ইলিয়াস নবির দেশে

 

সান্তরিনি দ্বীপের পাথুরে পাহাড় কেটেকুটে থরে থরে আবাস, হোটেল, রেস্তোরাঁ, বারএসব বানানো হয়েছে এদিকটায়। পাথরে তো আর ফুল ফোটে না, তাই অতিথিশালা বা রেস্তোরাঁর টবে বহু যত্নে লালিত সবুজ লতাপাতা আর রঙিন ফুলের কেয়ারি। এক রেস্তোরাঁয় খেয়ে-টেয়ে আবাসে ফিরে একটু জিরিয়ে নিলাম। রোদ পড়লে ঘুরতে এলাম পশ্চিম পাশের থিরা এলাকায়। আমি অবশ্য ঘুম থেকে জাগতে অনিচ্ছুকই ছিলাম। স্ত্রী টোপ ফেলল, দুপুরের খাওয়া খুব একটা জুত না হলেও সাঁঝের বেলায় কয়লায় ঝলসিত তাজা মাছ খাওয়ার বন্দোবস্ত একদম পাকা। চোখ কচলে গাড়িতে উঠলাম। লক্ষ করলাম, অদূরে পাহাড়ের বুক চিরে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে শঙ্খশুভ্র প্রাসাদের সারি। মাঝে মাঝে এদের মস্তকে আবার অনিন্দ্যসুন্দর নীল নীল গম্বুজ। সবার ওপরে অতি মনোহর বৃহৎ ঘণ্টা আর ক্রুশের যুগলবন্দি। পতপত করে উড়ছে গ্রিসের নীল-সাদা নিশান। কিছু স্থাপনা অবশ্য লালচে-মেটে রঙেও সেজেছে। তবে দৃষ্টিকটু ঠেকে না। অপূর্ব কিছু প্রাসাদের নগ্ন মর্মর মূর্তিকে জড়িয়ে আছে বাগানবিলাসের বর্ণিল ঝাড়। জানালায়, কার্নিশে আর ছাদে জড়ো হওয়া রাশি রাশি কপোতের মধুর গুঞ্জনও শুনছি। এদের রং আবার সফেদ আর নীলের মিশেল। উন্নত সব রেস্তোরাঁর দহলিজে নানান কিসিমের বনসাই। এদিকে পাথরের বেঞ্চিতে বসে সুরা পান করতে করতে সাগরের বুকে সূর্য ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখা নাকি পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।

একপর্যায়ে গাড়ি থামিয়ে আমরাও ত্রস্ত পায়ে জনস্রোতে শামিল হলাম। কত রংবেরঙের মানুষের আনাগোনা চারদিকে। তাদের গায়ে বিচিত্র সব পোশাক-আশাক। তবে চারধারে স্বল্পবসনা সুন্দরীদের ভূমিধস আধিক্য। এমনিতে কেউ কারও দিকে বিসদৃশভাবে ফিরেও চায় না। ক্বচিৎ চোখাচোখি হলে মৃদু হেসে সম্ভাষণ জানায়এই যা। মধুচন্দ্রিমায় আগত কপোত-কপোতীদের স্বর্গোদ্যান এই জনপদ। অনেকে যুগল দৃষ্টিকটুভাবে অবশ্য নিজেদের নিয়ে নিমগ্ন। লক্ষ করলাম, এক টলমলে যুবতীর গ্রীবার পাদদেশে লাল ছোপ ছোপ দাগ। এটা কি রোদেপোড়ার চিহ্ন নাকি কোন প্রেমিকপ্রবরের কামার্ত ভালোবাসার দাগঠিক বোঝা দুষ্কর। দৃষ্টি সরিয়ে দূরে তাকালাম। এখন সাগর কিছুটা অশান্ত হয়ে উঠেছে। মনে হলো, উন্মাতাল সাগরের ঊর্মিমালার সাথে বন্ধুর পথের পর্যটিকাদের দেহের জীবন্ত ঢেউের প্রতিযোগিতা লেগেছে। ভূমধ্যসাগরীয় তরূণীদের ওষ্ঠ আর কপোলের পাশ এমনটাই রঞ্জিত যে মনে হয় পাশের মরূদ্যানে ঝুলে থাকা ডালিমের রস ধার করে এরা রূপের বেসাতি মেলেছে। অপরাহ্ণের আবির এসব তরুণীর নীল-কালো রোদচশমায় পরিস্ফুট হয়ে দিক্‌ভ্রান্ত হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে দূরে কোথাও। সম্ভবত বিরহী আলোর রেখা কাঙ্ক্ষিত তরুণীর চোখের দুর্লভ নীলের দেখা না পেয়ে নীল সাগরে ডুবে আত্মহত্যাই করবে।

নিরিবিলি দেখে এক উলুঝুলু শিল্পী রংতুলি নিয়ে বৃহৎ ক্যানভাসে ছবি আঁকতে বসেছে। তার হাতে অর্ধপোড়া ধূসর চুরুট। ফেনায়িত মদের দীর্ঘ পেয়ালায় অলস অবহেলায় আয়েশ করে চুমুক দিচ্ছে এক পর্যটক। উৎসুক কেউ কেউ আবার এদিকে ভিড় জমিয়েছে। ওদিকে মাছ-মাংস ভাজার ভুর ভুর গন্ধ এসে নাসারন্ধ্রে লাগে। মাঝে মাঝে অবশ্য তরমুজের ফালি বা বিয়ারের ক্যান নিয়ে হ্যাংলার মতো দাঁড়িয়ে থাকা অপাঙ্‌ক্তেয় হকারের কিছুটা উৎপাতও আছে। পথের পাশে আবার শ্বেতপাথরে রঙিন চাদর বিছিয়ে খুদে খুদে ভাস্কর্যের পসরা সাজিয়েছে এক বাঙালি তরুণ। এগিয়ে গিয়ে বাতচিত করে জানতে পারলাম, মাদারীপুরের এক বর্ধিষ্ণু পরিবারের সন্তান সে। অনেক জমি-জিরাত বেচে দালালের মাধ্যমে গ্রিসে এসে হাজির হয়েছে। বিপৎসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে নাকি খেয়ে-না খেয়ে, সীমান্তপ্রহরীদের চোখ এড়িয়ে প্রথমে সে তুরস্কে এসেছে। বড় বিপণিবিতান থেকে পাইকারি দরে কিনে এনে নিজে বিষণ্নতার মূর্তি হয়ে সে এখন বেশি দামে বিক্রি করে সক্রেটিস, প্লেটো, থেমিসদের শ্বেতমূর্তি। বাড়িতে চোরাই পথে মাঝে মাঝে মায়ের জন্য টাকা পাঠায়। বেশ কিছু ইউরো সঞ্চয় হয়েছে, আর কিছু জমলেই ইতালিতে পাড়ি জমাবে। এবার দালাল পাকা কথা দিয়েছে। ছেলেটির কাছে এক সুবেশ ক্রেতা হাজির হলে আমি হাত নাড়িয়ে বিদায় হই।

আমার আনন্দটা অপরিমিত এই জন্য যে, পয়গাম্বর ইলিয়াসের মাকাম যে এই দ্বীপে, তা আমার জানা ছিল না। ট্যুরিস্ট পুস্তিকায় এরূপ কোনো ইশারাও নেই। প্রবেশদ্বারে প্রাগৈতিহাসিক কালের এক জীর্ণ লৌহকপাট। বৃহৎ রুদ্ধদ্বারের পাশ কাটিয়ে পকেটগেটে কয়েকটা টোকা দিলাম। কোনো সাড়া নেই। কিছুটা হতাশ হয়ে ভাবলাম, আগামীকাল গাইড নিয়ে আসব। আচমকা এক তরুণ যাজক এসে দরজা খুলে তাজিম করে সেলাম দিল। ধন্যবাদ জানিয়ে সামনে এগোলাম। এদিকে ধূপছায়ার আবেশে এক শীতল গোরস্থান। এর বুঝি বয়সের গাছপাথর নেই।

 সান্তরিনি দ্বীপের এক প্রান্তে নীল সমুদ্রের কোল ঘেঁষে ইলিয়াস নবির স্মৃতি-বিজড়িত থিরা এলাকা © ছবি: লেখক

থিরা ঘুরে অতিথিশালায় ফেরার পথ খুঁজি। সাগর সন্নিহিত পথ দিয়ে নামতে গিয়ে চোখে পড়ল এক ধূলিমাখা পথনির্দেশএখানে ঘুমিয়ে আছেন নবি ইলিয়াস থিরা। আগ্রহ নিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। সাগরের কোল ঘেঁষে মাথা উঁচু করে সান্ত্রীর মতো দাঁড়িয়ে আছে এক গুচ্ছ মৌন পর্বত। একজন জানাল, এদিকেই এ জনপদের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। একপর্যায়ে গাড়ি নিয়ে স্ত্রী রাজধানীতে ফিরে গেলেন। তার লক্ষ্য শপিং। নিঃসঙ্গ আমি খাড়া পথ বেয়ে হেঁটে হেঁটে ওপরের দিকে এগোলাম। যতই ওপরে উঠি নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হয়। বেশ শূন্যতা অনুভব করলাম। ক্লান্তি এসে ভর করেছে সর্বাঙ্গে। বেশ উঁচু বলে বাতাসের বেগও কমতির দিকে। এদিকটা অবশ্য একদম জনবিরল। বেশ কয়েকটা ভারবাহী গাধা অবলীলায় ওপরে উঠছে। কেমন যেন রুক্ষ পোড়া পোড়া গন্ধও কী পাচ্ছি? গা গুলিয়ে আসে। বোধ করি, এদিকটায় মৃতপ্রায় আগ্নেয়গিরিও আছে। লক্ষ করলাম, এই প্রস্তরময় পাহাড়ের শীর্ষে সফেদ বর্ণের বিশাল দুর্গ। উল্টো দিকের নীল তেপান্তরে দুলতে থাকা নৌযানকে এত উঁচু থেকে কাগজের ফুল বলে ভ্রম হয়। সূর্য বেশ ঢলে পড়েছে এখন। মহাভারতে বর্ণিত একলব্যের মতো কোনো খেয়ালি তীরন্দাজ বুঝি কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে রাশি রাশি সোনার তীর নিরন্তর ছুড়ে চলেছে সমুদ্রের বুকে, পাহাড়ের গায়ে। সোনালি আভায় চারপাশ যেন ছেয়ে আসছে।

এখন আমি যাচ্ছি এক সোনার মানুষের পাদদেশেনবি ইলিয়াসের আশ্রমে। আমার আনন্দটা অপরিমিত এই জন্য যে, পয়গাম্বর ইলিয়াসের মাকাম যে এই দ্বীপে, তা আমার জানা ছিল না। ট্যুরিস্ট পুস্তিকায় এরূপ কোনো ইশারাও নেই। প্রবেশদ্বারে প্রাগৈতিহাসিক কালের এক জীর্ণ লৌহকপাট। বৃহৎ রুদ্ধদ্বারের পাশ কাটিয়ে পকেটগেটে কয়েকটা টোকা দিলাম। কোনো সাড়া নেই। কিছুটা হতাশ হয়ে ভাবলাম, আগামীকাল গাইড নিয়ে আসব। আচমকা এক তরুণ যাজক এসে দরজা খুলে তাজিম করে সেলাম দিল। ধন্যবাদ জানিয়ে সামনে এগোলাম। এদিকে ধূপছায়ার আবেশে এক শীতল গোরস্থান। এর বুঝি বয়সের গাছপাথর নেই। পাথরের গর্তে থোকা থোকা সুগন্ধি লোবান। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু ঝোপঝাড়ের চিহ্ন। অদূরের বাগানে লাল, নীল আর সাদার মিশেলে ফুলের সমারোহ। পাশেই সবুজ সবজির ঝোপ। আঙুরলতায় মুকুল এসেছে। কাঁটাগাছের পাশে আয়েশ করে শুয়ে আছে জ্বলজ্বলে চোখের বেশ কয়েকটা আদুরে বিড়াল।

কুঞ্জবনরূপী এই নির্জন স্থানে বেঞ্চিতে ধ্যানমগ্ন একদল মানুষ। খাদেমরূপী ছেলেটা ঠোঁটে তর্জনী এঁটে নীরবতার ইঙ্গিত করল। আসলেই এখানে নির্জনতা বাঙ্‌ময়। চোখ বন্ধ করে পদ্মাসনে বসে ধ্যানমগ্ন হলাম। আমি পাপীতাপী মানুষ। তবু কেন যেন মনে হলো, এই জনপদের আলাদা একটা ফ্রিকোয়েন্সি আছে। মনে মনে আচমকাই বলে উঠলাম, হে ইলিয়াস নবী, আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। একটু পরে চোখ মেলে দেখি শেষ বিকেলের অরুণাভ শিখা যেন অনিঃশেষ মায়ায় আমায় জড়িয়ে ধরেছে। উঠে দাঁড়ালাম। কুণ্ঠিত বুকে কদম বাড়ালাম সামনের দিকে। ঘোর কৃষ্ণবরণ আলখাল্লা আর দীর্ঘ টুপিতে শ্বেত শ্মশ্রূময় দেবদ্যুতরূপ পাদরি সরদার যেন ঝলমল করছেন। কিন্তু তার ম্রিয়মাণ নীলাভ চোখে যেন জগতের তাবৎ বৈরাগ্য জটলা বেঁধেছে।

শেষে হেসে গেলাসে চুমুক দিয়ে বললেন, এখানকার দ্রাক্ষারস বেশ মশহুর। তবে আমি শুদ্ধাচারী বলে এখানে জিরের পানি দিয়েছে। প্রফেটের মনসট্রারির সওগাত, খেয়ে দেখুন। আমি এক চিমটে ভাঙা বাদাম তুলে মুখে পুরলাম। তিনি বললেন, এই দ্বীপের ঠিক উল্টো দিকে তুরস্কের জনবিরল পাহাড়ে আসহাবে কাহাফের গুহা রয়েছে। সুযোগ পেলে একবার ঘুরে আসুন। আমি বললাম, যদি হায়াতে কুলায় আর সুযোগ আসে।

সান্তরিনি দ্বীপের ব্যস্ততম ফিরা এলাকা © ছবি: লেখক

পাদরি সাহেবকে বললাম, বাংলাদেশ থেকে ইলিয়াস নবির আশ্রম দেখতে এসেছি। তিনি আমাদের কোরআনে বর্ণিত এক মশহুর পয়গাম্বর। তিনি বললেন, তৌরাত, বাইবেল আর কোরআনে এই প্রফেটের কথা আছে। তিনি হাত উঁচু করে ভারী কণ্ঠে বললেন, ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন। তাঁর তর্জনীর বৈদূর্যমণির আংটির সাথে কবজিতে আঁটা নীল পাথরের দীর্ঘ জপমালা যেন মিতালি পাতিয়েছে। আমি বললাম, আপনি দীর্ঘ তপস্যা করেছেন, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। তিনি হেসে বললেন, এই সময়টায় ইউরোপ আমেরিকার মানুষজন বিনোদিত হতে অবকাশে বের হয়। গ্রিসের সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য, সুনীল জলধি, উন্নত ভোজ, নানান কিসিমের দ্রাক্ষারস আর ভাস্কর্যরূপী মেয়েদের আকর্ষণে পাখির ঝাঁকের মতো হাজির হয় জাত-বেজাতের পর্যটকের দল। এসব ভোগবাদী আয়োজনে কি পুরো সঞ্জীবিত হওয়া যায়? কিন্তু এই মাকামে যারা আসে, তারা প্রভুর বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্তই। সে হিসেবে আপনি ভাগ্যবান।

একপর্যায়ে প্রশ্ন করলেন, আপনার পেশা কী? আমি বললাম, আইনশ্রমিক। তিনি রুপা-বাঁধানো দাঁতে হেসে জানালেন, তিনিও আইন-স্নাতক। এই যাজকপ্রবর আইনের বর্ণাঢ্য পেশায় যোগদান না করে একসময় জাহাজডুবির কবলে পড়ে শপথ করে অর্থোডক্স খ্রিস্টীয় মতবাদ প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। আমি তার সাথে একাত্ম হবার ইরাদায় মোসাহেবের মতো মোলায়েম স্বরে যোগ করলাম, আসলেই তো, আইনজীবী পেশাটা কেমন যেন! তিনি বললেন, একজন চরম সৎ আইনজীবীও তো খুনি, মাদক কারবারি বা গুন্ডা-পান্ডার পক্ষে আদালতে রীতিমতো যুদ্ধ করেন। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিলাম, আসলে এটা একটা পদ্ধতিগত কৌশলমাত্র। তিনি সরাসরি আমাকে প্রশ্ন করলেন, একজন নিরীহ আসামিকে সাজা দিতে একজন হাকিম হিসেবে আপনার কেমন লাগে? আমি বললাম, অনুভূতিটা অম্লমধুর; আর সাজা না দিলে সমাজের শৃঙ্খলাও যে ভেঙে পড়বে, আর ভিকটিমের কষ্টের বিষয়টিও ভাবতে হয়। তিনি সম্মতি জানিয়ে যোগ করলেন, অনেক অপরাধীর জন্ম হয় সমাজের মানুষের দলগত ব্যর্থতায়। তাই যতক্ষণ না শোষণহীন সমাজে সবার সমরূপী বিকাশের সুযোগ হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রযন্ত্রকে তাই শাস্তি প্রদানে কিছুটা ধীরলয়ে চলবার কথা। আমার জিজ্ঞাসু চোখের প্রতি দৃকপাত করে তিনি হেসে বললেন, আমার নয়, এটা আমার স্বদেশি মার্কসপন্থীদের উক্তি। উক্তি শেষে তিনি বললেন, দেখুন, নবী মোহাম্মদ যে শেষ বিচারে উম্মতের জন্য প্রভুর কাছে সুপারিশ করবেন বলে মুসলিমরা বিশ্বাস করে, তা তো একধরনের মহান ওকালতিই, তাই নয় কি?

আমি কিছু বলবার আগেই এক ছোকরা খাদেম এসে দুই পেয়ালা পানীয় আর কাচের বাটিতে বাদাম-খেজুরের জলখাবার রেখে গেল। আমি সশঙ্ক চোখে তাকালে তিনি শোনালেন গালিবের উক্তি: পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মিথ্যা বলা হয় ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে, যেটা হয় আদালতে; আর সবচেয়ে বেশি সত্য কথন হয় মদ ছুঁয়ে, যেটা হয় পানশালায়। আমি তার কথার গভীরতায় তন্ময় হয়ে গেলাম। শেষে হেসে গেলাসে চুমুক দিয়ে বললেন, এখানকার দ্রাক্ষারস বেশ মশহুর। তবে আমি শুদ্ধাচারী বলে এখানে জিরের পানি দিয়েছে। প্রফেটের মনসট্রারির সওগাত, খেয়ে দেখুন। আমি এক চিমটে ভাঙা বাদাম তুলে মুখে পুরলাম। তিনি বললেন, এই দ্বীপের ঠিক উল্টো দিকে তুরস্কের জনবিরল পাহাড়ে আসহাবে কাহাফের গুহা রয়েছে। সুযোগ পেলে একবার ঘুরে আসুন। আমি বললাম, যদি হায়াতে কুলায় আর সুযোগ আসে।

শেষে তিনি শোনালেন এক বিচারিক উপকথা। রাজার এক খাদেমকে রাজপ্রাসাদে তস্করবৃত্তির অভিযোগে রাজদরবারে আনা হলো। রাজা রেগে আগুন। এক শিকারে গিয়ে তাকে রাখালির কাজ ছাড়িয়ে এনে রাজার খাসকামরায় উচ্চ পারিতোষিকে নিয়োগ দিয়েছেনএখন এই তার প্রতিদান? আসামি অনেক দিন রাজার সেবা করেছে, তাই রাজা তাকে একটা সুযোগ দিতে চাইলেন। দোষী খাদেমকে বললেন, আগামীকাল তুমি যদি আমার কোতোয়ালের সাথে মল্লযুদ্ধে বিজয়ী হও, তোমার সাজা মওকুফ করে দেওয়া হবে, কিন্তু মল্লযুদ্ধে হারলেই গর্দান। কয়েদখানায় বসে নির্ঘুম চোখে অপরাধী ভাবে, এই জীবনে রাখালি করা ছাড়া কিছুই তো করিনি। আর সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুঠাম কোতোয়াল ভাবে, এই পুঁচকে রাখালকে মল্লযুদ্ধে হারানো তো মামুলি ব্যাপার। পরদিন সকালে রাজার উপস্থিতিতে উন্মুক্ত স্থানে মল্লযুদ্ধ শুরু হলো। সবাই অবাক হয়ে লক্ষ করল, দীর্ঘদেহী কোতোয়াল আজ শীর্ণ দেহের রাখালের সাথে মোটেই সুবিধে করতে পারছে না। সবাই ভেবেছিল, কোতোয়াল মজা করছে। একসময় কোতোয়ালের পরাজয় একদম সুনিশ্চিত হয়ে উঠল। তখন রাজার আদেশে এই মল্লযুদ্ধ বন্ধ ঘোষণা করে আসামিকে মুক্ত করে উপহার দেওয়া হলো। পার্শ্বচরদের দিকে তাকিয়ে রাজা বললেন, আমার কোতোয়াল তো এই মল্লযুদ্ধকে নিয়েছিল নিছক খেলারূপে আর আসামি একে নিয়েছিল তার জীবন-মরণের পুলসিরাতরূপে। সে জন্য কোতোয়ালের বিপরীতে সে সর্বস্ব বাজি রেখে মরণপণ লড়েছে।

সাঁঝ বুঝি হয়েই এলো। পাথরের পিলসুজে সারি সারি প্রদীপ জ্বলে উঠেছে। গির্জার ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠলে আমি বিদায় চাইলাম। পুণ্য উদ্দেশ্যে ব্যবহারের উপদেশ দিয়ে যাজক মহোদয় হাতে ধরিয়ে দিলেন গুহাচারি আসহাবে কাহাফের নামের তালিকা। অবশ্য গাড়ির জন্য অপেক্ষার অমনোযোগিতায় বাতাসের দমকায় সেই কাগজ নিচের সমুদ্রে গিয়ে পড়ল।