বড়দের জন্য রূপকথার এক মহাগপ্পো
ছোটবেলায় রূপকথার গল্প পড়তে কার না ভালো লাগত—আমারও বেশ প্রিয় ছিল। দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের ঠাকুরমার ঝুলি, এডগার রাইস বারোজের টারজান কিংবা হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের সেরা গল্প সংকলন একবার খুলে বসলে কবে যে সময় গড়িয়ে যেত! তার সঙ্গে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কেনা এক টাকা দামের রাক্ষস বা ভূতের গল্পের চটি বইগুলো তো ছিলই।
কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কাছে ‘আরব্য রজনী’র গল্পগুলোকেও পানসে লাগে। উপেন্দ্রকিশোর রায়ের ‘পান্তাবুড়ির গল্প’কেও আর ভালো লাগে না। লাল টাট্টু ঘোড়ায় চড়ে রাজকুমারীকে উদ্ধার করতে যাওয়া রাজকুমারের গল্প কবেই মন থেকে মুছে যায়! বয়স বাড়ার এই এক যন্ত্রণা। তাহলে বড়দের জন্য রূপকথা নেই কেন? তেমন সব গল্প, যেখানে সুয়োরানী-দুয়োরানীর কষ্টের কষ্টিপাথর আমাদের ছুঁয়ে দেবে। তেমন সব লেখা, যা গল্প-উপন্যাস নয়; একেবারে খাঁটি রূপকথা। যার সব চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবের কঠিন জীবন নেই। তবে চলমান পৃথিবীর অনেক কিছুর সঙ্গে মিল রয়েছে। কল্পনার রঙিন স্বপ্ন বুনে একটু সতেজ নিশ্বাস ফেলা যায়—তেমন সব গল্প।
‘টিয়াদুর’ নামে এমন এক গল্পের সন্ধান অবশেষে পেলাম। নাম শুনে কী ভাবছেন? এটা কোনো পাখি নাকি প্রাণী? দুটোই। টিয়া+বাদুর। আকাশে চরে। থাকে বোবাডোম নামের বৃক্ষে। এবারও নিশ্চয় অবাক হচ্ছেন! এমন গাছের নাম কস্মিনকালেও শুনেননি! এবার বলি লেখকের নাম—ইচক দুয়েন্দে। নামটাও হয়তো অপরিচিত লাগছে? পূর্ব ইউরোপের বা লাতিন আমেরিকার কোনো লেখক মনে করছেন না তো? মনে হওয়ায় স্বাভাবিক। লেখক বাংলাদেশেরই। আশির দশকে যারা লিটলম্যাগ আন্দোলনের খবরাখবর রাখতেন, তাঁদের যে কাউকে বললেই উনার পরিচয় পেয়ে যাবেন। ‘টিয়াদুর’ তার অনন্য সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যে এমন কল্পনাশ্রিত বড় গল্প লেখা আগে হয়েছে কি না আমার অজানা। এই আখ্যান রূপকথার এক মহাগপ্পো। যেখানে একবার প্রবেশ করলে আপনি হারিয়ে যাবেন কল্পনার জগতে।
কেনিয়ার বিখ্যাত পোস্টকলোনিয়াল তাত্ত্বিক গোয়ে ওয়া থিয়োঙ্গে লেখালেখির প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘কল্পনা ছাড়া কোনো প্রকৌশল বা প্রযুক্তি নেই। বাস্তবে রূপায়িত হওয়ার আগে এগুলো প্রথমে মনে কল্পিত হয়। শিল্প স্বয়ং কল্পনার পণ্য এবং পরে পুষ্টিতে পরিণত হয়।’ থিয়োঙ্গের এই বক্তব্য টিয়াদুরের ক্ষেত্রে স্মতর্ব্য। যে বইয়ের নাম খুব কম লোকই জানেন, তার আলোচনার শুরুতে কেন এত ভূয়সী প্রশংসা? কী আছে এই বইয়ে? জানার আগে চলুন পাঠক-পাঠিকা, টিয়াদুরের প্রথম অধ্যায় ‘তরুমা চি’র শুরুর কয়েকটা লাইন পড়া যাক—‘আনন্দ। তাহ্তি দুর্দিক আসার পর থেকে ঝিমকাননে বৃষ্টি ঝরছ তো ঝরছেই। দুর্দিকচিরমা আড্ডায় মশগুল। ‘ঈল্লিচিল্লি চৌদ্দভুজ’ বহুকাল পর আনন্দে নাচে।’
তাহ্তি দুর্দিক ও দুর্দিকচিরমা—এই গল্পের চরিত্র। চৌদ্দভুজকে আপনি গৃহজাতীয় কোনো কিছু হিসেবে কল্পনা করে নিতে পারেন। এই গপ্পের সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, লেখক কল্পনার সবকিছুকে আপনার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। বাংলা ভাষায় রচিত হলেও এই আখ্যানের চরিত্রের নামগুলোকে আদিবাসীদের মনে হতে পারে। সাড়ে তিনশ পৃষ্ঠার বইটিতে ৪৩টি অধ্যায়। আর চরিত্রের সংখ্যা অসংখ্য। মনে রাখার পক্ষে কষ্টকর, এটাই হয়তো এই গল্পের কঠিন দিক। লেখক চরিত্রগুলোকে নিয়ে এক গোলকধাঁধা বা ব্যূহচক্র তৈরি করে পাঠকের সঙ্গে এক খেলা খেলতে চেয়েছেন। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা ক্লান্তিকর ও অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। তবে কোনো চরিত্রকে বিকশিত হতে দেননি। তা হয়তো সজ্ঞানে।
টিয়াদুরের স্থানের নামগুলোও একেবারে আমাদের চেনামণ্ডলের বাইরে। মনে হবে, সবকিছু মিলিয়ে লেখক ভাষা ও নাম নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে চেয়েছেন। কিংবা আমাদের চেনা জগৎকে নাড়া দিতে। মনে করেন, যা দিয়ে আমরা দেখি, তাকে চোখ বলছি। ইংরেজিতে ‘eye’। ম্রো-রা একে কী বলে? আমরা জানি না। কিংবা অতীতের কোনো জনগোষ্ঠী একে অন্য নামে ডাকত হয়তো। ভবিষ্যতে ডাকবে অন্যভাবে। চরিত্র-স্থান চেনা জগতের না হলেও আমাদের চারপাশের ঘটনাগুলোর সঙ্গে টিয়াদুরের ঘটনার মিল খুঁজে পাবেন সহজে। যেমন একটা জায়গার নাম বলা যাক—সুসানজিফ্রো। এখানেও রয়েছে সংসদীয় ব্যবস্থা। সরকারি-বিরোধী দল। পক্ষ-প্রতিপক্ষের কাদা ছোড়াছুড়ি। বিপ্লবী ও ঝটিকা বাহিনী। বিশ্ববিদ্যালয়।
কেনিয়ার বিখ্যাত পোস্টকলোনিয়াল তাত্ত্বিক গোয়ে ওয়া থিয়োঙ্গে লেখালেখির প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘কল্পনা ছাড়া কোনো প্রকৌশল বা প্রযুক্তি নেই। বাস্তবে রূপায়িত হওয়ার আগে এগুলো প্রথমে মনে কল্পিত হয়। শিল্প স্বয়ং কল্পনার পণ্য এবং পরে পুষ্টিতে পরিণত হয়।’ থিয়োঙ্গের এই বক্তব্য টিয়াদুরের ক্ষেত্রে স্মতর্ব্য। যে বইয়ের নাম খুব কম লোকই জানেন, তার আলোচনার শুরুতে কেন এত ভূয়সী প্রশংসা? কী আছে এই বইয়ে? জানার আগে চলুন পাঠক-পাঠিকা, টিয়াদুরের প্রথম অধ্যায় ‘তরুমা চি’র শুরুর কয়েকটা লাইন পড়া যাক—‘আনন্দ। তাহ্তি দুর্দিক আসার পর থেকে ঝিমকাননে বৃষ্টি ঝরছ তো ঝরছেই। দুর্দিকচিরমা আড্ডায় মশগুল। ‘ঈল্লিচিল্লি চৌদ্দভুজ’ বহুকাল পর আনন্দে নাচে।’
এবার একটু ঘটনায় আসা যাক—সর্তেবাঠার পরীর মেলা হচ্ছে। চিরমা চি ও দুর্দিক সেখানে যায়। খবর আসে, অ্যাটম বিস্ফোরণে মেলায় আসা সবাই মারা গেছে। তাদের খুঁজতে যায় আত্মীয়স্বজন। কারও সন্তান হারিয়েছে তো কারও ভাই। সবাই তাদের খুঁজে সর্তেবাঠার পরীর মেলায় আসতে থাকে। কিন্তু মৃত্যুর খবরেও মেলা বন্ধ নেই। স্বজনদের খুঁজতে আসার মধ্যে কারও প্রেম হয়, কেউবা রাজনীতিতে জড়ায়। কেউ বিপ্লবের বার্তা দেয়। কেউ ফেরে মৃত্যুর মুখ থেকে। তার মধ্যে হাজির ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়াদুর। পঙ্গপালের মতো আকাশ ছেয়ে যায়।
পুরো গল্পটি রূপকভাবে বর্ণিত। অ্যালিগরিক্যাল। উপজীব্য মূলত রাজনীতি-সমাজ বাস্তবতা। কল্পরাজ্যের ভেতর দিয়ে বাস্তব সময়ের চিত্র অংকন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ চলচ্চিত্রটি দেখা থাকলে কল্পরাজ্য কেমন হয়, তার ধারণা পাবেন। সময়ের উল্লেখ না থাকলেও টিয়াদুরের কাহিনি আধুনিক সময়ের মনে হবে। কারণ, আধুনিক যুগের হেলিকপ্টারের পাশাপাশি রয়েছে ‘অজগর যান’ নামের এক বিশাল এক কাল্পনিক বাহনও। অস্ত্র হিসেবে বলা হচ্ছে অ্যাটমকে। হাস্যরসের সঙ্গে গভীর তত্ত্বমূলক কবিতাও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ‘তিন্দব সংঘ’ নামে এক সংগঠন আছে। যাদের কাজ পকেট মারা। তাদের রয়েছে জাতীয় সংগীতও। আর রয়েছে ‘সর্তোবাঠার পরীর মেলার পাশে দুরটিপঞ্চ গ্রামে নিখিল সুসানজিফ্রো সর্বজনীন বস্ত্রপ্রসার সংঘ’। এমন লাইন পড়ার পর হাস্যরসের উদ্রেক করলেও মূলত এর ভেতর দিয়ে এক রাজনৈতিক আখ্যান রচিত হয়েছে টিয়াদুরে। সঙ্গে রয়েছে ভালোবাসার কথাও।
লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তবতা বা ইউরোপের সুররিয়ালিজমের যে জয়গান, বঙ্গদেশের সাহিত্যে তার ছায়া পড়েছে অনেক আগে। তবে সম্পূর্ণ কল্পনাশ্রিত টিয়াদুরের ক্ষেত্রে এসব কোনো তকমাই জুড়ে দেওয়া যায় না। এই গল্প ভিন্ন আঙ্গিকের। বাস্তব, আবার অবাস্তবও। অলৌকিকও নয়। কোনো ইজমে ফেলার আগে ভাবতে হবে, টিয়াদুর কোনো শ্রেণির গপ্প। গপ্প নাকি উপন্যাস? নাকি কিছুই নয়। অর্থাৎ, আয়নার যে সত্য, তা তো মূল সত্য নয়। আয়না আমাদের ডানকে বামে, বামকে ডান দিয়ে দেখায়। একটি শব্দ বা লাইনকে আয়নার সামনে ধরলে যে চিত্র আমরা পাই, তাই হয়তো টিয়াদুর।
টিয়াদুরের ‘চি ও উইচি’ নামের ৪১ নং অধ্যায়ের একটি কবিতাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যাক। বলে রাখা ভালো, চি ও উইচি মূলত টিয়াদুরে বর্ণিত কবিতা। আমাদের যেমন ছড়া-কবিতা-উপন্যাস; তেমনি সুসানজিফ্রোর কবিদের সাহিত্যে রয়েছে চি ও উইচি।
‘চি/ধবো/নঞ্জরনি/নজ্ঞা/হেন/নজ্ঞা/ণপুরূনি/দভে/মনা/নকংমানা/মনা’—এবার আয়নার সামনে ধরুন। অবশ্য ইচক দুয়েন্দে এ ক্ষেত্রে পাঠককে কষ্টে ফেলতে চাননি। নিচেই খোলাসা করেছেন সবকিছু। এই কবিতার উল্টো দিক—‘নাম নামাংকন নাম ভেদ নিরূপণ জ্ঞান নহে/ জ্ঞান নিরজ্ঞন বোধ।’ এর ইংরেজি অনুবাদও দিয়েছেন নিচে—
`name naming to differentiate names
not knowledge
knowledge is pure feeling’
তো এমন নামের রহস্যেঘেরা মহাগপ্পো টিয়াদুর। যার পরতে পরতে রয়েছে ধাঁধা, রাজনীতি, প্রেম ও ঠাট্টা। শুরুতেই চোখের সামনে দেখবেন বড় বড় ফন্টের অক্ষর। মনে হবে, কোনো মফস্বলীয় ছাপাখানায় ছাপানো। এমন সাইজের ফন্ট সচরাচর কোনো বইয়ে চোখে পড়ে না। এখানেও লেখক প্রচলতাকে পাশ কাটিয়ে গেছেন। রাজশাহী থেকে পেঁচা সম্পাদনা পর্ষদের পক্ষে মুহাম্মদ শামসুল কবীর কর্তৃক প্রকাশিত টিয়াদুর। মুহাম্মদ শামসুল কবীর এবং পেঁচা ছোট কাগজের নামখানা নিশ্চয় যৎকিঞ্চিৎ পাঠকের যৎকিঞ্চিৎ পরিচিত ঠেকতে পারে। সব ছাপিয়ে টিয়াদুর বাংলা সাহিত্যের অনন্য এক সংযোজন বলা যায়। তবে এই বই শেষ করার জন্য আপনার বেশ ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে। আর কে না জানে, ‘ধৈর্যের ফল সুমিষ্ট হয়’।