আশির পার্থ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন
আশির দশকের শক্তিমান কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন। বাংলা কাব্যজগতে কিছুটা দেরিতে তাঁর প্রবেশ। বয়সের বিচারে তিনি ষাটের শেষার্ধের বা সত্তরের প্রথমার্ধের কবি হতে পারতেন, তাঁর কবিতাচর্চার প্রারম্ভকালও সেটাই। সজ্ঞানেই তিনি আশির দশকের শুরুতে আবির্ভূত হলেন। একদিকে সত্তরের স্লোগানমুখর ঝাঁজালো ধারা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে, অন্যদিকে অনেক নক্ষত্রজ্বলা ষাটের দশকে হারিয়ে না যেতে তাঁর এই সতর্ক পদক্ষেপ। ‘নির্জীব উদ্ভাসহীন’ আর ‘প্রখর স্লোগানচারী’ সত্তর দশকের অন্তর্ভুক্ত হতে চাননি সচেতনভাবেই। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতার স্বরটি আলাদা; আশির দশককেই তাঁর মনে হলো প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন, যেখানে তিনি নিজেকে একজন ‘স্থিতপ্রজ্ঞ দার্শনিক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। মননশীলতায় ঋদ্ধ প্রথম গ্রন্থ ‘তিন রমণীর ক্বাসিদা’য় রয়েছে ঐতিহ্যিক মন্ময়তা। ঐতিহ্যসূত্রকে ছিন্ন না করে নতুন উচ্চারণে বাংলা কবিতার অভিমুখ ফেরাতে চেয়েছেন নন্দনের দিকে। বইটি শুরুতেই দৃষ্টি কাড়ল কাব্যমোদীদের এবং প্রকাশের তিন বছর না পেরোতেই আলাওল সাহিত্য পুরস্কার পেল। এ গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘প্রার্থনায় নম্র হও পাবে’-তে তাঁর প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ:
পৃথিবীর সর্বশেষ কবি আমি অহংকার আমার কবিতা।
‘তিন রমণীর ক্বাসিদা’-য় খোন্দকার আশরাফ হোসেন যে তিন রমণীর শাব্দিক চিত্র আঁকলেন, তারা জননী, জায়া ও দয়িতার ত্রিমাত্রিক ভূমিকায়। তিন রমণী চিরকালই সাহিত্য ও চিত্রকলার এক কৌতূহলকর বিষয়। শেকসপিয়ারের ম্যাকবেথে পাই তিন ডাইনির সাক্ষাৎ। পটুয়া কামরুল হাসানের ছবিতেও তিন রমণী যূথবদ্ধ দাঁড়িয়ে। সেখানে তারা সহচরী, একই বয়সের নারী। খোন্দকারের কবিতায় সেই চিত্রটি আছে কবিতাটির প্রথম অংশে, দ্বিতীয় অংশে পাই দার্শনিক অভিজ্ঞানপূর্ণ পুরাণের মতো ছবি, দ্বিতীয় অংশ সমুখে নিয়ে আসে শেকসপিয়ারের তিন রমণীকে, অপ্রত্যাশিত যাদের আবির্ভাব, অভিশাপে যার জর্জর করে দেহ। তৃতীয় অংশে পরিস্ফুট হয় জননী, জায়া ও দয়িতার ছবি। এমনিভাবে অধীত অনেক চরিত্র ও প্রেক্ষাপট উঠে আসে খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতায়, আসাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেন না তিনি, অধীত বিষয়কে স্থাপন করেন বাংলার আলো-হাওয়ায়, ঐতিহ্যকে করে তোলেন মননের কেন্দ্রভূমি।
দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘পার্থ তোমার তীব্র তীর’-এ দার্শনিকের ভূমিকা ছেড়ে তিনি বাংলা কবিতার পার্থের ভূমিকা নিলেন। সমাজভাবনাকে উপস্থিত করলেন নান্দনিকতার বিবিধ মাত্রায়। খোন্দকারের তীব্র জীবনমুখীনতা ও সমাজমনস্কতা খুঁজে পাওয়া যায় এ গ্রন্থে। প্রথম গ্রন্থে যা ছিল চিরকালীনতার শব্দমালা, দ্বিতীয় গ্রন্থে তা সমকালীনতার শৈল্পিকরূপে প্রকাশিত হলো। দুটি কাব্য তাঁকে পাকাপোক্ত আসন দিল বাংলা কবিতার মঞ্চে। দ্বিতীয়ের প্রারম্ভেও প্রথম গ্রন্থের সমান্তরাল আত্মপ্রত্যয়ী ঘোষণা:
আমি একটু অন্যরকম পেখম মেলার ইচ্ছা রাখি
বুকে আমার একটু জখম অন্য রকম,
সুতরাং তিনি তাঁর অভিপ্রায় ও আত্মবিশ্বাসকে লুকিয়ে রাখেননি। ছিল আত্মগর্বী উচ্চারণ—‘তোমরা বামন, হ্রস্ব খাটো, তোমাদের ঐ মাপের কাঠি/ একটু ছোট আমার জন্য, তোমাদের ঐ ঘরের কপাট/ বড়ই নিচু, আমি একটু দীর্ঘদেহী—’। ঝাঁকড়া চুলের আশরাফ হোসেন শারীরিক গঠনে দীর্ঘকায় ছিলেন—এ যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি তাঁর কবিতা সমসাময়িকদের চেয়ে অনেকটাই উঁচু। তাঁর এ প্রবল আত্মবিশ্বাস এসেছিল নিভৃতচর্চা ও প্রস্তুতি থেকে, সমসাময়িকেরা যখন প্রচারের জোয়ারে ভাসমান এবং জনপ্রিয়তার মোহে আচ্ছন্ন, তখন তিনি নিভৃতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন, আলাদা একটি জগৎ নির্মাণের পরিকল্পনা আঁটছিলেন। সহজাত কাব্যপ্রতিভা ও প্রকাশ উৎসারণ জুগিয়েছে আত্মবিশ্বাস। ‘একবিংশ’ পত্রিকা প্রকাশ এবং এ পত্রিকার উদ্দেশ্য বয়ানের মধ্য দিয়ে তিনি নিজস্ব কাব্যমতাদর্শ ও অভীপ্সাকে নির্দিষ্ট করে নিলেন, অগ্রজদের থেকে আলাদা করে নিলেন নিজের জগৎকে, কাছে টানলেন অনুজদের।
খোন্দকার আশরাফ হোসেন পুরোমাত্রায় আধুনিক কবি। রোমন্টিকতার রেশ তাতে মাঝে মাঝে যুক্ত হলেও তিনি সৌন্দর্যে অনিবার্য বিনষ্টি প্রত্যক্ষ করেছেন, দেখেছেন সম্পর্কের ভাঙাসেতু। যে কালপর্বে তিনি কাব্যজগতে প্রবেশ করেছেন, তাতে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। প্রথাগত প্রেমের বা সৌন্দর্যমুগ্ধতার কবিতা তাঁর কাব্যপরিমণ্ডলে খুঁজে পাওয়া কঠিন না হলেও বিরল। আধুনিক এ কবির কবিতার কেন্দ্রে প্রকৃতি নয়, রয়েছে মানুষ, যে মানুষ ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে চায়। তৃতীয় গ্রন্থ ‘জীবনের সমান চুমুক’-এ মানুষ সম্পর্কিত তাঁর ঘোষণা আমাদের বিস্মিত, সম্মোহিত করে:
মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না
না নিসর্গ না ঈশ্বর না প্রেম না ঘৃণা
মানুষের হাতে নীল বেলুন তার চোখে দুই কালো মাছি
মানুষকে কেউ ধারণ করতে পারে না, মানুষের
কোনো জন্মদাতা নেই, তার কটির উত্তাল যৌবন কারো
উত্তরাধিকার নয়। [মানুষ]
মানুষকে কেন্দ্রে রেখে তাঁর কাব্যের পরিধি বিস্তৃত হয় সমাজভাবনায়; রাষ্ট্রের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে পার্থের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তিনি।
কিন্তু আমি অন্য রকম পার্থ আছি,
আমার রথের শীর্ষদেশে যে পতাকা ছিঁড়তে পারো॥
এমন আশা নিষ্ফলতা।
[আত্মপক্ষ/পার্থ তোমার তীব্র তীর]
আধুনিকতা দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও পরবর্তীকালে তিনি হয়ে উঠেছেন পুরোদস্তুর উত্তরাধুনিক ঘরানার কবি। নব-আবিষ্কৃত প্রপঞ্চকে শিরোধার্য মেনে আধুনিকতার ব্যক্তিকেন্দ্রিক উপলব্ধি ও বিমর্ষতার ধূষর পৃথিবীকে পেছনে ঠেলে এগিয়ে গেছেন উত্তরাধুনিকতার বহুমাত্রিক, বহুমানুষে ঠাসা প্রান্তরের দিকে। প্রান্তিক মানুষের প্রতি সহমর্মিতা, পুরাণমুগ্ধতা আর নিজ ভূমি ও জনগোষ্ঠীর প্রতি দায়বদ্ধতা এই ঐতিহ্যপ্রিয় কবির মাঝে আগাগোড়াই ছিল, কেবল প্রয়োজন ছিল নতুন আঙ্গিকে বলা। সে-ও তিনি বলেছেন পরম দক্ষতায়। জীবনের সমান চুমুক থেকে শুরু করে, সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর পেরিয়ে যমুনাপর্ব বেয়ে তাঁর কাব্যের তরী আয়না দেখা অন্ধ মানুষ ও জন্মবাউল দর্শন শেষে কুয়াশার মুশায়েরা পর্যন্ত এগিয়েছে আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার যৌথ স্রোতোধারাকে সঙ্গে নিয়েই। এ পর্বের খোন্দকার আশরাফ হোসেন ততটা প্রথাগত নন, যতটা তিনি ছিলেন তাঁর কবিতার আদিপর্বে [যদিও মাঝে মাঝেই তিনি প্রথাগত কাব্যভাষায় ফিরেছেন], বরং এ পর্বে তিনি প্রবল নিরীক্ষাপ্রবণ। কবিতা নাম্নী ললনাকে নিয়ে রঙ্গ-তামাশা করার স্ফূর্তি কখনোই কমেনি এ কবির, তাকে তিনি বিবিধ প্রসাধনে সাজিয়ে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেছেন, কখনো ললিত হাতে সুকঠিন ধাতুর ধারালো দা তুলে দিয়েছেন সংহারের উদ্দীপনায়, পড়িয়েছেন রুদ্রমূর্তি সাজ, ধনুকে ভরে দিয়েছেন বিষাক্ত তীর!
তাঁর কাব্যসমগ্র পর্যালোচনা করলে একথা প্রতিভাত হয়, খোন্দকার আশরাফ হোসেন সুপ্রচুর থিমেটিক কবিতা লিখেছেন। তাঁর অনেক কবিতায় পূর্ণ গল্প রয়েছে [একটি কবিতার নাম ‘কালো বাক্সের গল্প’]। তিনি বর্ণনা ভালোবাসেন, অন্তত তাঁর প্রথম দিককার কবিতা বর্ণনাপ্রধান-এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তবে সত্তর দশকের অধিকাংশ কবিতার মতো সাদামাটা পুনরুল্লেখে আগ্রহ নেই তাঁর, নেই পরিচিত উপাদানের পুনরাবৃত্তি দিয়ে কাব্যদেহ ভরে দেওয়া, বরং বর্ণনাকে অভিনব উপাদান ও প্রচুর কাব্যিক অলঙ্কারে মুড়িয়ে দিয়েছেন। প্রচুর উপমা, চিত্রকল্প আর অনুপ্রাসে মোড়ানো হলেও সেগুলোকে আমি বর্ণনামূলকই বলব। পুনরাবৃত্তির একটি ঝোঁক আছে, যদিও উপাদানসমূহ প্রথাগত কবিতার মতো নয়, তাঁর নিজস্ব, আশরাফীয়। উদাহরণ দিই:
আমি কি চেয়েছিলাম এই উদার বাতাসের উচ্ছ্বাস?
এই হঠাৎ বৃষ্টির মধ্যে ফুটে থাকা অবিশ্রান্ত শাপলাগুলো?
ধানখেতের আলে বসে বাতাসের দুদ্দাড় গোল্লাছুট দেখা?
এই একঘেয়ে সমতল প্রান্তরের বিশ্বস্ততা, কিংবা মেটেরঙ ঘাস?
ধান গাছের নিচে খরার জলসেচনের বুড়বুড়ি, এবং
ভটভট আওয়াজ-তোলা পাম্পমেশিনের আখড়াই?
[প্রশ্নের নদী উত্তর বাহিনী]
গ্রামীণ প্রকৃতির জলরঙে আঁকা রিয়েলিস্টিক চিত্র! বিশেষ্যকে বিশেষায়িত করা হয়েছে, আছে কাব্যমেজাজও, কিন্তু একই সঙ্গে আছে বিবরণ। শেষের দিকের কাব্য ‘আয়(না) দেখে অন্ধ মানুষ’-এর ‘আই হসপিটাল’ কিংবা ‘আবার আসতে পেলে যা যা করব (না) কবিতাদ্বয় সংক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী, কিন্তু একই সঙ্গে ক্যাটালগিং ধরনের, যা ছিল ষাট ও সত্তর দশকের কবিতার একটি প্রধান চরিত্র এবং দুর্বলতা।।
খোন্দকার আশরাফ এ সত্য জানতেন বলেই তাঁর কোনো কাতরতা নেই, আছে সত্য প্রকাশের দুঃসাহস, সকল প্রকার ছুৎমার্গ থেকে মুক্ত তিনি এক আধুনিক পুরুষ, যিনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন,
তোমরা এসেছ ভালো, তোমরা বেসেছো ভালো, বসো,
আজ রাতে মেনুতে রয়েছে দেখি তোমাদের মাংসের কাবাব।
[নৈশভোজ/জীবনের সমান চুমুক]
বেহুলা-লখিন্দরের উপাখ্যান বারবার ফিরে এসেছে তাঁর কাব্যে; পুরাণের প্রতি আগ্রহী কবির ভালো লাগা এখানে স্থির। বাংলাদেশকে বলেছেন ‘বেহুলা বাংলাদেশ’। বিভিন্ন প্রতীকে ফিরে আসে সুতানালী সাপ আর গাঙুরের জলে বেহুলার যাত্রা হয়ে ওঠে প্রতিবাদী অভিযাত্রার অবলম্বন। কেবল লখিন্দরকে নয়, বেহুলাকেও কেটেছে সন্তাপের সাপ। প্রথম কাব্যের ‘সাপ’ কবিতায় সাপকেই আহবান করেন [‘তোমাকেই হতে হবে চন্দ্রবণিকপুত্রের অমোঘ ঘাতক’] পুঁজির হৃদপিণ্ডে ছোবল বসাতে। এখানে চন্দ্রবণিকপুত্র লখিন্দর পরাক্রান্ত পুঁজির প্রতীক। তবে লখিন্দরকে তিনি অন্য ভূমিকাতেও দেখেছেন। কখনো চাঁদ সদাগর সপ্তডিঙা ভরে বিলাসের বস্ত্র নিয়ে আসে। আগুনকে তার মনে হয়েছে ফণা তোলা সাপিনী আর প্রিয়ার আকাঙ্ক্ষায় বনের মাঝে যে মরণে তিনি প্রস্তুত, তা-ও অন্য কিছু নয়, সর্পাহত কাঠুরের মরণ। বন, বনের কাঠুরিয়া, পাতাকুড়ুনি মেয়ে খোন্দকারের প্রিয় অনুষঙ্গ, যিনি কখনো কখনো কবিতার সাদাপাতাকে নাটকের মঞ্চ হিসেবে দেখতে ভালোবাসেন।
মুক্তিযুদ্ধ তাঁর কবিতার ক্যানভাসে বড় জায়গা জুড়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি অনবদ্য কবিতা আছে তাঁর—‘বাউসি ব্রিজ’ ৭১’। উনিশ শ একাত্তরে একুশ বছরের টগবগে যুবক তিনি, ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। ‘বাউসি ব্রিজ’ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে উঠে আসা বলেই শক্তিমান:
কাঠবিড়ালির মতো ত্রস্ত নৈপুণ্যে আমরা নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়েছিলাম
তখন কৃষ্ণা একাদশীর ডাইনী রাত ছিলো গর্ভবতী, আর তার কিছুক্ষণ পর
ষাঁড়ের বাঁকানো শিঙ নিয়ে চাঁদ তার হাইডআউট থেকে বেরিয়ে এসেছিলো
আকাশ-এরিনার অন্য কোনায় তখন মেঘ নামক যোদ্ধা অপেক্ষমাণ
বিলম্বে প্রবেশের কারণে তাঁর চেয়ে বয়সে ছোট কবিদের সাথে এক অসম অথচ নির্ভেজাল বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। অগ্রজদের এড়িয়ে, সমসাময়িকদের ভিড় ডিঙিয়ে তিনি সখ্য গড়ে তুলেছিলেন নবীন কবিদের সাথে। সত্তরের কবিতার অগভীরতা, শিল্পহীন চিৎকার তাঁর পছন্দ হয়নি, বরং নিরীক্ষাপ্রবণ নবীন কবিদের মাঝে তিনি পেয়েছিলেন সেই প্রকরণ ও ভাবাদর্শগত গভীরতা, যা ছিল তাঁর নিজেরও অন্বিষ্ট। শিশুরা ঘুরেফিরে এসেছে চার শিশুকে নিয়ে সংসার-ভারাক্রান্ত পিতা-কবির কাছে। প্রথম গ্রন্থেই ‘আমার সন্তানেরা’ শীর্ষক কবিতায় তাঁর উচ্চারণ কিছুটা সংক্ষুব্ধ:
তোরা পাশবালিশের তুলা একদিন উড়ে যাবি বিন্নির প্রবল খই,
আদ্দেক বুকের মধ্যে তাতানো বালির চাপ থেকে যাবে। জীবনের
উদগ্র বাতাস এসে নিয়ে যাবে ব্যথার ফসল, তোরা চলে যাবি ঠিক
বিষণ্ন চৈত্রের বায়ু বুকে জুড়ে তাতাবে আগুন আরো, সীসের কড়াই।
বেদনাহত পিতার ক্ষোভ ‘আমি চলে গেলে উৎসব তেমনি হবে, পৃথিবীর কিছু লোভ/ কমে গেলে উজ্জ্বলতা পাবে আরো তোদের চোখের বাতি,’ বাস্তব পৃথিবীর রূঢ় চিত্রকে সমুখে টেনে আনে। কবিতাটি শেষ হয় একটি অনন্য চিত্রকল্পে—‘তাতানো উনুনে তোরা ধানের সোমত্ত বীজ ফুটে যাবি লাফিয়ে কড়াই থেকে,/ কিন্তু আমি সীসের কড়াই শুধু তাতানো বালির প্রেমে ফোটাবো তোদের’—যা সন্তানের জন্য জনকের অসামান্য আত্মত্যাগ ফুটিয়ে তোলে। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কাছে, ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক লিখেছেন ‘আমার পুত্রকে’ শীর্ষক কবিতা। আধুনিক কবি জানেন, ধ্বংসে উন্মত্ত পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে রেখে যেতে তিনি নিতান্ত অক্ষম, তাই আপন শিশুকেও আশ্বস্ত করতে পারছেন না, শোনাতে পারছেন না অভয়ের বাণী। বৈষম্য ও বিভক্তির আবর্তে ঘূর্ণিরত পৃথিবীতে সুকান্তের বিপ্লবী আশাবাদ অলীক বলেই প্রতিভাত হচ্ছে সন্তানের জন্য উদ্বিগ্ন পিতার কাছে, যিনি কবি বলেই সত্যকে লুকিয়ে রাখছেন না। বিপৎসঙ্কুল পৃথিবীতে সন্তানকে স্বাগত জানাতে তাই দ্বিধাগ্রস্ত জনক-কবি।
তাঁর অনেক কবিতাই ক্ল্যাসিক মেজাজের। ‘নীল সাবানের প্রেম’ কবিতার প্রথম পঙ্ক্তিতে লেখেন, ‘নীল সাবানে মেয়েটি ধোয় আগুন-রঙা শাড়ি’, পরের স্তবকের শুরুতে ‘নীল সাবানে মেয়েটি ধোয় লাল কাপড়ের দুখ’, তৃতীয় স্তবকে ‘নীল সাবানে মেয়েটি ধোয় নীরব চোখের জল’, শেষ স্তবকে লেখেন ‘নীল সাবানের ফুরিয়ে যাবে গভীর প্রেমিক মন/ নদীর জলে ভাসবে মেয়ের শাড়ি ও যৌবন’। বাংলার নারীর অপার দুঃখের জীবনের বয়ান কবিতায় বুনে যান পুনরাবৃত্তিমূলক থিমেটিক ভঙ্গিমায়, যা ক্ল্যাসিকধর্মী। বাঙালি নারীর আব্রু ও সৌন্দর্যের প্রতীক শাড়ি বেশ কিছু কবিতায় উপস্থিত। ‘আয়(না) দেখে অন্ধ মানুষ’ গ্রন্থে ‘কালো বাইবেল’ কবিতায় পাই,
আমার বাইবেলের কালো অক্ষরগুলো অগুনতি কৃষ্ণকায় মানুষের মতো
নীরব শোকমিছিল করে পার হয়ে চলে গেল অন্ধকারে:
আমার চোখের সামনে তখন শূন্যতার সাদা পৃষ্ঠা শুধু, ধূ ধূ।
কালো অক্ষরগুলো চলে গেলে সাদা পৃষ্ঠা তো অনন্ত শূন্যতা, অর্থহীন। মহাবিশ্বের আলো-আঁধারির মতো সাদা-কালো মানুষের মিলিত কোলাজেই পৃথিবীর সম্পূর্ণতা। দার্শনিক জিজ্ঞাসা খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতার একটি প্রধান দিক, কবির দেওয়া উত্তরের মাঝেও রয়েছে দর্শন।
কি খুঁটছ সারাদিন অনন্তের পাখি
খুঁটছি যবের দানা, শস্যবীজ, খুঁটছি জীবন।
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কি নিচ্ছ ঠোঁটের ফাঁকে সুদূরের পাখি?
আমি নিচ্ছি দুটো খড়, এই মৃত্যু, আরেক জীবন।
[সুদূরের পাখি]
এটি তাঁর একটি প্রিয় কবিতা। আরেকটি প্রিয় কবিতা ‘এ-ও দুঃখ কেটে যাবে’, [প্রায়শই এই দুটি কবিতা তিনি পাঠ করতেন] যেখানে তিনি উচ্চারণ করেন, ‘এ-ও দুঃখ কেটে যাবে প্রজ্ঞাপারমিতা, তুমি আমি মিশে যাবো পাথরে পাথর,/ মাটিতে সমূহ মাটি, ভস্মাধারে ছাই,/ কবিতায় নিথর কবিতা।’ এই উপলব্ধি তাঁকে শান্তি দেয় না, কিন্তু সুস্থিত করে। ‘চতুষ্পদ দর্শন’ একটি অধিবিদ্যক কবিতা। কবিতাটি পাঠককে চমকে দেয়:
অতো রাতে ষাঁড়গুলো কোথা থেকে আসে
কোত্থেকে হাঁ?
গাঁয়ের সরল কৃষকদের সোনার ফসল তছনছ করতে আসা এই ষাঁড়গুলো হলো জোতদার ও তার লাঠিয়ালদের প্রতীক।
খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতার একটি প্রধান বৈশিষ্ট হচ্ছে তাঁর প্রায় সকল কবিতাই বক্তব্যে দৃঢ় এবং প্রাঞ্জল। অহেতুক দুর্বোধ্যতা তিনি সৃষ্টি করেননি, পাঠকের সাথে অমোচনীয় দূরত্ব সৃষ্টি করতে চাননি। তাঁর কবিতার আড়াল প্রতীক, উপমা, চিত্রকল্পের আড়াল, এ ছাড়া অনপনেয় কোনো আড়াল বা কুয়াশা নেই, যদিও শেষ কাব্যের নাম ‘কুয়াশার মুশায়েরা’ রেখেছেন, সেখানেও আড়াল অনতিক্রম্য নয়। তাঁর কবিতা জনবোধ্য হয়ে ওঠার এটি একটি বড় কারণ। আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কবিতা লেখা তাঁর কাছে একটি বার্তা প্রেরণের মতো দায়িত্ব, যা তিনি নিষ্ঠার সাথে করতে চেয়েছেন। ‘ভূয়োদর্শন’ কবিতায় লেখেন,
দুঃখ হলো এক গিটার যে বাদকের আঙুল কেটে
নিজের তারের ধার পরীক্ষা করে;
আর সুখ এমন বাড়িঅলা, ঘর খালি নেই তবু টু লেট
নামায় না; দুঃসময় এমন বিরাট গেট
যার ভেতর দিয়ে দেখা যায় বন্ধুর আসল মুখ;
নিরর্থ নয়, তাঁর প্রতিটি কবিতাই অর্থবোধক। পাতা ভরানোর জন্য কবিতা লেখেননি, যদিও আমৃত্যু তিনি কবিতার ভেতরেই কাটিয়েছেন। সময়ের বাঁকবদলের সাথে বদলে নিয়েছেন নিজের কবিতা। প্রারম্ভকালে তাঁর কবিতা প্রথাগত কাব্যভাষাতেই রচিত হয়েছিল, কিন্তু তিনি তাঁর সময়ের তরুণ কবিদের নিরীক্ষা ও কাব্যের বাঁকবদলটি দ্রুত ধরতে পেরেছিলেন, দ্রুতই ঘুরিয়ে দিতে পেরেছিলেন নিজের কবিতার প্রকাশভঙ্গি ও অভিমুখ। আধুনিকতা পেরিয়ে তাঁর কবিতা উত্তরাধুনিকতায় তারুণ্যের দীপ্ত উল্লাসেই প্রবেশ করেছিল। তাঁর উত্তরাধুনিক কবিতাসমূহ যেমন তরুণদের প্রভাবিত করেছে, তিনি নিজেও প্রভাবিত হয়েছেন তরুণদের কবিতা দ্বারা. তাদের রন্ধনশালার চমকপ্রদ মালমসলা থেকে নিজস্ব অনেক ডেলিকেসি বানিয়েছেন। খোন্দকার আশরাফের এই অভিযোজন ক্ষমতা বিস্ময়কর। সঙ্গী হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন তরুণদেরই, নিজের সম্পাদিত পত্রিকা ‘একবিংশ’-এ তিনি তরুণদের কবিতাই মুদ্রিত করতেন এবং সজ্ঞানে এড়িয়ে গিয়েছিলেন প্রবীণদের। নতুনের পথে হাঁটতে, নতুন প্রকরণের ভেতর পৌঁছাতে, নতুন কাব্যভাষা আবিষ্কারে তাঁর সততা ও দৃঢ়তা এতে প্রমাণিত। তাঁর এই তারুণ্যপ্রীতি পছন্দ হয়নি জ্যেষ্ঠদের, তাঁর বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্তিকে তাঁরা ধর্ষকামী মানসিকতায় ঠেকিয়ে রেখেছিলেন এবং সফলও হয়েছেন। যদিও পচনশীল এসব মহাজন কাব্যইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে দ্রুতই হারিয়ে যাবেন, কিন্তু আপন ঔজ্জ্বল্যে জাজ্বল্যমান থাকবেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন।
উপমা, চিত্রকল্প, প্রতীক, অনুপ্রাসে সমৃদ্ধ তাঁর কবিতা। সুধীন দত্তের কবিতার মতো মেদহীন নয় তাঁর কবিতা, বরং অনেক অলঙ্কারে সজ্জিত কবিতা-দেহ জীবনানন্দের কবিতার মতো কিছুটা পৃথুলা। তাঁর কবিতায় যেটুকু দুর্বলতা প্রতিভাত হয়, তা বর্ণনার পুনরুক্তি ও অনেক কবিতায় পর্যাপ্ত আড়ালের অনুপস্থিতি—যা সহজ করে বলার বা বিষয়কে সরাসরি উপস্থাপনের জন্য ঘটেছে। সহজ করে বা সরাসরি যা কিছুই তিনি বলেছেন, তা কাব্যের ভাষাতেই বলেছেন, গদ্যের পথে হাঁটতে চাননি, যদিও গদ্যভাষণ তিনি পুরোপুরি এড়াতে পারেননি। বাংলা কবিতা, বাংলা ভাষা ও বাংলার জনপদের সুমহান ঐতিহ্য তাঁর অন্যতম প্রিয় বিষয় ছিল। ছিল চিরায়তের প্রতি দুর্দমনীয় আাগ্রহ। লিখেছেন এমন অনেক কবিতা, যা চিরকালের সত্যকে ধারণ করে। দূর অতীত এবং চিরভবিষ্যের প্রতি মুগ্ধ হয়েও তিনি ছিলেন তীব্রভাবে সমসাময়িক। খোন্দকার আশরাফ ব্যক্তিত্বে, এবং কবিতায় ছিলেন প্রগতিশীল ও প্রতিবাদী, অন্যায় ও দুঃশাসনের বিরোধী, ছিলেন নির্যাতিত মানুষের পক্ষে। কিন্তু তিনি তাঁর বয়সে সমসাময়িকদের মতো অশৈল্পিক প্রতিবাদ, কাব্যমাধুর্যহীন প্রগতিশীলতাকে লালন করেননি বরং পরিহাসছলে তীক্ষ্ণ কৌতুকে কাব্যিক চাতুর্যে আক্রমণ করেছেন গোঁড়ামি, পশ্চাৎপদতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতাকে। সঙ্কীর্ণ গোঁড়ামি ও কুসংস্কারমুক্ত এ কবি প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে সর্বদাই সোচ্চার ছিলেন, তাঁর ভূমিকা এ ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট, কিন্তু তিনি ঘৃণা করেছেন চিৎকারকে। কবি বলেই তাঁর প্রতিবাদের ভাষা কাব্যিক।
জীবনানন্দ তাঁর প্রিয়তম কবি। অনেক কবিতাতেই জীবনানন্দের ছায়া পরিদৃশ্যমান, নিয়েছেন কবিতার শিরোনাম [যে জীবন ফড়িঙের]। আরেকটি কবিতার শিরোনাম ‘জীবনানন্দের চিল’। বিখ্যাত পাখিটিকে শ্যালো মেশিন প্রকম্পিত ইউরিয়া পটাশের গন্ধমাখা রূপান্তরিত বাংলায়, যেখানে ক্ষুধা দিগন্তবিস্তৃত, পুনর্বার আবিষ্কার করেন জলকষ্ট ঠোঁটে। আশ্চর্য যে, আঙ্গিকের বিচারে জীবনানন্দের ঠিক বিপ্রতীপ ঘরানার সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার প্রতিও খোন্দকার আশরাফের সমান আগ্রহ ছিল। জীবনানন্দের হৃদয়-সংবেদের সাথে সুধীন্দ্রনাথের বোধ ও চেতনাকে মেলাতে চেয়েছেন কাব্যে। কল্লোল-পরবর্তী পাঁচ কবিকে ঘিরে তাঁর উৎসাহ, আগ্রহের কমতি ছিল না কখনো। রবীন্দ্রভুবনের বিরুদ্ধে সচেতন বিদ্রোহী ত্রিশের কবিকুলের ভাবাদর্শী খোন্দকার আশরাফ হোসেনে রবীন্দ্রপ্রভাব দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে অনুপস্থিত; যদিও রবীন্দ্রনাথ তাঁর মস্ত প্রেরণা, তবু রাবীন্দ্রিক আদলে কিছু লেখেননি তিনি।
মৃত্যুভাবনা খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে আগাগোড়াই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল। মৃত্যুকে তিনি, রবীন্দ্রনাথের মতোই, বিভীষিকাময় করে আঁকেননি [মরণ রে,/ তুঁহু মম শ্যামসমান]। তিনি অবলোকন করেন কী করে আমরা জীবনের রঙিন প্রজাপতির পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় ভাঙা সানকির মতো গোরস্থানে পৌঁছে যাই। গোরস্থানকে ভাঙা সানকির সাথে তুলনা অদৃষ্টপূর্ব। সত্যিই তো, পথ না ফুরাতেই পৌঁছে গেলেন ‘সাড়ে তিন হাত আয়তক্ষেত্রের মর্মান্তিক দৃশ্যপট’-এ। তাঁর মৃত্যু কেবল অতীব দুঃখের নয়, বাংলা কবিতার জন্য অপরিমেয় লোকসানের, কেননা সব মিলিয়ে তাঁর মাপের প্রতিভাবান কবি চারপাশে খুব বেশি দেখি না।