ক্ষত আগলে রাখার ব্রত
ইমরে কারতেশ একমাত্র হাঙ্গেরীয় লেখক যিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০২ সালে তিনি এই পুরস্কার লাভ করেন কথাসাহিত্যের জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎসি-গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া এই লেখকের কৃতি সম্পর্কে নোবেল কমিটি বলেছিল, ‘ইতিহাসের বর্বরোচিত স্বেচ্ছাচারিতার কবলে পড়া ব্যক্তিমানুষের বিপন্ন অভিজ্ঞতা লেখায় তুলে আনার জন্য’ তাকে পুরস্কৃত করা হলো [Press release, The Nobel Prize in Literature 2002]।
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা ও সেই অভিজ্ঞতা-তাড়িত মানুষের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলার নিষ্করুণ আখ্যান কারতেশের কথাসাহিত্যের মূল প্রতিপাদ্য। তাঁর চারটি উপন্যাসের চরিত্র এই পটভূমি কেন্দ্র করে আবর্তিত। উপন্যাস চারটি হলো: ফেইটলেস [১৯৭৫], ফিয়াস্কো [১৯৮৮], কাডিস ফর আ চাইল্ড নট বর্ন [১৯৯০] এবং লিকুইডেশন [২০০৩]। সে বিবেচনায় এই রচনাগুলোকে টেট্রালজি বা চতুষ্টয় নামে অভিহিত করা যায়। বাংলা সাহিত্যে টেট্রালজির উদাহরণ সমরেশ মজুমদারের উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ ও মৌষলকাল।
কারতেশের টেট্রালজির মধ্যে প্রথম তিনটি উপন্যাসকে নোবেল কমিটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল। এই ট্রিলজিকে তারা বলেছে ‘ব্যর্থতার উপাখ্যান’। এর মধ্যে কাডিস ফর আ চাইল্ড নট বর্ন উপন্যাসটি বিশিষ্ট তাঁর আঙ্গিকের জন্য। আঙ্গিকের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে তিনি ঋণী তার প্রায় সমকালীন এক অস্ট্রীয় লেখক নিকোলাস থমাস বার্নহার্ডের কাছে [Nicholas Lezard : The Guardian]। কোনো এক নীরব শ্রোতার সামনে স্বগতোক্তির মতো ক্লান্তিহীন বর্ণনার মধ্য দিয়ে অন্তর্গত বিষাদ ও বিচ্ছিন্নতার চিত্র তুলে ধরাই বার্নহার্ডের মূল কৌশল। ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে’ একা কথা বলা। এতে বাইরের জগতের ঘটনা প্রকাশ পায় সামান্যই, সেও আসে টুকরো-ছিন্নভাবে। তাতে কাহিনির পারম্পর্য তেমন রক্ষিত হয় না। কিন্তু কথকের চিন্তার প্রবাহ থেকে যায় অবিচ্ছিন্ন। এই অবিচ্ছিন্ন চিন্তাস্রোত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেবে চৈতন্য প্রবাহরীতির। এ রীতির মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আমরা স্মরণ করতে পারি: ঘটনা বর্ণনা নয়, চরিত্রের চিন্তাকে অনুসরণ; আকস্মিকতার মধ্য দিয়ে বর্ণনা শুরু এবং আকস্মিকভাবেই তা শেষ; বর্ণনার মধ্যে কোনো ছেদ থাকবে না; আখ্যানভাগের সময় খুবই স্বল্প, হতে পারে কয়েক ঘণ্টার বা কয়েক দিনের; এক ধরনের বিষাদ, উদ্বেগ ও শূন্যতাবোধ এর মূল প্রেষণা।
বাংলা ভাষায় এমন দুটি উপন্যাসের নাম আমরা বলতে পারি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চাঁদের অমাবস্যা এবং সতীনাথ ভাদুড়ীর জাগরী। বিশেষত জাগরী উপন্যাসটি, যা বিবৃত হয়েছে উত্তম পুরুষে। তবে একান্তই যদি মিলিয়ে পড়তে হয় সেক্ষেত্রে উল্লেখ করা দরকার শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাসের কথা। এটি উত্তম পুরুষে বর্ণিত নয়, তবে এর পটভূমি মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দশক, যেখানে একজন যুবকের উপলব্ধিতে ধরা পড়ছে বৈরী সময়, আতঙ্ক-সঞ্চারী প্রতিবেশ¾যার উৎসে আছে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা। তেমনি কাডিস ফর আ চাইল্ড নট বর্ন উপন্যাসটিরও পশ্চাৎপটে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি। আর সেই স্মৃতিতাড়িত মানুষের বয়ান রচিত হচ্ছে আশির দশকের শেষে, যখন পূর্ব-ইউরোপের দেশগুলিতে চাপিয়ে দেয়া সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ছে একে একে। গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। কিন্তু ততদিনে মর্মগতভাবে মৃত্যু হয়েছে আমাদের কথকের।
উপন্যাসটা শুরু হয়েছিল এক আকস্মিক আর্তনাদের মধ্য দিয়ে। সুতীব্র সেই ‘না’ ধ্বনি বিরাজমান বাস্তবতার প্রতি প্রত্যাখ্যানও বটে। কিন্তু তারও অধিক, বাস্তবতার সঙ্গে খাপ-খাওয়াতে না পারা। নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার এই ‘না’ বেশ কয়েকবার উচ্চারিত হয় উপন্যাসে। এ কারণে নিকোলাস লেজার্ড মন্তব্য করেছেন, উপন্যাসটার নাম ‘না’-ও হতে পারত...
গণতন্ত্রের সেই উষালগ্নে একদিন একটি কফিশপে গিয়ে সে শুনতে পায় পাশের টেবিলে বসা দুই তরুণীর কথোপকথন। এক তরুণী তার বান্ধবীকে বলছে, একজন ইহুদির সঙ্গে কখনোই সে শারীরিক সম্পর্কে যেতে পারবে না। চট করে লেখকের মনে পড়ে যাবে, সে তো প্রথাগতভাবে ধার্মিক নয়। নিজেকে ইহুদি না ভাবলেও এই জাতি-পরিচয়ের ভার তাকে বহন করতে হয়েছে আশৈশব। সহ্য করতে হয়েছে ঘৃণা ও অত্যাচার। তাহলে এর শেষ কোথায়?
উপন্যাসটা শুরু হয়েছিল এক আকস্মিক আর্তনাদের মধ্য দিয়ে। সুতীব্র সেই ‘না’ ধ্বনি বিরাজমান বাস্তবতার প্রতি প্রত্যাখ্যানও বটে। কিন্তু তারও অধিক, বাস্তবতার সঙ্গে খাপ-খাওয়াতে না পারা। নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার এই ‘না’ বেশ কয়েকবার উচ্চারিত হয় উপন্যাসে। এ কারণে নিকোলাস লেজার্ড মন্তব্য করেছেন, উপন্যাসটার নাম ‘না’-ও হতে পারত। প্রসঙ্গত তিনি থমাস বার্নহার্ডের ইয়েস [হ্যাঁ] উপন্যাসের প্রচ্ছন্ন প্রভাবের কথা বলেছেন। সে প্রভাব যদি নাও থাকে, স্বীকার করতেই হবে এই ‘না’ কথাটা বেশ নাটকীয় উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে কাহিনির বয়ানে। পুরো উপন্যাসটাকে টেনে নিয়ে গেছে এই সামান্য কথাটুকু। কেননা পাঠের সূচনাতেই আমরা উদগ্রীব হয়ে উঠি¾কেন এই ‘না’? এর উত্তর পেতে আমাদের উল্টে যেতে হয় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। ক্রমান্বয়ে আমরা বুঝতে পারি এই ‘না’ হচ্ছে লেখকের পিতা হতে না পারার ও না চাওয়ার মর্মন্তুদ বেদনা। সেই বেদনা আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে, যখন তার ছেড়ে যাওয়া স্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করতে আসে একটি কফিহাউজে। উদ্দীপনাময় জীবনের পিপাসা তার স্ত্রীকে চলে যেতে বাধ্য করেছে। অবলীলায় সে বিয়ে করেছে একজন খ্রিষ্টান ডাক্তারকে। ফুটফুটে দুটি ছেলেমেয়ের হাত ধরে সে প্রবেশ করে কফিহাউজে।
কারতেশ বলেছিলেন আমি একবার মরেছিলাম, যেন বেঁচে উঠতে পারি। তাঁর উপন্যাসের নায়ক সেই মৃত্যুর হাত থেকে এবার রক্ষা করতে চান নিজের সন্তানকে। কিন্তু তাও কি সম্ভব? কী নিশ্চয়তা আছে তার? সন্তানের মৃত্যুকে এড়ানো যেতে পারে কেবল তার জন্মকে রোধ করে। তাই পিতা হতে চান না তিনি। আয়রনি হলো এই, যে শিশু জন্মাল না সে তো মৃত্যুতেই লীন। ফলে তার জন্য কান্না আর হাহাকার ভিন্ন আর কোনো স্মৃতি নেই, থাকতে পারে না মানুষের জীবনে। শোক প্রকাশের কৃত্যকেই বরণ করেছেন লেখক। কাডিস শব্দটি তাঁর কাছে জীবনের সমর্পণ। উপন্যাসের শেষে এসে ঈশ্বরকে বলছেন: ‘নিজেকে তুলে ধরার সর্বশেষ অন্তরঙ্গ প্রচেষ্টায় আমার পলকা একগুঁয়ে জীবনকে নিবেদন করছি, আমার জীবনকে নিবেদন করছি যাতে আমার উঁচু করে তুলে ধরা হাতে এই জীবনের লটবহরসহ চলে যেতে পারি আর দ্রুত প্রবহমান উষ্ণতার কালো, অন্ধরাতে ডুবে যেতে পারি...’ [কারতেশ : ৯৬]।
আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখব এর কথক, যিনি মূলত একজন লেখক ও অনুবাদক, তিনি তাঁর ইহুদি পরিচয়কে স্বীকার করেন না বলেই ভেবেছিলেন। সেই তিনিই শেষ পর্যন্ত তাঁর ইহুদিত্বকে বরণ করে নিচ্ছেন। কারণ তিনি বুঝতে পারছেন, কেবল ইহুদি হবার কারণেই একটি গণহত্যার অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে তাঁকে আসতে হয়েছে। জীবনের রূঢ় সত্যকে তিনি অনুভব করেছেন, যা তাঁকে অন্য সবার থেকে আলাদা করেছে। এই সত্যকে তিনি হারাতে রাজি নন কোনো কিছুর বিনিময়েই। আনন্দ-উচ্ছ্বাসের ছটায় তাঁকে ম্লান হতে দেবেন না, এই তাঁর ব্রত। তাই সেই আউশভিচ কনসেন্ট্রশন ক্যাম্পের অভিজ্ঞতাকে স্বেচ্ছায় বয়ে চলেন সর্বদা। তারই ভেতর থেকে খুঁড়ে বের করে আনতে চান নিজের অস্তিত্বকে। তার লেখনীও চলে সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে, সভ্যতার এই গ্লানি যদি সেইসব মানুষকে স্পর্শ করে, যারা লাঞ্ছিতের জন্য এখনো লজ্জা অনুভব করে।
অস্তিত্ব, অনস্তিত্ব, স্থায়ী, ক্ষণস্থায়ী, আত্মা, আদল¾এমন কয়েকটি শব্দকে আশ্রয় করে লেখকের চিন্তার স্ফুরণ ঘটেছে। স্বাভাবিকভাবেই দার্শনিক উচ্চারণগুলি প্রায়শ রূপ নিয়েছে কাব্যিকতার। যেমন: ‘তখন মাঝেমধ্যে খেয়াল করে দেখছিলাম নারীর একজোড়া চোখ আমার মুখের ওপর আঠার মতো লেগে আছে যেন আমার ভেতর থেকে ঝর্নাধারার মতো কোনো প্রবাহ আশা করছে : আমি আদি এক ধারণার অস্তিত্বের কথা বলছিলাম যা অজানা কোনো পার্থিব প্রভাবে আমাদের শরীর, আত্মা, আমাদের ভেতরের পশু¾কোনো কিছুর দ্বারাই প্রভাবান্বিত নয়’ [কারতেশ : ৫৬-৫৭]।
এই কাব্যিকতা কবিত্বময় বর্ণনার নিরিখে বিবেচ্য নয়। অন্তর্জগতের নানা প্রতিক্রিয়া, ভাষাতীত উপলব্ধির বয়ান তৈরির মাধ্যম হিসেবেই তাকে বিচার করতে হবে। ব্যাপারটা আউশভিচের মতোই¾ব্যাখ্যা করার নয় বলে যার সম্পর্কে চুপ থাকতে হবে¾এই কথা লেখক মানেন না বলেই তিনি অব্যাখ্যেয় আত্মসমীক্ষার মুখোমুখি হয়েছেন। এবং এই আত্মসমীক্ষার সত্যনিষ্ঠতা উপন্যাসটিকে ‘আত্মজৈবনিক’ মর্যাদা দান করেছে।
আমরা আলোচনা শেষ করব অনুবাদকের সম্পর্কে দুটি কথা বলে। এ কথা স্বীকার করতেই হয়, অনুবাদের ভাষা মোটের ওপর প্রাঞ্জল, তবে প্রাণবন্ত নয়। তার কারণ দীর্ঘ বাক্য এবং প্রবন্ধাত্মক শব্দের [যেমন : অন্তর্ভুক্তকরণ] প্রয়োগ। দীর্ঘ বাক্যের একটা উদাহরণ দেয়া যাক : ‘কোনো ইনফ্লুয়েঞ্জাগ্রস্ত রোগী বিছানায় শুয়ে কাউকে তার আশেপাশে টুকিটাকি কিছু করতে দেখে বা এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে দেখে, তার কাজকর্ম ঘোরাফেরা নিয়ন্ত্রণের জন্য অতীতের সুস্থ অবস্থার মতো দুএকটা ক্লান্ত কথা বলে, আর উপস্থিত ব্যক্তি যদি না শোনে বা শুনতে না পায় তাহলে সে সমস্ত প্রচেষ্টা পুরোপুরি দুর্বলতার সাথে বাদ দিয়ে দেয়¾আমার মন কাজকর্মকে ঐ রোগীর মতো অনুসরণ করে’ [কারতেশ ৫৩]। আক্ষরিক অনুবাদ অপেক্ষা ভাষান্তর এসব ক্ষেত্রে সহায়ক হতো বলে অনুমান করা যায়।
তা সত্ত্বেও উপন্যাসের মূল সুরটি ধরতে পাঠকের সমস্যা হয় না। চূড়ান্ত অর্থে ‘রিলেইট’ করা যায়। ইতিহাসের নিষ্ঠুরতার বয়ান হিসেবে একে আমরা অনায়াসে পাঠ করতে পারি।
তথ্যসূত্র
১. Press release, The Nobel Prize in Literature 2002. (nobelprize.org/prizes/literature/2002/summary/)
২. Nicholas Lezard, ‘Kaddish for an Unborn Child by Imre Kertész’ The Guardian.
[theguardian.com/books/2010/sep/18/kaddish-for-unborn-child-imre-kertesz]
৩. ইমরে কারতেশ: কাডিস ফর আ চাইল্ড নট বর্ন, [ইংরেজি অনুবাদ: ক্রিস্টোফার সি উইলসন ও ক্যাথেরিনা এম উইলসন], বাংলা অনুবাদ: দুলাল আল মনসুর, কাগজ প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৩।
বেশ প্রাঞ্জল আলোচনা।
Harun Suman Rashid
মে ০৬, ২০২১ ০০:১৩
ভালো লাগল, বিদেশি আরো লেখকের লেখা পড়তে চাই, গালিব ভাই।
আহমদ সোলতান
মে ০৭, ২০২১ ১০:৩৪
ভাল লাগল। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দুদের নিয়ে এমন কোন উপন্যাস/গল্প/কবিতা বাংলা সাহিত্যে নেই। বাস্তবতা এটাই। যদি কেউ লিখত, তাহলে তাকে মালাউন, সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি ট্যাগ দিয়ে দেয়া হত। আপনাদের সাথে বিদেশীদের পার্থক্য এটাই। আপনাদের আরবীয় জাতীয়তাবাদের পদলেহন বিকট আকার ধারণ করেছে, যেটা সবাই বোঝে।
সালমা সিদ্দিকা
মে ২৫, ২০২১ ০৯:২৭
খুব ভাল লেখা, গালিব ভাই। আরও এমন লেখা চাই আপনার হাত থেকে।
তানভীর মাহমুদ
মে ০৫, ২০২১ ১৩:৪৫