রুশ বিপ্লব, প্রতীকবাদ ও আলেক্সান্দর ব্লক

 

আমার সাথে কে কতটা একমত হবেন, আমি নিশ্চিত নই। তবে আমার ধারণা, বিংশ শতাব্দীর রুশ কাব্যের যাত্রা শুরু হয়েছিল আলেক্সান্দর ব্লকের হাত ধরে। আর বিংশ শতাব্দীর রুশ কাব্যের শেষটাও হয়েছে ব্লকের হাত ধরে এগিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। কিছুটা হলেও কারও কারও কাছে গোলকধাঁধায় ভরা মনে হতে পারে আমার এই শেষের মন্তব্য। কেননা ব্লকের জন্ম ১৮৮০ সালে এবং ৪১ বছর বয়সে মৃত্যু ১৯২১ সালে। এই যদি হয় কবির জীবনকাল, তাহলে সূচনা না হয় মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু সমাপ্তি? সেই প্রশ্নের উত্তর আমি আমার বক্তব্যের একেবারে শেষ দিকে দেব। তাঁর আগে শুরুটা দেখে নেওয়া যাক।

আমি হ্যামলেট
বিশ্বাসঘাতকতা এখন জাল বুনে যায়
ভালোবাসা যখন বেঁচে থাকে কেবল তোমার হৃদয় জুড়ে
সময় আর শূন্যতায়।

ওফেলিয়া, প্রিয় বন্ধু আমার,
থাকো তুমি দূরে শীতল হিংস্রতা থেকে।
আমি যুবরাজ মরে যাই নিজ দেশে আমার,
বিষাক্ত তীক্ষ্ণ তরবারির আঘাতে।

কবিতাটি ব্লক লিখেছিলেন শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে, ১৯০৩ সালে। তিনি কি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন কোন্‌ সে দিন সামনে অপেক্ষমাণ? হয়তো কিছুটা হলেও ধরতে পেরেছিলেন। ফলে সে আঁচ পাওয়া থেকেই হয়তোবা উঠে এসেছে এই বিলাপ।

বিংশ শতাব্দীর রাশিয়ার ইতিহাস হচ্ছে খুবই জটিল আর মর্মান্তিক ইতিহাস। জটিল এ কারণে যে ইতিহাসের ব্যাখ্যায় নানা মুনির নানা মত। আমরা যারা ইতিহাসের পাঠক বা শ্রোতা, তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে বাধ্য। শতাব্দী রাশিয়ার জন্য শুরু হয় গ্লানির মধ্য দিয়ে। সেই গ্লানি হচ্ছে রুশ-জাপান যুদ্ধে দেশের বেদনাদায়ক পরাজয় থেকে উঠে আসা গ্লানি। গ্লানি অচিরেই জন্ম দিয়েছিল ব্যাপক গণ-আন্দোলনের, যার শিখর আমরা দেখতে পাই ১৯০৫ সালের ব্যর্থ বিপ্লবে।

১৯০৫ সালের বিপ্লব সেই অর্থে বিপ্লব ছিল কি না, তা নিয়ে অবশ্য নতুন করে শুরু হওয়া বিতর্কের শেষ নেই। তবে সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, সেই সময়ের সেই ব্যাপক গণজাগরণের প্রভাব ছিল রাশিয়ার জন্য সুদূরপ্রসারী, যে বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়েছেন লেভ তলস্তয় থেকে শুরু করে রুশ সাহিত্যের সেই সময়ের অগ্রণী মনীষীদের অনেকেই। ফলে শতাব্দীর শুরু থেকে একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি নানাভাবে প্রভাবিত করেছে সৃজনশীল জগতের প্রতিনিধিদের।

এখানেও ব্যাখ্যাগত বিভ্রান্তি কিছুটা হলেও রয়ে গেছে। ১৯০৫ সালের বিপ্লব সেই অর্থে বিপ্লব ছিল কি না, তা নিয়ে অবশ্য নতুন করে শুরু হওয়া বিতর্কের শেষ নেই। তবে সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, সেই সময়ের সেই ব্যাপক গণজাগরণের প্রভাব ছিল রাশিয়ার জন্য সুদূরপ্রসারী, যে বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়েছেন লেভ তলস্তয় থেকে শুরু করে রুশ সাহিত্যের সেই সময়ের অগ্রণী মনীষীদের অনেকেই। ফলে শতাব্দীর শুরু থেকে একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি নানাভাবে প্রভাবিত করেছে সৃজনশীল জগতের প্রতিনিধিদের। সেই সূত্রে রাশিয়ায় দেখা যায় যেন এর সাথে পাল্লা দিয়ে একের পর এক কাব্য আন্দোলন গড়ে উঠতে। এ রকমই এক আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন ব্লক। তাঁর সেই প্রতীকবাদ পথের অনুসারীরা বিপ্লবী কোনো অর্থেই ছিলেন না। তবে তারপরও সামাজিক জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত তাদের কাব্যে নিয়ে এসেছে সময়ের বাস্তবতাকে। অন্য অর্থে এটাকে বলা যায় একধরনের পরস্পর বিরোধিতা। এই পরস্পর বিরোধিতা পরবর্তীকালে অনেকভাবেই আচ্ছন্ন করে রেখেছে বিংশ শতাব্দীর রুশ কবিদের। ব্লকের কাব্যেও এ কারণেই হয়তো প্রতিধ্বনিত হতে দেখা যায় হারিয়ে যাওয়া রাশিয়াকে নিয়ে এমন হাহাকার:

আবারও, যেন সেই সোনালি কালের মতোই,
তিন বাদক কাঁপিয়ে চরাচর বাজনায় তুলে টান,
কে যেন সুচের ছোঁয়ায় আঁকে ছবি
শিথিল বাঁধাধরা জীবনের কলতান...

রাশিয়া, নিঃস্ব রাশিয়া আমার,
তুলে নাও আমাকে তোমার ধূসর ঘরে,
তোমারই গান নিঃসৃত এই কণ্ঠে আমার,
প্রথম প্রেমের অশ্রু যেমন ঝরে!

বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন রাশিয়ার জন্য ঘাত-প্রতিঘাতের এক সময় হয়ে ওঠায় অন্যান্য ধারার রুশ কবিদের মতো প্রতীকবাদীরাও একসময় অতীতের সরল জীবনধারার দিকে ফিরে তাকাতে শুরু করেছিলেন। সমালোচকেরা সেটাকে বাস্তবতা থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা আখ্যায়িত করলেও পরবর্তী সময়ের রুশ কাব্য এটাকে ঠিক সে রকম সাদা-কালোর সহজ সরল ব্যাখ্যা হিসেবে মেনে নেয়নি। এ কারণে মেনে নেয়নি যে জীবনের চলার পথ জটিল ও অনিশ্চিত হয়ে ওঠা সৃজনশীল ব্যক্তিত্বকে সব সময় অনেক বেশি ভাবায় এবং সাহিত্যের গতানুগতিক সংজ্ঞার ছাঁচে ফেলে এর চুলচেরা বিশ্লেষণ সব সময় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ব্লক যেমন অন্যত্র বলেছেন:

পুণ্য তুমি, ফেলে আসা দিন,
তারুণ্যের কম্পন ভরা স্বপ্নের আহ্বান,
গুরুভার যখন হৃদয় থেকে হয় বিলীন,
কানে বাজে সেই পুরনো দিনের গান।

প্রচলিত মতে প্রতীকবাদী কবিদের নেতৃত্বে ব্লকের অবস্থান ধরে নেওয়া হয়। তবে প্রতীকবাদীরা অন্য অর্থে সবাই ছিলেন ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে কাব্যচর্চায় নিয়োজিত কবি। ফলে একক একটি ধারা সবাই যে আক্ষরিক অর্থে অনুসরণ করে গেছেন, তা স্পষ্টভাবে বলার উপায় নেই। রুশ কাব্যে প্রতীকবাদের গুরু হিসেবে চিহ্নিত হলেও অন্যদিক থেকে ব্লক ছিলেন একাকী, নিঃসঙ্গ একজন কবি। দেশ ও জাতির দুঃসময় যাকে করেছিল মর্মাহত এবং আরও বেশি বিচ্ছিন্ন। ব্লকের কবিতায় এই নিঃসঙ্গতা, এই একাকিত্ব বারবার উঠে এসেছে অনেকটা যেন বেদনাহত এক ব্যক্তিত্বের আর্তচিৎকার নিয়ে। যে চিৎকারও অন্যদিক থেকে আবার সম্পূর্ণ অর্থে ব্যক্তিগত নয়, বরং অনেকটাই সামষ্টিক। শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত হিসেবে এই একটি কবিতাকে ধরে নেওয়া যেতে পারে।

প্রিয় বন্ধু আমার, শব্দহীন এই ঘরে
জ্বরের তাপ আমাকে পোড়ায়।
নেই সান্ত্বনা কোথাও শব্দহীন এই ঘরে
ধীরে জ্বলা আগুনের ছোঁয়ায়!

ভেসে আসে গান, উঠে ঝড়
তৃপ্তিও যে নিয়ে আসে ভয় জাগানো মায়া...
তোমার এই কাঁধেও, বন্ধু আমার,
দেখি আমি কারও প্রখর দৃষ্টির কালো ছায়া।

তোমার এই শান্ত কাঁধের পেছনে
ভেসে থাকে ঝাপ্টানো ডানার গুঞ্জন, স্বপ্নিল...
আমাকে মারে দৈব দৃষ্টি হেনে
ঝড়ের দেবতা আজরাইল!

গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বের হয়েছে আমার বিংশ শতাব্দীর রুশ কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ কবির কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। শিরোনামটি আমি বেছে নিয়েছি বুলাত অকুদঝাভার অসাধারণ একটি কবিতা থেকে। বইটি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছেন, শতাব্দীর শুরুর দুই দিকপাল কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি ও সের্গেই ইয়েসেনিন আর শতাব্দীর শেষ দিকের অন্য দুই দিকপাল ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো ও আন্দ্রেই ভজনেসেনস্কিকে কেন আমি সংকলনে স্থান দেইনি। এই প্রশ্নের পরিষ্কার উত্তর হচ্ছে, কাব্য প্রতিভা এবং সার্বিক পরিচিতির দিক থেকে এরা এতটাই ওপরে যে এদের জন্য জায়গা করে দিয়ে আমাদের পাঠক সমাজের কাছে তুলনামূলক অপরিচিতদের পরিচিতি আমি আড়াল করে দিতে চাইনি। তবে শেষের দুজনকে নিয়ে আমি অনেক দিন থেকেই কাজ করছি। এঁদের কবিতার ভিন্ন একটি অনুবাদ সংকলন প্রকাশের ইচ্ছা আমার আছে।

এই ব্যাখ্যা না হয় বুঝা গেল। তবে ব্লক? ব্লক কেন নেই সংকলনে? ঠিক এই প্রশ্নটি আমাকে করেছিলেন রাশিয়ার দৈনিক সংবাদপত্র রাসিস্কায়া গাজিয়েতার টোকিও ব্যুরো প্রধান বইটি নিয়ে আমার ছোট একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময়। আসলেই তো? ব্লক কি আমাদের অঞ্চলে সেভাবে পরিচিত? না, তা তো নয়। ব্লক কি বিংশ শতাব্দীর রুশ কবি নন? না, সেটাও নয়? আমার সেই রুশ সাংবাদিক বন্ধুর প্রশ্ন আমাকে ভাবিয়েছিল বেশ। তখন থেকে আমি ব্লক সম্পর্কে আরও জানার চেষ্টা করেছি। আমার পরিষ্কার ধারণা জন্মেছে, বিংশ শতাব্দীর রুশ কাব্য শুরু হয়েছে ব্লককে দিয়ে, আর শেষটাও হয়েছে ব্লক কে দিয়েই। যদিও শতাব্দী শেষ হওয়ার প্রায় আট দশক আগে প্রয়াত হয়েছেন এই কবি। আবারও এই শেষের প্রসঙ্গটি আমি তুলে রাখছি আলোচনার একেবারে শেষ দিকের জন্য।

আলেক্সান্দর ব্লক © ছবি: অজানা ।।  উইপিডিয়া থেকে নেয়া

 বাংলায় কাকতালীয়ভাবে আমার নিজের রুশ কবিতার অনুবাদও শুরু হয়েছিল ব্লককে দিয়ে। প্রয়াত অগ্রজপ্রতিম বন্ধু, সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক হাসনাত ভাইয়ের প্ররোচনা আর অনুপ্রেরণায় ব্লকের ছোট যে একটি কবিতার অনুবাদ আমি ১৯৮০ দশকের শুরুতে দেশে ফিরে যাওয়ার পর করেছিলাম, সেটা ছিল এরকম:

রাত্রি, সড়ক, ওষুধের দোকান, বাতি
আর আলো কেমন অর্থহীন, বিষণ্ণ,
যদি বেঁচে থাকো আরও সিকি শতক,
সব কিছু এমনই থাকবে, পালাবার পথ নেই কোনো।

যদি মরে যাও
আবারও যাত্রা তবে সেই শুরু থেকে।
সড়ক, বাতি, ওষুধের দোকান, রাতের নেমে আসা
খালের বরফ ভেজা ঢেউ পেছনে রেখে।

প্রতীকবাদী কবি হিসেবে জীবনের অর্থহীনতাকে এভাবে দেখেছিলেন ব্লক। তবে অনেকটা পথ পার হয়ে; প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ১৯১৭ সালের দুটি বিপ্লব, এবং মৃত্যু আর ক্ষুধার গৃহযুদ্ধে কিন্তু অন্য এক ব্লককে আমরা পাই। তবে রাশিয়ার এবং সেই সাথে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের কাব্য প্রেমিকদের দুর্ভাগ্য যে দুর্দশার উত্তরণ ব্লক দেখে যেতে পারেননি। দেখে যেতে পারলে তাঁর কাব্যে আরও একটি বাঁক নেওয়া দেখার সুযোগ হয়তো আমাদের হতো। সে রকম মূল্যায়ন থেকে আমার কাব্যগ্রন্থে ব্লককে অন্তর্ভুক্ত না করা ঠিক হয়নি বলে আমি এখন মনে করি।

বিংশ শতাব্দীর যুগান্তকারী সব ঘটনা শতাব্দীর রুশ কবিদের সকলকেই কমবেশি প্রভাবিত করেছে। সেই প্রভাব যে কেবল তাদের কাব্যের গণ্ডিতে সীমিত ছিল, তা কিন্তু নয়। এদের ব্যক্তিগত জীবনেও তা রেখে গেছে গভীর ছাপ। আর অনেক ক্ষেত্রেই সেই ছাপ ট্র্যাজিক অলংকরণে ভরা। মারিনা ৎসিভিতায়েভা নিজেকে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন কড়িকাঠের ফাঁসের দড়িতে, প্যারিস থেকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে রাশিয়ায় ফিরে যাওয়ার পর। স্বামী ও সন্তানকে হারানো আন্না আখমাতোভা বুকের ভেতরে গভীর বেদনা চেপে রেখে বেঁচেছিলেন অনেক দিন। তবে হারিয়ে ফেলেছিলেন কাব্যের সেই স্ফুলিঙ্গ, পাঠকের মনে যা জাগায় চমক, তোলে ঢেউ। বন্দিশিবিরে অনাহারে থেকে আর অসুখে ভুগে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন ওসিপ মান্দেলেশ্তাম। এরও আগে বিভ্রান্তি ছিনিয়ে নিয়েছিল ইয়েসেনিন ও মায়াকোভস্কিকে, সেই মায়াকোভস্কি, ইয়েসেনিনের আত্মহত্যার পর যিনি লিখেছিলেন, মরে যাওয়া অনেক সহজ, কঠিন হচ্ছে বেঁচে থাকা। সেই তুলনায় আর্সেনি তার্কোভস্কি ততটা দুর্ভাগা না হলেও জীবিত অবস্থায় নিজের লেখা কবিতা প্রকাশ করতে পেরেছেন খুবই কম।

এদের বিপরীতে পরবর্তী প্রজন্মের রুশ কবিদের অনেকটা ভাগ্যবান বলতে হয় এ কারণে, হানাহানি আর পারস্পরিক সন্দেহের বিশ্ব থেকে বের হয়ে এসে রাশিয়ার সমাজ তত দিনে হয়ে উঠেছিল অনেক বেশি সহনশীল। পাশাপাশি কবিতা হয়ে উঠেছিল পাঠোদ্ধারে মর্ম উপলব্ধির সাহিত্যই কেবল নয়, একই সাথে মানুষের জীবনে বিনোদন উপভোগেরও একটি অংশ। ফলে ইয়েভতুশেঙ্কো এবং ভজনেসেনস্কির মতো কবিদের দেখা গেছে উপচে পড়া দর্শকের উপস্থিতিতে স্টেডিয়ামের মঞ্চে নিজেদের কবিতা পাঠ করতে। অন্যরাও তখন সচল রেখেছেন কাব্যচর্চা। বুলাত অকুদঝাভা গিটার বাজিয়ে নিজের ব্যতিক্রমী কণ্ঠে আবৃত্তি নয়, বরং গেয়েছেন কবিতা। আর এদের সেই সব কবিতায় রূপক আকারে হলেও ফুটে উঠেছে আড়ালে থেকে যাওয়া সমাজের বাস্তব দৃশ্যাবলি। ভজনেসেনস্কি যখন দর্শকের সামনে উপস্থিত হয়ে বলেন, ঈশ্বরের সাতার-পোশাক গাঙচিল; অথবা আমি গয়া, আঁখি তারা আমার উপড়ে নেয় কালো কাক, উড়ে এসে নগরীর নগ্ন প্রান্তরে; অনেকেই তখন পরোক্ষে ধরে নিতে পারেন কোন ইঙ্গিত তিনি দিচ্ছেন। অথবা বুলাত অকুদঝাভার আবাসস্থলের বর্ণনা দিতে গিয়ে আরেক কবি যখন উচ্চারণ করেন, ঈশ্বরহীন গলিতে থাকেন এক ঈশ্বর, সন্ধ্যায় ঘুরতে বের হন তিনি পোষা কুকুরকে নিয়ে। আমাদের মনেও তখন একই সাথে দেখা দেয় নানা প্রশ্ন।

দীর্ঘ সেই কবিতায় একেবারে শেষ দিকে এসে যিশুখ্রিস্টের উল্লেখ নিয়ে সেই শুরু থেকেই চলেছে বিতর্ক, যা কিনা ব্লককে করেছিল মর্মাহত আর বিষণ্ণ, এতটাই যে এরপর কবিতা লেখা তিনি একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে লাল পতাকাকে ক্রুশ কাঠের রূপক হিসেবে ব্লক ব্যবহার করেছিলেন কি? সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য এখন আর তিনি জীবিত নেই। তবে আমরা জানি ক্রুশবিদ্ধ যিশু রুশদের জীবনে বিংশ শতাব্দীর শেষে আবার ফিরে এসেছেন। ফলে আমরা ধরে নিতে পারি, রুশ কাব্যে সোভিয়েত পর্বের সমাপ্তিও হয়েছে ব্লকের হাত ধরে যাত্রা করা পথেই।

রূপকের অতিরিক্ত ব্যবহার, মাত্রাতিরিক্ত আমি বলছি না, এটা হচ্ছে রুশ কবিতার আবশ্যকীয় একটি উপাদান। মূলত আলেক্সান্দর পুশকিনের সময় থেকে রুশ কাব্য আধুনিকতার ছোঁয়া পেতে শুরু করেছিল। তখন থেকেই রূপক হয়ে আছে কবিদের জন্যখোলাখুলি যা বর্ণনা করা যায় না, তা তুলে ধরার জুতসই এক হাতিয়ার। অন্যদিকে রূপক কোনো অর্থেই কাব্যের সৌন্দর্যকে ম্লান করে দেয়নি। এটাও রুশ কাব্যের আরেকটি চমকপ্রদ দিক।

রুশ কাব্যের ইতিহাস সার্বিকভাবে বড় দুটি বিভাজনে বিভক্ত। প্রথম অংশ, রাশিয়ায় যেটা সাধারণভাবে রুশ কবিতার স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত, সেই অংশে আছেন পুশকিন আর লের্মেন্তভের মতো কবিরা। এই পর্বের সূচনা সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে এবং এর স্থায়িত্বের সময়কাল অনেকটাই সীমিত। মূল দুই কবির বাইরে গৌন কবিদের উপস্থিতি লক্ষ করা গেলেও কাব্যধারাকে এরা কেউ সেভাবে প্রভাবিত করতে পারেননি। আফানাসি ফেত, নিকোলাই নেক্রাসভ কিংবা ফিওদোর তুৎচেভ নিজেদের সময়ে জনপ্রিয়তা পেলেও সেই জনপ্রিয়তা ব্যাপক অর্থে কালোত্তীর্ণ সেভাবে হতে পারেনি। একইভাবে কালোত্তীর্ণ হয়নি দেমিয়ান বেদনিদের মতো বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নের প্রলেতারীয় ধারার কবিদের কবিতা।

রুশ কাব্যের দ্বিতীয় বিভাজনে আছে বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকে আবির্ভাব হওয়া কবিদের বড় একটি দলের কাব্য। রাশিয়ায় রুশ কাব্যের এই কাল রৌপ্য যুগ নামে পরিচিত, যার সূচনা হয়েছিল আলেক্সান্দর ব্লকের মধ্যে দিয়ে। রুশ বিপ্লব এদের অনেককেই প্রভাবিত করেছে, অনেকেই এরা পরবর্তীকালে আশা ভঙ্গের হতাশায় ভুগেছেন। তবে কাব্যচর্চা বন্ধ থাকেনি। অন্যদিকে দ্বিতীয় এই দলটিকে নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে চলেছে নানা খেলা। এই খেলার সূত্র ধরে পশ্চিমে বরিস পাস্তেরনক হয়ে উঠেছেন মূলত ঔপন্যাসিক, যা কিনা তাঁর কাব্য প্রতিভাকে অনেকটাই আড়াল করে রেখেছে। একইভাবে সেই পথ ধরে পশ্চিমে ইয়োসেফ ব্রদস্কি হয়ে উঠেছেন নেতৃস্থানীয় রুশ কবি, যে দাবি মেনে নিতে আমি কোনো অবস্থাতেই রাজি নই। রুশ কাব্যের যারা অনুরাগী আর পাঠক, ব্রদস্কি তাদের কাছে যতটা না কবি, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনীতিক।

বক্তব্য খুব বেশি দীর্ঘায়ত না করে আবারও এখানে আমি ফিরে যেতে চাই শুরুর সেই মন্তব্যে, যেখানে আমি বলেছি রুশ কাব্যে বিংশ শতাব্দীর শেষটাও হয়েছে আলেক্সান্দর ব্লকের হাত ধরে। কেন, সেই বর্ণনাই আমি এখানে দিচ্ছি।

ব্লকের শেষ জীবনের বিখ্যাত একটি কবিতা হচ্ছে দ্বাদশ। রুশরা দীর্ঘ সেই কবিতাকে কাব্য উপন্যাস বলতে পছন্দ করেন। ব্লকের অন্য অনেক কবিতার মধ্যে এখানেও দেখা যায় রূপকের ছড়াছড়ি, যেসব রূপকের অর্থ উদ্ধার করতে গিয়ে মাথার চুল ছিড়তে হয়েছিল সেন্সর কর্মকর্তাদের। তবে শেষ পর্যন্ত সেন্সরের ছাড়পত্র সেই কাব্য পেলেও হতাশ ব্লক এরপর থেকে কবিতা লেখাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। ব্লকের সেই কবিতার শেষ কয়েকটি লাইন হচ্ছে এ রকম:

দর্পিত ভঙ্গিতে মিছিলে হেঁটে যায় তারা...
পেছনে খুঁড়িয়ে চলে ক্ষুধার্ত কুকুর,
মাথায় পেঁচিয়ে থাকে তুষার
রক্ত লাল পতাকা হাতে
তুষার ঝড়ে ধীরে পা ফেলে
এগিয়ে আসা গুলির মুখে নির্ভয়ে হাঁটে তারা–
তুষার কণার মুক্তায় গড়া মুকুট আর,
হিমের ফুলেল উষ্ণীষ মাথায়
সামনে তাদের চলেন যীশু খ্রিস্ট।

দীর্ঘ সেই কবিতায় একেবারে শেষ দিকে এসে যিশুখ্রিস্টের উল্লেখ নিয়ে সেই শুরু থেকেই চলেছে বিতর্ক, যা কিনা ব্লককে করেছিল মর্মাহত আর বিষণ্ণ, এতটাই যে এরপর কবিতা লেখা তিনি একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে লাল পতাকাকে ক্রুশ কাঠের রূপক হিসেবে ব্লক ব্যবহার করেছিলেন কি? সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য এখন আর তিনি জীবিত নেই। তবে আমরা জানি ক্রুশবিদ্ধ যিশু রুশদের জীবনে বিংশ শতাব্দীর শেষে আবার ফিরে এসেছেন। ফলে আমরা ধরে নিতে পারি, রুশ কাব্যে সোভিয়েত পর্বের সমাপ্তিও হয়েছে ব্লকের হাত ধরে যাত্রা করা পথেই।