এস্পানিওলার শহরের সিনিওর সানতস ও মারিয়া
ব্যাকরোড ধরে হালকাচালে ড্রাইভ করতে করতে আমি আমেরিকার আদিবাসীদের গ্রাম সান-ইদেলফনসো পোয়েভলোর স্বায়ত্তশাসিত পরিসর অতিক্রম করে এগিয়ে যাই সামনে। আফ্রিকা ছাড়ার কাঁটায় কাঁটায় ছয় মাস পর আমার এ গাড়িটি সিয়েরা লিওন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সান্তাফে শহরে এসে পৌঁছেছে। গাড়িখানা লজজড় এবং মেজাজী, অর্থাৎ মুড খারাপ থাকলে বেগড়বাই করার খাসিলত আছে। বহু বছরের পুরোনো এ বাহনটিতে এখনো লেগে আছে সিয়েরা লিওনের লালচে ধুলোবালি। এটি যে হ্রস গতিতে আগুয়ান হচ্ছে, এতেই আমি খুশিতে বাগবাগ। সামনের মরু পরিসর অতিক্রম করে দিগন্তজুড়ে ফুটে ওঠে—সাংগ্রে দে খ্রিস্ত পাহাড়ের জগদ্দল ল্যান্ডস্কেপ। আজ আমি রওনা হয়েছি এস্পানিওলা শহরের উদ্দেশে।
সান্তাফে থেকে সামান্য দূরে এস্পানিওলা শহরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকলেও অর্থনীতির নিরিখে এ আবাসিক এলাকাটি হিস্পানিক কৌমের গরিব-গোর্বাদের বাসস্থান হিসেবে পরিচিত। ১৫৯২ সালে এ অঞ্চল মেক্সিকো থেকে আগত স্প্যানিয়ার্ডরা দখল করে ‘নুয়েবো মেহিকো’ নাম দিয়ে—আমেরিকান আদিবাসীদের হটিয়ে শহরটির গোড়াপত্তন করেছিল। তারপর মার্কিনরা নুয়েবো মেহিকো স্রেফ গায়ের জোরে করতলগত করে নিউ মেক্সিকো নাম দিয়ে নতুন একটি রাজ্যের পত্তন করলে, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের সুবিধার জন্য স্থাপন করা হয় রেল রোড। ১৮৮০ সালে এস্পানিওলা শহরটি গড়ে ওঠে রেলবাহিত ব্যবসা-বাণিজ্যের ঠেক হিসেবে।
ড্রাইভ করতে করতে সড়কের পাশে পেল্লায় একটি ক্লিফ ফরমেশনের দিকে নজর পড়ে। পাথুরে জগদ্দলটি সরেজমিনে না দেখে আগ বাড়তে ইচ্ছা হয় না। রাজপথের পাশে নুড়িপাথর ছড়ানো জায়গা প্রচুর, তাই সাইড করে পার্ক করতে কোনো অসুবিধা হয় না। খানিক হেঁটে আমি পাথরের আচানক স্থাপত্যকলাটির তলায় এসে দাঁড়াই। মরচে পড়া বাদামি রঙের শিলা থেকে ফট ফট শব্দে উড়ে যায় মরুভূমিতে প্রবাসী হওয়া মেক্সিকোর একঝাঁক নীলচে-ধূসর ঘুঘু। ক্লিফ ফরমেশনটির মাঝ বরাবর কিছুটা লম্বাটে গোলাকার একটি ফোকর। আমি পাথর বেয়ে খানিক ওপরে উঠে প্রাকৃতিক এ জানালা দিয়ে ওদিকের আকাশছোঁয়া দিগন্ত নিশানা করে তাকাই। গাছপালাহীন প্রান্তরে একাধিক চার্চ-টাওয়ারের ক্রুশ চিহ্ন, কবরগাহ ও পুরোনো দিনের রেলওয়ে স্টেশন নিয়ে এস্পানিওলার আউটলাইন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জায়গাটি দারুণ রকমের জনহীনতায় এমন মৌনভাব ধারণ করে আছে যে, এখানে দুদণ্ড বসে যেতে বাসনা হয়।
পাথরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসতেই করোটিতে ফিরে আসে আমার সুহৃদ সানতস-এর প্রসঙ্গ। এ মুহূর্তে আমি সিনিওর সানতসের সন্ধানে রওনা হয়েছি এস্পানিওলার দিকে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থে মানবজাতিকে যে রকম বিভক্ত করা হয়েছে কেতাবি ও অকেতাবি হিসাবে, অনেকটা সে কায়দায় নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যে জনবিভাজনের রূপটি হচ্ছে—লিগ্যাল ও ইলিগ্যাল। এ ফরমুলানুযায়ী আমি এখানকার লিগ্যাল বাসিন্দা। আমার সুহৃদ সানতস-এর প্রশাসনিক তকমা হচ্ছে ইলিগ্যাল ইমিগ্র্যান্ট বা অবৈধ অভিবাসী।
পেশায় সিনিওর সানতস হ্যান্ডিম্যান, কারও ঘরদুয়ারে বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের কলকবজা বিকল হলে তিনি তা মেরামত করে দেন। সাইড বিজনেস হিসেবে তিনি হাউস ক্লিনিংও করে থাকেন। তাঁর মজুরি—বৈধভাবে যারা এ ধরনের কাজ করে, তাদের চেয়ে অনেক কম। আমার কৃপণ বলে পরিচিতি আছে, তাই সান্তাফের যে কটেজে আমি বসবাস করছি—ওখানে কোনো সমস্যা দেখা দিলে সিনিওর সানতসকে এত্তেলা দেই। তিনি অতি অল্প পারিশ্রমিকে আমার মুশকিল আসান করে দেন। একটি জংধরা ভ্যানগাড়িতে তাঁর টুল-কিট নিয়ে সানতস ঘুরে বেড়ান। প্রয়োজনে রাত্রিবেলা গাড়ির পাটাতনে স্লিপিং-ব্যাগ পেতে নিদ্রা যান। তবে এস্পানিওলায় বাসরত এক মেক্সিকান বৈধ অভিবাসীর পরিবারের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়েছে। উইকএন্ডে সিনিওর কাজ করেন না। তিনি এ অবসরটুকু কাটান মেক্সিকান পরিবারটির সাথে।
সিনিওর সানতসের পিতা আটের দশকে মেক্সিকোর টিহুনা শহর থেকে অবৈধভাবে এসে ঢোকেন ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগো শহরে। পিতার অভিবাসী হওয়ার অনেক বছর পর—কিশোর সানতস নিশিরাতের অন্ধকারে নদী সাঁতরে সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে পড়েন যুক্তরাষ্ট্রের জনহীন এক মরুভূমিতে। দিন তিনেক অচেনা ডেজার্টে পায়ে হেঁটে ট্র্যাক করার পর, খাদ্য ও জলের অভাবে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন তিনি একটি কাঁটাঝোপের তলায়। একজন র্যাটেল সাপ শিকারি উদ্ধার করে তাঁকে নিয়ে আসে সান্তাফে শহরে।
তো এ শহরেই তিনি অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বাস করতে শুরু করেন। একবার সান ডিয়েগোতে গিয়ে পিতাকেও খুঁজে বের করেছিলেন। কিন্তু তত দিনে তাঁর পিতার ভিন্ন একটি সংসার হয়েছে। দুটি শিশুসন্তান নিয়ে সৎমা পরিবার চালাতে গলদঘর্ম হচ্ছেন, কারণ পিতা মারাত্মকভাবে অ্যালকোহলিক। তো বেহেড মাতাল পিতার সংসারে তাঁর স্থান হয়নি। সানতস সান্তাফেতে ফিরে উপার্জনে মনোযোগ দেন। তাঁর বয়স চৌত্রিশ, নিজের কোনো সংসার হয়নি। তবে মেক্সিকোতে ফেলে আসা জননী, চার ভাই-বোনের একান্নবর্তী পরিবারকে তিনি ফি মাসে টাকা পাঠিয়ে জিইয়ে রেখেছেন।
সিনিওর সানতস সুযোগ পেলে গালগল্পে মেতে উঠতে পছন্দ করেন। মানুষটি ব্যতিক্রমী রকমের বন্ধুবৎসল। পরিচিতজনদের সাংসারিক প্রয়োজনে তাঁকে সংবেদনশীল হয়ে উঠতে দেখেছি একাধিকবার। আমার কটেজে ছোটা-কাজ করতে আসলেই ভারি সুন্দর করে জানতে চান, ‘এসটাস বিয়েন, নেসেসিতো আলগো, পোয়েডে আয়ুদারতে?’ বা ‘সবকিছু ভালো চলছে তো? কোনো কিছুর দরকার আছে কি? আমি কি কোনোভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
আমি স্বপাকে আহার গ্রহণ করি। রান্নার উপকরণ হিসেবে আদা ও গরমমসলা কোনো দোকানে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সমস্যা শুনে বিকেলবেলা সানতস এসে হাজির হন আদা ও এক প্যাকেট এলাচি নিয়ে। বিনিময়ে কোনো টাকাপয়সা নিতে চান না। তবে আমি কফি অফার করলে তিনি তা পান করতে করতে আমি যে বছর দুয়েক মেক্সিকো সিটিতে বাস করেছি, তার বিস্তারিত বয়ান শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, মেক্সিকোর ওহাকা অঞ্চলের মানুষ তিনি, শৈশবে স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে সিওদাদ মেহিকো বা মেক্সিকো সিটিতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যাবেন। কিন্তু গরিবি হালতের জন্য লেখাপড়া তেমন একটা করতে পারেননি।
বৈধ কাগজপত্র তাঁর নেই, সুতরাং এ জন্মে হয়তো আর কখনো মেক্সিকো সিটিতে যাওয়া হবে না। আমি প্লেয়ারে ‘মারিয়াচি মেহিকানিসমো’ নামে পরিচিত মেক্সিকোর লোকগীতির সিডি চড়ালে মাথা দুলিয়ে তিনি সংগীত উপভোগ করতে করতে ফের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘এসটা মুসিকা টকা মি কোরাজান,’ বা ‘এ গানের ধ্বনি আমার হৃদয় স্পর্শ করছে।’ এসব গান হালফিল ইউটিউবে পাওয়া যায়। কিন্তু সিনিওর সানতস ইন্টারনেটের বিষয়-আশয় তেমন একটা বুঝতে পারেন না। তো আমি কয়েকটি মেক্সিকান সংগীতের সিডি তাঁকে উপহার দিলে তিনি উষ্ণ হাগে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আমি তাঁর চোখে আর্দ্রতা দেখতে পাই।
সিনিওর সানতসের সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতার কথা ভাবতে ভাবতে ক্লিফ ফরমেশনের তলা থেকে ফিরে আবার গাড়ি স্টার্ট দিই। মিনিট দশেকের ভেতর এসে পৌঁছি এস্পানিওলায় ঢোকার মুখে একটি পার্কে। ঘড়িতে বাজছে কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে নয়টা। এ সময় ঠিক এই পার্কটিতে সিনিওর সানতসের দাঁড়িয়ে থাকার কথা। আমি গাড়ি থেকে নেমে তাঁর তালাশে এদিক-ওদিক তাকাই।
অত্র এলাকায় একসময় বাস করত আমেরিকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন গোত্র। তাঁদের সংস্কৃতির স্মারক হিসেবে পৌরসভা পার্কটিতে স্থাপন করেছেন পাঁচটি টিপি বা একধরনের তাঁবু। টিপিগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে লে-রাইডার বলে পরিচিত সত্তর-আশি বছরের পুরোনো তিনটি ভিনটেজ মোটর-কার। হিস্পানিক কৌমের যুবকদের মাঝে লো-রাইডার মোটর-কারগুলোর কদরদানি প্রচুর। তরুণেরা হাতে পয়সা আসলেই খরিদ করে জংধরা লজজড়—বয়সের ভারে অচল ভিনটেজ লো-রাইডার কার। এস্পানিওলা শহরের কিছু গ্যারেজে তৈরি হয় এসব গাড়ির খুচরা পার্টস। ছেলেরা ভিনটেজ গাড়িগুলো সারাই করে উইকএন্ডে তাতে চড়ে নাকি তাদের বান্ধবীদের সঙ্গে ডেটে যায়। এ আচরণ নিয়ে পত্রপত্রিকায় আমি ফিচার পড়েছি। বলা হয় যে—এস্পানিওলা শহরটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের লো-রাইডার গাড়িগুলোর রাজধানীবিশেষ। কিন্তু এ মুহূর্তে আমি এসব গাড়ি খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণের বিশেষ আগ্রহ বোধ করি না।
মিনিট দশেক কেটে যায়। সিনিওর সানতস এসে হাজির হন না। গড়পড়তা আমেরিকানদের মতো সময়নিষ্ঠ তিনি নন। তাই অপেক্ষা করতে করতে আমি আজ তাঁর সাথে সাংগ্রে ডে খ্রিস্ত পাহাড়ের ভেতর-মহলে প্রায় লুকিয়ে রাখা গুলিবিদ্ধ যে হেলিকপ্টারটি দেখতে যাচ্ছি, তার প্রেক্ষাপট নিয়ে ভাবি। জোসেফ মরগান নামে এয়ারফোর্স থেকে অবসরপ্রাপ্ত এক শ্বেতাঙ্গ মার্কিন সান্তাফে এলাকায় ফোর্ড ট্রাইমোটর নামক অনেক বছরের পুরোনো একটি এয়ারক্রাফট ওড়ান। ট্রাইমোটর প্লেনগুলো যুক্তরাষ্ট্রের যশস্বী গাড়ি নির্মাতা হেনরি ফোর্ড নির্মাণ করেছিলেন ১৯২৫ সালে। এ ধরনের মোট ১৯৯টি বিমান তৈরি হয়েছিল। এগুলোর দু-চারটি নমুনা পৃথিবীর নানা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
একটি ভিনটেজ ট্রাইমোটর জোসেফ মরগান সয়ং পাইলট হিসেবে ফ্লাই করছেন। তার উড়োজাহাজটিকে তিনি আদর করে টিন-গুজ বা ধাতব-রাজহাঁস নামে ডাকেন। পয়সার বিনিময়ে মাত্র আটজন প্যাসেঞ্জার নিয়ে টিন-গুজটি উড়ে যায় সাংগ্রে ডে খ্রিস্ত পাহাড়ে ওপর দিয়ে রকি মাউন্টেনের প্রান্ত অব্দি। যারা টিন-গুজে উড়েছেন, তারা শিংগাল হরিণ-চরা পাহাড়ি উপত্যকা পর্যবেক্ষণের প্রশংসায় আত্মহারা হন হামেহাল।
আমি টিন-গুজের প্যাসেঞ্জার হওয়ার জন্য মরগান সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানতে চান—আমি নিকট অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে কোথাও ভ্রমণ করেছি কি না। জবাবে আমি সিয়েরা লিওনে আমার বসবাসের কথা উল্লেখ করি, মরগান ইবোলা সংক্রমণের অজুহাত দিয়ে আমাকে তার টিন-গুজে ওড়া থেকে বঞ্চিত করেন। আমি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি, সিয়েরা লিওন ছাড়ার সময় এবং যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর আমি বিশদভাবে মেডিকেল চেক-আপ করিয়েছি। আমার শরীরে ইবোলার বীজাণু নেই বলে ডাক্তাররা ক্লিয়ারেন্স দিয়েছেন। আমি ইবোলা-মুক্ত বলে ডাক্তারের দেওয়া সনদের স্ক্যান করা কপি ইমেইলে অ্যাটাচ করে পাঠানোর প্রস্তাব দিই। কিন্তু ভবি ভোলার পাত্র নন, মরগান রূঢ়ভাবে আমাকে টিন-গুজে উড়তে দিতে অসম্মতি জানান।
বিষয়টি আমাকে দারুণভাবে খাজুল করেছিল। ঝিম ধরে চুপচাপ কটেজের বেলকনিতে বসে ছিলাম। সিনিওর সানতস আমার কটেজের কিচেনে অভেন-স্টোভ মেরামত করছিলেন। ঘটনাটি জানতে পেরে বিচিত্র কিছু তথ্য দিয়ে তিনি আমাকে চমকে দেন! জোসেফ মরগানের কটেজে তিনি প্রায়ই নানা ধরনের ছোটা-কাজ করেন। মরগান নাকি আফগানিস্তানের পানশীর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে নির্মিত একটি গুলিবিদ্ধ এট্যাক হেলিকপ্টার কিনে এনেছেন। যুদ্ধে জখম হওয়া হেলিকপ্টারটি তিনি সাংগ্রে ডে খ্রিস্ত পাহাড়ে তার বাইশ একরের প্লটে সিমেন্টের প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে স্থাপন করেছেন।
জায়গাটি জংলা ও রিমোট। ওই দিকে আমেরিকান আদিবাসীদের পোয়েভলো বা গ্রাম থাকার ফলে—ওসব জায়গায় নিউ মেক্সিকো পুলিশের ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, পোয়েভলোগুলো মূলত স্বায়ত্তশাসিত, ওখানে নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের পুলিশের ঢুকে পড়ার আইনি অধিকার নেই। ফেডারেল সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হয়তো ওদিকে ঢুকতে পারবে, তবে তাদেরও আদিবাসীদের প্রশাসনিক অথরিটির কাছ থেকে পারমিশন নেওয়ার ঝামেলা ঘাঁটাতে হবে।
হেলিকপ্টার চত্বরে মরগান খোলা আকাশের তলায় একটি পাথরের ফায়ারপ্লেস বানিয়েছেন। তা ঘিরে পূর্ণিমা রাতে বসে মুনলাইট ক্যাম্পফায়ারের মহফিল। সিনিওর সানতসের কাজ হচ্ছে—ক্যাম্পফায়ারের পর ওখানে গিয়ে ছাই ইত্যাদি পরিষ্কার করা এবং শুকনা কাঠের বান্ডিল পরবর্তী মজমার জন্য মজুত করে রাখা। এ ছাড়া ফায়ারপ্লেসের পাশে জংগলে আছে ওপেন এয়ার শাওয়ার-সহ বাথরুম ইত্যাদি, সানতস এসবেরও তদারক করে থাকেন।
হেলিকপ্টার চত্বরের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে সানতস ফিসফিসিয়ে বলেন, মুনলাইট ক্যাম্পফায়ারে জোফেস মরগান নাকি আমোদ-প্রমোদের জন্য জোৎস্না রাতে জড়ো করেন কয়েকটি হিস্পানিক কন্যাকে। মেয়েগুলো মেক্সিকো থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের অপ্রাপ্ত-বয়স্ক সন্তান। হেলিকপ্টারটির দেয়ালগুলোও মরগান সাজিয়েছেন চাইল্ড পর্নোগ্রাফির রুচি-বর্জিত চিত্রাদি দিয়ে।
আমি তাঁর সঙ্গী হয়ে ওখানে গিয়ে চাপলিশে হেলিকপ্টারের একটি ছবি তুলতে চাইলে সিনিওর সানতস রাজি হন। আজকে তিনি সাংগ্রে ডে খ্রিস্ত পাহাড়ে হেলিকপ্টারের গোপন আস্তানায় আমাকে নিয়ে যাবেন—এ রকমের কথা দিয়েছিলেন। টিপি ও লো-রাইডার ভিনটেজ মোটর-কারে শোভিত পার্কে তাঁর দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল! আরও মিনিট কয়েক অপেক্ষা করে অধৈর্য হয়ে আমি তাঁকে টেক্সট করি। জবাবে তিনি একটি অ্যাড্রেস দিয়ে আমাকে ওখানে যেতে বলেন।
এস্পানিওলা শহরের প্রান্তিকে সানতসের দেওয়া ঠিকানা খুঁজে পেতে সমস্যা কিছু হয় না। কাঠের বাড়িটির সর্বত্র নিম্নবিত্ত হিস্পানিক সংস্কৃতির ছাপ। ছাদ থেকে ঝুলছে মেক্সিকান পালাপার্বণে ব্যবহৃত নকশা করা রঙিন কাগজের ঝলমলে স্কয়ার। দুয়ারে নক করতেই ছিমছাম গোছের ফর্সামতো এক নারী দুয়ার খুলে দেন। আমি তাঁর চোখমুখে জমে থাকা বিষাদ দেখতে পেয়ে চমকে উঠি! মনে হয়, এ নারী একটু আগে জননী মরিওমের থানে প্রার্থনা করতে করতে অঝোর হয়ে কেঁদেছেন।
আমাকে কিছু বলতে হয় না। মনে হয়, মহিলা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি ‘বিয়েনবেনিদো সিনিওর’ বলে আমাকে ওয়েলকাম করে নিজের পরিচয় দেন, তাঁর নাম সিনিওরা মারিয়া। আমি তাঁর বাড়িয়ে দেওয়া হাত স্পর্শ করতেই তিনি মৃদু স্বরে বলেন, ‘সানতস এসতা এসপারানডো এন এল পাটিও তারসেরো,’ বা ‘সানতস তোমার জন্য ব্যাকইয়ার্ডে অপেক্ষা করছে।’ সিনিওরা মারিয়ার হাতের ইশারা অনুসরণ করে আমি চলে আসি কাঠের বাড়িটির পেছনের আঙিনায়।
দেখি, সানতস দোলনার ফ্রেমের সামনে ছোট্ট একটি মেয়ের সঙ্গে স্নেহময় খেলায় মশগুল হয়ে আছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে খেলা থামিয়ে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে তিনি আমার সাথে খুব উষ্ণভাবে হাত মেলান। কথায়-বার্তায় জানতে পারি, বাচ্চাটির নাম ভেরোনিকা। ডিভোর্সপ্রাপ্ত সিনিওরা মারিয়া তাকে নিয়ে একাই এ বাড়িতে থাকেন। এখানকার একটি কামরা সানতস সাবলেট নিয়ে রেখেছেন। যখন কাজের চাপ থাকে না, তখন এ বাড়িতেই তিনি বিশ্রাম করেন।
আমাকে কোনো প্রশ্ন করতে হয় না। ভেরোনিকাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে সানতস যেন মারাত্মক কোনো অপরাধ করেছেন, এ রকম কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলেন, ‘লো সিয়েনতো মুচো সিনিওর সুলতান... আই উনা প্রবলেমা...,’ বা ‘যারপরনাই দুঃখিত সুলতান সাহেব, একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে।’ আমি বিরক্তি চেপে মনোযোগ দিয়ে তাঁর ব্যাখা শুনি। না, হেলিকপ্টারের চত্বরে আমাকে নিয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, তিন দিন আগে জোসেফ মরগান জংলা জায়গাটির গাছের ডালে, হেলিকপ্টারের ব্লেডে সর্বত্র ক্যামেরা লাগিয়েছেন। তাঁকে জানানো হয়েছে যে, সিকিউরিটি কোম্পানির ট্রেনিংপ্রাপ্ত একজন এজেন্ট ক্যামেরা থেকে প্রাপ্ত ভিজ্যুয়াল ডেটা বিশ্লেষণ করে সারাক্ষণ মুনলাইট কাম্পফায়ারের থানটিকে নজরে রাখছেন। তিনি আমার দিকে অপরাধীর বোবা চোখে তাকিয়ে থাকলে—আমি যুগপৎ বিব্রত ও হতাশ হই। বুঝতে পারি, মরগানের মুনলাইট ক্যাম্পফায়ার নিয়ে লেখার সম্ভাবনা পকেটের ফুটো দিয়ে সড়কে গলে পড়া আধুলির মতো চিরতরে হারিয়ে গেল। সিনিওর সানতস ফের ক্ষমা চান। আমি কিছু বলি না, তবে বেজায় খিন্ন লাগে।
সিনিওরা মারিয়া ব্যাকইয়ার্ডে এসে ম্লান হেসে এবার ইংরেজিতে বলেন, ‘কামঅন অভার এন্ড হ্যাভ আ কাপ অব কফি। সান্তাফে থেকে ড্রাইভ করে এসেছ, এক পেয়ালা কফি খেলে তোমার ভালো লাগবে।’ আমি সিনিওরা মারিয়ার পেছন পেছন তাঁর সিটিংরুমে ঢুকতে ঢুকতে মহিলার ওয়েলকামিং আচরণ নিয়ে ভাবি। পুরোনো রংচটা সোফায় আরাম করে বসার জন্য তিনি যেভাবে আমার দিকে একটি কুশন বাড়িয়ে দেন, তাতে তাঁকে অনেক দিন পর দেখা হওয়া প্রিয় খালাতো বোনের মতো অন্তরঙ্গ মনে হয়।
সিনিওরা মারিয়া কিচেনে গেলে আমি সিটিংরুমের তাবৎ ডিটেলস্ খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করি। কামরাটির সর্বত্র ছড়ানো ভেরোনিকার খেলনা ও শিশুতোষ বইপত্র। দেয়ালের কাছে একটি কফি-টেবিলে জননী মরিওমের প্লাস্টার অব প্যারিসে গড়া মূর্তি। তার নিচে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর প্রতীক। ঠিক তার তলায় ট্র্যাক-স্যুট পরা একটি কিশোরের ফটোগ্রাফ। ছবিটির কাছেই জলভরা বাটিতে রাখা লাল গোলাপ। আলোকচিত্রে বালকটি ব্যায়ামের ভঙ্গিতে যেভাবে দুদিকে তার বাহু প্রসারিত করে রেখেছে, তাতে তার দাঁড়ানোর আদলে তৈরি হয়েছে যেন আরেকটি ক্রুশকাঠের চিত্ররূপ।
আমি জননী মরিওমের থানে কিশোরের ফটোগ্রাফসটি নিবিড়ভাবে স্টাডি করছি বুঝতে পেরে, সিনিওর সানতস কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘মারিয়ার ছেলে হেকটর, অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা, খুব ভালো বাস্কেটবল প্লেয়ার ছিল, তোমাকে পরে সব খুলে বলব।’
সিনিওর সানতস এবার ভেরোনিকাকে নিয়ে সিটিংরুমের এক কোনায় বসে পাজলের পিস্গুলো জড়ো করে একটির সাথে আরেকটি যুক্ত করার খেলায় মেতে ওঠেন। আমি কাচভাঙা শোকেসের দিকে তাকাই, ওখানে বেশ কয়েকটি রুপার শিল্ড ও কাপ মৃত এক বালকের স্মৃতিতে জানালা দিয়ে এসে পড়া রোদে ঝলমল করছে।
সিনিওরা মারিয়া ট্রে-তে করে কফি নিয়ে ঢোকেন। সাথে ভাপা পিঠার মতো ধোঁয়া ওড়া তপ্ত তমালে। সানতস ট্রে থেকে এক কাপ কফি তুলে নিয়ে ভেতরের কামরায় চলে যান। সামনাসামনি সোফায় বসে মারিয়া কফিতে চুমুক দিয়ে ম্লান হেসে বলেন, ‘সানতস বলেছে তুমি রাইটার, হেলিকপ্টার নিয়ে লিখতে চেয়েছিলে, সরি, সে তোমাকে আজ হতাশ করল।’ প্রতিক্রিয়ায় আমি ‘ইটস্ অলরাইট সিনিওরা’ বলে তাঁর দিকে তাকাই।
দেখি, মারিয়া ঘাড় হেলিয়ে তাঁর প্রয়াত কিশোর পুত্রটির ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি গ্রীবা বাঁকিয়ে ফের আমার চোখে চোখ রেখে বলেন, ‘দেয়ার আর ডিসঅ্যাপয়েন্টমেন্টস ইন লাইফ, সানতস আমাকেও অনেকবার ডিসঅ্যাপয়েনটেড করেছে।’ আমি মৃদু স্বরে বলি,‘ আই আন্ডারস্ট্যান্ড সিনিওরা’, তখনই তাঁর মুখের অভিব্যক্তি আমার করোটিতে সংরক্ষিত স্মৃতিতে তোলপাড় তোলে। মনে হয়, ম্লান এ মুখখানা কোথায় যেন কোনো জাদুঘরে আমি অনেকবার নিবিড়ভাবে অবলোকন করেছি।
হেলিকপ্টারের চাতালে যেতে না পাওয়ার হতাশা আমার মনে গুমরাচ্ছিল, তাই চুপচাপ কফি পান করি। সিনিওরা মারিয়া বা সানতসের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ না জমিয়ে অতঃপর ‘আদিওস’ বলে বিদায় নেই। মারিয়া চৌকাঠের তলায় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘মন খারাপ করে এখনই সান্তা ফে-তে ফিরে যেয়ো না। সানতস তোমাকে এস্পানিওলা শহরের সিটি সেন্টারে নিয়ে যাবে। একটু ঘোরাঘুরি করো। লেখার উপকরণ কিছু না কিছু হয়তো পেয়ে যাবে।’ তাঁর মন্তব্যে এমন এক ধরনের অন্তরঙ্গতা ছিল যে, কেন জানি আমার মন ছুঁয়ে যায়।
সানতসের সঙ্গে সিটি সেন্টারের দিকে হেঁটে যেতে যেতে ফিরে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা মারিয়ার দিকে তাকিয়ে আমি হাত নাড়ি, এবং ফের তাঁর মুখে কোথাকার কোন জাদুঘরের দেয়ালে ঝুলে থাকা কোন তৈলচিত্রে প্রায় পৌঢ় অজানা এক নারীর মুখের বিষাদগ্রস্ত অভিব্যক্তি যেন ঝলসে ওঠে।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে আসি হিস্পানিক কৌমের কবরস্থানের কাছে। যিশুখ্রিস্টের বড়সড় একটি মূর্তির তলায় রট-আয়রনের ফেন্স দেওয়া কবরগুলোতে প্লাস্টিকের রঙচঙে ফুলের প্রচুর তোড়া সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। সিনিওর সানতস পথের পাশে দু-পা এগিয়ে গিয়ে যিশুর মূর্তির দিকে তাঁর গলায় ঝোলানো ক্রুশ চিহ্ণটি তুলে ধরে মৃদু স্বরে প্রার্থনা করেন।
আমাকে কোনো প্রশ্ন করতে হয় না, তিনি ফের হাঁটতে হাঁটতে বলেন, ‘এ গোরস্তানে আমরা মারিয়ার ছেলে হেকটরকে গোর দিয়েছি। সে চলে যাওয়ার পর থেকে আমি আর কখনো মারিয়ার মুখে হাসি দেখিনি।’ আমি এবার কৌতূহল চাপতে না পেরে সরাসরি জিজ্ঞেস করি, ‘কে লে পাসো আ সু ইহো’, বা ‘মারিয়ার ছেলেটির কী হয়েছিল?’
জবাবে সানতসের কাছ থেকে যা শুনি তা হচ্ছে, বারো বছর বয়সে হেকটর বাস্কেটবল খেলতে গিয়ে প্রথম পায়ে আঘাত পায়। চিকিৎসায় ভালো হলে সে ফের খেলতে শুরু করে। বয়স যখন সাড়ে তেরো—পায়ে ঠিক যে জায়গায় সে আঘাত পেয়েছিল, সে জায়গায় ফের ফ্রাকচার হয়। চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সুস্থ না হলে ডাক্তাররা সার্জারি করে। খানিক ভালো হয়ে সে আবার খেলতে শুরু করে, কিন্তু খেলার পরপরই ফিরে আসত মারাত্মক রকমের পেইন, ডাক্তাররা অপিওড বলে আফিমের সারাৎসার থেকে প্রস্তুত একটি পেইনকিলার দেয়। তা সেবন করে হেকটর খেলা চালু রাখে আরও কয়েক মাস।
কিন্তু ছেলেটিকে অপিওডের এডিকশনে পেয়ে যায়। নেশাগ্রস্ত আচরণের জন্য সে বাস্কেটবলের টিম থেকে বাদ পড়ে। তখন হেকটর তার মা মারিয়াকে ব্ল্যাক মার্কেটে অপিওড কেনার পয়সার জন্য চাপ দিতে শুরু করে। মারিয়া পয়সা না দিলে ছেলেটি তার চুল ছিঁড়তো, দেয়ালে মাথা দিয়ে আঘাত করে ফাটিয়ে রক্ত ঝরাত। তো এ রকম অপিওড নিতে নিতে একদিন মাদকের ওভারডোজে তার মৃত্যু হয়। ‘ফুয়ে মুই ত্রিসতে ই ট্যাজিকো সিনিওর সুলতান,’ বা ‘ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক ও ট্র্যাজিক,’ বলে সানতস দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
যে তথ্যের তালাশে এতটা পথ ড্রাইভ করে এসেছি, তা না পাওয়ার হতাশা আবার আমাকে আচ্ছন্ন করে। আমি ওয়াকিবহাল যে—ট্রাভেলে আনন্দ যেমন অঢেল, তেমনি অপ্রাপ্তিও প্রচুর। ভাবি, যা পাইনি তা নিয়ে খেদ না করে বরং এ অব্দি এসে সিনিওরা মারিয়ার সঙ্গে পরিচিত হয়ে যা পাচ্ছি, তাতে মনোযোগ দিলে আখেরে আমি হয়তো লাভবান হবো।