অভিজ্ঞতার নিরিখে সময়কে দেখা

 

ডুবে যেতে যেতে কবিতায় কবি আযীমুল হক লিখছেন, আমি শুধু স্বপ্নই চাই, জাগরণ বড্ড ভারী। প্রত্যেকের জীবনেই এমন সময় আসে যখন সকলেই শুধু স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরেই হয়তো বাঁচতে চায়। বাস্তব জগতের কঠোর কুটিলতার বিপরীতে পাল্টা স্বপ্নের জগৎ নির্মাণ করে সেখানেই ডুবে থাকতে চায়।
কবি আযীমুল হকের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ডুবে যেতে যেতে পড়তে পড়তে এমন অনুভূতিটা আবারও সচেতন হয়ে ওঠে। আযীমুল হকের কবিতায় সময় একটা বড় প্রতিপাদ্য হয়ে উঠেছে। সময় শিরোনামে তাঁর দুটি কবিতা আছে। এ ছাড়া অন্যান্য কবিতার ছত্রে ছত্রে সময়ের একটা উপস্থিতি পাঠকের চোখে বিশেষভাবে ধরা পড়বে। বইয়ের প্রথম কবিতা তৃষ্ণা-য় কবি সময়কে ধরেছেন সময়ের টাই ফাঁসি হয়ে গলায় ঝোলে। আবার আড্ডা কবিতায় লিখছেন, দেয়ালঘড়িটা সময়ের সাচ্চা কেরানি
কবি পরিচিতি পড়ে আমরা জানতে পারি, কবি কর্মসূত্রে একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা। পূর্বেও তিনি সরকারি চাকরিতেই নিয়োজিত ছিলেন বিভিন্ন সময়কালব্যাপী। এ ক্ষেত্রে সময়কে টাই-এর সাথে তুলনা করে তাকে গলার ফাঁসি হিসেবে বিবেচনা করা; কিংবা দেয়ালঘড়িটাকেই কেরানি সমতুল্য মনে করাটা তাঁর কাজের অভিজ্ঞতারই একটা বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে নিজের অভিজ্ঞতার নিরিখে সময়কে দেখার ও ধরার একটা দারুণ অভিনবত্ব কবি আযীমুল হকের কবিতায় দেখতে পাই।
কনস্টেবল শিরোনামে একটা কবিতাও আমরা দেখি, যেখানে পুলিশের একজন নিম্নস্তরের পুলিশ কর্মচারীর বঞ্চনার কথা উল্লেখিত হয়েছে। অনেক পাঠকের কাছে কবিতাটা যদিও অন্যান্য কবিতা থেকে যথেষ্ট মানসম্পন্ন বলে মনে না-ও হতে পারে।
বইয়ের সব কবিতাই যে মানকে উত্তীর্ণ করে গেছে, এমনটা বলা যাবে না। কিছু কবিতার ভাব, ভাষা, ছন্দ, গাঁথুনি প্রভৃতির সামান্য অসংগতি ও দুর্বলতা যেকোনো কবিতাপ্রেমী ও বোদ্ধা পাঠকের চোখেই ধরা পড়বে। তবে এর বিপরীতে এমন কিছু কবিতাও পাওয়া যাবে, যা পড়ামাত্রই একটা তৃপ্তির অনুভূতি অনুভূত হবে। কবির ভাব ও দর্শন সম্পর্কেও একটা সম্মক ধারণা মিলবে।
প্রশ্ন কোরো না শিরোনামের কবিতাটা তেমনই একটা কবিতা। যেখানে মানুষের ভালো থাকা, না থাকা বিষয়ে সাধারণ ধারণাকে কবি প্রশ্নবিদ্ধ করছেন, নাকচ করে দিচ্ছেন বলিষ্ঠ উচ্চারণে। একই সাথে কবি দার্শনিকোচিত উত্তর খুঁজছেন আর বলছেন,

আসলে পৃথিবীতে কেউ কোনোদিন
ভালো ছিল না, নেই, থাকবে না।
ভালো তো থাকবে ঘাসফড়িং, বিষ পিঁপড়ে
গুবরে পোকা অথবা বিধাতা।

বইয়ের ফ্ল্যাপে যেমনটা লেখা হয়েছে, কবিতার শরীর নির্মাণে তিনি স্থাপত্যবাদী। দার্শনিকোচিত ভাবুকতা তাঁর কবিতার এক বড় শক্তির দিক। আবার তাঁর কবিতা দীর্ঘশ্বাসের মতো আরামদায়কও বটে। এই কবিতার ক্ষেত্রে এই কথাগুলো হয়তো বিশেষভাবে প্রযোজ্য।
এ প্রসঙ্গে গুচ্ছ পঙ্‌ক্তি থেকে একটি কবিতার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক হবে

পাঞ্জাবির পকেট খালি
খালি নয় শূন্য আছে
শূন্য নয় হাওয়া
হাওয়া নয় সময়
সময় নয় আমি আছি।

অর্থাৎ এখানেও সময়কে ধরার একটা প্রয়াস কবি দেখিয়েছেন, তবে দার্শনকোচিতভাবে। সময়ের এ রকম উপস্থিতি আরও আছে। গতানুগতিকতা কবিতায় আমরা দেখি, কবি বলছেন

বুড়ো সময়ের গালে বয়সের ভাঁজ।
এখন কর্মের সাথে সময়ের রমণে
জন্ম নেয় কালের মাকাল,
ভ্রূণ ভঙ্গের হতাশার বীজ

বিচিত্র বিষয়বস্তু ও ভাবনাকে উপজীব্য করে কবি আযীমুল হক এই বইয়ে কবিতা সাজিয়েছেন। দর্শন, ইতিহাস, মিথোলজি, দৈনন্দিন জীবনের টানাপোড়েন, নিত্যব্যবহার্য বস্তুসামগ্রী, নিজের কর্মক্ষেত্র, শৈশবে দেখা প্রকৃতি, নদী, যৌবনের প্রেম-উপেক্ষা, পাওয়া না-পাওয়া প্রভৃতি সব বিষয়ই বিভিন্ন কবিতার উপজীব্য। কোনোটি কবিতা হয়ে উঠেছে, কোনোটি হয়তো স্বগতোক্তির মতো।
বইয়ের ফ্ল্যাপে যেমনটি বলা হয়েছে, কিছু কবি থাকেন যাঁদের উচ্চারণমাত্রই কবিতা। জীবন ও জগৎকে দেখার তাঁদের একটা আলাদা চোখ থাকে। তাঁরা পাঠকের প্রচলিত দেখার জগৎকে সজোরে ধাক্কা দেওয়ার তাকত রাখেন। আযীমুল হক এই গোত্রের কবি। আমরা মনে করি, পাঠক বইটি পড়ে এই মূল্যায়নের যথার্থ বিচার করবেন।
বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ এর একুশে বইমেলায়। ওই বছরের মার্চে বইয়ের দ্বিতীয় মুদ্রণ বের হয়। বইটি প্রকাশ করেছে
অন্যপ্রকাশ। বইটিতে মোট ৪১টি কবিতা রয়েছে।
বইয়ের ফ্ল্যাপে, আযীমুল হকের ডুবে যেতে যেতে কাব্যগ্রন্থ যথার্থ কাব্যপিপাসুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। আমরাও মনে করি, যথার্থ কাব্যপিয়াসীরা এই বইয়ের যথাযথ মূল্যায়ন করবেন