মহামারির আকালেও চলচ্চিত্রের বিনির্মাণ
মহামারির মাঝেও জাপানের চলচ্চিত্রাঙ্গনে কী এক অভূতপূর্ব ঘটনাই না ঘটে চলেছে! আর এর কেন্দ্রে রয়েছে ‘কিমেতসু না ইয়াইবা’ বা ‘ডিমোন স্লেয়ার’ নামক একটি এনিমেশন চলচ্চিত্র। বক্স অফিসের অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে মাস কয়েক ধরেই এই ছবি প্রেক্ষাগৃহ মাতিয়ে চলেছে। মিলনায়তনে গিয়ে এটি উপভোগ করেছেন প্রায় আড়াই কোটির মত দর্শক। শত বছরের পুরনো প্রেক্ষাপটে, হন্তারক দানবের বিরুদ্ধে লড়াইরত স্বজন হারানো এক বালককে ঘিরে চলচ্চিত্রের কাহিনি আবর্তিত হয়। জাপানের অনেকেই বলছেন, এই চলচ্চিত্র যেন বর্তমান দুঃসময়েরই এক প্রতীকী প্রতিফলন। অদৃশ্য শত্রু মানব প্রকৃতিকে যে বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, সেই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকে থাকার অনুপ্রেরণা যেন মানুষ পেয়ে যাচ্ছে এক এনিমেটেড বালকের দানব বধের এই চলচ্চিত্রায়ণের ভেতর দিয়ে। শুধুমাত্র ‘ডিমোন স্লেয়ার’ই নয়, চলচ্চিত্রের অনুরূপ সৃজনশীল শক্তি নিয়ে করোনার করাল থাবার বিপরীতে এক বৈশ্বিক আসরও সম্প্রতি বসেছিল জাপানের রাজধানী টোকিওতে। ৩৩ তম টোকিও চলচ্চিত্র উৎসব বা টিফের [TIFF] আয়োজন চলে ১০ দিন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠানের আদলে অবশ্য আয়োজকদের অনিচ্ছাকৃত কিছু পরিবর্তন আনতে হয়। মহামারির কালে সারা বিশ্বের চলচ্চিত্র উৎসবগুলো যেখানে বাতিল বা অনলাইনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, টিফ সেখানে ভেন্যু এবং অনলাইন, দুটোর মিশেলে অনেকটা হাইব্রিড আদলে উৎসবের আয়োজন করে।
উৎসবের আকর্ষণ ছিল ‘টোকিও প্রিমিয়ার ২০২০’, যা গতানুগতিক ‘প্রতিযোগিতা বিভাগ’ থেকে কিছুটা ভিন্ন। মূলত এর মাধ্যমে সচরাচর আয়োজিত প্রতিযোগিতা বিভাগ, এশিয়ান ফিউচার এবং জাপানি সিনেমা স্প্লাশ বিভাগকে একত্র করে একটি অভিন্ন বিভাগে পরিণত করা হয়। ১০৭ টি দেশ ও অঞ্চলের প্রায় সাড়ে ১৩ শ চলচ্চিত্র থেকে বাছাইকৃত মোট ৩২ টি ছবি এতে প্রদর্শিত হয়। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের অংশগ্রহণ এতে থাকলেও বরাবরের মতই বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধিত্ব এতে দেখা যায়নি। ১৩ টি এশীয় ছবির বিষয়বস্তু ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সংঘাত থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বৈষম্যকে পরিস্ফুট করা সব চলচ্চিত্রেরই নাটকীয় গল্প সংশ্লিষ্ট সমাজের প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরে। যেমন: চীনের নতুন নারী পরিচালক সেন ইউ’র ‘দি ওল্ড টাউন গার্লস’ হচ্ছে একটি প্রত্যন্ত শিল্পনগরীতে মা-মেয়ের সম্পর্ককে ঘিরে উত্তেজনায় ভরা ক্রাইম ড্রামা। অন্যদিকে ইরানি পরিচালক ইদা পানাহানদেহ’র ‘তিতি’ আবর্তিত হয় হারানো বৈজ্ঞানিক সূত্র খুঁজতে গিয়ে এক অভিজাত বিজ্ঞানীর সাথে একজন দরিদ্র রোমানি পরিচারিকার অদ্ভুত সংযোগ ঘটার কাহিনী নিয়ে। ভারতের মাঙ্গেশ জোশি পরিচালিত ‘এশেজ অন এ রোড ট্রিপ’-এ আছে হাসিকান্নার সংমিশ্রণে এক যৌথ পরিবারের নানাদিক। এবারের উদ্বোধনী চলচ্চিত্র ছিল মাসাহারু তাকে পরিচালিত ‘আন্ডারডগ’। জাপানের ফেদারওয়েইট ডিভিশনের র্যাঙ্কে একসময় এক নম্বরে থাকা এবং পরবর্তীতে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের ইতি ঘটা আকিরা নামক এক মুষ্টিযোদ্ধা এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। তার হারানো গৌরব ফিরে পাওয়া নিয়ে পরিবার, পারিপার্শ্বিকতা এবং অন্যান্য বক্সিং খেলোয়াড়দের সাথে দ্বন্দ্ব ও সৌহার্দ্যের নানা নাটকীয় উপস্থাপনায় সাজানো এই চলচ্চিত্র।
উৎসবের আরেক উল্লেখযোগ্য নিয়মিত আয়োজন ছিল ‘জাপান নাউ: ডিরেক্টর ইন ফোকাস’ বিভাগ। আর এতে প্রদর্শিত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক কোজি ফুকাদার ‘হসপিতালিটে’, ‘হারমোনিয়াম’ এবং ‘এ গার্ল মিসিং’-এর মত বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্রগুলো যেন সমকালীন জাপানেরই গল্প। ‘শপ লিফটারস’ চলচ্চিত্রের জন্য এবারের টিফে আরও যুক্ত হয়েছিলেন কান’এ পাম ডি’ওর পুরস্কার জয়ী বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার হিরোকাজু কোরে-ইদা। মূলত তাঁর উদ্যোগে জাপান ফাউন্ডেশন এশিয়া কেন্দ্র এবং টিফ যৌথভাবে আয়োজন করে ‘এশিয়া লাউঞ্জ’ অনলাইন কথোপকথন সিরিজ। এতে অন্য অনেকের মধ্যে থাইল্যান্ডের স্বনামধন্য চলচ্চিত্রকার এপিচাপং উইরাসেতাকুল, ইন্দোনেশিয়ার মৌলী সুরিয়া, চীনের জিয়া যাঙ-কে, কম্বোডিয়ার রিথি পান এবং জাপানের কিংবদন্তী নিউ ওয়েভ চলচ্চিত্রকার ইয়োশিদা ইয়োশিশিগে অংশ নেন।
১০ দিনের এই আয়োজনে সরাসরি স্ক্রিনিং, মঞ্চে আরোহণ, প্রশ্নোত্তর অধিবেশনের পাশাপাশি চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট এ ধরনের নানা অনলাইন সিম্পোজিয়াম এবং ওয়েবিনারও অনুষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ বিধিনিষেধের কারণে এবার টিফ এর দর্শকরাই বিচারকের ভূমিকা নেন এবং দর্শক পুরস্কার বা গভর্নর অফ টোকিও এওয়ার্ডের বিজয়ীর নাম নির্বাচন করেন। আর ‘টোকিও প্রিমিয়ার ২০২০’ বিভাগের ৩২টি চলচ্চিত্র থেকে তাদের বেছে নেয়া সেরা ছবি হল জাপানি পরিচালক আকিকো ওহকুর রোম্যান্টিক কমেডি ‘হোল্ড মি ব্যাক’। নিক্কাতসু প্রযোজিত এবং রিসা ওয়াতাইয়ার উপন্যাস নির্ভর এই রোম্যান্টিক-কমেডি ধাঁচের চলচ্চিত্রে মূলত আধুনিক টোকিওতে একজন কর্মজীবী নারীর অন্তর্গত লড়াইকেই তুলে ধরা হয়েছে। ‘নন’ নামে পরিচিত তারকা অভিনেত্রী রেনা নোউনেন অভিনীত চলচ্চিত্রটির মূল চরিত্র হল বহু বছর ধরে একাকী জীবনে অভ্যস্ত ৩১ বছর বয়সী এক তরুণী মিৎসুকো। অন্য কারো সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ার ব্যাপারে সদা আতঙ্কগ্রস্ত মিৎসুকো তার মাথায় তৈরি করে নেয় কাল্পনিক বন্ধু ‘এ’ [ইংরেজি Answer-এর সংক্ষিপ্ত রূপ]। যার ওপর সবসময় নির্ভর করে সে। অদৃশ্য এই বন্ধু যেন আকাঙ্ক্ষা ও ভীতিসহ তার অন্তর্গত নানা বোধ প্রকাশের উপায়। আর এরই মধ্যে কেনতো হায়াশি নামে এক তরুণের সাথে সাক্ষাৎ হলে প্রণয়ী সম্পর্কের ব্যাপারে তার এতদিন ধরে নীরব থাকা উৎসাহ মাথাচাড়া দেয়। ফলে মিৎসুকো নিজের ভেতর আচমকা জেগে ওঠা আকাঙ্ক্ষা এবং এতদিনকার নিরঞ্ঝাট জীবনের ভেতর এক অন্তর্গত লড়াইয়ের সম্মুখীন হয়। চলচ্চিত্রটিতে মূলত জাপানের অনেক তরুণের নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নেয়ার ক্রমবর্ধমান সামাজিক বাস্তবতাকে হালকাভাবে উপস্থাপন করার কারণে এটি দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।
শেষ নাগাদ ‘হোল্ড মি ব্যাক’ পুরস্কার পেলেও, টোকিও প্রিমিয়ার কিন্তু সাজানো হয়েছিল নানা দেশের নানা ঘরানার চলচ্চিত্র দিয়ে। যার মধ্যে রয়েছে, এক ডেলিভারি ড্রাইভারের প্রাত্যহিক জীবনে বেঁচে থাকার নিদারুণ বাস্তবতা নিয়ে ম্যাট চ্যাম্বারস পরিচালিত ‘দি বাইক থিফ’, পারিবারিক শাসন, ট্রাজেডি এবং সম্পর্কের পুনর্নির্মাণ নিয়ে তুর্কি পরিচালক সেম ওযেইর অপেক্ষাকৃত স্বল্প সংলাপের চলচ্চিত্র ‘ফরগিভনেস’ এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এক বুর্জোয়া গৃহবধূর স্বাধীনচেতা জীবন নিয়ে মারি বেররোসো পরিচালিত পর্তুগালের ছবি ‘মোরাল অর্ডার’। তবে উৎসবের চলচ্চিত্রগুলোর গল্পের গাঁথুনি এবং ফর্ম ছিল একেবারেই আলাদা। দুটি চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গ অবশ্য এখানে বলা যায়, যাদের মধ্যে সীমিত পরিসরে হলেও বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে কিছুটা মিল আছে। মূলত প্রযুক্তি, আত্মপরিচয়, এবং স্মৃতি-বিস্মৃতির দ্বন্দ্বকে ঘিরেই ভিন্ন কাঠামোতে এগুলো তৈরি হয়েছে। এসম্পর্কে আরেকটু গভীর ধারণা দিতে চলচ্চিত্রগুলো নিয়ে স্বল্পপরিসরে আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক।
কানাডীয় চলচ্চিত্র পসেসর । সৌজন্যে 2020 TIFF
পসেসর: স্মৃতির নিয়ন্ত্রণ বা বোধের যান্ত্রিকতা
কানাডার টরোন্টো ভিত্তিক লেখক ও পরিচালক ব্র্যান্ডন ক্রোনেনবার্গের দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘পসেসর’ একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি। এর মধ্যে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক ভৌতিক চলচ্চিত্রের আদল। তার পিতা ডেভিড ক্রোনেনবার্গের মতই সহিংসতা এই চলচ্চিত্রের মূল উপজীব্য। তবে ব্র্যান্ডন এখানে একটি নিজস্ব চলচ্চিত্র ভাষা তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কাহিনি আবর্তিত হয়েছে আমাদের বাস্তব পৃথিবীর সমান্তরাল এক বিশ্বে, যেখানে অতি উচ্চ-প্রযুক্তি ব্যবহার করে পেশাদার খুনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব রয়েছে। একজন হত্যাকারী এবং দূরবর্তী নিয়ন্ত্রণের সহযোগিতায় খুনি হিসেবে ব্যবহারের জন্য তারই অপহরণ করা এক ব্যক্তির মধ্যে চলা নিরন্তর টানটান উত্তেজনাপূর্ণ লড়াই, এই সাইফাই থ্রিলারের মূল প্রেক্ষাপট।
পরিচালক ক্রোনেনবার্গের মনে আচমকা হানা দেয়া আত্মপরিচয়ের এক দ্বান্দ্বিক অনুভূতি থেকেই ‘পসেসর’-এর মূল ধারণার উদ্ভব। তাঁর ভাষ্যানুযায়ী, আচমকা একদিন তার কাছে নিজের সত্তাকে কেমন যেন অচেনা ঠেকে, যেন অপর কারো অস্তিত্ব মিশে আছে তার দেহ বা মস্তিষ্কে। এই বোধ তাকে তৎক্ষণাৎ নিজের ব্যক্তিত্বের পুনর্নির্মাণে প্ররোচিত করে। আর এই অন্তর্দ্বন্দ্বের শৈল্পিক উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি নির্মাণ করেন বৈজ্ঞানিক থ্রিলারের এক অদ্ভুত জগত, যেখানে আত্মপরিচয় এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার মারাত্মক লঙ্ঘনের মত বিষয়গুলো সামনে চলে আসে।
চলচ্চিত্রে উপস্থাপিত বিশ্বে তাসিয়া ভস [আন্দ্রিয়া রাইসবোরো] হলেন একজন খুনি যিনি নিজের লক্ষ্যে আঘাত হানার জন্য আরেকজনের দেহের নিয়ন্ত্রণ নেন। তাসিয়া তার কোম্পানির সহায়তায় হোস্টের মস্তিষ্কে একটি ইমপ্ল্যান্ট স্থাপন করে। একটি বিশেষ যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে নিজের চৈতন্যকে তাদের মনের মধ্যে প্রবেশ করাতে সমর্থ হয়। আর প্রতিটি কাজের শেষে হোস্ট বা ব্যবহৃত দেহের মালিককে আত্মহত্যায় বাধ্য করে তাসিয়ার চৈতন্য আবার তার নিজের দেহে ফিরে আসে। তবে এর একটি সরাসরি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। কাজের প্রয়োজনে অন্য ব্যক্তির অনুকরণে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হয় বলে তাসিয়াকে আত্মপরিচয় থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে হয়। পাশাপাশি পরিবারের কাছেও নিজের পরিচিত সত্তা বা ব্যক্তিত্বকে উপস্থাপনের অভিনয় করতে হয়। এমনকি পুত্র বা স্বামীর সাথে একান্ত সময় কাটানোর সময়ও সহিংসতার চিন্তা বা ইমেজ তাকে তাড়া করে।
তবে প্রতিনিয়ত এরকম মানসিক টানাপড়েন সত্ত্বেও, উর্ধ্বতন কর্তার [জেনিফার জেসন লেই] অনুরোধে ধনী এক নির্বাহী এবং তার কন্যাকে হত্যার একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ তাসিয়া হাতে নেয়। আর এক্ষেত্রে কন্যার প্রেমিক কলিন টেইটের [ক্রিস্টোফার এবোট] দেহের উপর সে ভর করে। তবে এই অভিযানে কন্যার মৃত্যু হলেও পিতা বেঁচে যান। অন্যদিকে তাসিয়ার ইচ্ছানুযায়ী টেইট নিজের দিকে গুলি না ছুঁড়ে বরং মাথায় ছুরিকাঘাত করে ইমপ্ল্যান্টটি নষ্ট করে দেয়। ফলে টেইটের দেহ ত্যাগ করা বা তার ইচ্ছাশক্তিকে অতিক্রম করতে অপারগ হয়ে পড়ে তাসিয়া। অন্যদিকে টেইট নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর বুঝতে পারে না যে, ঠিক কী কারণে সে তার বান্ধবীকে হত্যা করেছে বা কেন সে অন্য কারো [তাসিয়া] জীবনের টুকরো স্মৃতি মনে করতে পারছে। শেষ পর্যন্ত নানা নাটকীয়তা শেষে তাসিয়া নিজেকে টেইটের দেহ থেকে বের করে আনতে সমর্থ হয়। ততদিনে পরিবারের সাথে মানসিকভাবে সে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভার্চ্যুয়াল অস্তিত্ব যে বাস্তব জীবনের উপর কতটা সর্বগ্রাসী প্রভাব ফেলতে পারে, তাসিয়ার নিজের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা বা আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলা, তারই জ্বলজ্বলে প্রমাণ।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির আদলে নির্মিত হলেও এই চলচ্চিত্রের একটি যৌক্তিক সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। এতে তুলে ধরা হাইটেক প্রযুক্তি সংবলিত নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম যেন সমকালীন বিশ্বে নেপথ্যে ঘটে চলা ঘটনাবলিরই অবিকল প্রতিচ্ছবি। অন্তহীন ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উপাত্ত-সংরক্ষণ করা এপল কিংবা গুগলের মত কয়েকটি বৃহৎ তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি যেখানে মূল ক্রীড়নক। একইভাবে প্রযুক্তিগত কারসাজির মাধ্যমে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গের বা আড়ি পাতার যে বিস্ফোরক তথ্য এডওয়ার্ড স্লোডেন কিছুকাল আগে উন্মোচন করেছিলেন, তার একটি প্রভাবও এই চিত্রনাট্যের আদলে স্পষ্ট। যদিও শেষ পর্যন্ত এখানে পরিচালকের মনোযোগের কেন্দ্র হচ্ছে আত্মপরিচয়ের বিনির্মাণ, তবে সেটি অবশ্যই প্রযুক্তির কল্যাণে জীবনের সমস্ত তথ্য অন্যের হস্তগত হওয়ায় সৃষ্ট মনস্তাত্ত্বিক শূন্যতার প্রেক্ষাপট থেকেই উদ্ভূত। অন্যদিকে এটি শেষ পর্যন্ত আত্মপরিচয়ের সেই চিরায়ত দার্শনিক প্রশ্নকেই তুলে ধরে, গ্রিক দর্শনিক থেকে সমকালীন দার্শনিকরা যার উত্তর নিয়ে এখনও দ্বিধাবিভক্ত—‘আমি কে?’ বা ‘আমি কি আমার দৈহিক অস্তিত্ব, আমার চিন্তা, আমার কাজ নাকি আমার ভাষা?’ দুজন পুরোপুরি ভিন্ন অবস্থানে থেকেও তাসিয়া এবং টেইটের একে অপরের চিন্তা আর স্মৃতির ভেতরে ঢুকে পড়া বা নিয়ন্ত্রণ করা দর্শকদের এই জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতেই প্ররোচিত করে।
নির্মাণের ক্ষেত্রে ক্রোনেনবার্গ নিজের ভিশন বা দর্শনকে প্রকাশের জন্য ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের ব্যবহার অগ্রাহ্য করার কারণে সব ধরনের স্পেশাল ইফেক্ট এবং রঙের বৈচিত্র্য সরাসরি চলচ্চিত্রের সেটেই তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ পোস্ট প্রোডাকশনের সময় কম্পিউটার গ্রাফিক্সের উপর নির্ভর না করে বিশেষ ইফেক্টগুলো শুটিং চলাকালে সিনেমাটোগ্রাফার করিম হুসেইন ক্যামেরার মধ্যেই ধারণ করেছেন। যেমন: দুটি দেহ একীভূত হওয়ার দৃশ্য চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগের পরিচালক জর্জ মিলিয়েরের ‘জার্নি টু দি মুন’ বা ‘দি কনজুরার’-এর ক্যামেরা কৌশল বা চাতুরীর কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণের দৌরাত্ম্য এবং এর নেতিবাচক প্রভাব দেখাতে গিয়ে সহিংসতার দৃশ্যায়নকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা প্রশ্নসাপেক্ষ। এখানে পিতার গ্রাফিকাল সহিংসতার পথ পুরোটা অনুসরণ না করে ব্র্যান্ডন ক্রোনেনবার্গ অন্য পথে হাঁটলে হয়ত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর মাঝে নতুন মিথস্ক্রিয়া ঘটতে পারত। পরিশেষে বলা যায়, ‘পসেসর’ দর্শকদের একটি অংশকে টানটান উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে কাহিনি এগিয়ে যাওয়ার আনন্দ দিলেও সামগ্রিক চলচ্চিত্র জ্ঞান থাকা দর্শক বা বিশেষজ্ঞদের জন্য পুরোটা তৃপ্তিকর নাও হতে পারে। চলচ্চিত্র গুরু পিটার ওয়াটকিন্স যেমন বলেছেন,পর্দায় দেখানো সহিংসতার সরাসরি দৃশ্যগুলো বাস্তব জগতেও সহিংসতা উস্কে দেয়ার সম্ভাবনা বা প্রেক্ষাপট তৈরি করে। তাই বৃহৎ কর্পোরেশন বা রাষ্ট্রীয় সহিংসতার শৈল্পিক জবাব কিছুটা ভিন্নরকম সৃষ্টিশীলতা বা প্রতীকী চলচ্চিত্র ভাষা দিয়েও দেয়া যেতে পারে এবং এটি দর্শকের মনোযোগে বড় কোন ব্যাঘাত না ঘটানোরই কথা। আর সে পথে হাঁটলে এই চলচ্চিত্রের গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপ্তি আরও বিস্তৃত হতে পারত।
গ্রিক চলচ্চিত্র এপলস © Boo Productions and Lava Films.
এপলস: হারানো স্মৃতির নব বিনির্মাণ
গ্রিস, পোলান্ড ও স্লোভেনিয়ার যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত তরুণ গ্রিক চলচ্চিত্রকার ক্রিস্তোস নিকুর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র ‘এপল’ হচ্ছে স্মৃতি-বিস্মৃতির জগতে দোদুল্যমান এক ব্যক্তির সীমাবদ্ধ জীবনের গল্প। বিশ্বব্যাপী এক মহামারীর মাঝে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি [আরিস সার্ভেতালিস] পুরোপুরি স্মৃতিভ্রষ্ট অবস্থায় নিজেকে খুঁজে পান হাসপাতালে। এরপর তিনি অন্তর্ভুক্ত হন চিকিৎসক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পরিচালনায় স্মৃতি পুনরুদ্ধারের এক কর্মসূচিতে। তবে সেখানে খুব একটা সুবিধা না হওয়ায়, এক নারী চিকিৎসক [আনা কালাইতযিদু] তাকে অন্য এক অভিনব উদ্যোগে অন্তর্ভুক্ত করেন। যেখানে স্বজনদের কোনো সূত্র খুঁজে না পাওয়া রোগীদের নতুন পরিচয় তৈরির জন্য বিশেষ কিছু কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। সেখানে নিজস্ব এক বাড়ির বরাদ্দ তার মেলে। তারপর, দিনের পর দিন স্মৃতি পুনরুদ্ধার কর্মসূচির নতুন স্বাভাবিকের আওতায় একটি ক্যাসেট টেপে রেকর্ড করা নির্দেশনা তিনি অনুসরণ করে যান। একই কর্মসূচির অধীনে থাকা স্মৃতিভ্রষ্ট আরেক নারীর [সোফিয়া ইয়েওরগোভাসিলি] সাথে সেখানে তার পরিচয় হয়, যা শেষ পর্যন্ত প্রেমের সম্পর্কের দিকে গড়ায়।
ট্রাজেডি এবং কমেডির সংমিশ্রণে স্মৃতি নির্ভর কয়েক দশক পুরনো একটি অপেক্ষাকৃত কম যন্ত্রাশ্রয়ী সময়ের কথা তুলে ধরেন তিনি। এটি মূলত বর্তমান সময়ের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং নিত্য প্রযুক্তির মাঝে স্মৃতিকে হারিয়ে ফেলার এক এলিগরিক্যাল উপস্থাপনা। এতে পুরনো ঘরানার গাড়ি, ক্যামেরা, টেপরেকর্ডার বা দালানের অবয়ব, সবকিছু মিলে ভিন্ন এক জগতকে উপস্থাপন করা হয়, যা অতীতের কোন এক সময় বা শহরের প্রতিনিধিত্ব করে। উৎসবের আলোচনায় পরিচালক বলেন, নিজের জীবনের স্মৃতির পাশাপাশি নানা আবহ তৈরি করা স্মৃতি তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন এই চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়ে। প্রযুক্তির এই যুগে আমাদের স্মৃতি যেন নানা ডিভাইসে সীমাবদ্ধ, তাই তিনি দর্শকদের একটি দূরের জগতে নিয়ে যেতে চেয়েছেন, যেখানে পৃথিবী তখনও এনালগ ছিল। আর পুরো আয়োজনের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে, বর্তমান আর ভবিষ্যতের পথ চলার পাথেয় হিসেবে নিজেদের অমূল্য স্মৃতি থেকে শিক্ষা নেয়া।
মূল চরিত্রের অভিনেতা আরিস গ্রিসের বিখ্যাত অভিনেতা এবং নৃত্যবিদ। যিনি সাধারণত মিনিমালিস্ট উপায়ে শারীরিক এবং মানসিক অভিব্যক্তি প্রকাশ করে থাকেন। তার ঋজু দেহের অভিনয় খানিকটা ফরাসি অভিনেতা জাক তাতির কথাও মনে করিয়ে দেয়। চলচ্চিত্রে দেখানো হয়, কোনো ধরনের অভিব্যক্তি ছাড়াই তিনি সারাদিন একটির পর একটি আপেলের আবরণ ছাড়িয়ে খান। আর তখনই সেটি কেনা বন্ধ করেন, যখন পাড়ার ফলের দোকানদার একদিন তাকে জানান যে, আপেল মানুষের স্মৃতিকে সতেজ রাখে। প্যাকেটে ভরা আপেলগুলো একে একে দোকানদারের অলক্ষ্যে আবার তাকে রেখে দেয়ার দৃশ্য এই চলচ্চিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। এটি এমন ইঙ্গিত দেয়, চরিত্রটি যেন নতুন এই জগত বা পরিচয়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। অতীতের আত্মপরিচয়ে ফিরে যাবার কোন আগ্রহ তার ভেতরে আর অবশিষ্ট নেই। স্মৃতিভ্রষ্ট এই পুরুষ যেন চিকিৎসা পেলেও স্মৃতিহীন অবস্থাতেই থেকে যেতে চান। অন্যদিকে যে মনে করতে চায় না, কোনো চিকিৎসাই তার কাজে লাগার কথা নয়। কারণ অচেতনে থাকা অতীতের কোন বেদনাদায়ক স্মৃতির [এক্ষেত্রে মূল চরিত্রের স্ত্রীর মৃত্যু] কাছে কেইবা ফিরে যেতে চায়, যদি কারো সুযোগ মেলে আবারও নতুন করে সব শুরু করার।
চলচ্চিত্রটি ৪:৩ একাডেমির ফ্রেমের মাপে তৈরি হয়েছে, যা পোলারয়েড ছবির মাপকে মনে করিয়ে দেয়। পরিচালকের মতে, মানুষের অন্তর্গত দিকটি তুলে ধরার জন্যই ল্যান্ডস্কেপের দ্বারস্থ না হয়ে তিনি পোট্রেট সাইজের দিকে ঝুঁকেছেন। সিনেমাটোগ্রাফির স্টাইলেও একটা রূপান্তর পরিলক্ষিত হয়। শুরুতে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে ক্যামেরা মূল চরিত্রের আরও ঘনিষ্ঠ অবস্থানে চলে আসে। অন্যদিকে, ট্রাইপডের চাইতে হাতে বা কাঁধে বহন করা [হ্যান্ডহেল্ড] ক্যামেরার ব্যবহারও বেশি চোখে পড়ে, যা দর্শকের কাছে চরিত্রসমূহের মানবিক দিকগুলোকে আরও বেশি উন্মোচন করে। সরু ফ্রেমের সাথে প্রধান উপকরণ হিসেবে একটি পোলারয়েড ক্যামেরার সংমিশ্রণ মূল চরিত্রের একাকীত্বকেও ব্যাপকভাবে ফুটিয়ে তোলে। গেল শতাব্দীর ৭০-৮০ দশকের পুরনো আবহে গল্পটির নিঃশব্দ অগ্রসরমানতার সাথে চরিত্রের বেদনাও ক্রমশ গভীর হয়ে ওঠে। চলচ্চিত্রটিতে ব্যবহৃত বিবর্ণ রঙও পোলারয়েড ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়। ছবিটির নাম ‘এপলস’ রাখার পেছনেও রয়েছে ‘পসেসর’-এর মতই প্রযুক্তির অতি দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে অপ্রত্যক্ষ সমালোচনা। মানুষের অতিরিক্ত ডিভাইস নির্ভরতা তার স্মৃতির সতেজতাকে যান্ত্রিক করে তোলায়, মার্কিন কোম্পানি ‘এপলস’-এর সমালোচনাও এখানে করা হচ্ছে বলে পরিচালকের দাবি। যদিও শেষ পর্যন্ত নিজের এপার্টমেন্টের এক কুকুরের সাথে সাক্ষাৎ কাহিনির মূল চরিত্রকে আবারও বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনে, সে কি পারবে স্মৃতি পুনরুদ্ধার কর্মসূচির অধীনে তার সদ্য নির্মিত এনালগ স্মৃতির ইমেজ দিয়ে চারপাশের ডিজিটাল বর্তমান বা ডিভাইসবদ্ধ অতীতের দৃশ্যমানতাকে ঢেকে দিতে? এই প্রশ্ন রেখেই যেন নির্মাতা ইতি টানেন এই চলচ্চিত্রের। নিকু এও জানতে চান যে, স্মৃতি কি তবে নির্বাচিত কিছু ইমেজ? অথবা আমরা কি নিজেদেরই বহুকাল ধরে জমানো স্মৃতিরই সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ? স্মৃতি-বিস্মৃতির দ্বান্দ্বিক উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে ‘এপলস’ মূলত বেদনা ও আত্মপরিচয়ের মধ্যে সংযোগ তৈরি করে। গ্রিসের প্রতিশ্রুতিশীল এই প্রতিভার উপর কিছুটা হলেও ইয়োর্গোস ল্যান্থিমোস এবং রিচার্ড লিঙ্কলেটারের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এই আলোচনার ইতি টানব উৎসবের সমাপনী চলচ্চিত্র “হোকসাই” দিয়ে, যেটি অবশ্য সরাসরি স্মৃতি নয় বরং শৈল্পিক অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইকে ঘিরে নির্মিত হয়েছে।
জাপানি চলচ্চিত্র হোকসাই © 2020 Hokusai Movie
হোকসাই: শিল্প ও শিল্পীর লড়াই
হাজিমে হাশিমোতো পরিচালিত ‘হোকসাই’ জাপানের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী কাৎসুশিকা হোকসাই’-এর জীবনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে। তাঁর হাতে সামুদ্রিক ঢেউয়ের একটি কালজয়ী শিল্প [The Great Wave off Kanagawa] সৃষ্টির নেপথ্যের কাহিনিই এর মূল উপজীব্য। জাপানে ‘এদো’ কাল ছিল এমন এক সময়, যখন শোগুনতে নামে পরিচিত সামন্তরা শিল্পী বা আমজনতার মত-প্রকাশের স্বাধীনতাকে কঠোরহস্তে দমন করত। চিত্রশিল্পী হোকসাই সেই সময়ে বেড়ে ওঠেন। তিনি চাপকে প্রতিহত করে নিজের শিল্প বিশ্বাসের প্রতি ছিলেন আগাগোড়া সৎ। সেকারণে তিনি নিজস্ব পথ অনুসরণ করা থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। তাঁর সৃষ্টিকর্ম জাপানের শিল্পজগতে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করে। জাপানের প্রকৃতি, বিশেষ করে, ফুজি পর্বতের নানা রূপ ও দিকের ছবির জন্য তিনি বিখ্যাত। এমন কি জাপানের বাইরে ভ্যানগগ ও মনের [Monet] মত শিল্পীরাও তাঁর শিল্পরীতিতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তবে তিনি যখন দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া অসাধারণ সমুদ্র তরঙ্গের ছবি নির্মাণে ব্যস্ত, সেই মুহূর্তগুলো ঠিক কেমন ছিল? অথবা সেকালে তাঁর জীবনযাত্রাই বা কী রকম ছিল? গতানুগতিকতার বাইরের শিল্পী হোকসাইয়ের সেই অব্যক্ত গল্পই তুলে ধরা হয়েছে এই চলচ্চিত্রে।
আগে তাঁকে নিয়ে আত্মজীবনী ভিত্তিক কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ না হওয়ায়, এই চলচ্চিত্রের উপর দর্শকদের একটি বাড়তি আগ্রহ ছিল। স্বনামধন্য এই উকিয়ো-এ উডব্লক শিল্পীর ২৬০তম জন্মবার্ষিকীতে চলচ্চিত্রটিতে মূলত হোকসাইয়ের শৈল্পিক সৃষ্টিশীলতার দুটি দিকের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। তরুণ পর্বে দেখানো হয়, একজন দূরদর্শী প্রকাশকের দ্বারা তাঁর শিল্পীসত্তার আবিষ্কার, দারিদ্রতা থেকে মুক্তি এবং প্রাকৃতিক জগতের প্রতি তার আচ্ছন্ন হয়ে পড়া। আর প্রবীণ পর্বে দেখানো হয়, ১৮শ শতকের শুরুর দিকে শিল্প ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর এদো সরকারের দমনাভিযানের বিরুদ্ধে তার লড়াইরত শেষ জীবন। মূলত একজন শিল্পী এবং তার চারপাশের পরিমণ্ডলের পাশাপাশি সেসময়ের এদো শহরের [বর্তমানের টোকিও শহর] ঐতিহাসিক রূপ এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আর শিল্পচর্চা যে একটি রাজনৈতিক কাজ, দর্শককে সেটিও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন চলচ্চিত্রকার। হোকসাইয়ের তরুণ এবং বৃদ্ধ বয়সকে প্রতিনিধিত্ব করেন যথাক্রমে দক্ষ অভিনেতা ইউইয়া ইয়াগিরা এবং মিন তানাকা।
পরিচালক হাশিমোতো সাধারণত তাঁর চলচ্চিত্রে ঐতিহাসিক পটভূমির পুনর্নির্মাণ এবং আধুনিকতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি মানুষের সহিংস রূপকে উন্মোচনের উপর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, যা প্রচলিত জিদাইগেকি [ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র] থেকে স্বতন্ত্র। আলোচ্য চলচ্চিত্র নিয়ে হাশিমোতো বলেন, হোকসাইয়ের জীবনের এই বিপ্রতীপ উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে একটি দুর্দশাগ্রস্ত বছরে তিনি সবাইকে এটি মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন যে—‘যতবার আমরা হোঁচট খাই না কেন, জীবন অব্যাহত রাখার শক্তি আমাদের আছে।’
তাই বলা যায়—প্রযুক্তি, স্মৃতি এবং শৈল্পিক লড়াইয়ের আদলে উৎসবে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রগুলো যেন মহামারির পাটাতনে সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান। তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে অবশ্য শুরুতে আলোচিত ‘ডিমোন স্লেয়ার’ এনিমেশন চলচ্চিত্রের বালকের মত হন্তারক দৈত্য বধের কোনো বিকল্প নেই। আশার কথা হল, যে অদৃশ্য হন্তারকের মুখোমুখি বিশ্ব এখন দাঁড়িয়ে, তার বিনাশ কঠিন হলেও টিকার বদৌলতে সেই অগ্রযাত্রা কিন্তু ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাপী শুরু হয়ে গেছে। তবে করোনার দুঃসময়ে সরাসরি ও অনলাইনের সংমিশ্রণে এবারের টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব যেন ছিল চলচ্চিত্র কর্মী এবং দর্শকদের কাছে বৈচিত্র্যপূর্ণ নির্মাণের দমকা হাওয়া, যা সমস্ত শঙ্কা কাটিয়ে স্মৃতি, আত্মপরিচয় এবং শৈল্পিক পুনর্নির্মাণের লড়াই অব্যাহত রাখার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। করোনার ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে উৎসব চলাকালে টোকিওর রৌপ্পঙ্গির প্রেক্ষাগৃহগুলোতে প্রায় ৪১ হাজার দর্শকের উপস্থিতি সেই সাক্ষ্যই বহন করে। ♦