বাহার মারি সাম্পান যার
বাহার মারি সাম্পান যার
দাঁড় দুইআনে কেঁকোরত করের
দৈর্যা হর তোলপার
বাহারি সাম্পান। দুই দাঁড়ের অদ্ভুত ধ্বনিতে নদী তোলপাড়। মাঝি তার গানে দুই কূল মাতিয়ে তুলছে। বউঝিয়েরা ঘাটে বসে হাঁড়িপাতিল ধুয়ে নিচ্ছে। কলসিতে জল ভরতে এসে কেউ কেউ পানিতে নামছে। নদীর মাঝখানে কে এমন করে পাগল করা সুরে গান গাইছে? ঘোমটার আড়াল থেকে মুখ তুলে দেখছে তারা। লাঙল কাঁধে চাষি, সঙ্গে গরুর পাল। জমিতে হাল দিয়ে চারা লাগিয়েছে। বদর পীরের দোয়ায় ক্ষেতের ফসলে হাটবাজার ভরে যাবে। কেউ কেউ পানিতে নেমে জাল মারল। জালটি পড়েছে মাছেদের ঝাঁকের ওপর। এত ভারী জাল সে টানবে কী করে? ছেলেমেয়েরা তীরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে আনন্দে।
কর্ণফুলীকে ঘিরে এই আমাদের জীবনধারা। এই আমাদের সংস্কৃতি। মলয় ঘোষ দস্তিদারের আঞ্চলিক গানে এমনভাবে উঠে এসেছে আবহমান কর্ণফুলী আর তার দুই তীরের জীবনচিত্র। কর্ণফুলী আর এর মানুষ যেন একে অপরের পরিপূরক হয়ে গেছে। এখানকার মানুষের সুখ, দুঃখ, আনন্দ বেদনা, ব্যবসা, বাণিজ্য, যোগাযোগ, সংস্কৃতি—সবকিছুর সঙ্গে নিয়তির মতো জড়িয়ে আছে কর্ণফুলী। চট্টগ্রামের উন্নতি, অবনতি—সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই জলধারা। আবদুল গফুর হালির একটা গানে দুখী গৃহবধূ বলছে, ‘কর্ণফুলীর নদির পানিত, মিশে আঁর চোখের পানি।’ [কর্ণফুলীর পানির সঙ্গে আমার চোখের পানি মিশে আছে]। কর্ণফুলী এক জীবন্ত অনুষঙ্গের মতো জড়িয়ে আছে আমাদের সবকিছুর সঙ্গে। মনের সব কথা তাকে শোনাতে তাই দ্বিধা নেই। সনজিত আচার্যের এক বিখ্যাত গানে শুনতে পাই, এক অভাগিনী কর্ণফুলীকে দূত বানিয়েছে। তার দুঃখের কথাগুলো বন্ধুর কাছে পাঠাতে অনুরোধ করছে নদীকে।
ও রে কর্ণফুলী রে, সাক্ষী রাখিলাম তোরে
অভাগিনীর দুঃখের কথা কবি বন্ধুরে।
বিশেষত গানপ্রধান চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সাহিত্যে কর্ণফুলী অন্যতম প্রধান উপজীব্য। রমেশ শীল, আবদুল গফুর হালী, অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী, সেকান্দর পণ্ডিত, মোহাম্মদ নাসির, মলয় ঘোষ দস্তিদার, এম এন আখতার, সনজিত আচার্য, সৈয়দ মহিউদ্দিন, কবিয়াল ইয়াকুব আলীসহ বহু গীতিকারের গানে কর্ণফুলীর ঢেউ এসে দোলা দিয়েছে সুরের জগতে।
শুধু আঞ্চলিক সাহিত্য নয়, প্রমিত বাংলায় রচিত বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত বিখ্যাত সব রচনায়ও কর্ণফুলীর বিস্তার আমরা দেখেছি। সেই ঐতিহ্যও অনেক দিনের। মধ্যযুগের কবি দৌলত কাজীর কাব্য সতি ময়নায় যেমন কর্ণফুলীর নাম খুঁজে পাই, তেমনি জাতীয় কবি কাজী নজরুলের কবিতায়ও পেয়ে যাই কর্ণফুলীকে। আমাদের সাহিত্যের বিশাল ভান্ডারে কর্ণফুলী ঢেউ এসে তাকে প্লাবিত করেনি বটে, তবে তার দোলা এসে আমাদের হৃদয়কে আর্দ্র করেছে।
তাদের রচনায় উঠে এসেছে নদীপাড়ের মানুষের আচার-আচরণ, বিশেষ করে গ্রামীণ জীবন জলছবির মতো প্রকাশিত হয়েছে। সাম্পান, মাঝি, নদী থেকে পানি নিয়ে যাওয়া গ্রামের বালিকা, জোছনা রাতে নদীর রূপালী ঢেউ, মানুষের জীবিকা—সবকিছু কখনো গদ্যে, কখনো পদ্যে উঠে এসেছে।
কর্ণফুলী নিয়ে রচিত সাহিত্যের নিদর্শন আমরা প্রথম পাই মহাকবি নবীন চন্দ্র সেনের কাব্যে। কর্ণফুলীর তীর রত্নগর্ভা নোয়াপাড়া গ্রামেই তাঁর জন্ম। তাঁর রঙ্গমতী কাব্য এবং আত্মজীবনী আমার জীবন-এ কর্ণফুলীর উল্লেখ আছে।
মধ্যযুগের কবি দৌলত কাজীর লৌর চন্দ্রানী কাব্যে আমরা কর্ণফুলীর উল্লেখ পাই—
কর্ণফুলী নদীপূর্ব্বে আছে এক পুরি
রোসাঙ্গ নগর নাম স্বর্গ অবতারি।
বৈচিত্র্যসন্ধ্যানী লেখক আলাউদ্দিন আল আজাদ কর্ণফুলী নদীর পাড়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবন, তাদের আশা-হতাশা, আনন্দ বেদনার উজ্জ্বল চিত্র তুলে ধরেছেন তাঁর কর্ণফুলী উপন্যাসে। এই উপন্যাসে তিনি চট্টগ্রামের ভাষা ব্যবহার করে ভাষাটিকে যেমন মর্যাদা দিয়েছেন, তেমনি বাংলা সাহিত্যে এনেছেন বৈচিত্র্যের স্বাদ। উপন্যাসের চরিত্রগুলো চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলে, তাতে চরিত্রগুলো অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও অকৃত্রিম হয়ে ওঠে পাঠকের কাছে। বাংলা ভাষার সব পাঠকের কাছে এই উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা দুর্বোধ্য ঠেকলেও শেষ বিচারে মানুষের আবেগ ও প্রাণের স্পর্শে কর্ণফুলী হয়ে উঠেছে আমাদের সাহিত্যের কালজয়ী এক সৃষ্টি। শুধু চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা নয়, আমরা কর্ণফুলীতে দেখি চাকমা ভাষায়ও কথা বলতে। চরিত্রগুলোতে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে তিনি এই কাজ করেছেন। আর এ কারণে এই উপন্যাসে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে দক্ষতার জন্য তিনি ইউনেসকো পুরস্কার পেয়েছেন। আলাউদ্দিন আল আজাদ চট্টগ্রামের ভাষাকে কর্ণফুলীর সাবলীল স্রোতোধারার সঙ্গে তুলনা করেছেন। বইটির ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘কর্ণফুলীর জীবনধারা, সবুজ প্রকৃতি, শ্যামল পাহাড় ও সাগর সঙ্গমে বয়ে চলা প্রবাহের মতোই এই ভাষা অবিভাজ্য।’
শুধু আঞ্চলিক সাহিত্য নয়, প্রমিত বাংলায় রচিত বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত বিখ্যাত সব রচনায়ও কর্ণফুলীর বিস্তার আমরা দেখেছি। সেই ঐতিহ্যও অনেক দিনের। মধ্যযুগের কবি দৌলত কাজীর কাব্য সতি ময়নায় যেমন কর্ণফুলীর নাম খুঁজে পাই, তেমনি জাতীয় কবি কাজী নজরুলের কবিতায়ও পেয়ে যাই কর্ণফুলীকে। আমাদের সাহিত্যের বিশাল ভান্ডারে কর্ণফুলী ঢেউ এসে তাকে প্লাবিত করেনি বটে, তবে তার দোলা এসে আমাদের হৃদয়কে আর্দ্র করেছে
কর্ণফুলী © ছবি: জুয়েল শীল
নদীর চরিত্র পাল্টায়, কখনো সে শান্ত, কখনো সে চঞ্চল, কখনো সে ভাঙে, আবার কখনো নিজের গর্ভ থেকে বের করে নিয়ে আসে নতুন চর। মানুষের জীবনাচরণও বদলায়। প্রযুক্তির হাত ধরে মানুষ বদলাতে থাকে অবিরত। তার কারণে কর্ণফুলীর দুই পারের মানুষের জীবনধারণের ধরনও পাল্টায়। ১৯৬২ সালে রচিত কর্ণফুলী উপন্যাস যখন রচিত হওয়ার পর ষাট বছর পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে কত কোটি কোটি ঢেউ গড়িয়ে গড়িয়ে পড়েছে দুই পাড়ে। কর্ণফুলী নদী নিজের গতি খুব একটা পরিবর্তন না করলেও, ইতিহাসের বাঁক বদল হয়েছে বহুবার। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সাল। কত লাশ বয়ে নিয়ে গেছে এই কর্ণফুলী, কত রক্ত মিশে আছে তার জলে। কর্ণফুলী তার সাক্ষী কালে কালে সব ঘটনার। কেননা মানুষ যেন যুগে যুগে তার বেদনার অশ্রু কর্ণফুলীতেই সমর্পণ করেছে। এই বোধ অত্যন্ত আবেগঘন ছন্দ আর ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে নজরুলের কালজয়ী কবিতা কর্ণফুলীতে। চট্টগ্রামে এসে তিনি এই কবিতা রচনা করেছিলেন।
ওগো ও কর্ণফুলী,
উজাড় করিয়া দিনু তব জলে আমার অশ্রুগুলি।
যে লোনা জলের সিন্ধু-সিকতে নিতি তব আনাগোনা,
আমার অশ্রু লাগিবে না সখী তার চেয়ে বেশি লোনা!
তুমি শুধু জল করো টলমল; নাই তব প্রয়োজন
আমার দু-ফোঁটা অশ্রুজলের এ গোপন আবেদন।
যুগ যুগ ধরি বাড়াইয়া বাহু তব দু-ধারের তীর
ধরিতে চাহিয়া পারেনি ধরিতে, তব জল-মঞ্জীর
বাজাইয়া তুমি ওগো গর্বিতা চলিয়াছ নিজ পথে!
কূলের মানুষ ভেসে গেল কত তব এ অকূল স্রোতে!
তব কূলে যারা নিতি রচে নীড় তারাই পেল না কূল,
দিশা কি তাহার পাবে এ অতিথি দুদিনের বুলবুল?
–বুঝি প্রিয় সব বুঝি,
তবু তব চরে চখা কেঁদে মরে চখিরে তাহার খুঁজি!
তুমি কি পদ্মা, হারানো গোমতী, ভোলে যাওয়া ভাগিরথী—
তুমি কি আমার বুকের তলার প্রেয়সী অশ্রুমতী?
দেশে দেশে ঘুরে পেয়েছি কি দেখা মিলনের মোহানায়,
স্থলের অশ্রু নিশেষ হইয়া যথায় ফুরায়ে যায়?
ওরে পার্বতী উদাসিনী, বল এ গৃহ-হারারে বল,
এই স্রোত তোর কোন পাহাড়ের হাড়-গলা আঁখি-জল?
বজ্র যাহারে বিঁধিতে পারেনি, উড়াতে পারেনি ঝড়,
ভূমিকম্পে যে টলেনি, করেনি মহাকালেরে যে ডর,
সেই পাহাড়ের পাষাণের তলে ছিল এত অভিমান?
এত কাঁদে তবু শুকায় না তার চোখের জলের বান?
[কর্ণফুলী: কাজী নজরুল ইসলাম]
সুদীর্ঘ এই কবিতায় আমরা কর্ণফুলী তার সমসাময়িক স্থানকাল পেরিয়ে এক মহাকালের দিকে ধাবিত হয়েছে যেন। লোনা জলের মহাসিন্ধুর অসীম সীমানায় কর্ণফুলী যেমন মিশে যায়, তেমনি কর্ণফুলী যেন পেয়ে গেছে অনন্তকালের অমরত্ব এই কবিতার মাধ্যমে। স্পষ্টতই বোঝা যায় কর্ণফুলী নদী কবির মনে বিশেষ রেখাপাত করেছিল, তিনি প্রবলভাবে আবেগতাড়িত হয়েছেন এই নদীতে ভ্রমণের পর। কর্ণফুলীর নামকরণ নিয়ে যে উপকথা প্রচলিত আছে, তারও উল্লেখ আছে এই কবিতায়।
ওগো ও কর্ণফুলী
তোমার সলিলে পড়িছিল কবে কার কান–ফুল খুলি
তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন তরুণী কে জানে
সাম্পান নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে
আনমনা তার খুলে গেল গেল খোঁপা কান–ফুল গেল খুলি
সে ফুল যতনে পরিয়া কর্ণে হলে কী কর্ণফুলী।
[কর্ণফুলী: কাজী নজরুল ইসলাম]
লক্ষণীয় বিষয় হলো, কবি এখানে সাম্পান শব্দটি অত্যন্ত সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন। কারণ, এই বিশেষ আকৃতির জলযানটি একমাত্র কর্ণফুলী নদীতেই ব্যবহার হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। কবির গানেও আমরা সাম্পান শব্দের ব্যবহার পাই।
আমার সাম্পান যাত্রী না লয় ভাঙা আমার তরী।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সাহিত্য ও গানে সাম্পান আরেকটি বিশেষ অনুষঙ্গ। আর সাম্পান আর কর্ণফুলী দুটোর সম্পর্ক একে অপরের পরিপূরকের মতো।
চট্টগ্রামের কবি ওহীদুল আলম ১৯৪৬ সালে কর্ণফুলীর মাঝি নামে একটি গাথাকাব্য লেখেন। কবি জসীমউদদীনের কাব্যরীতিতে লেখা এই কাব্যে কর্ণফুলীর দুই পারের মানুষের জীবনধারা অসাধারণ কাব্যে ফুটে উঠেছে। কবি জসীমউদদীন, ডক্টর এনামুল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, অন্নদাশঙ্কর রায়সহ সে সময়ের বুদ্ধিজীবী লেখকেরা এই কাব্যের প্রশংসা করেছিলেন। এখানে মোট ১২টি গল্প কবিতার ছন্দে বর্ণিত হয়েছে। সব গল্পেই কর্ণফুলীর সজল ও সতেজ উপস্থিতি আছে। তাতে কর্ণফুলীর অপরূপ প্রকৃতির বর্ণনা রয়েছে। তারই উদাহরণ তুলে ধরছি পাঠকের সামনে।
দেয়াঙ পাহাড় দৈত্যের মত সেথায় আছিল খাড়া
তারি পাশ দিয়ে দিবানিশি ছোটে কর্ণফুলীর ধারা।
দুই ধারে তার সবুজের বন শিহরি উঠিছে বায়
লুলিত লতিকা দোল খেয়ে পড়ে দুরন্ত দখিনায়।
...
ভোরের অরুণ চিক চিক জ্বলে সবুজ বনের আগে
রাতের কুহেলি মিশে যায় ধীরে ধরায় জীবন জাগে।
[কর্ণফুলীর মাঝি: ওহীদুল আলম]
কর্ণফুলীর কন্যা কবিতায় কর্ণফুলীর অন্য রকম রূপ একেবারে ভিন্ন ছন্দে প্রকাশিত হতে আমরা দেখি।
পাহাড় গহ্বর কাঁপে ব্যাঘ্র চলে পরতাপে
লতায় লতায় ঝুলে ফুল
তার তলে কর্ণফুলী ছুটিছে তরঙ্গ তুলি
ত্রিভুবনে নাতি তার তুল
[কর্ণফুলীর কন্যা : ওহীদুল আলম]
পঞ্চাশের কবি আল মাহমুদের শুরুর দিনগুলো কেটেছে চট্টগ্রামে। এ কারণে চট্টগ্রামের ভাষার বহু শব্দ, চট্টগ্রামের বহু জায়গার নাম তাঁর কবিতায় আমরা দেখতে পাই। তাঁর লেখায়ও কর্ণফুলী বাদ যায়নি।
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলী কূলটায়
দুধভরা এই চাঁদের বাটি
ফেরেশতারা উলটায়।
[আল মাহমুদ]
কর্ণফুলী © ছবি: জুয়েল শীল
কথাসাহিত্যিক বিপ্রদাশ বড়ুয়ার শৈশব যৌবনের একটা বিরাট অংশ কেটেছে কর্ণফুলীর তীরবর্তী গ্রাম রাঙ্গুনিয়ায়। তাঁর প্রকৃতিবিষয়ক লেখাগুলোতে কর্ণফুলী এক অপরিহার্য বিষয়। তাঁর কমপক্ষে এক ডজন ছোটগল্পে কর্ণফুলী তরঙ্গায়িত হয়েছে। বিপ্রদাশের বিখ্যাত উপন্যাস শ্রামণ গৌতম অভিনব, অচেনা, দূরযায়ী ও অসরাচর। কর্ণফুলী নদী, এর তীরবর্তী জনপদ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অচেনা জনজীবন এক নতুন দিকের উন্মোচন করে। কর্ণফুলী তাঁর সাহিত্যে জলছবির মতো উঠে এসেছে। এই উপন্যাস থেকে কর্ণফুলীর কিছু শব্দছবি পাঠকদের জন্য পুনর্পাঠ করছি—
কর্ণফুলীতে তখন জোয়ার শুরু হয়েছে। নৌকা মাঝ নদীতে, একজন দাঁড় টানছে, পিছনে মাঝি। শীতের সকাল। রোদ উঠেছে ঝকঝকে। সাদা বক ও টিট্টিভ পাখি উড়ে যাচ্ছে প্রায় পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে। দুই কূলে বাড়িঘর, পানের বরজ, পাউন্ডি খেত। দূরে পুব দিকে মাথা উঁচু করে আছে সীতা পাহাড়। ডান দিকে কোদালা চা বাগান। বাগানের সাহেবের বাংলো বাড়ি দেখা যাচ্ছে। হালকা কুয়াশার ওড়নার নিচে পাহাড়ের গাছপালা চুপচাপ বসে আছে। আমাকে যেন ডাকছে।...চন্দ্রঘোনার পথে নৌকায় বসে অপেক্ষা করছি কখন পথ শেষ হবে। তখন বেলা এগারোটার মতো হবে। কোদালা চা বাগান ফলে যেতেই কর্ণফুলী আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসছে।
[শ্রামণ গৌতম: বিপ্রদাশ বড়ুয়া]
কথাসাহিত্যিক সুব্রত বড়ুয়া, ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়ার লেখায়ও কর্ণফুলী এসেছে।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অপরিহার্য সম্পর্কের কারণেই কর্ণফুলী অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছে মানুষের জীবনে-যাপনে, সংস্কৃতিতে ও সাহিত্যে। মানুষের রচিত সাহিত্যে তাই আজও আসে কর্ণফুলী। কর্ণফুলী এখনো এখানকার কবি, সাহিত্যিক, গীতিকারের অন্যতম প্রিয় বিষয়। তারই প্রমাণ মিলল ছড়াকার আবুল কালাম বেলাল সম্পাদিত ছড়া কবিতায় কর্ণফুলী নামে একটি সংকলনে। কর্ণফুলীর তীরে কৈশোরের অনাবিল স্মৃতির কথা আমরা পেয়ে যাই এই সংকলনে রমজান আলী মামুনের পদ্যে।
সেই যে কবে পানির ঘাটে এসে
পি কে সেনের লাল দালানের পর
বইতো বাতাস একটু নিরিবিলি
মন ছুটে যায় অন্য তেপান্তর।
[কর্ণফুলীর বুকে, রমজান আলী মামুন]
শুধু গান, কবিতা, গল্প উপন্যাস নয়, নাটকেও কর্ণফুলী এসেছে। নাট্যকার মামুনুর রশীদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক সোয়াতএর পটভূমি চট্টগ্রাম বন্দর। সোয়াত একটি জাহাজের নাম। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান শিপিং করপোরেশনে পণ্যবাহী জাহাজ এম ভি সোয়াত চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর ফেলে। এই জাহাজে করে খাদ্যশস্যের নামে বিপুল অস্ত্র নিয়ে আসা হয়। বাঙালিদের হত্যার উদ্দেশ্যে আনা এই অস্ত্রের কথা জেনে যায় বাঙালিরা। কর্ণফুলীর মোহনায় অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দর তাই প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে। পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠে প্রতিরোধের স্ফুলিঙ্গ। নাট্যব্যক্তিত্ব আহমেদ ইকবাল হায়দার নির্দেশিত এবং থিয়েটার ইনস্টিটিউট প্রযোজিত মুক্তিযু্দ্ধের এই ঐতিহাসিক ঘটনা নাটকের উপজীব্য বিষয়।
মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে যে নদী ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে, সে নদী মানুষের রচিত সাহিত্যে, গবেষণায় উঠে আসবে, তা খুবই স্বাভাবিক। আর আরও স্বাভাবিক মানুষের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিও গড়ে উঠবে সেই নদীকে ঘিরে। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ও ঐতিহ্যেও কর্ণফুলী অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। এখানকার সাম্পান খেলা, অঁলা গান, প্রাচীন পুঁথি—সবকিছুই কর্ণফুলীর উপস্থিতি বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের ঐতিহ্য সংস্কৃতি থেকে তাকে আলাদা করেছে। শুধু বাংলা ভাষা কিংবা চট্টগ্রামের ভাষা নয়, বৃহত্তর চট্টগ্রামের তিন পাহাড়ি জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা নানা জাতের– ধর্মের মানুষের ভাষার গানে, কবিতায়, কাহিনিতে কর্ণফুলীর উপস্থিতি পাওয়া যায়।
কর্ণফুলী © ছবি: জুয়েল শীল
২০০৩ সালে ডেভেলপমেন্ট জার্নালিস্ট ফোরামের পক্ষে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব থিয়েটার আর্ট [বিটা]-এর সমন্বয়ে আমার সম্পাদনায় কর্ণফুলী নামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। এতে কর্ণফুলীসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে ১৬টি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কর্ণফুলীসংক্রান্ত নানা গবেষণা কাজে এবং নতুন লেখার সময় এটি একটি সহায়ক সংকলন।
মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে যে নদী ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে, সে নদী মানুষের রচিত সাহিত্যে, গবেষণায় উঠে আসবে, তা খুবই স্বাভাবিক। আর আরও স্বাভাবিক মানুষের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিও গড়ে উঠবে সেই নদীকে ঘিরে। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ও ঐতিহ্যেও কর্ণফুলী অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। এখানকার সাম্পান খেলা, অঁলা গান, প্রাচীন পুঁথি—সবকিছুই কর্ণফুলীর উপস্থিতি বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের ঐতিহ্য সংস্কৃতি থেকে তাকে আলাদা করেছে। শুধু বাংলা ভাষা কিংবা চট্টগ্রামের ভাষা নয়, বৃহত্তর চট্টগ্রামের তিন পাহাড়ি জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা নানা জাতের—ধর্মের মানুষের ভাষার গানে, কবিতায়, কাহিনিতে কর্ণফুলীর উপস্থিতি পাওয়া যায়।
কর্ণফুলী নদীর নাম নিয়ে আছে নানা উপকথা। কানের ফুল থেকে কর্ণফুলী। নামকরণের এই কাহিনিই বেশি জনশ্রুত এবং জনপ্রিয়। আরাকানের এক রাজকন্যার সঙ্গে বাঙালি এক রাজপুত্রের প্রেম হয়। এক চাঁদনি রাতে তারা দুজন নৌভ্রমণে বের হয়। নদীর জলে চাঁদের প্রতিফলন আর প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করছিল দুজন। এ সময় রাজকন্যার কানে গোঁজা একটি ফুল পড়ে যায় কর্ণফুলীতে। ফুল হারিয়ে অস্থির হয়ে ওঠে রাজকন্যা্ আর সেটি উদ্ধারের জন্য ঝাঁপ দেয়। আর প্রবল স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এদিকে প্রেমিকাকে বাঁচাতে রাজপুত্রও ঝাঁপ দেয়। কিন্তু ফিরে পেল না। প্রেমিকার শোকে দিশেহারা রাজপুত্র নিজেও আত্মাহুতি দেয়। এই করুণ কাহিনি থেকেই কর্ণফুলী নদীর নামকরণ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
তবে আরবি শব্দ করনফোল থেকে কর্ণফুলী নামের উদ্ভব হয়েছে—এই যুক্তি বেশি গ্রহণযোগ্য। করণফোল মানে লবঙ্গ। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে করনফোল বা লবঙ্গ উৎপাদিত হতো। আরব বণিকেরা সেই লবঙ্গ বা করনফোল নদীপথে চট্টগ্রাম শহরে এনে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে রপ্তানি করতেন। এসব কথা খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে দ্বাদশ শতকের। একবার করনফোলবাহী একটি বাণিজ্যতরী নদীপথে আনার পথে ডুবে যায়। করণফোল ডুবে যাওয়ায় নদীটির নাম ওরা করনফোল বলে আখ্যা দিলেন। আর সেই করনফোল নদীর তীরবর্তী শহরকে ওরা বলতেন কর্নবুল। প্রাক ইসলামি যুগের আরবি কবি ইমরুল কায়েসের কবিতায় করনফোল শব্দটি পাওয়া যায়।
নাচিম চ সাবা যায়াত রিবায়াল করনফোল।
[প্রাচ্যের বাতাস সুবাসিত লবঙ্গের ঘ্রাণে]
নামকরণ যেভাবেই হোক। জন্মের পর থেকে ১৭০ মাইল দীর্ঘ পথে তার হাজার বছরের যাত্রা। লুসাই পাহাড় থেকে বঙ্গোপসাগর। বিস্তীর্ণ দু তীরে মানুষের জীবনের কী বিপুল বিস্তার। বাঙালি, চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের বিচিত্র সংস্কৃতির এক অসাধারণ সম্মিলন। তাকে নিয়ে কত গান, কত কথকতা, কত প্রবাদ, কিংবদন্তি, সাহিত্যের সম্ভার। কর্ণফুলী যেখানে সাগরের সঙ্গে মিশে গিয়ে তার যাত্রার পরিণতি ঘটিয়েছে, সেখানেই বহু বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এশিয়ার সিংহদ্বার। চট্টগ্রাম বন্দর। এর দুই তীরে মানুষের শ্রমে ফলবতী হয়েছে শস্যখেত। বসেছে হাটবাজার, যোগাযোগের ঘাট। গড়ে উঠেছে শিল্প, বেড়েছে স্থাপনা। প্রসারিত হয়েছে বাণিজ্য। কর্ণফুলীর জলের ধারা আমাদের রক্তের ধারার সঙ্গে যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এ জন্যই এটি আমাদের জীবনরেখা। এটিকে বাঁচাতে হবে আমাদের অস্তিত্বকে বাঁচানোর জন্য।
কর্ণফুলীকে নিয়ে এমন ঋদ্ধ তথ্যবহুল লেখা এর আগে পড়িনি। কর্ণফুলীকে ঘিরে দিনে দিনে সম্মৃদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি। গল্প,কবিতা গান উপকথা, এমন কি পুঁথিও রচিত হয়েছে। চট্টগ্রামের ঐতিহ্য এই কর্ণফুলীর জলের বুঁদে মিশে আছে সেই সকল ঐতিহ্য গাঁথা। 'বাহার মারি সাম্পান যার' নতুন মাত্রায় আরও এক অভূতপূর্ব সংযোজন। অনেক আজানা তথ্য জানলাম। সম্মৃদ্ধ হলাম। আমার মতো আরও অনেকই সম্মৃদ্ধ হবেন এমন গবেষণা মূলক তথ্য বহুল প্রবন্ধটি পাঠ করে। কৃতজ্ঞতায় প্রণত হলাম। এভাবে চট্টগ্রামের আরও অনেক ঐতিহ্য উঠে আসবে ওমর কায়সারের গবেষণা মূলক লেখায়, শুভ কামনা রইলো।
mahbuba chowdhury
মার্চ ০১, ২০২২ ১৬:২৬