‘গোলাপটি সিলিকনে তৈয়ার হইয়াছে, লইয়া যান’
ওপরের শিরোনাম যে কারও কাছে একটু বেখাপ্পা লাগতে পারে। মনে হতে পারে, এইটা আবার কেমন কথা যে, গোলাপ হয়ে যাবে সিলিকন! কিন্তু সময় বদলেছে, আর প্রযুক্তির এই বাড়-বাড়ন্ত অবস্থায় প্রকৃতির [গোলাপ] মরে যাওয়া কোনো অবান্তর ভাবনা নয়; মূলত এ এক দারুণ বাস্তবতাই বটে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে সবই তো বদলে যাচ্ছে। মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম থেকে শুরু করে সবই পরিবর্তিত হচ্ছে ক্রমাগত। ফলে গোলাপের সিলিকন হয়ে যাওয়া এমন কিছু নয়। গোলাপের এই সিলিকন হয়ে যাওয়া কেবলই রূপকের অর্থে জনসমাজের রূপান্তরই নয়; এরই সাথে সাথে তা একজন মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার পুরা করে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের সাথেও সম্পৃক্ত হওয়ার মতো বিষয়।
আদতে সাহিত্যের হিসাবটা এই পরিবর্তনের সাথে বেশ গুরুত্বপূর্ণভাবে সম্পৃক্ত। কারণ, সাহিত্যের আন্দোলনগুলোর দিকে নজর দিলে এই বিষয় বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সমাজের রূপান্তর কীভাবে সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠেছে। ফলে পূর্ববর্তী শিল্পবিপ্লব যে সমস্ত কারণে সাহিত্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হবে, ঠিক একই কারণে গুরুত্বপূর্ণ হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। বাংলাদেশের বর্তমান যে অবস্থা, সেই অবস্থায় চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব সাহিত্যে বেশ প্রখর হবে বলেই আশা রাখা যায়। কিন্তু পূর্ববর্তী ‘আধুনিকায়নের’ স্তরটা ঠিকঠাক হয়ে না ওঠায় উত্তর আধুনিক জমানা, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আর তার সাথে সম্পৃক্ত সামাজিক স্তরগুলোর বিষয়-আশয় ঠিকঠাক হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিত খুঁজে পাবে কি না, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে ওঠে। সময় এই বিষয়ে বড় নির্ধারক হিসেবে কাজ করবে। সময়ই জানিয়ে দিবে সব। কিন্তু বর্তমানে কী হচ্ছে, এবং তার প্রভাবক-শক্তি কীভাবে সক্রিয় রয়েছে, সেটাও আমলে নেওয়া জরুরি।
২
শিরোনামের যে আলাপ, সেই আলাপের ভূমিকা তো মোটামুটি হলো। এবার এই আলাপের ভিতরে প্রবেশ করা যাক। তবে শুরুটা হোক রাজনীতি দিয়ে। রাজনৈতিক ভাঙা-গড়ার সাথে সামাজিক পরিবর্তনের বিষয়টা দারুণভাবে সম্পৃক্ত। রাজনীতি সাহিত্যেরও অন্যতম অনুষঙ্গ। প্রাচীন ও মধ্যযুগে, ভারতে ঘন ঘন সামন্ততান্ত্রিক পট পরিবর্তনের বিষয়টাও রাজনৈতিক বিষয়; যদিও তার সাথে বিস্তর ফারাক রয়েছে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ‘ফারাক নির্মাণের’ বিষয়টা স্বাভাবিক, রাজনৈতিক বিষয়ও এই একই বৃত্তে ঘুরপাক খায়। এরই ফলে সাহিত্যে এই রাজনৈতিক বিষয়াদি মধ্যযুগ পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট ছাঁচের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। অর্থাৎ ‘কাব্যি করার’ আগে যে সামন্ত অধিপতির অধীনে লেখক ‘নেমক’ খেয়ে সাহিত্য করছে, সেই অধিপতির কিছু গুণগান গেয়ে প্রাথমিক রফা সারা হতো।
একটা রাজনৈতিক ইতিহাসের ‘লিনিয়ার বয়ান’ এখানে স্পষ্ট হতো। এ ভিন্ন কিছু কিছু সামাজিক পরিস্থিতির বয়ানও স্পষ্ট হতো; তবে তা অবশ্যই আধিপত্যের হিসাব-নিকাশ মিটিয়ে করা হতো। কিন্তু ব্যক্তির রাজনৈতিক অনুভূতি, কিংবা অনুভূতি প্রকাশের ব্যাপারটা এই সাহিত্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। এর কারণ রাজনৈতিক প্রভাবে নির্মিত সে সময়কার সামাজিক পরিস্থিতির প্রভাব। যে সমাজের ভিতর, যে আর্থ-উৎপাদন কাঠামোয় সাহিত্য সৃষ্টি হতো, সেই পরিস্থিতিতে এ ভিন্ন আর কিছু করা সম্ভব হতো না। ফলে এই বিষয়ের একটা বাস্তব ভিত্তি ছিল। অর্থাৎ গোষ্ঠীনির্ভর এবং সামষ্টিক সমাজের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
কিন্তু ইংরেজরা এই অঞ্চলে তাদের উপনিবেশ গড়ে তোলার পরপরই পূর্বের অবস্থার পরিবর্তন হয়। বদলে যেতে থাকে পূর্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ফলে সাহিত্যেও এই বিষয়টার প্রভাবে পরিবর্তন হতে থাকে। কিন্তু সেই বিষয়টা কেমন ছিল, আদতে? কারণ যে সামাজিক পরিস্থিতিতে প্রাচীন ও মধ্যযুগের রাজনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সেই বিষয় কিন্তু ইংরেজ আমলে আর থাকল না। বদলে গেল। কিন্তু তারপরও সেই বিষয়টার একটা সমস্যার ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে। কারণ, প্রাচীন ও মধ্যযুগের রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটা দৈশিক পরিস্থিতি নির্ভর ভারসাম্য ছিল। কিন্তু আধুনিক যুগে এসে এই ভারসম্যের বিষয়টা আর থাকল না; নতুন যুগের সূচনায় এই রাজ্যপটের হিসাবটা বদলে গেল। কেবলই সামন্ত অধিপতিদের গুণগান কিংবা বিবরণের ভেতর দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি এই সমাজ। ব্যক্তির বিকাশ, তা যতই সংকীর্ণভাবে হোক না কেন—এ ক্ষেত্রে বড় নিয়ামক হিসেবে সক্রিয় থেকেছে। আবার ধনতান্ত্রিক এবং সামন্ততান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির দ্বৈত প্রভাবে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরির প্রেক্ষাপট নির্মাণ হয়েছিল। আর এর পরবর্তীকালে দুই-দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং উপনিবেশ থেকে উপনিবেশিত ভূমির স্বাধীনতা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নির্মাণ করেছিল।
কিন্তু বর্তমানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে পূর্বের সমস্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিরই পরিবর্তন ঘটেছে। রাজনীতির জন্য এখন আর ময়দানে নামা লাগে না। ঔপনিবেশিক ক্ষমতার তলে নির্মিত জাতীয়তাবাদী চিন্তা আর উদারনৈতিক রাজনৈতিক আদর্শের বিষয়ও আর তেমন দরকারি বিষয় হিসেবে কার্যকর থাকে না। রাজনীতিতে এখন কেন্দ্র-প্রান্তের এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক বিষয়-আশয় মূলতই কার্যকর হয়েছে। কিন্তু তা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ছাঁচের ভেতর দিয়ে। বিপ্লবী কিংবা জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারেই ভ্যানিশ হয়ে গেছে। যা টিকে আছে, তা গড় জনগণের কাছে ‘হাইস্যকর’ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, ‘সেই প্রয়োজনের’ বিষয়টা আর নেই। আদতে সামাজিক পরিস্থিতিতে ‘সেই প্রয়োজন’ প্রয়োজন হারিয়ে বসে আছে। ফলে নকশাল আন্দোলনের জন্য ফিরে যেতে হয় না সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে। ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের চরিত্রের যে কায়-কসরত, এই উপন্যাসের রাজনৈতিক আদর্শ ঠিকঠাক নির্মাণে, তা বেশ চকচকে তার রাজনৈতিক কর্মব্যস্ততায়। গোরার মতো চরিত্রের, যার কেন্দ্রে উদারনৈতিক রাজনৈতিক আদর্শ প্রাধান্য বজায় রাখে, এই সময়ে আর দরকার নেই। আবার সুভাষের মতো কবিতায় সাম্যবাদের গরমা-গরম বুলি আওড়ানোর দরকারও বোধ হয় এখন আর নেই।
এখন এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে রাজনৈতিক বিষয়-আশয় যেমন ‘ক্লাউড-কিপারের’ ভেতর দিয়ে সম্পাদন সম্ভব, তেমনি করে রাজনৈতিক নানান বিষয়ও কিন্তু নিয়ন্ত্রণের পিছনে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব-উদ্ভূত নানান প্রযুক্তি ও কলাকৌশল ব্যবহৃত হয়। ফলে একটা দ্বৈত সংঘাত-পরিস্থিতি নির্মাণ এই প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়। তাই একেবারেই যে সবকিছু সিধেভাবে চিন্তা করা সম্ভব, তা বলা ঠিক নয়। পূর্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটা লিনিয়ার প্রকল্প ছিল। সেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যমুখী রাজনৈতিক প্রকল্পের উদ্দেশ্য এবং কার্যপ্রণালিও একটা নির্দিষ্ট দিকে প্রবহমান ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই বিষয়টা আর লিনিয়ার উদ্দেশ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বহু-বর্ণিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে বর্তমানে রাজনৈতিক প্রকল্পগুলো কার্য সম্পাদন করে।
এমনকি রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণাসহ নানান বিষয় নিয়ন্ত্রণের বিষয়টা এখন পত্রিকা তো দূরে থাক, টিভি পর্দায়ও আর নেই। ব্যাপারটা পুরোপুরি সোশ্যাল মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। এখন রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণাসহ প্রায় সবই হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। এখন ‘গুজব’ এবং ‘ভাইরাল’ শব্দের প্রভাবে যেকোনো ‘আসন’ সহজেই নির্মিত যেমন হয়, তেমনি ভেঙেও পড়তে পারে। অর্থাৎ জনসমাজের নিয়ন্ত্রণে, সামাজিক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিষয়-আশয়-এর প্রচার-প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সোশ্যাল মিডিয়া। সোশ্যাল মিডিয়া যে কেবল একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের রাজনৈতিক কার্যকলাপই নিয়ন্ত্রণ করে, ব্যাপারটা এমন নয়। একই সাথে বিশ্ব রাজনীতির নানান বিষয় নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অতি সম্প্রতি ইউনাইটেড স্টেটসের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এই বিষয়ে অবতারণা করা যেতে পারে। আবার উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও এই একই পথে চলছে।
সারা বিশ্বের যেকোনো রাজনৈতিক বিষয়ে জনসমর্থন আদায়ের বেলায় বিশ্বব্যাপী হ্যাশট্যাগের বিষয়টাও নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এই হ্যাশট্যাগের মাধ্যমেও যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কিংবা বদলে ফেলা সম্ভব। ফলে একক এবং একগুঁয়ে রাজনৈতিক নীতি বাস্তবায়নের বেলায় যেকোনো রাষ্ট্রের একটু ভাবনা-চিন্তা করার ব্যাপার থাকে। হঠাৎ করে যেকোনো পলিসি চাপিয়ে দেওয়ার পূর্বে বহুবার এই বিষয় নিয়ে ভাবনা-চিন্তার দরকার পড়ে, যেকোনো রাষ্ট্রের, তা তাদের যতই ক্ষমতা থাক না কেন। কারণ, কোনো খবরই এখন আর এক সেকেন্ডের বেশি সময় নেয় না প্রচারিত হতে। বলতে গেলে সেকেন্ড বিষয়টাও বাতিল হয়ে ন্যানো সেকেন্ড এই জায়গা দখল করেছে। কিন্তু হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে আমরা একই সাথে যেমন ফিলিস্তিনের জন্য তুরস্কের কান্না দেখতে পাই, ঠিক বিপরীত দিকে তুরস্ক কর্তৃক কুর্দি হত্যার বিষয়ও জানতে পারি। ফলে একক নীতি আর উদ্দেশ্যর ওই লিনিয়ার রাজনৈতিক আদর্শ এখন আর সেভাবে মান্য হয় না। যদিও নানান বিনির্মাণের কথা শোনা যায় চারদিকে। তবে সব বিনির্মাণ মূলত পুঁজিকে নির্ভর করেই নির্মিত হয়।
দৈশিক এবং বৈদেশিক এই সমস্ত রাজনৈতিক প্রভাব শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিধৃত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। এই বিষয়সমূহ সাহিত্য এড়িয়ে যেতে পারে না। বাংলাদেশ যে তৃতীয় বিশ্বের বা গরিবি দেশ—এই বিষয় এখন আর গুরুত্বপূর্ণ সূচক শব্দ নয়। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে এই বিষয়টা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি করে বহির্বিশ্বের রাজনীতির বেলায়ও এই বিষয়টা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই রবীন্দ্রনাথের উদারনৈতিক আর ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক প্রকল্প এখন অচল বিষয় হিসেবেই বিবেচিত হবে; তবে কেউ এই প্রকল্প মেনে চললে তার বুকে ছুরি মারার দরকার নেই। কারণ, সময়।
রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর যুগের বিবেচনায় ওই রাজনৈতিক প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগের হিসেবে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক প্রকল্প ধোপে টিকবে না। আবার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো মার্ক্সবাদী সাহিত্যিকের রাজনৈতিক প্রকল্প এবং তার প্রায়োগিক দিকের বিপ্লবী অগ্রসর-প্রকল্পও বেশ অকেজো। যদিও ‘স্লোগান’ থেমে নেই। কিন্তু কেবলই ‘স্লোগান’ দিয়ে হবে না। তার কার্যকারিতা এবং সফলতা নিয়েও ভাবতে হবে। তাহলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা কোন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে? মূলত একটা বিন্দু ও সরলরৈখিক রাজনৈতিক প্রবণতার বাইরে গিয়ে একধরনের জটিল রাজনৈতিক প্রবণতার সৃষ্টি হয়েছে। যে রাজনৈতিক প্রকল্প জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক প্রকল্পকে যেমন আক্রমণ করে, তেমনি করে মার্ক্সবাদকেও অস্বীকার করে। আবার গণতান্ত্রিক প্রবণতাকে পুরোপুরি মেনে নেয় না। অর্থাৎ একক কোনো রাজনৈতিক আদর্শ মানিত হওয়ার বিষয় চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে সম্পাদন সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক দিক থেকে এই রকম একক কোনো ব্যবস্থায় স্থির না থাকার বিষয়টা একসময় একটা সমস্যার সৃষ্টি করে। এবং এই কেন্দ্রহীন রাজনৈতিক প্রকল্প একধরনের বিশৃঙ্খলারও সৃষ্টি করে। তাই সাহিত্যেও এর প্রভাব পড়ে। যেহেতু কোনো একটা আদর্শ যে সাহিত্যিক লালন করছেন, তাকে তো হুট করেই মেরে-কেটে সেই রাজনৈতিক আদর্শ থেকে বর্তমানের রাজনৈতিক আদর্শে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। আদতে তা হয়ও না। রবীন্দ্রনাথকে বড়জোর সমালোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু গোরা কিংবা যোগাযোগ উপন্যাসের রাজনৈতিক আদর্শের জন্য তাঁকে খারিজ করে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, সেই যুগ তখন ছিল, যখন রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু এখন আর তার বাস্তবতা নেই। তাই এককভাবে, একপেশে হয়ে, ঘাড় গুঁজে সমালোচনা করাটাও যেন কেমন বিষয়। আবার রাজনৈতিক দরকারে সুভাষ যে সাহিত্য করেছেন, এবং তাঁর প্রকল্পকে যেভাবে কাজে লাগাতে চেয়েছেন, তা সেই সময়ের দরকারি বিষয়। এই একই হিসেবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মার্ক্সবাদী রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন।
এই কারণেই বর্তমানে যে সমস্ত সাহিত্য হচ্ছে এবং হবে, সেইখানে ‘বহুস্বর বিশিষ্ট রাজনৈতিক আখ্যান’ নির্মিত হবে; আদতে দরকারি বিষয় হবে। বাখতিনের ‘ভাষার পলিফনি’-এর বিষয়টা যোগ করা যেতে পারে এই রাজনৈতিক অবস্থা আলোচনায়। কারণ, বাখতিনের ‘ভাষার বহু স্বরের’ প্রস্তাব কেবল ভাষার ভিতরেই আবদ্ধ থাকতে পারে না। যেমন পারে না দেরিদার ‘শব্দের বহুমাত্রিক অর্থময়তার’ বিষয়টা। বর্তমানে রাজনৈতিক সম্বন্ধের বিষয়টাও এই একই সূত্রে আবদ্ধ হতে পারে। নতুন করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং এর প্রভাবে নতুন যে রাজনৈতিক আদর্শের সৃষ্টি হয়েছে, তা এর মুখ্য কারণ।
৩
রাজনীতির সাথে ক্ষমতাও বিশেষভাবে সম্পৃক্ত। রাজনীতির মতো ক্ষমতাও নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক অবস্থানে এবং আর্থিক প্রক্রিয়ার ওপরই বিশেষভাবে ক্ষমতা ও আধিপত্য-কাঠামো নির্ভর করে, বেড়ে ওঠে, কিংবা ধসে পড়ে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে, যখন পশু শিকার করে মানুষ জীবন যাপন করত, তখন ছোট ছোট দলে মানুষকে বসবাস করতে হয়েছে। কারণ, যূথবদ্ধতা ব্যতীত শিকার ব্যাপারটা ঠিকঠাক করে ওঠা সম্ভব ছিল না। ফলে মার্ক্সের চিন্তার ‘আদিম সাম্যবাদী সমাজ’ সে সময় সম্ভব ও বাস্তবে কার্যকর ছিল। সেই সমাজে ক্ষমতা ও আধিপত্যের হিসাবটা ছিল এক রকম। এবং ক্ষমতা ও আধিপত্য নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিটাও ছিল একই সমান্তরালে প্রবাহিত। অর্থাৎ, একটা ভারসাম্য সেই সমাজে বজায় ছিল। কিন্তু মার্ক্স যে নতুন সময়ে এসে সেই সমাজের স্বপ্ন দেখেন, তা-ও মূলত একটা ‘ভালো স্বপ্নই’ বটে—মানে ইউটোপিয়া আরকি! কিন্তু কৃষি সভ্যতার সূচনায়ই সামন্তাধিপতিদের সৃষ্টি হলো। সেই সমাজে সামন্ত প্রভুরাই সব নিয়ন্ত্রণ করত। এরপরেই নতুন যুগের সূচনা হলো। শুরু হলো শিল্পবিপ্লব। নতুন করে পুঁজির সৃষ্টি হলো। পুঁজিই সবকিছুর নিয়ন্তা হয়ে উঠল। ফলে ক্ষমতা আর আধিপত্যের বিষয়টা অনেকটাই জেমস ওয়াটের বাষ্পীয় ইঞ্জিনের নিয়ন্তাদের হাতে গিয়ে উঠল। ফলে সামন্ত আর্থ-উৎপাদন কাঠামোয় আর ক্ষমতা ও আধিপত্যের বিষয়টা স্থির থাকল না। নতুনভাবে নতুন জায়গায় চলে গেল।
শিল্পবিপ্লবের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়েও ক্ষমতা ব্যাপারটা নতুন করে স্থান বদল করতে থেকেছে। কারণ, শিল্পবিপ্লব ঠিকঠাক থাকলেও তার ধরনটা বদলে গেছে। আর পূর্বের শিল্পবিপ্লবের সীমিত বিষয়-আশয় এই যুগে বিপুল প্রযুক্তির সাহায্যে বেড়ে গেছে। কেবলই স্টিম ইঞ্জিনের বিষয়টা বহু বিস্তৃত হয়েছে এমন নয়। স্থির প্রযুক্তির বিষয়টা চলন-গতি সম্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ উৎপাদন, প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদনের যে উদ্বৃত্ত, তা পরিবহনের জন্য নতুন নতুন মাধ্যম আবিষ্কার প্রথম শিল্পবিপ্লব পরবর্তী যুগের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফলে ক্ষমতা-আধিপত্যের সাথে উপনিবেশের বিষয়টা পূর্বের চেয়ে জাঁকালো হয়ে উঠল। আর এরই সাথে সাথে ক্ষমতার হিসাব-নিকাশের ছকটা বদলে গেল। কেন্দ্র-প্রান্তের মতো ক্ষমতা-আধিপত্য নির্ভর ছকটাও এই সময় এসে পরিপূর্ণতা পেয়েছিল। তাই ক্ষমতার আর আধিপত্যের ছাঁচের হিসাবটা পূর্ববর্তী যুগের হিসাবের একেবারেই বাইরে। আর এর পরবর্তী যুগ কম্পিউটার আর এই কম্পিউটার সম্পৃক্ত নানান বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। সেই বিষয়-আশয় দুনিয়াকে আরও গতিমান করে তুলেছিল।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই কালে ক্ষমতা-আধিপত্য ব্যাপারটা অনেকটাই প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। ক্ষমতা কোনো ‘একক এবং নির্দিষ্ট কেন্দ্রকে’ ঘিরে বেড়ে ওঠে না; কিংবা নিয়ন্ত্রিতও হয় না। ক্ষমতার ‘চূর্ণ-বিচূর্ণ’ হওয়ার বিষয়টা এই সময়ে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কোনো একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্র বা বিষয়কে ঘিরে ক্ষমতা চলাচল করে না। এখন আর সেই কেন্দ্র-প্রান্তের ক্ষমতা-কাঠামোর লিনিয়ার হিসাবটাও ঠিকঠাক সম্পূর্ণ হওয়ার মতো পরিস্থিতিতে বজায় নেই। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষে ক্ষমতার অন্দর মহলের খবরাখবর পর্যন্ত সহজেই জনসাধারণের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে ক্ষমতা-আধিপত্যের বেলায় যে ভয় জনসমাজে একটা প্রক্রিয়ায় ছিল, সেই ভয় এখন আর টিকে নেই। রিয়েলিটি, সিমুলেশন, সিমুলাক্রা পর্যায় পার হয়ে এই হাইপাররিয়েলিটির যুগে অন্যান্য পরিস্থিতির মতো ক্ষমতার বিষয়টাও পরিবর্তিত হয়ে গেছে। যেহেতু সহজেই সবকিছু সাধারণের হাতে এসে পড়েছে। ক্ষমতা-আধিপত্যের নিয়ন্তারাও ঠিক একই প্রক্রিয়ায় জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণের পথ খুঁজে পেয়েছে। নজরদারির বিষয়ে এবং শাস্তি প্রদানের জন্য এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব-আমলের প্রযুক্তি ও মাল-সামানাই ব্যবহার করছে শাসকগোষ্ঠী। ক্ষমতা নিয়ন্তা-গোষ্ঠীর বিপক্ষীয় গোষ্ঠীকেও এই একই প্রক্রিয়া ‘একহাত দেখে’ নেওয়া হচ্ছে।
ফলে গোয়েন্দা কার্যক্রম, রাষ্ট্রের নিপীড়ক চরিত্র, ক্ষমতা-আধিপত্যের নির্মমতার ধরন বদলে গেলেও, ধারার হিসেবে তা পূর্ববর্তী ধারার সাথেই বিশেষভাবে সম্পৃক্ত। কেবল ক্ষমতা-আধিপত্য বিষয়টা চূর্ণ-বিষয় হিসেবে বিবেচিত হলেও মূলগত বিষয়ের লক্ষণ ও উদ্দেশ্য বোধ করি সেইভাবে বদলায়নি। সাহিত্যে, শিল্পে, সংস্কৃতিতেও এই বিষয় একত্র হচ্ছে। তার প্রতিফলন বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয়ও বটে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রাচীন থেকে বর্তমানের হিসাবটা এই প্রক্রিয়ায় সমানভাবে চলবে না। কারণ, বাংলাদেশের ভূমিভিত্তিক শাসনব্যবস্থার হাল-হকিকত, তার ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা ক্ষমতা-আধিপত্য সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রায় প্রকাশ পায়। আবার চতুর্থ শিল্পবিপ্লব পূর্ববর্তী শিল্পবিপ্লবগুলোর ধরনও ভিন্ন এই অঞ্চলে অন্যান্য অঞ্চল থেকে। তবে হেরফের হলেও মূলগত জায়গায় ক্ষমতা-আধিপত্যের নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়াটি বৈশ্বিক প্রক্রিয়ার সাথেই বেশ মিলমিশ খায়।
৪
একটি সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্কের বিষয়টা সামাজিক নানান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভিতর দিয়ে নির্মিত হয়। আবার একইভাবে নারী-পুরুষের সম্পর্কের প্রকৃত অবস্থা ঘিরেই শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিষয়টা তৈয়ার হয়, সামনে আগ বাড়ে। যে চরিত্র সাহিত্যে নির্মাণ হয়, সেই চরিত্রের প্রেম কিংবা যৌন সম্পর্ক বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ— কেবলই বিষয়ের জন্য নয়, সাহিত্যের হয়ে ওঠার জন্যও তা গুরুত্বপূর্ণ। সীতার জন্য লঙ্কাকাণ্ডের ঘটনা, কিংবা হেলেনের জন্য ট্রয়কাণ্ড—এখন সম্পূর্ণই বদলে গেছে এসবের প্রেক্ষাপট। নারী, নারী দেবতা কিংবা এইসবের সাথে সামন্ততন্ত্রের সেই বুনট সম্পর্ক আর নাই। নারীকে নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড কিংবা ট্রয়কাণ্ডের কোনোটাই এই সময়ে ঘটে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার ঘরের ভিতরে বন্দি এবং যার কাজ কৃষি-সমাজের সাথে—সেই বিষয়ও এই সময়ে চালিয়ে যাওয়া বেশ কষ্টের।
এই মর্মে বলে রাখা ভালো যে, শরৎ-রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের প্রেম-সম্পৃক্ত চরিত্রসমূহের চিঠি চালাচালি, কিংবা বৈঠকখানায় দু-এক নজর দেখার মাধ্যমে ‘প্রেম-পিরিতির প্লট’ এখন অনেকটাই ইউটোপিয়ান বিষয় হিসেবে মনে হবে—এই আমলের লোকজনের কাছে। কথা সত্য। এর বাস্তব উদাহরণ এই যে, শরৎ পড়ার চল আর এখন এই অঞ্চলের গৃহবধূদের মধ্যে সংক্রমিত হয় না, বলতে গেলে প্রবেশ করতেই অসমর্থ। কিন্তু শরৎ পড়ার একটা ঐতিহ্য বেশ আগ থেকেই ছিল। মানুষ অবসর কাটানোর জন্য বইকে বেছে নিয়েছিল। আর এরই ধারায় শরৎ-রবীন্দ্রনাথের একটা চাহিদা ছিল। কিন্তু সেই সময় আর বাজার উধাও! কারণ, এসবের কোনো দরকার আছে বলে লোকজন মনে করে না।
অর্থাৎ সাহিত্যে নারী-পুরুষের সম্পর্কের ‘লিবারেল ডকট্রিনের’ দিন শেষ হয়েছে। সেই জমানার কার্যকারণ সূত্রের জন্য যে আর্থ-উৎপাদন কাঠামোর ওপর ভর করতে হতো, তার দিনও শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। অর্থাৎ পরিস্থিতি বদলেছে। আর্থ-উৎপাদন কাঠামোয় যেমন পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, ঠিক একইভাবে রাজনৈতিক নানান বিষয়েরও পরিবর্তন হয়েছে। ফলে এই দুইটা বিষয় সামাজিক নানান বিষয়কে নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হওয়ার কারণে নারী-পুরুষের সম্পর্কের হিসাবটাও এই একই প্রক্রিয়ায় বদলে গেছে। আবার নাগরিক পরিস্থিতিতে যে ধরনের যৌনতা-নির্ভর ‘আধুনিক’ সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতের বিষয় ছিল, প্রধানত বড় বড় নগরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল, তারও ভাঙন হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কলকাতায় কল্লোলের সাহিত্য আদর্শকে বিবেচনা করা হয়েছিল ‘আধুনিক’ সাহিত্য হিসেবে। আদতে যে সাহিত্য ছিল ফরাসি প্রকৃতিবাদী সাহিত্যেরই অনুসরণ।
কিন্তু বর্তমানে পূর্বের কয়েকটি যুগের বিষয়-আশয়-প্রভাবে বেড়ে ওঠা এবং গড়ে ওঠা নারী-পুরুষের সম্পর্কের বিষয়টা বদলে গেছে। প্রযুক্তিগত কারণেই মূলত এই বিষয়টা হয়েছে। প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান পরিবর্তন এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই বিষয় বৈশ্বিক শিল্পবিপ্লবের ধারায় হলেও সংকটের বিষয়ও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রযুক্তির হিসাবটা যে অর্থে ইউরোপের সামন্ততন্ত্রকে বদলে দিল, সেই অর্থে বাংলাকে কেন্দ্র করে রেনেসাঁধর্মী বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে শিল্প-প্রযুক্তির কোনো সৃষ্টি হয় নাই। যা হয়েছে তা মূলত ব্যবসায়-এর বিষয়।
যেহেতু সেই সামন্ত যুগে রাজাদের মনোরঞ্জনের জন্য ‘ছেঁদো কবিরা’ বারবার লিখেছেন রমণীর নানান রূপ-বর্ণনাবিষয়ক কবিতা। তা দিয়েই অবদমিত যৌনাকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার এক দারুণ প্রয়াস পেয়েছে ওই সব সামন্তাধিপতি। আর বাস্তবেও হারেম-সংস্কৃতির বিষয় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যৌনতা ব্যাপারটা যতটা না যৌনাঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত, তার চেয়ে বেশি সম্পৃক্ত মস্তিষ্কের সাথে। প্রাচীন কাব্য চর্যাপদের মূল উদ্দেশ্যটা হলো বৌদ্ধিক ধর্মভিত্তিক তত্ত্বের রূপায়ণ। কিন্তু সেইখানেও যৌনতা বাদ যায় নাই। আদতে প্রেম-যৌনতা, সর্বোপরি নারী-পুরুষের সম্পর্ক পৃথিবীতে নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এরই ফলে ‘বধূর পরকীয়া প্রেম-সম্পর্ক’ এই কাব্যে দেখানো হয়েছে।
মধ্যযুগে রাধা-কৃষ্ণের মিলনের জন্য যে সমস্ত ‘জোগাড়-যন্তর’ করতে হয়েছে ওই কাহিনিকারের, সেই ‘জোগাড়-যন্তরের’ দরকার বোধ করি এখন আর নেই মানুষের। যদিও এই ধারার প্রণয় আর যৌনতার নানান সূচক-চিহ্ন মধ্যযুগের কাব্যে ভরপুর; এবং তা সম্ভব হয়েছে একটা সামন্ত সমাজের ভিতরেই। গোষ্ঠী-প্রধান এবং সামন্ত-নিয়ন্তার ক্ষমতা নানান সামাজিক বিষয়কে যেমন দখল করেছে, তেমনি করে নারী এবং যৌনতার বিষয়-আশয়ও দখল করার একটা প্রবণতা এই সমাজে ছিল। সাহিত্যে সে বিষয় স্পষ্ট হয়। অর্থাৎ নারী-পুরুষের সম্পর্ক এবং যৌনতার বিষয় সম্পৃক্ত থেকেছে ভূমির সাথে। এবং এই আলাপ যদি এই অঞ্চলের ‘নারী-পুরুষের সম্পর্ক এবং যৌনতার বিষয়’ বাতিল করেও করা হয়, তো সেখানেও দেখা যাবে যে অন্যান্য অঞ্চলেও নারী দখল এবং যৌন কর্তৃত্বের বিষয় গোষ্ঠী এবং সামন্ত সমাজের গুরুত্বপূর্ণ লোকজনের ভিতরেই প্রোথিত ছিল।
কিন্তু এর পরিবর্তন ঘটে গেল নতুন সময়ে, উনিশ শতকে। উনিশ শতকে নারী-পুরুষের সম্পর্ক আর যৌনতার হিসাবটা অনেকেই কলকাতাকে কেন্দ্র ধরে করতে চান। কারণ, মেট্রোপলিটন এর মেজাজ-মর্জির ওপর ভিত্তি করে এই সময় সবকিছু যেমন নির্মিত হচ্ছিল, তেমনি করে পূর্বতন সবই খারিজ করে দেওয়ার একটা প্রবণতা চালু ছিল। নতুন করে পুঁজির সাথে সম্পৃক্ত আধা শিক্ষিত শ্রেণি—এমনকি অনেকেই কোনো শিক্ষা-দীক্ষা বাদেই—প্রণয় ও যৌনতার মূলগত ছাঁচটা তৈয়ার করেছিল। এই উঠতি মুৎসুদ্দি শ্রেণির হিসেবেই এই সময়ের প্রণয় ও যৌন সম্পর্ক নির্মিত হয়েছে। কাঁচা টাকা পাওয়ায় কেন্দ্র-প্রান্তের আর্থ-উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত থাকা লোকজন কলকাতায় রক্ষিতা রাখার মতো কাজকর্ম করতে পেরেছে। আবার একই সাথে সামন্ত মূল্যবোধের হিসেবে তাদেরকে একটা স্বীকৃত ব্যবস্থার বন্দোবস্ত করতেও দেখা গেছে। কারণ, এই সময়ে গ্রামীণ সমাজ একেবারেই বিলুপ্ত হয় নাই। ফলে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণি ব্যতীত জনসমাজের প্রণয় ও যৌনতার ছাঁচটা এক রকমই রয়ে গেছে। এর পরেও দৈশিক ও বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে এই সম্পর্ক আর যৌনতার বিষয় কম-বেশি পরিবর্তিত হয়েছে।
কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে যৌনতার সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়েছে বিপুলভাবে। ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি কিংবা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই যৌন চাহিদা মিটিয়ে নেওয়ার বিষয়টা এখন বেশ সাধারণ বিষয় হিসেবেই স্বীকৃতি পেয়েছে। আবার সম্পর্ক তৈরি করার জন্যও এই সোশ্যাল মিডিয়া বড় ভূমিকা পালন করছে। এমনকি বর্তমানে বিদেশি নারী-পুরুষ যে ‘প্রেমের টানে চলে আসে’, তা-ও এই সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণেই সম্ভবপর হয়েছে। একই সাথে সম্পর্ক ভাঙার পিছনেও গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা পালন করছে এই সোশ্যাল মিডিয়া। আবার লিবারেল ডকট্রিনের সম্পর্ক কিংবা ‘আধুনিক’ ডকট্রিনের সম্পর্কের বিষয়টা একেবারেই গুঁড়িয়ে দিয়েছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং এর প্রভাবে উৎপন্ন প্রযুক্তিগত বিষয়-আশয়।
বৈঠকখানায় মৃদু আলাপের যুগকে তো কল্লোলের লোকজন ‘পতিতাপল্লীতে’ নামিয়ে এনেছিলেন। নায়ক-টায়কের যৌনলিপ্সা এবং যৌন ক্রিয়াকলাপের সাথে বাস্তবে যাওয়া আসার বিষয়টা ছিল। কিন্তু এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে এই বিষয়টা বদলে গেছে। এখন যৌন চাহিদা পূরণে যেমন ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি কার্যকর মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে, তেমনি করে ‘স্কট সার্ভিসের’ মতো সার্ভিসগুলো জনপ্রিয় এবং প্রচলিত হয়ে গেছে প্রযুক্তির কল্যাণেই। ‘ফোন সেক্স’, ‘লাইভ সেক্স চ্যাট’, ‘ইমো গ্রুপ সেক্স চ্যাট’, ‘মেসেঞ্জার ন্যুড গ্রুপ’— এর মতো নানা রকম শব্দ এখন নতুন করে পুরোনো সম্পর্ক ও যৌনতার বিপরীতে চাবি-শব্দ হিসেবে নির্মিত হয়েছে। আবার যেকোনো সময় এই বিষয়গুলোই ভাইরাল হয়ে সম্পর্কের বিপর্যয় তৈরি করছে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেমন শরীরী উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ নয় এই সময়ে; তেমনি করে যৌনতার বিষয়-আশয়ের ক্ষেত্রেও শরীরী উপস্থিতির বিষয় গুরুত্বপর্ণ নয়। এই বিষয় দখল করে নিয়েছে প্রযুক্তি। বদলে গেছে সম্পর্ক ও যৌনতার ধরন।
৫
ধর্মের কল যে বাতাসে নড়ে, বহুদিনের এই রূপকী সত্য ক্লাউড-মিডিয়ার যুগে সত্য হয়ে গেছে। প্রতিক্রিয়াশীল কিংবা প্রগতিশীল—সব বাজারেই ‘বাতাসি’ ধর্মের গন্ধ ছড়ানো সহজ। ধর্মের নামে কয়েক সেকেন্ডেই যে কাউকে মেরে-টেরে ফেলার মতো ভয়ংকর বিষয় ঘটে যেতে পারে। আবার গোটা শয়েক পর্ন স্টারের পেইজে লাইক মারা লোকটাও যে ধর্ম বিষয়ে বয়ান দেয়—এ সবই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সহজ করে দিয়েছে। যতটা না দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি করে দিয়েছে স্পষ্ট। মানুষের ধর্ম নিয়ে ভণ্ডামিটা স্পষ্ট করে দিয়েছে। ধর্ম নিয়ে রাজনীতির মাঠটা যে গরমা-গরম করা সম্ভব হয়েছে, তা সম্ভব হয়েছে এই টেকনোলজির অগাধ কল্যাণেই। হান্টিংটনের সেই ভবিষ্যৎবাণী বাস্তব হয়েছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কল্যাণেই।
যে বিধ্বংসী বিষয়-আশয় দেখার পর নিৎজে বলেছিলেন, ঈশ্বর মারা গেছেন। সেই অবস্থার পরিবর্তনের ফলে আরও এক নতুন পরিস্থিতিতে মানুষ আবার ধর্মকে বিশেষভাবে আঁকড়ে ধরেছে। মিথ বা জাদু; এরপর ধর্ম; এরপর বিজ্ঞান—এই যে ক্রনোলজি এখন আরও একটা নতুন বাস্তবতায় রূপলাভ করেছে। ভাষা, জাতীয়তাবাদ, কালচার বা সংস্কৃতির চেয়ে ধর্ম এখন বেশ বড় একটা পরিচয়-সূত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এর বহু কারণের মধ্যে একটা কারণ এই যে, শিল্পবিপ্লবগুলোর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ নানানভাবে মানবিক মূল্যবোধ এবং বাস্তব জীবনমুখী চিন্তা-আদর্শকে বিতাড়িত করেছে। ফলে মানুষের চিন্তা-আদর্শের ক্ষেত্র থেকে দূরে সরে গিয়ে ধর্মের বিষয়টা তার জায়গা দখল করে নিয়েছে। এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পরবর্তী সময়ে এই বিষয়টা আরও প্রকটতর হয়েছে। বিশেষ করে যে লিবারেল ডকট্রিনের পতন আগেই হয়েছিল ‘আধুনিক’ ডকট্রিনের কাছে; সেই পতনের ভার এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে এসে আরও বেড়ে গেছে।
৬
নতুন ধরনের নিঃসঙ্গতা নির্মাণে বড় ভূমিকা পালন করেছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। আধুনিক সময়কালের বিবরণে এবং এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়ায় যে নৈঃসঙ্গ্যচেতনার উদ্ভব হয়েছিল ইউরোপে, সেই একই প্রভাবের একটা ক্ষুদ্র গণ্ডিবদ্ধ নৈঃসঙ্গ্যতার বিষয় হয়েছিল এই অঞ্চলে। একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির ভিতরে ব্যক্তির উদ্ভব বিকাশ এবং তার সাথেই সম্পৃক্ত নৈঃসঙ্গচেতনার বিষয়টা কলকাতাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছিল। সেই নৈঃসঙ্গ্যচেতনার সাথে মানবিক নানান বিষয়ের সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এর পরবর্তী সময়ে যে ধরনের নৈঃসঙ্গ্যতার উদ্ভব হয়েছে, এই ধারার নৈঃসঙ্গ্যতা নানান কারণে পূর্ববর্তী ধারা থেকে একেবারেই ব্যতিক্রম। এর পূর্বে গোষ্ঠী জীবনের ভাঙনের ফলে পরিবার ছোট হয়ে একধরনের নাগরিক নৈঃসঙ্গ্যতার পটভূমি নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে সেই বিষয়ের আরও বহু বহু ফিউশন ঘটে গেছে। মানুষ আর সেই পারিবারিক প্রেক্ষাপটের ভেতরে নেই। মানুষ হয়ে পড়েছে আরও বিচ্ছিন্ন। মানুষের এই নৈঃসঙ্গ্যতা নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব দ্বারা প্রভাবিত নানান ধরনের টেকনোলজি। একই স্থানে দশজন মানুষ একত্র হওয়ার পরও তারা প্রায় প্রত্যেকেই হয়ে পড়ছে এক একটা ‘দূরবর্তী দ্বীপের’ মতো। কারণ, এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে হাতের অ্যান্ড্রয়েড ফোন। এই ফোনের ভিতরের নানান অ্যাপ মূলত ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির দূরত্ব তৈরি করছে। তা কেবল এক ফ্ল্যাট থেকে আরেক ফ্ল্যাটের লোকের দূরত্ব নয়। এই দূরত্ব একই ফ্ল্যাটের প্রত্যেক ব্যক্তিকে প্রত্যেক ব্যক্তি থেকে পৃথক করেছে। আর এইভাবেই এই সময়ের নৈঃসঙ্গ্যতার নির্মাণ সম্পূর্ণ হচ্ছে।
অর্থাৎ সামষ্টিক জীবন পার করে ব্যক্তির বিকাশের ভিতর দিয়ে যে নৈঃসঙ্গ্যতা নির্মিত হয়েছিল প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ভিতর দিয়েই, সেই নৈঃসঙ্গ্যতাই আরও প্রকট হয়ে আবির্ভূত হয়েছে বর্তমানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে। সামষ্টিক জীবনচেতনার বিলুপ্তি এবং গ্লোবালাইজেশনের প্রভাবে বৃহৎ পরিবারগুলোর ভাঙনের ফলে ছোট ছোট পরিবারের আবির্ভাব হয়েছিল। ফলে বিচ্ছিন্নতার বিষয়টা একটা নির্দিষ্ট বৃত্তে আবদ্ধ হয়েছিল। বর্তমানে তা আরও কয়েকটা ফিউশনের ভিতর দিয়ে প্রকটতর হয়ে উঠেছে।
৭
অর্থনৈতিক বিষয়-আশয় নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যেকোনো সমাজের পরিবর্তনের পেছনে আর্থ-উৎপাদনের নানান বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে এর ভেতরে উৎপাদন, বণ্টন এবং তা সঞ্চয়ের বিষয়-আশয়ও সম্পৃক্ত থাকে। ফলে এই বিষয় বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। সামন্ত সমাজে অর্থের গতিশীলতার অভাবে একধরনের নিশ্চল আর্থিক ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলেও, শিল্পবিপ্লবের ফলে উৎপাদনের বহুমুখীনতা বিশেষভাবে কার্যকর হয়ে পড়ে ব্রিটিশ উপনিবেশের কারণে। যে বিষয়, এই সময়ে এসে আরও গতিমান হয়েছে। বিশেষ করে অর্থের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে আদান-প্রদানের বিষয়টা এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে পৌঁছে গেছে। ‘মানি ফ্লুডিটির’ বিষয়টা নানান কারণে ভীষণভাবে গতি পেয়েছে। এক ন্যানো সেকেন্ডেই এখন এক স্থান থেকে আরেক স্থানে অর্থ বিনিময় সম্ভব হয়। এই বিষয়টা টেকনোলজির কল্যাণেই সম্ভবপর হয়ে উঠেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির চেয়েও দ্রুত ধাবমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে মানুষ এখন সময় পার করছে। অর্থাৎ গ্লোবাল ভিলেজের ধারণা আরও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এবং এই প্রভাব কেবলই অর্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়-আশয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। তা ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের আর সকল বিষয়-আশয়ের সাথে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিও এর বাইরে নয়।
বিনিময় প্রথাভিত্তিক আর্থিক যুগের পর নোট আবিষ্কার যেমন পুরোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে খারিজ করে দিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। ঠিক একইভাবে ইন্টারনেট ব্যাংকিং পূর্বের সকল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অচল করে দিয়েছে। মানুষকে এখন আর ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে টাকাপয়সার লেনদেনের মতো বিষয়টা করতে হয় না। মানুষ ঘরে বসেই এই কাজ করতে পারে। একটা সহজ কিন্তু সামান্য ভুলেই জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে—এমন একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে এখন মানুষ সময় পার করছে। এই বিষয়টা যে কেবল অর্থ-কড়ি আদান-প্রদান অর্থাৎ, ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যেই সীমাবদ্ধ—ব্যাপারটা এমন নয়। উৎপাদনের বিষয়ও এরই সাথে সাথে বদলে গেছে।
রোবটিকসের মতো বিষয় শ্রমের ক্ষেত্রে মানুষের সংযুক্ত হওয়ার সুযোগকে ক্রমশই সীমিত করে দিচ্ছে। কার্ল মার্ক্স যে শ্রমিকের হিসাব-নিকাশের ওপর ভিত্তি করে তাঁর অর্থনৈতিক আলাপের অবতারণা করেছিলেন, যে ‘সারপ্লাস ভ্যালুর’ কথা বলেছিলেন, সেই সমস্ত বিষয় এখন আর বোধ হয় বেশি দিন টিকবে না। কারণ, উৎপাদনের সাথে শ্রমিকের সম্পর্ক ক্রমশই সীমিত হয়ে আসছে। এই কারণে উৎপাদনে মার্ক্স শ্রমিকের ‘ভাগা’ নিয়ে যে আলাপ তুলে খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন এবং ‘প্রিমিটিভ’ যুগের সাম্যবাদী সমাজের উত্থানের স্বপ্ন দেখেছিলেন—তা বোধ হয় এখন আর হয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। কারণ, অর্থের আদান-প্রদান বলে নয়, উৎপাদন এবং উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ততায় মানুষের অবস্থা এখন আর তেমন বিবেচিত হবে না।
এই সমস্ত আর্থিক প্রক্রিয়া, এই যুগে, কোনো একটা শ্রেণিকে নিয়ে নয়। সমগ্র জনগণই এই প্রক্রিয়ার সাথে নানানভাবে জড়িত। ফলে উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের ফলে যে সামন্ততন্ত্র ভেঙে নতুন সামন্ততান্ত্রিক পরিস্থিতি তৈয়ার হয়েছিল। একই প্রক্রিয়ায় ক্ষুদ্র আকারে হলেও পরবর্তী সময়ে নগরায়ণ এবং শ্রমিক বস্তির মতো বিষয় গড়ে উঠেছিল। অর্থাৎ বর্ণভিত্তিক সমাজ ভেঙে কর্মভিত্তিক সমাজের সূচনা হয়েছিল। সেই প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘গণদেবতা’ উপন্যাসের চরিত্র নির্মাণ করেছেন। দেখিয়েছেন কীভাবে এই অর্থনৈতিক পরিবর্তন ভারতীয় আদিম পেশাগুলোতে নিয়োজিত মানুষকে কলকারখানা কিংবা ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হতে বাধ্য করে। এর কিছু পরে, সময়ের সাথে সাথে নতুন ধরনের সমস্যা তৈয়ার হয়। এখন তা আরও বেড়েছে। প্রথম যুগে শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে পিতার পুরোনো পেশাকেই কেবল ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। একটা বেকারত্বের বিষয়ও নির্মিত হয়েছিল।
কিন্তু বর্তমানে রোবটিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে অগ্রসরমাণ অবস্থা, তা যদি এইভাবে চলতে থাকে তো সামনের পরিস্থিতি যে খুব ভালো হবে না, তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। কম্পিউটার আবিষ্কারের ফলেই চাকরির বাজার অনেকটা সংকুচিত হয়েছিল। আর এখন তো রোবটিকস আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ। ফলে মানুষের শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জনের পথ ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে। যদিও সম্ভাবনা প্রচুর কিন্তু সেই সম্ভাবনা বাস্তব করার মতো দক্ষতা যে থাকা দরকার, তা কি আমরা এখনো অর্জন করতে পেরেছি? উত্তর হবে—না। কারণ, বিপুল জনগোষ্ঠী এই দক্ষতার অর্জনের ভিতরেই যেতে পারবে না। দক্ষতা অর্জনের জন্য যে সর্বনিম্ন জানা-শোনা দরকার, তা-ও নেই অনেকের। ফলে এই দক্ষতা অর্জনের সীমাবদ্ধতা এবং শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকারের সংখ্যা এবং ধন-বৈষম্য আগের চেয়ে প্রকট হবে। মূলত হচ্ছেও তাই। এই পরিস্থিতি ক্রমশই পরিবর্তন হবে। কিন্তু সেই সময় আবার নতুন বিপ্লবের আগমন হয়ে গেলে এই বিপ্লব অসম্পূর্ণই রয়ে যাবে।
৮
এই সবকিছু মিলিয়ে নেওয়ার পর একটা বিষয় বেশ স্পষ্টভাবে আলাপের প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে বাস্তবতা ও সাহিত্যের বিষয়টা। ক্ল্যাসিক যুগে সাহিত্যের যে নির্দিষ্ট বৃত্তের ভিতরে আবদ্ধ থাকার বিষয় ছিল, তা পরবর্তীকালে রোমান্টিক-আধুনিক যুগে এসে একটু কেন্দ্র আর একটা নির্দিষ্ট গতিপথ ধরে সামনে যাওয়ার বিষয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে এই বিষয়টা আরও নতুন দিকে মোড় নেয়। কেন্দ্র-চ্যুতি এবং নির্দিষ্ট বিষয়-আশয় থেকে বের হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারায় সাহিত্যিক কার্যক্রম নির্মিত হয় এই প্রক্রিয়ার বাস্তবতায়। এই প্রক্রিয়ায় নির্মিত হয় বাস্তববাদী চিন্তার হাইপাররিয়েল। যে বিষয় বাস্তবতাকে মেনে নানান ধরনের মাইমেসিস প্রক্রিয়াকেও উতরে গিয়ে নির্মাণ করে নতুন রিয়েলিটি—যা বিবেচিত হাইপার রিয়েল হিসেবে।
এই যে সোসাইটি এবং এর পারিপার্শ্বিকতার পরিবর্তন ঘটে, নিয়তই এবং বাস্তবতার নতুন ছাঁচ তৈরি হয়—এর ভিতর দিয়ে মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতিও বদলে যায়। ইলিশ মাছ বাস্তবে না খেয়েও এর চিহ্ন এবং গন্ধ সম্পৃক্ত প্যাকেটের অন্য বিষয়ও এই হিসাবের মধ্যে স্পষ্ট হয়। ফলে এই হাইপাররিয়েল যুগে, বাস্তবতা যেখানে চিহ্ন ও গন্ধের সাথেই বেশি জড়িত, সেইখানে কেবলই মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতিই সম্পৃক্ত নয়, একই সাথে তা সম্পৃক্ত সাহিত্যের সাথে। ফলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ যুগে সবই বদলে যেতে বাধ্য। যে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কার সমগ্র পৃথিবীতে প্রথম শিল্পবিপ্লব এনে দিয়েছিল, সেই বিপ্লব যেভাবে মানুষ এবং তার পরিপার্শ্বকে পরিবর্তিত করে দিয়েছে, তেমনি করে এর পর-পর ঘটে যাওয়া আন্দোলনগুলোও অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
এই প্রসঙ্গে আর একটি আলাপ সেরে নেওয়া যাক। ‘কাগুজে বাঘ’ নয়, ‘কাগুজে বই’ নিয়ে। সম্প্রতি বই-পত্রের আর তেমন বাজার নেই। তার জন্য চারপাশে ন্যাকা কান্নারও অভাব নেই। কিন্তু মানুষের বই কিনে বই পড়ার সময় কি আর আছে? শুনুন, এ ক্ষেত্রে ‘লিবারেল জমানার’ কথা একদম ভুলে যান। সেই সব দিন আর নাই। ‘আধুনিক যুগে’ এই বিষয়ে যে বিষয়-আশয় সম্পাদিত হয়েছিল, তা একেবারেই ভিন্ন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহাচিত্রের হিসাব-নিকাশ সম্পূর্ণ করার পর এই বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মানুষের অবসর সময়ের জীবন-যাপন কেমন ছিল। যেহেতু চারদিকের নানান প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তখনো মানুষের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ঠিকঠাক রূপ পায়নি। ফলে মানুষ ইচ্ছে করলেও সেই পরিস্থিতি বদলে ফেলতে পারেনি। এরই ফলে গাল-গপ্পের মতো মনে হওয়া বর্তমানের রূপকথার সৃষ্টি হয়েছে। মিথিক প্রকল্পও সেই সময়কার মানুষের দ্বারা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সেই অলৌকিকতার যুগ পার করে কৃষি সভ্যতার সূচনায় যে গোষ্ঠীনির্ভর সমাজ তৈরি হয়েছিল সেই সমাজেও সাহিত্যের উৎপাদন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। যার ফলেই সামন্ততান্ত্রিক সমাজনির্ভর সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ।
কিন্তু এই সব বাদ দিলাম। বর্তমানে নানান মাধ্যমে লোকজন বলাবলি করে, লোকজনের ড্রয়িংরুমে কেন বইয়ের তাক নেই—বিষয়টা গায়ে জ্বালা ধরায়। পিছনের সবই ভালো—এমন একটা কথা বৃদ্ধ-সমাজে চিরন্তন সত্যের মতো স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু সময় বদলালে, প্রগতির সংজ্ঞা বদলে গেলে যে সবই বদলায়, সে কথা বৃদ্ধদের মনে রাখা উচিত, তা যতই ভীমরতির মধ্যে পড়ুক না কেন বৃদ্ধরা। ড্রয়িংরুমের বইয়ের তাকের কথা বলছিলাম। তো আরও কিছু বিষয় রয়েছে। যে মানুষ স্বভাবতই অলস। তার নিত্য কাজের বাইরে অবসরে সে কেন খেটেখুটে আনন্দ নেবে? এর কোনো মানেই হয় না। তাই বই পড়ে গল্প-কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধ পাঠ করে মস্তিষ্ক চালনা করে অবসর কাটানোর মতো আপাতকঠিন কাজকে কেন সে গ্রহণ করবে। যেখানে এর বিপরীতে ফেসবুকের স্ক্রলিংয়ে যেহেতু তার কোনো কষ্ট নেই। আবার ‘চোখের বালি’ উপন্যাস পাঠ করার বদলে আরামসে যদি ‘চোখের বালি’ সিনেমা দেখে একই স্বাদ পাওয়া যায় তবে, কে যাবে ওই সব ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটে? কোনোই দরকার দেখা যায় না। ব্যাপারটা হচ্ছেও তাই।
৯
এই সব আলাপ শেষে আরেকটু কথা বলা যাক। ইউরোপের রেনেসাঁ কিংবা মডার্নিটির সাথে বাংলা অঞ্চল ঠিকঠাক খাপ খাইয়ে চলতে না পারলেও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সাথে একই সময়ে একই সাথে চলতে পারছে, তা যেভাবেই হোক না কেন। কারণ, ভূমি-সম্পৃক্ত পূববর্তী শিল্পবিপ্লবের সাথে একটা দূরত্ব ছিল। কারণ, পূর্ববর্তী শিল্পবিপ্লবগুলোর সাথে ভূমির একটা বড় সম্পর্ক ছিল। ফলে একটা দূরত্ব কিংবা পিছিয়ে থাকার বিষয়টা হয়ে গেছে। কিন্তু বর্তমানে, পূর্ববর্তী শিল্পবিপ্লবগুলোর প্রভাবের সাথে, পরিবর্তনের সাথে যে দূরত্ব ছিল, তা গ্লোবালাইজেশনের পরবর্তী এই যুগে একই সমান্তরালে তৈয়ার করা অনেকটাই সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর এই পরিবর্তনের বিষয়টা একত্রে চলেছে। এর সাথে খাপ খাইয়েও নিয়েছে এই অঞ্চল। সাহিত্য যেহেতু অন্যান্য যুগের পরিবর্তনের ধার ধেরে চলেছে, ঠিক একইভাবে এই সময়ের পরিবর্তন এবং তার প্রভাবের ধার না ধেরে এর কোনো উপায় নেই।
পূর্ব-বাংলা বৈশ্বিক হিসাবে সবদিক ঠিকঠাক রেখে পূর্ববর্তী তিনটি শিল্পবিপ্লব ঠিকঠাক ধরতে পারে নাই। কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লবটা ঠিকই ধরতে পেরেছে। এমনকি প্রাচীন ও মধ্যযুগের বিবেচনায়ও তিন তিনটি শিল্পবিপ্লব বাদেও কেন্দ্র থেকে দূরবর্তীতে অবস্থান ছিল পূর্ব-বাংলার। ফলে মূল লাগামটা ধরতে ব্যর্থ হয়েছে পূর্ব-বাংলা। নির্দিষ্ট কেন্দ্র না থাকার জন্য এই সমস্যাটা হয়েছে প্রকট। কেন্দ্রের এই একপেশে ভৌগোলিক অবস্থান এই বিষয়কে বিশেষভাবে স্পষ্ট করেছে। পূর্ব-বাংলার ভূমিরেখার নানান বিষয় এ ক্ষেত্রে বিশেষ হয়েছে। কারণ, কাঁচামালের জোগানদাতা পূর্ব-বাংলা নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পিছিয়ে গেছে। আদতে পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে।
কলকাতার আধুনিকায়ন ছিল এক অর্থে প্রলম্বিত। সেই প্রলম্বিত আধুনিকতা থেকেও বঞ্চিত হয়েছে পূর্ব-বাংলা। যে ধরনের রেনেসাঁস, মডার্নিটির কথা তুলে বেশ গর্বের সাথে ঢেকুর তুলতে দেখা যায় লোকজনকে। আদতে তার তেমন কোনো শক্ত শিকড় ছিল না। আবার এই আধুনিকায়ন একটি ক্ষুদ্র গণ্ডির ভিতরে সম্পাদিত হয়েছে। একটা নির্দিষ্ট অঞ্চল নিয়ে এই আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া সংগঠিত ও সংঘটিত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির লোকজন। আবার এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে নাই এমন লোকের সংখ্যা ঢের। ফলে ভারতীয় স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থার অস্তিত্ব সে সময়ও টিকে ছিল। আবার এই সমস্ত প্রক্রিয়া থেকে যোজন-যোজন দূরে অবস্থান ছিল পূর্ব-বাংলার।
কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের হিসাবটা একেবারেই ভিন্ন প্রক্রিয়ায়। বিশেষ করে এই বিপ্লবের সম্পাদন মাধ্যমে ভূমি কিংবা অন্যান্য মাধ্যমের বিষয়-আশয় গুরুত্বপূর্ণ নয়। আবার যে ধরনের প্রযুক্তির দরকার, তা-ও একদম ঠিকঠাক তৈয়ার হয়েই আসে। কোনো ঝামেলা ছাড়াই, কেবল চালালেই চলে। বৃহৎ বিনিয়োগ কিংবা বৃহৎ প্রযুক্তির তৈরির বিষয় আর স্থির নাই। যুগের পরিবর্তনে সময় যেমন ন্যানো সেকেন্ডে বিভক্ত হয়ে গেছে, ঠিক একইভাবে প্রযুক্তির বিষয়-আশয়ও বেশ ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়েছে। এই বিষয়টা, আগেও বলেছি, ভূমি বা অন্যান্য প্রায়োগিক বিষয়-আশয়ের সাথে সম্পৃক্ত থাকে না।
১০
সর্বশেষ আরও কিছু কথা বলে শেষ করতে হবে। যেকোনো পরিস্থিতি নির্মাণের জন্য দরকার একটা কার্যকর পরিপ্রেক্ষিত। বাংলাদেশ যে পরপর তিনটি শিল্পবিপ্লব ঠিকঠাক ধরতে পারে নাই, এর কারণ কী? তা পূর্বে বলা হয়েছে। আর এই ধরতে পারা বা না পারার জন্য যে ধরনের বৈধতার দরকার, তা কি বাংলাদেশের ছিল? এমনকি কলকাতার যে সমালোচনা করা হয়—যে কলকাতায়ও ঠিকঠাক এই বিষয় হয়ে ওঠে নাই, তারও কি বৈধতা আছে? এই বিষয়ে একটা কথা বলা প্রয়োজন, যে ধরনের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষে এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে পশ্চিম এই পর্যন্ত চার চারটি শিল্পবিপ্লব করে ফেলল, তার সামান্যতম অংশ কি এই অঞ্চলের ছিল? এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ছিল তো অনেক কিছুই, কিন্তু বিদেশি ঔপনিবেশিকের পাল্লায় সব গোল্লায় গেছে। সেটাও একটা যুক্তি। কিন্তু আসল বিষয়টা হলো কলকাতায় যদিও প্রলম্বিত রেনেসাঁ বা ‘আধুনিকায়নের’ বিষয়টা হয়েছে, পূবে তার ছিটেফোঁটাও ছিল না। ফলে বর্তমান বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়েছিল। কিন্তু এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিষয়টা মোটামুটি করে উঠতে পারবে বলে মনে হয়।
কিন্তু কেবল করে উঠলেই তো হবে না। কোনো ঐতিহ্যের ভিতর দিয়ে কোনো নতুন ইতিহাস নির্মাণের বিষয়টা রয়ে যায়। বর্তমানে যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, সেই পরিস্থিতিতে পূর্বের ঠিকঠাক পরিপ্রেক্ষিত না থাকায় সবচেয়ে বড় সংকটটা হয়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত সংকট। এ ছাড়া হঠাৎ যে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং জনসাধারণের তা ব্যবহার, তার জন্য যে ধরনের পূর্ব প্রস্তুতি এবং পরিবেশ দরকার, তা এই অঞ্চলে গড়ে ওঠেনি। এমনকি প্রযুক্তি ব্যবহারের মতো প্রয়োজনীয় শিক্ষার পাটাতনটিও নির্মাণ করা সম্ভব হয় নাই এই অঞ্চলে। ফলে হঠাৎই এই প্রযুক্তিগত বিষয়-আশয়, যা নির্মিত ও সহজলভ্য হয়েছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে, এক অর্থে যেমন উপকারী, তেমনি আরেকটা বৃহৎ অর্থে তা খুবই ক্ষতিকর। কারণ, প্রযুক্তিগত এই উন্নয়নের বিপরীতে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গোড়াটা কাটা পড়ে যাচ্ছে। এই বিষয় একবার বিশেষভাবে ভাবার দরকার আছে। কারণ, কেবলই একটা বিষয় পেয়ে ‘ধিতান-ধিতান-ধিতান-তি...’ করে নাচার আগে ভাবনাটাও জরুরি। অর্থাৎ চতুর্থ শিল্পবিপ্লব-উদ্ভূত বিষয়-আশয় ব্যবহার এবং তার ইতিবাচক-নেতিবাচক ক্রিয়াকলাপ ও প্রভাব সম্পর্কেও সচেতন থাকতে হবে।