উৎসবের ‘সিনেনামা’ অথবা সিনেমার উৎসব
এবারের ২০তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পেয়েছে ভারতের তামিল ভাষার ছবি ‘কুজাঙ্গাল’ (বাংলায় নুড়িপাথর, ইংরেজিতে পেবলস)। পিএস বিনোথরাজ পরিচালিত ছবিটির প্রেক্ষাপটে রয়েছে প্রত্যন্ত গ্রাম, সূর্যের কড়া উত্তাপ, বালি আর পাথুরে জমিন, শুকনো পরিবেশ, পানির অভাব, আর দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এমনই এক রুক্ষ ও শুষ্ক পরিবেশের ভেতর পরিচালক আমাদের দেখান এক মাথাগরম লোককে, নাম গণপতি (কারুত্থাদাইয়ান), সে স্ত্রীর ওপর ক্ষিপ্ত এবং সে জন্য সে পুরো দুনিয়াকেই জ্বালিয়ে দিতে প্রস্তুত। কিছুক্ষণ পরপর সিগারেট ধরাচ্ছে। বাসের ভেতর মারপিট করছে। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কাছা খুলে শালাকে পিটাচ্ছে। গণপতির সাথে ছিল তার ছেলে ভেলু (চেল্লাপান্ডি)। ভেলুকে নিয়েই গণপতি শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল স্ত্রী-কন্যাকে খুঁজতে। সে কোনো কারণে ভীষণ রেগে আছে। স্ত্রীর সাথে আর সংসার করবে না। তো শ্বশুরবাড়ি গ্রাম থেকে মোটামুটি দূর, সেখানে ছেলেসহ গিয়ে স্ত্রীকে খুঁজে পায়নি। বাবার দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড দেখে ভেলু মন খারাপ করে। রাগ করে ফিরতি বাস ভাড়ার জন্য সব টাকা ছিঁড়ে ফেলে। এ জন্য বেদম পিটুনি খেতে হয় তাকে বাবার হাতে। উপায় নেই, অসহ্য গরম ও তপ্ত নুড়িপাথর ছড়ানো পথ দিয়ে, খালি পায়েই গ্রামের দিকে রওনা দেয় গণপতি। তাকে অনুসরণ করতে শুরু করে বেচারা ভেলু।
পথে একটি ছোট পাথর কুড়িয়ে, জামায় মুছে মুখে পুড়ে দেয় ভেলু। ক্ষুধা লেগেছে তাই। অতিষ্ঠ গরম আর পারিবারিক অশান্তি মাথায় নিয়ে বাপ-ছেলে বাড়ি ফেরে। ফিরতি পথে এক কুকুরছানাও জুটে যায় তাদের সাথে। ফিরে জানা যায়, ভেলুর মা আর বোন দূরে গেছে পানি সংগ্রহ করতে। কারণ, সেখানে পানির ভয়াবহ সংকট। একদল নারী বসে আছে একটা ছোট গর্তের সামনে, বিশাল বিশাল কলসি নিয়ে। এক বৃদ্ধা অল্প অল্প করে ঘোলা পানি তুলে ভরছে কলসিতে। সারা দিন লেগে যাবে তার। আর অন্যদের কী অবস্থা, তা কল্পনা করে নেওয়া যেতে পারে। তো সিনেমাটি এই পানি ভরার দৃশ্য এবং সেটার একঘেয়ে শব্দ দিয়েই শেষ হয়। আমার মনে পড়ে যায় ‘দ্য টুরিন হর্স’ (২০১১) ছবিটির কথা।
দুনিয়ায় মানুষের জীবন আসলে গড়ে ওই একই রকম, একঘেয়ে এবং শেষ অব্দি জীবনটাই একটা বোঝাস্বরূপ, একে বহু কষ্টের ভেতর দিয়ে বয়ে নিতে হয়। সেই জীবনপথে মাঝে মাঝে যেসব স্মৃতি আমাদের আনন্দ দেয়, সেগুলো এই সিনেমার ভেলুর কুড়িয়ে পাওয়া নুড়ি পাথরের মতোই। এবারের উৎসবে এই ছবির শ্রেষ্ঠ হওয়াতে তাই অবাক হইনি।
আসলে প্রেক্ষাগৃহের বাইরে বড় পর্দায় চলচ্চিত্র দেখার বড় সুযোগ পাওয়া যায় চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে। এবং তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবির বাইরে নিরীক্ষাধর্মী ও সিরিয়াস ছবির দেখা মেলে এই উৎসবেই। যেসব চলচ্চিত্র কারখানা অতটা তেজি অর্থনীতির নয়, কিংবা উৎসব অঞ্চলে যেসব কারখানা অতটা পরিচিত নয়, সেসব ইন্ডাস্ট্রির ছবির স্বাদ নেওয়া যায় উৎসবে। এ ছাড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—স্বাধীন নির্মাতাদের বানানো চমৎকার ছবি দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায় এই উৎসবেই।
এই উৎসব আমার কাছে বিশেষ হয়ে থাকবে এই কারণে যে এবারের আয়োজনেই আমি ফিপ্রেসি জুরি হিসেবে নিয়োগ পাই জার্মানির মিউনিখ থেকে এবং উৎসবের ‘বাংলাদেশ প্যানোরামা’ শাখার ছবি দেখা ও বিচারের অভিজ্ঞতা অর্জন করি। আমার সাথে ফিপ্রেসি জুরি হিসেবে আরও ছিলেন ভারতের অভিজ্ঞ চলচ্চিত্র সমালোচক ও সাংবাদিক সিরাজ হাশিম সাঈদ ও মিসরের সাংবাদিক মোহাম্মেদ সায়িদ আবদেলরেহিম। ৯ দিনে ওদের সাথে থেকে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
বাংলাদেশসহ ৭০টি দেশের ২২৫টি ছবি অংশ নেয় এবারের উৎসবে। বহু দেশের চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, সংগঠক, প্রোগ্রামার, সমালোচক ঢাকায় এলেও, মহামারির কারণে অনেক আমন্ত্রিত অতিথিই শেষ পর্যন্ত আর যোগ দিতে পারেননি। আমার সাথে পরিচয় হয় ফ্রান্সের নির্মাতা ও প্রযোজক পিয়েরে ফিলমনের। তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সম্পর্কে জানতে ভীষণ আগ্রহী। যতটুকু জানি, ততটুকু জানাই তাঁকে। পরিচয় ঘটে ভারতের চলচ্চিত্রবিষয়ক শিক্ষক ইপ্সিতা বরাতের সাথে, চলচ্চিত্র নির্মাতা অঙ্কিত বাগচী ও সুপ্রিয়া সুরির সঙ্গে।
আসলে প্রেক্ষাগৃহের বাইরে বড় পর্দায় চলচ্চিত্র দেখার বড় সুযোগ পাওয়া যায় চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে। এবং তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবির বাইরে নিরীক্ষাধর্মী ও সিরিয়াস ছবির দেখা মেলে এই উৎসবেই। যেসব চলচ্চিত্র কারখানা অতটা তেজি অর্থনীতির নয়, কিংবা উৎসব অঞ্চলে যেসব কারখানা অতটা পরিচিত নয়, সেসব ইন্ডাস্ট্রির ছবির স্বাদ নেওয়া যায় উৎসবে। এ ছাড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—স্বাধীন নির্মাতাদের বানানো চমৎকার ছবি দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায় এই উৎসবেই
বুলগেরিয়ার চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক ইয়ানা ল্যাকারস্কা নিজের বানানো ছোট ছবি ‘দ্য ব্রিজ’ আমাকে দেখতে দেন। মৃত্যুসম্পর্কিত দার্শনিক মাত্রার ছবি। একটি মেয়ে আত্মহত্যা করতে যায়, সে সময় তার মনে ভিড় করে জীবনের পিছুটান। জীবন যেন এক হাওয়াই মিঠাই। শেষ পর্যন্ত তাকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনে এক আলোকচিত্রী। তিনি হয়ে ওঠেন মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া মেয়েটির গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল। অপূর্ব রূপকধর্মী ইয়ানার ছবিটি।
ক্রোয়েশিয়ার প্রযোজক ও চলচ্চিত্র সংগঠক ডালিয়া আলিক আমাকে ব্যক্তিগতভাবে দেখতে দেন ‘দ্য স্ট্যাম্প’। শরণার্থী এক যুবকের জীবন দোদুল্যমান হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের জেরে। এত বড় একটি বিষয়কে তিনি চমৎকারভাবে আনেন ১৮ মিনিটের ভেতর।
এই চলচ্চিত্র উৎসব আমার কাছে আরও কয়েকটি কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। জাপানের ধ্রুপদি চলচ্চিত্রকার ইয়াসুজিরো ওজুর ৫টি ছবি বড় পর্দায় দেখার সুযোগ পাই এখানে। এখন তো প্রায় সকলেই কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের পর্দায় ছবি দেখেন, কিন্তু চলচ্চিত্রের যে আদি সংস্কৃতি, বড় পর্দায় ছবি দেখা সেটার প্রতি আমার দুর্বলতা রয়েছে। ওজুর তিনটি ছবি আগে দেখলেও, আমি সেগুলো বড় পর্দায় দেখার সুযোগ হাতছাড়া করিনি। তা ছাড়া ব্লু-রে প্রিন্ট থাকায় ছবির দৃশ্যগুলোও ছিল ঝকঝকে। এতে করে ফ্রেমের ডিটেইল বোঝা গেছে খুব ভালো করে। জাপানি মাস্টার ফিল্ম মেকারের ছবি দেখা ছাড়াও জাপানের এক বাংলা ভাষাপ্রেমী চলচ্চিত্রকারের সাথেও পরিচয় ঘটে। তার নাম মিকা সাসাকি। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন: ‘টেগোর সংস’, ছবিটি এবারের আসরে প্রদর্শিত হয়েছে।
উৎসব চলাকালে প্রতিদিনের ‘উৎসব’ বুলেটিনে লিখেছি নিয়মিত কলাম: বিধান রিবেরুর সিনেনামা, এই শিরোনামে। বুলেটিনটি সম্পাদনা করেছেন মশহুরুল আমিন মিলন। তার উৎসাহেই লিখতে শুরু করি ছোট কলামগুলো। অবশ্য আমাকে দিয়ে লেখানোর প্রস্তাবটি সম্পাদককে প্রথমে দেন উৎসব পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামাল। তিনিই ফোন করে সম্পাদককে ধরিয়ে দিয়েছিলেন।
আহমেদ মুজতবা জামাল এক হাতে যেভাবে বিদেশি অতিথি থেকে শুরু করে দেশের ভিআইপি, সংগঠনের কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীদের সামলেছেন তা অতুলনীয়। দেশের বাইরের ছবিকে সঠিকভাবে বাছাই করে আনা যেমন বড় চ্যালেঞ্জ, তেমনি সেগুলো এখানে সময় মেনে প্রদর্শন করাও যথেষ্ট কঠিন কাজ। এত বড় আয়োজন তিন দশক ধরে করে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। বাংলাদেশের এই চলচ্চিত্র উৎসব আন্তর্জাতিক মানের হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে আহমেদ মুজতবা জামাল ও তার রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদের অবদান অনস্বীকার্য।
উৎসব মানে ‘ঘন হয়ে আসুন সকলে’
বাংলা ‘উৎসব’ কথাটির মূলে পাওয়া যায় উৎসারিত আনন্দ বা পার্বণকে। উৎসবের আনন্দ নদীর মতো অথবা বৃক্ষের মতো, প্রসারমাণ। চলচ্চিত্র উৎসবের সঙ্গে বৃক্ষের দৃশ্যকল্পটি দারুণ মেলে। গাছের শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে থাকা ফুল-ফল-পাতার মতোই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে থাকে নানা ধরনের আয়োজন।
২০তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও তাই দেখা যায় এশিয়ান ফিল্ম কম্পিটিশন, রেট্রোস্পেকটিভ, ট্রিবিউট, বাংলাদেশ প্যানোরামা, ওয়াইড অ্যাঙ্গেল, সিনেমা অব দ্য ওয়ার্ল্ড, উইম্যান ফিল্মমেকার, স্পিরিচুয়াল ফিল্ম, চিলড্রেন ফিল্ম ও শর্ট অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্টের মতো বিভাগ। এই সব বিভাগে ১৫ থেকে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত দেখানো হবে বাংলাদেশসহ ৭০টি দেশের ২২৫টি চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রপ্রেমীদের জন্য এর চেয়ে বড় আনন্দের আর কী হতে পারে? ৯ দিনই তাদের জন্য বড়দিন।
নবীন ও আধুনিকতম শিল্প চলচ্চিত্র যেভাবে মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে, ওটিটি ও ইউটিউবের মাধ্যমে, সেখানে মনে হতে পারে চলচ্চিত্র উৎসব হয় তো ম্রিয়মাণ হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা না হয়ে উল্টো মহামারির চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে গোটা বিশ্বেই চলচ্চিত্র উৎসবগুলো আবারও ঔজ্জ্বল্য ছড়াতে শুরু করেছে। ভুলে গেলে চলবে না মানুষ মূলত সামাজিক জীব, তাদের বেঁচে থাকার জন্য উৎসব প্রয়োজন। চলচ্চিত্র গণমাধ্যম এবং এটি মূলত তৈরি হয় অনেক মানুষ যেন একত্রে বড় পর্দায় শিল্পকর্মটি উপভোগ করতে পারে সে জন্য। যদিও এখন এই বড় পর্দার সংস্কৃতি প্রবেশ করেছে ক্ষুদ্র পর্দার ভেতর, তারপরও, বড় পর্দায় চলচ্চিত্র দেখার আবেদন ফুরিয়ে যায়নি, ফুরিয়ে যায়নি বলেই উৎসব চলছে। মানুষ আনন্দভুক বলেই উৎসব থাকবে।
চলচ্চিত্রের উৎসব সাধারণ মানুষের ভেতরে ভালো ছবি দেখার আগ্রহ তৈরি করে, তাদের দেখার চোখকে প্রসারিত করে। ভালো চলচ্চিত্র শুধু আনন্দই দেয় না, চিন্তা ও মননের বিকাশ ঘটায়, উদার হতে সহায়তা করে।
ভালো ছবি কারে কয়?
চলচ্চিত্রের চিন্ময়ের দিকটাকেই সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বলে মনে হয় আমার। একটি ছবি নির্মাণে ত্রুটি থাকতে পারে, হলিউড বা বলিউডের মতো ঝকঝকে-চকচকে কাজ না-ও হতে পারে, কিন্তু চিন্তার জায়গাটি স্বচ্ছ থাকলে আমার মনে হয় বাকি সব গৌণ হয়ে যায়। মুখ্য হয়ে ওঠে চলচ্চিত্রের গতিমুখ, নির্মাতার চিন্তাপথ। এই অভিযাত্রা একার পক্ষে সম্ভব নয়।
চিন্তার বাহক প্রয়োজন হয় অর্থাৎ দৃশ্যসজ্জা, ক্যামেরা, সম্পাদনা ইত্যাদি কলাকৌশল সহযোগেই চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হয়। এটাকে বলা যেতে পারে মৃন্ময়। কুমার মাটি দিয়ে যে ফুলদানি তৈরি করেন, নির্মাণ শেষে সৃজনের ছাপটাই ফুটে ওঠে সেই ফুল সাজাবার পাত্রে, কুমারের চৈতন্য স্বরূপে হাজিরা দেয় সেই পুষ্পাধারে। তাই বলা যায়, মৃন্ময় ও চিন্ময় সহযোগেই, অন্যান্য শিল্পের মতো, চলচ্চিত্রও আমাদের সমুখে আসে। প্রথম কোনটা বিচার করা হবে সেটাই আসল কথা। আমার বিবেচনায় আগে চিন্ময়, পরে মৃন্ময়। আধার গুরুত্বপূর্ণ নিঃসন্দেহে, কিন্তু আধেয় অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সচেতন শিল্পীর ক্ষেত্রে আধেয় বা চিন্ময়ই ঠিক করে দেয় আধার বা শরীর কেমন হবে। তাই তো অ্যাকশন-থ্রিলার জঁরার সম্পাদনা রীতি ও কালার প্যালেটের সাথে ড্রামা ফিল্মের মিল হয় না।
একেকজন মানুষের চলচ্চিত্র দেখার ভঙ্গি একেক রকম। তা ছাড়া নানাজনের চলচ্চিত্র বিচারের পদ্ধতিও আলাদা হতে বাধ্য। তবে আমার মনে হয় ভালো ছবি সেটিকেই বলা যায়, যে ছবির নির্মাতার চিন্তার স্বচ্ছতা আছে এবং সেই চিন্তাকে পর্দায় রূপান্তরের দার্ঢ্য আছে। এই দুটি বৈশিষ্ট্যের জন্য একজন নির্মাতার যেমন ব্যাপক প্রস্তুতি দরকার, তেমনি ছবি বিচারের জন্যও একজন চলচ্চিত্র সমালোচক বা বিচারকের দরকার চিন্তাচর্চার।
অবশ্য চিন্তার স্বচ্ছতা দিয়েও অনেক সময় ‘খারাপ’ ছবি হতে পারে। ধরুন, কেউ ফ্যাসিবাদ নিয়ে প্রপাগান্ডা ছবি বানাল, বেশ পরিষ্কার চিন্তা দিয়েই বানাল, সে ক্ষেত্রে? নির্মাণ ভালো হলেও তখন সেটাকে বর্জন করাই শ্রেয়।
উৎসব ও প্রেক্ষাগৃহ দুটোকেই চায় চলচ্চিত্র
ইদানীং একটি চল শুরু হয়েছে চলচ্চিত্রে, তা হলো বাণিজ্যিক ধারার সাথে চিন্তাশীলতা ও শৈল্পিক উপাদান মিশ্রণের চল। এর পেছনে অবশ্য মূলত কাজ করে বাণিজ্যই। এসব ছবি মুনাফা চায়, সিনেমা বোদ্ধাদের মনও চায়। প্রেক্ষাগৃহভর্তি দর্শক চায়, উৎসবে জলপাই পাতায় মোড়া পুরস্কারও চায়।
২০তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যে ছবিটি দেখানো হয় ‘দ্য অ্যাঙ্গার, সেটিও এই ধাঁচেরই ছবি। লেবানন-জার্মানির যৌথ প্রযোজনার এই ছবির পরিচালক মারিয়া ইভানোভা জেড দেখিয়েছেন লেবাননের ইডা নামের এক তরুণী শিল্পীর সাথে ফরাসি পুরুষ হান্সের প্রণয় ও করুণ পরিণতির কাহিনি। সত্তরের দশকে লেবাননে গৃহযুদ্ধ শুরুর পর দেশটিতে নানামুখী তৎপরতা ও হামলা, পাল্টা হামলা শুরু হয়। রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটেই এই ছবি তৈরি করা হয়েছে। তবে মাঝে যেভাবে বলিউড ছবির মতো নায়ক-নায়িকাকে গানের সাথে দৌড়াদৌড়ি ও ছোঁয়াছুঁয়ি করতে দেখা যায়, তাতে এই ছবিকে বাণিজ্যিক করার প্রচেষ্টা চোখ এড়ায় না।
একেকজন মানুষের চলচ্চিত্র দেখার ভঙ্গি একেক রকম। তা ছাড়া নানাজনের চলচ্চিত্র বিচারের পদ্ধতিও আলাদা হতে বাধ্য। তবে আমার মনে হয় ভালো ছবি সেটিকেই বলা যায়, যে ছবির নির্মাতার চিন্তার স্বচ্ছতা আছে এবং সেই চিন্তাকে পর্দায় রূপান্তরের দার্ঢ্য আছে। এই দুটি বৈশিষ্ট্যের জন্য একজন নির্মাতার যেমন ব্যাপক প্রস্তুতি দরকার, তেমনি ছবি বিচারের জন্যও একজন চলচ্চিত্র সমালোচক বা বিচারকের দরকার চিন্তাচর্চার
উৎসবে ক্রোয়েশিয়া থেকে আসা তরুণী প্রযোজক ডালিয়াও বলছিলেন যৌথ প্রযোজনা এবং বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে মাঝামাঝি ধরনের ছবির সম্ভাবনার কথা। ছবিকে এখন প্রায় সকলেই আগে উৎসব ঘুরিয়ে তারপর প্রেক্ষাগৃহে ঢোকাতে চায়। তারপর টেলিভিশন, অতঃপর ওটিটি। এতে প্রযোজকের পয়সা উঠে আসে। তবে বাংলাদেশে এই ধরনের ছবি খুব একটা দেখা যায় না। নেই বললেই চলে। এমনিতেই ছবি মুক্তির সংখ্যা কমে গেছে অনেক। বছরে কমপক্ষে ৫০টি ছবি মুক্তি না পেলে আসলে সেই চলচ্চিত্র কারখানার বিকাশ বন্ধ হয়ে যায়। আমাদেরও তাই হয়েছে। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে যখন প্রযোজকেরা নানা কিছুর মিশেলে, নানা কৌশল প্রয়োগ করে ছবি বাজারে নিয়ে আসছে, সেখানে আমরা গতানুগতিক ভাবনার বাইরে যেতে পারছি না। চলচ্চিত্র কারখানাকে বাঁচাতে হলে যুগের চাহিদা মাথায় রাখতে হবে। প্রফিট মোটিফের সাথে মেশাতে হবে সেরিব্রাল অ্যালিমেন্ট।
তবে কি, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ছবি তৈরির শুরু থেকেই যদি মাথায় মুনাফা থাকে, তাতে যতই শিল্প ও ঘিলু মেশানো হোক না কেন, সেটি বাণিজ্যিক ছবিই থাকে, আর্ট ফিল্ম আর থাকে না। ছবি তৈরির প্রধানতম বিষয় হলো উদ্দেশ্য। কেউ বাণিজ্যের জন্যই ছবি বানায়, কেউ রাজনৈতিক অর্থনীতির বোঝাপড়া থেকে শিল্পের আশ্রয় নেয়। চলচ্চিত্রের পেছনে কে আছেন, সেটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ক্যামেরা-স্তিলোর জমানায় সিনেমার আধার
প্রযুক্তির কল্যাণে ক্যামেরা যত উন্নত ও সহজলভ্য হয়েছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে চলচ্চিত্র নির্মাণের সংখ্যা। বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ছবির সংখ্যা কমলেও, স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণ কিন্তু বেড়েছে। আগে লোকে ১৬ মিমি দিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি বানাত, এখন মোবাইল ফোনের ক্যামেরা দিয়েই সেটা সম্ভব হয়ে উঠছে। ক্যামেরাকে এখন লেখার কলমের মতো করেই ব্যবহার করা যাচ্ছে। তো এই ক্যামেরা-স্তিলোর জমানায় শুধু কি চিন্তাভাবনার স্বচ্ছতা থাকলেই ভালো কাজ করা সম্ভব?
লেখকের কাছে যেমন বিষয়বস্তু শুদ্ধ নয়, সেই বিষয়কে ফুটিয়ে তোলার জন্য একটি জুতসই কাঠামো বা ভঙ্গি দরকার হয়, নির্মাতার বেলাতেও তাই। প্রথমত নির্মাতার বুঝতে হয় তিনি কী বানাবেন, কেন বানাবেন, কার জন্য বানাবেন। এরপর তার জানতে হয় কীভাবে বানাবেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পরিচালক প্রথমটা ঠিকঠাক ধরতে পারলেও, দ্বিতীয় বিষয়টি অর্থাৎ বলার ভঙ্গিটি রপ্ত করতে পারেন না, সে ক্ষেত্রে ছবিটি মার খেয়ে যায়। আপনার রান্নাটা ভালো, দারুণ রেসিপি, কিন্তু পরিবেশন করলেন অগোছালো ভঙ্গিতে এবং একটি ভাঙাচোরা-ময়লা পাত্রে; আমন্ত্রিত অতিথি (পড়ুন দর্শক) কিন্তু খাবারের (পড়ুন সিনেমা) ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।
এবারের উৎসবে আমার সহ-বিচারক, ভারতের চলচ্চিত্র সমালোচক সিরাজ হাশিম সাঈদ বলছিলেন, সিনেমা যদি চলমান হয় (মুভি তাই মুভিং), তাহলে সেই ছবি দেখতে ভালো লাগে। নিঃসন্দেহে, ছবির নিজস্ব একটি গতি তো থাকবেই। সেটা হোক প্রচণ্ড গতির কিংবা ধীরগতির। জেমস বন্ডের যেকোনো ছবির পাশে ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) রাখলেই পার্থক্যটা বোঝা যায়।
যেকোনো ধরনের ছবির সাফল্যই নির্ভর করে বিষয় ও সঙ্গতিপূর্ণ নির্মাণের ওপর। সাফল্যটাও অবশ্য আপেক্ষিক ব্যাপার। অনেক ছবিই আছে, যেগুলো সময়ের আগে নির্মিত বলে সমকালে সাফল্য পায়নি। তবে আমি মনে করি, প্রযুক্তির যে উৎকর্ষ আমরা দেখছি, যেভাবে হাতের মুঠোয় চিত্রনাট্য রচনা, দৃশ্য ধারণ ও সম্পাদনা সম্ভব হয়ে উঠছে, সে ক্ষেত্রে ছবির বিষয় যদি ঠিকঠাক নির্ধারণ করা যায়, তাতে যদি সারবত্তা থাকে এবং শেষ পর্যন্ত গোটা বিষয়টিকে প্রকাশের জন্য যদি সঠিক প্রকাশভঙ্গি খুঁজে পাওয়া যায়, তবে আলো ফুটবেই, আজ অথবা কাল।
বাস্তবের চলচ্চিত্র জাদু দিয়ে হয় না
বড় বোনের নাম আকরাম, সে অটিস্টিক। তার ১১ বছরের ছোট বোন আজার, সে একটি বড় বিউটি সেলুনে কাজ করে। আর তাদের ভাই এমাদ, অকর্মণ্য, জার্মান যাওয়ার দিবাস্বপ্নে বিভোর। এমাদকে নিয়ে দুই বোনই বিরক্ত। অটিস্টিক বোনটিকে এমাদ শুধু খেপায়। একদিন রাগের মাথায় আকরাম তাকে ছাদ থেকে ফেলে দেয়। গুরুতর আহত এমাদের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে আরেক বোন আজার। তাদের পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য ছিল এই এমাদ। ভাইয়ের লাশ দূরে বরফ জমাট জলাশয়ে ফেলে আসে দুই বোন। কিন্তু এই হত্যাকে মেনে নিতে পারেনি বড় বোন। কল্পনায় এমাদ ফিরে ফিরে আসে। শেষ দৃশ্যে, রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে ঘরে গ্যাস ছেড়ে রাখে অটিস্টিক বোনটি। ভোরে দেখা যায় রক্তজবা মাশরুম ফুটে আছে বাড়ির প্রাঙ্গণে। তিন ভাইবোনের মিলন ঘটে। অর্থাৎ গ্যাস থেকে আগুন লেগে দুই বোনও মারা যায়। পরপারে তারা আবার মিলিত হয়।
ইরান ও কানাডার যৌথ প্রযোজিত চলচ্চিত্রটির নাম ‘বটোক্স, কাভে মাজাহারি পরিচালিত এই কাব্যিক ছবি উৎসবে দেখানো হয় ১৭ জানুয়ারি। অভিভূত হওয়ার মতো ছবি। কিছু কিছু চলচ্চিত্র থাকে, যেগুলো দেখে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যেতে হয়। ছবিতে জাদু বাস্তবতার ভেতর দিয়ে, আমার ধারণা, ইরানি সমাজের পুরুষতন্ত্রকে খারিজ করার স্বপ্নের কথাই বলা হয়েছে।
পৃথিবীতে কতশত রকমের ছবি যে নির্মিত হচ্ছে! সেখানে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি থাকার পরও সিনেমার পর্দায় সেটিকে ঠিকভাবে যে তর্জমা করা যাচ্ছে না, তার প্রধান কারণ মনে হয়, আমাদের তাড়াহুড়ো স্বভাবের পাশাপাশি জ্ঞানের প্রতি অনীহা। আমরা খুব সহজেই, কষ্ট ও ধ্যান ছাড়া, অনেক বেশি অর্জন করতে চাই। কিন্তু একটা জিনিস আমরা ভুলে যাই, নিজস্ব ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি বোঝা ছাড়া, চলচ্চিত্র মাধ্যমের ভাষাকে আয়ত্ত করা ব্যতীত বিশ্বমানের চলচ্চিত্র নির্মাণ করা প্রায় অসম্ভব। চলচ্চিত্রে জাদু বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলা যায়, কিন্তু বাস্তবে ভালো ছবি করতে হলে জাদু দিয়ে কাজ হবে না, সেখানে কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় প্রয়োজন।
পর্দার পাশের মহাত্মারা
চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় ‘অতর তত্ত্ব’ বলে যে ধারণাটি আছে, তাতে পরিচালককে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। আর এই তত্ত্বের বিরোধীরা বলেন, চলচ্চিত্রে অভিনয়শিল্পী, চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক, সঙ্গীত পরিচালক—এদের গুরুত্ব খাটো করার কোনো সুযোগই নেই। চলচ্চিত্র এক যৌথ শিল্প, তাই অন্যদের অবদান অনস্বীকার্য, তবে পরিচালক জাহাজের কাপ্তান, এটাও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ তো গেল চলচ্চিত্রের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত মানুষদের কথা। কিন্তু তারা ছাড়াও একটি চলচ্চিত্রের জন্য কাজ করেন পরিবেশক, প্রদর্শক এবং আরও এগিয়ে বললে, শেষ বৈতরণী পার করে দেন দর্শক। তো এই পুরো বর্গের বাইরেও কিন্তু আরও চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট মানুষজন আছেন, যাঁদের অবদানের কথা একটু পাশেই পড়ে থাকে। তাঁরা হলেন চলচ্চিত্র সমালোচক ও চলচ্চিত্রকর্মী।
দর্শকের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার কাজটি শুধু নয়, একটি চলচ্চিত্রের নানামুখী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে চলচ্চিত্র সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে তোলে চলচ্চিত্র সমালোচক বা লেখকেরা। তাঁরাই মূলত চলচ্চিত্রের সাহিত্যকে নির্মাণ করেন, চলচ্চিত্রের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন। অন্যদিকে চলচ্চিত্রকর্মী: দিনরাত খেটে যাঁরা চলচ্চিত্রের পত্রিকা বের করেন, যাঁরা উৎসবের আয়োজন করেন, যাঁরা উৎসবের জন্য চলচ্চিত্রের ডালি সাজান (ফিল্ম প্রোগ্রামার), তাঁরাও অনেকটা পাদপ্রদীপের অন্ধকারেই থাকেন। গণমাধ্যম তাঁদের নিয়ে খুব একটা লেখালেখি করে না। তাতে কিন্তু এসব মানুষের চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা ও উদ্যোগ কমে যায় না।
উৎসবে ১৮ জানুয়ারি তেমনই এক মানুষকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র দেখলাম: ‘অরুণা বসুদেব: মাদার অব এশিয়ান সিনেমা’, এটি তৈরি করেছেন দিল্লির তরুণ নির্মাতা সুপ্রিয়া সুরি। ছবিটির মাধ্যমে চলচ্চিত্রকে সঙ্গী করে ভারতীয় চলচ্চিত্র সমালোচক ও সংগঠক অরুণার ছুটে চলা উদ্ভাসিত হয় আজকের প্রজন্মের সামনে। নিউইয়র্ক ও প্যারিসে চলচ্চিত্রের ওপর লেখাপড়া ও হাতেখড়ি নিয়ে নিজ দেশে ফিরে, এশিয়ার চলচ্চিত্রকে তুলে ধরার জন্য প্রকাশ করতে শুরু করেন পত্রিকা ‘সিনেমায়া’। এশীয় চলচ্চিত্রের পরিচিতি ও প্রসারের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘নেটওয়ার্ক ফর দ্য প্রমোশন অব এশিয়ান সিনেমা’ (নেটপেক) নামের আন্তর্জাতিক সংগঠন। চলচ্চিত্রের জন্য অন্তঃপ্রাণ অরুণাকে বলা হয় এশীয় সিনেমার জননী।
যাহোক, চলচ্চিত্রের বিচিত্র দুনিয়ায় অরুণা বসুদেবের মতো মহাত্মারা আছেন বলেই চলচ্চিত্র পায়ের তলায় শর্ষে পায়।
বড় মঞ্চ মশকরা করার জায়গা নয়
প্রস্তুতি ছাড়া কোনো শিল্পকর্ম নিয়ে বড় মঞ্চে আসা উচিত নয়। তাতে নিজেরই অপমান হয়। আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন শিল্পী কখনো নিজেকে প্রস্তুত না করে দশজনের সামনে নিজেকে বা তাঁর শিল্পকর্মকে হাজির করেন না। ধরুন, কেউ শিল্প করছে না, প্রপাগান্ডা করছে, বিজ্ঞাপন বানাচ্ছে, আমি মনে করি সেটারও ন্যূনতম শৈল্পিক মানদণ্ড থাকা চাই।
প্রশ্ন আসতে পারে, শিল্প কাকে বলে? আর তার মানদণ্ড কি গজফিতা দিয়ে মাপা যায়? শিল্পের সর্বজনসম্মত সংজ্ঞা যেমন নেই, তেমনি সেটি পরিমাপের যন্ত্রও কেউ আবিষ্কার করেনি। তবে আমরা সাধারণ বোধবুদ্ধি দিয়ে বুঝি—নান্দনিক জায়গা থেকে, বৌদ্ধিক পরিসরে যে কাজ আমাদের মুগ্ধ করে, আন্দোলিত করে এবং রেশ রেখে যায়, সেটিকেই শিল্প বলে। এখন কোন শিল্প কতটা মুগ্ধতা ছড়ায়, কতটুকু সাড়া জাগায় এবং কত দিন মনে ছাপ ফেলে রাখে, সেটা পরিমাপের ভেতর দিয়েই শিল্পকে মাপজোখ করা যায়—অন্তত আমার এমনটাই মনে হয়।
বাঙালি কি বাচাল? সেটা জরিপ চালানোর পর সঠিক করে বলা যাবে। তবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দেখলে অতিকথনের প্রবণতা তো দেখা যায়ই, উপরন্তু দর্শকদের বোকা ভেবে চোখে আঙুল দিয়ে ছবির অর্থ বুঝিয়ে দেওয়ার ঝোঁকও দৃষ্টিগোচর হয়। এটা করতে গিয়ে পরিচালক অনেক সময় অযথা, দৃশ্যের পর দৃশ্য জুড়ে যেতে থাকেন, যা অপ্রয়োজনীয়
চলচ্চিত্র সবচেয়ে আধুনিক শিল্প। আগের সকল শিল্পকে সে যেমন গ্রহণ করেছে অকাতরে, তেমনি তার সামনে যা কিছু আসছে (যেমন অ্যানিমেশন) তার সবটাকেই সে আপন করে নিচ্ছে সহজাত বৈশিষ্ট্যের কারণে। তার মানে চলচ্চিত্র হলো সকল শিল্পকে নিয়ে গঠিত এক জটিল শিল্প। যত জটিল তত উন্নত, তত সুন্দর। এ কারণেই চলচ্চিত্র নির্মাণ কঠিনতর কাজ। শিল্পের নানা শাখা বিষয়ে যার বোঝাপড়া নেই, সে চাইলেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারবে না। ক্যামেরা দিয়ে যেমন খুশি তেমন দৃশ্য ধারণ করা মানেই চলচ্চিত্র নয়। মানে চলচ্চিত্র আসলে চলমান চিত্র কেবল নয়, তাকে ‘সিনেমা’ হয়ে উঠতে হয়।
তো ‘সিনেমা’ নির্মাণের জন্য প্রথম প্রস্তুতিটা নিতে হয় সাহিত্যপাঠের ভেতর দিয়ে। এরপর সঙ্গীতের কান তৈরি করা। তারপর ভালো সিনেমা দেখার চোখ ও মন গঠন করা। দীর্ঘদিন এভাবে প্রস্তুত হয়ে, ছোট ছোট কাজ দিয়ে নিজেকে পরখ করার ভেতর দিয়েই চলচ্চিত্র বানাতে হয়, অতঃপর কাজটি নিয়ে বড় মঞ্চে আসতে হয়।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব একটি বড় মঞ্চ, এখানে অনেক বড় শিল্পীর মহৎ কাজ দেখানো হয়। এ রকম মঞ্চে সুযোগ পেলে যেকোনো নির্মাতারই উচিত চর্চার ভেতর দিয়ে এসে, নিজের সবচেয়ে ভালো কাজটি নিয়ে উপস্থিত হওয়া। এখানে যেনতেন কাজ নিয়ে হাজির হয়ে মশকরা করার অর্থ হয় না। তাতে অন্যদের সময় নষ্ট হয়, অপমান করা হয় এবং নিজেকেও হাসির পাত্র করে তোলা হয়।
শিল্পে পরিমিতিবোধ থাকা জরুরি
বাঙালি কি বাচাল? সেটা জরিপ চালানোর পর সঠিক করে বলা যাবে। তবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দেখলে অতিকথনের প্রবণতা তো দেখা যায়ই, উপরন্তু দর্শকদের বোকা ভেবে চোখে আঙুল দিয়ে ছবির অর্থ বুঝিয়ে দেওয়ার ঝোঁকও দৃষ্টিগোচর হয়। এটা করতে গিয়ে পরিচালক অনেক সময় অযথা, দৃশ্যের পর দৃশ্য জুড়ে যেতে থাকেন, যা অপ্রয়োজনীয়।
শিল্প অনেক বেশি আদরণীয় হয়ে ওঠে আড়ালের কারণে। শিল্পে আড়াল থাকতে হয়, রূপ থেকে রূপান্তর এবং নাম থেকে নামান্তর, এই টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে বুনে যেতে হয় শিল্পের বয়ান। সে কারণেই পর্নোগ্রাফি কোনো শিল্প নয়। ইঙ্গিত, একাধিক অর্থ, রূপক, মিতবাক ইত্যাদি হলো ভালো মানের শিল্পের কার্যকর উপাদান। উৎকৃষ্ট শিল্প কখনো অতিকথনের দোষে দুষ্ট হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রায়ই হয়ে ওঠে ‘টকিং হেড’, অর্থহীন দৃশ্যের বিজ্ঞাপন।
আমাদের দেশের বিজ্ঞাপনেও একই রকম চরিত্র প্রকাশিত। দেখবেন কোনো খালি জায়গা রাখতে চায় না। সব জায়গায় কিছু না কিছু লেখা থাকবেই। তেমনি চলচ্চিত্রের বেলাতেও দেখা যায়, পরিচালকগণ যে বক্তব্য এক শটেই সারতে পারতেন, সেখানে একাধিক শটের সমাহার ঘটান; মনে সন্দেহ, যদি দর্শক বুঝে উঠতে না পারে? তো এমন সন্দেহের বশবর্তী হয়ে পরিচালক সংলাপেও একই বিষয় বারবার বলিয়ে নেন অভিনয়শিল্পীদের দিয়ে। এতে ছবিটি ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে এবং দর্শকও বিরক্ত বোধ করেন।
অনেক কথা অল্পতে বলার কৌশল রপ্ত করা সহজ ব্যাপার নয়, দৃশ্য মাধ্যমে তা আরও বেশি সংপ্রশ্নবিদ্ধ বা চ্যালেঞ্জিং। চলচ্চিত্রে তাই মিজোঁসেন, মন্তাজ ও রঙের বিন্যাসের ওপর দখল থাকার পাশাপাশি পরিচালকের দেশ-বিদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকা খুব দরকার। অন্তত যে বিষয়ের ওপর তিনি কাজ করছেন, সেটার ওপর জ্ঞান অর্জন করা অবশ্যকর্তব্য। ভাসা ভাসা জানা দিয়ে চলচ্চিত্রের ভাষাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা অসম্ভব। দৃশ্যমাধ্যমের ভাষাকে বশংবদ করতে চাইলে গভীর মনোনিবেশের কোনো বিকল্প নেই। আর শিল্পের পরাকাষ্ঠায় পৌঁছানোর কোনো হ্রস্বতর পথও নেই। গভীর ধ্যান, চর্চা ও অনুশীলনই পারে অতিকথন ও অতিদেখানোর প্রবণতা কমিয়ে মেদহীন, নান্দনিক শিল্পের জন্ম দিতে।
শেষ বলে কিছু নেই
যাঁরা বিজ্ঞানের ছাত্রী, তাঁরা জানেন, শক্তির শেষ নেই, রূপান্তর আছে। ২০তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আজ শেষ দিন। উৎসব এক শক্তির নাম, এর শেষ নেই। আজকের পর এর রূপান্তর ঘটবে আগামী উৎসবের আয়োজনে। এই উৎসব থেকে আহৃত অভিজ্ঞতা: নতুন-পুরোনো ধ্রুপদি সিনেমা দেখা, গুণী মানুষদের সাথে আলাপ-পরিচয়, সর্বোপরি সিনেমা নিয়ে টানা ৯ দিন যাপন করা এক ভিন্নমাত্রার শক্তি জোগাবে সংশ্লিষ্টদের, সিনেমাপ্রেমীদের। শুধু শক্তি নয়, উৎসব আসলে উৎসাহও দেয়: নবীন নির্মাতাদের, পুরস্কারপ্রাপ্তদের এবং ভালো ছবি দেখার জন্য দর্শকদের।
এবারের আসরের আয়োজক এবং যুক্ত হওয়া দেশ-বিদেশের পরিচালক, প্রযোজক, প্রোগ্রামার, চলচ্চিত্র সমালোচক—প্রত্যেকেই মোটামুটি আনন্দিত যে সফলভাবে, ভালো কিছু ছবির প্রদর্শনী করা গেছে, সার্থকভাবে সেমিনার সম্পন্ন হয়েছে এবং সাধারণ মানুষের ভেতর পুরোপুরি না হলেও, উৎসবের দ্বিতীয়ার্ধে সাড়া জাগানো গেছে। তবে নয়া-মুকুট (নভেল করোনা) যেভাবে চোখ রাঙানিতে রাখছিল সকলকে, অনেক বিদেশি প্রতিনিধি তো শেষ মুহূর্তে আসতেই পারেননি, সারাক্ষণ মুখ সামলাতে হয়েছে মুখোশে, হাত ভেজাতে হয়েছে নির্বিষ করার তরলে, কারও সাথে করমর্দনও করা যায়নি মন খুলে, আলিঙ্গন তো দূর-কি-বাত!
এই মহামারিকালে প্রদর্শনীর সময় আসন ফাঁকা রেখে বসার নির্দেশনা থাকলেও, অনেক ক্ষেত্রে দর্শকের চাপে তা মেনে চলা সম্ভব হয়নি। আসলে উৎসবে সব সময় সেটা মেনে চলা সম্ভবও নয়। তা ছাড়া মানুষ আর কত গৃহবন্দী থাকবে? মানুষ খোলা হাওয়া চায়, আনন্দ-উৎসব-মেলা চায়, তাই দল বেঁধে মানুষ এসেছে ছবি দেখতে। যদিও সংক্রমণের ভয়ে বইমেলা পেছানো হয়েছে, তবে চলচ্চিত্র উৎসব যে বন্ধ করে দেওয়া হয়নি, পূর্বনির্ধারিত দিনেই যে তার সমাপ্তি টানা যাচ্ছে, তাতেই শুকরিয়া!
যেকোনো চলচ্চিত্র উৎসব শেষ হয় আগামী আসরে আরও নতুন, আরও দুর্দান্ত চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর অঙ্গীকার নিয়ে। উৎসবের পর্দা নামে পরবর্তীকালে অপূর্ব কিছু করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি যদি টিকা কার্যক্রম জোরদার হয়, তাহলে আগামী উৎসবে নিশ্চয় শঙ্কাহীন চিত্ত নিয়ে চলচ্চিত্র উপভোগ করা যাবে, উচ্ছ্বাস নিয়ে উদযাপন করা যাবে উৎসব।