ঔপনিবেশিক পরিস্থিতি ও উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য-পাঠ
পোস্ট-কলোনিয়াল পরিস্থিতি বুঝতে হলে প্রথমে কলোনিয়লিজমের চিত্র ও চারিত্র্য, স্বরূপ সস্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। ষোল-সতেরো শতকে ইউরোপীয় শক্তি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও দেশ দখল করে উপনিবেশ স্থাপন করে। ইউরোপীয় শক্তির বহুমাত্রিক আগ্রাসন ও আধিপাত্যের ফলে অধঃপতিত হয় উপনিবেশিতের [Coloniæed] নিজস্ব সমাজ, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। উপনিবেশ তৈরির প্রধান উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক। এই অর্থনৈতিক স্বার্থকে নেপথ্যে রেখে তারা স্বার্থসংশ্লিষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা [মিশনারি প্রতিষ্ঠা, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠা ১৮০০] প্রাচ্যতত্ত্বচর্চা শুরু করে। প্রাচ্যতত্ত্বচর্চা বা ওরিয়েন্টালিজম পশ্চিমের একটি প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানপ্রকল্প। এই জ্ঞানচর্চার সঙ্গে ক্ষমতা ও সাম্রাজ্যবাদ, বিদ্যার সঙ্গে উপনিবেশিকায়নের [Coloniæed] কর্তৃত্ব সুদৃঢ় হয়। তারা তৈরি করে প্রচুর ওরিয়েন্টালিস্ট, গড়ে তোলে ‘সোসাইটি এশিয়া’ [১৮২২], রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটি [১৮২৩] আমরিকান ওরিয়েন্টাল সোসাইটি [১৮৪২] ইত্যাদি সংস্থা। বিভিন্ন পর্যটক ও তাদের ভ্রমণ বিবরণগুলোও ওরিয়েন্টবিষয়ক ধারণা তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ আরও সুদৃঢ় এবং দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য তারা খ্রিস্টধর্মকেও উপযুক্তভাবে কাজে লাগায়, গড়ে তোলা ‘সোসাইটি ফর প্রোমোটিং ক্রিশ্চান নলেজ [১৭০১], ব্যাপটিস্ট মিশনারি সোসাইটি [১৭৭২], চার্চ মিশনারি সোসাইটি [১৭৯৯], ব্রিটিশ অ্যান্ড ফরেন বাইবেল সোসাইটি [১৮০৪]—এসব সংস্থা ইউরোপীয় সাম্রাজ্য সম্প্রসারণে সরাসরি ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ ওরিয়েন্টালিজম হচ্ছে এমন একটা প্রবেশপথ, যে প্রবেশপথ দিয়ে ইউরোপীয়রা সমস্ত প্রাচ্যে ঢুকে পড়ে এবং দখল করে নেয়। শধু অর্থনৈতিক স্বার্থ নয়, ভারতবর্ষের কাঁচামাল ও নীল চাষের পাশাপশি কিছু মানুষের মষ্তিস্কও চাষ করে ফেলে ইংরেজরা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম ইউরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল। ইয়ুরোপীয় জাতির স্বভাবগত সভ্যতার প্রতি বিশ্বাস ক্রমে কী করে হারায়ে গেল, তারই এই শোচনীয় ইতিহাস আজ আমাকে জানাতে হল।...ইংরেজ শাসনের দ্বারা সর্বতোভাবে অধিকৃত ও অভিভূত ভারত...এই বিদেশীয় সভ্যতা, যদি একে সভ্যতা বলো, আমাদের কী অপহরণ করেছেস যাকে নাম দিয়েছে Law and order বিধি এবং ব্যবস্থা, যা সম্পূর্ণ বাইরের জিনিস, যা দারোয়ানি মাত্র। পাশ্চাত্য জাতির সভ্যতা অভিমানের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা অসাধ্য হয়েছে। সে তার শক্তিরূপ আমাদের দেখিয়েছে, মুক্তিরূপ দেখাতে পারেনি।’
ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতি শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথ আস্থা হারিয়েছেন। ইউরোপীয় ওরিয়েন্টালিস্ট ও ভ্রমণবেত্তারা এই ধারণা বদ্ধমূল করে তুলেছেন যে, পশ্চিম থেকে প্রাচ্য কত ভিন্ন—বেগানা, উদ্ভট। এভাবে ঔপনিবেশিক শক্তি নিজেদেরকে ‘সেলফ্’ এবং আমাদেরকে ‘আদার’ বা অন্য হিসেবে ধরে নিয়ে নিকৃষ্ট, হীন বলে চিত্রিত করেছে।
উত্তর-উপনিবেশবাদী চিন্তার একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো প্রথমে ঔপনিবেশিক পরিস্থিতি শনাক্ত করা। স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে শুরু করে গণমানুষের জীবন পর্যন্ত কীভাবে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি, মোটিভ, বিভিন্ন উপাদান অক্ষুণ্ন থেকে যায়, তা যাচাই করাও উত্তর উপনিবেশবাদের একটা কাজ। নিজ সংস্কৃতি নিয়ে স্থানীয়রা যেন হীনম্মন্যতায় না ভোগে এবং আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি ও মমত্ব সৃষ্টিই উত্তর উপনিবেশবাদের প্রধান লক্ষ্য
উপনিবেশায়ন[coloniayation]-এর আরেকটি মানদণ্ড হচ্ছে ‘কেন্দ্র’ ও ‘প্রান্ত’ ধারণা। এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর ওরিয়েন্টালিজম [১৯৯৫] গ্রন্থে পশ্চিমের বহু গুরুত্বপূর্ণ রচনা ঘেঁটে দেখান যে, কীভাবে ঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চা ঔপনিবেশিকতার ভাষা-সংস্কৃতি ও বাস্তবতাকে বিকৃত করে, এমনকি মুছে ফেলে, আর এর মধ্য দিয়েই ঔপনিবেশিকদের চিহ্নিত করে নিকৃষ্ট, বর্বর, অসভ্য, হীন এবং আদার বা অন্য রূপে। উপনিবেশ তার শিক্ষাব্যবস্থা ও জ্ঞানচর্চার মধ্যে এমন প্রভাব ফেলে যে, ঔপনিবেশিকদের মধ্যে এমন হীনম্মন্যতাবোধের জন্ম দেয়, সে নিজেকে নিকৃষ্ট ভাবতে শুরু করে এবং বিপরীতে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীকে নিজেদের তুলনায় উৎকৃষ্ট, উন্নত, সভ্য বলে চিন্তা করে। নিজকে খাটো করে দেখতে গিয়ে দেশীয় সংস্কৃতির শিকড় থেকে সে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওরিয়েন্টালিজম এভাবে কলোনিয়ালিজমে রূপান্তরিত হয়। ওরিয়েন্টালিজম হয়ে উঠেছে বিদ্যাপ্রধান আর প্রাচ্য দুর্বল ও অধস্তন, নিকৃষ্ট আদার বা ‘অন্য’ রূপ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশগুলো স্বাধীন হলেও দেশগুলোর শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতি এমনকি চিন্তাগত দিক থেকে উপনিবেশী প্রভাব মুক্ত হতে পারেনি। উত্তর-উপনিবেশবাদ [post colonialism] বা উত্তর ঔপনিবেশিক অধ্যয়ন [post colonial studz] হচ্ছে পশ্চিমা ওই একতরফা জ্ঞান-শৃঙ্খলার আধিপত্যকে অস্বীকার করা, তার বিপরীতে এককালের উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর নিজস্ব স্বর ও ভঙ্গিমা, সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অনুসন্ধান করা। উত্তর-উপনিবেশবাদ যাচাই করতে চায় তার অন্তরে বাহিরে উপনিবেশের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও ধরন। শুধু তা-ই নয়, এখন বিশ্বায়নের নামে অর্থ-সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মাধ্যমে যে নয়া উপনিবেশায়ন [New-coloniayation] চলছে পৃথিবীজুড়ে, তাকেও জিজ্ঞাসা চিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে উত্তর খুঁজতে চায়। উত্তর-ঔপনিবেশিক ভাবুক আলবার্ট মেমির দি কলোনাইজার অ্যান্ড দি কলোনাইজড [১৯৫৭], ফ্রানৎস ফ্যানোঁর এ ডাইং কলোনিয়ালিজম [১৯৭০], দি রেচেড অব দি আর্থ [১৯৬৩], হোমি কে ভাবার দি লোকেশন অব কালচার [১৯৯৪], নেশন অ্যান্ড ন্যারেশন [১৯৯০] ইত্যাদি গ্রন্থে উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তা-চেতনার বিকাশ ও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তাঁরা যথার্থ তাত্ত্বিক মনস্বিতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ফ্রানৎস ফ্যানোঁর কাজের কেন্দ্র আলজেরিয়া, কিন্তু তাঁর লেখায় খুঁজে পাওয়া যায় আফ্রিকার কালো মানুষের স্বপ্ন সম্ভাবনা, দ্রোহ ও হৃদয়-উত্তাপ এবং ঔপনিবেশিক মানুষের লড়াকু জীবনের প্রতিচ্ছবি। তাঁর কালো চামড়া সাদা মুখোশ [১৯৫২] বা ক্ষয়িষ্ণু উপনিবেশবাদ [১৯৭০] গ্রন্থে তুলে ধরতে চেয়েছেন মূলত পুরাণের বিভিন্ন চরিত্র, মুখ-মুখচ্ছবি, যাতে নেটিভদের চেহারা ঠিকমতো উঠে আসে এবং তাদের প্রত্নপ্রতিমা যেন আরও স্পষ্ট হয়। বাংলা সাহিত্যে এই কাজটি করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মেঘনাদবধ কাব্যে [১৮৬১]। রামায়ণের রাবণ ছিলেন সীতা অপহরণকারী, দোষী, পাপী, নিকৃষ্ট কিন্তু মাইকেলের কাব্যে সেই রাবণ হয়ে উঠলেন স্বর্ণ লঙ্কার বিশাল ঐতিহ্যের অধিপতি, মহান দেশপ্রেমিক, বীরবাহু ও মেঘনাদের মতো বীরের দর্পিত পিতা, যারা দেশের জন্য সম্মুখ সমরে নিহত হয়। উপনিবেশের উত্তাল সমকালের ভেতর পুরাণের এই বিনির্মাণ কেন? কারণ, পুরাণের মুখচ্ছদ ছাড়া ঔপনিবেশিক ভারতের চেহারা কিছুতেই ধরা যেত না। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ [১৮৬০] নাটকে ইংরেজ নীলকরদের অত্যাচারে দুর্বিষহ বাংলার কৃষকদের করুণ অবস্থা, ঔপনিবেশিক শাসকদের অত্যাচারের চিত্র, অর্থনৈতিক দিক থেকে দেশের অবস্থা, সভ্যতা-অহংকারী ইংরেজদের বর্বরতার পরিচয় সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে। নীলদর্পণ নাটকের তোরাপ চরিত্রই বস্তুত বাংলার প্রথম নেটিভ চরিত্র, যার প্রতিবাদ ও দ্রোহের মধ্যে ফুটে উঠেছে উপনিবেশবিরোধী চেতনা। হোমিভাবার রচনায় জ্যাক দেরিদা, জ্যাক লাঁকা ও মিশেল ফুকোর উদ্ভাবিত নানা কৌশলের প্রয়োগ থাকলে ও তাঁর লেখায় প্রায় ঘুরে ফিরে আসে মিমিক্রাই, হাইব্রিডিটি, ডিসপ্লেসমেন্ট, আনহোমলি ইত্যাদি প্রসঙ্গ। যা ঔপনিবেশিক ‘সেলফ্’ অ্যান্ড ‘আদার’ ‘কেন্দ্র’ ও ‘প্রান্ত’ ধারণা তথা পশ্চিমের প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানতাত্ত্বিক শৃঙ্খলার বিপরীতে নানা জিজ্ঞাসার উদ্রেক করে। ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী কীভাবে উপনিবেশিতের ওপর দৈহিক-মানসিক নির্যাতন চালায়, তাদের মনোজগৎকে বিকৃত করে দেয়; যার ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা দেয় হীনম্মন্যতাবোধ হোমিভাবা পশ্চিমের এই ‘কেন্দ্র’ ও ‘প্রান্ত’ ধারণার একতরফা জ্ঞান-শৃঙ্খলাকে মারাত্মক ত্রুটি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ, ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী নিজের মতো করে শনাক্ত ও তৈরি করেছে ‘আদার’ বা ন্যাটিভদের, এতে স্থানীয়দের নির্বাক উপস্থিতিও ছিল না, তাই তারা ন্যাটিভদের নিকৃষ্ট, বর্বর, অসভ্য হিসেবে দেখেছে। সুতরাং পশ্চিমের এই একতরফা জ্ঞানতত্ত্ব প্রত্যাখ্যানযোগ্য। কেননা উপনিবেশের উপস্থিতিতে [colonial presence] নেটিভরা থাকে অধঃপতিত, অবদমিত, তার বিপরীতে সক্রিয় থাকে কলোনিয়াল শক্তির আধিপত্য, কতৃত্ব, মাতব্বরি, ক্ষমতা ও শাসন—নিয়ন্ত্রণের একচেটিয়া প্রভুত্ব। ফ্রানৎস ফ্যানোঁর দি রেচেড অব দি আর্থ মূলত উপনিবেশের এই প্রবণতারই উত্তম বিশ্লেষণ। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসের কথা উল্লেখ করা যায়। গোরা হলো ভারতের বিভিন্ন ধর্মমত এবং সামাজিক রীতির সঙ্গে পাশ্চাত্যের প্রভেদ-পার্থক্য ও সংঘর্ষ, ধর্মবিশ্বাস, কুসংস্কার, দাসমনোবৃত্তি, আত্মম্ভরিতা, পাশবিকতার মধ্যে যে সংঘর্ষ—তারই প্রতিচ্ছবি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশগুলো স্বাধীন হলেও দেশগুলোর শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতি এমনকি চিন্তাগত দিক থেকে উপনিবেশী প্রভাব মুক্ত হতে পারেনি। উত্তর-উপনিবেশবাদ [post colonialism] বা উত্তর ঔপনিবেশিক অধ্যয়ন [post colonial studz] হচ্ছে পশ্চিমা ওই একতরফা জ্ঞান-শৃঙ্খলার আধিপত্যকে অস্বীকার করা, তার বিপরীতে এককালের উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর নিজস্ব স্বর ও ভঙ্গিমা, সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অনুসন্ধান করা
উপন্যাসের শুরুতে গোরা উগ্রভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদী, পরিসমাপ্তি পর্যায়ে কৃষ্ণ দয়ালবাবুর অসুস্থতায় আকস্মিকভাবে গোরা জানতে পারে সে আইরিশম্যানের পুত্র, সে ভারতবর্ষীয় হিন্দু নয়, এই অপ্রত্যাশিত রূঢ় সত্যের ধাক্কায় গোরা উত্তীর্ণ হয় ভারতবর্ষীয় সত্তায়, বিশ্বমানবতায়। গোরার মানসসঙ্কট, আইডেন্টিটি ক্রাইসিস ও আদর্শের দ্বন্দ্ব মূলত উপনিবেশেরই প্রতিক্রিয়ার ফল। কলোনিয়াল প্রেজেন্সই গোরার মানসিক সংকট তৈরি করেছে। অনুরূপভাবে তারাশঙ্করের গণদেবতা, পঞ্চগ্রাম উপন্যাসে কলোনিয়াল কতৃত্বের সংঘাতময়, দ্বন্দ্বজটিল রূপের সঙ্গে ব্যক্তি ও সমষ্টির আন্তঃসম্পর্কের স্বরূপ বিশ্লেষিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণে নিষ্পেষিত ভারতের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ কৃষ্ণ, কামার, কুমোর, তাঁতি, জেলে জীবনপ্যাটার্ন ও চরিত্রের স্বরূপ গণদেবতা ও পঞ্চগ্রাম উপন্যাসে যেভাবে উঠে এসেছে, তা অন্য কোথাও দেখা যায় না। কাজী নজরুল ইসলামের দ্রোহময় উচ্চারণের মধ্যে যে দীর্ঘ ও প্রলম্বিত প্রতিমূর্তির আভাস পাওয়া যায়, তা একই সঙ্গে উপনিবেশবিরোধী ও প্রতিরোধমূলক। নজরুল যখন বলেন, ‘বল বীর/বল উন্নত মম শির/ শির নেহারি, আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির/ বল বীর/ বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি/ চন্দ্রসূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ ভূলোক-দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/ খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া/ উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর।’ [বিদ্রোহী] কিংবা ‘এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল/ এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল। [শিকল পরার গান]—তখন বুঝতে হবে ‘শব্দকে’ তিনি মূলত ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে।
বাঙালি খাটো, দৈহিক শক্তিও তার বীরোচিত নয়, তবু নজরুল বলছেন, বল বীর, এবং চন্দ্রসূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি, ভূলোক-দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া খোদার আসন আরশ ছেদিয়া উঠিয়াছি চির-বিস্ময়’ নিজের ভাবমূর্তিকে এতো দৈর্ঘ্যতায় ও সুউচ্চতায় চিত্রিত করার উদ্দেশ্য হচ্ছে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের শক্তি সঞ্চয় করা। এ জন্য হিন্দু-মুসলিম মিথ-পুরাণের সমাবেশ ঘটিয়েছে তাঁর কাব্যে। উপনিবেশের বিরুদ্ধে কবিতা লেখার অপরাধে একমাত্র নজরুলই জেল খেটেছেন, তাঁর গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতা এবং সাতচল্লিশে দেশবিভাগোত্তর পাকিস্তানের নয়া-উপনিবেশবাদের দ্বান্দ্বিক সমাজবাস্তবতা রূপায়িত হয়েছে শহীদুল্লাহ কায়সারের সংশপ্তক [১৯৬২] উপন্যাসে। বাকুলিয়া, তালতলি, কোলকাতা, ঢাকা, স্থান ও কালের দিক থেকে যেমন দূরত্ব, তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, দেশভাগ, উপনিবেশের অবসান ইত্যাদি ঘটনার সঙ্গে ফেলু মিঞা, রমজান, সেকান্দর মাস্টার, হুরমতি, লেকু, জাহেদ, রাবু চরিত্রের ক্রমবিকাশ, নাটকীয় পরিবর্তনের মধ্যে ঔপনিবেশিক শাসন, কর্তৃত্ব, আধিপত্যের বিকৃত প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। গোরা যেমন প্রথমে হিন্দুর চোখে স্বাধীনতাকে দেখেছিল, তেমনি সংশপ্তকের জাহেদও প্রথমে মুসলমানের চোখ দিয়ে সাতচল্লিশে দেশবিভাগ ও তথাকথিত স্বাধীনতাকে দেখেছে। পরবর্তী পর্যায়ে, সময় ও দ্বন্দ্ব জটিল সমাজবাস্তবতায় জাহেদ পরিণত হয়েছে প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে। তারাশঙ্করের গণদেবতা ও পঞ্চগ্রাম [১৯৪৩-৪৪] উপন্যাসের দেবু ঘোষ, শ্রীহরি পাল এবং দুর্গা চরিত্রের সঙ্গে হুরমতি ও লেকুর চরিত্রের যেমন মিল পাওয়া যায়, তেমনি ফেলু মিঞা চরিত্রের মধ্যে ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদের আকাঙ্ক্ষা বিধৃত। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের তাড়নায়ই রাবুরা বাকলিয়া আবাস ছেড়ে কলকাতা যেতে বাধ্য হয়। উপন্যাসে উপনিবেশের অভিঘাতকে চিহ্নিত করা যায় সহজে:
ধানের কল, গমভাঙার কল অনবরত ঘরঘর শব্দ তুলে চলছে। শহরের পাইকার আর ব্যাপারীদের স্থায়ী আস্তানা পড়েছে। পণ্যের বিকিকিনি, বায়নাদার, দানাদার, ফড়ে ব্যাপারীর লেন-দেনে চঞ্চল দত্তের বাজার। বাজারের শেষ মাথায় দত্তের বাড়ির পুরানো ভিটেয় উঠেছে কাজী বাড়ির নতুন ইমারত। তালতলির পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর যত শূন্যতা আর হাহাকার এখানে এসে পথ হারিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে [সংশপ্তক, পৃ-৪০৩]।
ঔপনিবেশিক পরিস্থিতির এই এক নিষ্করুণ চিত্র। উপন্যাসের সূচনায় হুরমতির লাঞ্ছনার দৃশ্যে পঞ্চম জর্জের নামাঙ্কিত, রানির প্রতিমূর্তিসংবলিত ধাতব পয়সা আগুনে লাল করে হুরমতির কপালে শাস্তিস্বরূপ ছেঁক দেওয়ার মধ্যে কালের বিদীর্ণ ও ক্ষতবিক্ষত চেহারা স্পষ্ট হয়।
উত্তর-উপনিবেশবাদী চিন্তার একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো প্রথমে ঔপনিবেশিক পরিস্থিতি শনাক্ত করা। স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে শুরু করে গণমানুষের জীবন পর্যন্ত কীভাবে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি, মোটিভ, বিভিন্ন উপাদান অক্ষুণ্ন থেকে যায়, তা যাচাই করাও উত্তর উপনিবেশবাদের একটা কাজ। নিজ সংস্কৃতি নিয়ে স্থানীয়রা যেন হীনম্মন্যতায় না ভোগে এবং আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি ও মমত্ব সৃষ্টিই উত্তর উপনিবেশবাদের প্রধান লক্ষ্য। এতে প্রাক্তন উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর মনে আত্মমর্যাদাবোধ, আপন অস্তিত্বের গৌরবময় ঐতিহ্য, দর্শন, রাজনীতি, সমাজবিদ্যা, ইতিহাস, শিল্পকলাসহ সবকিছুর প্রতি মমত্ববোধ তৈরি হবে।