বইসুহৃদ, নিষ্ঠাবান সাহিত্য-গবেষক ভূঁইয়া ইকবাল

 

ভূঁইয়া ইকবালের নাম জানি আশির দশক থেকেই। তিনি একজন সত্যিকারের বইসুহৃদ [bibliophile]। বাংলাদেশের বইসুহৃদদের খবর কোনো-না-কোনোভাবে আমার কাছে পৌঁছে যায়। তাঁরা আমাকে না চিনলে কী হবে, আমি তাঁদের অনেককেই চিনি। সরাসরি আলাপ না থাকলেও ভূঁইয়া ইকবাল তেমনিভাবে ছিলেন আমার অনেক দিনের চেনা।

মুহম্মদ জাহাঙ্গীর ও ভূঁইয়া ইকবালের যৌথ সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন বক্তব্য [১৯৭৭-৮৪] সূত্রে তাঁর নাম প্রথম জানতে পারি আশির দশকের গোড়ায়। তখন পর্যন্ত লিটল ম্যাগাজিন পুরোপুরি বিরল হয়ে ওঠেনি বাংলাদেশে; হঠাৎ হঠাৎ দু-একটা ভালো পত্রিকা সে সময় পর্যন্তও বের হতো। বক্তব্য পত্রিকাটি আমার খুব ভালো লেগেছিল। নিজের অজ্ঞতার পরিমণ্ডলে বসবাসরত মনে একটা ব্যতিক্রম এর মধ্যে ধরা পড়েছিল বলেই আকৃষ্ট হয়েছিলাম হয়তো। তখন মনে হতো সবচেয়ে কম পড়ার মাধ্যম প্রবন্ধ-সাহিত্য। আমার মধ্যে এই রকম একটা বিস্ময়বোধক প্রশ্ন ছিল যে, বক্তব্য শুধু প্রবন্ধের পত্রিকা হয়ে কী করে টিকে আছে! এ রকম পত্রিকা কি বিক্রি হয়? কারা কেনে? আরো মনে হয়েছিল, যাঁরা এমন একটা পত্রিকাকে টিকিয়ে রাখতে পারছেন তাঁরা কতই না উদ্যমী মানুষ। বক্তব্য পত্রিকার দুই সম্পাদকের মধ্যে মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর টেলিভিশন সূত্রে আমার কাছে একটু বেশি পরিচিত ছিলেন। ভূঁইয়া ইকবালের নাম ছাড়া অন্যতর পটভূমি জানা ছিল না; কিন্তু বক্তব্য সূত্রেই তিনি আমার শ্রদ্ধেয় হয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে তাঁর সম্পর্কে জানলাম যে তিনি চট্টগ্রামে থাকেন; অধ্যাপনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে তাঁর স্থান যে বেশ উঁচুতে, জানলাম সেটাও। ততদিনে ভূঁইয়া ইকবালের দু-দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর এবং আলী ইমামের সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা হলেও তাঁর সঙ্গে আমার সরাসরি পরিচয় হয়নি। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত দেশ পত্রিকার সাহিত্য সংখ্যায় তাঁর সংগ্রহ ও গবেষণা প্রকাশিত হলে বাংলাদেশের সাহিত্যপ্রেমী হিসেবে বেশ শ্লাঘা বোধ করি; কারণ, তথ্যনিষ্ঠ গবেষণায় আমাদের প্রতিনিধিত্ব খুব বেশি নেই সেখানে। তারওপর দুই দেশের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিকূলতা তো আছেই। সেসব পেরিয়েও দেশ সাহিত্য সংখ্যায় ভূঁইয়া ইকবালের উপস্থিতি ছিল আমার কাছে আনন্দদায়ক ঘটনা। বাংলা একাডেমি যখন প্রকাশ করল তাঁর সংকলিত ও সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথের একগুচ্ছ পত্র [১৯৮৫] তখন অনুভব করলাম রবীন্দ্রচর্চার অনালোকিত একটা দিকে স্পষ্টভাবে আলো পড়ল।

বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে খোঁজ করতে গিয়ে খগেন্দ্রনাথ মিত্রের বই সূত্রে একসময় জানতে পারি স্কুলপড়ুয়া ভূঁইয়া ইকবালের সম্পাদনায় প্রকাশিত বিজ্ঞান পত্রিকা টরেটক্কা-র [১৯৬৫] কথা। একসময় আবদুল মান্নান সৈয়দের সূত্রে জানলাম নিতান্ত কৈশোরোত্তীর্ণ বয়সেই ভূঁইয়া ইকবাল যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন গত শতাব্দীর ষাটের দশকের লিটল ম্যাগাজিন প্রবাহে; বের করেছিলেন কবিতা পত্রিকা পূর্বলেখ [১৯৬৬-৬৭]; ইসরাইল খানের বাংলা সাময়িকপত্র: পাকিস্তান পর্ব [২০০৪] সূত্রে জেনেছি তিনটি সংখ্যা বেরিয়েছিল পত্রিকাটির; তাঁর জীবনতথ্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখলাম কেবল পত্রিকা বের করেই ক্ষান্ত হননি, তরুণ বয়সেই বাংলাদেশের প্রকাশনা-ঊষর অবস্থায় স্বপ্ন দেখেছিলেন একটা সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তুলবেন; ষাটের দশকেই নির্মলেন্দু গ‍ুণ ও আবুল হাসানের যৌথ কাব্য প্রকাশের বিজ্ঞাপনও বেরিয়েছিল কোনো কোনো সাহিত্য পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিনে। নির্মলেন্দু গ‍ুণের কবিতা অমীমাংসিত রমণী এবং আবুল হাসানের যে তুমি হরণ করো ছিল কল্পিত সে বই। প্রকাশনা সংস্থার নামও ঠিক হয়েছিলপূর্বলেখ প্রকাশনী। সে স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত তখন বাস্তবায়িত হতে না পারলেও পরে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই তিনি বের করতে পেরেছিলেন পূর্বলেখ প্রকাশনী থেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র থাকাকালে ভূঁইয়া ইকবাল দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় [পরবর্তীকালে দৈনিক বাংলা] তিনিও সাংবাদিকতা করতেন। ছাত্রজীবনে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তাঁর মনোযোগ যে গবেষণার দিকে, তার পরিচয়ও সে সময়েই বোঝা গিয়েছিল। তখনই তাঁর সঙ্গে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল গবেষণায় তাঁর অনুপ্রাণিত আগ্রহ থেকেই। ভূঁইয়া ইকবালের বন্ধু সহকর্মীদের সূত্রে জেনেছি, তাঁর মধ্যেকার গবেষণামনস্কতা লক্ষ করে আনিসুজ্জান তাঁকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ওই পদে যোগ দিয়ে তিনি কেবল নিয়ম রক্ষার চাকরি করেননি, গভীর মনোযোগী হয়েছিলেন সত্যিকার গবেষণায়। নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন গবেষক হিসেবে। আশির দশকে তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন পিএইচডি গবেষণার জন্য। বাংলাদেশের উপন্যাসে সমাজচিত্র ছিল তাঁর অভিসন্দর্ভের বিষয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে ১৯৮৫ সালে সম্পন্ন করেন পিএইচডি ডিগ্রি। বই আকারে তাঁর সন্দর্ভটি বাংলাদেশের উপন্যাসে সমাজচিত্র নামে প্রকাশিত [১৯৯১] হলে ওই গবেষণায় তথ্য আহরণ ও সন্নিবেশের পারঙ্গমতায় তাঁর বিশিষ্টতা চিহ্নিত ও প্রশংসিত হয় তখনই। পরের সব গবেষণায়ও তাঁর তথ্য অনুসন্ধানে নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের পরিচয় পাওয়া গেছে। সিলেকশনস ফ্রম দ্য মুসলমান ১৯০৬-১৯০৮ [১৯৯৪] তাঁর প্রথম দিককার উল্লেখযোগ্য কাজ। মৌলভি মুজিবুর রহমান সম্পাদিত দ্য মুসলমান পত্রিকায় বিশ শতকের বাঙালি ও ভারতীয় মুসলমানদের জীবন ও চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। স্মরণীয়, বিশ শতকের গোড়ার দিকের বঙ্গে মুসলমানদের মধ্যে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছিল, তার পরিচয় দ্য মুসলমান পত্রিকায় পাওয়া যায়। সে সময় দ্য মুসলমান পত্রিকায় প্রকাশিত রচনায় ও সম্পাদকীয়তে বিচিত্র মতের প্রতিফলন ঘটেছিল। সে কালের মুসলমানদের শিক্ষাচিন্তা, হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ ও সংহতি-প্রয়াস, শিক্ষার ভাষা কী হওয়া উচিত, ধর্মীয় চিন্তার পার্থক্য ও বিরোধ কোথায়, জমিদারদের অত্যাচার ও তার বিরুদ্ধে প্রজাদের প্রতিরোধ ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। তাঁর এই কাজটি বিনয় ঘোষ সংকলিত কয়েক খণ্ডে সম্পন্ন উনিশ শতকের বেশ কয়েকটি ইংরেজি সাময়িকপত্রের রচনা-সংকলনের সঙ্গে তুলনীয়। মুসলমানদের জীবনচিত্র বিনয় ঘোষের সংকলনগুলোতে অনুপস্থিত থাকায় ওই সময়ের সমাজেতিহাসের শূন্যস্থান পূরণের দিকে এগিয়ে নিয়েছে ভূঁইয়া ইকবালের এই কাজ। রবীন্দ্র প্রাসঙ্গিক কাজের ভিড়ে বা নানা ধরনের কাজের আধিক্যে তাঁর কাজটি অনেকটা আড়ালে পড়ে আছে।

আজকাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা যতটুকু গবেষণা করেন, তা সাধারণত চাকরি ও পদোন্নতির প্রয়োজনে; ফলে অধিকাংশ কাজই খুব কম তাৎপর্য বহন করে। ভূঁইয়া ইকবাল এর ব্যতিক্রম। চাকরি থেকে অবসরের পর বরং তাঁকে গবেষণায় আরও বেশি করে আত্মনিয়োগ করতে দেখা গেছে। সারা জীবনের সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে মন খুলে কাজ করতে পারার আনন্দে উদ্দীপ্ত ছিলেন তিনি। কারণ, গবেষণা তিনি করতেন আত্মতাগিদ থেকে। সাহিত্য ও সমাজ গবেষণায় এমন মুক্ত মনে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজে বেশি নেই। মৃত্যুর অল্পদিন আগেও অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের অপ্রকাশিত গদ্য রচনা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, প্রস্তুত করছিলেন পাণ্ডুলিপি।

এমন কথা চালু ছিল যে, রবীন্দ্রনাথ মুসলমান সমাজ সম্পর্কে বিশেষ কিছু ভাবেননি; অথবা বলা হতো বাংলার মুসলমান সমাজ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব কী ছিল, তা খুব একটা স্পষ্ট নয়। উপরন্তু বাংলার মুসলমান সমাজ সম্পর্কে তাঁর ভাবনা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক ও বিভ্রান্তি। ভূঁইয়া ইকবাল সেই রকম একটা পরিপ্রেক্ষিতকে বদলে দেওয়ার সূচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের একগুচ্ছ পত্র [১৯৮৫] বইটি দিয়ে; সে কাজ পরিণতি পায় তাঁর বৃহদায়তন গবেষণাপুস্তক রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজের [২০১০] মাধ্যমে। ভূঁইয়া ইকবালের রবীন্দ্র-গবেষণা আরও মাত্রা পেয়েছে তাঁর বাংলাদেশে রবীন্দ্র-সংবর্ধনা [১৯৯৩] বইয়ের মধ্য দিয়েও।

প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, এর আগে বিশ্বভারতী থেকে বেশ কয়েকটি খণ্ডে রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র প্রকাশিত হলেও বিশিষ্ট মুসলমানদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপের হদিস পাওয়া যায় না। ভূঁইয়া ইকবাল কৃত পত্র-সংকলন রবীন্দ্রমানসের এক অনুদ্ঘাটিত দিকে আলো ফেলেছে। নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ কাজ হিসেবে ভূঁইয়া ইকবালের এই কাজটি সব সময় চিহ্নিত হবে। এই বইয়ে সংকলিত হয়েছে মুসলমান প্রসঙ্গে এবং মুসলমান সম্পাদিত সাময়িক পত্রে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের রচনা, কবির উদ্দেশে লেখা মুসলমানদের চিঠিপত্র, মুসলমানদেরকে উপহৃত রবীন্দ্র-কবিতাবলি। এ ছাড়া মুসলমান সমাজ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় এই বইয়ে সংকলিত কয়েকজন মুসলমান লেখকের রচনা থেকেও। রবীন্দ্রনাথের পূর্ববঙ্গ ভাবনার আরেক দিক উন্মোচিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: পূর্ববঙ্গে বক্তৃতা [২০১৬], প্রমথ চৌধুরীর আরও লেখা নামের বৃহদাকায় রচনা-সংকলন ২০২০ সালে বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলায় দেখে চমকিত হয়ে উঠেছিলাম। আমার ধারণা ছিল, সাম্প্রতিক কালে গবেষক মলয়েন্দু দিন্দার আবিষ্কারের পরে প্রমথ চৌধুরীর কম লেখাই দৃষ্টির বাইরে রয়ে গেছে। বইটি নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি জানিয়েছিলেন মলয়েন্দুর সংকলন থেকে কয়েকটি মাত্র রচনা নেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ রচনাই তাঁর আবিষ্কার ও সংগ্রহ। নজরুল গবেষণায়ও তাঁর স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। তাঁর সংকলিত নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত নজরুলের কবিতা: বাজেয়াপ্তির জন্য অনুবাদ [১৯৯৫] নজরুল-জীবনীকারদের চিন্তার সূত্র জোগাবে।

ভূঁইয়া ইকবাল আরও বেশ কয়েকটি সংকলন সম্পাদনা করেছেন। এর মধ্যে কয়েকটি বাংলাদেশে থাকতেই দেখেছি। যেমন, খুবই প্রয়োজনীয় কাজ তাঁর সংকলিত নির্বাচিত রচনা: আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ [১৯৯৪]আমাকে বারবার দেখতে হয়; মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় [১৯৭৫] নামের সংকলনটি তো আশির দশকেই চোখে পড়েছিল এর বিশিষ্টতার জন্য, পরেও এর একটি সম্প্রসারিত সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে; এই সংকলনের জন্যই তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবিরের হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছিলেন [১৯৭৫]। শুধু বাংলাদেশ থেকেই নয়, পশ্চিমবঙ্গ থেকেও সম্ভবত তখনো পর্যন্ত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে এমন উৎকৃষ্ট সংকলন প্রকাশিত হয়নি। প্রিয় শিক্ষক আনিসুজ্জামান: সংবর্ধনা স্মারক [২০০৫] এবং সমাজ ও সংস্কৃতি: আনিসুজ্জামানের সম্মানে প্রবন্ধ সম্ভার [২০০৭] সম্পাদনা করে জীবদ্দশাতেই শিক্ষাগুরুর প্রতি ব্যতিক্রমী দায়িত্ব পালনেও অগ্রগামী হয়ে থাকলেন তিনি; শামসুর রাহমান: নির্জনতা থেকে জনারণ্যে [২০০৬] সম্পাদনা করে পথিকৃৎ হয়ে থাকলেন শামসুর রাহমান চর্চায়ও।

জীবনী রচনায়ও যে ভূঁইয়া ইকবাল বেশ উৎসাহী ও নিষ্ঠাবান ছিলেন, তার পরিচয় মেলে বাংলা একাডেমির জীবনী গ্রন্থমালার আওতায় বুদ্ধদেব বসু [২০১৪], আবুল কালাম শামসুদ্দীন [১৯৮৭], আনোয়ার পাশা [১৯৮৮], শশাঙ্কমোহন সেন [১৯৯০] ও স্যার আজিজুল হক [১৯৯৪] প্রভৃতি সাহিত্যিক-জীবনী রচনা থেকে। সব কাজেই তাঁর গবেষণা-নিষ্ঠা ও তথ্যশৃঙ্খলার পরিচয় পাওয়া যায়; পাওয়া যায় তাঁর সমাজ-পরিপ্রেক্ষিতের বিবেচনাও। এইসব জীবনী রচনায় সাহিত্যিকদের জীবনতথ্য এমনভাবে বিন্যস্ত করেছেন যে ভবিষ্যতের লেখকেরা বারবার ফিরে আসবেন তাঁর বইগুলোর কাছে।

আজকাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা যতটুকু গবেষণা করেন, তা সাধারণত চাকরি ও পদোন্নতির প্রয়োজনে; ফলে অধিকাংশ কাজই খুব কম তাৎপর্য বহন করে। ভূঁইয়া ইকবাল এর ব্যতিক্রম। চাকরি থেকে অবসরের পর বরং তাঁকে গবেষণায় আরও বেশি করে আত্মনিয়োগ করতে দেখা গেছে। সারা জীবনের সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে মন খুলে কাজ করতে পারার আনন্দে উদ্দীপ্ত ছিলেন তিনি। কারণ, গবেষণা তিনি করতেন আত্মতাগিদ থেকে। সাহিত্য ও সমাজ গবেষণায় এমন মুক্ত মনে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজে বেশি নেই। মৃত্যুর অল্পদিন আগেও অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের অপ্রকাশিত গদ্য রচনা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, প্রস্তুত করছিলেন পাণ্ডুলিপি।

২০১৭ সালে আমার দেশত্যাগের বছর দুয়েক পর জানতে পারি, তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় স্থায়ী বসতি গেড়েছেন। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০২১ সংখ্যা শব্দঘর পত্রিকায় প্রকাশিত তরুণ লেখক মুহিত হাসানের রচনাসূত্রে জেনেছি, সাম্প্রতিক কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি সম্পাদনা করেছেন শামসুর রাহমানের পাণ্ডুলিপিচিত্র [২০২০], অমিয় চক্রবর্তীর স্মৃতিকথা ও পত্রাবলি [২০২০], আনিসুজ্জামানের অপ্রকাশিত পত্রাবলি [২০২০] কিংবা শঙ্খ ঘোষ: অগ্রন্থিত পত্রাবলি [২০২১]। প্রতিটি কাজেরই রয়েছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য। ভবিষ্যতের সমাজভাবুকদের বারবার তাঁর এই সব কাজের কাছে ফিরে আসতে হবে।

গবেষণা তাঁর সমাজবোধ ও আত্মতাড়নার ব্যাপার ছিল। স্বার্থপরের মতো কোনো তথ্য তাই আগলে রেখে দিতেন না; এমনকি অযাচিতভাবেও অন্য গবেষকদের সাহায্য করতেন নিজের কাজ মনে করেই। কোনো তথ্য বা বই প্রয়োজন হতে পারে মনে করলে, নিজেই সেসব সংগ্রহ করে দিতেন সংশ্লিষ্ট গবেষককে। এমন দৃষ্টান্ত অনেক আছে। গভীর সমাজবোধের প্রেরণাতেই অন্যের বই প্রকাশের ব্যাপারেও গ্রহণ করতেন উদ্যোগ। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, দৈনিক বাংলা পত্রিকায় সাংবাদিকতা সূত্রে যুক্ত থাকার সময় সাংবাদিক আহমেদ হুমায়ূনের সঙ্গে মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর ও তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়; আলাপ প্রসঙ্গে তাঁরা আহমেদ হুমায়ূনের রবীন্দ্রবীক্ষার স্বাতন্ত্র্য অনুভব করেন। তখন তাঁরা আহমেদ হুমায়ূনকে উদ্বুদ্ধ করেন বিপরীত স্রোতে রবীন্দ্রনাথ [১৯৭৩] বইটি লিখতে। বইটি রচনায় মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে তিনিও ছিলেন অন্যতম উৎসাহদাতা, যা বইয়ের ভূমিকাতেও আহমেদ হুমায়ূন স্বীকার করেছেন। পূর্বলেখ প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশও করেছিলেন ভূঁইয়া ইকবালই। আবুল কাসেম ফজলুল হকের একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন নামের বইটিও পূর্বলেখ প্রকাশনী থেকে সেই ১৯৭৬ সালে বের করেছিলেন একই রকম সমাজবোধ ও আত্মতাড়না থেকেই।

চট্টগ্রামে থাকায় ব্যক্তিমানুষ ভূঁইয়া ইকবালকে আমার পক্ষে বেশি চেনার সুযোগ হয়নি। তবে নানা সূত্রে জেনেছিলাম যে, দীর্ঘকাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা সাহিত্য সমিতির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণের পর ভূঁইয়া ইকবাল কিছুদিনের জন্য পালন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের কিউরেটরের দায়িত্বও। জাদুঘরের প্রথম কিউরেটর জনাব শামসুল হোসেনের অবসর গ্রহণের পর প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়। ভূঁইয়া ইকবাল তাঁর স্বল্প সময়ের [২০১৭-২০১৯] দায়িত্ব পালনকালে প্রতিষ্ঠানটিকে সক্রিয় রাখতে পেরেছিলেন।

শিক্ষকতায় যোগ দেওয়ার পর কেবল ছাত্রদের পাঠদানেই নিজেকে সীমিত রাখেননি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই সমিতি থেকে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত আলাওলের পদ্মাবতীর খণ্ডাংশ [১৯৭৭], ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আবদুল করিম সম্পাদিত নসরুল্লাহ খোন্দকারের শরীয়তনামা [১৯৭৫], আবু হেনা মোস্তফা কামালের অভিসন্দর্ভ দ্য বেঙ্গলি প্রেস অ্যান্ড লিটেরেরি রাইটিংস [১৯৭৭] ও আনিসুজ্জামানের আঠারো শতকের বাংলা চিঠি [১৯৮৩] নামে গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো প্রকাশ করেন। তরুণতর বয়সে পূর্বলেখ প্রকাশনীর মাধ্যমে যে সমাজবোধের পরিচয় দিয়েছিলেন, তা আরও গভীর হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্য সমিতির দায়িত্ব পালনকালে উপর্যুক্ত বইগুলো প্রকাশ করে।

বাংলা সাহিত্য সমিতি থেকে তিনি প্রচলন করেছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের নামে দুটি স্মারক বক্তৃতারও। বাংলাদেশের ও বিদেশের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট পণ্ডিত আমন্ত্রিত হয়ে প্রদান করেছিলেন এই স্মারক বক্তৃতা। খোঁজ করে জেনেছি, তিনি অবসর গ্রহণের পর এসব কাজে ভাটা পড়ে।

ভূঁইয়া ইকবাল চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ পত্রিকার সাহিত্য বিভাগ সম্পাদনা করতেন। মাঝেমধ্যে যখনই তাঁর সম্পাদিত ওই বিভাগটি দেখতাম, বুঝতে পারতাম এর জন্য বিষয়বস্তু ও লেখক নির্বাচনে তাঁর একটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সম্পাদকীয় নীতি ছিল। অন্যান্য জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য বিভাগের তুলনায় সুপ্রভাত বাংলাদেশ পত্রিকায় তাঁর সম্পাদকীয় ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ছিল অনুভব করার মতো। আগেও যখন তিনি দৈনিক পূর্বকোণের সাহিত্য বিভাগ সম্পাদনা করতেন, তখনো তা ছিল স্বতন্ত্র রুচির পরিচায়ক।

পিএইচডি গবেষণার জন্য তিনি কিছুকাল কলকাতায় থেকেছেন। পরেও নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সেই সূত্রে সেখানকার সারস্বত সমাজের সঙ্গে তাঁর যে ঘনিষ্ঠতা হয়, তা তাঁর গবেষক রুচিকেও সমৃদ্ধতর করে তোলে; বাংলার সংস্কৃতি-গবেষণায় দিকপালদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তাঁর তথ্যনিষ্ঠাকে ও দায়িত্ববোধকে আমাদের সমাজে করে তুলেছে দৃষ্টান্তমূলক। গবেষক-স্বভাবে তাঁকে পুলিন বিহারী সেনের অনুসারী বলা যেতে পারে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, নিজের কাজ সম্পর্কে জাহির করে বেড়ানোর মতো নিম্নরুচি ছিল না তাঁর। ফলে অনেকটা নীরবেই কাজ করে গেছেন। সব মিলিয়ে গবেষণার জন্য তাঁর সংগৃহীত উপকরণ বিপুল। যদি তাঁর সংগ্রহকে প্রাতিষ্ঠানিক সূত্রে ব্যবহার করা যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে তাঁর গবেষণা ও সংগৃহীত তথ্য ভবিষ্যতের সাহিত্য ও সমাজ গবেষকদের অনেক সহায়ক হয়ে উঠবে। গবেষণাকাজের জন্য ভূঁইয়া ইকবাল বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও বাংলাদেশ লেখক শিবিরের হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন বটে, তবে এই সব পুরস্কার তাঁর কীর্তি ও কর্মের তুলনায় মোটেও বড় নয়। তিনি কাজ করে গেছেন কোনো রকম স্বীকৃতি-সম্মানের প্রত্যাশা বা আকাঙ্ক্ষা না করেই। এ রকম গবেষক এখন আমাদের সমাজে বিরল হয়ে পড়েছে।

এই লেখা শুরু করেছিলাম ভূঁইয়া ইকবালকে একজন বইসুহৃদ বলে; কিন্তু সে বিষয়ে কিছুই বলার সুযোগ পাইনি এতক্ষণ। ২০০৯ সাল থেকে তাঁর সঙ্গে আমার সরাসরি জানাশোনার উৎসই ছিল তাঁর বহসুহৃদ-সত্তার অভিঘাত; আমার সম্পাদিত বইয়ের জগৎ [২০০৯-২০১৪] পত্রিকার প্রথম-সংকলন প্রকাশের পর চট্টগ্রাম থেকে টেলিফোন করে এতটাই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন যে আমি রীতিমতো বিস্মিত হয়েছিলাম। বইয়ের জগৎ প্রকাশের পর তাঁর এই সমাদর ছিল আমার বড় পুরস্কার। পত্রিকাটি চট্টগ্রামে পৌঁছার কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর টেলিফোন পাই। প্রথমেই বলেন, চট্টগ্রাম থেকে ভূঁইয়া ইকবাল বলছি। আমি বহু বছর ধরে বই নিয়ে একটা পত্রিকা করার কথা ভাবতে ভাবতে দিন পার করে গেলাম, আর আপনি পত্রিকাটা করেই দেখিয়ে দিলেন; খুব ভালো পত্রিকা হয়েছে!

এরপর ঢাকায় তাঁর সঙ্গে যে দু-একবার দেখা হয়েছে, তা হয় কোনো-না-কোনো বইয়ের দোকানের ভেতরে, না হয় তার আশপাশে। দেখা হলেই অনুভব করতাম, আগে সরাসরি জানাশোনা না থাকলে কী হবে, তিনি আমার দীর্ঘকালের সুহৃদ; প্রকৃত বইসুহৃদ মনে করেছেন বলেই হয়তো তাঁর প্রসন্ন পরিমণ্ডলে আমাকেও স্থান দিয়েছিলেন।

মাস দুয়েক কোভিডে ভুগে যখন কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছি, তখন নিউইয়র্ক থেকে ঢাকায় কয়েকবার ফোনে তাঁর সঙ্গে কথা হয়; স্বল্প আলাপেই কত বই নিয়ে যে চমকপ্রদ সব তথ্য দিলেন, আর মনে করিয়ে দিলেন কত যে বইয়ের কথা! হাসপাতালে যাওয়ামাত্রই অল্প দিন আগে আরেক দিন অনেকক্ষণ ফোনালাপ হলোবলা যায় আড্ডা হলো। কথা হলো, ২০২২ সালের বইমেলা উপলক্ষে আমি যখন দেশে ফিরব, তখন চুটিয়ে আড্ডা হবে। বললাম, আড্ডা দিয়ে বইয়ের ইতিহাসের মধ্য দিয়ে অন্যভাবে জানব বাংলাদেশের সমাজ ও ইতিহাসকে। কিন্তু সে আড্ডার জন্য অপেক্ষা করতে পারলেন না তিনি। কোভিড-১৯ আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিল তাঁকে।