মুক্তির লড়াইয়ে ভিন্নধারার বয়ান

 

সে এক সময় ছিল। দেশে দেশে মানুষের মাঝে তীব্র হচ্ছিল মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আর শুরু হয়েছিল মুক্তির সূর্যটা ছিনিয়ে আনার বিভিন্ন পন্থার প্রগতির লড়াই। আজ সারা বিশ্বে অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব জায়গাতেই কর্তৃত্বের তীব্র আধিপত্য; কোথাও কোথাও ধর্মীয় সহিংসতা সমস্ত অগ্রগতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু গত শতাব্দীর ষাটের দশক ছিল এর সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে চরম আশাবাদের দিশা দেখানোর অপূর্ব সময়। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, স্পেনকেউই আর পৃথিবীজুড়ে তাদের উপনিবেশগুলোকে প্রত্যক্ষভাবে শাসন করার জায়গায় ছিল না। কারণ, সর্বত্রই শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার জন্য তীব্র লড়াই। তাদের প্রত্যক্ষ শাসনের প্রয়োজনীয়তাও কমে আসছিল, লগ্নিপুঁজি দক্ষতা অর্জন করেছিল। দেশে দেশে বুর্জোয়া শ্রেণির জন্ম হয়ে গিয়েছিল। কোনো কোনো দেশে স্বাধীনতা উপহার হিসেবে পৌঁছাতে লাগল উপনিবেশকে নতুন রূপ দিতেএকেবারে হাতছাড়া হয়ে যাবার আগেই।

একে একে এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার একটা না একটা দেশ স্বাধীনতা পাচ্ছিল। কেউ কেউ ছিনিয়েও নিচ্ছিল। ১৯৪৭-এ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নিল দুটি পৃথক রাষ্ট্রভারত ও পাকিস্তান। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার, ১৯৪৯ সালে চীনের বিপ্লব, ১৯৫১ সালে লিবিয়া, ১৯৫৬ সালে সুদান ও মরক্কো, ১৯৫৭ সালে ঘানা স্বাধীন হলো। ১৯৫৮ সালে ইরাকের রাজা ফজলেকে সিংহাসনচ্যুত করে গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষিত হলো। ১৯৫৯ সালে সংঘটিত হলো কিউবার বিপ্লব। ১৯৬০ সালে মৌরিতানিয়া, আইভরি কোস্ট, কঙ্গো, দাহমে, চাদ, সেন্ট্রাল আফ্রিকা, গ্যাবন, মালি ফেডারেশন স্বাধীনতা পেল। যেসব দেশ শুধু উপহার হিসেবে স্বাধীনতাকে দেখতে চাইছিল না, সেখানেই ঘটছিল আক্রমণ, প্রকাশ্যে বা গোপনে। যেমন১৯৬১ সালে আফ্রিকার কঙ্গোতে মুক্তি সংগ্রামী প্যাট্রিস লুমুম্বাকে সিআইএ হত্যা করল জাতিসংঘের ছাতারতলায়। এর কয়েক বছর পরই সিআইএ হত্যা করল কিউবা বিপ্লবের অন্যতম নায়ক আর্নেস্টো চে গুয়েভারাকে। আবার তুমুল ছাত্র বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছিল পশ্চিমা সাম্র্যজ্যবাদের শক্ত জমিন ফ্রান্স। সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টির বিতর্কিত ভূমিকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দ্রোহ থেকে আবার উন্মেষ ঘটল নতুন নতুন চিন্তা আর ভাবনার। যদিও আজকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এই সব চিন্তাও নতুন অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে।

ঠিক একই সময় অর্থাৎ ১৯৬০ সালে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে শুরু হলো মতাদর্শিক মহাবিতর্ক। সংশোধনবাদী ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে অবস্থান নিল মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বাধীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও এনবার হোক্সার নেতৃত্বাধীন আলবেনিয়ার লেবার পার্টি। দেশে দেশে বিভক্ত হতে শুরু করল কমিউনিস্ট পার্টিগুলো। আমাদের এখানেও কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়েছিল এবং কারও  সীমাহীন আন্তর্জাতিক কেবলা নির্ভরতায় সৃষ্ট আপোসকামিতা, আর কারও বিপরীত কেবলা নির্ধারণ করে বালসুলভ তৎপরতা নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামের তারুণ্যনির্ভর কাফেলাকে দিগভ্রান্ত করে সমস্ত মুক্তির লড়াইয়ের নেতৃত্ব জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারীদের হাতে তুলে দিয়েছিল। তারপরেও এই ভূখণ্ডের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই দশকে বেগবান হয়েছিল। আর পরের দশকের একেবারেই প্রথমে আমাদের ইতিহাসের এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মুক্তির লড়াই সম্পন্ন হয়েছিল। যদিও অনেকেই এটাকে বেহাত বিপ্লব হিসেবেই বিবেচনা করছেন। এরপরে আমাদের স্বাধীন দেশে মাঝে মাঝেই মুক্তির ঝলক চিলিক করে উঠলেও স্বপ্নভঙ্গের কালসীমা বারবার আবর্তিত হয়েই যাচ্ছে। প্রবীণ বামপন্থী রাজনীতিক এবং তাত্ত্বিক হায়দার আকবর খান রনোর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ শতাব্দী পেরিয়ে সেই ঘটনাক্রমেরই রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়াকে আমাদের সামনে রোমাঞ্চকর বর্ণনায় মূর্ত করেছে।

বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনের শুরু থেকে গত শতাব্দীর প্রায় দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত এর নেতৃত্বের কারোরই আত্মজীবনী লেখার প্রবণতা ছিল খুবই সামান্য। এ ক্ষেত্রে এই ধারার দর্শনভিত্তিক রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কাঠামোর কোনো নির্দিষ্ট বাধ্যবাধকতাও নেই। তবে সেই সময় পৃথিবীর অনেক দেশেই বিপ্লবী আন্দোলন অনেকটা তুঙ্গে থাকার কারণে এবং অনেক দেশেই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নীতি প্রণয়নের অত্যধিক ব্যস্ততার সেই সময়কার নেতৃত্ব আত্মজীবনী লেখার ফুরসত পায়নি বলে ধারণা করা যায়। কমিউনিস্ট আন্দোলনের শুরু থেকে অবশ্য ব্যক্তিগত পত্রালাপের গুরুত্ব ছিল এবং এগুলোর অনেকটাই গ্রন্থাকারে প্রকাশিতও হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক নেতৃবৃন্দ প্রথমে যুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহ, স্মৃতিচারণা এবং অভিজ্ঞতা লিখতে শুরু করেন। অবশ্য তার আগে নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি নামে একজন রুশ বিপ্লবের সময়কার লালফৌজের একজন যোদ্ধা নিজের জীবনকে ইস্পাত শিরোনামে একটি উপন্যাসে তুলে ধরেন। এটি বিশ্বের সাম্যবাদী আন্দোলনের একটি বড় ক্ল্যাসিক হিসেবে আলোড়ন তৈরি করে। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রথমে বিভিন্ন আন্দোলন এবং এখানকার সশস্ত্র তৎপরতার অভিজ্ঞতা ও কাহিনি তুলে ধরতে থাকেন। পাশাপাশি কিউবা ও ভিয়েতনামের বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্বের সংগ্রামের অভিজ্ঞতা তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে তাদের অনেকের লেখা দিনলিপিগুলোও পরে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কমরেড মুজফ্‌ফর আহমদ এবং পশ্চিমবঙ্গের নেতা সরোজ মুখার্জির একই শিরোনামে [আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি] দুটি আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছিল। তবে সেই আত্মজীবনীতে নিজেদের জীবনের চেয়ে বেশি ব্যক্ত হয়েছে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভিজ্ঞতা। এরপরে জ্যোতি বসু কিংবা নকশাল ধারা থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলন শুরু করা সন্তোষ রাণার আত্মজীবনীও আমাদের চোখে পড়েছে। হাল আমলে আরেকজন প্রখ্যাত নকশাল নেতা অসীম চ্যাটার্জির আত্মজীবনী লেখার প্রক্রিয়া দৃশ্যগোচর হয়েছে। আমাদের দেশেও মোহাম্মদ তোয়াহা, মণি সিংহ, বদরুদ্দীন উমর কিংবা রাশেদ খান মেননদের আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে। আবার কিউবা বিপ্লবের কিংবদন্তি ফিদেল কাস্ত্রোর আত্মজীবনীও বিশ্বে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে এসব কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্বের এই আত্মজীবনীগুলোর বড় বৈশিষ্ট্য হলো তাতে শুধু নিজেদের ভূমিকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রবণতা প্রাধান্য পায় না, বরঞ্চ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের জনগণের সংগ্রামের ইতিহাসকেই জীবন্ত করার প্রচেষ্টা সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়ে থাকে। হায়দার আকবর খান রনোর আত্মজীবনীশতাব্দী পেরিয়ে, সেই ধারারই একটি আত্মকথা।

হায়দার আকবর খান রনোর আত্মজীবনীর প্রথম অংশে আমরা দেখতে পাব, কীভাবে সেই সময়কার পরাধীন কাঠামোতেও ঔপনিবেশিক প্রভুদের নির্দেশনাকে বাস্তব করতে গিয়ে উঠতি মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের অভিপ্রায়ে দুর্ভিক্ষের মতো মরণঘাতী প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। তিনি লিখেছেন, ব্রিটিশ শাসকরা পোড়ামাটির নীতি গ্রহণ করেছিল। পোড়ামাটি নীতির অংশ হিসেবে বেসামরিক সরবরাহ মন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর হুকুমে মানুষের ঘরবাড়ি তল্লাশি করে ধান-চাল, যানবাহন সব গঙ্গার ওপারে নেওয়া হলো। যুদ্ধের জন্য খাদ্য মজুত করা হলো। এর পাশাপাশি অসৎ ব্যবসায়ীরাও চাল মজুত করে চালের দাম বাড়িয়ে দিল

হায়দার আকবর খান রনো তাঁর নিজের আত্মজীবনী লিখেছেন, নিজের নিছক ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা বা নিজেকে বুদ্ধিবৃত্তিক আভিজাত্যের মঞ্চে তারকা হিসেবে প্রতিপন্ন করার তাগিদে নয়, আবার বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে নিজের ব্যক্তিগত ভূমিকাকে তুলে ধরার জন্য নয়। যেহেতু তিনি সামষ্টিক প্রতিরোধের মাধ্যমে মানবমুক্তির দর্শন মার্কসবাদে বিশ্বাসী এবং এখন পর্যন্ত সেই দর্শনের ধারার রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত, তাই সেই ধারার রাজনৈতিক অবস্থান থেকে গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে এদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে নিজস্ব সম্পৃক্তার জায়গা থেকে পর্যবেক্ষণ এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতাকেই এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন। তিনি আত্মজীবনীর শুরুতে লিখেছেন, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির বড় ও ছোট মাপের যে সব পরিবর্তন ঘটেছে অনেকের মতো আমিও তা দেখেছি। অনেক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে আমি ছিলাম। তারই একটি খণ্ড চিত্রও যদি তুলে ধরা যায়, তবে তার ঐতিহাসিক মূল্য কতটুকু থাকবে জানি না, কিন্তু কারো কারো কাছে ভালো লাগতে পারে। তবে তাঁর এই আত্মজীবনী একটি নির্দিষ্ট নীতির গণ্ডিকে অতিক্রম করে এ দেশের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উন্মাতাল দিনগুলোর একটি রাজনৈতিক দলিল হিসেবেই বিবেচিত হবে বলে আমি মনে করি।

রনোর আত্মজীবনীর শুরুতেই আমরা দেখতে পাব সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর নিজেদের উপনিবেশ দখল এবং বাঁটোয়ারা নিয়ে শুরু হওয়া ভয়ঙ্কর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই অঞ্চলের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। তার জন্মই হয়েছিল এই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে। প্রসঙ্গক্রমেই এসেছে শ্রমজীবী মানুষের তখনকার স্বপ্নভূমি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা; আবার এসেছে তখনকার ভারতবর্ষের স্বাধীনতাপ্রত্যাশী জনগণের স্বপ্ননায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কথা; এসেছে তখনকার কংগ্রেসের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে কখনো আপোস, আবার কখনো সংগ্রামের প্রসঙ্গ। সংক্ষেপে হলেও তখনকার শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল কমিউনিস্ট পার্টিও নির্বুদ্ধিতার শামিল কৌশল এবং পরবর্তীকালে ভুল পদক্ষেপ এই ধারাকে কীভাবে সেই সময় ব্যাকফুটে পাঠিয়ে দিয়েছিল, তার একটি চিত্র এখানে পাওয়া যাবে। হায়দার আকবর খান রনোর পারিবারিক বৃত্তান্তের একটি অংশও প্রারম্ভে দেওয়া হয়েছে। তখনকার পূর্ব বাংলার মানুষ কীভাবে কলকাতাকেন্দ্রিক হয়েছিল, কীভাবে তাঁর নানা সৈয়দ নওশের আলী সেই সময়কার অবিভক্ত বাংলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব হিসেবে দেশভাগের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়েছিলেন, প্রথমে বুর্জোয়া ধারার রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত হয়ে পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন, নিজের বাবা মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে নানার সহযোগিতার আনুকূল্যে পেশাগত জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েও আজীবন অসাম্প্রদায়িক এবং প্রগতিশীল ধারার চেতনাকে নিজের ভেতর লালন করে গিয়েছিলেন এবং নিজের স্ত্রী-সন্তানদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছিলেন, সেই প্রেক্ষাপটগুলোও সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। আসলেই তখন এই বঙ্গে এ রকম কিছু রাজনৈতিক প্রবাহ কিংবা ব্যক্তিত্ব ও পরিবার তৈরি হয়েছিল, যা আজকের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিরল হতে বসেছে।

হায়দার আকবর খান রনোর আত্মজীবনীর প্রথম অংশে আমরা দেখতে পাব, কীভাবে সেই সময়কার পরাধীন কাঠামোতেও ঔপনিবেশিক প্রভুদের নির্দেশনাকে বাস্তব করতে গিয়ে উঠতি মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের অভিপ্রায়ে দুর্ভিক্ষের মতো মরণঘাতী প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। তিনি লিখেছেন, ব্রিটিশ শাসকরা পোড়ামাটির নীতি গ্রহণ করেছিল। পোড়ামাটি নীতির অংশ হিসেবে বেসামরিক সরবরাহ মন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর হুকুমে মানুষের ঘরবাড়ি তল্লাশি করে ধান-চাল, যানবাহন সব গঙ্গার ওপারে নেওয়া হলো। যুদ্ধের জন্য খাদ্য মজুত করা হলো। এর পাশাপাশি অসৎ ব্যবসায়ীরাও চাল মজুত করে চালের দাম বাড়িয়ে দিল। সামান্য ব্যবসায়ী ইস্পাহানি ও আর পি সাহা সেই দুর্ভিক্ষের ফলে ফুলে ফেঁপে বড়লোক হয়ে গেল। ইস্পাহানি ছিল জিন্নাহের ঘনিষ্ঠ এবং মুসলিম লীগের প্রভাবশালী ব্যক্তি। চাল মজুত করা হয়েছিল ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে চাল কাজে লাগেনি। গুদামের মধ্যে পচেছে। পরে বস্তা বস্তা পচা চাল গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। মার কাছে শুনেছি পচা গন্ধে গঙ্গার ধারে যাওয়া যেত না।

 

আবার এই অঞ্চলে মধ্যযুগের মুসলিম শাসন সত্ত্বেও বিদ্যমান থাকা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে নিজেদের ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনের অভিসন্ধিতে ব্রিটিশরা প্রথমে বেনিয়া এবং পরে সরাসরি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাধ্যমে বিভিন্ন বিভেদের কর্মকাণ্ড, দর্শন ও ইতিহাস সৃষ্টি করে এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈয়ারের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো বর্বর কাঠামো সমাজে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এখানকার ভিন্ন ধর্মভিত্তিক সহাবস্থানকে বিভাজিত করার এই ভয়ঙ্কর নীতি যেমন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশের কাজে লেগেছিল, ঠিক একইভাবে কাজে লেগেছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের পশ্চিমা অংশের বৈষম্য চাপিয়ে সীমাহীন শোষণের কাজেও। আবার আজ এই মধ্যযুগীয় অস্ত্র একইভাবে কাজে লাগাতে তৎপর এই উপমহাদেশের একটি বৃহৎ বলয়। শ্রমজীবী মানুষের সংহতি বিনষ্ট করতে এবং নিজেদের অবাধ লুটপাটকে অব্যাহত রাখতে তাদেরও একই অস্ত্র দরকার। রনোর আত্মজীবনীর শুরুতে যেমন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের শেষ দিকে অবিভক্ত বাংলার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীভৎসতা কিছুটা চিত্রিত হয়েছে, তেমনি পাকিস্তান এবং হাল আমলের বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও প্রসঙ্গক্রমে এসেছে। তবে তার নিম্নোক্ত বর্ণনা আজকের সামাজিক বাস্তবতাতেও মূর্ত হয়ে ওঠে। রনো লিখেছেন, ৫০ সালের কথা বেশ মনে আছে। এবার উল্টো ঘটনা-নানা বাড়ির লোকেরা ভয় পাচ্ছে, মুসলমান বলে এই বাড়ি আক্রান্ত হয় নাকি। আমার মনে আছে, বাড়ির পিছন দিকের জানলা দিয়ে বাড়ির লোকেরা দেখছে, দূরে আগুন জ্বলছে। আমার চেয়ে তিন বছরের বড় খালাতো বোন রেবা আমাকে ফিস ফিস করে বলল, রনো বলতে পারিস, কিসের আগুন! আমি ঠিক বুঝিনি। বললাম, কিসের? এগার বছরের বোন বলল, মুসলমানদের পোড়াচ্ছে। সে সময় আমরা বরিশাল থেকে কলকাতা এসেছিলাম বেড়াতে। আমাদের নিতে এসেছিলেন বাবা। তিনি এসে শুনালেন বরিশালে কি ভয়ঙ্কর দাঙ্গা হয়েছে, সেখানে মুসলমানরা হিন্দুদের খুন করেছে। আজকের পৃথক ভূগোলে বিভক্ত হয়ে গেলেও বাংলাদেশের কুমিল্লা, রংপুরের হিন্দুদের ওপর আক্রমণ আর ভারতের আসামে মুসলিমদের ওপর সাম্প্রদায়িক বর্বরতা কি দেশীয় শাসকদের অধীনে সেই বাস্তবতার পুনরাবৃত্তিকে ইঙ্গিত করে না।

হায়দার আকবর খান রনোর রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার নেপথ্যে তাঁর কলকাতার নানাবাড়ির রাজনৈতিক পরিবেশ এবং সেই বাসার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরোক্ষ অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল। তিনি লিখেছেন, কলকাতার নানাবাড়িতে আমি দেখেছি মুজাফফর আহমদ, [শ্রীপদ আম্রুত] ডাঙ্গে, জ্যোতি বসু প্রমুখ নেতা। কমরেড সুন্দরাইয়া ও কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত কিছুদিন ওই বাড়িতেও ছিলেন। নানাবাড়ির সামনে এক বিরাট মাঠ ছিল। সেই মাঠে জনসভা হতো। মনে আছে আমি স্লোগান শুনেছি, মুজাফফর আহমদের মুক্তি চাই। পার্টির মুখপাত্র স্বাধীনতা প্রকাশের জন্য জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হত। ...কলকাতায় যখন ট্রামভাড়া বৃদ্ধিবিরোধী আন্দোলন চলে, তখনও আমি সেখানে ছিলাম। ছোট থাকলেও বাড়ির লোকদের মধ্যে কি প্রচণ্ড উত্তেজনা ছিল তা লক্ষ করেছি।

এই একদম শৈশবেই বামপন্থীদের প্রতি ভালো লাগা এবং নিজের বাবা-মায়ের প্রগতিশীল ধ্যানধারণায় নিজের মধ্যেই আস্তে আস্তে রাজনৈতিক সচেতনতা তার মধ্যে তৈরি হয়েছিল, যা ছিল সব সময় প্রগতির পক্ষে। ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি পৃথক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় যখন অদ্ভুত ধরনের ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে হলো তখন বাবার চাকরিসূত্রে রনোকে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে স্থায়ী হতে হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। কিন্তু স্কুলে পড়ার সময় হায়দার আকবর খান রনোর মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভাবনা সঞ্চারিত হয়েছিল। তিনি আত্মজীবনীতেই স্কুল জীবনের এ রকম দুটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন, আমাদের স্কুলে রাজনীতি ছিল না। দুটি ঘটনা আমার মনে আছে। একবার হাঙ্গেরীর প্রতিবিপ্লবের ওপর ফিল্ম দেখানো হচ্ছিল। আমি প্রতিবাদ করে বেরিয়ে আসি। আরেকবার আমাদের ছাত্রদেরও মার্কিন উপহারস্বরূপ সোয়েটার দেওয়া হচ্ছিল। তাতে লেখা ছিল US Friendship. আমি বলি, Brother I refuse to take imperialist gift

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক চিন্তার মাঝেই রনো তাঁর সাম্রাজ্যবিরোধী অবস্থানের সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছিলেন। ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনেই রনো ভাসানীর জনগণের পক্ষের আওয়াজকে খুঁজে পেয়েছিলেন এবং তার মধ্যেই পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার স্বপ্ন অবলোকন করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, তখন আমি বাবার সঙ্গে টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম ভাসানীর সেই ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন দেখতে। ...এই কাগমারী সম্মেলন থেকেই মওলানা ভাসানী পূর্ববাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দিয়েছিলেন। তার সেই ইতিহাসখ্যাত আসসালাম ওয়ালুইকুম এখান থেকেই উচ্চারিত হয়েছিল। ভাসানীকে পরে তিনি নিজের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় বহুবার পেয়েছেন। নিজেই তাঁর সাথে আন্দোলন করেছেন। এমনকি এই আত্মজীবনীর একটা বড় অংশজুড়েই আছে ভাসানী প্রসঙ্গ। ভাসানীর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান এবং তাঁর সাধারণ মানুষের পক্ষে অভূতপূর্ব রাজনৈতিক কৌশল, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোসহীন অবস্থান এবং কমিউনিস্টদের প্রতি আকণ্ঠ সমর্থন ও এক সময়ে তাদেরকে নিয়ে বড় বড় গণ-আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান এবং কৃষক আন্দোলনের জোয়ার বইয়ে দেওয়ার সামগ্রিক কর্মকাণ্ড রনো তার সান্নিধ্যেই দেখেছেন। আবার রনোর এই আত্মজীবনীতেই মওলানা ভাসানীকে এ দেশের বামপন্থীদের ব্যবহার না করতে পারার আক্ষেপও ব্যক্ত হয়েছে। আবার নিজেই এই দায় থেকে মুক্ত হতে চাননি। আসলেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে মওলানা ভাসানীকে এখন পর্যন্ত সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি এবং এক ধরনের সাদামাটা পার্শ্বনায়ক হিসেবেই দেখার একটা প্রবণতা এখনো দৃশ্যমান। হায়দার আকবর খান রনোর আত্মজীবনী এই প্রচেষ্টার বিপ্রতীপে দাঁড়ানোর একটি সহায়ক সাক্ষ্য হিসেবে প্রতিপন্ন হতে পারে।

হায়দার আকবর খান রনোর শতাব্দী পেরিয়ে গ্রন্থে ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন, আন্তর্জাতিক মতাদর্শিক মহাবিতর্কে এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভক্তি, আবার তার আগেই একই বিষয়ের রেশ ধরে সে সময়কার সবচেয়ে প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠনের বিভক্তি, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির বৈষম্যমূলক আচরণ এবং প্রায় সময়জুড়ে থাকা সামরিক স্বৈরাচারদের এ দেশের গণ-আন্দোলনকে নৃশংস দমননীতির একটি অনন্য চিত্র পাওয়া যায়। তার এই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, তখনকার সরকারপন্থী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দ্বিমুখিতা, জাতীয়তাবাদের সংগ্রামকে নেতৃত্ব দেওয়া রাজনীতিকদের কারও কারও আপোসহীনতা আবার কারও কারও দোদুল্যমানতা, আপোসকামিতা আর স্বাধীনতার আওয়াজ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের দ্বিধাগ্রস্ততা। আবার এই গ্রন্থেই তিনি তুলে ধরেছেন এ দেশের প্রান্তিক মানুষের প্রতিরোধের গল্প। আবার তাদের সংগ্রামকে বেগবান করে তাদেরই প্রতিনিধিত্বের দাবিদার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বেও ত্যাগ, নিষ্ঠা আর সংগ্রামের চিত্র যেমন এখানে পাওয়া যাবে, তেমনি আবার তাদের তাত্ত্বিক অপরিপক্বতা, কেবলা খোঁজার অসৃজনশীল প্রবণতা, ক্ষেত্রবিশেষ কূপমণ্ডূকতার শামিল কর্মকাণ্ড, গোষ্ঠী মানসিকতার জেরে অগণতান্ত্রিক আচরণ এবং সর্বোপরি আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব থেকেও সঠিক সময়ের সঠিক কৌশল না নেওয়া এবং বাস্তবতার চাহিদা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে মূলধারা থেকে বিচ্যুত হতে হতে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে ওঠার ঘটনাপ্রবাহ এই আত্মজীবনীতে বর্ণিত হয়েছে। আবার রনোরাই নিজস্ব একটা ধারা তৈরি করে এই বিচ্যুতির বিপ্রতীপে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টার গল্পও এখানে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সেখানেও নিজের বা সহযোদ্ধাদের কিছু বিচ্যুতির দায় আবার তিনি এড়িয়ে যাননি। তাঁর এই আত্মজীবনী গ্রন্থ আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছে, কীভাবে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের নেতৃত্ব বামপন্থীদের মোহগ্রস্ততা, অন্ধ অনুকরণের প্রবণতা আর সীমাহীন বিচ্যুতির ফলে জাতীয়তাবাদের একচেটিয়া অধিকারে গিয়েছিল। তবে স্বাধীনতার প্রশ্নে মওলানা ভাসানী এবং সেই সময়কার পিকিংপন্থী কিছু ধারা এবং উক্ত ধারা থেকে স্বতন্ত্র হয়ে কাজী জাফর, হায়দার আকবর খান রনো এবং রাশেদ খান মেননদের স্বতন্ত্র একটি ধারা যে জাতীয়তাবাদীদের আগে অবস্থান নিতে পেরেছিল, তার কথাও এখানে উল্লেখ আছে। কিন্তু বড় ধরনের বিভক্তি আর সঠিক কৌশল না গ্রহণ করতে পারায় শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধকালীন নেতৃত্বের সম্পূর্ণ চালিকাশক্তি জাতীয়তাবাদীদের হাতে চলে গিয়েছিল। তার কারণেই একটা বিপ্লব কীভাবে বেহাত হয়েছিল, সেটাও তিনি এখানে বলেছেন। রনোদের নিজস্ব এই সব বিচ্যুতির তাত্ত্বিক কারণের দিকে তিনি সংগত কারণেই আত্মজীবনীতে বিস্তৃত করার প্রচেষ্টা না চালিয়ে ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনায় বেশি মনোযোগী হয়েছেন। সে জন্যই এই আত্মজীবনী তাত্ত্বিকতার কঠিন আবরণে না থেকে একটি সুখপাঠ্য হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।

হায়দার আকবর খান রনোর এই আত্মজীবনীতে একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। তিনি এখানে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেছেন যে এই যুদ্ধেও প্রত্যক্ষদর্শী এবং অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে। তবে তিনি এখানে সাধারণ জনগণের বীরত্বকেই সর্বাধিক গুরুত্বর্পূণ মনে করেছেন। তিনি লিখেছেন, পাক-হানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যা, ধর্ষণই সব নয়। এর বিপরীত দিকে আরেকটি চিত্র আছে। তা হল সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ যুদ্ধ। কি অপরিসীম বীরত্ব, কি অসামান্য আত্মত্যাগ, কি দুর্জয় সাহস। তাও আমি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছি। আমার মতো আমার বয়েসী আরও লক্ষ লক্ষ মানুষও তা প্রত্যক্ষ করেছে। ...আমার মনে হয় আমি খুব ভাগ্যবান। ...আরও ভাগ্যবান মনে হয় এই কারণে যে, তখন বয়েসের দিক দিয়ে আমি ছিলাম যুবক, যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়ে। যুদ্ধে আমি গেছি।

শতাব্দী পেরিয়ে একজন ব্যক্তির জীবন ছাপিয়ে এ দেশের একটা উল্লেখযোগ্য সময়ের সামাজিক ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের একটা দলিল হিসেবেই আমাদের কাছে বিবেচিত হয়েছে। আর হায়দার আকবর খান রনো মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হওয়া সত্ত্বেও ভাষার কাঠিন্যকে পরিহার করে সহজবোধ্য গদ্যে নিজস্ব মতাদর্শিক অবস্থান অক্ষুণ্ন রেখে আমাদের সামনে সেই উত্তাল সময়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বয়ান তুলে ধরেছেন।

আজ মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তির সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা এক রৈখিক প্রবণতা লক্ষ করি। সেটা হলো, মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত কৃতিত্ব একরৈখিক ধারার মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ করার প্রবণতা। কিন্তু সেদিন কিন্তু ধর্মের লেবাস লাগানো গুটিকয়েক সুযোগসন্ধানী ছাড়া এই জনযুদ্ধে অন্যসব ধারা, সামরিক বাহিনীর প্রায় অধিকাংশ বাঙালি অফিসার, কর্মকর্তা, সৈনিক, পুলিশ-ইপিআরের পূর্ব বাংলার বড় অংশ, সরকারি-আধা সরকারি অফিসের কর্মকর্তা, কর্মচারী, শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র এবং প্রান্তিক মানুষসবাই সেদিন এই যুদ্ধে সশস্ত্র কিংবা নানা ধরনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এখনকার রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ধারার বাইরে আর কারও সংগ্রামের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিলছে না। কিন্তু হায়দার আকবর খান রনো এই আত্মজীবনীতে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে সেদিন কতিপয় স্বাধীনতাবিরোধীরা ছাড়া বাকি সবাই ছিল মুক্তির সারথি। তিনি লিখেছেন, ইতিহাস রচনার সময়ও, দেশের অভ্যন্তরে যে সাহসী যুদ্ধ করেছেন সাধারণ মানুষ ও বাম কমিউনিস্ট সংগঠন, তা ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি প্রায়ই একটি কথা বলি, মুক্তিযোদ্ধা কে? যিনি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছেন, তিনিই কেবল মুক্তিযোদ্ধা? না, এভাবে বলাটা ঠিক নয়। যে বৃদ্ধ মাতা গোপনে সশস্ত্র তরুণদের গভীর রাতে রেঁধে খাইয়েছেন অথবা যে বালক সশস্ত্র যোদ্ধাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে, তারাও মুক্তিযোদ্ধা। তাহলে অল্প কিছু বিশ্বাসঘাতক বাদে দেশের তখনকার সাত কোটি মানুষই মুক্তিযোদ্ধা।

এই আত্মজীবনীতেই উল্লেখ আছে সেদিন কিছু বামপন্থী সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি। তারা কিন্তু নরসিংদীর শিবপুরসহ ১৪টি সশস্ত্র ঘাঁটিতে যুদ্ধ করেছে। এর মধ্যে শিবপুরের রণাঙ্গনের বীরত্বের কাহিনি সেই সময় সবার মুখে মুখে ঘুরেছে। হায়দার আকবর খান রনোরই ছোট ভাই হায়দার আনোয়ার খান জুনো পরবর্তীকালে এই লড়াইয়ের ইতিহাস তাঁর রচিত একটি গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া সেদিন সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিও বেশ কিছু জায়গায় সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে। আবার সেদিন পিকিংপন্থী ধারার কমিউনিস্ট দলগুলো প্রথম দিকে সর্বাত্মক ফ্রন্ট করার পথে ছিল এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্ত তাদের বিবেচিত কেবলা চীন সেদিন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তারা ভুল কৌশল এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। এ প্রসঙ্গে দেশের মার্কসবাদী তাত্ত্বিক এবং রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাঁরা আওয়ামী লীগ ও ইয়াহিয়া খানকে একই পাল্লায় মাপলেন। এটি কখনো হয় নাকি? যেখানে দেশের মানুষ লড়াই করছে, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করছে, সেখানে তাঁরা বলে দিলেন দুই কুকুরের লড়াই। এর চেয়ে সর্বনাশা কিছু হতে পারে না। তাঁদের উচিত ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে একত্রে মুক্তিযুদ্ধ করা। এপ্রিলের শুরুতে একটি বৈঠক হয়েছিল, যাতে সুখেন্দু দস্তিদার, আবদুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহার সঙ্গে আমিও ছিলাম। সেখানে মওলানা ভাসানীর একটি চিঠিও দেখানো হলো। ঠিক হলো কমিউনিস্টরাও একসঙ্গে লড়াই করবে। কিন্তু এপ্রিলের ১৩ বা ১৪ তারিখে আমি যশোরে ছিলাম। চৌ এন লাইয়ের বিবৃতি দেখানো হলো, যেখানে তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার কথা বলেছেন। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। আমাদের সঙ্গে সৈয়দ জাফর নামের এক কর্মী ছিলেন, তাড়াতাড়ি তাঁকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসি। এরপর তাঁরা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ও শ্রেণিশত্রু খতমের লাইন নিলেন।

তবে সেই সময় ইপিসিএমএলের সবাই যে একইভাবে চিন্তা করেছিলেন, তা-ও সঠিক নয়। স্থানীয় পর্যায়ে অনেকেই কেন্দ্রীয় লাইনের বাইরে গিয়ে ভিন্ন চিন্তা ধারণ করে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তৎকালীন যশোর জেলার নেতা এবং বর্তমানে প্রাবন্ধিক নূর মোহাম্মদ তাঁর একাত্তরের যুদ্ধে যশোর জেলা ইপিসিপি(এম-এল)-এর বীরত্বপূর্ণ লড়াই ও জীবনদান শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, যুদ্ধেও সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল মার্চের পর স্বল্প অস্ত্র নিয়ে যে যুদ্ধ শুরু করা হয় তা পাকিস্তান রাষ্ট্রের শত বাধা, শত নির্যাতন এবং শত হত্যাকাণ্ড মোকাবিলা করে প্রায় সাত মাস বহাল রাখতে পারা। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য ছিল বিপ্লবী কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে কৃষকের ক্ষমতায়নের চেষ্টা। ...মূল যুদ্ধের ক্ষেত্র বাদ দিয়েও দেখা গেছে অন্যান্য স্থানেও কমরেডরা জেলা পার্টি লাইনের ভিত্তিতে নিজেদের মতো করে নানাবিধ দুঃসহ-বিপত্তি মোকাবিলা করে টিকে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।১০ আবার আবদুল মতিন-আলাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিও বহু জায়গায় পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তারা সেদিন ভুল কৌশল নেওয়াতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব পর্যায়ে যেতে পারেনি সত্যি, কিন্তু আবার তাদেরকে যে ভারতে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিংয়ে নিতে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, অল্প কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার এবং সামরিক কর্মকর্তারা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তাদেরকে ট্রেনিংয়ে নিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ করতে সাহায্য করেছিলেন, সে ঘটনাগুলো এই আত্মজীবনীতে যেমন রয়েছে, তেমনি আরও অনেকের লেখাতেই উল্লেখিত হয়েছে। রনো এই আত্মজীবনী গ্রন্থে মওলানা ভাসানীকে ভারত সরকার কর্তৃক গৃহবন্দী করে রাখার অভিযোগ যেমন উত্থাপন করেছেন, তেমনি তাদের গঠিত বামপন্থীদের কমিটির অনেককে ভারতে গ্রেফতার এবং নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি সে সময়কার ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি [মার্কসবাদী] নেতৃত্ব এবং কমরেডদের আন্তরিক সহায়তার কথা আন্তরিকভাবে উল্লেখ করেছেন। তাহলে সে সময় ভারতের সাধারণ জনগণ এবং বিভিন্ন প্রগতিশীল বামপন্থীদের আন্তরিক ভূমিকা সত্ত্বেও ভারতের সরকারের সমর্থন এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ কি নিঃস্বার্থ ছিল? হায়দার আকবর খান রনোর এই আত্মজীবনী নিঃসন্দেহে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনালোচিত বয়ানকে সামনে আনে। এবং আমাদের সামনেও আত্মজিজ্ঞাসার প্রেক্ষাপট তৈরি করে। আবার পাশাপাশি দীর্ঘ সময় ধরে মুক্তিযুদ্ধের একতরফা ন্যারেটিভ শুনতে শুনতে আমরা যারা ক্লান্ত, তাদের সামনে অন্যধারার লড়াইয়ের বয়ান উপস্থাপন করে নতুন ভাবনার উদ্রেক ঘটায়।

 

শতাব্দী পেরিয়ে-এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে হায়দার আকবর খান রনো আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতীয়তাবাদের স্লোগান তুলে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের উদারনৈতিক অংশ একদম বিলোপের সম্মুখীন হয়ে উঠতি বাঙালি মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের অংশের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং তাদের হাতে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া একটি ভূখণ্ডের জনগণের নিদারূণ স্বপ্নভঙ্গের প্রত্যক্ষ ঘটনা। তিনি বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাকে দেখিয়েছেন এইভাবে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যে ইতিহাসের মহানায়ক, তা কেউই অস্বীকার করবেন না। তবে মহানায়কের মতো আচরণ তিনি করতে পারেননি।১১

আজও বাংলাদেশের মানুষ সেই আশাভঙ্গের বেদনা কাটিয়ে নতুন করে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার পথে কেন হাঁটতে পারছে না, সেটাও আমাদের কাছে বড় ধরনের প্রশ্ন। তবে হায়দার আকবর খান রনোর মতো আমূল পরিবর্তনের দর্শনে বিশ্বাসী রাজনীতিক তো আর প্রশ্ন উত্থাপন করেই ক্ষান্ত হতে পারেন না। তাই স্বাধীন বাংলাদেশেও তিনি বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক তৎপরতায় নেতৃত্বের পর্যায় থেকে জনগণের সংগ্রামকে বেগবান করার প্রচেষ্টা করেছেন। সেই কাহিনির একটা চিত্র আমরা পাব এই অধ্যায়ে। তবে তিনি এই আত্মজীবনীতে নিজের বা তাদের সামষ্টিক কর্মকাণ্ডের বিচ্যুতিগুলোর দায় স্বীকার করেছেন। আবার কমিউনিস্ট আন্দোলনে নিজের অবস্থান অকপটে ব্যক্ত করে আত্মজীবনীতেই লিখেছেন, আমার জীবন মানটা মধ্যবিত্ত স্তরে রয়ে গেছে। প্রকৃত কমিউনিস্ট হতে হলে শ্রেণীচ্যুতি দরকার। এ ক্ষেত্রে আমার ঘাটতি রয়েছে বলে মনে হয়। তবে আমি মতাদর্শের ক্ষেত্রে বড় রকমের বিচ্যুতি করেছি বলে মনে করি না। আমি নিজেকে শ্রমিকশ্রেণীর একজন বলে মনে করি এবং এ জন্য আমার কিছুটা গর্বও রয়েছে।

শতাব্দী পেরিয়ে একজন ব্যক্তির জীবন ছাপিয়ে এ দেশের একটা উল্লেখযোগ্য সময়ের সামাজিক ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের একটা দলিল হিসেবেই আমাদের কাছে বিবেচিত হয়েছে। আর হায়দার আকবর খান রনো মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হওয়া সত্ত্বেও ভাষার কাঠিন্যকে পরিহার করে সহজবোধ্য গদ্যে নিজস্ব মতাদর্শিক অবস্থান অক্ষুণ্ন রেখে আমাদের সামনে সেই উত্তাল সময়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বয়ান তুলে ধরেছেন। আবার ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন রোমান্টিকতা, সূক্ষ্ম সমাজ বিশ্লেষণ এবং প্রয়োজনমতো শেক্‌সপিয়ার, তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেক সাহিত্যিকের রচনাকর্মের নির্বাচিত অংশের ব্যবহার এই আত্মজীবনীকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে। সর্বোপরি, যারা গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শেষ পর্যন্ত এই ভূখণ্ডের তৎকালীন সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রতিক্রিয়ার ইতিহাস জানতে আগ্রহী, নিঃসন্দেহে তাদের জন্য এটি একটি মূল্যবান গ্রন্থ হবে বলে আমার ধারণা।

তথ্যসূত্র
১. হায়দার আকবর খান রনো, শতাব্দী পেরিয়ে, তরফদার প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৫, পৃষ্ঠা-১৩
২. উদ্ধৃত, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৯
৩. উদ্ধৃত, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৩
৪. উদ্ধৃত, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৩
৫. উদ্ধৃত, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৭
৬. উদ্ধৃত, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৮
৭. উদ্ধৃত, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৪০
৮. উদ্ধৃত, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৮৭
৯. বদরুদ্দীন উমর, সাক্ষাৎকার, সোহরাব হাসান এবং মনোজ দে, সম্পাদকীয় পাতা, দৈনিক প্রথম আলো-১৯ ডিসেম্বর
১০. নূর মোহাম্মদ, একাত্তরের যুদ্ধে যশোর জেলা ইপিসিপি (এম-এল)-এর বীরত্বপূর্ণ লড়াই ও জীবনদান, মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীরা, সম্পাদনা: হায়দার আকবর খান রনো, তরফদার প্রকাশনী, পৃষ্ঠা: ২৪১
১১. উদ্ধৃত, হায়দার আকবর খান রনো, শতাব্দী পেরিয়ে, তরফদার প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৫, পৃষ্ঠা-৩০৭ 
১২. উদ্ধৃত, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৯৮আকবর খান রনো,
শতাব্দী পেরিয়ে, তরফদার প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৫, পৃষ্ঠা-১৩