রহস্যের ভেতরের রহস্যে শহীদুল জহির
খুব অস্পষ্ট, মনে পড়ে শহীদুল জহিরের মুখ, প্রায়-অচেনা, যেন কোনো দিন দেখা হয়নি তাঁর সঙ্গে, এইমাত্র, সামনাসামনি দেখে আমার মনে হলো, তাঁকে চিনি। কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে, আমার সঙ্গে আগে কখনোই দেখা হয়নি তাঁর। এ-তথ্য কি ঠিক? বলতে গেলে তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার সে চান্স ছিল না। তাঁর সামাজিক প্রতিবেশ, আর আমার ঘোরাঘুরির এলাকার মধ্যে বিস্তর ফারাক। আমি যখন পুরান ঢাকার গলি-তস্য গলি চষে বেড়াতাম বন্ধুদের সঙ্গে সেই ৭২ থেকে ৮০ পর্যন্ত, মানে গোটা ৭-এর দশক, কোনো কবিতা পড়ার দাওয়াত পেয়ে, অবশ্যই আমার সঙ্গে আবিদ আজাদ, শিহাব সরকার, মাসুদুজ্জামান, জাহাঙ্গীরুল ইসলাম, আতাহার খান, হাসান হাফিজ ও আরও অনেকেই দাওয়াত পেত এবং তখন দল বেঁধেই যাওয়া হতো সে-সব প্রোগ্রামে। সেই দিনগুলোতে শহীদুল জহির বন্ধুদের সঙ্গে ব্যস্ত কিংবা কোনো নির্জন মাঠে একা একাই সময় বণ্টন করছেন বা চিন্তার শস্য-রচনা করছেন। এটা হতে পারে, মধ্য-সত্তরের পরের দিনগুলোতে আমরা সংবাদপত্রকেন্দ্রিক আড্ডায় বুঁদ আর জহির পেশার কারণে, কিংবা অন্য কোনো উপলক্ষে ঢাকার বাইরে, কিংবা কোনো মফস্বল এলাকার টিএনও হিসেবে, ধরা যাক, মৈমনসিংয়ের ফুলবাইরা/ ফুলবাড়িয়ার টিএনও হিসেবে, গদি আঁটা চেয়ারে লাল বা ভ্যারাইটি কালার্ড স্ট্র্যাইপ টাওয়ালের ওপর বসে সরকারি কাজে ব্যস্ত। পরে, অনেক পরেই হবে তা, বন্ধু এবং আমার প্রথম প্রকাশক কবি আবিদ আজাদ বলেছিল জহির তার বন্ধু। সেটা আমি জানতাম না। তখন জেনে ভালো লেগেছিল যে আমাদেরই আরও কয়েকজন সরকারি আমলা কবি, লেখক তারা, বন্ধু হবে জহিরের। সত্যই শহীদুল জহির বন্ধু ছিলেন ইলিয়াস আহমেদ, মুস্তাফা মহিউদ্দিন, সৈয়দ মনোয়ার, আবু করিম, আমিনুল ইসলাম ভুঁইয়া, নূরুল হক নিরো বা আলী আহমদের।
এবং সত্য সত্যই একদিন তার মুখোমুখি হলাম শিল্পতরু অফিসে। আবিদ পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিল, শহীদ ভালো গল্প লেখেন। ঠিক তারই কিছুদিন পর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক আলী আহমদ আমাকে পেয়ে বললেন, আরে, মাহবুব, আপনি শহীদুল জহিরকে পড়েছেন? আমি মাথা এদিক-ওদিক করায় তিনি একটি ক্ষীণতনু বই বের করে দিয়ে বললেন, ‘এইটা পড়েন। দারুণ লেখেন। তার দেখার দৃষ্টি অন্য রকম, তার ভাষাভঙ্গি অন্যদের মতো সরল ও সহজ বর্ণনাত্মক নয়। আপনার ভালো লাগবে।’ তিনি সেটাই ভেবেছিলেন। কিন্তু আলী আহমদের আশার সঙ্গে আমার ভালো লাগা ঠিক মিশ খায়নি। আমার ভালো লেগেছিল, তবে তার পেছনে ছিল মুক্তিযুদ্ধ, নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও বদু মওলানাদের মতো হিংস্র মানব-শ্বাপদের চিত্রায়ণ। আলী আহমদ হয়তো লেখারও অনুরোধ করেছিলেন, আজ ভুলে গেছি। আলী আহমদ বই না দিলে হয়তো জহিরের বই পড়া হতো না আমার। আমি কিছু লিখেছিলাম কি না, আজ মনে নেই, কেননা, আজকের মতো কমপিটিং সিস্টেম তখনো বাংলাদেশে বিরল, বলতে গেলে আসেইনি, ল্যাপটপ তো আরও দূর জিনিস। এই ল্যাপটপ শব্দটি এই যন্ত্রের নাম হলো কী করে? ভেবে দেখলাম, তাকে কোলে নিয়ে বা কোলে বসিয়ে কাজ করতে পারার অধিকারে তার এই নাম।
আমার বেশ ভালোই লেগেছিল শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাসটি। এর দুটি কারণের মধ্যে একটি হলো জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নাম এবং উপন্যাসের কাহিনিস্রোত ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় রাজনৈতিক এজেন্ট জামায়াতের হিংস্র রাজাকার-আলশামস-আলবদর শ্রেণির একজনের [বদু মওলানার] কুকীর্তির নির্মম/নির্মোহ বর্ণনা। কিন্তু তার সেই বর্ণনা, ঘষটানো, অস্বচ্ছ কাচের মতো। মনে হয়, হাঁটতে গিয়ে যেমন ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে হাঁটে কেউ কেউ, চরিত্র যুবক আবদুল মজিদও সেই রকম, তাকেই, সেই চরিত্রেই এঁকেছেন জহির। উপন্যাসের প্রথম বাক্যটি পড়ে আমার ধন্ধ লাগার অবস্থা।
‘উনিশশ’ পঁচাশি সনে একদিন লক্ষ্মীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আবদুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে ফট করে ছিঁড়ে যায়।’ সত্যই এমন বাক্য যে সূচনার পঙ্ক্তি হতে পারে, তা আমার চিন্তার সঙ্গে মেলে না। আবদুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল ছিঁড়ে যাওয়ার ব্যাপারটি, ‘পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে ফট করে ছিঁড়ে যায়’ কীভাবে?। পরিস্থিতি তার স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে কি না, তা আমার বোধে আসে না। তবে এটা বুঝি যে প্রচলিত সমাজের মানুষেরা এমনভাবে ভাবেন না। কিন্তু সমাজের অপ্রচলিত কেউ কেউ এমনভাবে ভাবতেই পারেন। পুরান ঢাকার রায়সা বাজারের একটি মহল্লায় যাওয়ার পথে আবদুল মজিদের ডান পায়ের স্পঞ্জের স্যান্ডেলের একটি ফিতা ফট করে ছিঁড়ে যাওয়ার পর শহীদুল জহির দ্বিতীয় যে বাক্যটি লিখেছেন, তাকে কথাসাহিত্যের গাল্পিক বর্ণনা না বলে প্রবন্ধের বাক্য হিসেবে মেনে নেওয়াই ভালো। দ্বিতীয় বাক্য—‘আসলে বস্তুর প্রাণতত্ত্ব যদি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতো তাহলে হয়তো বলা যেত যে, তার ডান পায়ের স্পঞ্জের স্যান্ডেলের ফিতে বস্তুর ব্যর্থতার জন্য নয়, বরং প্রাণের অন্তর্গত, সেই কারণে ছিন্ন হয়, যে কারণে এর একটু পর আবদুল মজিদের অস্তিত্ব পুনর্বার ভেঙে পড়তে চায়।’
জহিরের গদ্যের ঢঙটি, খোঁড়া, ভাঙা এবং তৃতীয়পক্ষের মুখে শোনা কাহিনিজাত। ঘষটানো অস্থির সময়কাল, অনেকটাই পরোক্ষ হলেও তাঁর গদ্যের মধ্যে একটি জটিল উৎস আছে, যা অন্য রকম, ভালো লাগার মতো। আমারও ভালো লাগে এ-কারণে যে মানুষের জীবনের চলনধারাই এমন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা। ভাবনাগুলো একের ভেতরে অন্যটি অবলীলায় সেঁধিয়ে/ঢুকে যায়
এই দ্বিতীয় বাক্য যে একটি উড়ে আসা সঙ্গতিহীন এই গল্পের জন্য বা অতিরিক্ত, যা গল্পের আবহ ও গতিকে প্রবন্ধের কাঠামোর মধ্যে ঢেলে দিয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। তবে এই গল্পের প্যাঁচালো বর্ণনা সত্ত্বেও যে নির্মম ঘটনাপ্রবাহ আমরা বুঝতে পারি, তাকে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসের ধারায় নতুন ও অবশ্যই অপ্রতিদ্বন্দ্বী, বলা অন্যায় হবে না। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় সহযোগীদের নির্লজ্জ-বেহায়াপনা ও নির্মমতা আমাদের চেতনাকে কেবল রক্তাক্তই করে চলে না, যেন আমাদের ঝুলিয়ে রাখে তার অস্বচ্ছ নির্মমতার গহন চিত্রমালায়। আমরা ভুলতে পারি না বদু মওলানার উড়ন্ত কাকের মুখে নরমাংসের টুকরো ছুঁড়ে দেবার গল্প। এই গল্প অতিরঞ্জিত নয়, মনে হতে পারে অতিপ্রাকৃত, কিন্তু সত্যই এখানে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। আবদুল মজিদ কেন তার মহল্লার বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে চায় এই প্রশ্নের সঙ্গে বদু’র করা হত্যাগুলোর সাংস্কৃতিক অভিঘাত, নাকি তার স্বাধীন দেশে বদু’র পুনর্বাসন? ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনার জেরে এবং বদু মওলানার মহল্লায় ফিরে আসার ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতির দ্বান্দ্বিকতা আবদুল মজিদকে আশাহত করে। বদু’র পুনর্বাসিত মহল্লায় মজিদ থাকতে চায় না আর। কারণ, হিংস্র পুনর্বাসিতরা বিজয়ী মানুষদের কেবল পরিহাস-শ্লেষের বানেই বিদ্ধ করে না, সমাজের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা অমানুষদের স্বরূপও উন্মোচন করে। এটাই আমার মনে হয়েছে। আমাদের সমাজে একাত্তরের রাজাকার ও পরাজিত পাকিপন্থীদের পুনর্বাসনের যে রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত আমরা দেখেছি, সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া নতুন প্রজন্মের ঘাড়ের ওপর, তাদের এই ফিরে আসার সঙ্গে রাজনীতিকদের ব্যর্থতারই এক সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিকথা এই জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। এবং ওই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ-প্রতিবেশের মধ্যে যে সামাজিক নির্মমতা চলছে, পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার যে রমরমা চলছে, প্রতিক্ষেত্রে, প্রতিদিন—এই গল্প সেই বয়ানই দেয় আমাদের। তবে তা অতি প্রচ্ছন্নভাবে এবং মনে হয় রাজনৈতিক কালচার সম্পর্কে অসচেতনতা, অজ্ঞতা ও মৌলিক শিক্ষার ঘাটতির ফলেই তা ঘটছে ও ঘটে চলেছে। এটা রাজনীতিকেরা বুঝতেই পারেননি যে তাদেরই জ্ঞাতিভাই হিসেবে ‘বদু মওলানারা’ ১৯৭১ সালে তাদেরই অস্তিত্ব ধ্বংসে কেমন কসাই হয়ে উঠেছিল। এবং আজও তাদের উত্তরপ্রজন্ম শাসনের চেয়ারে কেবল আসীন নয়, দেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও সামাজিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এভাবে, বদু’র রাজনৈতিক পরিচয়, ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। বদু’রা ধর্মীয় কালচারের খোলস জড়িয়ে নিয়ে রাজনৈতিক কর্মের রূপ ধারণ করেছে আজকের বাংলাদেশ তার ভোক্তা ও সাক্ষী। এই বদু’দের কারণেই ইসলাম কলুষিত হয়েছে, অথচ ধর্ম হিসেবে ইসলামের মৌলিকত্ব মানবতায় নিহিত। শান্তি ও পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব যে ধর্মের মূলে প্রবহমান, সেখানে কতিপয় বজ্জাত বদুর কারণে গোটা ধর্ম ও তার সাংস্কৃতিক প্রভাব প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আজ আমরা তাদের সন্দেহের চোখে দেখি।
‘কিন্তু দুই বছর পর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলে বদু মওলানা যখন লক্ষ্মীবাজারে ফিরে আসে মহল্লার লোকেরা তার গায়ে পুনরায় পপলিনের ধূসর সেই আলখেল্লা দেখতে পায়। বদু মওলানার মুখের সেই হাসিটি তখন শুধু থাকে না। এবার বদু মওলানা যেন পুনরায় শূন্য থেকে শুরু করে।... ... কেমন আছো তোমরা? এই প্রশ্নের ভেতরকার পরিহাস এমন নিদারুণ ছিল যে, নিজের বাড়ির প্রাঙ্গণের ভেতর তা শুনে এবং বদু মওলানাকে দেখে আবদুল মজিদ বাক-রহিত হয়ে থাকে।... কেমুন আছেন আপনারা?’ এই কুশল জিজ্ঞাসা যেন আবদুল মজিদের মায়ের সহ্যের বাইরে চলে যায়। ক্রুদ্ধ, ক্ষিপ্ত এবং শোকার্ত এই নারী দ্রুত বারান্দা থেকে প্রাঙ্গণে নেমে এসে চিৎকার করে উঠেছিল, তাকে অভিসম্পাত দিয়েছিল এবং হাহাকার করে বলেছিল ‘থুক দেই, থুক দেই, থুক দেই মুখে’। একই ভাবে এই নারী, একদিন তার কন্যার ক্ষতবিক্ষত মৃত দেহ দেখে হাহাকার করেছিল। তখন বদু মওলানাকে খুঁজে পাওয়া যায় নাই, সে তখন পালিয়েছিল। একাত্তর সনের ডিসেম্বরের সেই বিষণ্নতম বিকেলে আবদুল মজিদ যখন তার বোনের মৃত দেহটি কুড়িয়ে আনে সে সেটা একটি শাড়ি দিয়ে জড়িয়ে এনেছিল। মোমেনার দেহটি আবদুল মজিদ বস্ত্রহীন দেখেছিল; আর জড়ানো কাপড়ের তলে তার মা শুধু দেখে। মেয়ের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে আবদুল মজিদের মা’র কান্না জমে গিয়েছিল। মেয়েকে সে সেদিন শেষ গোসল করাতে দেয় নাই এবং কাফন ছাড়া, পরনের কাপড়ে জড়িয়ে তাকে দাফন করতে মহল্লার লোকদের বাধ্য করেছিল।... ... সে তার মেয়ের লাশ এ রকম রক্তমাখা এবং কাফনহীন অবস্থায় হাশরের মাঠে আল্লাহর আরশের সামনে নিয়ে গিয়ে হাজির করবে।’ [পৃ. ৩৮/জীবন রাজনৈতিক বাস্তবতা]
এই উপন্যাসের সবচেয়ে সিগনিফিকেন্ট অংশ অবশ্যই লক্ষ্মীবাজারের বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। অন্যত্র মানে আবদুল মজিদের শ্বশুরবাড়ি বাড্ডায় নতুন বাড়ি বানিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত।
এই স্থানচ্যুতি যে রূপক এবং একটি জাতির উৎখাতেরই রূপক, আমার তাই মনে হয়েছে। তবে, তা না বললেও সচেতন মানুষ/পাঠক ঠিকই তা বুঝতে পারবেন। ১৯৭১-এর নরঘাতক বদু মওলানার ১৯৭৩/৭৪ সালে প্রত্যাবর্তন এবং সমাজে পুনর্বাসন এবং তাদের রাজনৈতিক পুনরুত্থান আজকের বাংলাদেশেরই চেহারা আমরা দেখতে পাচ্ছি। নতুন নতুন বদু এবং তাদের বংশধররাই রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘নৃশংসতা’ যুক্ত করে চলেছে। আজ আমরা যুব-রাজনৈতিক সমাজের নারকীয় কর্মকাণ্ড দেখতে পাচ্ছি, তাতে লক্ষ্মীবাজার থেকে বাইরে চলে যাওয়ার মতো নয়, আজকে দেশ থেকে দেশান্তরে চলে যাচ্ছে যুবসমাজ। কারণ দেশের রাজনীতি, দেশের শাসক ও তাদের লেজুড়দের দাপট ও রাজনৈতিক তাণ্ডব প্রতিবেশের মধ্যে ভয় ও ভয়ংকর রূপের বিস্তার, এই সিদ্ধান্ত নিতেই বাধ্য হচ্ছে যে, ‘বদু’রা ধেয়ে আসছে নতুন রূপে।
‘আবদুল মজিদের বাড়ি বিক্রির একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এবং ধরে নেয়া যায় যে, তাদের বাড়ি বিক্রি হয়ে গিয়ে থাকলে লক্ষ্মীবাজারে ইতোমধ্যেই তাদের নাম অবলুপ্ত হয়েছে। অথবা না হয়ে থাকলে, সহসাই হবে।’
এই অংশটি গুরুত্বপূর্ণ এ-কারণে যে আবদুল মজিদের মতো মানুষেরা, যারা ১৯৭১ সালে নানা দিক থেকে সর্বস্বান্ত হয়েছে বটে, কিন্তু অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে পড়েনি বা যায়নি। তারা স্ব স্ব জায়গায়ই স্থাবর-অস্থাবর সহায়-সম্পত্তি নিয়ে বেঁচে ছিল। কিন্তু এখন তা আর সম্ভব নয়। তারা স্ব-স্থানচ্যুত হয়েছে বা সহসাই হবে। অবলুপ্ত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ও পরিচয়। যারা মুক্তিযুদ্ধ ও তার চেতনার গীত গাইছেন, তারা উপলব্ধি করতে পারছেন না যে যারা এ-দেশটিকে পাকিস্তানি হানাদার-দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করেছিল, তারা পুনর্বাসিত রাজনৈতিক রাজাকারদের ঘৃণার প্রধান পাত্র আজ। তারাই সমাজে সংসারে, সরকারে প্রশাসনে, সংস্কৃতিতে এবং প্রণোদনার রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত। তারা জানে না কি রক্তের বিনিময়ে দেশটাকে স্বাধীন করা হয়েছে। তারা জানে না বদুদের উত্তর প্রেতাত্মা জেঁকে বসেছে স্বাধীনতার ওপর। আর তাই প্রাণদাতারা স্থানচ্যুত হয়ে, এলাকাচ্যুত হয়ে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে। আর সেটাই বলতে চেয়েছেন, বলব বলেছেন জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার কাহিনিকার শহীদুল জহির।
জহিরের গদ্যের ঢঙটি, খোঁড়া, ভাঙা এবং তৃতীয়পক্ষের মুখে শোনা কাহিনিজাত। ঘষটানো অস্থির সময়কাল, অনেকটাই পরোক্ষ হলেও তাঁর গদ্যের মধ্যে একটি জটিল উৎস আছে, যা অন্য রকম, ভালো লাগার মতো। আমারও ভালো লাগে এ-কারণে যে মানুষের জীবনের চলনধারাই এমন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা। ভাবনাগুলো একের ভেতরে অন্যটি অবলীলায় সেঁধিয়ে/ঢুকে যায়। এমনকি নামাজ পড়ার সময়ও নামাজির চিন্তায় গেঁথে থাকে সামাজিক ও তার স্বার্থময় বোধের চিত্রমালা। মানুষ খুবই জটিল প্রাণ। তার চিন্তাশক্তি ও ভাবনাজাল আরও জটিল। সে-জন্যই শহীদুল জহিরের এমন গদ্য আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্ত অন্যের বয়ান থেকে নেওয়া বর্ণনা আমাকে তৃপ্তি দিতে পারেনি। কারণ, ওই বয়ান শহীদুল জহির সরাসরিই দিতে পারতেন। লেখক তার কাহিনি বা বয়ানের প্রথম ও প্রধান চরিত্র বলেই আমি মনে করি। এ-কারণেই তৃতীয় পক্ষের বয়ানজাত বর্ণনা বা শোনা কথা আমার ভালো লাগেনি। আসলে ওই বয়ান ধারাটি শহীদুল জহির আহরণ করেছেন আমাদের সমাজের প্রচলিত লোকগল্পকারদের স্টাইল থেকে। সেই গল্পকার যখন দেও-দৈত্যদের প্রাসাদের বর্ণনা দিতেন, আমরাও সেই গল্পের চরিত্রের সঙ্গে ঢুকে পারতাম দর্শক হিসেবে, অবশ্যই মনে মনে। জহির সেই গল্প বলার টেকনিকই বেছে নিয়েছেন। সে-কারণেই লেখক হয়ে যায় ‘মহল্লার লোক’ এবং ‘আমরা’। লেখকের নিজস্ব বর্ণনার কোনো কিছু দেখি না। তৃতীয় পক্ষের মুখে শোনা বর্ণনা তিনি বর্ণনা করেন গল্পে-উপন্যাসে।
জহিরের গল্পগুলোকে এক্সপেরিমেন্টাল বলতে পারি। কিন্তু সেই পরীক্ষা বা গবেষণামূলক গল্প কি আমাদের পাঠকদের তৃপ্ত করতে পারে? গল্পগুলোর মধ্যে কেবল ‘ডলু নদীর হাওয়া’র লাইনআপে পরিণতি আছে, যা সমর্তবানু বা এলাচিং-এর মনোবাস্তবিক চেতনার পরিণতি পাওয়া যায়
আমি বিস্মিত হয়ে জানলাম উপন্যাসের প্রিন্টার্স লাইন পড়তে গিয়ে। ওটা তেমন প্রয়োজনীয় বলে মনে হয় না আমাদের। কিন্তু বইটি কবে বেরিয়েছে সেই তথ্য জানা খুবই জরুরি। আবার প্রকাশকের নাম দেখে আমি চমকিত হলাম। প্রকাশক গোলাম মোস্তফা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী, হাক্কানী পাবলিশার্সের মালিক। ভালো লাগল এটা জেনে যে এমন একটি অফট্র্যাক উপন্যাসের প্রকাশক আমারই বন্ধু গোলাম মোস্তফা। এ-কারণে মোস্তফাকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এই প্রকাশনা এমন অবহেলায় প্রকাশ না করলেও পারত মোস্তফা। প্রচ্ছদ কে এঁকেছেন? তার কোনো নাম নেই। একরঙের প্রচ্ছদ অতীব সিম্বলিক। একটি কালো বৃত্তের মধ্যে একটি ফুল্লময় আপেল এবং তার মাথায় ছোট দুটি কুশি।
এই প্রণোদনাময় উপন্যাসের জন্য শহীদুল জহিরকে একটি ধন্যবাদ জানাতে চাই। কিন্তু তিনি তো এই জঙ্গমময় দুনিয়া ছেড়ে গেছেন। তাই সেই দুনিয়ায়, তার কাছে আমার ধন্যবাদ মনে মনে পৌঁছে দিতে কার শরণ নেব আজ?
তার গল্পগ্রন্থ ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প পড়ে যা আমি বুঝলাম, তাঁকে অবশ্যই ধন্যবাদ দেবার মতো। তার বহু কারণের মধ্যে একটি তাঁর রাজনৈতিক ভাষাভঙ্গি ও তাঁর কথ্যমিশ্রিত আঞ্চলিক চলমান রূপ। গল্পের কাহিনি ঠিক কাহিনির মতো সহজ নয়, যেন তেমন কোনো কাহিনিই নেই তার ভেতর, আছে চরিত্রগুলোর কথা আর কথা বলার সূত্রে যেটুকু প্রাকৃতিক দিগন্ত দরকার পড়ে, তা আমরা দেখতে পাই। চরিত্রগুলোর নিত্যবাস্তব কথ্যভাষা, চারপাশের লোকেদের উপস্থিতি, তাদের জিজ্ঞাসা ও উত্তরের মধ্যে নিহিত লোকচরিত্রের বহিঃপ্রকাশ, তাদের মনের ভেতরে লুকানো রসাত্মক ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতিবেশের বর্ণনা এবং সেই বর্ণনায় সময়চেতনার অনিশ্চিতি গল্পকারের মনোবাস্তবের অনিশ্চিত চেতনারই প্রকাশ বলে মনে হয়। প্রায় প্রতিটি চরিত্রই দ্বন্দ্বময়। তাদের মনোভঙ্গি স্থির ও প্রতিজ্ঞ নয় লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বরং তারা লক্ষ্যের সীমানায় গিয়েও প্রত্যাবর্তন করে।
‘কোথায় পাবো তারে’ গল্পের সূচনা হয়েছে এভাবে—
‘দক্ষিণ মৈশুন্দি, ভূতের গলির লোকেরা পুনরায় এক জটিলতার ভেতর পড়ে এবং জোড়পুল ও পদ্মনিধি লেনের, ওয়ারি ও বনগ্রামের, নারিন্দা ও দয়াগঞ্জের লোকেরা তাদের এই সংকটের কথা শুনতে পায়; তারা, ভূতের গলির লোকেরা বলে...’
কী বলে তারা? না, সে-কথা লেখক লেখেন না। কেন লেখেন না, তা বোঝা যায় না। তার কার্যকারণও নেই। লেখক, আবদুল করিম নামের এক সদ্য যুবকের কথা বলতে চায়। তাই পরের স্তবকের সূচনা হয় এভাবে—
‘আমরা পুনরায় আবদুল করিমের কথায় ফিরে যেতে চাই, কারণ কয়েকদিন থেকে আমরা মহল্লায় শুনতে পাচ্ছিলাম যে, সে মৈমনসিং যাচ্ছে; কিন্তু আমরা তার এই কথাকে গুরুত্ব না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। তখন একদিন বৃহস্পতিবার বিকালে আমাদের মহল্লা, ভূতের গলির ৬৪ নম্বর বাড়ির মালিক আবদুল আজিজ ব্যাপারি ঠোঙায় করে গরম ডালপুরি কিনে ফেরার পথে আবদুল করিমের সঙ্গে তার দেখা হয় এবং সে বলে, আহো মিঞা, ডাইলপুরি খায়া যাও।’
কে এই আবদুল করিম? কী তার পরিচয়? কেন তার কথা বলতে চায় লেখক? এবং সেই আবদুল করিম নামক চরিত্রের ‘ফিরে’ আসার ব্যাপারটা কী?
আবদুল করিম তো এই গল্পে আসেইনি লেখকের হাত ধরে, তাহলে ফিরে আসার প্রসঙ্গ আসে কেন? কেন তিনি চরিত্রটিকে ‘ফিরে’ দেখার তথ্য জানান আমাদের।
মনে হয়, লেখক হচ্ছেন চিহ্নিত ‘আমরা’ অচিত্রিত চরিত্র আবদুল করিমের কথায় ফিরে যেতে চায়। লেখক কেন নিজেকে ‘আমরা’ করে গল্প ফাঁদছেন? যে চরিত্রের সূচনাই হয়নি বা যে চরিত্র গল্পে আসেইনি সেই আবদুল করিমের কথা বলতে চায় আমরা নামের আড়ালে থাকা লেখক শহীদুল জহির। এই ‘আমরা’ নামের আড়ালে জহির তার অস্তিত্বকে গণমানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে একীভূত করেছেন কি? গণমানুষ, সব সময়ই বা অধিকাংশ সময় লোকমুখে অনেক তথ্য শোনে এবং তাই বিবেচনায় নেয়। সেই ধ্যান-ধারণার সঙ্গে জহির কি নিজেকে মিশিয়ে নিয়েছেন, যাতে গল্পের সূচিমুখ অপ্রচল হয়ে ওঠে? এই ব্যক্তিসত্তাকে বহুসত্তার অন্তর্লীন করে ফেলা, যা নতুন এক স্টাইল হয়ে উঠতে পারে।
গল্পের বর্ণনায় দেখি দক্ষিণ মৈশুন্দির সঙ্গে ভূতের গলির ভূসামাজিক দূরত্ব ঠিক একই সামাজিক কাঠামোর অন্তর্গত না হলেও লেখক তাদের একই এলাকার মতো করে সাজিয়েছেন। হয়তো এই সামাজিক দূরত্ব চরিত্রের সামাজিক-সাংস্কৃতিক মনোবীক্ষণের জন্য কোনো সমস্যা সঙ্কট সৃষ্টি করেনি, তবে, তা পাঠককে ধাঁধার মধ্যে ফেলে দেবে। যারা ভূতের গলি চেনেন এবং চেনেন দক্ষিণ মৈশুন্দি, তাদের কাছে এই নাম ও স্থানীয় নৈকট্য ও দূরত্ব ঠিক ধাঁধা সৃষ্টি করবে।
আবদুল করিম মৈমনসিং যায়, তবে বেশ কয়েক দিন মহল্লায় তা চাউর করে নেবার পর। সে জনাতিনেককে ডাল, আলু, গুড় ইত্যাদি এনে দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু সেই ব্যবসায়ীরা তেমন সাড়া দেয় না। কারণ, তারা আবদুল করিমকে অকর্মণ্য বা ভাদাম্মা হিসেবেই চেনে। কিন্তু মৈমনসিং যাওয়ার সিদ্ধান্ত অটুট রেখে আবদুল করিম আবদুল আজিজ ব্যাপারীকে বলে সে কেবল বেড়াতে যাবে, কারও জন্য কিছু কিনে আনবে না। তখন ব্যাপারী তার বড় ছেলে দুলালকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বলে এবং আবদুল করিম রাজি হয়।
কিন্তু আবদুল করিম ও দুলাল মিয়া অচেনা মেয়ে শেফালিদের গ্রামের কাছের আখালিয়া নদী পার হয়েও আর শেফালিদের বাড়িতে যায় না। তারা ফিরে আসে।
‘দুলাল মিঞার মুখের দিকে সে তাকিয়ে বলে, ল দুলাইল্যা, যাইগা।
দুঃ মিঞা : কি কও।
আঃকঃ : ল ফিরা যাই।
দুঃ মিঞা:ক্যালা?
আঃ কঃ : এমনেই, ল যাইগা।
দুঃ মিঞা : অহনে এই কথা কও, আইল্যা ক্যালা?
আঃকঃ : আইলাম,ল অখন যাইগা।
দুঃ মিঞা : আমারে আনলা ক্যালা?
আঃ কঃ : তুই আইলি ক্যালা!
এখন কিছুটা বোঝা যায় যে কেন আমরা নামের আড়ালে বসা লেখক আবদুল করিমের কথায় ‘ফিরে’ যেতে চান।
এবং আমরা আবারও গল্পের সেই সূচনায় গিয়ে পড়ি, যেখানে ব্যাপারী আবদুল করিমকে বলে, আহো ডাইলপুরি খায়া যাও। আর ব্যাপারীর দাওয়ায় বসে আবদুল করিম ডালপুরি খায় আর বলে—‘হালারা আলু দিয়া ডালপুরি বানায়।’
জীবনযাপনের ভেতরে যে ভেজাল থাকে, প্রতিদিন যে মিথ্যা আর স্বপ্নের ভেতরে এক আশা ও নিরাশার তকতি উড়তে থাকে, আর গন্তব্যে যাওযা নিয়ে যে দোলাচল আছে মানুষের আদিম চেতনায়, তাই যেন উঠে এসেছে এ-গল্পে। অকর্মণ্যের মধ্যে জেগে থাকা কর্মের উদ্যোগ ও উদ্যোগহীনতার টানাপোড়েন, জাগতিক জীবনের ঘোর এই গল্পের মূল কথা। শেফালি নামের কোনো অস্তিত্ব থাক বা না থাক, সেই চরিত্রটি এক আকর্ষক হিসেবে কাজ করেছে। এই গল্পে, গল্পের টান আছে কিন্তু তার স্রোত নেই, গতিও থমকানো, ধারাবাহিকতাও খণ্ডিত, কিন্তু একটি আবহ যেন গায়ে লেপ্ট থাকে আঠার মতো। শুধু এ-গল্পেই নয়, শহীদুল জহিরের অন্য গল্পগুলোতেও এই একই ধারার বহমানতা। কোনোটাই সহজ ও সরল গতিময় নয়।
লক্ষ করা যাক তার ‘মহল্লার বান্দর আবদুল হাকিমের মা এবং আমরা’ নামের গল্পটির ভাষা।
‘তখন হয়তো কখনো ভূতের গলির লোকেরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, হয়তো প্রসন্ন হয়ে বলে, হয়তো জটিল সময়ের ভেতর কাহিল হয়ে বিরক্তির সঙ্গে বলে। একাত্তর সনের ঘটনা ২ মার্চের পর থেকে যখন দেশে ঘটতে থাকে, যখন রাতে ঢাকা শহরে কার্ফু জারি করা হয়, টিপু সুলতান রোড দিয়ে ছুটে যাওয়া ভারী মিলিটারি গাড়ির চাকার গোঙানি এবং গুলির ফটফট আওয়াজ নীরবতাকে বিদীর্ণ করে এবং যখন ২৫ তারিখের রাতে নয়াবাজারের কাঠের গোলা পুড়তে শুরু করে তখন ভূতের গলি তার বাইরে থাকে না;’
লেখকের এই বর্ণনা-ঢং তার অন্য গল্পেও পাঠ করি। একই ঢঙে লেখা গল্পগুলো। আর চরিত্রগুলোও আচরণ করে একই ঢঙে, একই মনস্তাত্ত্বিক প্যাটার্নের বর্ণনার সমাজ-কাঠামোও একই।
ভূতের গলি প্রথম দেখা পাই জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাসে, তারপর ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প-এ।
‘তখন মহল্লায় ডেঙ্গু জ্বর দেখা দেয়, আমরা বুঝতে পারি মশা কেমন করে বিলাই হয়ে ওঠে এবং মানুষ তাদের বয়ে ইন্দুরের মত লৌড়ায়; আমরা জানতে পারি, এডিশ মশা থেকে এই ছাতার রোগ হয় এবং এই রোগ হলে পশ্চাদ্দেশ দিয়ে রক্ত বের হয়ে লোকে মারা পড়ে।’
[ইন্দুর বিলাই খেলা, পৃষ্ঠা ৭৯]
‘তাহলে, অনেকদিন আগে হয়তো আবদুর রহমান এবং আবুল হোসেন মন্দিরের বারান্দায় লুঙ্গি আর হাতা কাটা গেঞ্জি পরে বসে ছিল তখন সন্ধ্যা বেলা জোড় পুলের দিক থেকে তার আম্মা অথবা দাদি আম্মার সঙ্গে শামিমা, হয়তো শামিমা বেগম, অথবা সুলতানা, হাতে বড় সাইজের একটা জাম্বুরা নিয়া হেঁটে আসে।’
[প্রথম বয়ান, পৃ. ৯৫]
‘সমর্ত বানুর ডান হাতের মধ্যের আঙুলে পরা একটা আংটি চামড়া এবং মাংসের ভিতরে গেড়ে বসে থাকে, অথবা হয়তো বুড়া হয়ো যাওয়ার পর এটা ঢিলা হয়ে আসে—তথাপি তৈমুর আলি চৌধুরীর দিন কাটে পানিতে সমর্তের হীরার আংটি ডুবিয়ে তৈরি করা বিষ খেয়ে মরা অথবা না মরার খেলায়। জসিমউদ্দিন করাতি এবং মগ রমণী অঙমেচিঙয়ের মেয়ে, সমর্ত বানুর সঙ্গে পা ভাঙার ভিতর দিয়ে অথবা তার আগেই তৈমুর আলি চৌধুরী জড়িয়ে পড়ে এবং তা অব্যাহত থাকে, ফলে বিয়ের আগে তৈমুর আলি সমর্তের ২য় চুক্তির শর্তে রাজি হয়।’
[ডলু নদীর হাওয়া, পৃ.৯৮-৯৯]
‘আমরা তাই আলমগীর হোসেনকে খুঁজে বের করে বলি, কিছু করেন আমাগো লাইগা, তরমুজের দাম বাইড়া গেল, দশ টাকার তরমুজ অখনে তিরিশ ট্যাকা দাম, আমরা বাঁচি কেমনে; তখন সে আমাদেরকে বলে যে, লেদ মেমিনের কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে, কর বসানো হয়েছে, তা ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের, যেমন চাল, ডাল, তরমুজের দাম বেড়েছে, কাজেই তারা কি করতে পারে; তার কথা শুনে আমরা বুঝতে পারি কেমন করে তরমুজের দাম বাড়ে, তরমুজ কেমন করে নিজের দাম নিজেই বাড়িয়ে নেয় একটি চক্রের ভিতর দিয়ে,’
[আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস, পৃ. ১২৭]
‘মানুষ যদি স্থায়ী না হয়, তাহলে তরমুজের স্থায়ী হতে পারার উপায় নাই, কারণ মানুষ এবং তরমুজ উভয়ই পচনশীল;’
[আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস, পৃ. ১৩০]
ডলু নদীর হাওয়া গল্পের কথক বহুবচনের আমরা তেকে কিছুটা দূরে এসেছে বটে, কিন্তু অন্যের জিহ্বায় ঝাল খাওয়ার অভ্যাস এখানেও আছে। ‘সাতকানিয়ার লোকেরা, যারা বাজারে যায় অথবা বাজার থেকে বোয়ালিয়া পাড়া কিংবা সতী পাড়ার দিকে ফেরে,...
বর্ণনার এই ঢংটি অন্য গল্পগুলোকেই অনুসরণ করেছে। তবে, এই গল্পে তিনি একটি জটিল খেলা তৈরি করেছেন। ‘ইন্দুর বিলাই খেলা’তেও এমন বিষয় আছে। কাহিনি বর্ণনায় নতুনত্ব নেই বললেই চলে। গল্পে যে কথা বলতে চান শহীদুল জহির, তা সরাসরি আমাদের বলেন না, বলেন ‘ইন্দুর বিলাই খেলা’-এর খেলার মতো করেই। উদ্ধৃত গল্পগুলোর ভাষা পড়লেই বোঝা যাবে তার ভাষার দীনতা ও সাফল্য। দীনতা এখানেই যে বর্ণনায় স্ট্যান্ডার্ড কলোক্যালের সঙ্গে কথ্য আর লোকাল ডায়লেক্টের মিশ্রণ। সংলাপে এলাকা অনুয়ায়ী ডায়লেক্ট ব্যবহার। যেমন ঢাকাইয়া ডায়লেক্ট, চট্টগ্রামের ডায়লেক্ট বেশ শুদ্ধভাবে ব্যবহৃত হয়েছে বলেই মনে হয়। এটা তার অবজারভেশনের ফল, বুঝতে পারি। কিন্তু গল্প বলার ‘প্যাটার্ন’ থেকে তিনি বেরোতে পারেননি বা বেরোননি ইচ্ছে করেই। ওই ইচ্ছেটাকে আমরা নাম দিতে পারি তার সৃজনশীলতা। কেউ কেউ বলবেন তার গল্প বলার বিশিষ্টতা, কিংবা বৈশিষ্ট্য। টেকনিক কোনো শিল্প নয়, শিল্পের আকরণ, আকরণ বিশেষ হতে পারে, কিন্তু তা থেকে রসাস্বাদন না হলে সেই শিল্পকে কি সফল বলা যায়?
জহিরের গল্পগুলোকে এক্সপেরিমেন্টাল বলতে পারি। কিন্তু সেই পরীক্ষা বা গবেষণামূলক গল্প কি আমাদের পাঠকদের তৃপ্ত করতে পারে? গল্পগুলোর মধ্যে কেবল ‘ডলু নদীর হাওয়া’র লাইনআপে পরিণতি আছে, যা সমর্তবানু বা এলাচিং-এর মনোবাস্তবিক চেতনার পরিণতি পাওয়া যায়। সে তৈমুরকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছে, সে দ্বিতীয় চুক্তি হিসেবে দুই গ্লাস পানির একটিতে তার হীরের আঙটি চুবিয়ে বিষাক্ত করার মাধ্যমে তৈমুরকে বন্দী করে ফেলে। সে তৈমুরের ঔরসে ১২ বাচ্চার জন্ম দেয়, কিন্তু তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয় না। তাই তৈমুরের মুত্যুর পর [দুই গ্লাস পানি খাওয়ার পর] সে আলীকদমে চলে যায়। তৈমুরকে মেরে ফেলার পেছনে, আসলে তা স্পষ্ট নয় যে সত্যই গ্লাসে বিষ মেশানো ছিল। পরে চট্টগ্রামের সোনারু/হীরা যাচাইকারী বলে যে এটা হীরা না, কাচ। তাহলে কি কাচের পানি খেয়ে তৈমুর মারা গেল? এটা আরেক রহস্য।