বৃষ্টিমোচনে অশ্রুবধ

 

আমার মৃত্যুর পরে কোনো শুয়োরের বাচ্চা কাঁদতে পারবে না।
মনিটরের দিকে তাকিয়ে খালি পায়ে নরম কার্পেটে হাঁটার মতো আরাম লাগল তোফায়েলের। লেখাটাকে বোল্ড করল, ইটালিক করল, ফন্ট অদলবদল করে ছোটবড় করল। তাতেও মন না ভরলে প্রিন্ট দিয়ে এনে তাকিয়ে রইল, চেটে চেটে খেতে পারলে ভালো হতো। চেটে চেটে খাওয়ার কথা মনে হতেই অটো হাত চলে গেল টেবিলের ড্রয়ারে। এক পেগের একটা ছোট্ট ভোদকার বোতল পড়ে আছে কয়দিন ধরে। এক শালা দিয়ে গেছে। ডান হাতের তালুতে কয়েক ফোঁটা ফেলে চেটে চেটে খেল। সতেরো দিন আগে সে ঠিক করেছে, আর না, বহুত হইছে। দিনক্ষণ ঠিক করতেও আলসেমি লাগছিল এত দিন। তিন দিন আগে মাথায় এসেছে উইল করে কান্দা বন্ধ করার কথা। তারপর থেকে দুনিয়াকে লাত্থি মারার সুখ হচ্ছে।
টুকটাক নেট ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে জানতে পেরেছে, আত্মহত্যা করতে গিয়ে বিফল হলে শাস্তির বিধানও নাকি আছে। যদিও মানবিক কারণে নাকি সেই শাস্তি দেওয়া হয় না। বদলে রিহ্যাবে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কোনো কোনো পশচোদা দেশে। আবার নাকি মরতে গিয়ে ফেল মারলে, শাস্তির বিধান তুলেও নিয়েছে শালার বোকাচোদারা। কেউ নিজের জীবন নিজে শেষ করতে চাইলে শালাদের এত পাছা জ্বলে কেন! তোফায়েল ভাবল, হারামি আত্মহত্যা নিয়ে আর একটু পড়লেখা করতে হবে। বিড়বিড় করে বলল, শালার আত্মহত্যার শেষ দেখে ছাড়ব আমি। বাংলাদেশের আইনে আছে আত্মহত্যার উসকানিদাতা পাবে দশ বছরের জেল। এই কারণে কেউ দায়ী নয়—মার্কা নোট লেখে সবাই। শালাদের মন ভর্তি থিকথিকে মায়া। তোফায়েল আবার ভাবল, দেবো নাকি কয়েকজনকে ফাঁসিয়ে?
কিন্তু লক্ষ্যচ্যুত হলে চলবে না। মরার পরে কেউ কাঁদতে পারবে না—এটাই নিশ্চিত করতে হবে।
যদিও এটা একটা অদ্ভুত হুকুম। মরার পরে কেউ কাঁদলে, সেটা মৃত ব্যক্তির পক্ষে কীভাবে আটকানো সম্ভব? কিন্তু মৃত ব্যক্তির শেষ ইচ্ছার খুব দাম এই শালার দুনিয়ায়? তাইলে?
ঘেন্নায় থুতু চলে এল তোফায়েলের মুখে। আত্মহত্যা ঠিক কবে করবে ঠিক করতে পারলে থুতু মেঝেতেই ফেলত। দিনক্ষণ ঠিক নাই বলে বেসিনে গিয়ে ফেলে এল।


তোফায়েলের বয়স পঁয়ত্রিশ। জীবনে যা যা খারাপ ঘটা সম্ভব, সব ঘটেছে তার জীবনে। তবু যে পঁয়ত্রিশ বছর সে এই জীবন টেনেছে, এই জন্য হলেও তার শেষ হুকুম সবার মানা উচিত। কাল সকালে একজন উকিলের কাছে যাবে ঠিক করে ঘুমিয়ে গেল সে। সকালে উঠে অবাক হয়ে খেয়াল করল, ঘুম খুব ভালো হয়েছে। একা একাই হো হো করে হাসল। শালার জীবনকে চেপে ধরলে ঠিকই সিধা হয়। বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টার সময় কুত্তার বাচ্চা ঘুমকে আনতে নটির বেটি ঘুমের ওষুধের পা ধরেও লাভ হতো না। যেসব শালাশালিদের জীবন প্যারাচোদা, তাদের উচিত আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়া। তারপর উইল করে কান্দা বন্ধ করা। তারপর কিছুদিন চেপে ধরা জীবনের ছটফটানি দেখে দাঁত কেলিয়ে হেসে টেসে মরে যাওয়া। এ বিষয়ে একটা আর্টিকেল লিখে রেখে মরতে হবে। যেন ভবিষ্যতের মরুয়াদের একটা গাইডলাইন থাকে। খালি নিজে মরলেই তো হয় না, অন্যদের স্বেচ্ছামরা মাখনের মতো স্মুদ করার জন্যও কিছু করে যাওয়া উচিত। মরার পরে যদি আত্মহত্যাওয়ালাদের আলাদা রাখে, জুনিয়রদের কাছে এক্সট্রা ফেভার পাওয়া যাবে। যদিও শালারা ধর্মের নামে বলে আত্মহত্যা করলে সিধা নরকবাস। কিন্তু তোফায়েলের মনে হয়, এ হতে পারে না। ঈশ্বর তো বাপ-মা নয় যে, ব্যর্থ সন্তানের ওপর বেশি চেইতা থাকবে।


এগারোটার দিকে যে উকিলের চেম্বারে গিয়ে হাজির হলো, তার নাম চিন্ময় ভৌমিক। নেমপ্লেট দেখে তোফায়েল চিবিয়ে চিবিয়ে হাসল, তার নামের কী বাহার। উকিলদের যে ডাক্তারদের মতো চেম্বার থাকে জানতই না এত দিন। এক চিমসা ছ্যামড়া ভেতরে নিয়ে বসিয়ে দিয়ে উড়ে চলে গেল—যেন চড়ুই। আধাবুড়া চিন্ময় ব্যাটা এল আধা ঘণ্টা পরে পান চাবাতে চাবাতে। ব্যাটার নাম নাকি চিন্ময়, ধরে চাবকানো দরকার, বলদে জাবর কাটার মতো পান চাবায়। চিন্ময় মধুর হেসে বলল, চা খাবেন? তোফায়েল মুখ বিষ করে বলল, না, খাবো না; আলাপ শুরু করি? চিন্ময়ের বড় বড় চোখ আগ্রহে চকচক করে উঠল। তোফায়েলের মনে বুদ্‌বুদ উঠল—শালার ফি বাকি রেখে মরে গেলে কেমন হয়। চিন্ময় বলল, আজকাল জমিজমার কেস আসেই না। আপনার জমিজমার কেস নাকি? তোফায়েলের চেহারা দেখে কারও জমিজমা মনে আসতে পারে! তাজ্জব হয়ে বলল, সত্যি আপনার মনে হলো, আমার জমিজমার ঝামেলা? চিন্ময় বলল, না, ঠিক মনে হলো না, কিন্তু জমিজমার মামলা চেয়ে পূজা দিয়েছি কাল। আজকেই ভগবান পাঠায়ে দিলে বোঝা যাবে র‌্যাপিড অ্যাকশন হয়েছে। পুরা পেট খালি করে হো হো করে হাসল তোফায়েল। চিন্ময়ও হাসল কষ্ট করে, ক্লায়েন্টের হাসির সম্মানে হাসি ফিরায়ে না দিলে ফিসে পয়মন্তী আসে না। কিন্তু ক্লায়েন্ট হাসতে পারলে চিন্তার কথাই। কাঁদলে যেমন বোঝা যায় কেস গুরুতর, হাসলে পলকা।
হাসাহাসি ফুরালে চিন্ময় সিরিয়াস হলে জানতে চাইল, কেসটা কী?
তোফায়েল আরও সিরিয়াস হয়ে বলল, উইল করতে চাই।
এবার চিন্ময়ের দাঁত বেরিয়ে গেল, তবে যে বললেন, জমিজমা নয়?
তোফায়েল ফ্ল্যাট মুখে বলল, জমিজমা নয়।
চিন্ময় এঁকেবেঁকে বলল, তবে কিসের উইল!
তোফায়েল জিভের ডগা দিয়ে বলল, কান্দা বন্ধ করার উইল।
বেশ কয়েক সেকেন্ডের চিটচিটে নীরবতা। চিন্ময় কিছু বলার আগেই তোফায়েল বলল, আমার মৃত্যুর পরে কেউ কাঁদতে পারবে না—এই উইল।
এবার চিন্ময় পেট খালি করে হো হো হেসে বলল, আপনার ধারণা, আপনি মরলে লোকে লাইন দিয়ে কাঁদতে বসবে? কয়জন মোট?
টেবিলের তলায় তোফায়েলের বুড়ো আঙুল সুরুত করে কড়ে আঙুলের গোড়ায় চলে গেল, অনামিকার গোড়ায় গিয়ে থেমেও গেল। মোট পাঁচজন! মাত্র পাঁচজন! হারামজাদা উকিল এ কিসের সামনে দাঁড় করায়ে দিল! কে কে কাঁদবে এই হিসাব তো করা হয় নাই!
চিন্ময় ভুরু নাচিয়ে বলল, কয়?
তোফায়েল গরুর গোয়া থেকে মাটিতে গোবর পড়ার শব্দের মতো বলল, পাঁচ।
চিন্ময় বলল, পাঁচজনের নাম-ঠিকানা দিয়ে যান, নোটিশ পাঠায়ে দেই।
বাপ, মা, বড় বোন, প্রাক্তন বউ আর আজীজের নাম ঠিকানা লিখে দিয়ে বেরিয়ে এল তোফায়েল।


চিন্ময় পাঁচজনের লিস্ট সামনে নিয়ে সারা দিন বসে থাকল, মাঝখানে দুজন ক্লায়েন্ট এল, চলেও গেল, কিন্তু মাথা থেকে তোফায়েলের উইল সরে গেল না এক মুহূর্ত। সন্ধ্যায় নোটিশের ড্রাফট বানাতে বসল। মহোদয়/মহোদয়া, আমার ক্লায়েন্ট জনাব তোফায়েল আহমেদের অন্তিম ইচ্ছা ইহাই যে, তাহার মৃত্যুর পরে আপনি/আপনারা খটখটে নয়নে থাকিতে বাধ্য থাকিবেন। চিন্ময়ের একবার মৃদু ইচ্ছা হলো, নিজের হাতে নোটিশগুলো পৌঁছে দিয়ে এদের প্রতিক্রিয়া দেখে। আবার সে ভাবনা নাকচ করে দিল। উকিল নিজেই নোটিশ নিয়ে যায় না কখনো। পোস্ট না করে মন্ময়কে পাঠানো যায়। ছোট ভাইয়ের ধারাভাষ্যের ওপরে পুরো আস্থা আছে তার। মরার পরে কান্না বন্ধ করার জন্য উইলের নোটিশ নিয়ে যেতে হবে শুনলেই এক লাফ দিয়ে রাজি হবে মন্ময়। তার আবার গল্প লেখার বাতিক, কিন্তু নিজের চোখে না দেখে বানিয়ে কিছু লিখতে পারে না। ফিরে এসে দারুণ করে গল্প শোনাতে পারবে। কিন্তু সে চিন্তাও বাতিল করল। বদলে পাঁচ দাগি আসামির লিস্টের দিকে তাকিয়ে রইল। মাতা মোসাম্মৎ নূরজাহান বেগম। কী এমন করেছে এই মহিলা যে, পুত্রশোকে কাঁদার অধিকার হারিয়েছে সে? পিতা তোজাম্মেল হক। আহা পিতা! নিজের বাপের কথা মনে হলো চিন্ময়ের। বাপকে খুব ভালোবাসত সে। জীবনে একদিনই হাউমাউ করে কেঁদেছে, বাপ যেদিন মরে গেল। চিন্ময় যদি বাপের আগে মরত, তাহলে নিশ্চিত বাপও বেশি দিন বাঁচতে পারত না। লিস্ট রেখে উঠে বাইরে গেল। কেমন অস্থির লাগছে।


উকিলের চেম্বার থেকে বেরিয়ে কতক্ষণ এদিক-ওদিক হাঁটল তোফায়েল হক। আকাশে সোফিয়া লরেনের মতো মেঘ; বৃষ্টি হবে না শুধু লোভ দেখাবে। মাথায় একটা লাইন ঘুরছে, ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী/প্রিন্সেস ডায়ানা রাজরানী। আবার আকাশের দিকে তাকাল, মেঘগুলো আর সোফিয়া লরেনের মতো সেক্সি লাগছে না, ডায়ানার মতো মায়াবী লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, ঢাকা অতটাও খারাপ শহর নয়; যে শহরের আকাশে সোফিয়া লরেন আর প্রিন্সেস ডায়ানা ভেসে বেড়ায়, সেই শহর খারাপ কীভাবে হবে। তার সিলেটি বউ মনতারা ফারজানাও ঢাকা পছন্দ করত। তবু সে লন্ডনে চলে গেল। চলে যাওয়ার পরে ডিভোর্স লেটার হাতে পেল। তারও কিছুদিন পরে জানতে পারল, চলে যাওয়ার সময় তিন মাসের পোয়াতি ছিল সে। সেই হিসাবে পুত্রের বয়স এখন দুই বছর দুই মাস। শালা এই দুনিয়া এখন খবরের ময়দান। সব খবর কানে আসে। আবার আকাশেই তাকাল মনতারা ফারজানার এক্স হাজবেন্ড তোফায়েল হক। আকাশে ছুটোছুটি লাগিয়েছে মে মাসের মেঘ। যেন সাদা সাদা জুতা পায়ে, টিফিনের সময়ে স্কুলের মাঠ। সে তবে এখন ছোটে সাদা জুতো পায়ে, বিলাতের পথে? সেই কারণে মাফ হয়ে যায় দুইশো বছরের ডাকাতি আর গোলামি। সেই কারণে প্রিন্সেস ডায়ানা আপন বোন, মেঘের ডায়ানাও তাই মায়ার, লোভের চোখে তাকানো যায় না।


পাঁচজনের লিস্টে নাম-ঠিকানার নিচে নিচে ফোন নম্বরও আছে। এখন তো কুরিয়ারের কাল, ফোন নম্বর লাগে। কেমন কাহিল হয়ে গেছে চিন্ময়। চিঠি রেডি করে খামে ভরে নাম-ঠিকানা ফোন নম্বর সব লিখেছে, তবু পাঠাতে পারছে না। একটা চিঠিতে বিদেশের ঠিকানা লিখেছে ইংরেজিতে, মন্ময়ের হাতের লেখা ভালো। সুন্দর করে টিকিট লাগিয়েছে। বাকিগুলো দেশেই যাবে, দুইটা যাবে এক বাড়িতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বাড়ির নাম নূরজাহান ভিলা। নূরজাহান আর তোজাম্মেলের একই ঠিকানা, শুধু ফোন নম্বর আলাদা। চিন্ময়ের একবার মনে হলো, পাঁচটা ফোন নম্বরই মুখস্থ তোফায়েলের, লেখার সময় ফোনবুকে তাকায়নি। যাদের ফোন নম্বর মুখস্থ থাকে, তারাই মরলে কাঁদে? নিজেকে নানান প্রফেশনাল ধমক দিয়েও আজীজের নম্বরে ফোন করে বসল চিন্ময়। ও পাশের হ্যালো শুনে ‘আজীজ বলছেন’ বলতে হাত কেঁপে গেল। আজীজের ‘হ্যাঁ আজীজ, আপনি?’ যেন আগুন গরম চা গিলেছে, এমনভাবে বলল, আমি তোফায়েলের উকিল। আজীজের গলা পাওয়া গেল সঙ্গে সঙ্গে, ‘তোফায়েল উকিল দিয়ে কী করে?’ এ রকম তিতা গলা আগে কখনো শোনেনি চিন্ময়। খুব নরম গলায় বলল, তোফায়েলের উইলে আপনার নাম আছে। ধমকে উঠল আজীজ, ‘কুঁতে কুঁতে কথা বলেন কেন, একবারে বলেন, ঘটনা কী? তোফায়েলের সম্পত্তি গজাইছে, নাকি চুল বাল উইল করছে?’ চিন্ময় চাবুক খাওয়া গলায় বলল—‘তোফায়েলের মৃত্যুর পর আপনি কাঁদতে পারবেন না।’ আজীজের গলা পাওয়া গেল, ধুর শালা, তোফা মরলে আমি তিন দিন মুততেও যাব না। কেটে দিল ফোন।


নিজের ফোন থেকে একে একে সব নম্বর ডিলিট করে দিয়ে নিজেকে পাতলা লাগল তোফায়েলের, যেন তুলা হয়ে উড়ে যাবে এখনই। বোতল তুলে ঢকঢক করে পানি খেল পেট ভরে, যেন পানির ওজনে উড়ে যেতে না পারে। মনিটরে লিখল, লোটিশ পেয়েও যদি কেউ কান্দে পুলিশ যেন ধরে নিয়ে যায়। ‘ন’ কে ‘ল’ লিখেছে দেখেও লোটিশ মুছে নোটিশ করল না। শালার লোটিশই ঠিক আছে। নূরজাহারের আদরের কন্যা মমতাজ নোটিশ পেয়ে কী করে দেখার বড় খায়েশ হচ্ছে নূরজাহানের পুত্র তোফায়েলের। স্পষ্ট দেখতে পেল, খাম খুলে কাগজটা বের করে মুখ বেজার করে বলল, হারামজাদা নতুন ভং ধরছে। চিঠির দলার ঢিল হওয়াও দেখল স্পষ্ট। দেখে ডেট ফাইনাল করে ফেলল, একত্রিশে মে। তারপর হাসতে হাসতে জোরে জোরে আবৃত্তি করল, বাবার হইল আবার জ্বর সারিবে ঔষধে। তাহলে নূরজাহান আর মমতাজ শাশুড়ি-বউ মা। অংক মিলে গেলে ছোটবেলায় নূরজাহান আর মমতাজ একসাথে তোফায়েলকে খুব মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। এখন কেমন অবিশ্বাস হয়, শালা তোফায়েলের অংকও কোনো দিন মিলছে। খ্যা খ্যা করে হাসতে গিয়ে খেয়াল হলো শালা একা একা হাসা পাগলের লক্ষণ না? শালা মরব বলে কি পাগল হয়ে যেতে হবে? লোকে বলবে শালা মানসিক রোগী ছিল বলে সুইসাইড চোদাইছে। ধুর বাল।


চিন্ময়ের একবার তোফাজ্জল হককে ফোন করতে ইচ্ছে করল। বাবারা হয়তো বেশি নির্দয় হতে পারে না। যাদের ভালোবাসার ক্ষমতা কম, তাদের অবহেলার তীব্রতাও কম। মায়েদের বেলায় এটা হয়, তাদের ভালোবাসা যেমন তীব্র, অবহেলাও। কিন্তু আজীজের সাথে কথা বলার পর আর সাহসে কুলাচ্ছে না। বন্ধুর ঘৃণা তবু মানা যায়, মায়ের অবহেলাও মানা যায়। কিন্তু বাপ কাউকে ঘৃণা করছে এটা চিন্ময়ের পক্ষে হজম করা সম্ভবই নয়। এই কেসে মানসিকভাবে জড়িয়ে না পড়লেই ভালো হতো, নোটিশ পাঠিয়ে দিয়ে ভুলে যেত। কিন্তু তোফায়েল যে সুইসাইড করবেই, বুঝে গেছে সে। হয়তো শেষ চেষ্টা হিসেবে পাঁচজনের একটা তালিকা তাকে দিয়ে গেছে, এদের একজনই হয়তো তোফায়েলকে বাঁচাতে পারে। আবার সুইসাইড হয়ে গেলে পুলিশের ঘাঁটাঘাঁটিতে নিশ্চিত এই নোটিশের প্রসঙ্গ আসবে। তখন পুলিশ কি চিন্ময়ের দিকে তাকিয়ে তীব্র গলায় বলবে না, একটা কিছু করে থামিয়ে দিতে পারলেন না? পুলিশ পর্যন্ত এসে চমকে গেল চিন্ময়; সুইসাইড, পুলিশ এসব ছাপিয়ে মনে হলো, তোফায়েল কোনো গুরুতর অন্যায় করেছে। কী সেই অন্যায়? নাকি সেটা আবার আইনি অপরাধও, পালাতে চাচ্ছে সে? নিজেকেই বলল, পুলিশকে খবর দেওয়া উচিত?


তোফায়েল আবার চিন্ময়ের চেম্বারে গেল ৩১ মে। মনে মনে গালি দিতে দিতে গেল, শালার উকিলের ফিটা দিয়েই মরি। শালাকে আরও একটা দায়িত্ব দিয়ে যেতে হবে, কেউ কানলেই যেন শালা পুলিশকে ডেকে ধরিয়ে দেয়। চিন্ময় আজ পান খাচ্ছে না, হাতে সিগারেট। তোফায়েল বসতে না বসতেই সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিল। তোফায়েল খুক খুক করে হেসে বলল, আজ কোনো বিশেষ দিন নাকি? চিন্ময় বলল, হ্যাঁ, আজ খুব খুশির দিন, আপনার ফি মাফ। তোফায়েল খুশি হয়ে বলল, তাহলে আর একটা কাজ দেই আপনাকে, কেউ কানলেই পুলিশে ধরিয়ে দেবেন। চিন্ময় হো হো করে হেসে দম নিয়ে বলল, ‘মইরেন না তোফায়েল, আমার সাথে থাকেন, আমার পরিবারের মেম্বার হয়ে।’ তোফায়েল খুশি হয়ে বলল, ‘তাহলে আমাকে দত্তক নেন, অন্নপ্রাশন করে আমার নাম বদলে দেন, আপনি আগে মরলে আমি আর আমি আগে মরলে আপনি মুখাগ্নি করবেন।’ লম্বা দম নিয়ে ফের প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘মরার পর পুড়ে ছাই হওয়ার খুব ইচ্ছা আমার।’ চিন্ময়ের খুব মায়া হলো, এখনই মাঝের টেবিল ডিঙিয়ে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরতে পারলে শান্তি লাগত। গ্লাসে পানি ঢালার মতো করে চিন্ময় বলল, ‘তুমি কি বড় কোনো অপরাধ করেছ?’ তোফায়েল হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল, চমকে গেল চিন্ময়। হাসি আর থামে না, গলগল করে বলল, প্রায়শ্চিত্ত না পুলিশ?

১০
যেদিন থেকে আত্মহত্যা করবে ঠিক করেছে, সেদিন থেকে উপায়টা নিয়ে ভেবেছে। নেট সার্চ দিয়ে এবং নেশারুদের কাছে খবর নিয়ে। বেশির ভাগ নেশারু মনে করে, যা খেলে মাতলামি আসে, সেইটার মাত্রা দ্বিগুণ করলেই কেল্লা ফতে। শরীর দুর্বল হয়ে থাকলে জমে ভালো। তোফায়েল গত দুই দিন কিছুই খায় নাই। পেট খালি, মাথাও পাতলা চক্কর দিচ্ছে, এখন ওভার ডোজ ড্রাগের পক্ষে মৃত্যু ঘটিয়ে দেওয়া সহজ। জুনিয়রদের জন্য এসবই নিজের কম্পিউটারে লিখে রেখেছে তোফায়েল। কোনো তাড়াহুড়ো নেই, পুরা রাত আস্তে ধীরে মাত্রা বাড়িয়ে বাড়িয়ে মরে গেলেই হবে। দরজা খুলেই রেখেছে, পচে যাওয়া, দরজা ভাঙা এসবের দরকার তো নেই। এত ভালো চিন্তা করতে পেরে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিল। খি খি করে হেসে বলল, মরে গেলে সব মানুষ নাকি ভালো মানুষ; আমি শালা আগেই ভালো মানুষ হয়ে গেলাম।
প্রথমে হালকা ফিনফিনে কুয়াশার মতো, তারপরে জমাট, তারপরে আরও জমাট তারপরে তুমুল বৃষ্টি। মরে যে গেল স্পষ্ট বুঝতে পারল তোফায়েল, শেষ বাতাসটা বের হয়ে যাওয়ার সময় প্রচন্ড একটা চাপ লাগল পুরো শরীরে। মানে বাইরের বাতাসের এই চাপ থাকেই, ভেতরের বাতাস কাউন্টার দেয় বলে বোঝা যায় না। ভেতর থেকে আর কাউন্টার এল না বলেই চাপটা লাগল। বাহ্, মরে গিয়েও তাহলে সব বোঝা যায়, চিন্তাও করা যায়। এটা লিখে যাওয়া হলো না দেখে আফসোস হলো। কিন্তু এই আফসোসের সাথে দুঃখ নেই। তাহলে মরে গেলে বোঝা যায় সবই, কিন্তু দুঃখ হয় না। বাহ্, কিন্তু এটা তো নতুনই। সকাল হলো, সেটাও বুঝতে পারল। কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল, কে প্রথম জানতে পারবে যে গাধা তোফায়েলটা আর নেই? কতক্ষণ গেছে ঠিক খেয়াল করতে পারল না, শালা মরে গিয়েও ঘুম এসে গেছিল নাকি! অবাক হয়ে দেখল দরজা ঢেলে ঘরে ঢুকল চিন্ময়। তোফায়েলের নিশ্চিন্ত লাগল, যাক, আসল লোক এসে গেছে আর চিন্তা নাই।

১১
তোফায়েলের মৃতদেহ ঘিরে যারা আছে, সকলেই ভিজে কাক। খোলা জায়গায় শুয়ে এমন অন্ধকার বৃষ্টি আগে দেখেছে কি না মনে পড়ল না। একটু পর পর সবাইকে মুখের পানি মুছতে হচ্ছে। বড় কালো ছাতা মাথায় দূরে দাঁড়িয়ে চিন্ময়। তার লিস্টের সবাইকে সে-ই ফোন করেছে, বাকিদের আবার লিস্টের লোকেরা ফোন করেছে। বেশ ভালো গ্যাদারিংই হয়েছে। প্রত্যেকের মুখে খুব কড়া নজর চিন্ময়ের। বৃষ্টির পানির চেয়ে চোখের পানি এক শেড গাঢ়। তবু বৃষ্টির পানি আলাদা করতে পারছে না। একসময় নিজের অশ্রুর দিকে খেয়াল হলো চিন্ময়ের, ছাতা আছে বলে ধুয়ে যাচ্ছে না অপরাধী অশ্রু। এখন পর্যন্ত আর কারও এই অপরাধ প্রমাণিত হয়নি। যে চোখের পানি নিয়ে এত চিন্তা ছিল তোফায়েলের, এখন আর সেটা এত গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না। মৃত্যু তবে এই—সবই থাকে, কিন্তু ওজন নেই!