চট্টগ্রামের ভাষা ও দুখিনি মায়ের গল্প
ঘরে আঁসে ঘরে হাঁদে
ঘরে আঁসে ঘরে হাঁদে
ঘরে মানুষ তোয়ায়
সুন্দর ঘরগান ছাড়ি গেলগুই
আঁ–র উগ্গা ফোয়ায়।
[ঘর হাসে, ঘর কাঁদে
ঘর মানুষ খোঁজে
সুন্দর ঘরটি ছেড়ে চলে গেল
আমার একমাত্র ছেলেটি]
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষার প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো, এর কোনো নিজস্ব বর্ণমালা নেই। বাংলা বর্ণমালা দিয়ে চট্টগ্রামের ভাষার শতভাগ বোঝানো যায় না। এর প্রধান কারণ বাংলা ভাষার বাইরেও চট্টগ্রামের ভাষার নিজস্ব কিছু ধ্বনি আছে। যেসব ধ্বনির লিখিত রূপ নেই। চট্টগ্রামের ভাষার কিছু ছদ্মবেশী ধ্বনি আপাতদৃষ্টে বাংলার কোনো ধ্বনির মতো মনে হয়, কিন্তু শেষ বিচারে সেগুলোর মধ্যে সুক্ষ্ম তারতম্য থেকে যায়। এই তারতম্যের কারণে বাংলা বর্ণমালা দিয়ে লিখলে চট্টগ্রামের ভাষার ধ্বনি ও এর বাচনভঙ্গি [accent] যথাযথভাবে ফুটে ওঠে না। অনেক সময় চট্টগ্রামভাষীও বাংলা বর্ণমালায় লিখিত চট্টগ্রামের ভাষা সে কারণে বুঝে উঠতে পারেন না। এখানে একটা উদাহরণ দিই। চট্টগ্রামের একটি শব্দ ‘ফইর’। এই একটি শব্দ অতিসুক্ষ্ম বাচনভঙ্গি ও শ্বাসাঘাতের তারতম্যের কারণে তিন রকমের অর্থে দাঁড়ায়। সেই সূক্ষ্ম তারতম্যগুলো বাংলা কোনো বর্ণমালা দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়।
‘ফইর’ শব্দটি একভাবে যদি আমি উচ্চারণ করি এর অর্থ দাঁড়ায়—পুকুর।
যদি অন্যভাবে উচ্চারণ করি, তবে এর অর্থ দাঁড়াবে—ফকির। [দরবেশ, ভিক্ষুক]।
ওপরের দুইটা থেকে আরও আলাদাভাবে উচ্চারণ করে বোঝানো হয়—পাখির পালক।
এ কারণে চট্টগ্রামের ভাষাকে বাংলা বর্ণে লেখার কাজটা আসলে অসম্পূর্ণ একটা কাজ। চট্টগ্রামের ভাষা প্রধানত শ্রুতিনির্ভর। আর্যভাষা থেকে আগত এই মুখের ভাষায় কত হাজার বছর ধরে সাগর পাহাড়বেষ্টিত একটি বিরাট অঞ্চলের মানুষের ভাববিনিময় হচ্ছে। সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, বিস্ময়, পুলক প্রকাশিত হচ্ছে। তারা গান করছেন, সাহিত্য রচনা করছেন। ছোটবেলা থেকে দাদি, নানির মুখে শুনেছি অজস্র শ্লোক। যেকোনো কাজে, কথায় তারা ফুরফুর করে উচ্চারণ করে যান ছড়া। যেসব ছড়ার কোনো বই নেই। শত শত বছর ধরে এগুলো মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে। যুগে যুগে নিঃশেষ হওয়ার নিয়তি মেনে নিয়েছে কত ভাষা। হয়তো এই মুহূর্তে যখন এই লেখাটি লিখছি, পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে কোনো একটা ভাষাভাষীর সর্বশেষ মানুষটা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। আর সঙ্গে সঙ্গে লোপ পেয়ে গেল একটি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, আচার আচরণ, সাহিত্য।
চট্টগ্রামের ভাষারও কি এই নিয়তি হবে? এই ভাষাও কি বিনাশের ঝুঁকির মধ্যে আছে? পরিস্থিতি বিবেচনায় মনের মধ্যে এ রকম শঙ্কা জাগে। বর্ণমালাহীনতা, বাংলা মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রসার, নগরায়ণ, শিশুদের বাংলা চলিত ভাষায় কথা বলার অভ্যাস করানো, প্রচুর বাংলা ও বিদেশি শব্দের অনুপ্রবেশসহ নানা কারণে মানুষের বাগপ্রবণতা থেকে এই ভাষা ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, এখনো বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এক বিশাল জনপদের অর্ধকোটির বেশি মানুষ এই ভাষায় কথা বলে, গান গায়, মুখে মুখে শ্লোক বলে, সাহিত্য রচনা করে। বাংলার আশ্রয়ে এর বর্ণমালাকে ব্যবহার করে শ্রুতিনির্ভরতার সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করে যাচ্ছে চট্টগ্রামের ভাষা। বাংলা সাহিত্যের বহু উৎকৃষ্ট গল্প, উপন্যাস, কবিতায় চট্টগ্রামের ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। শত শত বছর ধরে প্রচলিত বহু বচন, শ্লোক, ছড়া, লোককথা এখনো মুখে মুখে ফেরে চট্টগ্রামের মানুষের। বাংলা সাহিত্যকে যদি আমরা একটা অনন্তপ্রবহমান জলধারা বা নদীর মতো চিন্তা করি, তবে চট্টগ্রামের ভাষা সেখানে ক্ষীণ হলেও একটি ছোট উপ বা শাখানদী; যা মূল প্রবাহে অনবরত জলের জোগান দিয়ে চলেছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গান ও তার সুর চট্টগ্রাম বাইরে তো বটেই, এমনকি দেশের সীমানা ছাড়িয়েও বহু মানুষের হৃদয়কে আর্দ্র করে রাখে। প্রচলিত লোকছড়া ও গান ছাড়াও বর্তমান কালের লেখকেরাও চট্টগ্রামের ভাষায় রচনা করে চলেছেন ছড়া, গান ও অন্যান্য সাহিত্য। এখনো দাদি-নানিরা কথায় কথায় ছড়া কাটেন। যেকোনো পুলক বা বিষাদে দরিয়ার ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে হৃদয় নিংড়ানো সব পঙ্ক্তিমালা। পুত্রশোকে বলে ওঠেন—
ঘরে আঁসে ঘরে হাঁদে
ঘরে মানুষ তোয়ায়
সুন্দর ঘরগান ছাড়ি গেলগুই
আঁ–র উগ্গা ফোয়ায়।
গত শতকের চল্লিশের দশকে চিত্ত সিংহ নামের এক কথাসাহিত্যিক ‘বারোমাইস্যা নামে’ একটি উপন্যাসও লিখেছেন চট্টগ্রামের ভাষায়। কথাসাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদের বিখ্যাত উপন্যাস ‘কর্ণফুলী’তে চরিত্রগুলোর কথোপকথন চট্টগ্রামের ভাষায়। কবি আল মাহমুদের কবিতায় উঠে এসেছে চট্টগ্রামের অনেক শব্দ। দুই বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়ার ছড়ার বই ‘কোয়াল খাইয়ে’ পুরোটাই চট্টগ্রামের ভাষায় রচিত। চট্টগ্রামের ছড়াকারেরা নিয়মিতই ছড়া লিখে যাচ্ছেন। চট্টগ্রামের ভাষার সাহিত্যের ছোটকাগজও অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এ ছাড়া সর্বশেষ প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে অন্তর্জালে আজকাল চট্টগ্রামের ভাষায় সংবাদ চ্যানেলেরও আবির্ভাব হয়েছে। অনেকেই চট্টগ্রামের ভাষায় রচিত লেখালেখি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই সব মাধ্যম যতই বিকশিত হবে, চট্টগ্রামের ভাষাও ততই বেগবান হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চট্টগ্রামের ভাষার আয়ু ক্ষয়ের আশঙ্কা দিন দিন কমছেই।
দুখিনি মায়ের গল্প
আমি আমার ছেলেমেয়েদের খুব একটি গল্প বলিনি। কিন্তু সব সময় নিজের মায়ের কাছ থেকে গল্প শুনে আসছি, সেই ছোটবেলা থেকেই। এখনো মায়ের শরীর যদি একটু ভালো থাকে, আমাকে কাছে পায়, গল্প শুরু করে। তার প্রায় গল্পে একটি পদ্য থাকে। প্রথমে মা পদ্যটি বলে। তারপর সেই ছন্দোবদ্ধ লাইনগুলো কোন্ প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে, তার একটি ব্যাখ্যা দেয়। সেই ব্যাখ্যাটাই হচ্ছে গল্প। চট্টগ্রামে লোকমুখে প্রচারিত ছড়াগুলোর এটি একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিষয় এবং শৈল্পিক বিচারে এসব গল্পছড়ার কিছু কিছু পৃথিবীর যেকোনো ভাষার চিরায়ত লোকছড়ার সমতুল্য। আমার মায়ের মুখ থেকে শোনা অনেক গল্পের মধ্যে আজ একটি গল্প ও তার ছড়া তুলে ধরছি। তবে এ প্রবন্ধে উল্লেখিত বেশির ভাগ ছড়া আমার মায়ের মুখে শোন। তাতেই চট্টগ্রামের প্রচলিত ছড়ার গুণ এবং এর আদল পাঠকের কাছে স্পষ্ট হবে।
চোখ ভেজানো এই গল্প এক দুখিনি মায়ের। প্রথমেই গল্পের ছড়াটি পড়ি।
ঝুরঝুরাইয়া ঝুরঝুরাইয়া
ন–অ আইস্য ঝড়
মা–রে বনবাস দিই
ফুত যক ঘর
[ঝুরঝুর ঝুরঝুর করে
এসো না তুমি ঝড়
মাকে বনবাস দিয়ে
ছেলে যাক ঘর]
মায়ের কেন আকুতি ঝড়ের প্রতি। গল্পটা শোনা যাক।
জয়তুন বিধবা। একটিমাত্র ছেলে। ছেলেকে বড় কষ্টে লালন করেছে। লেখাপড়া শিখিয়েছে। ছেলে বড় হয়েছে। বিয়ে করেছে। ছেলের সংসার হয়েছে। এ বড় সুখের খবর। কিন্তু দিন দিন ছেলের ব্যস্ততা যত বাড়ছে, ততই মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। দূরত্বটা ক্রমশ বাড়ছে। আগের মতো ছেলে তার মায়ের কাছে আসে না। ছেলের বউ খুব চালাক। কৌশলে শাশুড়িকে তার ছেলের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। কাছে ঘেঁষার সুযোগ দেয় না। মায়ের নামে নানা কথা শুনিয়ে ছেলের মনটাকে ভারী করে রেখেছে বউ। মা চোখ বুজে সব সহ্য করে। কিছুই বলে না। পাশে ছেলের ঘরে অশান্তি হয়। একদিন ছেলে বাজার থেকে একটি বড় মাছ নিয়ে আসে। বড় মাছ দেখে মা খুব খুশি। মাছটি দেখে মুড়োটা খেতে বড় মন চাইল জয়তুনের। তাই ছেলের বউয়ের কাছে গিয়ে বলল– ও বউ, কত দিন মাছের মাথা খাইনি। আজ আমাকে মাছের মাথাটা খেতে দিস।
বউ বলল– ওমা! এ কেমন কথা? মাছের মাথা খাবেন, তাতে অসুবিধা কী? আপনি খাবেন না তো কে খাবে? সবাই যখন খেতে বসব, তখন আপনি শুধু একটু মনে করিয়ে দেবেন।
জয়তুন বলল— না না, ছেলের সামনে বলতে পারব না। বড় লজ্জা লাগবে আমার।
শাশুড়ির লজ্জার কথা শুনে বউ কিছুক্ষণ হাসল। তারপর বলল— নিজের ছেলেকে লজ্জা পান, অথচ আমি পরের মেয়ে, আমাকে লজ্জা পেলেন না? আচ্ছা, ঠিক আছে, মাছের কথা বলতে হবে না, আপনি শুধু খাওয়ার সময় বলবেন— ওই। ওই বললেই আমার মনে পড়ে যাবে আপনি মাছের মাথাটা খেতে চেয়েছেন।
রাতে ছেলে নিজের কাজ থেকে ফিরে আসার পর সবাই মিলে খেতে বসেছে। মাছের মাথাটা রাখা হয়েছে মাঝখানে। জয়তুনের চোখ পড়ল সেদিকে। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ও বউ, ওই। মনে আছে?
ছেলে তা শুনল। বউয়ের কাছে জানতে চায়— আমার মা কী বলে?
বউ ছেলের কানে কানে বলল, মা লজ্জায় বলতে পারছেন না, তাই আমাকে বলতে বলেছেন। তার নাকি একা একা আর ভালো লাগে না। তিনি একটি বিয়ে করতে চান।
এ কথা শুনে ছেলে অবাক হয়ে বলল, কী, এত বড় কথা! মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড ঘৃণায় ছেলে বলে উঠল, তোমার এতটুকু লজ্জা করল না মা? একথা তুমি বলতে পারলে? এই বয়সে। আমি আর তোমাকে এই ঘরে রাখব না। তোমার মতো মাকে বনবাসে দেওয়া উচিত।
যেই কথা সেই কাজ। তারপর দিন ছেলে মায়ের চোখ বেঁধে জোর করে নিয়ে গেল বনের মধ্যে। বনে মাকে রেখে আসার সময় আকাশে মেঘ দেখা দিল। বাতাস বইতে শুরু করল। এখনই বৃষ্টি নামবে, ঝড় আসবে—এ রকম একটা পরিস্থিতি। মায়ের বড় চিন্তা হলো। মনে মনে বলল, এই ঝড় জলের মধ্যে ছেলে আমার ঘরে যাবে কী করে? তাই ঝড়ের কাছে মায়ের আবেদন। হে ঝড়। তুমি এখন ঝুর ঝুর করে নেমে এসো না। আমার ছেলেটি তার মাকে বনবাস দিয়ে আগে ঘরে ফিরে যাক। তারপর না হয় এসো।
ঝুরঝুরাইয়া ঝুরঝুরাইয়া
ন অ আইস্য ঝড়
মারে বনবাস দিই
ফুত যক ঘর
মাকে নিয়ে কত গল্প, কত কবিতা পৃথিবীর নানা ভাষার মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত আছে। প্রেমিকার জন্য মায়ের হৃদ্পিণ্ড কেটে নিয়ে প্রেমান্ধ ছেলে দৌড়ে চলে যাওয়ার সময় পড়ে গিয়েছিল। ছিটকে পড়া মায়ের হৃৎপিণ্ডটি বলে উঠেছিল— বাবা, ব্যথা পেয়েছিস। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষার মানুষের কাছে মায়ের হৃৎপিণ্ডের এই জিজ্ঞাসার কথা জানা আছে। কিন্তু চট্টগ্রামের মায়ের ঝড়ের প্রতি এই আবেদন পৃথিবীর যেকোনো চোখে জল এনে দেবে।
এ রকম বহু গল্পের ছড়া চট্টগ্রামের ভাষায় আছে, যার মূল্য অপরিসীম। কেননা এগুলো জনপদের সংস্কৃতি, সাধারণ মানুষের ভাবনার স্তর, জীবনযাপনের ধরন সম্পর্কে ধারণা করা যায়। এসবের সাহিত্যিক ও মানবিক মূল্যও গুরুত্বপূর্ণ।
এ রকম আরেকটি গল্প, জেলে আর জেলেনির মধ্যে মান-অভিমান চলছে। কেউ কারও সাথে কথা বলে না সরাসরি। প্রয়োজনে তারা কথা বলে কর্মবাচ্যে। যেমন বউ বলল—সবাই মাছ ধরে যাচ্ছে, সে কি যাবে না?
জেলে-জেলেনির গল্পের ছড়াটা আগে শোনা যাক। জেলে খাটো। জেলেনি লম্বা। তাদের মধ্যে কর্মবাচ্যে কথাবার্তা চলছে।
অক্কলে যার মাছ ধইরতু সে নঅ যার কা?
সকল যাইব খাইয়া দাইয়া সে খাইব কী?
রান্দি এরগি বারি এরগি ফাইরগ্যা নঅ খার কা
কেয়াই লম্বা, কেয়াই বাইট্টা ভাইব্বা নঅ চা’র কা
পি’র উত পি দি ফাইরগা নঅ খা’র কা?
বউ বলছে—সবাই মাছ ধরতে যাচ্ছে, তার কি যাওয়া হবে না?
স্বামী বলছে— সবার তো খাওয়া দাওয়া হয়েছে, তার কি খাওয়া হবে না?
বউয়ের উত্তর— রেঁধে রেখেছি। শিকের উপর থেকে পেড়ে খেতে কি পারে না?
খাটো স্বামী বেচারা শিকের নাগাল পায় না। তাই সে বউকে বলছে— কেউ লম্বা, কেউ বেঁটে, সে ব্যাপারটা ভেবে দেখছে না কেন?
বউয়ের উত্তর— পিঁড়ির ওপর পিঁড়ি বসিয়ে দিলেই তো শিকেয় রাখা ভাত তরকারির নাগাল পাওয়া যায়।
চট্টগ্রামের ভাষায় এ রকম বহু গল্পছড়া ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। নিচের ছড়াটিতে এক নববধূর আহাজারি। মা-বাবা তাকে বিয়ে দিয়েছে নদীর ওপারে। বহুদিন তার মা বাপের সঙ্গে যোগাযোগ নাই।
দইরগার কুলত কড়ই গাছছো
বাতাস আইলে গুজুরে
মায়ে বাপে বিয়ে দিল দইজ্জার পুককুলে
আইসতো চাইলে আইত নঅ পারি
যাইতো চাইলে যাইন নঅ ফারি
লাওয়া বাপে বিয়া দিল দুইজ্জার পুককুলে
ঘাটর আগাত ডালিম গাছছো
লটকি পড়ের আগা
কন পুড়লি দেহাই দিলি
মুই পুড়লির ঘাডা।
[দরিয়ার কুলে হাওয়া এলে শিরীষ গাছটা কেঁদে ওঠে। মা-বাবা আমাকে বিয়ে দিল দরিয়ার পূর্ব তীরে। আসতে যদি চায় কেউ আসতে পারে না। যেতে যদি চাই, যেতে পারি না। আমার সৎবাবা আমাকে বিয়ে দিল দরিয়ার পূর্ব কূলে। ঘাটের কাছে ডালিমের গাছটি কেমন নুইয়ে পড়েছে। কোন্ পোড়াকপালী আমার মতো পোড়াকপালীর বাড়ি দেখিয়ে দিয়েছিল।]
এবারের গল্পটি এক ভাগ্যবিড়ম্বিত পিতৃমাতৃহীন এক মেয়ের। গল্পে কিছুটা জাদুবাস্তবতার আভাস আছে। শিশুকালে মেয়েটি বাবার কাছে বায়না ধরেছে— আকাশের চাঁদটি তার চাই। কন্যাস্নেহে অন্ধ বাবা মেয়ের আবদার রক্ষা করতে গিয়ে মই বেয়ে চাঁদ ধরতে গিয়ে মারা যায়। স্বামীর মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে মেয়েটির মাও মারা যায় কদিন পর। মেয়েটি মানুষ হতে থাকে ছয় ভাইয়ের সংসারে। ভাইয়েরা বাণিজ্যের জন্য দেশের বাইরে গেলে তাদের বউরা একদিন এক জেলের কাছে সামান্য মাছের বিনিময়ে ননদকে বিক্রি করে দেয়। জেলের ঘরে বসে বসে তখন মেয়েটি এভাবে নিজের নিয়তির কথা বলে।
বাপ মরিছে চান পরানে
মা মরিচে শোকে
ছয় বউজে বেচি খাইল
বাডা মাছর লোভে।
ছয় বউজের আসঝাস
বইনেরে দিল বনবাস
[চাঁদ আনতে গিয়ে বাবা মরেছে। মা মরেছে শোকে। ছয় ভাবি আমাকে বিক্রি করে দিল বাটা মাছের লোভে। ছয় ভাবির নির্যাতনে বোন আজ নির্বাসিত দিন কাটাচ্ছে।]
জীবনের ছন্দে ছড়ার বিস্তার
গল্পের সঙ্গে ছড়াগুলো দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। আজকাল মায়েদের সময় কই ছেলেকে কাছে নিয়ে একটু গল্প শোনাবে। গল্প তো আজকাল ছোটরা দেখে। তা ছাড়া জন্ম থেকেই ওরা বাংলা ভাষায় কথা বলে। সাতপুরুষের জন্ম, ভিটেবাড়ি চট্টগ্রামে। কিন্তু তার মা-বাবা চায় না সে সে ভাষায় কথা বলুক। বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে মুখে চট্টগ্রামের ভাষা শুনতে শুনতে হয়তো সে কিছুটা বোঝে, কিন্তু সত্যিকারের বাচনভঙ্গিতে বলতে পারে না। তাই এসব গল্প নতুন প্রজন্মের শিশুরা তাদর মা–বাবা, অথবা দাদি-নানি, দাদা-নানার কাছে শোনে না। একইভাবে নাগরিক জীবনে যেখানে থাকার জন্য এতটুকু বাসা পাওয়া যায় না, সেখানে খেলার মাঠ ক্রমশ দুর্লভ হয়ে পড়ছে। তা ছাড়া খেলার ধরনও পাল্টাচ্ছে। একসময় উপকরণহীন নানা খেলা ছিল আমাদের দেশে। হাডুডু, বউচি, লুকোচুরি, ইচিংবিচিং, বলীখেলা, ওপেন টু বাইস্কোপ, কড়ি খেলা, কানামাছি, লাঠিখেলা, কাবাডি, কুতকুত, গোল্লাছুট, টোপাভাতি, ডাংগুলি, দাঁড়িয়াবান্ধা, পুতুল খেলা, এক্কাদোক্কা, রুমাল চুরি—এ রকম শত রকম খেলায় বাংলার মাঠ, বিল মুখর থাকত। এসব বেশির ভাগ খেলার প্রধান উপকরণ ছিল ছড়া।
বউচি খেলার একটি ছড়ার ছন্দ এবং গাঁথুনির দক্ষতার কারণে একবার শুনলেই মুখস্থ হয়ে যায়।
ও চিয়া চিয়া,
তোর বর বিয়া
উঁইচ দি ডিয়া,
বরকিদি টান
তঅ নদিলি এক কিলি পান, এক কিলি পান...
এ রকম বহু ছড়া আজ মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন তো আর দেখি না ছেলেমেয়েদের কানামাছি খেলার সময় ছড়া কাটতে।
কেন গরিবি গর
বাইন্ধা চোখে হাত বিচারি
আঁরে এক্কানা ধর
দুই হাঁইউত্তুন, তিন হাঁই দিলে
ফইরুত যাই ফর।
[কী করবি কর
বাঁধা চোখে হাত দিয়ে
আমায় একটু ধর
দুই কদম থেকে তিন কদমে
পুকুরে গিয়ে পড়।]
এখন অন্তর্জালে শ্রুতিমাধ্যম বেশ শক্তিশালী হয়েছে। এখনই সময় হারিয়ে যাওয়ার আগে এগুলো আবৃত্তি করে ধরে রাখা। প্রবীণ মানুষ, যাঁরা প্রকৃত শৈশব পেয়েছেন, গোল্লাছুটে মাঠ মাতিয়েছেন, আকাশে ঘুড়ি উড়িয়েছেন, হইচই করে মেলায়, খেলায়, হাটে ঘাটে সময় কাটিয়েছেন, তাঁদের স্মৃতিতে এখনো জমে আছে এই সব ছড়া। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে এই প্রত্নসম্পদগুলো আহরণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
শুধু খেলাধুলায় নয়, জন্মের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি অনুষঙ্গে ছড়া কাটতে ভালোবাসতেন মানুষ। কোনো ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ছড়া কেটে তার প্রতিক্রিয়া জানানো, কাউকে ব্যঙ্গ করে, খনার বচনের মতো কোনো স্বতঃসিদ্ধ কথা, চাষবাস, মাছ ধরা, গাছের গুণাগুণ, রান্নাবান্না, প্রতিটা বিষয় নিয়ে চট্টগ্রামের মানুষের নিজস্ব শ্লোক আছে।
অলস, বেশি খাওয়া এক মেয়েকে নিয়ে ব্যঙ্গ।
আতিনা ফিরা এক ফাল
তিন সাইন্না এক গাল
পোড়ালী ধপ্পর
ফলর হরা লপ্পর
[সামনের ঘর থেকে পেছনের ঘরে যেতে এক লাফ
তিনটি পিঠা এক গালে সে খেয়ে ফেলে
ঘর ঝাড়ু দেওয়ার নামে আসলে সে শুধু ধুপধাপ করে]
তুমুল বর্ষায় মন কেমন করা দিনগুলোর ছড়া—
ঝড় ফরেদ্দে টিবির টাবির
বারে ভিজের লাই
পুরান হাইল্যা দোস্ত আইয়ির
ফানর কিলির লাই।
[টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে
বাইরে ধানের ঝুড়ি ভিজছে
আমার পুরোনো বন্ধু আসছে
এককিলি পানের জন্য]
সাগর তীরে ছোট শামুককে দেখে প্রশ্ন
এক্কানাচারা কড়লি
দইরগা কেনে ফারলি?
[একটুখানি কড়ি, তুই এত বড় সাগর পাড়ি দিয়ে কীভাবে এই তীরে এলি?]
রেলগাড়ির চালকের কোনো ছুটিছাটা নেই, সে বাড়ি যেতে পারে না। তাই তার জন্য শ্লোক—
আঁত্তে নাইদে ঘরবাড়ি
আঁই চালাইদি রেলগাড়ি
[আমার ঘরবাড়ি নেই, আমি রেলগাড়ি চালাই]
ভাত খেয়ে যারা তড়িঘড়ি করে শুয়ে পড়ে তাদের জন্য ব্যঙ্গ—
হাইলাম ভাত
ভইরলু পেট
পেটে হদ্দে আঁরে
লইয়েরে লেট।
[খেলাম ভাত, ভরল পেট, পেট বলছে এবার আমাকে নিয়ে শুয়ে যাও]
যারা ভাত বেশি খান, তাদের সচেতনতার জন্য ছড়া—
উনাভাতে দুনা বল
বেশি ভাতে রসাতল
[সামান্য কম খেলে তার গায়ে জোর থাকে, বেশি খেলে রসাতলে যেতে হয়]
আদিরসাত্মক ছড়ারও কমতি নেই চট্টগ্রামে।
উয়া উয়া তুয়া তুয়া
এই দুনুয়া কী
দেইখতে লাগের নরম তরম
ধইরতা দিবানি?
[উঁচু উঁচু ঢিবির মতো ওই দুইটা কী, দেখতে মনে হচ্ছে নরমশরম। ধরতে দেবে নাকি?]
গায়ের রং দেখে যারা পাগল হয়ে যায় তাদের প্রতি সতর্কতা।
লাল দেইয়িরে ফাল নদিও
ইবা মেডির দলা
কাম ন জানে, টাম ন জানে
কী গরিবু ধলা
[লাল দেখে ফাল দিয়ো না। যদি কাজকর্ম কিছুই না জানে, তবে ফর্সা দিয়ে কী হবে? ওটা তো আসলে কাদামাটির দলা।]
বাংলাদেশের খাদ্যভাণ্ডার নামে পরিচিত চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার গুমাইবিলের নবান্নে ধান কাটার উৎসব নিয়ে ছড়া বা শ্লোক—
আঁতত কাঁচি, কোঁরত দা,
ভাত খাইতু রইন্যা যা
[হাতে কাস্তে, কোমরে দা
ভাত খেতে রাঙ্গুনিয়া যা]
কালের গর্ভে ক্রমশ বিলীয়মান এই সব সম্পদের উদাহরণ দিতে গেলে এখনো শত পৃষ্ঠায় শেষ হবে না। মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাওয়া ছড়িয়ে থাকা এই সব ছড়া যেন মানুষের জীবনের ছন্দেই রচিত হয়েছে।
থেমে নেই স্রোতের প্রবাহ
নদীর সঙ্গে ভাষার তুলনা বহু পুরোনো। পুরোনো হলেও সেই তুলনা যথার্থ। নদীর যেমন বাঁক পরিবর্তন হয়, ভাঙা গড়া আছে, তেমনি নানা বিবর্তনের ভেতর দিয়ে ভাষা গড়িয়ে যায়। চট্টগ্রামের মানুষের মুখের ভাষাও তার ব্যতিক্রম নয়। ভাষা পাল্টেছে যুগের সঙ্গে সঙ্গে, সমাজ ও তার সংস্কৃতিও পাল্টেছে। গত এক শ বছরে আন্তর্জাতিক, জাতীয় জীবনে ঐতিহাসিক পটপরিবর্তন হয়েছে। তাতে নানা দিক থেকে পরিবর্তন হয়েছে চারপাশের চেনা জগতের। জীবনের ধারার পরিবর্তন, আচার আচরণের বদল, আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বদলে যেতে যেতে লোকজ শিল্পের সৃষ্টির ধরনও পাল্টে গেছে। সেই পাল্টে যাওয়া সমাজে এখন আর মুখে মুখে ছড়া কাটার অভ্যাসও কমে গেছে। তবু এখনো মানুষ মনের আবেগে, পুলকে, বেদনায় নতুন কোনো বচন উচ্চারণ করে ফেলেন। তবে সেটা লোকশিল্পের মর্যাদায় যেতে পারে না তৎক্ষণাৎ। যুগে যুগে তা মানুষের মুখ থেকে মুখে ঘুরে বেড়াতে হয়, তখনই তা হয়ে ওঠে লোকছড়া। তবে সুখের বিষয়, আবহমান কাল ধরে মানুষের অন্তর থেকে উৎসারিত এই সব ছন্দের ঝংকার কিন্তু থেমে নেই। বাংলা ভাষায় নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করেন এ রকম অনেকেই সচেতনভাবে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ছড়া কবিতা লিখে চলেছেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ছড়া লিখিয়েদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রণী নামটি মসউদ উশ শহীদ। সত্তর দশকের এই ছড়াকার হঠাৎ করে লেখালেখি থামিয়ে দিলেও তার লেখা দু-একটা ছড়া আমাদের মনে পড়ে। মসউদ উশ শহীদের একটি ছড়া—
আঁরা থাগি দুইজ্যার পারত
আঁরা বাড়ি মুরার খোরত
আঁধা–ছোঁধা ঝড় তুয়ানত
আঁরা ন থাআই ঘরর কোনত
ঘর ভাঙিলি বানাই ঘর
মুরার শি’য়াত বানাই শঅর
[আমরা থাকি নদীর পারে, আমাদের বাড়ি পাহাড়ের কোলে, তুমুল ঝড় বাতাসে আমরা ঘরের কোণে পড়ে থাকি না। ঘর ভাঙলে আবার নতুন করে ঘর বাঁধি, পাহাড়ের চূড়ায় আমরা শহর বানাবার ক্ষমতা রাখি]
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার ছড়াকারদের আরেকটি নাম এখানকার সাধারণ মানুষ খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রেখেছে। তিনি হলেন নূর মোহাম্মদ রফিক। জনপ্রিয় এই ছড়াকার ছড়া লিখেছেন কম, কিন্তু বিষয় বাছাই, শব্দের গাঁথুনির দক্ষতা, ছন্দের ওপর দখল, তীব্র শ্লেষ ও ব্যঙ্গ থাকার কারণে শ্রোতা-পাঠকের দৃষ্টি কেড়েছে।
ছগরবাছি চাই যও ভাই তোঁয়ারা
রাস্তার উয়র আজব উগগা ফোয়ারা
এস্টেডিয়াম বিমান অফিস পিছদি
জামালখান লেনর থোরা নিছদি
বলখত বলখত পানি উডের হাপ্তাভর
আছা যাওয়া লোকে নানান কথা ক’র
কেঅ কদ্দে দইজ্জার পানি ভাছি যার
কেঅ কদ্দে কারবার বড় চমৎকার
হেই পানি লই খেলা খাদ্দে পোয়াছা
ঘুমত রইয়ে পানির মালিক ওয়াছা
[নগরবাসী তোমরা দেখে যাও। রাস্তার ওপর আজব একটা ফোয়ারা। স্টেডিয়াম বিমান অফিসের পেছনে, জামালখান লেনের কিছু নিচে, ছলকে ছলকে পানি উঠছে সপ্তাহজুড়ে। আসা যাওয়ার পথে লোকজন দেখে নানা কথা বলছে। কেউ বলছে, নদীর পানি ভেসে যাচ্ছে। কেউ বলছে, ব্যাপারটা বড় চমৎকার। সেই পানি নিয়ে ছোট ছেলেমেয়েরা খেলছে। আর পানির মালিক ওয়াসা ঘুমিয়ে রয়েছে।]
নূর মোহাম্মদ রফিকের লেখা পড়ে চট্টগ্রামের ভাষায় ছড়া লিখতে উৎসাহী হয়েছেন আমাদের দেশের ছড়ার জাদুকর সুকুমার বড়ুয়া। তাঁর ছন্দের জাদুতে তিনি বর্তমান কালের চট্টগ্রামের ছড়াকে এক লহমায় যেন অনেক দূর নিয়ে গেলেন। চট্টগ্রামের ভাষায় ছড়ার একটি বই লিখে ফেললেন তিনি। বইটির নাম ‘কোয়াল খাইয়ে’। সুকুমার বড়ুয়ার দুটো ছড়া পাঠকদের জন্য উদ্ধৃত করছি।
মাছ নিবো ফইন্যা
বড় কালি ঘইন্যা
নুন নাই তেল নাই
নাই জিরা ধইন্যা
মনে মনে বিয়া গরে
সিনেমার কইন্যা।
[কালবাউশ মাছ কিনতে যাচ্ছে উনি, কিন্তু তার ঘরে নুন, তেল, জিরা, ধনে—কিছু নেই। সিনেমা দেখেই তার নায়িকাকে বিয়ে করেন।]
চিনাজোঁক
ফিরিঙ্গিবাজার গিরিঙ্গি লাগায়
যার তার লগে কেরপেট
পরঅরে খাবায় আধা পেডি আর
নিজে খাই ফেলায় দেড় পেট
জিলাপির পেঁচ নরম নরম
আঁতুরির পেঁচ শক্ত
চিনাজোঁক আহা কত মোলায়েম
কত জোরে টানে রক্ত
[ফিরিঙ্গি বাজারের এক লোক যার তার সাথে ঝগড়া লাগায়। কাউকে কিছু খেতে দেয় না, কিন্তু নিজের দেড় পেট কায়। জিলাপির প্যাঁচ খুব নরম, কিন্তু অন্ত্রের প্যাঁচ খুব শক্ত, চীনাজোঁক দেখতে কত মোলায়েম আর নরম মনে হয়, কিন্তু সে নিমেষে রক্ত টেনে নেয়]
চট্টগ্রামের ভাষায় ছড়া লিখছেন সনজীব বড়ুয়া, আবু মুসা চৌধুরী, আলেক্স আলীম, সন্তোষ বড়ুয়া, উৎপল কান্তি বড়ুয়া, অরুণ শীল, আবুল কালাম বেলাল, তালুকার হালিমসহ আরও অনেক লিখিয়ে। আগ্রহী পাঠকদের জন্য কয়েকটা ছড়ার উদ্ধৃতি নিচে তুলে ধরছি।
সনজীব বড়ুয়ার একটি ছড়ায় সাম্প্রতিক নৈরাজ্যের একটি ছবি পাওয়া যায়—
ছনর ছানির ঘর গেইয়ে গৈ
টইনর ছানি যার
কউচ্চা কউচ্চা গাছর ফাঁগে
দালানে কাউপপার
বিজ্ঞানে তো আউগগাই গেইয়ে
মানুষ পিচ্ছা যার
লোভ–লালচ আর খুনাখুনি
দুনিয়া ছারখার।
[ছনের তৈরি চাল চলে গেছে, টিনের ছাউনিটাও যাবে যাবে। সবুজ সবুজ গাছের ফাঁকে দালান উঁকি দিচ্ছে। বিজ্ঞান এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মানুষ পিছিয়ে যাচ্ছে]
অরুণ শীলের নিচের ছড়াটি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী লোকছড়ার মেজাজ পাওয়া যায়।
লুচুর লুচুর আইঅর যঅর
পুচুর পুচুর কতা কঅর,
কুন্দ্দি বাঁজর কইজ্জা!
অ জেডি তুঁই ফইজ্জা ।
[চুপি চুপি আসছো যাচ্ছো/ ফিস ফিসফিস কথা বলছো / কোনদিকে লাগাছো ঝাগড়া!/ জ্যাটি তুমি দুষ্ট প্রকৃতির।]
চট্টগ্রামের ভাষার ছড়াগুলোর জনপ্রিয়তা অতুলনীয়। বিশেষ করে সমসাময়িক ঘটনার ওপর রচিত ছড়াগুলো বেশ কয়েক দিন ধরে মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আমিও মাঝে মাঝে দু-একটা ছড়া লিখেছি সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে। মশার উৎপাত নিয়ে লেখা একটি ছড়া পাঠকদের জন্য পেশ করছি।
কানর হাছে মশা বেয়াগ্গুন
একনাগাড়ে ভ্যান ভেনার
মশারিয়ান টাঙিবারলাই
বউ উগ্গা ফ্যান ফেনার।
নালার ভিতর, খৈয়ার ভিতর
মশায় পাড়ের আন্ডা
ডরে মাইনসুর কৈলজা গুইলদা
অই যারগুদদে ঠান্ডা।
একখানাছাড়া পতঙ্গ তুই
ফুটায় দিলি শক্ত হূল
রক্ত চুষি, ডেঙ্গু ছড়াই
বাঁধাই দিল হুলুস্থুল।
ওষুধ ছিডার, কামান দাগের
তঅতো মশা মইরতো নঅ
আসল ভেজাল হন্ডে আছে
কেয়াই তারে ধইরতো নঅ।
[কানের কাছে মশা সব অনবরত ভ্যান ভ্যান করছে। মশারিটা টাঙিয়ে দেওয়ার জন্য বউ বকবক করছে। নালায়, ডোবায় মশা ডিম পাড়ে। ভয়ে মানুষের রক্ত হিম হয়ে যায়। একটুখানি পতঙ্গ মশা শক্ত হুল ফুটিয়ে রক্ত চুষে নিয়ে ডেঙ্গু ছড়ায়। হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিল। ওষুধ ছিটিয়ে, কামান দাগিয়ে মরবে না। আসল ভেজাল কোথায় আছে সেটা কেউ ধরবে না।]
ভাষার লিখিত রূপ আবিষ্কারের অনেক আগে থেকেই মানুষ কবিতা রচনা করে আসছে। মানুষের স্মৃতিই এর বড় বাহন। বাংলা ভাষার ওপর নির্ভরতা সত্ত্বেও চট্টগ্রামের ভাষায় সাহিত্য রচিত আগে যেমন হয়েছে, এখনো চলছে। ভবিষ্যতেই এই ধারা চট্টগ্রামের পাহাড় থেকে উৎসারিত ঝরনার মতো বেগবান থাকবে। কেননা অন্তর্জালসহ নানা বৈদ্যুতিন বাহনে এখন শ্রুতিনির্ভর মাধ্যম খুবই শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী। চট্টগ্রামের ভাষায় সংবাদের চ্যানেলও চালু হয়েছে। সেগুলো সারা বিশ্বে অবস্থানরত চট্টগ্রামের মানুষেরা লুফে নিচ্ছে। আর ছন্দেগাঁথা শিল্প শোভনীয় ছড়া হলে তো কথাই নেই।
@ওমর কায়সার আপনাকে ধন্যবাদ জানাই এমন একটি তথ্যবহুল লেখার জন্য। আমি বর্তমানে চাটগাঁইয়া ভাষা নিয়ে টুকটাক কাজ করার চেষ্টা করছি। আমার পরিকল্পনায় বর্ণমালা, ব্যকরণ, সাহিত্য সম্পর্কে অল্পবিস্তর চিন্তা ভাবনা আছে। এ ব্যাপারে বিশদ আলোচনা করতে পারলে বা আপনার কোনো পরামর্শ পেলে উপকৃত হবো। অনুগ্রহ করে আপনার সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় বলবেন কি দয়া করে?
Saeed Moin
আগস্ট ০৮, ২০২২ ২৩:১৩
অনেক ধন্যবাদ লেখাটি প্রকাশের জন্য।
ওমর কায়সার
সেপ্টেম্বর ০১, ২০২১ ২৩:০৯
ভালা লাইগ্যে। হাইল্যা পুকুর-এরেও ফইর আর ফকির-এরে ফইর ইয়ার মানিন্নপারির। পুকুর ত’ পইর অনর হতা।
মাসুদ আনোয়ার
সেপ্টেম্বর ০২, ২০২১ ০০:১০
বেশ ভালো লাগল। লেখকের জন্য শুভ কামনা। রাবেয়া খাতুনের চট্টগ্রামের ভাষায় রচিত ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ উপন্যাসটাও অনবদ্য সৃষ্টি।
হুসেইন ফজলুল বারী
সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২১ ১৩:৫০