উত্তরা ক্যাফে ও অন্যান্য কবিতা
আমি কি সুখে আছি
জন্মাইছি গ্রামে। সন্ধ্যা হইলেই
চারিদিক আন্ধার দেখিতাম। যাহারা গ্রাম গঞ্জ আর নদীকূল
জাগাইয়া রাখিত, মানে পাখিসব, এতসব কিচির মিচির
সূর্যাস্তের সাথে কোথায় হারায় কোনোদিন ভাবনায় আসে নাই।
পাশের বাড়ি থেকে রেডিওর গান ভেসে আসে, কী মধুর তার সুর!
মনে মনে ভাবিতাম, আহা! তাহারা কী সুখে আছে।
আমাদের রেডিও ছিল না, টেলিভিশন ছিল না
আমাদের ঘোড়া ছিল না, গাড়িও ছিল না
মাঝে মাঝে কাছের শহর রংপুরে যাইতাম। ’মুই গ্রামের মানুষ,
তাই ভয়ত থাকোঁ, কী হইতে ফির কী হয়া যায়। দেখি,
শহরের মানুষ কী সুন্দর করি কথা কয়’, আমার কথাগুলো
ওদের মতো সুন্দর হয় না। আমার জামা-কাপড়ও কেমন জানি…
কী যে সুন্দর সুন্দর মেয়েমানুষ রিক্সা দিয়া যায়, কী সুন্দর সাজগোজ
কপালের টিপ, ইশ্! কী যে সুন্দর কইরা হাসে অরা।
আমি হাঁটতে হাঁটতে দেখি বড় বড় দোকান আর কত কত জিনিস।
ভাবি, আসলে দুনিয়ায় মেলা কিছু করবার আছে,
দেখবার মতো জিনিসেরও অভাব নাই। মনে হয়, যদি এই রকম
বড় শহরে আমার বাড়ি হইতো! দুইতলা বাড়ি, বহুদিন
আমি স্বপ্নে দেখিয়াছি দুইতলা বাড়ি।
তারপর কী হইতে যে কী হইয়া গেলো
রংপুর শহর পার হইয়া বড় শহর ঢাকার উপর দিয়া
আসিয়াছি আরও বড় শহরে। ইহার
উঁচা উঁচা দালান দেখিতে মাথার টুপি খসিয়া পড়ে;
এ শহর আলোয় আলোয় ঝলমল করে,
এ শহর ঘুমায় না কখনও। আহা!
কত কী যে দেখিয়াছি। তারপর কী সুখে আমিও
একদিন বাঁধিলাম ঘর, দেখি সেও বিদ্যুৎ বাতির মতো
সারাক্ষণ হাসিতেছে।
আমার ঘরে অখন অনেকগুলা রেডিও, রঙিন টেলিভিশন
নতুন টয়োটা গাড়ি, ইটে গাঁথা তিনতলা বাড়ি…
আমি কি সুখে আছি?
ওপারে তাকায়ে দেখি, ওই সব দৃশ্য আরও সুন্দর।
উত্তরা ক্যাফে
বাবাদের আদরের কন্যা ওরা
আধুনিক
কথা বলে টু দ্য পয়েন্ট;
কফি খায়, ডিক্যাফ—
ওদের কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম
মুছে দেয়
শীততাপ হাওয়া
কিন্তু মেয়েগুলো অস্থির
কথা বলে বেশি, তার বান্ধবী
তার চে বেশি
কারো প্রেম ঝুলে আছে
কারো ভাঙে ভাঙে
আমার যে কী হবে!
কেউ তাকে পুরুষ বশীকরণ সূত্র শেখায়
উলিপুরে দাদা বাড়ির টয়লেট নিয়ে
হেসে কুটি কুটি
কানাডা প্রবাসী
একজোড়া প্রেম আসে
লেমিনেটেড মেনু দেখে
ভ্রু কুঁচকে
চড়ুই পাখির মতো উড়ে চলে যায়
কভিড-১৯
বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ
বাজারে আগুন
গাজায়
উপর্যুপরি গোলাবর্ষণ
গাল-গপ্পে এসবের
এক বাক্যও বলে নাই কেউ
বাইরে সন্ধ্যার ঝিলমিল আলোছায়া
ইশারায় বলি,
কফি দাও আরেক্কাপ
চিনি ছাড়া।
ওরা ভয়ে আছে
সরকারি লোক এসে বলে গেল, ‘আপনাদের ভয় নেই।’
পীরগঞ্জের ‘বড় করিমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ আজও
সকাল সকাল রোল কল করা হয়—
রণি চন্দ্র, ভবেশ, গৌতম ও আরতি স্কুলে আসে নাই,
উপিন বাবুর ছোট ছেলে আসে নাই সেও।
ওদের বন্ধু বাবুল উঠে দাঁড়ায়, বলে,
‘ওমার ঘরবাড়ি পুড়ি গেইছে স্যার’।
বহুদূর থেকে উড়ে আসা পাখিগুলো
ছনঘরে ছাইভস্ম দেখে ফিরে গেছে ফের;
কেউ কেউ কাল সারারাত ধানখেতে শুয়ে ছিল।
টেলিভিশনে, খবরের কাগজে খবর আসছে
’আপনাদের ভয় নেই’
কিন্তু সকলেই জানে, ’ওরা ভয়ে আছে’…
এত প্রেম এত জ্বালা
ও আমার বৃষ্টি বাদল ঝোড়ো হাওয়া
ও রোদ, থামাও তোমার উজালা হাসি
ও বর্ষা, নদীকূল,
প্রিয় জোসনা আমার
হাওয়ায় ওড়া বিড়ির ধোঁয়া;
ও আমার মাঝি ভাই
পুঁটুলি মাথায় গ্রাম্যবধূ
ঘাটে একা
ও আমার সাজেক ভ্যালি, শুকনাছড়া
কী সুন্দর ঝরা পাতা, ধানের গন্ধ,
হেমন্তের হাওয়া।
কোন গাঁও থেকে আসো তুমি!
সাইকেল কাঁধে কাঁয় অয়,
সকাল সকাল কোঠে যায়!
অর তো জানা চাই পাহাড়ের কথা
আকাশের বিশালতা,
দিনে রাইতে বাতাসের ক্ষেমতা;
অর তো জানা চাই হিমালয়
কত উঁচা?
ও আমার সাঙ্গু নদী,
ও আমার চিম্বুক পাহাড়
ও আমার দূর পাল্লার লাক্সারি কোচ,
খড়ি কুড়ানি
কার বেটি অয়;
কে গো এই পাড়া বেড়ানি!
ও আমার দূর পাহাড়ের ঝর্ণাজল
খাগড়াছড়ির ঘন জঙ্গল
ও আমার জাফলং, বিছনাকান্দি
ও আমার পণ্য বোঝাই ট্রাক
নতুন নতুন হোন্ডা সিভিক
শাহবাগ মোড়, ট্রাফিক পুলিশ
ও আমার গ্রীষ্মকাল
গন্ধভরা আম কাঁঠাল
অঙ্গ জুড়ে ভেজা শাড়ি
কও দেখি গিয়া
আমারে বান্ধিবে সে কী দিয়া!
ও আমার বসন্ত কোকিল, ঝির ঝির হাওয়া
কোন গাঁও থেকে আসো তুমি
দেহ মনে ভরে দাও এত প্রেম এত জ্বালা।