মণিপুরের চোখের মণি
মাটিতে পা দিয়েই অন্য এক রকম অনুভূতি হলো। কেমন যেন আদুরে আদলে পা জড়িয়ে ধরছে ঘাস। আমি ধানখেতের আল ধরে এগোচ্ছি। পেছনে পড়ে আছে বড় রাস্তা। ঝপ করে গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছি ধানখেত দেখে আর এর সাথে করে নেমেছে এক রাজ্যের মেঘ আমার আশপাশে। সামনে ধানখেত পার হলেই পাহাড়, সবুজ পাহাড় নিচু হতে চাইছে কিন্তু কিছুতেই পারছে না। তাই ধানখেত যেন পথ চলতে চলতে পাহাড়ের গায়ে হুড়মুড়িয়ে উঠে গিয়েছে হলুদ সবুজ চাদর হয়ে। পাহাড়ের বুঝি শীত করে না, পাহাড়ের বুঝি গায়ে কাঁপন ধরে না! তখন এই উষ্ণ ধানখেত না থাকলে পাহাড়ের আর কী-বা থাকল।
ভারতের মণিপুর রাজ্যে এসেছি সোজা নাগাল্যান্ড থেকে। আসার আগে কত জনে যে ভয় দেখাল, ওখানে যেয়ো না আন্ডারগ্রাউন্ড উগ্রবাদী দল আছে, ট্যুরিস্ট পেলে তো কথাই নেই জিম্মি করে সরকার থেকে তাদের দাবি আদায় করবে, আরও কত কী। আমি ভাবি, আমি তো ট্যুরিস্ট নই। আমি যখন যে দেশে যাই তখন সে দেশের। আমাকে কেন ধরবে লোকে। আমি নিরীহ গোবেচারা পথিক। দু-দণ্ড বসে চলে যাব, এতে কারও কিচ্ছুটি ক্ষতি হবে না।
মণিপুরের পাহাড়ি পথের আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাছপালার নকশা প্রতি বেলায় বেড়ে চলে, উদারতা শেখায়। আর প্রকৃতি অনেক সময় নিয়ে সেজে বসে থাকে যখন তাকে দেখতে একটিমাত্র মানুষ আসে, সে মানুষটা আমি। আমি উঠেছি রাজধানী ইমফল-এ একটি হোটেলে। আমি ছাড়া বাকি সব স্থানীয় এ হোটেলে। এ শহরে হোটেলও নেই তেমন। যেমনই থাকুক না কেন ছোট, প্রায় জনমানবহীন এ রাজধানী আমায় বুকে তুলে নিয়েছে। সাধারণ মানুষজন কি লুকিয়ে থাকে এ রাজ্যে! একটা বাড়িও দেখলাম না। হোটেলটা কাঙলা ফোর্টের কাছাকাছি। মূল শহর আর বাজার এলাকা এটাই।
ইমফল আসার পথে এক জায়গায় বাস থেমেছিল। জায়গাটার নাম সেনাপতি। ছোট এক মণিপুরি মফস্বল শহর। এত ছিমছাম আর সবুজ। তবে তার চেয়েও অবারিত মনে হয়েছে এর পাহাড়ি সবুজ ঢাল, মানুষের উপচে পড়া সরলতা আর আপ্যায়ন। বাস থেমেছিল খাবারের বিরতিতে। আমি সাধারণ পথিক, খুব বেশি আড়ম্বর নেই জীবনে। সাধারণ মানুষই আমার প্রাণভোমরা হয়ে থাকে।
খাবারের হোটেলটাও ছোট, সিমেন্টের দেয়াল আর টিনের ছাউনি। সিঁড়ি দিয়ে অল্প ওপরে উঠতে হয়। খাবারের চেয়ে আমায় পাহাড় তখন ডাকছিল। এক কোনা দিয়ে রোদের সোনারং ছড়িয়ে পড়ছে, আরেক দিকে দেখি এক মণিপুরি মেয়ে টেম্পল বর্ডারের ফানেক পরে সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ফানেক হলো লুঙ্গির মতো করে পরিধেয় মণিপুরি নারীদের বস্ত্রখণ্ড। গায়ে ব্লাউজ আর রঙিন ওড়না জড়ানো। আমার এক অদ্ভুত কারণে মণিপুরের প্রতি আলাদা করে তোলা ভালোবাসা রাখা আছে। হঠাৎ উছলে পড়ে। আর ভারতের সব রাজ্যের মধ্যে আমার মণিপুরি মেয়েদের সবচেয়ে সুন্দর, নির্মল বলে মনে হয়।
লাইরাগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা
খেয়ে যখন বাসে উঠব তার আগেই আরেক দৃশ্য দেখে মন আরও ভালো হয়ে গেল। এই এলাকার নিরাপত্তার জন্য ভারত সরকার বেশ কিছু সেনাসদস্য মোতায়েন করেছে। তারা মণিপুরের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করে, টহল দেয়। সে রকমই একজন সেনাসদস্য রাস্তায় ডিউটি দিচ্ছিলেন। কোথা থেকে যেন ৪/৫ বছরের এক মণিপুরি বাচ্চা এসে সেনাসদস্যের হাত ধরে টেনে পাশে ছোট দোকানে নিয়ে গেল। চকলেট আবদার করল। সেনাসদস্যের বাড়ি হয়তোবা ভারতের অপর প্রান্তে, কিন্তু এখানে একজন আত্মীয় পেয়ে তিনি মহা খুশি। বাচ্চাটার বাড়ি কাছেই আর অফিসারের ঘাঁটি তার পাশে। বন্ধুত্ব হতে সময় লাগে নাকি!
আজ বাস থেকে দেখা সেই গ্রামে আবার এসেছি। মণিপুরি গ্রাম দেখার লোভ সামলানো গেল না। এ জন্যই তো সেনাপতির মূল বাসস্টপেজে না নেমে একটু এগিয়ে নামলাম। নেমেই পেলাম ধানখেত, যেখানে আলের ঘাসে পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে এগোচ্ছি। শীত চলে গিয়েছে। তবে রাতে ঠিকই জানান দেয়। শিশিরে পা সামান্য হলেও শিহরিত হয়ে উঠতে চাইছে। দুপাশের ধানখেতকে সাক্ষী রেখে আমি এগোই একটু একটু। বাস যে রাস্তায় চলছিল তা কিছু জায়গায় সমতল আবার কিছু জায়গায় ছিল পাহাড়ি। আমি নেমেছি পাহাড়ি পথে। এখন খানিক নিচে নামছি। ধানখেত, জঙ্গল ছাড়া আশপাশে আর কিছুই নেই। এই খেতের মালিক যে কে! পাহাড় কেটে কেটে বিছানার মতো করে ধাপে ধাপে এখানে ধানগাছ লাগানো হয়েছে। সবুজে সবুজে বিশাল এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। এখান থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে একদম নিচেও চলে যাওয়া যায়। আমার উদ্ভট খেয়ালের আর শেষ নেই।
আরেকটু নিচে নামতেই দেখি ধানখেত শেষ হয়ে গিয়েছে আর নিচে নামার পথে তিনটে ঘর বেশ স্বচ্ছন্দে হাওয়ার সাথে হাসাহাসি করছে।
এই জংলি জায়গায় ঘর করে কাদের থাকার সাধ হলো! আমি ঘরের সামনে ঘুরঘুর করতে লাগলাম। মাটির দেয়াল আর ছনের চাল। এমন ঘর এখনো ভারতে আছে, আশ্চর্য তো! কয়েকটা ছাগল চরে বেড়াচ্ছে উঠোনে। এক পাশে মুরগির খোপ, সম্পন্ন গৃহস্থ। মিনিট পাঁচেক পর একটি ছেলে দেখি কোথা থেকে মাটি ফুঁড়ে উদয় হলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
‘এটা কি তোমার ঘর?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমি কিছুক্ষণ এখানে সময় কাটাব, তোমার আপত্তি আছে?’
সরল হাসি দিয়ে বলল, ‘একদম না।’
কিশোরের পরিবার
ছেলেটির নাম কিশোর। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ছেলে। খুব অমায়িক সুরে কথা বলছিল। ঘরের বারান্দায় কাঠের লম্বা বেঞ্চ পাতা, আমি বেঞ্চে বসার আগেই সে একটা চেয়ার এনে দিল। আর সাথে সাথে কিশোরের মতোই মাটি ফুঁড়ে ৮/১০ জন নারী দাওয়ায় এসে দাঁড়াল। এঁরা কিশোরের আত্মীয়। মা, চাচি, ফুফু, বোন—সবাই একসাথে থাকেন, মানে যৌথ পরিবার। এদের নিজস্ব ভাষা মণিপুরি তবে আমার সাথে হিন্দিতে কথা বলছিল।
সদ্য স্নান শেষে অনেকেই পূজা সেরে কানে ফুল গুঁজেছেন। আর কপালে চন্দনের লম্বা টিকা।
মণিপুর রাজ্যে শুনেছি নারীদের জয়জয়কার। নারীরা স্বাধীনতা উপভোগ করেন। এক বন্ধু তো বলেই ফেলেছিল যে, মণিপুরের নারীরা রাস্তায় সুদর্শন পুরুষ দেখলে মাঝে মাঝে নাকি টিজ করে। যাহ বাবা, এ যে দেখছি সুলতানা’স ড্রিম-এর মতো অবস্থা। তবে কিশোরের পরিবারের নারীরা এত দূর যাননি। তাঁরা গরুছাগল, হাঁসমুরগি পালেন। রান্নাবান্না করেন। মাঝে মাঝে বাজারে নিজের বাগানের ফল সবজি বিক্রি করতে যান, বাজার সদাই করেন। তবে তাঁদের নিজেদের সামান্য হলেও কিছু রোজগার আছে। তাঁদের পরনে ফানেক আর ব্লাউজ। কোনো আড়ষ্টতা নেই, চোখে আছে শুধু এক-আকাশ বিস্ময়।
আমাকে মাঝখানে বসিয়ে সবার মধ্যে হইচই পড়ে গেল। আমি এসেছি বড় শহর থেকে। তাঁরা খুবই খুশি। এর মধ্যে জেনে গেলাম বাড়ির বাকি পুরুষেরা এখন খেতে।
আমাকে এরা চা খেতে বলল, আমি না করিনি। মাটির ঘর, মাটির চুলা হলেও বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। চা এল একটা বড় গ্লাসে। দেখে মনে হলো এক গ্লাস দুধ খেতে দেওয়া হয়েছে। খেয়েও তাই মনে হলো। তবে এদের নিজেদের গরুর দুধের চা বলেই এত আগ্রহ ভরে খেলাম। এরপর এরা আমাকে খেত দেখাতে নিয়ে গেল।
ধানখেতে এখন সোনারং ঝকমক করছে। চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে থোকা থোকা সবুজ কোথাও। আলের পর আল ধরে ধানখেতে নারীপুরুষ একসাথে কাজ করেন। এখন অবশ্য কাজ কম। ধানকাটার সময় কাজ অনেক। ধানখেতের পাশে আলুখেতও আছে। আর যত দূর চোখ যায় তত দূর শুধুই পরমাত্মীয় হয়ে থাকা নিশ্চুপ বনানী।
কিশোরের পরিবারের মেয়েদের এতগুলো নাম মনে রাখা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। কিশোরের বোনটি বেশ সপ্রতিভ। ওর নাম মনবি। কয়েক মাস আগে বিয়ে হয়েছে। কিশোরের বউকেও দেখলাম, লাজুক মেয়ে। মনবি আমাকে বলল, কোনোভাবেই আমি দুপুরের খাবার না খেয়ে ওদের বাড়ি থেকে বিদায় নিতে পারব না! এদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য নিজেরও খুব বেশি তাড়া ছিল না।
সেনাপতি শহরে শুটকি মাছের বিক্রেতা
এঁদের সাথেই চললাম তাই এঁদের বাড়ির দিকে। বাড়ির দাওয়ায় এতক্ষণে পাটি পেতে আসন করা হয়েছে। মণিপুরি খাবারে সাধারণত শাকসবজি বেশি থাকে। সবার ঘরের কোণে বাগান করা। সেখান থেকে প্রতি বেলার সবজি পাওয়া যায়।
খাবারের আয়োজন বিশাল বলেই মনে হলো। কয়েক রকমের সবজি, সালাদ আর ডাল। খাবারের অবশ্য নিজস্ব নাম আছে। লাল চালের ভাত পরিবেশন করা হয়েছে কাঁসার থালায়। কাঁসার থালা চোখে দেখলাম সেই শৈশবের পর। এখনো ভারতের পুব দিকের রাজ্যগুলোয় কাঁসার থালাবাসন চোখে পড়ে। মণিপুরি খাবারের অন্যতম অংশ হলো নারি বা শুঁটকি। এটি বিভিন্ন সবজিতে মিশিয়ে চমৎকার তরকারি করে খাওয়া হয়। বাজার ঘুরতে গিয়ে ঝুড়ি ভরতি নারি নিয়ে বসে থাকতে দেখেছি নারীদের। ইমফলের বাজারেও বেশির ভাগ বিক্রেতা নারী।
ভাতের সাথে আছে ইরোম্বা। ইরোম্বা হলো সেদ্ধ সবজির সাথে শুঁটকি আর শুকনো মরিচ গুঁড়া করে মিশিয়ে বেশ নতুনত্ব আনা এক খাবার। সালাদকে বলা হয় সিংজু। এরা সালাদ তৈরি করেছে কুচানো বাঁধাকপি, শুঁটকির গুঁড়া দিয়ে। এর সাথে আছে ডাল আর বড়া। যেকোনো মণিপুরি খাবারের অন্যতম উপাদান হলো এন্নাম পাতা। খাবারের আলাদা স্বাদ আর গন্ধ এনে দেয়। ডালের স্বাদ একেবারে ভিন্ন, তবে কয়েকবার চেয়ে না খেলেই নয়। বড়া তৈরি করা হয়েছিল এন্নাম পাতা দিয়ে। কয়েকটা বড়া খেয়েই লাঞ্চ সারা যায় কিন্তু আমার দিকে এখন জনা দশ/বারোর দৃষ্টি নিবদ্ধ। সমস্ত খাবার শেষ না করে ওঠা যাবে না। মনবা আফসোস করছিল আজ মাছ, মাংস রান্না হয়নি বলে। অবশ্য মাংস এরা বছরে কয়েকবার খায়, মাছও মাসে দু/একবারের বেশি নয়। শুঁটকি আলাদা করে রান্না করা হয় না, বিভিন্ন সবজির সাথে পেস্ট করে মিশিয়ে দেওয়া হয়। সবশেষে গাছের পাকা কলা।
পাহাড়ের দিকে মুখ করে, প্রকৃতি দেখতে দেখতে একদল সরল মণিপুরি নারীর মাঝে বসে খাবার খাওয়ার নিষ্কলুষ আনন্দ আমার এ জীবনে পাওয়া হয়নি। এরা কখনো শহর দেখেনি। লাইরা নামক গ্রামে জন্ম, এ গ্রামেই মৃত্যু। এতে এদের কোনো খেদ নেই। প্রকৃতিও চায় না স্বকীয়তা হারাতে, তাই কোথাও পাঠায় না।
আমি এ বাড়ি থেকে উঠতে না চাইলেও সন্ধ্যের পর গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায় মূল সড়কে। তাই বেলা পড়তে পড়তে বিদায় নিতে হলো লাইরা গ্রাম থেকে। কিশোরের পরিবারের খুব ইচ্ছা, আমি যেন তাদের সাথে থাকি। হয়তো পরে কোনো এক সময়। পরের কোনো ভ্রমণে।
এই গ্রাম, এই পাহাড়, এই সজীবতা এখন নির্লোভ প্রার্থনায় মগ্ন। এক আবেশে নিভু নিভু রোদ করছে প্রকৃতির বন্দনা। আর প্রকৃতি কি সূর্য ছাড়া পথ চলেছে কখনো। আমি পথ চলতে চলতে দেখি প্রকৃতি আর সূর্যের সেই মাখামাখি, মণিপুরি নারীরা যেমন মেখে আছে আমার মনের সাথে।
অসাধারণ লিখেছেন । শুভ কামনা সবসময় ।
Rafique Meeraaj
ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২২ ২৩:৩২