টানটান উত্তেজনার ১০০ দিন
শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছি গ্রামে। সেই জন্মস্থান শহর ঢাকা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। তবু সেখানে কমিকস পড়ে বড় হওয়ার মতো সুযোগ ছিল না। সেবা প্রকাশনীর রোমাঞ্চ কাহিনি পাঠ করে কৈশোর যাপনের অভিজ্ঞতা হয়নি আমার। পাঠের অভ্যেস হয়েছে তাই বিক্ষিপ্ত কায়দায়। নানা কিছুর সংস্পর্শে। সেটা কখনো আট ক্লাসের দ্রুতপঠনের গল্প। কখনো সংবাদপত্রের সাময়িকী। কখনোবা আরবের সেই হাজার রাতের কাহিনির কিশোর সংস্করণ পড়ে। আর অনেক অনেক পড়েছি শরৎ, হুমায়ূন, মিলন—এ ধারার নানা উপন্যাস।
তবে মাধ্যমিকের বয়সেই আচমকা নাগালে আসে প্রতিবেশী পরিবারের সংগ্রহে থাকা রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুর। সেটা গিলেছি গোগ্রাসে। পরে মাসুদ রানা, তিন গোয়েন্দার মতো থ্রিলার কিংবা মুহম্মদ জাফর ইকবাল রচিত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি কিছু কিছু পড়া হয়েছে। শহরে এসে বড়বেলায়ও বুঁদ হয়ে পড়েছি সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা। শরদিন্দুর ব্যোমকেশ বক্সীর একটা-দুটো পড়েছি। যা ধ্রুপদি সাহিত্য হিসেবে খুব সহজেই কবুল করা যায়।
হালে কাহিনির চেয়ে আমাকে বেশি টানে ইতিহাস আর আত্মকথাজাতীয় বই। কিন্তু রুচি বদলের মতো ভিন্ন কিছুও মাঝে মাঝে পড়তে হয়। তেমন ভাবনা থেকেই পাতে তুলে নিয়েছিলাম গোলাম কিবরিয়ার লেখা রোমাঞ্চ-কাহিনি কিয়নগজি ১০০ দিন বইখানি।
নামে থাকা ‘কিয়নগজি’ শব্দটি কিন্তু বাংলা নয়। এটি চয়ন করা হয়েছে সোহাইলি ভাষা থেকে। এই ভাষাভাষীরা আফ্রিকার আদিবাসী। এখানে একটু বলতে হয়, আমরা যে ইংরেজি ডেঙ্গু শব্দ বাংলা করে নিয়েছি, সেটা কিন্তু স্প্যানিশ শব্দ। স্পেনে এসেছে আবার সোহাইলি থেকে। ডেঙ্গুর পর তাই সোহাইলি দিযেছে আমাদের—কিয়নগজি। যার অর্থ নেতা, ইংরেজিতে লিডার। নেতা যেখানে থাকে, সেখানে রাজনীতি থাকবেই। চলবে আসবে রাষ্ট্র, সরকার, অর্থনীতি ও পুঁজি—এমন নানা কিছু। এ ধারার নানা চরিত্রের সমাবেশ হয়েছে গোলাম কিবরিয়ার রোমাঞ্চকর এই আখ্যানে। যা পড়তে পড়তে ঘুরতে হয় অন্তত তিনটি মহাদেশ—এশিয়া, আমেরিকা আর আফ্রিকা।
কাহিনির মূল কেন্দ্র আফ্রিকার এক দেশ। যেখানে আছে অনুদঘাটিত অনেক খনিজ সম্পদ। যাতে চোখে পড়েছে আমেরিকার ধনকুবেরদের। কিন্তু সেই দেশে রাষ্ট্রপতি ওমাগো হাতুই কঠিন জাতীয়তাবাদী। বিদেশি বিনিয়োগের পক্ষপাতী নন। তাকে সরানো ছাড়া পশ্চিমা বণিকদের বাণিজ্য ঘাঁটি করার কোনো উপায় নেই সেখানে। তাই আমেরিকায় বসে দীর্ঘমেয়াদি ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পাতে আন্তর্জাতিক চক্র। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় ছোট্ট সেই দেশটির সামরিক-বেসামরিক বিশ্বাসঘাতকগণ। অজান্তেই চক্রের হাতের পুতুল হতে হয় বাংলাদেশি যুবক জায়েদকে। প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে বানানো হয় সমরনায়কদের মতো সামর্থ্যবান। শেখানো হয় সোহাইলি ভাষা। তারপর চক্রের নির্দেশমতো জায়েদকে পাড়ি দিতে হয় দুর্গম বন। প্রাণ হাতে নিয়ে সেই বিপৎসঙ্কুল পথ পেরিয়ে অবশেষে আফ্রিকার ছোট্ট দেশে পৌঁছে যান তিনি। সেখানে এবার কৌশল করে ক্ষমতার মসনদে বসে যাবেন বাংলার জায়েদ। ষড়যন্ত্রকারীদের ইচ্ছেপূরণের অনেক কাছে চলে যান তিনি। রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানে জীবন শেষ হবে আসল প্রেসিডেন্টের। মুনাফালোভী বিশ্ব-বণিকদের পুতুল একজন তার স্থলে আসবেন। যিনি দেশ-দশের বদলে পশ্চিমাদের স্বার্থ রক্ষায় বেশি তৎপর থাকবেন। কিন্তু একজন বাঙালি কীভাবে সোহাইলিদের রাষ্ট্রপ্রধান হবেন? কী সেই কৌশল নিয়ে এগোচ্ছেন জায়েদ? তিনি কি শেষকালে তাদের সেই লোভের প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকেই হাঁটবেন? নাকি বিবেকের দংশন থেকে ঘুরে দাঁড়াবেন? কোন পথ ধরলেই বা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রীদের হাত থেকে নিজের জীবন বাঁচাতে পারবেন জায়েদ?
এমন নানা হিসাবের মধ্য দিয়ে বইখানিতে রোমাঞ্চকর আবহ তৈরি করেছেন গোলাম কিবরিয়া। যেখানে তার সৃষ্ট চরিত্র হিসেবে সক্রিয় পার্ল, ওমাগো হাতুই, জায়েদ, কাকাবুয়া মুরুয়া, মালিনা নেফ্রিদা প্রমুখ। তবে লেখক ঘটনাপ্রবাহ এগোতে নিয়েছেন ভিন্ন কৌশল। আমি নিশ্চিত, শুরুর কিছু অধ্যায় খাপছাড়া মনে হবে পাঠকদের। যেখানে প্রতিটি চরিত্র যেন আলাদা, গল্প আলাদা—যেমন রয়েছে আলাদা আলাদা দেশ আর মহাদেশও। তারপর এগোলে আঁচ করা যায় সব চরিত্র ধীরে ধীরে আলাদা সুতো দিয়ে হলেও আসলে একই কাহিনি বুনে চলেছে, যা এগিয়ে যায় গহিন অরণ্যের ভয়ঙ্কর পরিবেশ-প্রতিবেশ পেরিয়ে। তাই জঙ্গলযাত্রায় যারা রোমাঞ্চ তালাশ করেন, তাদের কাছে দারুণ লাগবে বইটির পাতার পর পাতা।
যারা হলিউডের মারদাঙ্গা ছায়াছবির বিনোদন পেতে চায় বই পড়ে, তারাও হতাশ হবে না—নিশ্চিত করেই বলতে পারি। যেখানে শেষ দিকে এসে জায়েদের প্রাণরক্ষার লড়াই অ্যাকশনধর্মী সিনেমার মতোই দৃশ্যমান হয়ে যায় চিত্রকল্পময় বিবরণে। তবে এই অংশ কিছুটা আরোপিত মনে হতে পারে। কারণ, মূল কাহিনি বলা যায় এর আগেই শেষ হয়ে গেছে। তাই অ্যাকশন বিবরণী না থাকলেও কিছু আসত-যেত না। অবশ্য নিয়মিত যাঁরা রোমাঞ্চ-আখ্যান পড়েন, তাঁদের কাছে এর প্রয়োজনীয়তা থাকতেও পারে। লেখক তেমন পাঠকদের কথা ভেবেই হয়তো শেষ ধাপে এসে মারদাঙ্গার বিষয়টি যুক্ত করেছেন।
অ্যাকশনের বিনোদনপিয়াসীরা তো বটেই, এর বাইরে যাঁরা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র নিয়ে আগ্রহী, জানতে চান পৃথিবীজোড়া অন্ধকারজগতের বিবরণ, তাঁরাও অনেক উপকরণ পাবেন কিয়নগজি ১০০ দিন বইয়ে। বিশ্বরাজনীতির বাস্তবতাও যে এতে নেই, সেটাও কিন্তু বলা যায় না। সম্প্রতি যেভাবে হাইতির প্রেসিডেন্টকে তাঁরই বাসভবনে হত্যা করা হলো, তারই পরাবাস্তবতা যেন আগেভাগেই রচনা করে রেখেছেন গোলাম কিবরিয়া।
এখানে আরও একটি বিষয় বলতে হয়, আমাদের দেশে রোমাঞ্চ-কাহিনির পাঠকগোষ্ঠী বিশাল। সেটা সদ্য প্রয়াত কাজী আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে নানা বয়সী পাঠকের স্মৃতিচারণা থেকেই আঁচ করা যাচ্ছে। অথচ মাসুদ রানার স্রষ্টাও মূলধারার সাহিত্যমহলে সেভাবে সমাদর পাননি। এর দায় কিন্তু কিছুটা এ-জাতীয় লেখকদের কাঁধেও দিতে হবে। কারণ, দস্যু বনহুর, মাসুদ রানা রচনার ক্ষেত্রে ঘটনা যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, সেভাবে গদ্যশৈলী নিয়ে ভাবেননি লেখকেরা। তাই পশ্চিম বাংলার ফেলুদা, ব্যোমকেশ বক্সীতে যেভাবে অনবদ্য গদ্যও মেলে, সেটার ঘাটতি আছে বাংলাদেশের রোমাঞ্চ-কাহিনিতে। কিয়নগজি ১০০ দিন-এর শুরুতে অবশ্য গদ্যশৈলী নির্মাণের প্রবণতাও লক্ষ করা যায়। একটু পাঠ করে নিতে পারি বইখানি-
সমুদ্রের সামনে দাঁড়ালে নাকি মন উদার হয়, জগতের যাবতীয় ক্ষুদ্র-তুচ্ছ বিষয়গুলো মন থেকে দূর হয়ে যায়, মন হয়ে উঠে আকাশের মতো বিশাল, সমুদ্রের মতো অবারিত-উদার। কোনো এক উপন্যাসে লেখক বলেছিলেন, নামটি মনে পড়ছে না, তবে সমুদ্রের সামনে এলেই কথাগুলো মনে পড়ে।
কিন্তু এ ধরনের বিবরণ রয়েছে কেবল প্রথম কিছু অধ্যায়ে। তারপর কাহিনিতে উত্তেজনা যত বেড়েছে, বিপরীতে গদ্য আর টানটান থাকেনি, অনেকটা শিথিল হয়ে গেছে। অবশ্য দীর্ঘ একটি কাহিনিতে গদ্যশৈলী একই ধারায় টেনে নিয়ে যাওয়া কঠিন কর্ম। বিশেষত যেখানে নজর বেশি রাখতে হয় থ্রিলারের ঘটনায়, যাতে কোনো ছন্দপতন না হয় সেদিকে। রকমারি চরিত্রের আচরণ, আর কাহিনির পরম্পরা যাতে গাণিতিক হিসাবের মতোই ঠিক থাকে। সম্ভবত গোলাম কিবরিয়া এসব দিকেই বেশি চোখ রেখেছেন শেষার্ধে এসে। অ্যাকশনধর্মী একটি চিত্রকল্প নিয়ে কাজ করতে গেলে গদ্য নিয়ে ভাবার জন্য অবকাশ পাওয়া কিন্তু কঠিনই। দেখে নিতে পারি বই থেকে—
সেকেন্ডের ভগ্নাংশে কুঁজো হয়ে বসে পড়ে একপাক ঘুরে ব্র্যাডের তলপেটে মোক্ষক একটা পাঞ্চ জমিয়ে দেয় জায়েদ। এটার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না ভাড়াটে খুনি। হাত দুটো উপরে এবং ব্যস্ত থাকায় বাধা দেয়ার সুযোগটুকু পায়নি। মোক্ষম আঘাতে হুস করে পেট থেকে সব বাতাস বেরিয়ে যায়। আঘাতের ধাক্কাটা তাকে পিছিয়ে দেয় কয়েক পা। আর এই সুযোগে পজিশন নিয়ে নেয় জায়েদ।
আলোচ্য আখ্যানের একটি ঘাটতি কিন্তু বেশ পীড়াদায়ক। সম্ভবত সুসম্পাদনার ছোঁয়া পায়নি বইটি। সেই কারণে সাধারণ বানান ভুল খুব বেশি চোখে লাগে। আর লেখকের কিবোর্ডের আঙুল-চালনাজনিত ভুলগুলো শোধরানো হয়নি। পরে সংস্করণে এসব ঘাটতি মেটানো অবশ্য-প্রয়োজন।
তবে এ ধরনের বই পাতে তুলে নিতে হবে একেবারে বিনোদন গ্রহণের জায়গা থেকে। কারণ, ভাষার কারুকাজ কিংবা সাহিত্যের স্বাদ নিয়ে বেশি ভাবতে গেলে কাহিনির মজা থেকে হতে হবে বঞ্চিত। সেই বঞ্চনার শিকার হতে কেই-বা চায়!