জিজ্ঞাসার অন্তরালে কবি দিলওয়ার

 

পঞ্চাশের দশকের কবিরা বিষয় ও আঙ্গিকদুই দিক থেকে জীবনানন্দ ও তিরিশ/চল্লিশের দশকের কবিদের নানা অভিব্যক্তি এবং বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকার কাব্যচেতনা থেকে প্রেরণা নিয়ে যে কাব্যভাষা তৈরি করেছিলেন, দিলওয়ার সে পথে যাননি। তাই বলে তিরিশের দশকের কবিদের সময়ে বাস করেও যতটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে কবিতা লিখে নজরুল ও জসীমউদ্‌দীন কবিখ্যাতি অর্জন করেছিলেন, সমকালিকদের সঙ্গে দিলওয়ারের কাব্যচেতনাগত দূরত্ব ততটা নয়ষোলো বছর বয়সে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ জিজ্ঞাসার কথা বাদ দিলে, পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ থেকে আঙ্গিকগত দূরত্ব অনেকটাই কমতে শুরু করেছিল। তবু দূরত্ব যেটুকু রয়ে গেছে, তা আঙ্গিকগত নয়, বিষয়গতএবং এই দূরত্ব অচেতন সাহিত্যচর্চার পরিণাম নয়, এই দূরত্ব ইচ্ছাকৃত এবং অনেকটাই কাব্যাদর্শগত।

বাংলা একাডেমি প্রকাশিত দিলওয়ারের নির্বাচিত কবিতার ভূমিকায় মোস্তাক আহমাদ দীনের উক্ত বক্তব্যটি কবি দিলওয়ার এবং তাঁর কবিতাকে বুঝতে আমাদের সহায়ক হবে। তাঁর কাব্যাদর্শ অত্যন্ত সহজ ও সরল। তিনি বৃহত্তর যে জীবন, সকল মানুষের মিলিত জীবনে যে বড় জীবন, সেই বড় জীবনের উপাসক ছিলেন। তাঁর এই চেতনার নাম হতে পারে গণচেতনা। তাঁর কবিতায় যে ব্যক্তিকে পাওয়া যায়, সে ব্যক্তি সকল ব্যক্তির সমষ্টি। যাকে আমরা জনতা বলি, দিলওয়ার সেই জনতার কবিতা লিখেছেন। এ জন্যই হয়তো মানুষ তাঁকে বলে গণমানুষের কবি।

তাঁর কিন ব্রিজে সূর্যোদয় কবিতাটিতে এর সত্যতা পাওয়া যাবে।

এখন প্রশান্ত ভোর। ঝিরঝিরে শীতল বাতাস
রাত্রির ঘুমের ক্লান্তি মন থেকে ঝেড়ে মুছে নিয়ে
আমাকে সজীব করে। ঊর্ধ্বে ব্যাপ্ত সুনীল আকাশ
পাঠায় দূরের ডাক নীড়াশ্রয়ী পাখিকে দুলিয়ে।

নিচে জল কল্ কল্ বেগবতী নদী সুরমার,
কান পেতে শুনি সেই অপরূপ তটিনীর ভাষা
গতিবন্ত প্রাণ যার জীবনের সেই শ্রেয় আশা,
সৃষ্টির পলিতে সে-ই বীজ বোনে অক্ষয় প্রজ্ঞার।

সহসা ফিরিয়ে চোখ চেয়ে দেখি দূর পূবাকাশে
তরুণ রক্তের মতো জাগে লাল সাহসী অরুণ
পাখির কাকলি জাগে। ঝিরঝিরে শীতল বাতাসে
দিনের যাত্রার শুরু। অন্তরালে রজনী করুণ।

ধারালো বর্শার মতো স্বর্ণময় সূর্যরশ্মি ফলা
কিন ব্রিজে আঘাত হানে। শুরু হয় জনতার চলা।

গতিবন্ত সুরমার মতো জনতার গতি বা চলাই তাঁর আরাধ্য। এই সচল জনতাই তাঁর নিজস্ব জীবনদেবতা। তিনি লিখেছেন: একটা কথা বারবার আমাকে তাতিয়ে তুলত। প্রশ্ন জাগত, এখানে কী ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি হবে? ... যেহেতু আমার চারদিকের বৃহত্তর মানবতার দারুণ শোকাবহ জীবন আমাকে বিক্ষুব্ধ করে তুলত, আমি তাই আপ্রাণ চেষ্টা করেছি অত্যন্ত সাদামাটা সেই জীবনের কিছু অন্তরঙ্গ বক্তব্য তুলে ধরতে।

আমৃত্যু কবিতাই লিখে গেছেন দিলওয়ার। ১৬ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ জিজ্ঞাসা। ১৯৫৩ সালে। শেষ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। তাঁর মৃত্যুর তিন বছর আগে। তিনি মারা যান ২০১৩ সালে। ৬০ বছরের কাব্যজীবন তাঁর

তিনি যে বড় জীবনের কথা, বড় জীবনের শোক-অসুখ লিখতে চান, মিলিত হতে চান সবার সাথে, সকল জীবনের সাথেতা যে খুব সচেতনভাবেই তিনি স্থির করেছিলেন তাঁর কবিতার আদর্শ হিসেবে তার প্রমাণ মেলে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের নাম থেকেই। কেননা কাব্যগ্রন্থটির নাম ঐকতান। তিনি একা গাইতে চান না/ চাননি তাঁর একার গানটি। তিনি সকলের সাথে গাইতে চান/ চেয়েছেন সকলের গানটি গাইতে। শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন: আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি। আর দিলওয়ার লিখেছেন তাঁর মন বেঁধে মনে কবিতায়

মন বেঁধে মনে এসো তো দু-জন এখানে দাঁড়াই।

দিলওয়ারের কবিতার এই চেতনা, মনকে মনে বেঁধে ফেলার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্তিকে জাগায়, জাগিয়ে ভেঙে ফেলে নির্জনতা। কারণ, ওই সদ্য জাগ্রত ব্যক্তিটি মিলিত হয় আরও আরও ব্যক্তির সাথে আর জনতায় পরিণত হয় তারা। নিঃসঙ্গতার আর একাকিত্বের গহ্বর থেকে তারা মুক্তি পায়।

দিলওয়ারের কবিতা তাই যতটা না একা একা পড়বার কবিতা, তার চেয়ে বেশি সকলে মিলে পড়বার। তাঁর কবিতা যতটা না ঘরের, তার চেয়ে বেশি বাইরের। তাঁর কবিতা ব্যক্তিকে একা হতে দেয় না। জনতায় মিলিত হতে প্ররোচনা দেয়। তাঁর কবিতা নিরাশার নয়, আশার। তাঁর কবিতা শোকের, দুঃখের, বেদনার এবং সুখী হওয়ার বাসনারও। মধ্যবিত্ত : বিস্ময় কবিতায় তিনি লিখেছেন

সকালে যখন সূর্য গিরিশীর্ষে প্রাণের কলস
নির্ভয়ে উপুড় করে স্বর্ণ-সুধা ঢালে অকাতরে 
কতো যে আনন্দ জাগে এই শ্রান্ত, ধূসর অন্তরে

...

তাঁর কবিতায় ঘুরেফিরে সূর্য শব্দটি আসে। বিভিন্ন অর্থে, প্রতীকে ও রূপকে। এক বড় শক্তিরূপে। হিম-শীতলতার বিরুদ্ধে, মৃত্যুর বিরুদ্ধে। আর জীবনের পক্ষে। সূর্য যেমন সবাইকে জাগায়, তেমনি দিলওয়ার তাঁর কবিতা দিয়ে জাগাতে চেয়েছেন মানবহৃদয়কে। অরুণিমা, দিন আনো কবিতায় তিনি লিখেছেন
 

অরুণিমা দিন আনো, কষিত সোনার মতো দিন
তিমিরার্ত পথেঘাটে অন্নহীন অলিতে-গলিতে,
রূপাজীবা কল্পনায়, আততায়ী জুজুর থলিতে,
দীপ্তির সমুদ্রগর্ভে নিশীথপিপাসা হোক লীন। 
... ... 
একটি সূর্যের মতো সার্বিক চৈতন্যে অরুণিমা
এবার ছড়িয়ে দেবে বিহঙ্গের অনন্ত নীলিমা! 

 

যে মানুষের মিলন ও মুক্তি তাঁর আরাধ্য সেই মানুষের ক্ষুদ্রতা তাঁকে দুঃখিত-ব্যথিত করেছে। শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন কবিতায় লিখেছেন

শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন যদি অপরাধ হয়
আমরা কি আজো দিতে পারলাম
মানুষের পরিচয়?
ডুবে আছি আজো খণ্ডে খণ্ডে সাম্প্রদায়িক পাঁকে
দম্ভদূষিত নাগপাশে বেঁধে
মানুষের বিধাতাকে। 

... ...

তাঁর এই কবিতা পড়ে আমরা স্তম্ভিত হয়ে যাই। টের পাই তাঁর কবিত্বশক্তি এবং প্রকৃত কবির ক্ষোভ ও বেদনা।

 

আমৃত্যু কবিতাই লিখে গেছেন দিলওয়ার। ১৬ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ জিজ্ঞাসা। ১৯৫৩ সালে। শেষ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। তাঁর মৃত্যুর তিন বছর আগে। তিনি মারা যান ২০১৩ সালে। ৬০ বছরের কাব্যজীবন তাঁর। কিন্তু, মোস্তাক আহমাদ দীন লিখেছেন, ...পঞ্চাশের দশকের কবিতার অধিকাংশ আলোচনায় বিষয়গত কারণে এবং সময়ের বহুজট যুগ-যন্ত্রণা ধারণ করেনি বলে দিলওয়ারের নামটি রয়ে যায় অনুল্লিখিত। যদিও তিনি কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৮০ সালে বাংলা একাডেমি এবং ২০০৮ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। ২০২০ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে তাঁর (মোস্তাক আহমাদ দীন সংকলিত ও সম্পাদিত) নির্বাচিত কবিতা। জাতীয় পাঠ্যক্রমের উচ্চমাধ্যমিক স্তরে তাঁর একটি কবিতা পাঠ্যও হলেও সর্বক্ষেত্রে তাঁর কবিতা যথেষ্ট মনোযোগ পায়নি। কিন্তু বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষের দ্বারা তিনি সমাদৃত ও অভিনন্দিত হয়েছেন সব সময়। এখনো, তাঁর মৃত্যুর পরেও তিনি এই অঞ্চলে গণমানুষের কবি হিসেবে সর্বদা স্মরণীয়। আমরা যারা সিলেটের আলো-হাওয়ায় বেড়ে উঠেছি, তারা সব সময় তা লক্ষ করেছি। সিলেটের মানুষের হৃদয়ে তাঁর স্থানটি অত্যন্ত আদরে সংরক্ষিত। তিনি এই অঞ্চলের মানুষের অহংকার।

ষাটের দশকে তাঁর লেখা ও আরতি ধরের গাওয়া তুমি রহমতের নদীয়া, দোয়া করো মোরে হজরত শাহজালাল আউলিয়া গানটি গেয়েই উদ্বোধন করা হয়েছিল সিলেট বেতার কেন্দ্রের।

তাঁর লেখা অসংখ্য গান সিলেটের বাতাসে ভেসে বেড়ায়। আমরা অনেক সময় জানিও না গানটির রচয়িতা কে!