অদৃশ্য বৃদ্ধরা
চুনকাম করা বাড়ি আর পরিপাটি ঘর দেখলে আমার ঘেন্না লাগে। দিলিরুজ্জামান খন্দকার কথাটি বললেন একেবারে প্রতিটি শব্দের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে। যারা শুনলেন তাদের বেশির ভাগই খন্দকার সাহেবের দিকে তাকালেন বিস্ময়ের চোখে। এদের মধ্যে দুজন কথাটি বলবার সময় দিলিরুজ্জামান খন্দকারের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারাই মূলত কথাটির শব্দগুলোর প্রতি তার ঘৃণার উত্তাপ টের পেয়েছেন বেশি। বাকিরাও বাক্যটিতে থাকা শব্দগুলোকে সাদামাটা হিসেবে শোনেননি।
আর যারা আনমনা ছিলেন, তারা পরে অন্যদের কাছ থেকে ফিসফিস কণ্ঠে শুনে নিয়েছেন। তাদেরও অন্যদের মতো দশা।
খন্দকার সাহেবের সঙ্গে এরা প্রায় রোজই গলির মুখের এই চায়ের দোকানে আসেন। আড্ডা দেন। আড্ডায় এর আগে কখনো এমন কথা দিলিরুজ্জামান বলেছেন বলে কেউ মনে করতে পারলেন না। একজন যিনি দিলিরুজ্জামানের খুব কাছে বসেছিলেন, তিনি কথাটি বলবার সময়ই তার হাত ধরে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। পুরো বাক্যই উগরে দিয়েছেন খন্দকার সাহেব।
এখন অনেক রকম প্রশ্ন আসতে পারত। কেন সুন্দর পরিপাটি বাড়ির ওপর তার এই রাগ, তবে কি দিলিরুজ্জামান কারও বাড়ির সৌন্দর্যে ঈর্ষান্বিত? আরও অনেক প্রশ্নই উঠতে পারত।
কিন্তু কেউ কোনো প্রশ্ন তুললেন না। দিলিরুজ্জামান পরে কেমন মেজাজের বাক্য উচ্চারণ করেন সেদিকেই সবার মন। কয়েকজন তো চোখের পলকও ফেলতে পারছেন না। পাছে আসন্ন বাক্যের মেজাজ ধরতে ব্যর্থ হয়। সবারই চায়ের কাপ খালি হতে থাকে। কাপের নিচের তলানি থেকে কেউ কেউ লবঙ্গের টুকরোটি বুড়ো আর কম্পমান আঙুলে তুলে মুখে পুড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তাতে সফল যে সবাই হয়, তা কিন্তু নয়। আসলে মানুষগুলো বয়সের ভারে পরাস্ত। আঙুলগুলো আর আগের মতো চটপটে নয়।
আরও এক কাপ চায়ের অর্ডার করে অপেক্ষায় রইলেন দিলিরুজ্জামানসহ কয়েকজন। এবার দোকানি হরমুজ আলী মুখ খুললেন। খন্দকার ছার, আপনে হইলেন সবার মুরব্বি। মানে বুইড়ার দলের ন্যাতা। আপনি আমার লগে এইভাবে কত দিন পর কতা কইলেন কন দেহি? ‘আরেক্কাপ চা দে’ এই ভাষায় আপনি আমার কাছে কোন দিন চা চান নাই। আপনাগো হক্কলের চায়ের স্বাদ আমি জানি। চিনির পরিমাণ জানার মতো অতটা হালকা বিষয় না কিন্তু স্বাদ জানাটা। এই ধরেন ওই যে ইয়াফেস ছারের কতাই কই। উনার চায়ে ১৩টা ঘুঁটা না দিলে আমি ঠিক ধরা খাইয়া যাই। উনি কন—উহুম, হরমুজ তোমার হাতের যাদু চইলা যাইতেছে মনে অয়। কী ছার কতাডা ঠিক কইছি কী না কন!
হরমুজের আরও মনে পড়ে ইয়াফেস সাহেবের সেই দিনটির কথা। যেদিন ইয়াফেস সাহেব খুব মন খারাপ করে সবার আগেই তার দোকানে এসেছিলেন। বাসায় চা খাওয়া নিয়ে গোলমাল হয়েছিল প্রথমে বুয়া দিলজানের সঙ্গে পরে পুত্রবধূ তিলোত্তমার সঙ্গে। তিলোত্তমা ঘুমাচ্ছিল সেই বিকেলে। ইয়াফেসের কথামতো তেরোটা ঘুঁটার চারটা দিতেই তিলোত্তমার ঘুম ভেঙে যায়। চায়ের কাপে চামচের টুংটুং শব্দে ঘুম ভাঙলে কার মেজাজ ভালো থাকে বলুন। প্রথমে বুয়া দিলজানকে ধমক দিলেন তিলোত্তমা। এরপর শ্বশুরকে। না, খুব কঠিন কিছু বলেননি। কাপের মধ্যে চামচের আঘাতগুলো সরাসরি তিলোত্তমার হার্টে গিয়ে লাগছিল। এই কথাটাই একটু রাগ মিশিয়ে খানিকটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেছিলেন তিলোত্তমা।
বুড়োদের প্রায় সবাইকেই দারুণভাবে চেনেন চা-দোকানি হরমুজ। হরমুজ বাবার সঙ্গে যখন এই দোকানে এসে জুটেছিল, তখন থেকেই এঁদের সবার সঙ্গে পরিচয়। সেই যে স্যার সম্বোধনটা বাবা শিখিয়ে দিয়ে গেছেন, এখনো তা অন্য কোনো কিছুতে রূপান্তরিত হয়নি।
হরমুজের দোকানে এখন প্রায় পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। লাকড়ির চুলায়ও পুড়তে থাকা কাঠের টুকরোগুলোও বৃদ্ধের মন খারাপে চিৎকার করতে ভুলে গেছে। পুড়তে থাকা লাকড়ির আহাজারি হরমুজ অনেকবার শুনেছে। হরমুজ মাঝেমাঝে পানি নিয়ে যখন কাপগুলোর ওপর ছিটিয়ে দেয়, তখন যে সামান্য শব্দ হয়, তা-ও অসহ্য ঠেকে কেতলিতে ফুটতে থাকা পানির কাছে। জ্বাল হতে হতে ঘন হয়ে আসা দুধের মতোই বৃদ্ধরা পরিপাটি ছিল, তারা কথায় কথায় হল্লা করত, আমুদে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করত। শুধু আজকেই, দিলিরুজ্জামান খন্দকারের কথাটাই গোপন ঝড় তুলে দিয়েছে সবার মনে। আনন্দ-উচ্ছ্বাস সব পালিয়েছে ঠাণ্ডা হয়ে আসা চায়ের মতো, যা কেবল নোংরা পানিতে কাদায় ফেলে দেওয়ার অপেক্ষমাণ।
অখিল শঙ্কর বাবু ছিলেন দোকানের দরজার কাছের চেয়ারে। তিনি একবার ভেতরে আরেকবার বাইরের দিকে তাকিয়ে মনটা হালকা করার চেষ্টা করছেন। তার ভাবগতিক দেখে হরমুজ আবার বলতে শুরু করে।
অখিল ছার আপনে বরং এখন বাসায় যান। আকাশের ভাব ভালো ঠেকতেছে না। ঠাণ্ডায় তো আবার আপনের খুক্কুর খুক্কুর শুরু হয়। কিন্তু তার কথায় অখিল শঙ্কর বাবুর ভাবান্তর হলো না।
তিন ছেলেকে নিয়ে অখিল বাবুর বাড়বাড়ন্ত সংসার। ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত। দুজন সরকারি চাকরি করে। ছেলেরা বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পর হরমুজকে নিজ হাতে মিষ্টি খাইয়েছিলেন তিনি। ছোট ছেলের জন্যই যত আক্ষেপ অখিল শঙ্করের। সেই আক্ষেপ ছুঁয়ে দিয়েছিল হরমুজকেও। মধ্য বয়সী হরমুজ কবার বোঝানোরও চেষ্টা করেছেন অখিল বাবুকে। শোনেন ছার, সংসার হইলো চুলার মতো, যত লাকড়ি দেবেন আগুনের তাপ তত গাঢ় হইবো—বলেই নিজের চুলায় নিভে আসা লাকড়িটা ঠেলে দিয়েছিলেন সেদিন।
দোকানে আরও জনা চারেক মানুষ আছে। তারা দিলিরুজ্জামানদের আড্ডার নিয়মিত শ্রোতা। এরা কথা বলতে নয় শুনতে আসেন। তারা আজও বাকরহিত তবে কোনো গল্পের বাঁকবদলে নয়।
দিলিরুজ্জামান খন্দকারের আরও অনেক বিষয়েই রাগ-আক্ষেপ আছে। বিশেষ করে দেশের রাজনীতি, গরিব মানুষের কষ্টের ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদি। কিন্তু কোনো দিন বাড়ির চুনকাম আর ঘরের পরিপাটি দশা নিয়ে তাকে অর্ধেক বাক্যও বলতে শোনা যায়নি। নিজের পোশাক-আশাকের মতোই তার বাড়িটিও সাফ-সুতরো থাকে সব সময়। এ নিয়ে তিনি মুখে কখনো গর্ব প্রকাশ না করলেও হাবেভাবে বোঝা যায়, তিনি না বলেও অনেক কিছু বোঝাতে চান। বেলজিয়াম নাকি আয়নার জন্য বিখ্যাত। এটা জেনে সরকারি এক সফরে বেলজিয়াম গিয়ে নিজের জন্য এক জোড়া চশমা গড়িয়ে এনেছিলেন। সচরাচর সেই চশমা ব্যবহারও করতেন না। এই আড্ডায় কালেভদ্রে চোখে তা শোভা পেত যতটা তার চেয়ে বেশি দেখা যেত পাঞ্জাবির কোনা দিয়ে চশমার কাচ পরিষ্কার করতে। একইভাবে তার বাড়িও ফি বছর রঙের ছোঁয়া পেত। আসবাবপত্রও বদল হতো বছর কয়েক পরপর। অথচ সেই মানুষটিই আজ বললেন ওসবে তার ঘেন্নার কথা।
এই বুড়োদের কথার ব্যাংক হরমুজ। সুখ-দুঃখের যত স্মৃতি তা-ও দিনে দিনে জমেছে হরমুজের ছোট্ট চায়ের দোকানে। প্রতিদিন সকালে হরমুজের বালি আর জালি দিয়ে পোড়া দুধের পাতিল থেকে পুরোনো গাদ ফেলে যতটা আনন্দ হয়, তেমনি এই বুড়োদের স্মৃতিগুলো আঁকড়ে রেখেও সুখ পায় হরমুজ।
দোকানটার অবস্থান গলির মুখ থেকে কখন যে বারাহিরচরের কবরস্থানের সীমানায় ঢুকে গেছে, হরমুজ ঠাহর করতে পারে না। হরমুজের অস্বস্তি হতে শুরু করে। কেউ তো একটা কথা বলুক। প্রতিবাদ করুক না হয় সান্ত্বনা দিক দিলিরুজ্জামানকে। হরমুজের বুকের ভেতরটা হুহু করে ওঠে। পুরো কবরস্থানের নীরবতা দোকানে বেশিক্ষণ জিইয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে না তার। ইচ্ছে করে একটা কাপ ফেলে দেয় মেঝেতে। টুংটাং শব্দ হয় বটে কিন্তু তাতে কাপটা ভাঙে না। হরমুজ কাপটা তুলে ভালো করে দেখে ফাটল ধরেছে কি না, তা-ও হয়নি। হরমুজ এবার দোকানের বুড়োদের দিকে তাকায়।
কেউ নেই। চেয়ারগুলো ফাঁকা। কয়েকটা কাপ টেবিলে পড়ে আছে নিরুত্তাপ।
বাইরে তখন কার্তিক মাসের সামান্য ঠাণ্ডা বাতাসওয়ালা সন্ধ্যা নামছে। এই বৃদ্ধদের গল্প না হয় আমার কাছে জমা আছে। সুযোগ পেলে বলেও শান্তি পাই। কিন্তু আমার গল্প থাকবে কার কাছে! এই ভাবনার দিশা খুঁজে না পেয়ে হরমুজ দোকানের সুইচটা অফ করে নিজেও অদৃশ্য হওয়ার ভান করে বসে থাকে।
হরমুজের না বলা গল্পটা আরেক কিস্তিতে শুনতে চাই | ভালো গল্পের জয় হোক | লেখক আরো গল্পের ঝাঁপি খুলুক | আমরা পড়তে চাই |
ফারদিন ফেরদৌস
ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২২ ১৯:৫৩
দপ করে নিভে যাওয়ার মত মনে হলো।আমি শুধু বুঝলাম -"বাইরে তখন কার্তিক মাসের সামান্য ঠাণ্ডা বাতাসওয়ালা সন্ধ্যা নামছে"----- এর পর নিশ্চয় মহিষের শিং কাঁপানো ঠান্ডা নামবে। যাইহোক লেখা চলুক অবিরাম... লেখকের জন্য ভালবাসা
জাহেদ সেলিম
ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২২ ১৩:৫৫
একদম ধন্ধে পড়ে যাওয়ার মত গল্প। শুরু হলো এক বিত্তবানকে দিয়ে। আর শেষ হলো বিত্তহীন চা দোকানীর হাহাকার দিয়ে। সবার মধ্যেই একই হাহাকার। কষ্ট। নিজের গল্পটা কে কাকে দিয়ে যাচ্ছেন বলবার জন্য সেই বেদনা বড় অদ্ভুতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। গল্পের পরিসর ছোট। ছোট গল্পের বৈশিষ্ট দারুণভাবে প্রকটিত। জীবন যে জীবন থেকে জীবনে প্রবাহিত হয়ে গল্পের পরম্পরা বয় বেড়ায়..। ধন্যবাদ তর্ক বাংলাকে চমৎকার একটি গল্প উপহার দেবার জন্য।
ইস্তেগবাল হোসেন
ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২২ ১৭:০৭
নিমজ্জনের খেলা, বড় গভীর, ডুব সাঁতারে পটু না হলে পাঠোদ্ধার করা বড়ই কঠিন!
আনোয়ার
ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২২ ১৬:০২