জলিল মাম্মাদ গুলুজাদেহের গল্প ডাকবাক্স
জলিল মাম্মাদ গুলুজাদেহ
কথাসাহিত্যিক। ইরানি মা-বাবার সন্তান। জন্ম বর্তমান আজারবাইজানে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৬ সালে। ব্যঙ্গরসাত্মক রচনার জন্য তিনি বিশেষ পরিচিত ছিলেন। লেখার জগতে প্রবেশের আগে মাম্মাদগুলুজাদেহ গ্রামীণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে বহু বছর কাজ করেছিলেন। বন্ধুদের সাথে যৌথভাবে একটি প্রকাশনা সংস্থা কেনার পর তিনি মোল্লা নাসিরউদ্দিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সেটি একটি ব্যঙ্গাত্মক ম্যাগাজিন হিসেবে প্রকাশিত হতো, যার ভাবধারা মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। অচিরেই ম্যাগাজিনটিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করে তার প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। মাম্মাদগুলুজাদেহকে আজারবাইজান এবং মধ্যপ্রাচ্যের নারী অধিকার কর্মে নিযুক্তদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া আজারবাইজানের প্রথম নারী পত্রিকা প্রকাশের পেছনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।জলিল মাম্মাদগুলুজাদেহ অসংখ্য ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও নাটক লিখেছেন। মাতৃভাষায় তাঁর দারুণ দখল ছিল। তিনি আজেরি ভাষাকে বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে তাকে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৯৩২ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ‘পোস্টবক্স’ আজারবাইজানি থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ভাফা টালিশলি।
—ভূমিকা ও অনুবাদ নাহার তৃণা
ডাকবাক্স
নভেম্বর মাসের বারো দিন পেরিয়ে গেছে। আবহাওয়া ঠান্ডা থাকলেও তখন পর্যন্ত তুষারপাত হয়নি। খান সাহেবের অসুস্থ স্ত্রীকে ডাক্তার পরীক্ষা করে জানালেন, তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। চাইলে তারা এক সপ্তাহের মধ্যে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়তে পারেন। খান সাহেবের ইয়েরেভান যাওয়ার তাড়া ছিল। ব্যবসায়িক কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য তার সেখানে উপস্থিত হওয়াটা জরুরি। একই সঙ্গে তিনি এই চিন্তাতেও অস্থির ছিলেন যে তুষারপাত শুরু হয়ে গেলে বিরূপ আবহাওয়ায় ভ্রমণ করা তার স্ত্রীর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে। ডাক্তারের অভয় বাণী শোনামাত্রই তিনি বন্ধু জাফর আগাকে চিঠি লিখতে বসলেন: ‘আশা করি আমরা আগামী সপ্তাহে সপরিবারে ইয়েরেভানে পৌঁছাব। আমরা গিয়ে যে বাড়িতে উঠব, তার ঘরগুলো যেন আরামদায়ক বসবাসের উপযুক্ত হয় সে ব্যাপারে তুমি কি একটু দেখভাল করবে? কাজের লোকেরা যেন ঘরে ফরাশ পেতে দেয়, চুলাগুলো আগুন জ্বালানোর উপযোগী করে রাখে, আর ঘরগুলোতে আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করে। পুরো ব্যবস্থাটা যেন আমার অসুস্থ স্ত্রীর জন্য প্রীতিকর হয় সে ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চাই। টেলিগ্রাম মারফত ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাকে জানিয়ো দয়া করে। তুমি যে কাজের কথা বলেছিলে, সেটা আমি গুরুত্বের সাথেই দেখছি। ভেবো না। ভালো থেকো। তোমার বন্ধু, ভালি খান।’
চিঠি লেখা শেষ হলে খান সাহেব সেটা ভাঁজ করে খামে ভরলেন। খামের ওপর প্রাপকের ঠিকানা লিখে তাতে স্ট্যাম্প লাগালেন। চিঠিটা ডাকবাক্সে ফেলে আসবার জন্য কাজের লোকটিকে ডাক দিতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে মনে পড়ল, তাকে তিনি অন্য কাজে ইতোমধ্যে বাইরে পাঠিয়েছেন। ঠিক তখনই বাইরের দরজায় কারও আওয়াজ পেলেন। বাইরে বেরিয়ে তিনি দেখলেন, ইটগাপান গ্রাম থেকে নোরুজআলি এসেছে। গ্রাম থেকে নোরুজআলি প্রায় তার সাথে দেখা করতে আসে, এবং কখনোই সে খালি হাতে আসে না। তাদের জন্য কিছু না কিছু সে আনবেই, এই যেমন ঘরের জাঁতায় পেষা ময়দা, মধু, মাখন ইত্যাদি। এবারও সে খালি হাতে আসেনি। খান সাহেবকে দেখামাত্রই নোরুজআলি তার হাতের লাঠিটা দেয়ালে ঠেকিয়ে দরজাটা ঠেলে খুলতে শুরু করল। এরপর বোঝাসহ গাধাটিকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। ভেতরে ঢুকেই সে গাধার পিঠের বোঝা থেকে তিন-চারটা মুরগি বের করে হাতে নিল। বোঝার বাঁধন খুলে কিছু বস্তা মাটিতে নামিয়ে রাখল। এরপর চোখ তুলে খান সাহেবের দিকে তাকিয়ে সামান্য নত হয়ে সম্মান জানাল।
‘তুমি এত ঝামেলা করতে কেন যাও বলো দেখি নোরুজআলি?’
‘এসব কোনো ঝামেলাই না। এই ভৃত্যকে এটুকু খেদমতের সুযোগ তো দেবেন সাহেব। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যেন আপনার সেবায় নিযুক্ত থাকি।’ জামাকাপড়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে গ্রাম্য চাষা নোরুজআলি উত্তর দিল।
ঘড়িতে তখন বেলা একটার মতো বাজে, ডাকবাক্স থেকে এ সময়ের ভেতর চিঠিপত্তর বের করে নেওয়া হয়। খান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘নোরুজআলি, তুমি কি এখানকার পোস্ট অফিসটা চেনো?’
‘গ্রামের চাষাভুষা মানুষ আমি, পোস্ট অফিস কোথায় আমি কী করে জানবো সাহেব?’
‘কেন্দ্রীয় আদালত ভবনটা কোথায় সেটা জানো?’
‘হ্যাঁ, আদালত ভবনটা কোথায় সেটা বিলকুল জানি। গত সপ্তাহেই প্রধান বিচারকের কাছে আমাদের নগরপালের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে গিয়েছিলাম। নগরপাল ব্যাপক পাজি, আমাদের উপর তার জুলুমবাজির শেষ নাই। আপনাকে সত্যিটা বলি সাহেব, নগরপাল মোটেও আমাদের এলাকার লোক নন। অন্য এলাকা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন, সে কারণে আমাদের তিনি ভয়ানক অপছন্দ করেন। আমাদের ভালোমন্দ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নাই। গেল সপ্তাহে আমার দু-দুটো বাছুর লাপাত্তা হয়েছে। সে জন্য ওখানে গিয়েছিলাম…’
রোসো বাপু, বাকি কথা পরেও বলতে পারবে। এখন আমার কথা খুব মন দিয়ে শোনো, একটা বিষয় তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি, সেইভাবে কাজটা তোমায় করতে হবে—বুঝেছ? আদালত ভবনের রাস্তার উল্টো দিকে একটা বাড়ি আছে, সেই বাড়ির দেয়ালের সাথে একটা বাক্স লাগানো আছে—ওটাই ডাকবাক্স। বাক্সটা দেখতে লম্বা, যার ওপরে সরু ঢাকনা দেওয়া। তুমি ঢাকনা সরিয়ে চিঠিটা ভেতরে ফেলে সটান বাড়ি চলে আসবে। একদম সহজ কাজ, পারবে না?’
নোরুজআলি সযত্নে চিঠিটা হাতে নিল। এরপর প্রথমে সে খান সাহেবের দিকে তাকাল, তারপর ভয়ার্ত চোখে চিঠিটা আরেকবার দেখল। সে সদর দরজার দিকে হেঁটে গিয়ে উবু হয়ে চিঠিটা মাটির ওপর রাখল। খান সাহেব গলা তুলে চেঁচালেন,
‘ওরে বোকা, ওখানে রাখছ কেন! মাটি লেগে নোংরা হয়ে যাবে তো। পা চালিয়ে গিয়ে চিঠিটা ডাকবাক্সে রেখে এসো বাপু।’
‘সাহেব, একটু সময় দেন, খচ্চরটার গলার কাছে যব ভরে একটা থলি ঝুলিয়ে দিয়ে যাই। অনেকটা পথ বেচারা হেঁটে এসেছে, নিশ্চয়ই সে খুব ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত।’
‘না, না এখন নয়, ওর খাওয়া পালিয়ে যাচ্ছে না, ওটা পরে হলেও চলবে। দেরি করলে এ বেলার ডাকে চিঠিটা যাবে না। ফিরে এসে বরং গাধাকে খাবার দিয়ো।’
‘ঠিক আছে। তাহলে ওটাকে বেঁধে রাখার অনুমতিটুকু দেন। আমার ভয় হচ্ছে ওটাকে না বেঁধে যদি ছেড়ে রেখে যাই তবে আপনার বাগানের গাছগাছালি খেয়ে সর্বনাশ করবে।’
‘না না, তারও দরকার নেই। তুমি যত জলদি পারো যাও দেখি। যাও যাও, গিয়ে ডাকবাক্সে চিঠি দিয়ে ফিরে এসো।’
হাতের চিঠিটা নোরুজআলি ওর জামার পকেটে রাখল। তারপর আবারও বলল— ‘খান সাহেব, ওই মুরগিগুলো এখনো বাঁধা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বেচারা অবলা জীব, অনুমতি দেন ওগুলোর বাঁধন খুলে কিছু শষ্যদানা দিয়ে যাই।’
নোরুজআলি তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে মুরগির জন্য শষ্যদানা নেবার উদ্যোগ করতেই আগের চেয়ে দ্বিগুণ জোরে খান সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘না, একদম না! ওসব পরে হবে, কাজ সেরে ফিরে এসো, তারপর।’ অগত্যা নোরুজআলি তার ছড়িটা তুলে নিয়ে বাচ্চা ছেলের মতো দৌড় লাগাল।
খানিকটা যাওয়ার পর, কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ায় আবার ঘুরে খান সাহেবের কাছে এসে ওজর দেখিয়ে বলল, ‘খান সাহেব, ওখানে একটা বস্তায় কিছু ডিম আছে। অসাবধানে আবার ভেঙে না যায়। আমার ভয় হচ্ছে খচ্চরটা না আবার ওটার উপরই শুয়ে পড়ে ডিমগুলোর দফারফা করে দেয়।’
ভয়ানক রোষে ফেটে পড়া গলায় খান সাহেব বলে উঠলেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে! বকবকানি থামাও। খামোখাই আমরা সময় নষ্ট করছি।’
নোরুজআলি যাবার জন্য পা বাড়াতেই খান সাহেব তাকে ডাকলেন।
‘নোরুজআলি, অন্য কারো হাতে চিঠিটা দিয়ো না আবার। কাউকে দেখানোরও দরকার নেই। ডাকবাক্সে চিঠিটা রেখে সোজা বাড়ি ফিরবে— মনে থাকে যেন! বুঝেছ?’
‘সাহেব এমন করছেন যেন আমি কচি খোকা! যতটা ভাবছেন অতটা অগামূর্খও নই। একদম ভাববেন না, নগরপালেরও সাধ্য নাই আমার হাত থেকে চিঠিটা কেড়ে নেয়।’
কথাগুলো বলেই নোরুজআলি ওখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। নোরুজআলি যাওয়ামাত্র খান সাহেব ঘরের ভেতর ফিরে গেলেন। তারপর গিয়ে অসুস্থ স্ত্রীর পাশে বসে দরদমাখা গলায় বললেন, ‘শোনো, সোনাপাখি, এবার যাত্রার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করো। ইয়েরেভানে চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছি তারা যেন আমাদের থাকবার ঘরগুলো ঝাড়পোঁছ করে আরামদায়ক করে রাখে। এবার আমরা বেরিয়ে পড়তে পারি। তোমাকে এখন বেশ সুস্থ দেখাচ্ছে, খোদার কাছে শুকরিয়া। ডাক্তার বলেছেন, হাওয়া বদল হলে তোমার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হবে।’
খান সাহেব যখন স্ত্রীর সাথে কথা বলছিলেন তখন কাজের লোকটা এসে বলল, ‘সাহেব, ওটা কার গাধা, উঠোনময় চরে বেড়াচ্ছে? বস্তায় ভরা জিনিসগুলোই-বা কে এনেছে?’
খান সাহেব বললেন, ‘জিনিসগুলো ওখান থেকে সরিয়ে রাখো। ইটগাপান গ্রাম থেকে নোরুজআলি এনেছে ওগুলো।’
কাজের লোক উঠোন থেকে মুরগি, ডিমগুলো রান্নাঘরে রাখল আর গাধাটাকে নিয়ে আস্তাবলে রেখে এলো। তারপর সে ময়দা ভর্তি একটা বস্তা খুলে তা থেকে এক চিমটি ময়দা নিয়ে খান সাহেবকে দেখিয়ে বলল, ‘খুব ভালো জাতের ময়দা।’
খান সাহেব সেদিকে তাকিয়ে তাকে তাদের জন্য রুটি তৈরি করতে বললেন। আহারপর্ব শেষ করার ঘণ্টা দুয়েক পর চিঠি আর নোরুজআলির কথা তার মনে পড়ল। কাজের লোকটাকে তলব করা হলো, কিন্তু সে জানাল, নোরুজআলি তখনও ফিরে আসেনি। নোরুজআলির এত সময় কেন লাগছে তা ভেবে খান সাহেব অবাক হলেন।
এটা ভেবে তিনি স্বস্তি পেতে চাইলেন যে, চিঠিটা ডাকে ফেলার পর ক্ষিদে পাওয়ায় কিছু কিনে খাবে বলে নোরুজআলি হয়তো বাজারে গেছে। আরও এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল কিন্তু তখনো নোরুজআলির পাত্তা নেই। শেষমেশ খান সাহেব কাজের লোকটিকে ডেকে নোরুজআলির কী হলো বাইরে গিয়ে খোঁজ নিতে বললেন। আধঘণ্টা পর কাজের লোক ফিরে এসে জানাল, সে কোত্থাও নোরুজআলিকে খুঁজে পায়নি। চিন্তিত খান সাহেব ঝুলবারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। নোরুজআলি কোথায় লাপাত্তা হয়ে গেল, সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে পায়চারি করতে লাগলেন।
ঠিক তখনই তার বাড়িতে পুলিশের এক কনস্টেবল এসে উপস্থিত হলো। সে জানাল, ‘খান সাহেব, পুলিশপ্রধান চান আপনি থানায় এসে আপনার গ্রামের লোকটিকে জামিনে ছাড়িয়ে নিন। আর তাতে যদি আপনার আপত্তি থাকে, পুলিশপ্রধান তাহলে লোকটিকে কয়েদখানায় পাঠাবেন।’
খান সাহেব বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে আগত লোকটির দিকে তাকালেন। সংবিৎ পেয়ে তারপর উত্তরে বললেন, ‘ওই লোক তো একদম গোবেচারা। তার পক্ষে এমন কী করা সম্ভব যার জন্য তাকে গ্রেপ্তার হতে হলো?’
‘কী ঘটেছে আমি নিজেও সঠিক জানি না জনাব। ভালো হয় যদি আপনি থানায় গিয়ে ঘটনা বিস্তারিত জেনে আসেন।’
খান সাহেব তড়িঘড়ি পোশাক পাল্টে নিলেন, অসুস্থ স্ত্রীকে সাতপাঁচ কিছুই জানালেন না, বেচারি খামোখাই চিন্তায় পড়ে যাবে। থানায় পুলিশপ্রধানের ঘরে ঢোকার আগে গরাদের ফাঁক দিয়ে তিনি হাজতের ভেতর নোরুজআলিকে দেখতে পেলেন। কিছু কয়েদির সাথে হাজতের এককোনায় বসে বেচারা শিশুর মতো হাপুস হয়ে কাঁদছিল, আর দুগাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু সে তার চোখার প্রান্ত (বিশেষ ধরনের উলের পোশাক) দিয়ে মুছছিল।
যথাসময়ে নোরুজআলির জেলহাজতে যাওয়ার পেছনের কাহিনি জানতে পারেন খান সাহেব। এরপর সাক্ষী হয়ে জামিনে নোরুজআলিকে ছাড়িয়ে একসঙ্গে বাড়ি ফিরে আসেন। খান সাহেবের সাথে বাড়ি ফিরে নোরুজআলি তার গাধাকে খেতে দেয়, তারপর দেয়ালে ঠেস দিয়ে আবার কাঁদতে বসে। খান সাহেব ঘরের ভেতর গিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে সোজা ঝুলবারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান এবং নোরুজআলিকে ডেকে পাঠান।
নোরুজআলি উপস্থিত হওয়া মাত্র কৌতূহলে ছটফটিয়ে খান সাহেব বললেন: ‘কী ঘটেছিল এবার সবটা আমাকে খুলে বলো নোরুজআলি! মনে হচ্ছে জবর একটা গল্প আছে এর পেছনে। যে কেউ এ নিয়ে বই লিখে ফেলতে পারবে। খুঁটিনাটি সবটাই শুনতে চাই। যখন তোমাকে চিঠিটা দিলাম সেখান থেকে শুরু করে কীভাবে তুমি হাজতে গিয়ে পৌঁছালে, শেষ পর্যন্ত বলো।’
নোরুজআলি উঠে খান সাহেবের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পরনের কাপড়ে চোখ মোছার পর বলল, ‘খান সাহেব আমাকে মার্জনা করবেন! আমি কোনো অপরাধ করিনি। গ্রামের মুখ্যুসুখ্যু গরিব এক চাষা আমি। চিঠি, ডাকবাক্স, পোস্ট অফিস বিষয়ে আমার পক্ষে জানা কীভাবে সম্ভব বলেন দেখি? আমাকে ক্ষমা করে দেন সাহেব, মিনতি করছি! আমার কারণে আপনাকে এই যে এত হ্যাপা পোহাতে হলো, কোনোভাবে আমি সেটা পুষিয়ে দেবার চেষ্টা করব। যে ঘটনা ঘটে গেছে সেটা তো আর ফেরানো সম্ভব না। এর পেছনে নিশ্চয়ই খোদার ইশারা ছিল। আমাকে ক্ষমা করেন সাহেব। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমি আপনার বিশ্বস্ত ভৃত্য হিসেবে বহাল থাকব…’
নোরুজআলি খান সাহেবের আরও কাছে সরে আসে এবং নিচু হয়ে তার পায়ে চুমু খায়।
‘এই ঘটনা নিয়ে তুমি এতটা ব্যতিব্যস্ত হয়ো না নোরুজআলি। তোমাকে দোষী ঠাওরে আমি কি কিছু বলেছি? আমার সাথে তুমি কি কোনো অন্যায় করেছ? তাহলে তোমাকে ক্ষমা করার প্রশ্ন আসছে কেন?’
‘ওহ্, খান সাহেব আপনি গল্পের বাকিটা জানেন না। ওই নাস্তিকের বাচ্চা নাস্তিকটা আপনার চিঠিটা পকেটে পুরে সটান হেঁটে চলে গেল।’
‘কে চিঠিটা পকেটে পুরে চলে গেল?’
‘ওই উটকো রাশিয়ান লালমুখোটা।’
‘চিঠিটা নিয়ে সে কোথায় গেল?’
‘সেই বাড়িটার ভেতরে, যেটার দেয়ালে ডাকবাক্স লাগানো, আপনি যেমন যেমন বলেছিলেন, সে রকম দেখতে বাড়িটা। চিঠি নিয়ে হুমদোটা ওই বাড়ির ভেতর চলে যায়।’ কিছু মুহূর্তের জন্য খান সাহেব চুপ মেরে যান।
‘চিঠিটা তুমি ডাকবাক্সের ভেতর রাখোনি?’
‘আলবৎ রেখেছি! আপনার চিঠিটা বাক্সে রেখেছি কি রাখিনি, রাশিয়ানটা এসে কী ছলচাতুরী করে যেন চিঠির বাক্সটা খুলে ফেলল আর চিঠি নিয়ে চলে গেল।’
‘আমাদের চিঠিটা ছাড়া অন্য কোনো চিঠি কি তখন বাক্সের ভেতর ছিল?’
‘হ্যাঁ তো, বেশুমার চিঠি ছিল বাক্সটার ভেতর। সবগুলো চিঠিই সে চুরি করেছে।’
নোরুজআলির কথা শুনে খান সাহেব অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।
‘নাহ্, নোরুজআলি তুমি পুরো গল্পটাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আদতে যা যা ঘটেছিল সবটা বলো দেখি।’
‘খান সাহেব, প্রথম থেকেই বলছি তাহলে, আপনার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে কেন্দ্রীয় আদালত ভবনের দিকে চলে যাই। আপনি যেমনটা বলেছিলেন ঠিক সে রকম দেখতে দালানটাও খুঁজে পাই, যার দেয়ালে চিঠির বাক্সটা ছিল। আমি বাক্সের ঢাকনা খুলে ভেতরে চিঠিটা রাখতে গিয়েও থেমে যাই। চিঠিটা হাতে নিয়ে প্রথমে ওটা দেখি তারপর বাক্সটাকে ভালোভাবে লক্ষ করি। সত্যি বলছি আমার কেমন ভয় ভয় করল। আপনাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম চিঠিটা বাক্সের ভেতর রেখে আমি কি ধারেকাছেই দাঁড়িয়ে থাকব, নাকি বাড়ি ফিরে আসব। কিছু ঠাহর করতে পারছিলাম না ওই মুহূর্তে। আমি চিন্তা করলাম যদি চিঠিটা বাক্সের ভেতর রেখে কাছাকাছি কোথাও দাঁড়িয়ে থাকি, তাহলে সন্ধ্যা পর্যন্ত হয়তো দাঁড়িয়েই থাকতে হবে। কিন্তু আপনি তো নিজের চোখেই দেখেছেন সাহেব, বেচারা খচ্চরটাকে অভুক্ত রেখে গেছি, মুরগিগুলোর পায়ের বাঁধনও খুলে যাইনি, কিছু ময়দা নিয়ে এসেছিলাম, সে-ও এখনো উঠোনেই পড়ে আছে। সাহেব, আপনার ভৃত্যটিকে যদি একটু ডাকতেন, দুজনে মিলে তবে বস্তাগুলো বাড়ির ভেতর নিয়ে যেতাম। মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে, ময়দা ভিজে একশা হয়ে যাবে।’
‘ওসব নিয়ে এখন চিন্তার দরকার নেই নোরুজআলি…তুমি বরং গল্পের বাকিটুকু বলে শেষ করো। কী হলো তারপর?’
‘ভেবে কূল না পেয়ে আমি আর চিঠিটা বাক্সের ভেতর রাখিনি। ডাকবাক্সের ঢাকনা বন্ধ করে ওখান থেকে খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম। একবার ভেবেছিলাম কী করব ফিরে এসে আপনাকে সেটা জিজ্ঞেস করি, কিন্তু ভয়ও হলো তাতে যদি আমার ওপর আপনি রেগে যান। ভাবলাম রেগেমেগে আপনি হয়তো বলতে পারেন, নোরুজআলি, তুমি একটা বোকার হদ্দ, যেমন গর্দভ, যার কিচ্ছু বোঝার ক্ষমতা নাই। তাই ওসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে একটু জিরিয়ে নেবার জন্য দেয়ালে হেলান দিলাম। তখন বারো-তেরো বছরের আর্মেনিয়ান এক খোকাকে আসতে দেখলাম। সে ডাকবাক্সের কাছে গিয়ে ঢাকনা খুলে আপনি আমায় যে রকম চিঠি দিয়েছেন, ঠিক ও রকম একটা চিঠি বাক্সের ভেতর রেখে ঢাকনাটা বন্ধ করে চলে গেল। বাক্সের ভেতর চিঠিটা রেখে ও কেন চলে যাচ্ছে, জানবার জন্য আমি তাকে ডাকলাম, কিন্তু সে আমাকে পাত্তাই দিল না। কেন কে জানে! হয়তো সে আমার কথাই বোঝেনি। যাহোক, কোনো দিকে না তাকিয়ে খোকাটা চলে গেল। তার কিছু সময় পরপরই, এক রাশিয়ান মহিলা এলো, তড়িঘড়ি বাক্সে চিঠি রেখে সে-ও চলে যায়। ওদের কারবার দেখে আমার ভেতর সাহস জন্মাল। মনে মনে ভাবলাম মনে হয় ওভাবেই বাক্সের মধ্যে চিঠিগুলো রাখতে হয়। কাজেই সাহস নিয়ে ‘বিসমিল্লাহ্’ বলে এগিয়ে গিয়ে ঢাকনা খুলে চিঠিটা বাক্সের ভেতর রেখে আপনার খেদমতে বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়ালাম।
বাক্সটা থেকে যখন আমি বেশ খানিকটা দূরে গেছি, তখনই ওই উটকো রাশিয়ান লোকটা উদয় হলো। প্রথমে ভেবেছিলাম, ব্যাটাও বুঝি বাক্সে চিঠি রাখতে এসেছে। কিন্তু দেখলাম না, ঘটনা মোটেও তা নয়, লালমুখোটা কিছু একটা ভজকট পাকাচ্ছে। সে তার হাতটা বাক্সের ভেতর ঢোকাল। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম, ব্যাটা চিঠিগুলো চুরির মতলবে এসেছে…সাহেব, আমি মনে হয় বেশিই বকবক করে ফেললাম, মার্জনা করবেন। আপনার ভৃত্যটিকে বলুন সে যেন আমাকে গ্রামে ফিরে যাওয়ার তোড়জোড়ে একটু সাহায্য করে, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
‘এক্ষুনি তোমাকে ছাড়া যাচ্ছে না বাপু, আগে তো বলো তারপর কী ঘটল?’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বলব, আপনার খেদমতে হজুরে হাজির আছি খান সাহেব। এই অধমের সন্তানেরাও যেন আপনার খেদমতে লাগতে পারে। আপনার আশীর্বাদ বিনা আমি যেন দিন গুজরান না করি। তো কী বলছিলাম? হ্যাঁ, আমি তখন দেখলাম লোকটা ডাকবাক্সটা থেকে সবগুলো চিঠি বের করে নিয়েছে। তারপর বাক্সের ঢাকনা বন্ধ করে যাবার জন্য পা বাড়াচ্ছে। আমি তৎক্ষণাৎ দৌড়ে গিয়ে পথ রোধ করে তাকে থামালাম। তাকে বললাম, ‘এই যে তুমি, বলি চিঠিগুলো বগলদাবা করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি? কী ভাবো তুমি! লোকেরা তাদের চিঠিগুলো এখানে রেখে যায় তুমি সেগুলো চুরি করবে বলে নাকি অ্যাঁ? চিঠিগুলো যেখান থেকে নিয়েছ সেখানে রেখে দাও শিগগির। নোরুজআলি এখনো মরেনি, জান থাকতেও সে তোমাকে তার মালিকের চিঠি নিয়ে সটকে পড়তে দেবে না। যে জিনিস তোমার নয়, সেটা নিতে নাই, জানো না তুমি লালমুখো? তোমাদের রাশিয়ান আইনে বলা নাই যে চুরি করা অপরাধ?
সাহেব, আমার সন্তানেরা আপনার খেদমতগার হোক সেই দোয়া করি, কিন্তু এখন আমাকে যাবার আজ্ঞা দেন–সত্যিই ম্যালা দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
‘এত তাড়াহুড়ো করো না, একটু পরেই না হয় তুমি যাবে…বলে শেষ করো, তারপর কী হলো?’
‘ভেবে বলছি সাহেব, কদ্দুর যেন বলেছিলাম…হুশ, হুশ! খচ্চরটাকে আটকাও, দেখো, ও যেন আঙুরলতা তছনছ না করে।’ নোরুজআলি গিয়ে গাধাটাকে থামাতে চাইছিল, কিন্তু খান সাহেব তাকে যেতে দিলেন না।
‘নোরুজআলি, রোসো তুমি, এখন যেয়ো না। কী হলো তারপর? বলো।’
‘কী হলো? হুম, আমি তখন ভিক্ষে চাওয়ার মতো কাকুতি-মিনতি করে লোকটাকে বললাম, খান সাহেবের চিঠিটা যদি হাতছাড়া হয় তবে তিনি আমায় মেরেই ফেলবেন। আমি তাকে বললাম, খান সাহেবের চিঠিটা ফেরত দাও। সে বলল—না, ওটা সে আমাকে ফেরত দেবে না। দেখলাম সে তখন প্রায় দৌড়ে পালাবার ফন্দি করছে। খোদাই মালুম, কতটা খুন চেপেছিল আমার মাথায়—আমি তাকে কাঁধে নিয়ে এতটাই জোরে আছড়ে মাটিতে ফেলেছিলাম যে ওর মুখ থেকে রক্ত পড়া শুরু হলো। খুনোখুনি হতে দেখে আদালত ভবন থেকে কিছু সৈন্য দৌড়ে এলো। তারা এসেই আমাকে আচ্ছামতো প্যাদালো। তারপর গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে গেল। আমি আজীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকব সাহেব, আপনি না থাকলে আজ আমার দফারফা হয়ে যেত—
ওরা আমাকে এতক্ষণে সাইবেরিয়া চালান করে দিত। হাজতবাসী আসামিদের অনেকেই আমাকে বলেছে, রাশিয়ান ওই লালমুখোটা নাকি সরকারি অফিসার। বেশ…আমার আসলে কী করা উচিত ছিল? সাহেব, আপনি বলুন আমি কী দোষ করেছি, সত্যিই কি আমি অপরাধী?’
খান সাহেব তখন হেসেই চলেছেন। তার হাসি আর থামছে না। বাইরে ততক্ষণে ঘোর আঁধার নেমে গেছে। নোরুজআলি খালি বস্তাগুলো গাধার পিঠে বাঁধাছাদা করে নিয়ে হাতের লাঠিটা দিয়ে তাকে মারতে মারতে গ্রামের দিকে ফিরে চলল।
তিন দিনের মধ্যে ইয়েরেভান থেকে খান সাহেবের কাছে একটা টেলিগ্রাম এলো। তাতে লেখা: ‘আপনার পত্র পেয়েছি। আপনাদের ঘরগুলো তৈরি রাখা হয়েছে।’ অল্প সময়ের মধ্যে খান সাহেব স্ত্রীকে নিয়ে ইয়েরেভানের উদ্দেশে যাত্রা করলেন।
দেড় মাস পর, নোরুজআলিকে আদালতে তলব করা হয় এবং কর্তব্যরত একজন সরকারি কর্মচারীকে লাঞ্ছিত করার অপরাধে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যদিও নোরুজআলি নিজেকে নির্দোষ দাবী করেছিল, কাজ হয়নি। তিন মাস পর খান সাহেব যখন এই ঘটনা জানতে পারেন, তখন কিছু সময়ের জন্য তিনি বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন।
ভাফা টালিশলি
জলিল মাম্মাদগুলুজাদেহ রচিত ‘পোস্টবক্স’ গল্পটি মূল আজারবাইজানি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ভাফা টালিশলি [Vafa Talyshly। আজারবাইজানের দক্ষিণ সীমান্তের কাছাকাছি শহর লঙ্কারনে একজন সোভিয়েত শিশু হিসেবে ভাফা টালিশলির বেড়ে ওঠা। এফএসএ ফাউন্ডেশনের বৃত্তি [১৯৯৪-৯৫ শিক্ষাবর্ষ] নিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডিগ্রি লাভ করেন। বৃত্তি অর্জনের প্রাপ্তিটিকে তিনি জীবনের সেরা একটি অর্জন বলে মনে করেন। কেননা বৃত্তির জন্য এক হাজার আবেদনকারীর মধ্যে মাত্র ৪০ জন শিক্ষার্থী যোগ্য হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন। আমেরিকায় পড়তে এসে সোভিয়েত এবং মার্কিন শিক্ষাব্যবস্থার রীতিনীতির মধ্যকার আকাশ-পাতাল পার্থক্য তিনি হাড়ে হাড়ে অনুধাবনে সক্ষম হন। নিজের স্বাধীন সত্তার খোঁজ তিনি সে সময়েই খুঁজে পান বলে বাকু ডায়েরিতে উল্লেখ করেন। টালিশলি আজারবাইজানের সাহিত্য পত্রিকার ‘বাকু ডায়েরি’র একজন লেখক। নিজের দেশ আজারবাইজান নিয়ে আশাবাদী ভাফা ইংরেজি অনুবাদকর্মে ইতোমধ্যে নজর কেড়েছেন। তিনি আজারবাইজেনীয় ভাষা সাহিত্য বিশ্বের দরবারে উপস্থিত করতে আগ্রহী। এর মধ্যে তিনি বেশ কিছু অনুবাদকর্ম করেছেন। আলোচ্য গল্পটি তার একটি।