মূল চরিত্রের নাম মানুষ
বাংলাদেশের মারিয়া জাহান এবং মেলবোর্নবাসী লেখক আরভিং দেয়াং। দুজনে যৌথভাবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন। ১৯১৩ সালের পর বহুকাল কেটে গেল। তারপর আরেকজন বাঙালি লেখকের হাতে এলো এই বিশ্বসেরা পুরস্কার। মিডিয়ার জগতে এ নিয়ে তোলপাড়। সারা দেশে চলছে আনন্দ উৎসব। কিন্তু লেখকের মনে এ নিয়ে কোনো উচ্ছ্বাস নেই। বরং সবকিছু এড়িয়ে যেতে চান। থাকতে চান আড়ালে। খবর প্রকাশের পর তিনি নিজের বাসভবন থেকে সরে গিয়ে অন্য কোথাও লুকিয়ে রইলেন। অন্যদিকে আরভিং দেয়াংয়েরও একই অবস্থা। নোবেল প্রাপ্তির খবরের পর তিনিও নিজের এলাকা ছেড়ে চলে গেলেন অন্য কোথাও। পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই লেখকের একই রকম আচরণ। কেন? এর মধ্যে কি কোনো রহস্য আছে? তাঁদের মধ্যে কোনো সংযোগ? সেই রহস্য উদঘাটনে পাঠক বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরাতে পারে না। গল্পের প্রথম থেকেই শুরু হয় পাঠকের কৌতূহল। সেই কৌতূহল তাকে টেনে নিয়ে যায় একেবারে শেষ পর্যন্ত। পাঠ শুরু হলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাঠকের নিস্তার নেই। বাদল সৈয়দের গল্পের এটাই বৈশিষ্ট্য। বিচিত্র বিষয়ে লেখা তাঁর গল্পগুলোর বহু উপাদানের অন্যতম হলো রহস্য। তাঁর সর্বশেষ গল্পের বই ‘দ্বিতীয় যৌবন’ এর নয়টি গল্প যেন এই বিপুল পৃথিবীর মানুষের বিচিত্র জীবনের রহস্য উদঘাটনেরই নয়টি পর্ব।
পৃথিবীতে মানুষই সবচেয়ে বেশি রহস্যময়—এই পুরাতন উপলব্ধি আবার চেতনায় ভেসে ওঠে বাদল সৈয়দের গল্প পাঠে। কিন্তু দ্বিতীয় যৌবনের গল্পগুলো রহস্যগল্প নয়। এগুলো জীবনের গল্প। যে জীবন মুক্তিযুদ্ধের, যে জীবন প্রেমের, যে জীবন রোগ ও শোকের এবং তা থেকে বাঁচার ও বাঁচানোর সংগ্রামের। আর সেই জীবনের সঙ্গে জড়িত যেসব মানুষ, খুব কাছে থেকে দেখি তাদের। নিখুঁত আর অনুপুঙ্খ বর্ণনা তাদের। সে বর্ণনায় চেহারার বৈশিষ্ট্য, পরনের কাপড়চোপড়সহ কিছুই বাদ পড়ে না। ফলে পাঠকের চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মতো উঠে আসে চরিত্রগুলো—
ক্লাস শেষে তিনি যখন এলেন, মনে হলো একঝলক কোমলতা চারদিকে ভাসছে। এত স্নিগ্ধ চেহারা খুব কম দেখা যায়। সাদা সুতির শাড়িতে লাল সূচিকর্ম সে স্নিগ্ধতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। শ্য্যামলা চেহারায় রিমলেস চশমার আড়াল থেকে তিনি বিস্ময় নিয়ে তাকালেন আমার দিকে।
— এক শীতের দুপুর।
ভদ্রলোকের রসবোধ চমৎকার। রুচিও। বেশ বয়স হয়েছে, কিন্তু পড়েছেন বাদামি রঙের জ্যাকেট, গলায় বারবারির স্কার্ফ, কালো ঢিলেঢালা কটন প্যান্ট, সাথে চকচকে কালো লোফার। চোখে চশমা, রিমলেস, সোনালি ফ্রেম। এ বয়সেও বেশ সুদর্শন।
— ফিনিক্স পাখির মতো এক সন্ধ্যা
চরিত্রের এ রকম বিস্তারিত বিবরণের কারণে পাঠকের কাছে গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ার পাশাপাশি সাহিত্যমূল্যের পাল্লাও ভারী হতে থাকে। শুধু মানুষ নয়, তাদের অবস্থান, চারদিকের পরিবেশ, আবহের বর্ণনাও যেন আণুবীক্ষণিক। খুঁটিনাটি বিস্তারিত। কোনো খুঁত নেই। বাদলের গল্পের পটভূমি বৈশ্বিক। বাংলা ভাষায় লেখা গল্পগুলোর চরিত্র পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে উঠে এসেছে। এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া—সবখানে ছড়িয়ে আসে তাঁর গল্পের পটভূমি। ফলে বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে একটি বৈশ্বিক পরিমণ্ডল পাওয়া যায়। ব্যক্তিগতভাবে একজন ভ্রমণবিলাসী মানুষ বলেই এ রকম একটা পরিমণ্ডল তিনি তৈরি করতে পেরেছেন। যথার্থভাবে কাজে লাগিয়েছেন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। গল্পের চরিত্রগুলোকে মেলবোর্নে, ঢাকার গুলশানে, পটিয়ার চা-বাগানে, নিউইয়র্কে বরফ আচ্ছাদিত রাস্তায়, কলকাতার হাসপাতালে, স্টকহোমসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে দেখা যায়। নিজে প্রত্যক্ষ না করলে এমন জীবন্ত ছবি আঁকা সম্ভব হতো না।
‘দ্বিতীয় যৌবন’ পাঠের পর বাদল সৈয়দের গল্পের প্রবণতা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে এযাবৎ বাংলা ছোটগল্পের সেরা নিদর্শনগুলোর যে প্রবণতা আমরা এত কাল দেখতে পেয়েছি, তা থেকে এগুলো ভিন্ন নয়। গল্পের রহস্যময়তা, চরিত্র ও আশপাশের বিস্তারিত বিবরণ, বৈশ্বিক পরিমণ্ডল, মানুষের জীবনের বৈচিত্র্য এবং সর্বোপরি মানবিক আবেদনই স্পষ্টত চিহ্নিত হয় গল্পগুলোতে। নয়টি গল্পের প্রতিটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যায়। প্রতিটি গল্পের পটভূমি ভিন্ন ভিন্ন এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। বেশ কয়েকটি গল্প শেষ করে মনে হয়, এটি একটি উপন্যাস হতে পারত। কারণ, জীবনের ব্যাপকতা ও কাহিনির বিস্তৃতি। গল্পের কৌশলী বর্ণনার কারণে চরিত্রগুলোর পরিণতি আঁচ করা কঠিন। গল্পের শেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আগে থেকে অনুমান করা যায় না। তার জন্য একটা কৌতূহল জাগিয়ে রাখে।
প্রথম গল্প এক ‘শীতের দুপুর’। একেবারে শেষ লাইনে না আসা পর্যন্ত বোঝা যায় না এই গল্পের কেন্দ্রে রয়েছেন এক চিররহস্যময়ী নারী। যাকে আমরা কখনো দেখিনি। অথচ বাংলা গানের শ্র্রোতারা যার নাম জানেন। এক কালজয়ী গানে তার নাম আমরা শুনেছি। হ্যোলো, এটা কি টু ফোর ফোর ওয়ান ওয়ান থ্রি নাইন? ওপাশ থেকে কোনো উত্তর নেই। এ পাশ থেকে প্রাণ উজাড় করা নিবেদন—চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছ? এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না। বেলা বোস কি সেই আবেদন শুনেছিলেন? নাকি শুনেও না শোনার ভান করেছিলেন। বাংলা গানের শ্রোতাদের বেলা বোসের রহস্যের ঘোরের ভেতর নিয়ে গেছেন বাদল সৈয়দ এই গল্পে। এর বিস্তারিত বর্ণনা দিলে যাঁরা এখনো পড়েননি, তাঁদের কাছে মজাভঙ্গের দায়ে অপরাধী হয়ে থাকব। তবে একথা সত্যি, আমাদের কল্পনার বেলা বোস রক্তমাংসের বেলা বোস হয়ে এলেন এই গল্পে। পুরো গল্পজুড়ে টানা উত্তেজনা আর রহস্য।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যে দুটি উৎকৃষ্ট গল্প সংযোজিত হলো এই বইয়ের মাধ্যমে। ১৯৭১ সালের বাস্তবতা, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আমাদের দেশে সফল গল্পের সংখ্যা খুব কম। সেদিক থেকে বাদল সৈয়দের ‘দ্বিতীয় যৌবন’ ও ‘ফিনিক্স পাখির সাথে এক সন্ধ্যা’য় সেই সময়টা অন্য রকমভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, যা মনে দাগ কাটে। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার এক অসাধারণ মানবিক দুটি উপাখ্যান তিনি গল্প দুটোতে উপস্থাপন করেছেন। তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের মর্ম, তাৎপর্য, মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা উপলব্ধি করাতে এই গল্প দুটো খুব কাজে দেবে। ফিনিক্স পাখির সাথে এক সন্ধ্যায় গল্পটি শুরু হয় ট্রেনের কামরায়। দুজন যাত্রীর মধ্যে পরিচয় হয়। কখনো মনে হয় না এটি এক মুক্তিযোদ্ধার গল্প। গল্প এগিয়ে যায়, আর ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় একাত্তরের রণাঙ্গন, শরণার্থী, সামনাসামনি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এক মুক্তিযোদ্ধার কথা। আহত মুক্তিযোদ্ধা সীমান্ত পার হয়ে প্রাণে বাঁচেন। সেখানে কলকাতার এক হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা হয়। সে সময় এক নার্সের সঙ্গে দেখা, হৃদয় বিনিময়। নার্সের শুশ্রূষায় ভালো হয়ে ফের যুদ্ধে চলে যান। নার্সকে কথা দেন ফিরে আসবে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অন্য এক যুদ্ধে লিপ্ত হন মুক্তিযোদ্ধা। ফিরে যেতে পারেননি তাঁর ভালোবাসার মানুষটির কাছে। অন্য গল্পগুলোর মতো এখানেও রহস্য আছে। সেই নার্সের কী পরিণতি হলো? সেই কৌতূহল পাঠককে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। সমস্ত ঘটনার বিবরণ একেবারে প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতার মতো। একেবারে জীবন্ত। বাদলের ভাষার বাহাদুরিতে গল্পকে মুহূর্তে আমাদের কল্পনাতীত কোনো বাস্তবতায় নিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধার প্রতি, শেষ পর্যন্ত মানুষের প্রতি আমাদের আস্থা বাড়ে, বিশ্বাস বাড়ে।
মুক্তিযুদ্ধের আরেক গল্প দ্বিতীয় যৌবন। এই গল্পের প্রধান চরিত্র মতি মিয়া। গল্পের শুরু থেকে মতিকে আমরা দেখি পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসেবে। হানাদার বাহিনীর নানা পাশবিক কুকীর্তির সহযোগিতা করাই তার কাজ। তার মা তাকে অভিশাপ দেয়। স্ত্রী ঘৃণা করে। কিন্তু গল্পের একেবারে শেষ এসে আমরা জানি, মতি মিয়া দুঃসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা, যিনি কিনা পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করার আড়ালে তাদের সমস্ত খবর মুক্তিযোদ্ধাদের দিতেন। মনটা বিষণ্ন হয়ে যায় এই জন্য যে, মতি মিয়ার মা কখনো জানতে পারেননি তাঁর ছেলে দেশের বিপক্ষে নয়, পক্ষে কাজ করে শহীদ হয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ কিংবা জীবনযুদ্ধ—যা-ই হোক। বিষয় ও চরিত্রের বহু ভিন্নতা সত্ত্বেও তাঁর প্রতিটি গল্পের কেন্দ্র একটাই। সেটাকে ঘিরেই তাঁর গল্পের জগৎ আবর্তিত হয়েছে। সেই কেন্দ্রের নাম মানবিকতা। বাদলের গল্পের মূল চরিত্রের নাম মানুষ। শেষমেশ তিনি তাদের মাহাত্ম্যই তুলে ধরেছেন সাবলীল, সাহিত্যিক ভাষায়, শৈল্পিক বুননে। ‘গন্তব্য’ গল্পের চিকিৎসক হাফিজ, ‘অ্যাকোয়ারিয়ামের একটি মুখ’ গল্পের চিকিৎসক মেশকাত আমাদের কাছে হয়ে ওঠে কিংবদন্তির মতো মায়ামানুষ। যারা নিজের পেশাকে ছাড়িয়ে মানবিক মূল্যবোধে হিমালয়ের চূড়ায় গিয়ে পৌঁছায়। কখনো দুঃখভরা, কখনো আনন্দের পরিণতি লাভ করলেও শেষ পর্যন্ত গল্পগুলোতে একটি মানুষ উঠে এসে দাঁড়ায় আমাদের হৃদয়ের প্রান্তে। আমরা অনেক নিচ থেকে মাথা উঁচু করে দেখি তাদের। ভালোবাসি তাদের। বাদল সৈয়দের গল্পগুলো মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়। কেননা সত্যি সত্যি তাঁর গল্পের মূল চরিত্রের নাম মানুষ।