তারা করতলে পদতলে
এক
প্রবল জ্বরের তপ্ততায় ঘোর; কামজ্বর-ঘোরভাঙা অভিলাষ জড়তা ছাড়িয়ে নিজেকে অতি দৈহিক আবহে গ্রাম্য পুঁজিতান্ত্রিক যাপনে অতিশয় আকর্ষণীয় পণ্যে সাজায়। গূঢ়তম গভীরে প্রবেশের ন্যূনতম আকাঙ্ক্ষাহীন এক যাপন; আপাত-প্রজাপতিসদৃশ চঞ্চলতায় বিভোর। ফলত পাশব জীবনকে নান্দনিকতার প্রলেপে রম্য রমণীরূপে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর।
ত্বক মসৃণ, উজ্জ্বলতর আর ঈষৎ দীর্ঘকায় দ্রাবিড়ীয় সৌকর্যের সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ যুবতী। ঝাঁ-ঝকঝকে পরিপার্শ্ব এবং তার তাবৎ গলিত নষ্ট অনুষঙ্গই তার ভুবন। তৃতীয় দুনিয়ার সকল বিকৃত অনুষঙ্গে অবিচল আস্থাসহ বেড়ে ওঠা এক নারী। বিপরীত ভাবনা তাকে মাঝে মাঝে অদ্ভুত আনমনা করে তোলে। তখন জীবনের কোলাহল থেকে দূরে বদ্ধ ঘরে কেবল প্রলম্বিত ঘুম আর কোলবালিশের সঙ্গে কথোপকথন।
লক্ষ্যহীন, আদর্শহীন, দশর্নহীন এক বন্ধ্যাকাল। কোনো যৌথ মানবিক দার্শনিক প্রত্যয় নেই। বিশ্বজুড়েই এই স্বাপ্নিক দর্শনের সংকট। তার অভিঘাতে বিচিত্রবঙ্গের প্রতিটি তরুণযুবাদের বিভ্রান্ত করে। সেই ঘোরেই তাদের বৃত্তাবদ্ধ যাপন। সুতরাং স্বপ্নগুলো ব্যক্তিগত অভিলাষের চক্রে আবর্তিত। স্বপ্ন তাই পিঁপড়েসদৃশ ক্ষুদ্রস্য ক্ষুদ্র; মূঢ়তার গণ্ডিতে আরও ক্ষুদ্র তাদের ভার্চ্যুয়াল পৃথিবী। অবিকশিত পুঁজির বিকৃত বিকলাঙ্গ কতক অনুষঙ্গ প্রত্যহ চোখধাঁধানো আলোতে গড়াগড়ি খায় চারিপার্শ্বে। তারই অনিবার্যতায় প্রেমকামজর্জর যাপনের দিকে দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে ছোটে। ভোগের চূড়ান্ত শিখর স্পর্শ করার বাসনায় সকল অধীত বিদ্যার সর্বোচ্চ বিকাশ-জমির মালিকানা, বাড়ির মালিকানা, গাড়ির মালিকানা, বিলাসী আভরণ আর অর্থ হচ্ছে একমাত্র লক্ষ্য। পুরুষ তার সর্বোচ্চ মেধা প্রয়োগ করে এইসব ক্ষুদ্রতর উপাদানের নিমিত্তে, নারী তার অধীত বিদ্যা জলাঞ্জলি দিয়ে দেহকে পণ্য করে ভোগের চূড়ান্ত শিখর স্পর্শের কাঙ্ক্ষায়। এমত সামাজিক ব্যাধিগ্রস্ততার ভেতর মানব যাপন বড়ই হাস্যকর।
পাখির চোখে যেন একপাল পতঙ্গের আলোতে আত্মাহুতি দেওয়ার সার্কাস।
দুই
দেশ অস্তিত্বহীন, শাসকযন্ত্র প্রশ্নহীন। একমাত্র ক্ষুদ্রতর ব্যক্তিগতই প্রধান। নীতিহীন অর্থনীতি, ভালোবাসাহীন যৌনতার তুমুল প্রতিযোগিতার ভেতর মানব যাপন সম্পূর্ণ নিমজ্জিত। পুরুষ গন্ধ শুঁকে শুঁকে কুকুরের ন্যায় অর্থ খোঁজে আর নারীর দেহ চাটে সমগ্র জিহবা দিয়ে। যুবতী লুফে নেয় অর্থবিত্ত বিলাসিতা আর কামকলায় আনে নিত্য বৈচিত্র্য।
এসবই হয় গোপনে-অতি গোপনে। গোপনের ঘনত্ব বেড়ে গেলে ঠোকাঠুকিতে বেরিয়ে পড়ে কিছু গল্প নাটক কিংবা সংবাদ। স্বপ্ন এখানে এতোই ক্ষুদ্রতায় পর্যবসিত যে স্বপ্ন নামটি নতুন অভিজ্ঞান দাবি করে।
স্বপ্নের কী নির্মম অপব্যবহার!
একালের গল্প সকল এমত নিম্নমানের।
পারুলি পাগলির মেয়ে বলে শৈশবে পথেঘাটে যেসব বাক্য বর্ষিত হতো তার কানে, সেসব এখন ম্লান। যেখান থেকে জন্ম নিতে পারত এক মহান স্বপ্নের প্রতিশোধ-যাপনের ঝলসিত আলোকে যেখানে এখন স্বীয় দেহ সৌন্দর্যের দম্ভ কেবল।
মাতৃস্মৃতিহীন, পিতৃহীন মেয়েটি এক অসহায় অস্থিরতায় প্রিয় মাতুলকে অবলম্বন করে ঢোকে বিদ্যার্জনের ধাপে। কঠিন সংগ্রামী চাকরির ঘামঝরানো সততায় ব্যক্তিগত সকল অভিলাষকে গলাটিপে মেরে মাতুল গড়ে তুলতে চায় পারুলি পাগলির মেয়েটিকে একজন মনোবৈজ্ঞানিক।
পাড়া কাঁপিয়ে শহর দাপিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ। সরলরেখা ক্রমশ বক্র হতে হতে তারায় পরিণত। আর তারা তাই তারকা হতে চায়।
আর এমত বাস্তবতার ভেতর থেকে বাইরের সকল কল্যাণকামিতা অযৌক্তিক দৃষ্ট হয়। কৃচ্ছ্রতার গল্প, নীতিগল্প যৌথতার গল্প তার নিকট বালখিল্যতা। যে মাতুলের অন্নে বস্ত্রে অর্থে তার যাপন সেই মাতুলসমেত এসবের ভেতরে থাকা সকলই তার ভাষায় সাব-নরমাল। নীতিহীন বাস্তবতার মধ্যে থেকে যাবতীয় ব্যক্তিক ভোগবিলাস চরিতার্থ তার স্বপ্নের কেন্দ্রে সবর্দা বহমান। মানবজমিনের গভীরে প্রবেশের ইচ্ছা নেই তার। উপরিভাগে বিদ্যমান সকল ঝলসিত আলোর পোকারা তাকে আকৃষ্ট করে।
এত পুরোনো গল্প-আগুনের শিখার দিকে পতঙ্গ ধায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে। কে ঠেকাবে তাকে!
তারা বলে কথা-হাতের মুঠোয় নক্ষত্র বিলাসের দুঃসাহস।
আমরা একটি ব্যর্থতার গল্প বলি।
অতীব সুন্দরী তারার একটি গ্রেকো রোমান অসুখ আছে। তারার দু হাতের করতল ও পায়ের পাতার চামড়া প্রতিদিন খসে পড়ে। জলের সঙ্গে অসুখটির বিরোধ চরমে। অনেক চিকিৎসা শেষে চিকিৎসকগণের সিদ্ধান্ত জল স্পর্শ করা যাবে না। একটি গ্রিস দেশীয় মলম ব্যবহার অপরিহার্য। মাতুল ও কল্যাণকামীরা চিন্তিত ও নিরন্তর একটি সমাধানকল্পে ব্যস্ত। তারা এসব পাত্তা দেয় না। তার আছে অতি সুন্দর দেহবল্লরী। রূপবতী যুবতীর কদর সর্বত্র। সুতরাং সে যাচাই-বাছাই করতে করতে অসংখ্য পাণিপ্রার্থীকে আহত করে একজনকে বাছাই করে জীবনসঙ্গী রূপে। ঝকঝকে তরুণ, দারুণ স্মার্ট, বিত্তবান এবং বশংবদ। প্রায়শ খসা চামড়া থেকে রক্তঝরা হাত-পা পরিচর্যায় ছেলেটি অসম্ভব ধৈর্যশীল।
তার আর কোনো বিকল্প নেই। অন্তরের একটি নান্দনিক কষ্ট ক্রমশ নষ্ট ও অশ্লীল হয়ে পড়ে।
এই নগরের প্রতিটি বৃক্ষের পত্রপল্লব তাদের ঈর্ষা করে। প্রতিটি পাখির কিচিরমিচির শব্দে ছড়িয়ে দেয় এই যুগলের ভালোবাসার রূপরসগন্ধ। ক্যাম্পাস বাসের সিটগুলো, শাটল ট্রেনের পাদানিগুলো, বোটানির গন্ধসমূহ ইথারে ইথারে ভাসিয়ে নেয় তাদের ভালোবাসা। ছাত্রছাত্রীর দল, শিক্ষক-শিক্ষিকার দল, কর্মকর্তা-কর্মচারীর দল, হলবাসী-কটেজবাসী সকলের বুকে ঈর্ষার ছুরি মেরে তারা এবং রুদ্র ক্রমশ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়। ইউক্যালিপটাস বৃক্ষগুলো মেডুসার মতো জড়িয়ে ধরে তাদের, বনবীথি গভীর গহিনে ঢুকে পড়ে তাদের ভালোবাসার ধ্বনিসমূহ।
তারায় তারায় রটে যায় তারার ভালোবাসার গল্প।
তিন
ভালোবাসার পরিণতি চূড়ান্ত। তারই দুদিন পূর্বে এক বৃষ্টিস্নাত বিকেলে তারা হিজলতলায় বসে। স্বপ্ন সব রঙিন দু’জনে দু’জনায় পরিপূর্ণ। তারার ক্রোড়ে নায়কের মাথা, চুল আলুথালু করছিল তারা। হঠাৎ নায়ক শিউরে ওঠে, ঠিকঠাক হয়ে মুখোমুখি বসে। নায়ক বিস্মিত নয়নে দেখে তারা’র পদতল ও করতল থেকে রক্ত ঝরার দৃশ্য। এটি নায়কের অপরিচিত দৃশ্য নয়, তবু ক্ষতবিক্ষত হস্তযুগলের দিকে তাকিয়ে অজানা ভয়ে চমকে ওঠে। চূড়ান্ত পরিণতির পূর্বমুর্হূতের এই দৃশ্য তাকে ত্রস্ত করে, ভয়ার্ত করে, নায়ক তাড়িত কণ্ঠে বলে, তোমার এগুলো কি ভালো হবে না আর? চরম অবহেলায় এবং অপরাপর দিবসের ন্যায় নির্লিপ্ত তারা বলে, এগুলো কোনো সমস্যাই নয়, ঠিক হয়ে যাবে। বস্তুত তার আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা-তার দৈহিক সৌন্দর্য ও অধীত বিদ্যার অহংকার। দ্রুত নায়ক একেলা উঠে দাঁড়ায়। আমি একটু আসছি বলে সে দ্রুততায় হাঁটতে থাকে—আর আসে না।
তারা প্রথমে অপেক্ষা করে, ভাবি জীবনসঙ্গীর এই আচরণ বুঝতেই পারে না। তারা হিজলতলায় বসেই থাকে তত দিন, যত দিন না, তারা নক্ষত্র হয়ে আকাশে ভাসে।