রূপসীর কুহক
‘এ তুই কাকে পেটে ধরেছিস? ওর দিকে তো রাহু নজর দিয়ে রেখেছে সেই জন্ম থেকে। তোর ছেলে হবে, ছেলে। ও তো হলো গিয়ে সম্রাট বাবরের ব্যাটা হুমায়ুন। বাপের আয়ু নিয়ে বাঁচবে। বাঁচবে ষাট বছরের কম না।’—অন্তঃসত্ত্বা রেহনুমার কপালে হলুদ বিবর্ণ হাত রেখে কথাগুলো বলছিল মুসলিম পীরের মাজারে আশ্রয় নেওয়া, লালসালু কাপড় গায়ে হিন্দু সাধক। কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে সাধক তার পাশে রাখা ঝুড়ির ঢাকনা খুলে সুতানলি সাপটাকে হাত দিয়ে ধরে বের করে এনে তার মাথায় চুমু দিল। তার দাড়ি ও গোঁফ হলদেটে, চক্ষু রক্তবর্ণ, মাথায় তেল চিটচিটে জটা। রেহনুমাকে তার বান্ধবী ময়না এই সাধকের কাছে নিয়ে এসেছে তার গর্ভস্থ দুমাসের সন্তানের ভবিষ্যৎ জানার জন্য। সাধক যা বলল তা শুনে রেহনুমার মনটা অজানা আশঙ্কায় ভরে গেল। ময়না বলল, ‘বাবা, আপনি কিছু একটা করুন যাতে এই ছেলের বিপদ-আপদ সব কেটে যায়।’ সাপের মাথায় চুমু খেতে খেতে সাধক বলল, ‘সবই উপরওয়ালার ইচ্ছা। আমি তো কেবল চোখের উপর ভাসমান ছবিগুলোর কথাই বলতে পারি।’ ময়না বলতে যাচ্ছিল, ‘প্লিজ বাবা, কিছু একটা করুন।’ তার আগেই সাধকের পাশে দণ্ডায়মান তার শিষ্য বলে উঠল, ‘আপনারা কেন অনর্থক ওনাকে বিরক্ত করছেন। উনি শুধু ভবিষ্যৎ দেখতে পারেন। আর কিছু করতে পারেন না।’ সাধককে বকশিশ দিয়ে তারা যখন রেহনুমাদের গাড়িতে উঠল সূর্য তখন মধ্য গগনে। শীতের কুয়াশা ভেদ করে বিস্তীর্ণ প্রান্তরকে আলোকিত করতে অপারগ হয়ে ম্লান রশ্মি ছড়িয়ে দিচ্ছিল সারি সারি শস্যখেত আর সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলা মহাসড়কের ওপর। দূরের কুয়াশাচ্ছন্ন গ্রামগুলোকে মনে হচ্ছিল যেন প্রাগৈতিহাসিকতায় মোড়ানো আদিম মানুষের বাড়িঘর। এই আদিমতাকে পেছনে ফেলে, পত্রশূন্য বৃক্ষগুলোকে পাশ কাটিয়ে, অজানা পাখির আর্তনাদের সন্ত্রস্ত নির্জন সড়ক ধরে তাদের গাড়ি ছুটে চলল ঢাকার দিকে। বিষণ্ন মন নিয়ে রেহনুমা যখন তাদের চারতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় নিজেদের ঘরে ঢুকল তখন তার স্বামী আসলাম অফিস থেকে সবেমাত্র ঘরে ফিরেছে।
ফালগুন মাস চলছে। আজ দোসরা মার্চ। আসলামের জন্মদিন। ইটপাথরের যান্ত্রিক শব্দাবলি ভেদ করে দূরে কোনো অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে থেকে একটা কোকিল একটানা ডেকে চলেছে যৌনগন্ধি সাথীর খোঁজে। গাছে গাছে নতুন সবুজ কচি পাতা ভরা সূর্যালোকে নিজেদের মেলে ধরে অপেক্ষার প্রহর গুনছে কবে পূর্ণাঙ্গ পত্রে পরিণত হবে। স্বচ্ছ কাচের মতো চকচকে শিশিরকণা ঘাসের নরম ডগায় অবস্থান করে জানান দিচ্ছিল গ্রীষ্ম আসতে আরও দেরি আছে। আকাশের অখণ্ড নীলিমায় রাশি রাশি মেঘমালা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করছিল। দখিনা বাতাসে ঝুলবারান্দায় স্বামীর জন্য অপেক্ষমাণ রেহনুমার চুল উড়ে উড়ে যাচ্ছিল। সে আজ একটা বেগুনি রঙের শাড়ি পরেছে। কপালে ছোট্ট একটি টিপ। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। মুখে কোনো মেকআপ নেই। তারা দুজন আজ বাইরে খাবে। স্বামীর জন্য সে একটি পাঞ্জাবি কিনেছে। আসলাম অফিস থেকে ফিরলে সে পাঞ্জাবিটা আসলামকে দিল। আসলাম বলল, ‘আমি তো পাঞ্জাবি পরি না। খামোখা এটা কিনতে গেলে কেন?’ জবাবে রেহনুমা বলল, ‘তোমাকে পাঞ্জাবিতে সুন্দর লাগে। আজ এটা পরো।’
আসলাম পাঞ্জাবিটা পরলে সন্ধ্যার পর তারা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ফিরল বেশ রাত করে।
শীত, বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্ম এলো। আবার চলেও গেল। রেহনুমার গর্ভস্থ সন্তানের বয়স এখন আট মাস। আলট্রাসনোগ্রাফি করা হয়ে গেছে। ছেলে হবে। আজ ছুটির দিন। বাইরে সূর্যগ্রহণ চলছে। গনগনে বৃত্তাকার জ্বলন্ত সূর্যটা থিরিথিরি করে কাঁপতে কাঁপতে রাহুর গ্রাসের ভিতর ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। গোটা শহরটা অন্ধকারে আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে। আকাশে বাদুরের দল ওড়াউড়ি শুরু করে দিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় পাখিরা নীড় খুঁজে পাচ্ছিল না। চারদিকে সুনসান নীরবতা। কেবল কার্নিশে বসে একটি দাঁড়কাকের আতঙ্কিত ডাক শোনা যাচ্ছিল। পাড়ার দূরবর্তী কোনো জায়গা থেকে একটি কুকুর ক্রমাগত কেঁদে চলছিল। ভরদুপুরকে মনে হচ্ছিল যেন গোধূলিলগ্ন। রাস্তাঘাট ফাঁকা ফাঁকা। ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষেরা পানাহার বন্ধ রাখল দুর্জ্ঞেয় কোনো ক্ষতির আশঙ্কায়। এমন নিস্তব্ধতায় আসলাম তাদের বাসায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। সে বই থেকে চোখ তুলতেই দেখে রেহনুমা বাথরুমে ঢুকল। সাথে সাথে একটা চিৎকার সে শুনতে পেল। সে বাথরুমে গিয়ে দেখে রেহনুমা চিত হয়ে শুয়ে আছে এবং তার রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তাড়াতাড়ি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তাররা অস্ত্রোপচার করে তার পেট থেকে যখন তার ছেলেটাকে বের করে আনল, তখন সম্পূর্ণ সূর্যটা রাহুর গ্রাসে চলে গেছে। তারা ছেলেটার নাম রাখল শুভ। রেহনুমা তাড়াতাড়ি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও শুভ কিছুদিন ইনকিউবিটরে রইল।
টিকটিক করে ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে থাকে আর শুভও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। তার যখন আড়াই বছর তখন ওর প্রচণ্ড জ্বর হয়। সাথে অনেক কাশি এবং শ্বাসকষ্ট। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। ডাক্তার বলল নিউমোনিয়া। তার চিকিৎসা চলল। সাত দিন ধরে চেষ্টা করেও জ্বর কমানো গেল না। ডাক্তাররা তখন শিশুদেরকে দেওয়া যায় এমন সর্বোচ্চ শক্তির অ্যান্টিবায়োটিক দিল। তাতেও কাজ না হলে তারা সব আশা ছেড়ে দিল। শুভর বাবা-মা দিশেহারা হয়ে পড়ল। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দেওয়াতে ছেলে আবার সুস্থ হয়ে উঠবে এ রকম বিশ্বাসের ক্ষীণ আলো তাদের মন থেকেও উধাও হয়ে গেল। সবাই যখন হাল ছেড়ে দিল, তখন সবাইকে অবাক করে শুভর জ্বর নেমে গেল। সে কয়েক দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠল। শুভ সুস্থ হওয়ার পরদিন অসুস্থ হয়ে পড়ল তার বাবা। ডাক্তার বলল ডেঙ্গু। সাত দিনের জ্বরে সমস্ত চিকিৎসাকে ব্যর্থ প্রমাণ করে দিয়ে শুভর বাবা আসলাম মারা গেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় রেহনুমা বিস্মিত হলো, স্তম্ভিত হলো। শোকে মুহ্যমান আর বাক্রুদ্ধ রেহনুমা খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিল। সন্তানের দেখাশোনা করাও বন্ধ করে দিল। তখন রেহনুমার বাবা-মা তাকে আর নাতিকে নিজেদের বাসায় নিয়ে গেল। তারা তাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞর কাছে নিয়ে গেল। এভাবে ছমাস ধরে রেহনুমার বিষণ্ণতার চিকিৎসা চলল। এরপর সে সুস্থ হয়ে উঠল এবং ছেলেকে কোলে তুলে নিল।
বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনের অনেক চাপাচাপি সত্ত্বেও রেহনুমা পুনরায় বিয়ে বসতে অস্বীকৃতি জানাল। ছেলেই হলো তার ধ্যান-জ্ঞান, জীবন-যৌবন, বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। স্বামীর বাড়িতে থেকে সে ছেলেকে মানুষ করতে লাগল। বাড়ি ভাড়া যা পেত, তা দিয়ে মা-ছেলের সংসার চলে গিয়েও বেশ কিছু টাকা হাতে থাকত। সেই শুভ আজ মানুষ হয়েছে। সে প্রকৌশলী হয়ে একটি সরকারি অফিসে মাঝারি কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিরত। সৎ এবং দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে তার সুনাম আছে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই সে লাজুক প্রকৃতির এবং নিভৃতচারী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কাউকে হয়তো ভালো লাগত। কিন্তু মুখ ফুটে সে কথা আর বলা হয়নি। তার বিয়ের বয়স হয়েছে এবং তার মা তার জন্য পাত্রী খুঁজছে। সে কী কারণে বিয়ে করতে দেরি করছে, এটা তার মা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। একটা না একটা অজুহাতে সে পাত্রীগুলোকে ফিরিয়ে দিচ্ছে।
কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ঝিলিককে এককথায় বলা যাবে সুন্দরী। সে যখন ক্যাম্পাসের ঢালাই করা পথ দিয়ে হেঁটে যায়, তখন তার দুপাশের দালানকোঠা প্রকম্পিত হয়। তাকে দেখলে সব ছাত্রের এবং তরুণ ও অবিবাহিত শিক্ষকদের হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়। চৈত্রের কাঠফাটা রোদে আকাশের মেঘেরা তার মাথার ওপর দণ্ডায়মান থেকে ছায়া দান করে। সে যদি আসমানের সীমাহীন নীলিমার দিকে তাকায়, তবে তা আরও গাঢ়তর হয়। জোনাকজ্বলা রাতে সে যদি ঘর থেকে বেরোয়, তবে জ্যোৎস্নার প্লাবনে ভেসে যায় বিস্তীর্ণ শস্যখেত, ঘরবাড়ি, গোয়ালঘর, বিদ্যালয়, বাজার আর মসজিদ। ভরা বর্ষায় সে যদি হাসে তবে জেলেদের জালে ধরা পড়ে রাশি রাশি ইলিশ, পাঙাশ আর বোয়াল। সবাই বলে ঝিলিকের মধ্যে জাদু আছে। আর সে জাদুতে ধরাশায়ী সবাই। সবাই ঝিলিককে ভালোবাসে। সবাই ঝিলিকের প্রেম চায়। কিন্তু ঝিলিক কাউকে ভালোবাসে না। তাই সবাই বলল ঝিলিক নার্সিসাস। ঝিলিক শুধু নিজেকে ভালোবাসে। কী করে ঝিলিকের মন পাওয়া যাবে এ নিয়ে তারা ভাবল। অসংখ্য বিনিদ্র রজনী যাপন করল। অবশেষে হাল ছেড়ে দিল। ছোটবেলা থেকেই ঝিলিক বিভিন্ন বয়সের ও সম্পর্কের পুরুষের কাছ থেকে প্রেমের প্রস্তাব পেয়ে এসেছে। কিন্তু কাউকেই সে পাত্তা দেয়নি।
এক বর্ষার বৃষ্টিস্নাত দিনে ঝিলিককে ঘুরতে দেখা গেল কদম ফুল হাতে কলেজের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটির সাথে। সবাই বিস্মিত হলো, হতবাক হলো। সবাই কানাঘুষা করল। বলাবলি করল যে ঝিলিক মেধার পাগল। কিন্তু পৃথিবীতে টাকারও তো প্রয়োজন আছে। তারা ঈর্ষান্বিত হলো এবং ঈর্ষা নিয়েই রাতে ঘুমাতে গেল। কিছুদিন পর সেই মেধাবী ছাত্রটির গা থেকে তারা ঝিলিকের শরীরের ঘ্রাণ পেল। তারা এখন কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইল। বসন্তকাল এলে তারা দেখল যে ঝিলিক একা একা ঘুরছে। তারা আবার আশাবাদী হয়ে উঠল এবং ঈর্ষায় দগ্ধ হৃদয় নিয়ে ঘুমানোর সময় ঝিলিককে স্বপ্নে দেখল। কিছুদিন না পেরোতেই তারা ঝিলিককে দেখল কলেজের সবচেয়ে সুদর্শন ছাত্রটির বাহুলগ্ন হয়ে ঘুরতে। তাদের মনে পুরোনো ঈর্ষা আবার জাগ্রত হলো। তারা আকাশের তারা গুনে নিদ্রাহীন রাত্রি পার করতে লাগল। সেই সুদর্শন ছাত্রটির গা থেকে যখন তারা ঝিলিকের শরীরের ঘ্রাণ পায়, তখন তারা মোটেও বিস্মিত হলো না। তারা এখন দ্বিধান্বিত। তবে আশাবাদী হতে দোষ কী? ঝিলিক যখন চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী, তখন সবাইকে হতবাক করে দিয়ে সে ধুম করে বিয়ে করে ফেলল একজন বিত্তশালী, দেখতে সুপুরুষ ঠিকাদারকে। তারা হতাশ হলেও মনে মনে বলল, ঝিলিক তার যোগ্য স্বামী পেয়েছে। ঝিলিকের বিয়ে হয়েছে আজ পাঁচ বছর হলো। কিন্তু কোনো সন্তানাদি এখনো হয়নি।
ঝিলিকের স্বামী একটি ব্রিজ নির্মাণ করেছে। বেশ মোটা অংকের কাজ। কিন্তু প্রকৌশলী বলছে, ব্রিজ তৈরিতে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে এবং নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি। তাই তার ব্রিজ নির্মাণের বিল পাস করছেন না সেই প্রকৌশলী। বিল পাস করাতে না পারলে বিরাট লোকসানের মুখে পড়তে হবে ঝিলিকের স্বামীকে। সেই প্রকৌশলীকে অনেক টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রলোভনে তাকে গলানো যাচ্ছে না। তিনি নাকি টাকা নেন না। ঝিলিকের সাথে তার স্বামী বিষয়টা নিয়ে আলাপ করতেই ঝিলিক বলে উঠল, ‘আমি তোমার বিল পাস করিয়ে আনতে পারব। আমাকে কী দেবে?’ উত্তরে তার স্বামী বলল, ‘যা চাও, তা-ই পাবে। হীরের নেকলেস হলে চলবে?’ ঝিলিক বলল, ‘চলবে। তুমি দেখো আমি কীভাবে তোমার বিল পাস করিয়ে আনি।’
যে প্রকৌশলী ঝিলিকের স্বামীর বিল আটকে রেখেছে তার নাম শুভ। সে অফিসে বসে কাজ করছিল। তার কক্ষে একসাথে একাধিক দর্শনার্থীর প্রবেশ নিষেধ। তার ব্যক্তিগত সহকারী ইন্টারকমে তাকে জানাল যে সূচনা বিল্ডার্সের মালিকের বউ এসেছে তার সাথে দেখা করতে। শুভ ভিতরে পাঠিয়ে দিতে বলল। ঝিলিক দরজা টেনে ভেতরে ঢুকে টেবিলের বিপরীতে রাখা চেয়ারগুলোর কাছে গিয়ে যখন বলল, ‘বসতে পারি?’
শুভ ফাইল থেকে চোখ তুলে তার দিকে চাইল। ঝিলিক একটা জামদানি শাড়ি পরেছে। তার চোখের দিকে তাকাতেই শুভ দেখল যে সেই চোখে একধরনের দ্যুতি আছে, যা যে কাউকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারে। শুভ সেই চোখের ওপর থেকে চোখ সরাতে পারল না। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে শুভর মনে হলো, তার গভীরতর প্রদেশে সবুজ অরণ্য আছে, যেখানে হারিয়ে যাওয়ার জন্য সে সারা জীবন ধরে অপেক্ষা করছে। সেই অরণ্যের বৃক্ষলতার ফাঁকে ফাঁকে বর্ণিল আলোর তির্যক যে রেখা মৃত্তিকায় পড়ে তাকে দান করে শিল্পিত রূপ সেই আলোয় শুভর চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সে দেখল, শাড়ি পরা অপ্সরা তার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পাতলা শাড়ির ফাঁক গলে সেই অপ্সরার নির্মেদ, নিটোল পেট, পিনউন্নত বক্ষ ভেসে উঠছে। হিন্দু প্রতিমার মতো গোলাকার, ফর্সা মুখের চারু ঠোটের বঙ্কিম হাসি দেখে তার মনে হলো স্বয়ং দেবী ভুল করে তার কক্ষে প্রবেশ করে ফেলেছে। এ হাসি দেখলে জীবনের সব ক্লান্তি, গ্লানিময় জীবনের সমস্ত ক্লেদ ধুয়ে মুছে গিয়ে ফুলেল সুবাসে সুরভিত হয় সম্পূর্ণ সত্তা। তার দেহবল্লরীর ভাঁজে ভাঁজে ফুটন্ত যৌবনের যে আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল, সে আগুনে নিঃশঙ্ক চিত্তে আত্মাহুতি দেওয়া যায়। অপ্সরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছেন? আমি আমাদের বিলটা পাস করাতে এসেছি।’
তার কণ্ঠের মাধুর্যে শুভর সমস্ত অস্তিত্ব সুরের মায়াবী মূর্ছনায় কেঁপে কেঁপে উঠল। শুভ কিছু ভাবতে পারছিল না। কিছু বলতেও পারছিল না, যেন সে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। এরপর সে দেখল সেই অপ্সরা তার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে নারীর ঘ্রাণ পেল, সে শরীরের ঘ্রাণ পেল। পেল মাংসের ঘ্রাণ, ঝিলিকের ঘ্রাণ, অপ্সরার ঘ্রাণ। সেই অপ্সরা তাকে চেয়ার থেকে টেনে দাঁড় করিয়ে ফেলল। সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো, বাধ্য বালকের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। এরপর সে তার ঠোঁটে কোমল, পেলব ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করল। সে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু তার সমস্ত প্রতিরোধ বালির বাধের মতো ভেঙে পড়ল। সে চুম্বনে সাড়া না দিয়ে পারল না। ঝিলিক চুমু দিতে দিতে শাড়ি খুলতে খুলতে তাকে পর্দা সরিয়ে তার বিশ্রাম কক্ষের ভিতরে নিয়ে গেল।
বিল পাস করিয়ে ঝিলিক তার স্বামীর কাছ থেকে হীরের নেকলেস ঠিকই পেল। তবে ব্রিজটি দুমাস পর ভেঙে পড়ল আর একজন মানুষ মারা গেল। পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হলো। টিভি চ্যানেলগুলো রিপোর্ট তৈরি করল। শুভর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হলো। দুর্নীতি দমন কমিশনও মামলা করল। সে জানতে পারল, যেকোনো সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। এক ফাল্গুনের সকালে সে যখন ঘুম থেকে উঠছিল না, তখন তার মা দরজা খুলে দেখে তার লাশটা ফ্যান থেকে ঝুলছে। তার লাশটা দেখে তার মায়ের মনে পড়ে গেল যে আজ দোসরা মার্চ, তার বাবার ষাটতম জন্মদিন।
এভাবে রেহনুমার জীবনে গণকের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছিল।