। ফলে যে তার জাতিসত্তার পরিচয় যথার্থ অর্থ নিয়ে বহন করতে পারে না, সে তলিয়ে যায়—বিলীন হয়ে যায়। আমাদের প্রিয় বাংলায়ও জাতিসত্তার পরিচয়ধারী অনেক অজস্র আঙ্গিক ও চরিত্র রয়েছে। একজন কবিয়াল বা পালাকার, একজন বয়াতি বা ভেল্কিবাজ যাদুকর, নাটকের ছুকরি, পূজার ঢাকি, কৃষ্ণের ঘেটু এরকম অসংখ্য চরিত্র রয়েছে যারা ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে বহন করে চলেছে গুরু-পরম্পরায়। সেই চরিত্রকে পূর্ণতা দিয়ে উন্মোচন করার মাঝেই রয়েছে সার্থকতা। 

মনে পড়ে ভুটানে সার্ক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেখানে আমরা যেমন শ্রীলংকানদের তালবাদ্য থাম্মাত্থামা, মৃদঙ্গম, বেংকু রাবানা, উদেক্কিয়া ইত্যাদি বাদ্য বাদন দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। আবার একইভাবে আমাদের দশরথ দার একক ঢোল বাদন দেখেও অন্যরা বিস্ময় প্রকাশ করেছিল। শ্রীলংকান বাদ্যও বাংলার প্রচলিত বাদ্যের মতোই। কিন্তু ন্যাশনাল একাডেমির পৃষ্ঠপোষকতায় তারা এমন এক জাঁকজমকপূর্ণ সমবেত পরিবেশনা শৈলী তৈরি করেছে, যার সৌন্দর্যবোধ ও দক্ষতা দেখে যেকোনো পর্যটকের বিস্মিত হবে।

উন্নয়নশীল ও উন্নত রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত উন্নতির পেছনে যে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সংস্কৃতিচর্চার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় তা সুদূরপ্রসারী হতে হবে। কোনো উন্নয়নই স্থিতিশীলতা পাবে না, যদি না তাকে একটি সাংস্কৃতিক বলয়ের আচ্ছাদনে আবরণশীল করা হয়। তারপর উদ্দীপনা ও পৃষ্টপোষকতার প্রসঙ্গ আসে। সাংস্কৃতিক পরিকল্পনা ও তা পরিচর্যার জন্য সর্বাগ্রে দরকার নিবিড় কার্যকরী নকশা। যারা উন্নয়নের সাথে সংস্কৃতির সুষম মেলবন্ধন ঘটাতে পারেনি, তারা তাদের উন্নতি ও ঐশ্বর্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি। যে সকল দেশ সম্রাট ও সাম্রাজ্যেও ভেতর দিয়ে জাতি, ভাষা ও মননশীলতার বিকাশ ঘটিয়েছে, তাদের সভ্যতাজাত চরিত্রকে গৌরবের বা ঐশ্বর্যের স্মারক হিসেবে ধারণ করে রাখতে দেখা যায়। বাংলাদেশেরও বিভিন্ন ডাইন্যাস্টিতে অনেক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রয়েছে, কিন্তু তারা পরদেশি হওয়ার কারণে এবং ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদিতার ফলে বাঙালিরা স্বীয় পূর্বজ হিসেবে স্মরণ করতে চায়নি। সংস্কৃতির সেবকেরাও হার্দিকভাবে সেইসময়ের অগ্রগামীধারাকে গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে দেশের প্রান্তিক শোষিত জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধ কিংবা স্বাধীনতা উন্মুখতার ভাষা ও সংস্কৃতিই শেষ পর্যন্ত আদরণীয় হয়েছে। একারণে এখানকার পরিবেশনাশৈলীতে ঐশ্বর্যের ছাপ কম এমনকি কিছুটা মলিনও। কিন্তু যাদের ঐশ্বর্যময় পরিবেশনা রয়েছে, তাদের আবার এইরকম প্রতিরোধ কিংবা গভীর জীবন-দর্শনমূলক অথবা উচ্চ-সাহিত্যনির্ভর প্রতীকী পরিবেশনাশৈলী কম। বাঙালির বাউলগান, কবিগান, জারিগান যে তাত্ত্বিক উচ্চতার স্মারক বহন করে তা অন্যত্র বিরল। এদেশে দাসত্বের গৌরব বন্দনার গীত নেই। এখানে পাওয়া যায় আত্মশক্তি, বিবেক কিংবা একাকিত্বের মাঝেও অটলভাবে টিকে থাকার স্তুতি। ঐশ্বর্য ও অভিজাত শিল্পকলাও সমান্তরালে প্রবাহিত হয়েছে, কিন্তু তা লোক-প্রান্তিক শিল্পকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। বিশেষ করে দরবারি সঙ্গীত, খেয়াল ধ্রুপদ প্রভৃতির ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য।

তবে প্রত্যেক ডাইন্যাস্টির যে নিজস্ব একটা সাংস্কৃতিক রূপরেখা ছিল, বিশেষ করে পাল আমল, সেন আমল, মুঘল আমল, ব্রিটিশ আমল, পাক আমল, এমনকি এসবের আগেও বৈদিক, গান্ধর্ব, মৌর্য, গুপ্ত, আলোকজান্ডারের আমলের সঙ্গীত ও সাংস্কৃতিক রূপরেখা কেমন ছিল তার সুস্পষ্ট সাংস্কৃতিক বিভাজন ও বৈশিষ্ট্যকে নিরূপণ করে তার সুচারু পর্যবেক্ষণমূলক পরিবেশনাশৈলী তৈরি হতে পারত বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশে। একটি স্বাধীন দেশের পক্ষে উন্নয়নমূলক পদক্ষেপে এই পরিকল্পনাকে ধীরে বাস্তবায়ন করাটাও অমূলক নয়। একটি প্রাচীন ভাষাভিত্তিক জাতির আত্মপরিচয়ের ইতিহাস কখনো একশ-দুশ বছরের ইতিহাস পরিচর্যার মধ্যে আটকে থাকতে পারে না। এদেশে প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন খুব কম। তা সত্ত্বেও প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ও ফলক অতীতের ইতিহাসকে শনাক্ত করতে যথেষ্ট পরিমাণে সহায়ক। তাছাড়া এদেশের আদিবাসী সংবস্কৃতির একটি বিপুল সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র রয়েছে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে প্রথমত লোকবাদ্য ও সঙ্গীত, দ্বিতীয়ত ঐতিহাসিক দরবারি সঙ্গীত, তৃতীয়ত আধুনিক জনপ্রিয় ধারার সঙ্গীত [পাশ্চাত্যসহ] এবং পরিশেষে আদিবাসী সঙ্গীতকে ছকে বিন্যস্ত করে মন্ত্রণালয় ও জাতীয় পর্যায়ে শিল্পকলা একাডেমিসমূহ পরিবেশনার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এইরূপ পরিকল্পিত গবেষণা ও পরিবেশনাশৈলী জাপান, চীন, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশে সুচারুরূপে উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করে চলেছে। 

প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন খুব কম থাকলেও দুই-তিন দশক আগে পুরোনো ঢাকার অলিগলি জুড়ে শতবর্ষী অনেক স্থাপত্য ছিল, তার নকশা কিংবা কাঠামোগত বিন্যাস, সরু সরু অজস্র গলি দেখে মনে হতো পুরোনো শহর হিসেবে এখানে বণিকশ্রেণি, রাজন্যবর্গ ও প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং ধার্মিক ও পতিতা সব ধরনের কম্যুনিটি গড়ে উঠেছিল। এই ধরনের পুরোনো শহর যেসব দেশে আছে, তারা খুব যত্নের সাথে সংরক্ষণ করেছে। আর যাই হোক পুরোনো শহরের অবকাঠামোকে তারা বিকৃত করতে দেয়নি। কিন্তু ঢাকা তার ৪০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যের চিহ্নগুলোকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস ও বিকৃত করে চলেছে। চীনের ফরবিডেন সিটিতে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের আগমন ঘটে। সুপরিকল্পিত নগরায়ণের কথা ভাবলে এখনো কিঞ্চিত যেটুকু নিদর্শন রয়েছে তা রক্ষার জন্য তৎপর হওয়া আবশ্যক।    

এদেশে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব রয়েছে, যা ঐতিহাসিক অগ্রযাত্রাকে অনেকটা স্থরিব করে রেখেছে। প্রথমদিকে ধর্মান্তরিত মুসলমান সমাজের ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা ভারতবর্ষের শিল্পচর্চায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। বাংলাদেশের জারিগান, কবিগান, পালা বা কিচ্ছাগানে তার প্রতিফলন দৃশ্যমান। আবার পরবর্তীতে কিছু রূপান্তরিত মুসলমান সমাজ ধীরে ধীরে সেই ধারাবাহিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অথচ ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে এই ধরনের পক্ষ-বিপক্ষ যাই থাকুক না কেন, মধ্যপ্রাচ্যের উন্নত রাষ্ট্রে পর্যটনশিল্পকে মূল্যায়ন করতে চেয়ে তারা উপাসনালয়কে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। জাতীয়তাবাদের বিকাশ মানে হল আত্মকেন্দ্রিকতার উর্ধ্বে থেকে পৃথিবীর সমগ্র জাতিসত্তার মুখোমুখি দাঁড়ানোর চেষ্টা। দেখা যাচ্ছে ইউরোপের গীর্জাসমূহ, এশিয়ায় মন্দির-মাজার, মধ্যপ্রাচ্যের মসজিদ পর্যন্ত পর্যটনশিল্পের আওতায় এনে সব ধর্মের মানুষের জন্য দর্শনীয় স্থানে রূপান্তর করা হয়েছে। বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধমন্দিরগুলো পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত। একইসাথে ভারত-নেপাল-ভুটানে অধিকাংশ হিন্দু মন্দির, পীর-আউলিয়ার মাজার সবার জন্য অনুমোদিত। ইউরোপের গীর্জায় সকলের প্রবেশাধিকারই উদার ও সম্প্রীতিমূলক ধর্মীয় সংস্কৃতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রায় সকল উপাসনাস্থল পর্যটকদের জন্য অনুপোযোগী [আখড়া ও মাজার ব্যতীত]। অথচ আরবে পবিত্র কাবা শরীফ থেকে শুরু করে তুরস্ক, ইয়েমেন, কাতার, আবুধাবি সকল দেশেই উপাসনাস্থলকে নান্দনিক ও দর্শনীয় করে সৃষ্টি করা হয়েছে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য। যেকোনো দেশের পর্যটকদের জন্য ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা-স্মারক পাওয়া যায়, যা সে দেশের আত্মপরিচয়কে বহন করে।

বাংলাদেশে তেমন কোনো ক্রাফট, আর্ট, খাদ্য বা বাদ্য মেলে কি, যা পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়! যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক থেকে অস্ট্রিয়া, জার্মান, চীন প্রভৃতি দেশ অনুসরণযোগ্য। যেমন, অস্ট্রিয়াতে দেখেছি পাঁচশো টাকায় সারাদিন ভিয়েনার যেখানে খুশি সেখানে ঘোরা যায়। আবার কোরিয়াতে দর্শনীয় স্থানকে সুলভ, এমনকি বিনে পয়সায়, পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাদ্যের দিক থেকে জাপান অনুসরণীয়। কারণ, এসকল দেশ সবকিছুর সাথে টুরিজমকে বিবেচনা করে দেখে।প্রতিবছর সারা বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক বিনিময় হয়ে থাকে। সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বও থাকে। কিন্তু তারা কী পরিবেশন করে, তা কি আদৌ বিদেশি জাতিসত্তার মানুষের কাছে আকর্ষণীয় বা আগ্রহের বস্তু হয়ে ওঠে? তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। আমার ডজনখানেক দেশের সাংস্কৃতিক পরিকল্পনার ছিটেফোঁটা ধারণা থেকে মনে হয়েছে, প্রত্যেকে তাদের সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে যে-ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে, এদেশে তার কোনো নিদর্শন চোখে পড়ে না। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে দস্তখত করেছে, কিন্তু এই পর্যায়ে একটি রাষ্ট্রের কী ধরনের বোঝাপড়ার মধ্যদিয়ে এগোতে হবে, সাংস্কৃতিক পথরেখা নির্মাণে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, তার সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা থাকা দরকার। তা না হলে উন্নয়নশীলতার ধারাবাহিকতা স্থবির হয়ে পড়বে।