কাজী আনোয়ার হোসেন কেন গুরুত্বপূর্ণ?

 

ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ছিয়াশি বছর বয়সে গত হলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। এ দেশে তথাকথিত আউট বই-পত্তরের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন মানুষজনের একটি ঈর্ষণীয় অংশের কাছে তো বটেই, এমনকি যাঁদের সেই সংযোগ নেই, তাঁদেরও অনেকের কাছে নামটি যথেষ্ট পরিচিত, এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, মাসুদ রানা সেবা প্রকাশনী এই দুটি শব্দবন্ধের সমার্থক। তবে দেহাবসানের এই অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে কাজী আনোয়ার হোসেন সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তাঁর পারিবারিক পটভূমি, তাঁর গায়ক অথবা মৌলিক লেখক হয়ে ওঠার সম্ভাব্যতা, জনপ্রিয়তা, শখ ইত্যাদি নিয়ে এখানে শব্দ খরচ করতে চাই না। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন গুণীজন, পাঠক ভক্ত সেসব বিষয়ে এরই মধ্যে লিখেছেন, এখনো লিখছেন। হয়তো আরও কিছুদিন লিখবেন।

এই লেখাতে বরং কিছু ভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই, যা বেশ বিতর্কিত স্পর্শকাতর। মাঝে মাঝে তা নিয়ে কথা ওঠে, কিন্তু সেখানে তাঁর পক্ষে-বিপক্ষে যত কথামালার তুবড়ি ছোটে, সেগুলোর মধ্যে যুক্তি যতটা থাকে, সে-তুলনায় আবেগ অথবা বিদ্বেষ নেহাত কম থাকে না। অবশ্য সেই আবেগের আতিশয্যের যথেষ্ট কারণও আছে, তা স্বীকার করতেই হব। তারপরেও আমরা এই লেখায় সেসব একটু দূরে সরিয়ে রেখে একটু নির্মোহভাবে তাঁর কর্মজীবনের দিকে, তাঁর গড়া প্রতিষ্ঠান সেবা প্রকাশনীর দিকে তাকাবার চেষ্টা করব।বোঝার চেষ্টা করবো আমাদের প্রকাশনার জগতে, সাহিত্যের অঙ্গনে কাজী আনোয়ার হোসেনের গুরুত্ব কোন জায়গায় এবং কতটুকু  

অনুবাদ চর্চায় একটু সচেতন মহলে যে কথাটা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি প্রচলিত, অথবা অনুবাদের কথা শুনলেই অনেকের মনে যে ইংরেজি শব্দবন্ধটার কথা চট করে মনে পড়ে, তা হচ্ছে লস্ট ইন ট্রান্সলেশন আমরা খুব হিসেবি। প্রথমেই আমাদের মনে আসে হারানোর কথা, মূলের রস বঞ্চিত হওয়ার কথা। কাজী নজরুল ইসলামের গানের কথা ধার করে বলতে হয়. হেথা হারাই হারাই ভয়,/ প্রিয়তমে তাই/ বক্ষে জড়ায়ে কাঁদি,/ ছাড়িতে না চাই। অবশ্য একথা সত্যি যে সাধারণ পাঠকের কাছে যেহেতু অনুবাদের বিকল্প নেই, তাই তাঁরা মূলের কথা ভুলে গিয়ে তরজমার রসাস্বাদনেই মনোনিবেশ করেন, ভালো অনুবাদ হলে তা পড়েই আপ্লুত হন। কিছু কিছু অনুবাদ পড়ার সময় তো আমরা ভুলেই যাই, সেটা প্রথমে কোন ভাষায় লেখা হয়েছিল। তাই বুদ্ধদেব বসু তাঁর অনূদিত কালিদাসের মেঘদূত-এ অনুবাদকের বক্তব্য অংশে বলছেন:

শেক্সপীয়র কীটস অনুবাদ ভিন্ন গ্রীক বা লাতিন সাহিত্য জানেননি, এবং ভারতীয় মানসে যে-দুটি গ্রন্থ সবচেয়ে প্রতিপত্তিশীল, সেই মহাভারত রামায়ণ সর্বভারতে বহু শতক ধরে অনুবাদ বা অনুলিখনে প্রচারিত হচ্ছে। ইংরেজি ভাষার যে-বাইবেল পৃথিবীর সর্বাধিক প্রচারিত গ্রন্থ, সেটি অনুবাদ বা অনুবাদের অনুবাদকিন্তু তার পাঠকের মধ্যে ক-জনের তা মনে পড়ে, বা মনে পড়লেও কী এসে যায়?

যাহোক, সেই মূলের রস হারানোর মনোবেদনার সঙ্গে যদি যুক্ত হয়, সেসব বইয়ের অঙ্গহানির বেদনা, তাহলে তো কথাই নেই। বলছিলাম, কাজী আনোয়ার হোসেন প্রতিষ্ঠিত বহুনন্দিত সেবা থেকে বের হওয়া বিশ্বসাহিত্যের সেরা বইগুলোর বাংলা অনুবাদের কথা। অনেকেরই অভিযোগ, এ বইগুলো পাঠককে বিশ্বসাহিত্যের অসাধারণ সব ভালো কাজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেও সে-পরিচয় খণ্ডিত’—বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনুবাদকেরা আসলে মূল বইয়ের অনুবাদ করেননি, সেসবের পুনর্কথিত [retold] এবং অনেক ক্ষেত্রেই সংক্ষেপিত [abridged] সংস্করণগুলো অনুবাদ করেছেন। কিন্তু শুধু কি সেবা? বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বইগুলোর পুনর্কথনমূলক অনুবাদ, ভাবানুবাদ, সংক্ষেপিত অনুবাদ কি কেবল সেবা-ই করেছে এই দেশে? মুক্তধারা থেকে শুরু করে অন্য আরও প্রকাশনা সংস্থাসহ বাংলা একাডেমিও কি করেনি কিছু কিছু? বিদেশেও কি হয় না?

যে প্রশ্নটি রয়েই যায় তা হলো বাংলা অনুবাদ কি এখনো এখানে সাবালক হতে পেরেছে? কাজী আনোয়ার হোসেনের সেবা থেকে যে-মানের অনুবাদ বের হয়েছেহতে পারে সেগুলোর অধিকাংশেই, আগেই যেমন বলা হয়েছে, মূল বইয়ের পুনর্কথিত [retold] এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংক্ষেপিত [abridged] সংস্করণগুলোর অনুবাদ; তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলা একাডেমিসহ এ দেশের অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থা বিভিন্ন বইয়ের মানসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ বের করতে পেরেছি কি?

ভদ্র সমাজে যা হয় তা হলো, প্রকাশনা সংস্থাগুলো শিশু-কিশোর বা সাধারণ পাঠকদের জন্য বিখ্যাত বা ক্ল্যাসিক বইপত্রের সংক্ষিপ্ত, পুনর্কথিত সংস্করণ, অনুবাদ, ইত্যাদি বের করে, যেগুলো পাঠকের জন্য অ্যাপেটাইজার হিসেবে কাজ করে। তারপর তাঁরা একই বা অন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে বের হওয়া সেসব বইয়ের পূর্ণাঙ্গ মূল বই বা সেসবের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ পাঠ করেন। কিন্তু এদেশে তেমন হয় কি? দেশের কয়টি প্রকাশনা সংস্থা থেকে বিশ্বের নানান ক্ল্যাসিকের মানসম্পন্ন অনুবাদ বের হয়েছে? যে কটি হয়েছে সেগুলো কি দেশের বিপুল জনসংখ্যার তুলনায়, পাঠকের তুলনায় যথেষ্ট? সেগুলো কি তাঁদের হাতে ঠিক ঠিক পৌঁছেছে?

আমাদের দেশের বাংলা একাডেমি নামের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটি একসময় কাজটি মোটামুটি ভালোভাবে করেছে [যদিও প্রতিষ্ঠানটি থেকে বের হওয়া বইয়ের বিপণনের অবস্থা মোটেই সন্তোষজনক নয়, এবং সেখান থেকে যেসব ভালো অনুবাদ বের হয়েছিল, সেসবের অনেকগুলোই তারা পুনর্মুদ্রণ করেনি]। কিন্তু তারপর? সেই অনুবাদ স্রোতের এমন ক্ষীণাঙ্গ দশা কেন? অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থাই-বা কী অবস্থা? বিগত কয়েক বছরে যদিও বাংলাদেশে অনুবাদ সাহিত্যের একটি জোয়ার পরিলক্ষিত হচ্ছে, কিন্তু সেখানে সিংহ ভাগ স্থান দখল করে আছে মোটিভেশনাল বই-পত্তর আর জনরা সাহিত্যই। তবে বলতেই হবে যে ইতিহাস বিজ্ঞানভিত্তিক বেশ কিছু ভালো নন-ফিকশনেরও অনুবাদ হয়েছে, হচ্ছে, যদিও অনেকগুলোরই মান খুব সুবিধের নয়।

যে প্রশ্নটি রয়েই যায় তা হলো বাংলা অনুবাদ কি এখনো এখানে সাবালক হতে পেরেছে? কাজী আনোয়ার হোসেনের সেবা থেকে যে-মানের অনুবাদ বের হয়েছেহতে পারে সেগুলোর অধিকাংশেই, আগেই যেমন বলা হয়েছে, মূল বইয়ের পুনর্কথিত [retold] এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংক্ষেপিত [abridged] সংস্করণগুলোর অনুবাদ; তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলা একাডেমিসহ এ দেশের অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থা বিভিন্ন বইয়ের মানসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ বের করতে পেরেছি কি?

তো, সেবা অনূদিত বইগুলোর পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ পরবর্তীকালে দেশের অন্যান্য রাষ্ট্রীয়, স্বায়ত্তশাসিত, বা ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রকাশনা সংস্থা থেকে যথেষ্ট পরিমাণে প্রকাশিত হয়নি বলে, যা হয়েছে সেগুলোও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের হাতে যায়নি বলে, এবং তার বিপরীতে সেবা-র অনন্য বিপণন পদ্ধতি বইগুলোর বেশ সহনশীল দামের সুবাদে নানান বয়েসী পাঠকের কাছে সেসব সহজে পৌঁছে যাওয়ার ফলে যেটা হয়েছে তা হলো সেবা তার সহজ-সরল অনুবাদের যে মান বা প্রচলনটা সৃষ্টি করেছে, সেটাকেই অধিকাংশ পাঠক অনুবাদের প্রমিত মান হিসেবে ধরে নিয়েছেন। তার ফলে সেবা অনুবাদ-এ অভ্যস্ত পাঠক মূল বইয়ের জটিল টেক্সট-এর সহজ-সরল অনুবাদ না হলে পড়তে পারছেন না। সেবার অনুবাদে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লেখকের লিখনশৈলী বজায় থাকেনি, অনেক দীর্ঘ বাক্য ছোট হয়ে গেছে, অনেক কঠিন বা আপাতদুর্বোধ্য শব্দের জায়গায় সহজ-সরল শব্দ এসেছে; এবং এসবের জন্য সেবাকে মোটেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় না। কারণ, ওসব বই অনুবাদের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য পাঠক ছিল আলাদা, যে-কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু সেবার সহজপাচ্য অনুবাদের ভোক্তাদের গুরুপাক বা প্রাপ্তবয়স্কদের খাবারে অনীহা অরুচি থেকে গেছে। ফলে সে বলছে অনুবাদ প্রাঞ্জল নয়, ভালো নয়চার্লস ডিকেন্স, উইলিয়াম ফকনার, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, হোর্হে লুইস বোর্হেস, উমবেরতো একো, ইতালো কালভিনো, মিশেল ফুকো, রলাঁ বার্ত, ফ্রান্জ কাফকা প্রমুখের জটিল বিষয় এবং জটিল লিখনশৈলীরও অতি সহজ অনুবাদ চাইছেন তাঁরা। এর একটি বড় কারণ, সেবা প্রকাশিত পুনর্কথন মূলক সংক্ষেপিত বই পড়ার পরবর্তী সময়ে এই পাঠকদের হাতে পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ পৌঁছায়নি। কিন্তু তার দায়ভার কাজী আনোয়ার হোসেন প্রতিষ্ঠিত সেবাকে দেওয়া যায় না মোটেই।

বইয়ের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশের প্রসঙ্গে একটি কথা এখানে প্রণিধানযোগ্য। বছর পনেরো আগে, ব্রিটিশ প্রকাশক অরিয়ন কম্প্যাক্ট এডিশনস নামে ঊনবিংশ শতাব্দীর ক্ল্যাসিকগুলোর বাড়তি বা অপ্রয়োজনীয় অংশগুলো বাদ দিয়ে ছেঁটে-ফলা নিবিড় সংস্করণই বের করেছিলেন, সেগুলো রিটোল্ড ছিল না। সেই তালিকায় ছিল হেরমান মেলভিলের মবি ডিক, আনা কারেনিনা, ভ্যানিটি ফেয়ার, দ্য মিল অন দ্য ফ্লস-এর মতো বিশাল-বপু সব বই। সম্পাদকদের মনে হয়েছিল, এসব ছেঁটে ফেলা অংশ না থাকলেও বইটির মানের ক্ষতি হবে না, বরং বইটি সুসম্পাদিত হবে। এই বিষয়ে তথ্যের জন্য উৎসাহী হলে আপনারা নিউ ইয়র্কার পত্রিকার ২০০৭ সালের ২২ অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত অ্যাডাম গোপনিক রচিত দ্য কারেক্শনস (পৃষ্ঠা ৬৬-৭৬) দেখতে পারেন।

কাজী আনোয়ার হোসেন © সুদীপ্ত সালাম/ ঢাকা অপেরা

কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে অন্য যে অভিযোগটি সারস্বত মহলে শোনা যায় তার সারকথাতিনি মূলত রহস্য, গোয়েন্দা, সাসপেন্স, থ্রিলার, স্পাই, কল্প-বিজ্ঞান কাহিনি, ওয়েস্টার্ন, রোমান্টিক সাহিত্য তথা সেসবের অনুবাদ  অ্যাডাপ্টেশন সরবরাহ করে গেছেন, যে কারণে সেবার পাঠকেরা তথাকথিত মেইনস্ট্রিম সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়নি, বা সেই রহস্যের জাদুনগর থেকে বের হতে পারেননি। আর তার ফলে তাঁদের কাছে অচেনা থেকে গেছে আমাদের সাহিত্যের বড় বড় নাম। সাহিত্য নামের খাবারের স্বাস্থ্যকর পদগুলো না খেয়ে তাঁরা খেয়েছেন গুরুপাক, মুখরোচক, রিচ ফুড বা ঝালমুড়ি আচারের মতো পথপার্শ্বে বিকানো খাবার।

ব্যাপারটি যদি তা-ই হবে, কাজী আনোয়ার হোসেন বা সেবা যদি কেবল এই রহস্য [জনক] কারবারেরই কারবারি হবেন, তাহলে ওপরে যে বইগুলোর কথা বলা হলো সেসব কোন প্রকাশনীর? কে সেটার প্রতিষ্ঠাতা। কার অনুবাদে, অ্যাডাপ্টেশনে, সম্পাদনায়, দূতিয়ালিতে প্রকাশিত হলো সেবা থেকে বিশ্বসাহিত্যের নামজাদা সব লেখকের অমর সব গ্রন্থের অনুবাদ, পুনর্কথনমূলক বা সংক্ষেপিত অনুবাদ, কিশোর ক্ল্যাসিক সিরিজে কানাইলাল রায়-এর কিশোর রামায়ণ, মহাভারতের মকবুলা মনজুর-এর ছোটদের মহাভারত, সময়ের তুলনায় এগিয়ে থাকা কিছু নন-ফিকশন [যেগুলো কাজী আনোয়ার হোসেন বিদ্যুৎ মিত্র ছদ্মনামে লিখেছিলেন], যেমন যৌন বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান, ধূমপান ত্যাগে আত্মসম্মোহন, খালি হাতে আত্মরক্ষা, সঠিক নিয়মে লেখা পড়া, জনপ্রিয়তা, রেয়াযউদ্দিন আহমেদ-এর মানুষ হলাম কী করে? আর, যে-বাংলায় তিনি নিজে লিখলেন, বিশেষ রে অনুবাদ অ্যাডাপ্টেশন করলেন, সে-ভাষার সৌকর্য্য বিষয়য়ানুগ ব্যবহারের তুলনা মেলা ভার গোয়েন্দা বা রহস্য গল্প, এবং থ্রিলার বা স্পাই কাহিনীর জন্য দরকার রীতিমতো গতিশীল, বাহুল্যবর্জিত, এক চৌকস ভাষা; ঘটনার রহস্যময়তার এক গুরুত্ব পরিপূরক হয়ে সেটাই পাঠককে বইয়ের পাতায় আটকে রাখে কাজী আনোয়ার হোসেন বাংলায় এই ধরনের ভাষার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন নিজে লিখে, নানান লেখকের ভাষা এভাবে সম্পাদনা রে  

সেবার মূলত রহস্য-রোমাঞ্চ-গোয়েন্দা কাহিনি প্রকাশের সূত্রে বলি, লক্ষ করে দেখুন, এক শ বছর ধরে প্রকাশিত কলকাতার মূলত সাহিত্য পত্র দেশ-ও তাদের শারদীয় সংখ্যায় নিয়মিতভাবে গোয়েন্দা উপন্যাস প্রকাশ করে [যদিও অনুবাদ সেখানে ব্রাত্য! যেখানে নিউইয়র্কার অনূদিত ছোটগল্প তো বটেই, মাঝে মাঝে কল্পবিজ্ঞান সংখ্যাও প্রকাশ করে]; আনন্দমেলাসহ ছোটদের অন্যান্য বাংলা পত্রিকার শারদীয় সংখ্যার কথা বাদ-ই দেওয়া গেল। অন্নদাশংকর রায়ের সেই অমর ছড়ার দুটি শব্দ উদ্ধৃত করে প্রশ্ন করতে চাই; তার বেলা?

সরকারি সাহায্য তথা অর্থানুকূল্যে প্রকাশিত শিশু, নবারুণ, ধানশালিকের দেশ-এর পাশে সেবা-র রহস্য পত্রিকা কিশোর পত্রিকাকে রাখলে বোঝা যাবে কোন পত্রিকাগুলো এ দেশের শিশু-কিশোর-যুবার বেশি কাছে যেতে পেরেছে, তাদের কল্পনাকে বেশি উজ্জীবিত করতে পেরেছে, তাদের মানস গঠনে প্রভাব ফেলেছে।

এবার বলিকাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে করা সম্ভবত সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগের কথা: মূল লেখকের অবদান অস্বীকার করে কেবল বিদেশী কাহিনী অবলম্বনে লিখে অসংখ্য গ্রন্থের অনুবাদ অ্যাডাপ্টেশন নিজের নামে প্রকাশ করা, তা-ও আবার গোস্ট রাইটারদের মাধ্যমে। মেধাস্বত্বের মানদণ্ডে তাঁকে অপরাধী সাব্যস্ত করাই যায়, সেটা হয়তো সঙ্গতও; বিশেষ করে মাসুদ রানা কুয়াশা বেলাতে যেহেতু এমনকি মূল লেখকদের নামই উল্লেখিত হয়নি কোনো বইয়েই।

এ-প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলব কেবল। আপনাদের মনে হতে পারে নিচের তুলনাগুলো অতিশয়োক্তিপূর্ণ। কিন্তু আমি তা মনে করি না। জার্মানির কৃষক যুদ্ধের সময় ধনিক শ্রেণির পক্ষ অবলম্বন করার জন্য মার্টিন লুথারকে খারিজ করে দেননি ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস। কৃতজ্ঞ চিত্তে স্বীকার করেছেন জার্মান ভাষায় লুথারের বাইবেল অনুবাদের অসামান্য প্রভাবের অবদান। দাস ব্যবস্থা নামক অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি বিশ্বখ্যাত দার্শনিক প্লেটো, অ্যারিস্টটল প্রমুখ মহান দার্শনিক। উল্টো সেটার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেছেন, এমনকি তাঁদের কেউ কেউ দাস মালিকও ছিলেন। কিন্তু সেজন্য আমরা এসব দার্শনিকের অবদান অস্বীকার করি না।

বলা যায়, পোলিশ চিত্র পরিচালক ক্রিস্তফ জানুসির মতো মানুষের উদার দৃষ্টিভঙ্গির কথা, যিনি চীনে তাঁর চলচ্চিত্রের এক পাইরেটেড সিডি বিক্রেতাকে দেখে এ জন্য আনন্দিত হয়েছিলেন যে এই বিক্রেতার মতো মানুষের কারণে বা পাইরেটেড সিডির প্রস্তুতকারকদের জন্য তাঁর কাজ দূরদূরান্তে সুলভে জনমানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে; বলা যায় কপি লেফট আন্দোলনের কথাও। তারপরেও যদি কাজী আনোয়ার হোসেনকে কাঠগড়ায় দাঁড় হতে হয়, সে ক্ষেত্রে বলব শয়তান-কেও তাঁর ন্যায্য পাওনাটা দেবেন, যেমন দেওয়া হয়েছে শয়তান মার্টিন লুথারকে, সর্ব শয়তান সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটলকে।

আমরা বিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি, রাদুগা, মীর প্রভৃতি প্রকাশনা সংস্থার নাম জানি, স্পেনের তলেদো স্কুল-এর কথা জানি, জানি বাগদাদের বায়েত আল-হিকমা-র কথা, অনুবাদের জগতে যে নামগুলো বিশ্ববিশ্রুত। অবশ্য স্বনামধন্য লেখক দিমিত্রি গুতাস বায়েত আল হিকমা-র ব্যাপারে ততটা উচ্ছ্বসিত নন। তিনি বলছেন:

Much ink has been used unnecessarily on descriptions of the bayt al-hikma mostly in fanciful and sometimes wishful projections of modern institutions and research projects back into the eighth century.

জঁ দিলেইলে এবং জুডিথ উডসওয়ার্থ সম্পাদিত ট্রান্সলেটর্স থ্রু হিস্ট্রি বইটি থেকে কিছু কথা উদ্ধৃত করা যাক:

Gutas advocates a “minimalist interpretation” of what he believes was merely a library, where, moreover, translations were made, not of Greek manuscripts, but of Persian texts. He does concede, nevertheless, that the bayt al-hikma created a climate in which the Graeco-Arabic translation movement, described below, could thrive [Gutas 1998: 54–59].

গত শতকের ষাটের দশকের প্রথমার্ধে কাজী আনোয়ার হোসেন প্রতিষ্ঠিত প্রজাপতি লোগো সম্বলিত সেবা প্রকাশনী নানান দিক থেকেই অনন্যতার দাবিদার: তাদের বইয়ে দেশের সর্বস্তরের পাঠকদের উপযোগী সহজ-সরল, নির্মেদ, প্রসাদগুণ সম্পন্ন ভাষা এবং নির্ভুল বিদেশী শব্দের সঠিকউচ্চারণনির্ভর বানানের ব্যবহার, বইয়ের শেষে আলোচনা বিভাগ-এর মাধ্যমে পাঠক-ক্রেতা-গুণগ্রাহী-সমালোচকদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে তাঁদের মতামত জানা, পেপারব্যাক বই ছাপার মাধ্যমে সর্বসাধারণের কাছে সহনশীল দামে বই বিক্রি সেই কবে থেকে চমৎকার বিপণনের সাহায্যে খুচরা বিক্রেতাদের মাধ্যমে পাঠকের কাছে প্রয়োজনে ডাকযোগে ক্রেতার বাড়িতেদূর মফস্বল অব্দি বই পৌছানো, লেখকদের সম্মানী তথা রয়্যালটি তাঁদেরকে পাই পাই রে যথাসময়ে বুঝিয়ে দেয়া (সম্প্রতি সেবার একজন বরেণ্য লেখক  অনুবাদক শেখ আবদুল হাকিমের সঙ্গে কপিরাইট সংক্রান্ত ঝামেলায় জড়িয়ে, এবং আদালতে মামলায় হেরে তাদের সে-সুনাম বেশ ক্ষুণ্ণ হয়েছে অবশ্য), বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অনুবাদক সৃষ্টি এসব বৈশিষ্ট্য বাংলা প্রকাশনে জগতে অনুকরণযোগ্য

সব শেষে বলবো, আপন ঢোল পেটানোর মোচ্ছবের এই যুগে, আত্মপ্রচারমূলক আমাদের এই সমাজ সংস্কৃতিতে কাজী আনোয়ার হোসেনের মতো আত্মপ্রচারবিমুখ মানুষটির কাছে, আমাদের দেশের প্রগতি, আমাদের তলেদো স্কুল, আমাদের বায়েত আল হিকমা-র প্রতিষ্ঠাতার কাছে কি আমাদের কোনো ঋণ নেই?