শাকপাতা
বিষাদমথিত ভোরের আলো ছুঁয়ে আছে আগাছার জঙ্গল।
উমরাও বেওয়া দেখে খটখটে মাটিতে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়া নুনে শাক। ছোট্ট ছোট্ট রসাল পাতাগুলো আলো লেগে ধারালো ফলার মতো চকচক করে যেন উমরাও বেওয়ার খিদে। উমরাও শাকের ঝাড়টিকে দেখে, তাকায় এদিক-ওদিক। আবছা আরও কতকগুলি নুনে শাকের বৃত্ত। নুনে শাক তারই মতো যেন বা খানিক নির্জন। আশপাশে কোনো আগাছাও নেই যার ছায়া তাকে ঢেকে দেবে।
এত নুনে শাক তার জন্যই ফুটে উঠেছে ভাবতেই শিহরণ জাগে। তখনই খানিকটা আন্দাজে খেয়াল করে অতি ক্ষুদ্র হলুদ ফুল আর ফুলের বৃন্ত ঘেঁষে ছোট্ট বীজ-থলে। মনে পড়ে কিশোরী কালে এই ফুলের মতো সোনার নাকছাবি পরার তীব্র বাসনা জেগেছিল যে রকম জাগে অনেক বুনোফুল দেখলেই। যদিও নাকছাবির হিসেবে নুনে শাকের ফুল নেহাত ছোট নয় এবং ছোট্ট একটি সোনার নাকছাবি বানানোর ইচ্ছে বা তৎপরতা কোনোটাই দেখায়নি তার বাপ, এমনকি বিয়ের সময়ও সে পায়নি এককুচি সোনা। বিয়ের আয়োজনও করতে চায়নি বাপ। ভেবেছিল নিজেই কাজ করে বানিয়ে নেবে। কিন্তু নিজে যতই খাটুক, সব টাকা দিয়ে দিতে হতো আব্বার হাতে। কোনো দিনই গয়না পরার শখ মিটল না। পেটের ভাত জোগাতেই জীবন শেষ।
ইটভাটায় কাজ করতে গিয়ে শ্রমিক আসাদুল্লার সঙ্গে পরিচয় হয় আর ইটের পাঁজার আড়ালে খুনসুটি করতে করতে নিজেদের বিয়ে ঠিক করে ফেলে। তার বাপকে আসাদুল্লা বিয়ের কথা জানাতেই সেই রাতেই বাপ মৌলবি ডেকে অত্যন্ত সাদামাটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে চার হাত এক করে দেয়, যাতে অংশ নেয় নিজের বাড়ির লোকজন আর দু’চারজন প্রতিবেশী।
সেসব মনে পড়ে একটি দীর্ঘশ্বাসে।
আপাতত সবচেয়ে বড় বৃত্তে ছড়িয়ে পড়া নুনে শাকের নরম ডালপালা মৃদু শব্দে আঙুলের ডগা দিয়ে কেটে নেয় আর শাড়ির কোঁচড় ভরে ওঠে। এই জমির মালিকানা বিষয়ে তার ধারণা অস্পষ্ট, হাতড়ে হাতড়েও মনে করতে পারে না। কিন্তু যদি কেউ আসে, তাড়িয়ে দেয় তাকে- সেই ভয়ে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়। এখন এই গ্রামে পতিত জমি বলে কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই। এমনকি যেকোনো বিষয়ে মালিকানার ধারণাটি বেশ জোরদার। ভাবতে ভাবতে ধীরগতিতে কুঁজো পিঠ আরও কুঁজো করে নুনে শাকের দিকে ঝুঁকে বা কখনো বসে শাক তোলার কষ্ট সে অনুভব করে আর তার মসৃণ বাঁশের লাঠিটি পড়ে থাকে মাটির ওপর।
‘ও দাদি, সব তুমি লিয়ে লিলে আমরা কী লিব?’
চমকে তাকায় শাকে নিবিষ্ট উমরাও। চোখের ওপর খানিক আবছা হয়ে থাকে বাঁশের ডালি কাঁখে কিশোরী সাদিয়া যদিও শাকের গোছাগুলো ঠিকই সে দেখেছিল। বয়সের ভারে কাঁপা স্বরে নিশ্চিত হতে চায়,
‘সাদিয়া লয়?’
‘হ্যাঁ গো দাদি।’
‘এই কডা শাগ লিলে তোর শ্বশুরের খুরাক কমবে না রে লাতনি।’
একজনের দাঁতে লাবণ্য আরেকজন দাঁতহীন, বৃদ্ধা ও কিশোরী পরস্পরের রসিকতায় হাসে।
‘তুই এসে ভালই হল, চোখে ভাল দেখি ন্যা। আরও চাড্ডে শাগপাতা তুলে দে দেখি লাতনি। তালে রাতের খুরাকের ভাবনাখান থাকে না।’
‘ঠিক আছে। তুমি ওখ্যানেই বসে থাকো। শাগ তুলা হয়ে গেলে একসাথে বাড়ি যাব।’
সাদিয়ার কথা মেনে উমরাও দু হাঁটু উঁচু করে শাক ভর্তি কোঁচড় কোলের ওপর রেখে দু হাতে হাঁটু আঁকড়ে বসে থাকে। বসে বসে সাদিয়ার শাক ছেড়ার নানাবিধ শব্দ শোনে। আবছা দেখা আর শাক তোলার শব্দে বুঝে নিতে চায় ঠিক কোন শাক তুলছে সাদিয়া। ভিন্ন ভিন্ন শাকের গন্ধ মিশে মিশ্র মৃদু গন্ধ বাতাসের গায়ে ভর করে উড়ছে আর ধাক্কা দিচ্ছে উমরাও-র নাকে। খিদেটা আবার চনমন করে ওঠে।
একটা শেয়াল আগাছায় নিজেকে ঢেকে চকচকে চোখ মেলে উমরাও-র দিকে জিভ বের করে তাকিয়ে থাকে আর তার জিভ থেকে ঝরে পড়ে এক ফোঁটা লালা।
সাদিয়া শাক তোলা শেষ করে শেয়ালের লালা ঝরা দেখে আর দ্রুত উমরাও-র পড়ে থাকা লাঠি নিয়ে তেড়ে যায়।
‘ছেই ছেই!’
লাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সভয়ে খানিক দূর থেকে কুকুর তাড়ানোর শব্দবন্ধ ব্যবহার ক’রে সে শেয়াল খেদায় কেননা শেয়াল তাড়ানোর আলাদা কোনো শব্দ আছে কি না তার জানা নেই। তবু সেই শব্দে শেয়ালটি পিছু হটে আর আগাছা-ভূমি আন্দোলিত করে পালিয়ে যায় শস্য খেতের দিকে।
‘কী তাড়াস লাতনি? কুকুর নাকি?’
‘ও কিছু না!’, খানিক চুপ করে থাকে সাদিয়া। ‘তুমি এখানে আর একলা আসবা না।’
‘ক্যানে রে?’
‘শেয়াল-কুকুরগুলা ক্ষেপে আছে।’
‘আমারে দেখতেও পায় না! তালে আর দুনিয়াদারির চিন্তা থাকে না।’
‘ও দাদি, এমন কথা কহ ক্যানে?’
সাদিয়া কল্পনায় এক বৃদ্ধার দেহ দেখে, দেখে শেয়াল-কুকুরের ছিঁড়ে খাওয়া আর অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। জোর করে চোখের সামনে থেকে সে দৃশ্যটা দূর করে আর যদিও উমরাও তার পরিবারের কেউ নয় তবু তার ভেতর কেমন এক সব হারানোর দুঃখ মোচড় দিয়ে ওঠে।
‘দাদি, তুমার শাকগুলা দ্যাও।’
সাদিয়া মেলে ধরে একটি শ্যামল কচুপাতা। তার মধ্যে উমরাও-র কোঁচড়ের শাকগুলি রাখে আর কচুপাতাটি তুলে নেয় নিজের ডালিতে। রাখার সময় সে খেয়াল করে নুনে শাকের মধ্যে কিছু অখাদ্য আগাছার পাতাও তুলেছে উমরাও। শাক বাছার সময় আলাদা করে নিলেই চলবে। দাদির চোখ দুটো একেবারেই গেছে ভেবে বিষণ্ণ হয় সাদিয়া।
‘চল দাদি।’
লাঠিটা এগিয়ে দেয় উমরাও-র হাতে, উমরাও লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় যদিও সাদিয়া উঠতে সাহায্য করতে চেয়েছিল কিন্তু জানে একটা তিরস্কারই সে পাবে কেননা উমরাও নিজেকে দুর্বল ভাবতে এখনো নারাজ আর নিজের প্রায় সব কাজই কারও সাহায্য ছাড়া সে করে আসছে। সেই কিশোরীবেলা থেকে ঘন মাটি দিয়ে তৈরি দশখানা পোড়া ইট বা এক ঝুড়ি ভেজা মাটির তাল সে সহজেই বয়ে নিয়ে যেত আর সেসব সত্যি যারা দেখেনি তারা হয়তো বিশ্বাসই করবে না, কেননা এখন আর গ্রামের কিশোরীরা ইঁটভাটায় কাজ করে না বরং তারা পরিযায়ী হয় বিভিন্ন শহরে আর খুঁজে নেয় অধিক পারিশ্রমিকের কাজ, বিশেষ করে কেরালা তাদের গন্তব্যের তালিকায় প্রথমে। যদিও সাদিয়ার মতো কয়েকজন বাড়ির লোকের আপত্তিতে গ্রামেই থেকে গেছে। বাইরে গেলে নাকি মেয়েদের মান-ইজ্জত থাকে না। কত কিছু কানাঘুষোয় শোনা যায়।
সাদিয়া দেখে শাক তুলতে বেশ খানিকটা সময় চলে গেছে এবং মায়ের বকাও প্রাপ্য হতে পারে তবু উমরাও-র গতির সঙ্গে সংগতি রেখে অত্যন্ত শ্লথ ভঙ্গিতে গ্রামের দিকে হেঁটে চলে আর নানান কথায় ধীরে ধীরে গড়িয়ে যায় পা ডুবে যাওয়া ধুলোয় একাকার হয়ে থাকা মাটির রাস্তাটি।
‘ও দাদি, সকালে কী খ্যায়েছ?’
‘তোর তাতে কি?’
‘আমি যেন জানি ন্যা!’
‘তালে শুধাস ক্যানে?’
‘তুমার র্যাশন কার্ডখান কুনঠে থুয়েছ?’
‘কাগজখান কুনঠে যে থুয়েছে রাশিদুল! ক’মাস টাকাও পাঠায় না। শাগই ভরসা। আবা শুনছি কাগজ না থাকলে নাকি দ্যাশ ছাড়া করবে। এই গেরামে জীবন কাটে গেল দ্যাশ ছাড়া করলে কুনঠে যাব!’
‘হ্যাঁ দাদি। চিন্তার উপর চিন্তা। দ্যাশের সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলছে। রাশিদুল ভায়ের কাজই নাই টাকা পাঠাবে কী!’
‘তুই জানলি কী করে?’
‘ভটচাজ বাড়ির টিভিতে খবরে রোজ বুলছে।’
‘রাশিদুলকে দ্যাখ্যালছে?’
‘না না। কত মানুষকে দ্যাখাছে গো কোলে কাঁখে ব্যাগ লিয়ে, বাচ্চা লিয়ে হ্যাটে হ্যাটে বাড়ি ফিরছে।’
‘হ্যাটে ফিরছে ক্যানে?’
‘বাস-টেরেন কিছু চলছে না যে দাদি। আমাধের গেরামের যারা কাজ করতে গেলছে সবাই হাঁটা লাগালছে।’
‘রাশিদুল যেখেনে কাজ করে টেরেনে যাতে দু-তিন দিন ল্যাগে যায়। হ্যাটে ক’দিনে ফিরবে!’
‘কাজ করে যে টাকা পায়েছিল সব শ্যাষ। হ্যাটে ফিরা ছাড়া উপায় কী?’
‘এমুন আল্লার গজব নামলো ছেলেডাকে হ্যাটে আসতে হচে। কী যে সব লতুন লতুন রোগ বালাই! মান্ষের এত পাপ কি সহ্য হয়!’
‘কী জানি দাদি, কী থেকে কী হচে!’
‘রাশিদুল কদ্দুর আসেছে জানিস?’
‘উসব দ্যাশ তো চিনহি ন্যা কিন্তুক উসমান চাচা চাচিকে ফোন করেছিল। বুলেছে গেরামের অনেকে একসাথে ফিরছে, রাশিদুল ভাইও আছে। এখুনও সাত-দশ দিন লাগতে পারে বুলেছে। অরাও তো জানে না, কুনুদিন হ্যাটে বাড়ি ফিরেছে নাকি!’
‘চিন্তার খুরাক হল বটে।’
‘তুমি অত চিন্তা কোর না। র্যাশনডা কীভাবে পাওয়া যাবে সেডাই দেখতে হচে। আমি পঞ্চায়েতের পোধান চাচাকে তুমার কথা বুলেছি যাতে র্যাশনডা তুমি পাও। দিবে বুলেছে।’
‘দেখিস তো লাতনি। চাল পাওয়া গেলে চাড্ডে ভাত খাই।’
‘পোধান চাচা বুলেছে তুমার নামে একখান কাগজ লিখে দিবে। কাগজখান র্যাশন দুকানে দেখালে সব পাওয়া যাবে। কাল যায়ে কাগজখান লিয়ে আসবো।’
‘কাগজ ক্যানে লাগবে? আমাকে চিন্হে না নাকি পোধান? র্যাশন দুকানিও তো চিন্হে। গেরামেই জন্ম, গেরামেই মিত্যু হবে। চাড্ডে চাল দেওয়ার লেগে কাগজ! আষাঢ়ে কথাবাত্তা জিন্দেগিতে শুনিনি। আগে তো কাগজ লাগতো না।’
‘সব লতুন নিয়ম দাদি। কাগজপাতি না হলে কুনও সুবিধা তো দূরে থও লিজের বাড়িতে থাকতে পাবা না।’
‘কুনঠে খ্যাদাবে জানিস?’
‘টিভির খবরে বুল্যাছে জেলে ঢুকিয়ে দিবে।’
‘এ কেমুন গজব! তার আগে আমার ইন্তেকাল হয়ে যাক।’
উমরাও-র তোলা এবং নিজের তোলা শাক বেছে নেয় সাদিয়া। নুনিয়া, কাঁটা নটে, সবুজ নটে, তেলাকুচা, ছোট বড় কয়েক রকম কচুশাকের পাতা সব বেছে ধুয়ে মিহি করে কাটে। উমরাও দাওয়ায় বসে চোখ পিটপিট করে দেখে। রান্না শাকের একটা অদম্য গন্ধ গলা পেরিয়ে পেটের ভেতর নামতে থাকে। তখনই খিদেটা আবার মাথাচাঁড়া দেয়। ‘এত খাইখাই ক্যানে?’, ফিসফিস করে নিজেকে ধমকাই উমরাও।
উঠোনের মাটির উনুনে শুকনো পাতা-ডালপালা গুঁজে দেয় সাদিয়া। দেশলাই নেই। নুনের পাত্র ফাঁকা। সাদিয়া সব খুঁজে দেখে। রসুন-লঙ্কা-পিঁয়াজ-তেল উমরাও-র ঘরে কিচ্ছু নেই। এক কুচি দানাও না। গতকাল সে এত খোঁজেনি। ভেবেছিল সামান্য কিছু হলেও দানাপানি থাকবে। একটা কষ্ট গলার কাছে এসে আটকে যায়। এতবার এত লোকের পিছনে ঘুরে ঘুরে উমরাও-র রেশনের ব্যবস্থা সে করতে পারেনি। তার হয়ে তদ্বির করার কেউই নেই গ্রামে। উমরাও-র ছোট ছেলে গ্রামে থাকলে সব ব্যবস্থা এতদিন হয়ে যেত। বাকি ছেলেরা বিয়েসাদি করে ভিন রাজ্যেই থেকে গেছে। আসে না। ভাবতে ভাবতে আনমনা সাদিয়া সচেতন হয়।
‘দাদি, আগুন লিয়ে আসছি।’
যেন মানব সভ্যতায় প্রথম আগুন জ্বালাবে সে। যেন প্রমিথিউসের মতো ক্ষমতার কক্ষ থেকে চুরি করে আনবে আগুন।
শাকের ডালি তুলে নিয়ে সাদিয়া বাড়ির দিকে রওনা হয়।
‘এত সুময় লাগে শাগ তুলতে? কখুন শাগ রান্ধবো?’, সাদিয়ার মা নছিয়া বিবি।
‘এই ল্যাও, ধুয়ে কেটে রেডি।’, সাদিয়া উত্তর দেয়।
‘সকাল থেকে পেটে দানাপানি পড়েনি আর মেয়ে আমার ইংরেজি ঝাড়ছে! ভাত হয়ে গেলছে। নুন দিয়ে খা নালে শাক হয়ে গেলে একবারে খাস।’
‘মা, আমি যতগ্যালা ভাত খাই তার আদ্ধেক উমরাও দাদিকে দিই?’
‘লিজেদের ভাত জুটছে না উনি পরের লেগে দরবার করছেন!’, উনুনের ওপর বসানো লোহার কড়াইতে শাক ঢালে নাছিয়া।
‘দাদি শুধু শাক খ্যায়ে থাকবে নাকি?’, মায়ের ওপর খুব রাগ হয় সাদিয়ার।
‘এই গজবের দিনে কে কাখে দেখবে! তোর বাপের হাতে একটা টাকাও নাই। কবে কাজ শুরু হবে তার ঠিক নাই। তাও ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে তিনি সারাদিন বটতলায় আড্ডা দিছেন। আমার হয়েছে মরণ!’
সাদিয়া এক গোছা পাটকাঠি নিয়ে উনুন থেকে আগুন নেয়।
‘পাটকাঠি লিছিস ক্যানে? সস্তা নাকি?’
‘দাদির শাগ রান্ধতে হবে।’, একটু চুপ করে থেকে সাদিয়া বলে, ‘মা, একচিন ত্যাল-নুন, কডা রসুনের কোয়া আর কাঁচা মরিচ দ্যাও না।’
‘আ মরণ! মরিচের দাম জানিস? ভালই যে দুটে গাছে মরিচ ধরেছে। নালে মরিচ ছাড়াই খাতে হত।’
মুখে বলে বটে। কিন্তু একটা স্টিলের থালায় ভাত, লঙ্কা, নুন, রসুন আর ছোট্ট বাটিতে অল্প একটু তেল সাজিয়ে নাছিয়া সাদিয়ার হাতে তুলে দেয়। সাদিয়া জানতো এটাই হবে। না দিয়ে থাকতে পারবে না মা। তাই এ বিষয়ে আর কিছু না বলে চুপচাপ মাকে লক্ষ্য করছিল। এক হাতে আগুন ধরানো পাটকাঠি আর এক হাতে থালাটি নিয়ে উমরাও-র বাড়ির দিকে রওনা দেয় সাদিয়া।
‘চট করে ফিরিস।’
‘হ্যাঁ মা। তুমার শাগ রান্না হবে আর আমিও আসে যাব।’
রান্নায় রান্নায় ঘন কালো হয়ে যাওয়া হাঁড়িতে শাক রান্না করে সাদিয়া। পাশে বসে উনুনে জ্বাল ঠেলে দেয় উমরাও। হাওয়ার পথ ধরে ধোঁয়ায় ভরে যায় ছোট্ট দু কামরার মাটির বাড়িটা।
‘বাদলার আগে ঘরের চাল ঠিক করবে বুলেছিল রাশিদুল। তা কী করে করবে?’
‘একচিন ধইজ্জ ধরতে হবে দাদি। যদ্দিন সব ঠিক না হয়।’
‘তা ভেন্ন উপায় কী! বাদলায় ঘর বাহির এক হবে এইডাই যা চিন্তা।’
‘পোধান চাচাকে বুলে দেখবো যদি একখান ত্রিপল দেয়।’
‘কত আর বুলবি লাতনি।’
‘ল্যাও দাদি, খায়ে ল্যাও। আমি বাড়ি যাই নালে মা বকবে।’
‘ভাতগুলা আমার থালে তুলে দে। তোধের থাল-বাটি লিয়ে যা।’
সাদিয়া থালায় ভাত সাজায়। ভাতের পাশে কড়াই থেকে বেশ খানিকটা শাক তুলে দেয়।
‘তুমি খাও। বিকালে টিভি দেখতে যাওয়ার সুময় দেখা করে যাব।’
‘একলা আর কত করবি?’
সাদিয়া খানিক আত্মতৃপ্তি লাভ করে আর পরক্ষণেই সেসব ঝেড়ে ফেলে ‘কী যে বল দাদি!’ উচ্চারণ করেই হাতে থালা ও বাটি নিয়ে সে দৌড় দেয় নিজের বাড়ির দিকে।
উমরাও অর্ধেক ভাত বাটিতে তুলে জলে ভিজিয়ে রাখে। বাকি অর্ধেক ভাত অনেকটা শাক দিয়ে মেখে ধীরে ধীরে খায়।
রাশিদুল এখন কী করছে? এখনো কি হাঁটছে রাস্তায়? কিছু কি খাবার জুটেছে? এসব ভাবতে ভাবতে গলা দিয়ে ভাত নামে না। শুকনো খটখটে চোখ ভিজে সামনের সব দৃশ্য ঝাপসা করে দেয়। ভাতের থালা সামনে নিয়ে কাঁদতে নেই। ভাত লক্ষ্মী। কান্না সহ্য করে না লক্ষ্মী। মনে পড়ে তার। তাড়াতাড়ি মলিন শাড়ির আঁচল টেনে চোখ মোছে উমরাও।
তখনই একটা কাক দাওয়ার ওপর বসে ঘাড় উঁচু করে ভাতের থালার দিকে দেখতে দেখতে ডাকে কা কা। পাখপাখালিরও খাবার জুটছে না। ভাবতে ভাবতে এক দলা ভাত ছুঁড়ে দেয় উঠোনে। কাকটা উঠোনে নেমে গিয়ে ভাত খুঁটে খেতে থাকে। দুটো শালিক উড়ে আসে ছুঁড়ে দেওয়া ভাতের কাছাকাছি। কাকটা তেড়ে যায়। শালিক দুটো কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসে। উমরাও আবার একদলা ভাত ছুড়ে দেয় উঠোনের অন্যদিকে। শালিক দুটো এবার দ্রুত ভাত খোঁটে। কাকটা দু পাশের ভাতের স্বত্বই নিতে চায়। এই নিয়ে কাকে-শালিকে আকচা আকচি চলে। এসব আবছা দৃশ্য দেখতে দেখতে খাওয়া শেষ করে উমরাও।
দাওয়ার উপর পুরোনো শীতল পাটিতে শুয়ে নানাবিধ চিন্তা ঘিরে ধরে। একেকটা দিন অনেক দীর্ঘ। যেন শেষ হতে চায় না। কষ্টের দিন এমনই লম্বা যে জীবনভর তারই দাপট। মানুষের সুখের দিন তরতর করে পার হয়ে যায়। তার কি কোনো সুখের দিন ছিল?
অনেক হাতড়ে সে মনে করার চেষ্টা করে। ছিল ছিল, তারও কিছু সুখের সময় ছিল। বিয়ের আগে ও পরে আসাদুল্লার সঙ্গে হাড়ভাঙা খাটনির ফাঁকে ফাঁকে সেও কাটিয়েছে কত গা শিরশির করা নিভৃত মুহূর্ত। ইটভাটায় সাজানো ইটের দেয়ালের ফাঁকে, নদীতে, জঙ্গলে। এখন অত জঙ্গল কই! সব বাড়িঘর, না হলে ক্ষেতখামার হয়ে গেছে। চারটি শাক তুলতেও যেতে হয় অনেকটা। তুলে খেয়ে খেয়ে নিজের বাড়ির আশপাশের শাক শেষ হয়ে গেছে। পাতা গজাতে সময় লাগবে। অন্যদেরও একই অবস্থা। যারা অবস্থাপন্ন তাদের বাড়ি শাক তুলতে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। কত কথা শোনায় চারটি শাকের জন্য। সাদিয়া আছে বলে কোনোরকমে খাবার জুটছে। মেয়েটার একটাই বায়না, পুরোনো কাহানি শুনতে চায়। টিভি এসে এসব কি কেউ মনে রেখেছে, উমরাও-র মতো দু-চারজন ছাড়া? ভাবতে ভাবতে তন্দ্রা আসে।
রাশিদুল কি বাড়ি ফিরতে পারবে?
তন্দ্রার ভাব মুহূর্তে কেটে যায় আর এক অজানা আশঙ্কায় কষ্ট করে উঠে বসে গরমে, ঘামে অস্থির উমরাও। উঠোনটা পড়ে আছে তীব্র রোদের ভেতর। গাছের পাতাও দুলছে না। এক ফোঁটা হাওয়াও যে নেই। সাদিয়ার এনে দেওয়া জল মাটির কলসি থেকে গ্লাসে ঢেলে সে ঢকঢক করে খায় আর কুঁজো হয়ে লাঠিতে ভর করে রোদের ভেতর উঠোনময় পায়চারি করে।
বিকেল যেন কিছুতেই আসে না আর সাদিয়ার জন্য অপেক্ষাও শেষ হয় না।
এক অস্বস্তিকর অবস্থার ভেতর বেশ কয়েক দিন কেটে যায়। সাদিয়ার তদ্বিরে রেশনের ত্রাণের জিনিসপত্র সে পেতে শুরু করে কিন্তু শাক তোলা তার শেষ হয় না। শুধু ডাল দিয়ে ভাত কি খাওয়া যায়? তবে কে একজন যেন দু কেজি আলু আর চাল দিয়ে গেল। আলু হাতে দেওয়ার সময় মোবাইলে ছবি তুলে নিল। সাদিয়া বলেছে, ওই ছবি নাকি কোথায় দিয়েছে। সবাই মোবাইলে দেখতে পাচ্ছে। কারও মোবাইল পেলে সাদিয়া দেখাবে বলেছে। ঝাপসা চোখে ছবি দেখলেও নিজেকে কি চিনতে পারবে উমরাও? ওই ছবি যে কারোর ছবি মনে হবে। তবু ছবি দেখার বাসনা সে ছাড়তে পারে না। সাদিয়ার যদি একটা মোবাইল থাকত, তাহলে সে এখনই ছবিটা দেখতে পারত। সাদিয়া ইটভাটায় কাজ করলে হয়তো মোবাইল কিনে ফেলত। ইটভাটায় কাজ করলে এখন নাকি আগের থেকে বেশি টাকা দেয়। রাশিদুলের কাজ ভালো হলে সাদিয়াকে একটা মোবাইল কিনে দিতে বলবে।
খানিক শান্ত হয় উমরাও। সাদিয়াকে বউমা করলে কেমন হয়?
কিন্তু ছেলে কি তার কথা শুনবে? সাদিয়ার মা-বাপ কি এত গরিব ঘরে মেয়ে দেবে? ওরাও তো গরিব।
দিতেও পারে।
এবার ছেলে ফিরলেই বিয়ের কথাটা বলবে। মনে তো হয় সাদিয়াও রাজি হয়ে যাবে। রাশিদুলের সুন্দর চেহারা। যদিও সম্পর্ক মিলছে না। তবে রক্তের সম্পর্ক তো নয়।
বিয়ে হয়ে গেলে সব অভ্যাস হয়ে যাবে।
যাক, ঘরে এখন কিছু চালডাল আছে। ছেলেটা এলে খেতে দিতে পারবে। নিজে শাকপাতা খাবে। বাড়ির শাকপাতাগুলো ক’দিনের মধ্যেই আবার গজাবে। শুধু নরম ডাল তোলা হয় বলে আবার গজিয়ে ওঠে শাক। শেকড়সুদ্ধ কেউ তোলে না। ছেলের জন্য রেখে দেবে চালডাল।
সমস্ত চিন্তা মাছি তাড়ানোর মতো তাড়িয়ে ভালো কথা ভাবতে চেষ্টা করে উমরাও। ছেলে ঘরে ফিরলে কী কী রান্না করবে ভাবে। ডাল, ভাত, আলুভাজা আর অবশ্যই শাক। ছেলেকে সে থালা সাজিয়ে খেতে দেবে। রাস্তাঘাটে কী খেতে পাচ্ছে কে জানে! পেট ভরে খাওয়াবে সে ছেলেকে। খাওয়ার সময় তালপাতার পাখাটা দিয়ে বাতাস করবে। যা গরম! বাতাস না করলে ছেলেটা খেতে পারবে না। এই গরমে এত দূর হাঁটছেই-বা কী করে!
ভেতরটা ভোঁতা মনে হয়। বসে বসেই সে তন্দ্রায় ঢুলতে থাকে এই নির্জন মধ্যদুপুরে।
খানিক পরে চমক ভেঙে উঠোনে দেখে কাঁধে ব্যাগ আবছায়া অবয়ব।
‘রাশিদুল, আসলি নাকি?’
কেউ উত্তর দেয় না। চোখে আঙুল ঘষে নিয়ে উঠোন দেখে উমরাও।
নেই, কেউ নেই।
শুধু একঝলক দমকা বাতাসে উঠোনের নিমগাছের পাতা দুলে ওঠে।
খুব সুন্দর
সুরোজ সানিম
আগস্ট ০১, ২০২১ ১৮:০১
খুব সুন্দর
সুরোজ সানিম
আগস্ট ০১, ২০২১ ১৮:৫৮