স্মৃতির পাতায় কিংবদন্তি জসীমউদ্দীন
গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকে আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। আমার পাঠ্য ছিল জসীম উদ্দীনের নক্সি-কাঁথার মাঠ কাব্যের একটি অংশ। কবিতার নাম ‘চাষার ছেলে’। আমাদের প্রধান শিক্ষক শামসুল হক কবিতাটি পাঠ করতে থাকলেন— ‘এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে, লম্বা মাথার চুল,/ কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল।’ পাঠ শেষ করে তিনি কবিতাটি বুঝিয়ে দিলেন। পরে স্যার বললেন, কবি জসীম উদ্দীনকে তিনি কোনো একটি অনুষ্ঠানে দেখেছেন। তাঁর মুখে কবিতা শুনেছেন। সে মুহূর্তে আমার মনে হলো, স্যার কত সৌভাগ্যবান। জসীম উদ্দীনকে দেখা সে তো একটা বিরাট ঘটনা। আহা, আমি যদি একবার কবিকে দেখতে পেতাম।
আমাদের স্যার শামসুল হক নিজেও কবিতা লিখতেন। আমাদের পড়াতে গিয়ে তিনি ‘জাতিসংঘ’ সম্পর্কে কয়েক লাইন কবিতা লিখলেন। তিনি কবিতা পড়াতে গিয়ে বিভিন্ন কবি সম্পর্কে আলোচনা করতেন। স্যার দেশাত্মবোধক গানও লিখেছেন। আমার প্রধান শিক্ষকের লেখালেখি আমাকে কবিতার প্রতি আগ্রহী করে তোলে। আগে কবি দেখিনি, স্যারকে আমার কবি বলে মনে হতো।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি, তখন কোনো একদিন ‘শরৎ’ নামের একটি কবিতা লিখলাম। চলল আমার কবিতা লেখা। পাঠ্যপুস্তকে প্রকাশিত কবিতাগুলোর অনুসরণে লেখা হয়েছিল সেসব কবিতা। সে সময়কার লেখা—তালগাছ, সন্ধ্যা, নীল পাখি, অমঙ্গল, সন্ধ্যা নামে, ফাঁকি প্রভৃতি কিশোর কবিতা লেখা হয়েছিল উচ্চবিদ্যালয়ে পড়া শেষ করার আগেই। এসব কবিতায় পাঠ্যপুস্তকে প্রকাশিত কবিতার প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে জসীম উদ্দীনের বাচনভঙ্গি, তাঁর আঁকা মাঠ-ঘাট, নদী-চর, রাখাল-চাষা প্রভৃতি বিষয়ের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় এসব কবিতায়।
ছেলেবেলা সীমিত পরিমণ্ডলে ছিল আমার জীবন যাপন। না ছিল একটা রেডিও, না দেখেছি পত্রিকা। কেবল পাঠ্যপুস্তকে কবিতা পড়ে ভাবে-আবেগে আপ্লুত হয়েছি। অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে দেখেছি আমার চারপাশের পরিবেশ ও প্রকৃতি। ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। তত দিনে আমার অনেক কবিতা পড়া হয়ে গেছে। জসীম উদ্দীনের রাখাল ছেলে, কবর, পল্লী জননী, উড়ানীর চর, ধানখেত, পল্লী বর্ষা, নিমন্ত্রণ, বছিরদ্দি মাছ ধরিতে যায় প্রভৃতি কবিতা পড়েছি বেশ মন দিয়ে। জসীম উদ্দীন আমার প্রিয় কবি হয়ে উঠলেন।
২
আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হলো। বরিশাল থেকে বিকেলের লঞ্চে গ্রামে চলে যাব। শুনলাম মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে কবি জসীম উদ্দীন আসবেন এই শহরে। টাউন হলে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠান আগামীকাল। বাবাকে জানালাম কথাটা। সেদিন বাড়ি যাওয়া হলো না।
পরদিন টিকেট নিয়ে ঢুকে পড়লাম টাউন হলে। কবি জসীম উদ্দীনকে দেখার জন্য যতটা সম্ভব সামনে আসন নিলাম। অনুষ্ঠানে একে একে বক্তৃতা এবং গান চলতে থাকল। ধৈর্য ধরে প্রতীক্ষা করছি কবিকে দেখার জন্য। না, কবিকে মঞ্চে দেখা গেল না।
কবি আজ মঞ্চে আসবেন না—এমনটাই জানা গেল। তবে অজুহাত দেখানো হলো, তাঁর শরীর ভালো নেই। দর্শক-শ্রোতা অস্থির হয়ে উঠলেন। তাঁরা চিৎকার করে বললেন, আমরা কবিকে দেখতে চাই—কবিকে দেখতে চাই। হইচই শুরু হয়ে গেল।
অবশেষে কবি জসীমউদ্দীন এলেন মঞ্চে। দর্শক-শ্রোতা উৎফুল্ল হলেন। কবি পথের ক্লান্তি এবং শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে দু-চার কথা বলে বিদায় নিলেন। অনুমান করলাম, পরদিন কবিকে নিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনা করা হবে—এটাই ছিল আয়োজকদের লক্ষ্য।
সে সময় আমার সাক্ষাৎ হলো আমাদের এলাকার এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি বললেন, আমি কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কথা বলতে চাইলে তিনি সে ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। যে হলে ওঠানো হয়েছে কবিকে সেখানে নিয়ে যেতে পারেন। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কবির সঙ্গে কথা বলার সেই সুযোগ গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না।
সেদিন কবি জসীম উদদীনের যে জনপ্রিয়তা আমি দেখেছি, তা সত্যি বিস্ময়কর। তাঁকে সেদিন দেখলাম এবং তৃপ্ত হলাম।
৩
উনিশ শ’ পয়ষট্টি সালে আমি বি.এ. পাস করি। ঢাকায় আমার বড় ভাই ওবায়েদ উল্লাহর বাসায় উঠি। আমরা বড়ভাইকে ডাকি মিয়া ভাই। ঢাকায় আসার উদ্দেশ্য ছিল উচ্চ শিক্ষা লাভ, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং সাহিত্যচর্চা। বছরের শেষের দিকে একদিন পত্রিকায় পড়লাম, কবি জসীমউদ্দীনের বাসভবন ‘পলাশ বাড়ী’তে সাহিত্যসভার আয়োজন করা হয়েছে। খবরটা পড়ে আমি খুবই অনুপ্রাণিত হলাম। অপরাহ্নেই চলে গেলাম কমলাপুরে কবি জসীমউদ্দীন রোডে।
কবির বাসভবনের গেটে পৌঁছে দেখলাম, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন দরজায়। গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি, পরনে পায়জামা। চুল তাঁর এলোমেলো। আমার হৃদয়ে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। তিনি আমাকে দেখেই হাসিমুখে বললেন, এই যে আমাদের তরুণ সাহিত্যিক এসে গেছে। এসো-এসো। আমি তো অবাক, আমাকে কোনোদিন দেখেননি কবি, কী করে এমন স্বাগত জানালেন। যেন আমি তাঁর কতকালের চেনা।
কবি আমাকে নিয়ে তাঁর ড্রয়িংরুমে বসালেন। কিছু্ক্ষণের জন্য ভেতরে গেলেন তিনি। আমি সোফায় বসে বসে তাঁর ড্রয়িংরুমে সাজানো শিল্পকর্ম দেখতে লাগলাম। শিকেয় বাঁধা মাটির আম, কাঁঠাল, পেঁপে ঝুলছে। দেয়ালে লাগানো রয়েছে কাঠের তৈরি নানা শিল্পকর্ম। গরু নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে রাখাল বালক। শো-কেসের একপাশেও এ ধরনের শিল্পকর্ম দেখা গেল।
জসীমউদ্দীন © ছবি: অ্যালেন লোম্যাক্স । সূত্র: কেনিফার এ কাটিং, আমেরিকান ফোকলোর সেন্টার। উইকিপিডিয়ার সৌজন্যে
কবি এলেন। বসলেন আমার কাছাকাছি। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম একটি মোটা খাতা। পত্রিকায় আমার যেসব লেখা ছাপা হয়েছে, সেগুলো সেঁটে রেখেছি এই বিশাল আয়তন খাতাটিতে। ওটা ফুলে বেশ মোটাসোটা হয়েছে। খাতাটি তুলে দিলাম কবির হাতে। কবি পাতা উল্টে দেখতে দেখতে দু-একটি ছড়া পড়লেন। কথায় কথায় বললেন, অনেকের ধারণা এমনিতেই সাহিত্য সৃষ্টি হয়ে যায়। আসলে তা নয়। এজন্য যথেষ্ট সাধনা করতে হয়। ছন্দ শিখে নিতে হয়। আয়ত্তে আনার চেষ্টা করতে হয়।
কবির সঙ্গে যখন আলাপ করছি তখন একে একে নবীন-প্রবীণ লেখকরা সাহিত্যসভায় হাজির হতে থাকলেন। সেদিন যাঁরা সভায় এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তরুণ ও নবীণ লিখিয়েদের সংখ্যাই ছিল বেশি। শুরু হলো সাহিত্যসভা। লেখকরা একে একে ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ পাঠ করলেন। আমিও একটি লেখা পাঠ করেছিলাম। তারপর এলো আলোচনার পালা। এক পর্যায়ে কবি আমাকেও কিছু বলতে বললেন। আমি শিশু সাহিত্যের সমস্যা নিয়ে কিছু বলেছিলাম। আগেই এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সেদিনের সভার বক্তব্যে বলেছিলাম, আমাদের শিশুদের পাঠ্যপুস্তকগুলো পুরনো যুগের ছড়া-কবিতা বা অন্যান্য রচনায় পরিপূর্ণ। এসব লেখা পড়ে আমাদের শিশুরা পুরনো ভাবধারায় গড়ে ওঠে। আধুনিক সাহিত্যের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয় না। শিশু-কিশোর মানসে আধুনিকতার পরশ দেওয়ার জন্য তাদের পাঠ্যপুস্তকে নতুন ধাঁচের ছড়া-কবিতা-গল্প প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমার বক্তব্য নবীন-প্রবীণ অনেকের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল। আমি বুঝতে পারলাম, পুরনো ও নতুন—উভয় ধরনের লেখাই রাখতে হবে পাঠ্যপুস্তকে।
আলোচনা শেষে এলো চা, কেক। চা পর্ব শেষ হলো। সেদিনের মতো শেষ হলো আমাদের সাহিত্যসভা। না, শেষ নয়। শুরু হলো আমার জীবনের একটা নতুন অধ্যায়।
তারপর কতদিন যে অংশ নিয়েছি সাহিত্য সাধনা সংঘের সভায়, তার হিসাব রাখিনি। প্রতি রোববার পালা করে সাহিত্যসভা বসতো কমলাপুরে কবি জসীমউদ্দীন, ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন এবং জিয়াউল হকের বাড়িতে। তাঁদের তিনজনের বাড়ি কমলাপুরে কবি জসীম উদদীন রোডে পাশাপাশি অবস্থিত। নাগরিক কোলাহল থেকে খানিকটা দূরে গাছের ছায়ায় ঢাকা এই তিনটি বাড়িই আমার বেশ ভালো লাগত। শান্ত-স্নিগ্ধ-শ্যামল পরিবেশ কার না ভালো লাগে।
সাহিত্য সাধনা সংঘের এই সভাটির প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল আমার এবং আমার মতো বহু তরুণের। দেখতাম কয়েকজন প্রবীণ কবি-সাহিত্যিকও এখানে আসতেন বেশ আগ্রহের সঙ্গেই। এ পর্যন্ত কোনো সাহিত্যসভাই এমন আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারেনি আমার মধ্যে। সারাটা সপ্তাহ অপেক্ষা করতাম, কবে আসবে রোববার। কখন যাব সাহিত্যসভায়। ছড়া, গল্প বা প্রবন্ধ তৈরি করে রাখতাম সভায় পাঠ করা জন্য। ঢাকায় বেকারজীবনে কিংবা চাকরিজীবনে দীর্ঘদিন এই অভ্যাস বজায় রেখেছি আমি। কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও ভুলে যাইনি সাহিত্যসভায় যাওয়ার কথাটি।
সাহিত্য সাধনা সংঘের সাহিত্যসভায় প্রবীণদের মধ্যে যাঁদের দেখেছি, তাঁরা হলেন জসীমউদ্দীন, কবি আজিজুর রহমান, কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন, ড. কাজী দীন মোহাম্মদ, অধ্যাপক আহমদ শরীফ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, আকবর হোসেন, দেওয়ান আবদুল হামিদ, ডাক্তার মোহাম্মদ হোসেন, জিয়াউল হক, জহিরুল ইসলাম, অধ্যাপক মহীউদ্দীন প্রমুখ। শহীদুল্লা কায়সারকেও একবার দেখেছি এই সভায়। আরো দেখেছি কবি আশরাফ সিদ্দিকী ও শিশু সাহিত্যিক সাজেদুল করিমকে।
ওই সময়ে যেসব তরুণ উপস্থিত থাকতেন ও লেখা পাঠ করতেন, তাঁরা হলেন—ভূঁইয়া ইকবাল, আলী ইমাম, রফিক সন্যামত, আবু সালেহ, রশিদ সিনহা, সুকুমার বড়ুয়া, শাহজাদ ফিরদাউস, কাজী সালাহউদ্দীন, দাউদ হায়দার, সালেহ আহমদ, শাহাদাত হোসেন বুলবুল, এম.এ. মজিদ, অনু ইসলাম, শেখ তোফাজ্জল হোসেন, সিরাজ উদ্দীন আহমদ, আবু বাকার, ইন্দু সাহা প্রমুখ। এছাড়া কবি আল মাহমুদ, কাজী রোজী এবং মাহবুব তালুকদারকেও এখানে দেখেছি।
আমি সাহিত্য সাধনা সংঘের বিভিন্ন সভায় আমার পরবর্তীকালে প্রকাশিত ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ পাঠ করেছি। আমাদের লেখার সমালোচনা করতেন জসীমউদ্দীন, আজিজুর রহমান, অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন, দেওয়ান আবদুল হামিদ, ডাক্তার মোহাম্মদ হোসেন প্রমুখ। প্রবীণদের আহবানে সাড়া দিয়ে তরুণদের মধ্যেও কেউ কেউ সমালোচনায় অংশ নিতেন। মাঝে মধ্যে আমিও সমালোচনায় অংশ নিতাম। আমার গল্প বিশেষ করে ছড়াগুলো সমালোচকদের বেশ প্রশংসা অর্জন করেছিল।
বিভিন্ন সাহিত্য সভায় সভাপতিত্ব করতেন কবি জসীমউদ্দীন, কবি আজিজুর রহমান, আকবর হোসেন, অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন, দেওয়ান আবদুল হামিদ, ডাক্তার মোহাম্মদ হোসেন, জিয়াউল হক, জহিরুল ইসলাম প্রমুখ। কবি সুফিয়া কামাল, মুনীর চৌধুরী ও অধ্যাপক আহমদ শরীফকেও সভাপতিত্ব করতে দেখেছি সাহিত্য সাধনা সংঘের সভায়।
এই সংগঠনের সাহিত্যসভায় গ্রাম থেকে এসে লোককবিরাও অংশ নিতেন। কবি জসীমউদ্দীন তাদের বড় সমাদর করতেন। কখনো কখনো একজন লোককবিকে বসিয়ে দিতেন সভাপতির আসনে। এভাবেই তিনি একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ অধ্যাপকদের সমাদর করতেন অন্যদিকে সমাদর করতেন গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত লোককবিদের।
একবার আমার ‘পর’ গল্পটি পাঠ করেছিলাম সাহিত্য সাধনা সংঘের সাপ্তাহিক সভায়। এই গল্পটিতে ছিল পল্লির কয়েকটি নিসর্গ চিত্র। আর ছিল মা ও ছেলের মর্ম বিদারী কান্নার বিবরণ। গল্পটি এরকম: স্বামী পরিত্যক্তা এক নারীর বিয়ে হয়ে গেল অন্যত্র। সেখানে গিয়ে হাজির হলো তার একমাত্র পুত্রটি। মা তাকে গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরে। এমন সময় নতুন স্বামীকে আসতে দেখে সে দুর্ব্যবহার করে সরিয়ে দেয় ছেলেটিকে। সেই ছোট্ট ছেলেটি বাগানের ভিতর দিয়ে হাঁটতে থাকে। বাঁশের শুকনা পাতাগুলো পায়ের তলায় পড়ে মচমচ করে ভেঙে যায়। কবি শুনতে শুনতে আহা-হা বলে ছেলেটির জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, অপূর্ব হয়েছে গল্পটি।
পরে তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন, মাহমুদউল্লাহ, তুমি গ্রামে-শহরে, হাটে-বাজারে, এখানে সেখানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করবে। সাহিত্যের অনেক উপাদান পাবে। কেবল গল্প নয়, তিনি আমার ছড়াগুলোও মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। আমাকে অনুপ্রাণিত করতেন।
না, তিনি আমার লেখার কেবল প্রশংসা করেছেন তা নয়, মাঝে মাঝে যথাযথ সমালোচনাও করেছেন। দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম আমি। সে সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা পাক-ভারত যুদ্ধ। প্রবন্ধটি পড়েছিলাম সাহিত্য সাধনা সংঘের সভায়। অমনি পড়ে গেলাম জসীমউদ্দীনের সমালোচনার মুখে। তিনি মতামত দিলেন, এত অল্প বয়সে যেন এ ধরনের বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ না লিখি। তাছাড়া, দ্বিজাতিতত্ত্ব বা বাংলা ভাষার বিভাজনকে তিনি সুনজরে দেখেননি।
জসীমউদ্দীনকে নিয়ে স্মারক ডাকটিকেট
৪
আরেকদিনের কথা, জিয়াউল হক সাহেবের বাসায় আমি ‘বজ্র’ নামের একটি স্বরচিত গল্প পড়েছিলাম। এই গল্পটিই ‘সেদিন বিকেলে’ নাম দিয়ে পত্রিকায় ছাপা হয়। গল্পটি শুনে জসীমউদ্দীন বললেন, দ্যাখো, দিন দিন তোমার অবনতি ঘটছে। এই বলে তিনি আমার ‘পর’ গল্পটি কথা উল্লেখ করলেন, আহা কত সুন্দর সে গল্পটি।
আমি বর্তমান গল্পটির কঠিন সমালোচনা সহ্য করতে না পেরে খানিকটা অসংযত হয়ে বলে ফেললাম, আপনি পল্লিকবি, তাই পল্লিসমাজ নিয়ে লেখা সাহিত্য আপনার ভালো লাগে। শহুরে সাহিত্য আপনি বুঝতে চান না। আমার এ কথায় তিনি কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু আমার ওপর রাগ করেননি। অচিরেই এক সাহিত্যসভায় সাক্ষাৎ হলে তিনি সহজভাবে আমার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। শান্ত কণ্ঠে আমাকে বুঝিয়েছিলেন, যান্ত্রিকভাবে বলা ঘটনা বা কাহিনী মাত্রই সাহিত্য নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি সাহিত্যের রস ও প্রাণ সম্পর্কেও আমাকে কিছু বলেছিলেন। কবির সঙ্গে খানিকটা রূঢ় আচরণের জন্যে আমি খুবই দুঃখিত ও ব্যথিত হয়েছিলাম। তিনি একজন বড় মাপের কবিই ছিলেন না, ছিলেন বড় মাপের মানুষও। বাংলা সাহিত্যের মৌলিক কবিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের পরে যাঁর স্থান, তাঁর সঙ্গে কত সহজেই না সংলাপ ও তর্কে মগ্ন হয়েছি। আসলে তিনিই সেই অধিকার দিয়েছেন। আমার মতো ক্ষুদ্র এক লিখিয়েকে তিনি ছোট করে দেখেননি। কারণ তিনি ছিলেন মহান হৃদয়ের অধিকারী বিশ্বমানের একজন কবি।
অনেক সময় আমি গল্পের খসড়া পাঠ করতাম সাহিত্যসভায়। লেখার মধ্যে কাটাকুটি থাকত। বিতিকিচ্ছিরি লেখা পড়তে বেগ পেতে হতো। একবার কবি রাগ করে বলেছিলেন, এরপর তুমি ভালো করে লিখে আনবে, কাটাকুটি চলবে না। কবির কথায় সভায় উপস্থিত কবি-সাহিত্যিকের মধ্যে আমি লজ্জা পেলাম। এ প্রসঙ্গে কবি নিজের হাতের লেখারও সমালোচনা করলেন। তাঁর হাতের লেখা বোঝা ছিল কষ্টসাধ্য।
কবি লক্ষ করেছেন, আমার উচ্চারণে গ্রাম্যদুষ্টতা থাকত। প্রায়ই তিনি আমার উচ্চারণ সারবার তাগিদ দিতেন। একবার কমলাপুর বুদ্ধ মন্দিরের দিকে যেতে যেতে তিনি আমাকে বললেন, দ্যাখো, তুমি তোমার উচ্চারণ সেরে ফেলো। যদি প্রফেসর হও, তা হলে ভারি অসুবিধায় পড়বে। অবশ্য এরপর খুলনায় এক বছর কাটিয়ে যখন ফিরে আসি ঢাকায়, সাহিত্যসভায় লেখা পাঠ করার পর কবি বলেছিলেন, তোমার ভাষা ও উচ্চারণে আজকাল কলকাতার সুর শুনছি। তোমার উচ্চারণের উন্নতি হয়েছে।
খুলনায় আমার চাকরি হয়েছিল। যাওয়ার সময় কবিকে জানাতে পারিনি। তিনি খুলনায় আমার খোঁজ নিয়েছিলেন সুন্দরবন বিষয়ে ইতিহাস লেখক ও আইনজীবী আ.ফ.ম. আবদুল জলিলের কাছে। জলিল সাহেব হাসিমুখে বলেছিলেন আমাকে, কবি জসীমউদ্দীন খুঁজেছেন আপনাকে। সেদিনও বুঝেছিলাম, ইনি সাধারণ মানুষ নন। মহান হৃদয়ের অধিকারী একজন মহামানুষ। তা না হলে আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তিকে খুঁজতে যাবেন কেন? জানি না, আজকাল সমাজে এমন মানুষ ক’জন আছেন।
খুলনা থেকে ঢাকা ফিরে আসার পর আবার কবির সঙ্গে দেখা কমলাপুরে তাঁর বাসভবনে এক সাহিত্যসভায়। সেদিন তিনি আমাকে পেয়ে আনন্দে-খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিলেন, যেন পিতা খুঁজে পেয়েছেন তাঁর হারানো পুত্রকে। আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। খুলনা বসেই রচনা করেছিলাম কিশোর উপন্যাস ‘মেঠো পথ’। এই উপন্যাসের একটা অংশ পাঠ করেছিলাম এই সভায়। তিনি এক পর্যায়ে সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, শুধু মাহমুদউল্লাহর ‘মেঠো পথ’ শোনার জন্য একদিন সাহিত্যসভা বসবে। তাঁর এই ঘোষণা ছিল আমার জন্য একটি বিরাট গৌরবের বিষয়। তবে সেভাবে সভার আয়োজন করা হয়ে ওঠেনি।
সাহিত্যসভা ও নানা স্থানে অনেকবার দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। এত দীর্ঘ বর্ণনা দেয়া কি সম্ভব? দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একবার মতিঝিলের একটি সড়কে সাক্ষাৎ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। সকাল বেলা হাঁটছিলেন তিনি। আমিও হাঁটছিলাম তাঁর সঙ্গে। তিনি গল্পে গল্পে সাহিত্যে নারীর রূপ বর্ণনা থেকে শুরু করে কাজী নজরুল ইসলামের ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘটনা বলে যাচ্ছিলেন। তিনি এমনভাবে বলে যাচ্ছিলেন, আমি যেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং জসীমউদ্দীনের সমবয়সী। আসলে এক অর্থে আমি তাঁদের সমবয়সীই। কারণ সাহিত্যের প্রতি আমার ভালোবাসা তাদের যুগেই পড়ে রয়েছে। আমার মন বসবাস করছে তাঁদের সঙ্গে।
তরুণ জীবনের শুরুতেই নতুন যুগকে স্বাগত জানিয়েছি। সাহিতচর্চায় সমাজ ও রাজনীতি মনস্ক হয়েছি। নতুনকে বরণ করতে গিয়ে ভুলে যাইনি পুরনোকে। কবি জসীমউদ্দীন ভাস্বর হয়ে থাকবেন আমার স্মৃতিতে।