কবিতায় রুপালি স্থাপত্য
কবিতা আসলে কী? কাকে বলে কবিতা? কবিতা হয় কীভাবে? এমন অসংখ্য প্রশ্ন তোলা যায় এবং সেসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে গবেষকেরা দীর্ঘ গবেষণা করতে থাকুন। এ নিয়ে পাঠকের তেমন মাথাব্যথা নেই। একজন পাঠক হিসেবে কবিতার ক্ষেত্রে প্রথম শর্ত ভালো লাগতে হবে, আমাকে ভাবাবে, আমাকে স্পর্শ করবে। কামিনী ফুলের গাছের পাশ দিয়ে যাবার সময় যেমন মিষ্টি একটা গন্ধ আমাদের আপ্লুত করে একটি ভালো কবিতাও তাই—আপ্লুত করবে। ঝরাপাতার র্যাপসোডির কবি লায়লা ফারজানার বইটির পাতা ওল্টাতে গিয়ে থেমে যেতে যেতে, আবার পথ চলতে শুরু করি। দূর থেকে একটা শিল্পের নান্দনিক গন্ধ নাকে লাগে, কিছুটা আবেশিত হই। র্যাপসোডি শব্দের যে অর্থ তা যদি বলি অনুভূতির ধ্রুপদি প্রকাশ, তাহলে বলতেই হয়, এই গ্রন্থে ঝরাপাতার আড়ালে কবি তার উত্তর আধুনিক মন ও মননের ধ্রুপদি প্রকাশ ঘটিয়েছেন। যদিও অনেক কবিতায় তিনি ইংরেজি শব্দ বা শব্দবন্ধ ব্যবহার করে একদিকে যেমন বাংলা ভাষার সাবলীল স্রোতকে রুদ্ধ করেছেন, একই সঙ্গে তিনি তার বৈশিক অবস্থান, অর্জিত জ্ঞানকাণ্ড স্থাপত্যবিদ্যার অভিজ্ঞতালব্ধ শিল্পিত নানা কৌণিক ও অবস্থানিক ভঙ্গিমা রং ও রূপকের খেলায় খুব নীরবে আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছেন। তিনি যখন লেখেন—
স্বর্গে এসে দাঁড়ালাম— নরম উজ্জ্বল আলো
নিয়ন আর এলইডির মাঝামাঝি।
ক্যাডমিয়াম ইয়েলো আর
টাইটেনিয়াম হোয়াইটের হালকা টোন
সাথে একটু মেঙ্গানিজ ব্লু
[জল বুদ্ধুদ ক্লোজড সেল]
এইভাবে চোখধাঁধানো রঙের খেলা তাঁর কবিতায়-পাঠকের সামনে ছবি তৈরি করে। কখনো রঙের ঘোরে পাঠক বিভ্রান্তও হয়। মনে হয় তিনি শিল্পীর চোখ দিয়ে দেখেছেন আর তুলির পরিবর্তে অক্ষর কিংবা শব্দ দিয়ে এঁকেছেন। রং আর ভাষা একাকার হয়েছে। ঝরাপাতায় এমন অসংখ্য কবিতা রয়েছে। কবিতাগুলো ছবি তৈরি করে। মনে হয় লুভের মিউজিয়ামে বিখ্যাত কোনো শিল্পীর ছবি সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
আমার কুইন-ম্যাজেন্টা ফ্রকে
ছোট ছোট তরঙ্গের মতো মায়ের হাসি—
জল-বুদ্ধুদের মতো আছড়ে ভাঙে
আবার ভাসে আবার মিলায়,
তাঁর উপমাও অসাধারণ কিন্তু সেটি ধরতে পাঠককে স্থাপত্যবিদ্যার স্বরে-অ স্বরে-আ জানা থাকলে সুবিধা হয়। রঙের পাশাপাশি সংখ্যায়, কোণ, সময়, মানবসভ্যতা ও শিল্পের নানা অনুষঙ্গ ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়—
রাত একটা বেজে তিন
বিছানায় তোমার একটা ধারণা নিয়ে আছি।
অথচ এলে না।
কিংবা
প্রেম তো কিছুই না। কথোপকথন
দুটি কাঁটার মাঝখানে এক প্রস্ত, রঙিন উল।
তো বলছিলাম ঝরাপাতার কবি শব্দ দিয়ে ছবি আঁকে। দৃশ্য তৈরি করে—সেটা যেন চলমান দৃশ্য, তাকে আবার তিনি যুক্ত করেন চিত্তের সাথে। মনের অনুভূতি নিয়ে আঁকা ছবিতে ইজেল উপুড় করে ঢেলে দেন সমাজ ও বাস্তবতার রং—
চারপাশ শান্ত, বাজারের থলে
তিনটি টিয়া। হাতে তিনটি নুড়ি
সকালে কাজ নেই। স্বাক্ষরের অপেক্ষায়
একটি ডিভোর্স পেপার আর একটি
কাবিননামা। শেরওয়ানির মাপ নেয়া বাকি।
বাকি কিছু বাড়ি ভাড়া।
‘ফিনিক্স’ যেমন ছাই থেকে শুরু করে, লায়লা ফারজানাও তেমনি পোড়া ছাইয়ের অতলান্ত থেকে শুরু করে ‘ফুলস্টপ মুছে আবারও সেমিকোলন করে’ দেন। তিনি পাতালে পার্সিফোনের গোঙানি, পুরানের হেডেস, স্টিফেন কিঙের ক্রাইমসন রাজার আদালত ঘুরে, মায়া-ইনকা, মেসোপটেমিয়া [চন্দ্রগ্রহণ] সভ্যতা ইডিপাস, ম্যাকবেথ, রুশোর কালো বিড়াল ভ্রমন শেষে কলোনিয়াল হ্যাংওভারে জেগে দেখেন—করোনায় লকডাউন হওয়া পৃথিবী। এই লকডাউনও তিনি আনলক করে দেন। এর মধ্য দিয়ে কবির পাঠ ও মানস ভ্রমণের অভিজ্ঞতা পাঠকের কাছে পৌঁছে যায়—শিল্প ও সৃজনের কঠিন পথ ধরে।
কবি যেমন বাস্তব আর কল্পনার মিশেল দিয়ে আমাদেরকে নিয়ে যান স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে, তেমনি বিজ্ঞানের আবিষ্কারে রোবটিক জীবনের দীর্ঘশ্বাসও ঝরে পড়ে ঝরাপাতার মতো। আছে ফরমালিন, এলিভেটর, ইলেকস্ট্রক শক কিংবা গুয়ের্নিকার ক্যানভ্যাস/ রক্তের ফিনকি ছুটলো হঠাৎ/ ভিজে গেল/ একটি গোলাপবোনা কালো গ্লভ।
যদিও নতুন নয়, তবু কবিতা নিয়ে তার নিরীক্ষার প্রমাণ পাই আমরা প্রেমবৃত্ত-১ ও ২-এ। মফস্বল দিয়ে শুরু করে তিনি ফিরে আসেন কলোনিয়াল হ্যাংওভারে। উল্টোপাতায় সেই বাক্যাবলিরই বিপরীত যাত্রা। যেখানে শুরু সেখানেই শেষ। যেখানে শেষ সেখানেই শুরু। বিষয় ও ভাবের বিবেচনায় এ কবিতা দুটি সাধারণ হলেও আঙ্গিক নিরীক্ষায় নতুনত্ব পাঠককে টানে। রুপালি স্থাপত্য কবিতায় কবি একই সঙ্গে পেশাগতভাবে ক্লান্ত আবার স্মৃতিকাতরও হন, তাঁর শিক্ষাজীবনের সোনালি সময় নিয়ে—
রুপালি ফ্যাকান্টির
রুপালি মেয়ে আমি
একদিন এসো ক্যাকটাসের ছায়ায়
অনেক গল্প সযত্নে পুষে রেখেছি শুনবো বলে।
রোমান্টিকতা, প্রেম, তাঁর কবিতায় উত্তর আধুনিকতার মোড়কে ধরা দেয়। ‘মধ্য গ্রীষ্মরাতের স্বপ্নের মতো’ তিনি ভ্রমণ করেন ব্রুকলিন মিউজিয়াম থেকে লালবাগের ইটের প্রাচীর, এরপর কুবের মাঝি হয়ে যাত্রা করেন ময়না দ্বীপ। উত্তর আধুনিক কবিত্বের অস্থিরতায় তিনি বিশ্বনাগরিকের মতো ঘুরে বেড়ান কবিতাশিল্পের সন্ধানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে। তাই তো নিউইয়র্কে বাস করে তিনি ভুলে যাননি পথের পাঁচালীর অপুকে—
কেমন হতো?/ যদি অপু ছুটতো/ সেন্ট্রাল পার্কে-স্টবেরি ফিল্ডে
দুরন্ত স্পাইডারম্যান হয়ে—/ জন লেলনের/ স্বপ্নপাগল নেশায়?
প্রেম ও শরীর একাকার হয়ে যায় লায়লা ফারজানার কবিতায়। তিনি প্রেমের সঙ্গে শরীরের ধ্রুপদি সম্পর্ক তৈরি করেন। ভালোবাসার মধ্য দিয়ে ‘সাঁতার’-এ শৈল্পিক আমন্ত্রণ আছে। আছে শব্দবন্ধনে উপমা-উৎপ্রেক্ষায় কাব্যের নান্দনিক প্রকাশ—
চারহাতে ক্রিস্টাল প্রবিষ্ট হোক,
নাভিগহ্বর থেকে নাভিগহ্বরে, শাড়ির বোতাম
খুলে ঠিকরে আসুক কিছু গলিত প্যাস্টেল
উষ্ণ হোক চার জোড়া পাঁজর।
কিংবা
টইটম্বুর মোরাব্বার মত
তার মাংসে ডুবে থাকবো আমি
আর আমার মধ্যে সে।
তাঁর উপমাতে বারবার ফিরে ফিরে আসে আলো আর রঙের খেলা। দৃশ্যকাব্য তৈরিতে কবির দক্ষতা অমলিন। নাগরিক নকশাকার কবির চোখে তাই রঙের খেলার মায়াবী পরশ পাওয়া যায়। কবি লেখেন—
জন্ডিসরঙা অর্ধমৃত কিছু নারী-পুরুষ
দেয়া নেয়ায় ব্যস্ত।
পার্পল লাইটে ভাসমান মেঝে...[খোলস]
কবি ‘ইনসমানিয়া’তে ঘুমাতে পারেন না। চারপাশ থেকে মধ্যরাতের দৃশ্যগুলো ধরা দেয় তাঁর কবিতায়, তাঁকে আচ্ছন্ন করে রুদালিদের শোক— ‘পাতাদের ছাইয়ে/ গাছদের স্বপ্ন ভেসে বেড়ায়’। কিংবা সামুদ্রিক মিথ্যা নিয়ে তিনি যখন ভাবেন—
একটি নদীর সত্য হারায় সমুদ্রে
নিজেকে বিলিয়ে সব নদী
তবুও সমুদ্র সাক্ষী।
‘হিপোগ্রিফের ডানা’ কবিতায় কবি অবলীলায় বলতে পারেন—‘উপসংহারে তুমিও নগ্ন-খোলা-অবাধ-বোতাম’। এ যেন ‘ঝরাপাতার র্যাপসোডি’তে উত্তর আধুনিক মন ও মননের সারমর্ম এবং শেষ সিম্ফনির পরও যেন আরও কিছু সুর ঝরে পড়ে আর আমাদের আপ্লুত করে—‘একাকী মেরুন আমি—দ্রবীভূত পার্পেল বৃষ্টিতে’। এখানেই কবি ছুঁয়ে যান প্রিয় পাঠককে। কবি লায়লা ফারজানা, আপনার প্রথম বই ঝরাপাতার র্যাপসোডি নিয়ে বাংলা কবিতার খোলা মজলিসে আপনাকে স্বাগত।
চমৎকার লেখা! খুবই ভালো লাগলো। লেখক অধ্যাপক প্রিয় মানুষ সৌরভ শিকদার কে শুভেচ্ছা। এত কাছে এসেও কতদিন কাছ থেকে দেখা নেই। একদিন দেখা হবে নিশ্চই। কবি লায়লা ফারজানা কে অভিনন্দন! তার কবিতার আমি একজন মনোযোগী পাঠাক হবার কৃতিত্ব তারই। সাধুবাদ!
মিথুন আহমেদ, নিউইয়র্ক
আগস্ট ০৪, ২০২২ ০৭:২৭