গোলাপফল
সমস্ত কিছুর স্বাদ কমে যাচ্ছে, সাইজ কমে যাচ্ছে। এমন কথা কয়েকজন বলল। তখন তাদের দিকে এগিয়ে এসে পাগলাগোছের লোকটি বলল, ‘একটা আখকে যদি একজন চিবায়, তারপর সেই ছোবড়াকে যদি আবার কেউ চিবায়, তারপর আরেকজন, তারপর আরেকজন; তবে স্বাদ কি আর কেউ পাবে। পৃথিবীকেও মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম চিবুতে আছে। পৃথিবীর স্বাদ তো কমবেই।’ লোকটি হাঁটা ধরে।
লোকটি হাঁটা ধরে বটে, তবে একাব্বরের মনকে ধরে নিয়ে সে গেল। ছেলেধরা যেমন ছেলে ভুলিয়ে নিয়ে ধরে নিয়ে যায়, তেমনই একাব্বরের মন ধরে নিয়ে লোকটা চলে গেল। একাব্বর বারবার বলতে লাগল, ‘লোকটার তো প্রচুর জ্ঞান রে।’
‘সমস্ত কিছুর স্বাদ কমে যাচ্ছে, সাইজ কমে যাচ্ছে’ বলে যে আড্ডা হচ্ছিল, সে আড্ডাতে আমরাও ছিলাম। যদিও আমরা কিছু বলছিলাম না। শুনছিলাম শুধু। একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধ তার চায়ের কাপে চুমুক দেবার সময় বলছিল, ‘আগে মাষকলাইয়ের ডাল এক বাড়িতে রান্না করলে দশ বাড়িজুড়ে তার গন্ধ পাওয়া যেত। আর এখন দেখ, নিজে ডাল দিয়ে ভাত খেলেও নিজে বুঝতে পারি না।’ তার কথার সমর্থন করে ওই বয়সেরই একজন বলল, ‘আগে ফজলি আমে কত সুন্দর স্বাদ ছিল। জি ভাই, এখন তেমন স্বাদ নাই। আর ফজলি আমের শরীর ছিল কত বড়। এখন অত বড় ফজলি আম দেখাই যায় না।’ এগুলো আমরা শুনছিলাম।
রণার চায়ের দোকানে বারোয়ারি মানুষের আড্ডা। সারাদিন আড্ডা চলে এখানে টেবিলে টেবিলে। আমরা যেতাম মূলত বিকেলবেলার দিকে। কলেজ ছুটি শেষে এসে এখানে আড্ডা দিতাম। চা খেতাম। বহুমুখী গল্প করতাম আমরা। জেলেপাড়ার লোকজন মাছের গল্প করত। তাদের কথার ভেতর জিন্দা মাছের লাফালাফি দেখতে পেতাম। কথার ভেতর থেকে জিন্দা মাছ লাফিয়ে লাফিয়ে টেবিলের ওপর পড়ত। এদের কাছে থেকে মাছ কিনে নিয়ে রণা মাছ রান্না করে। দুপুরে ভাত খাবার ব্যবস্থা ছিল। অনেক লোক এখানে ভাত খেতে আসে। সস্তাতে মাছভাত বা ডিমভাত খেতে পারত এখানে। মাছের গল্প উঠলে অমর জালুয়া বলে দিল, ‘ভাই আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন বাবার সাথে মাছ ধরতে যেতাম। জাল একবার এক ছাঁক ফেললেই প্রচুর মাছ উঠে আসত। কয়েক ছাঁক দিলেই মাছ বিক্রি করে অনেক টাকা পাওয়া যেত। সে মাছ কত বড় বড়। ইলিশ মাছের চেহারা দেখে বোঝা যেত ইলিশ কাকে বলে। কী রাজকীয় তার আঁশ, কী চকচকে চোখ তার। আর স্বাদের কথা নাই-বা বললাম। এক বাড়িতে ইলিশ ভাজলে দশ বাড়ির লোকের মগজ ভর্তি হয়ে যেত, পুরো পাড়ার লোকের জিভে জল চলে আসে। মাছ নয় শুধু, ঝোল দিয়েই দুথালি ভাত খাওয়া হয়ে যেত। আর এখনের ইলিশ কেমন চিমসে, রস নাই, আগের স্বাদ নাই।’ এসব গল্প যারা বলছিল, তারাও দীর্ঘশ্বাসের ফাঁস ছেড়ে দিচ্ছিল। যারা দীর্ঘশ্বাসের ফাঁসে জড়িয়ে যাচ্ছিল, তারাও তার চেয়ে বড় আর বেশি ওজনের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নতুন কিছু বলার চেষ্টা করছিল।
আমরা অবাক হয়ে এসব শুনছিলাম। এসব কথামালা, ব্যথামালার মধ্যেই মানুষটি এসে হাজির হয়েছিল। সে ওয়েটারের কাছে এক গ্লাস জল চেয়ে নিয়েছিল। দোকানের চালায় একটা ধেড়ে ইঁদুর তাঁতের মাকুর মতো এদিক-ওদিক করছিল। ইঁদুরের চকচকে চোখ। আর রণার দোকানে থাকা মোটা বিড়ালটা চোখ বুজে ঢুলার সুখ নিচ্ছিল। রণা তাকে একবার গালও দেয়, শালা শুধু খায় আর ঢুলে। বিড়ালটা চোখ মেলে একটু ‘ঞ ঞ’ করে ওঠে শুধু। রণা গ্রাহককে ভাঙতি টাকা ঘুরিয়ে দেয়। বিড়াল হাই তুলে আবার তার ঢুলনের স্বাদ নিতে থাকে। পাগলাগোছের লোকটা পানি শেষ করে একটা গভীর শ্বাস ভেতর দিকে টেনে ধীরে ধীরে ছেড়ে দেয়। পানি পান করে সে খুব তৃপ্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তার গভীর শ্বাস ছাড়ারও কিছুক্ষণ পর ওই কথাগুলো বলে। লোকজন থ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। লোকজনের চোখের ভেতর থেকে, মুখের ভেতর থেকে, ভাবের ভেতর থেকে থ সরে যাবার আগেই লোকটা হাঁটা ধরেছিল। সবাই সবার দিকে তাকাতাকি করছিল। কিন্তু একাব্বর কারও দিকে তাকায়ইনি। লোকটার দিকেই তাকিয়ে ছিল। যতক্ষণ লোকটাকে দেখা যাচ্ছিল তখন সে সেদিকেই তাকিয়েই ছিল। লোকজনের থ-ভাব বেশ কিছুক্ষণ পর কেটে গেলেও একাব্বরের থ আর কাটেনি। থ বনে যাওয়া মানুষদের থ এর আয়ু সকলের এক নয়। কারও কারও কোনো কোনো বিষয়ে থ থেকে যায় সারা জীবন, কোনো কোনো থ-ভাব কেটে যায় সেকেন্ড-মিনিট পরেই।
আমরা যখন বাড়ির দিকে ফিরছিলাম, তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। আমাদের ফিরতে হচ্ছিল আমবাগানের ভেতর দিয়ে। বাগানের ভেতর বেশ অন্ধকার। আমরা কথা বলছিলাম কী কী বিষয় নিয়ে। একাব্বর কোনো কথা বলছিল না। সে শুনছিলও না। অন্ধকারেও এটা বুঝতে পারছিলাম। আমরা বললাম– ‘কী রে একাব্বর, কথা বলিস না কেন?’ একাব্বর যেন কবর থেকে উঠে এলো, যেন কোনো এক গুহা থেকে উঠে এলো। সে বলল—‘লোকটা কিন্তু জ্ঞানী, বুঝলি, আমি বলছি লোকটা জ্ঞানী।’ আমরা বললাম—‘কোন লোকটার কথা বলছিস?’ সে বলল—‘আওে, ওই যে রণার দোকানে কথা বলে চলে গেল।’ এতক্ষণে মনে পড়ল লোকটার কথা। আমরা ভুলেই গেছিলাম। আমরা বললাম—‘কী সব আখের ছোবড়া দিয়ে কী সব বলল আর তুই বলছিস জ্ঞানী। সে বলল—‘তার কথার ভেতরটা তোরা ধরতে পারছিস না শুধু আখের ছোবড়াই দেখছিস।’
কয়েক দিন পরে সন্ধ্যায় হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম নদীর ধারে। শামুকগুলো খুব ধীরগতিতে চলছে। কোনোটা জলের দিকে যাচ্ছে, কোনোটা জল থেকে উঠে আসছে। ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত ধরে গেছে। কেন যে বিরক্ত ধরে গেছে বুঝতে পারছি না। সম্ভবত মনে হচ্ছে, শামুকগুলো আরও একটু জোরে চললেই তো পারে। কিন্তু তারা জোরে চলে না। এটা নিয়ে আক্ষেপের কী আছে নিজেই বুঝি না। অনেক কিছুই তো জোরে চলে। অনেক কিছুই তো ধীরে চলে। এ সময় একটা শিয়াল খুব জোরে ছুটতে ছুটতে চলে গেল। মনে হলো, ধুর, এত জোরে দৌড়ায় কেন। একা একা হাঁটছি। একা একা হাঁটলে অনেক কিছু দেখা যায়। একটা বককে দেখা গেল নদীর ওপারে। নদীটা এতই ছোট যে ওপার দেখা যায়। বকটা ওপারে আছে। সে এক পায়ে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে আছে। তার কাজ মাছ ধরা না শুধু এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকা কে জানে। চাঁদটার একটা ফটোকপি পড়ে আছে নদীর জলে। নদীর চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি। একটা মাছ ঠিক চাঁদটার মাঝখান ভেদ করে লাফ দিয়ে আবার ডুব দিল। চাঁদটা ডিমের কুসুমের মতো ভেঙে গেল। নদীর ওই জায়গাটাতে চাঁদের কণার শরবতের মতো মনে হলো, ইচ্ছে হলো দ্রুত গিয়ে ওই শরবত পান করে নিই। জলে থাকা চাঁদের কেন্দ্র ভেদ করে মাছের লাফ, চাঁদটার গলে যাওয়া আর শরবত মনে হওয়ার ব্যাপারটা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। বাতাস বইছে ফুরফুর করে। ধানের খেতের ধানেরা গান ধরেছে। জোনাকিরা এলোপাতাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন তারা কে গান গাইছে তাই খুঁজছে। নদীর জলে পা ডোবানোর ইচ্ছে হলো আমার। আমি এক পা ডুবিয়ে আরেক পা ডুবাতে যাব তখন কে যেন ডাকল। আমি পেছন ফিরে দেখলাম একাব্বর। কয়েক দিন থেকে মানে সেদিনের পরে একাব্বরের দেখা পাইনি। তাকে দেখে বেশ ভালো লাগল। ওই যে বলছিলাম, একা থাকলে অনেক কিছু দেখা যায়। তেমনই তাকে দেখে এতক্ষণ যা যা দেখছিলাম, ভাবছিলাম তা তা ভুলে গেলাম। তাকে দেখে খুব খুশি হলাম আমি। ‘কী রে এ কদিন কোথা ছিলি, তোকে দেখতে পাইনি।’ সে বলল, ‘চল ওখানে বসি।’ সবুজ ঘাস ছাওয়া একটা ঢিবিতে বসলাম আমরা। সে বলল, তার পরের দিন শুনলাম ওই জ্ঞানী লোকটা বটতলার হাটে আছে। সেখানে গেছিলাম। তাকে দেখতে পেলাম না। তবে একটা লোক বলল—‘সে এখন রানীহাটি বাজারে আছে।’ সেখানেও গেলাম। কয়েক জায়গা তাকে ঘুরে ঘুরে খুঁজেও পেলাম না। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। চাঁদের আলো হঠাৎ করে আরও বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে আমাদের কথা বলার মাঝখানে আমাদের অগোচরে হঠাৎ করে চাঁদটা কেউ বদলে দিয়ে চলে গেছে। এটা সন্ধ্যায় এসে যে চাঁদটাকে দেখেছিলাম সেটা নয়। আমি বললাম—‘তুই পাগল হলি নাকি, সে লোক কী এমন কথা বলেছে যে তোকে তার সন্ধানে এভাবে বেড়াতে হবে।’
এরপরে সে সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছিল। একদিন খুব ভোরে উঠে এসে বলল—‘জানিস গোলাপফল খুব মিষ্টি।’ আমি বলি—‘কী বললি?’ সে বলল—‘গোলাপফলের কথা বলছি।’ ‘গোলাপের আবার ফল হয় নাকি রে’ আমি বললাম। সে বলল, ‘ঘটনা তো সেখানেই রে। গোলাপফুল কত সুন্দর ফুল কিন্তু তোকে তার ফল খেতে দেবে না বলেই তো ফল ধরতে দেয় না।’ আমি হেসে বললাম—‘তা তুই গোলাপফল কোথায় পেলি?’ সে বলল, ‘সেটাই তো তোকে বলতে এসেছি। আজ রাতে স্বপনে দেখছি, আমি কোথায় যেন গেছি। খুব সুন্দর একটা জায়গা। সুন্দর পথ। চারদিকে নানা রকম গাছ। আরে বাগান। এক জায়গাতে দেখলাম গোলাপ বাগান। গোলাপ ফুল ফুটে আছে। পাখি ডাকছে মধুর স্বরে। গোলাপ বাগানে ঢুকে গেলাম। দেখলাম, গোলাপফুল ফুটে আছে গোলাপগাছে আবার গোলাপফলও ধরে আছে। আমি তো অবাক। আমি একটা গোলাপফল ছিঁড়ে নিয়ে এক কামড় মাত্র দিয়েছি। মুখ অপার্থিব স্বাদে ভরে গেল। না, তেমন স্বাদের জিনিস কোনো দিন আর খাইনি। এত চমৎকার ফল। আমি দ্বিতীয় কামড় দিতে যাব এমন সময় কোথা থেকে একটা লম্বামতো মানুষ দৌড়ে এলো। কোনো কথা না বলে প্রথমে সে আমার হাত থেকে গোলাপফলটা আগে কেড়ে নিল। তারপর বলল, তুমি কে, এখানে কেন? আমি বললাম আমার কথা। সে বলল—তুমি এখানে কেন, এ ফল তো তোমাদের জন্য নয়। বলে সে রেগেমেগে তার হাতের লাঠি দিয়ে গুঁতো দিল। লাঠির আগায় সম্ভবত সুচ ছিল। তীব্র যন্ত্রণায় আমার ঘুম ভেঙে গেল। দেখ, আমার গলার কাছে কেমন ফুটো হয়ে আছে।’ আমি বললাম—‘বাদ দে স্বপনের কথা, আর ওই গলার দাগ, সম্ভবত তোকে কোনো চিওড়ে চিমটে দিয়েছে।’ সে কোনো কথা না বলে চলে গেল।
একাব্বর কলেজ যাওয়া বাদ দিয়ে দিল। বলতে লাগল—‘কাগজ থেকে অক্ষর উঠে এসে চোখকে বুজিয়ে ফেলে। মনকে বুজিয়ে ফেলে। ওই যে ময়লা-আবর্জনা ফেলে মানুষ যেমন নদী বুজিয়ে দেয়, যেমন পুকুর বুজিয়ে ফেলে। মানুষ তো এমনিতেই অশিক্ষিত, এসব স্কুল-কলেজের লেখাপড়া আরও অশিক্ষিত করে ফেলে মানুষকে।