জীবনের জাদু
অভিকের সাথে আমার পরিচয় ফেসবুকে। বাংলার প্রকৃতি নামে একটা গ্রুপে আমরা দুজনই মেম্বার। ও থাকে ঢাকা, আমি থাকি কুমিল্লা। ও অবশ্য নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, পাহাড়ে-জঙ্গলে-সমুদ্রে। যেখানে ঘুরতে যায় সেখানে গিয়ে প্রচুর ছবি তুলে আনে। সেগুলো আপলোড করে। আমি তেমন কোথাও যাইটাই না। আমার সব ছবি গ্রামের গাছপালা, নদী-মাঠ, ফুল-পাখি, মানুষজনের। আমাদের গ্রাম দেখে ও মুগ্ধ। একদিন বলল, তোমাদের গ্রামে ঘুরতে আসতে চাই। আমি বললাম, তুমি যে-কোনো দিন আসতে পারো।
আজ অভিক আসছে। আমি গেলাম ওকে ইস্টিশন থেকে এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য। সকালবেলা গিয়ে কোম্পানীগঞ্জ বসে আছি। কিন্তু ওর বাস আর আসার নাম নেই। একটু পর পর ফোন দেই, কোথায় তুমি? ও বলে, এই তো, ময়নামতি। জ্যামে আটকে আছি। প্রচণ্ড জ্যাম। আসতে আসতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। এই প্রথম ওর সাথে আমার সামনাসামনি দেখা। কে বলে ভার্চ্যুয়ালি বন্ধুত্ব হয় না! আমরা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর যেটা গত দুবছরেও হয়নি, সেটা এখন দুমিনিটে হয়ে গেল। আমরা দুজন দুজনকে তুই তুই করে বলা শুরু করলাম। ও আমার কাঁধ খামচে ধরে বলল, আগে কিছু খাওয়া, দোস্ত। ক্ষুধায় জানটা বেরিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা থেকে কুমিল্লা আসতে নাকি দুই ঘণ্টা লাগে! আমার লাগল চার ঘন্টা! ও মাই গড! এত জ্যাম!
এখানে একটা হোটেলে চমৎকার খিচুড়ি পাওয়া যায়। দুজন বসে খিচুড়ি খেলাম। খিচুড়ি খেয়ে ও এত মুগ্ধ, খায় আর মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তোলে। আমি বলি, খা আগে, পরে ছবি তুলিস। মোবাইলে ক্যামেরা দেওয়াটাই আসলে উচিত হয় নাই। ক্যামেরার জাত মেরে দিয়েছে। মানুষ এখন আর কিছু দেখে না, উপলব্ধি করে না, তার আগেই ক্লিক করে বসে।
ও হাসতে হাসতে ব্যাগ থেকে ওর নিক্কন ডি নাইনটি ক্যামেরাটা বের করে বলল, নারে, এই খিচুড়ির ছবি মোবাইল ক্যামেরায় তুললে এর প্রেসটিজ থাকে না!
হাত ধুয়ে লেন্স লাগিয়ে ও খিচুড়ির ছবি তুলল, হোটেলের ছবি তুলল, হোটেলের বয়-মালিক, অন্য কাস্টমারদেরও ছবি তুলল। এবং পণ করে ফেলল, এরপর ও যতবার কুমিল্লা আসবে, এখানে এসে খিচুড়ি খেয়ে যাবে।
বিকেল ফুরিয়ে যাচ্ছে। রিকশা নিয়ে আমরা গ্রামের দিকে রওনা দিয়েছি। হেমন্তের শেষাশেষি। মাঠে মাঠে ধান কাটা শেষ। ক্ষেতে ক্ষেতে কৃষকেরা এখন রবিশস্য চাষে ব্যস্ত। মুগ, মসুর, কলাইয়ের ডগায় সবুজ হয়ে আছে কারও ক্ষেত, কারও ক্ষেতে উঁকি দিচ্ছে সূর্যোদয়ের মতো ফুলকপির মুখ। অভিক রিকশায় বসেই একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছে। একটু পর পর রিকশা থামাতে হচ্ছে। রাস্তার পাশে বাঁধা একটা ছাগলের দুধ খাচ্ছে তার বাচ্চারা, তা দেখে অভিক লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নেমে গেল। মাটিতে শুয়ে পড়ে সে ছাগলের বাচ্চার দুধ খাওয়ার দৃশ্য তুলতে লাগল। এমন ছবিপাগল ছেলে আমি আর দেখিনি। আমি রিকশা ছেড়ে দিলাম। ওকে নিয়ে রিকশা করে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। আমরা ক্ষেতকুনাচে হাঁটা শুরু করলাম।
শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা নামছে। সুর্যটা হাঁসের ডিমের কুসুমের মতো ফেটে লেপ্টে গেছে ছায়ার মতো গ্রামটার মাথায়। গোমতীর পাড় ধরে আমরা হেঁটে আসছি, হঠাৎ দেখি আবুর মা মরিচক্ষেতে পানি দিচ্ছে। আবুর মাকে দেখে অভিক থমকে দাঁড়াল, আরে, আবুর মা না! তুই ওনার ছবি দিয়েছিলি না ফেসবুকে?
হুম।
দাঁড়া, আমিও একটা ছবি তুলি।
একটা না, পর পর কয়েকটা ছবি তুলল অভিক আবুর মায়ের। আবুর মা নদী থেকে পানি তুলছে, পানি নিয়ে আসছে, ক্ষেতে পানি ঢালছে এমন কয়েকটা ভঙ্গর একটা ধারাবাহিক কাজের চিত্র। আবুর মা কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও একটু দাঁড়াল না পর্যন্ত। ঘোমটাটা একটু টেনে দিয়ে তার মতো করে কাজ করে যাচ্ছে। হঠাৎ করে অভিক খেয়াল করল, নদী থেকে ক্ষেতটা অনেকখানি দূর। আর পাড়টা খুব খাড়া। গোমতী তো এমনিতেই অনেক গভীর নদী, শীতকালে পানি অনেক শুকিয়ে যায়। পানি তুলতে হলে অনেকখানি নিচে নামতে হয়। অভিক একবার ক্ষেতের দিকে একবার নদীর দিকে গমনরত আবুর মায়ের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, আচ্ছা, এই পুরো ক্ষেতে পানি দিতে হলে ওনাকে মোট কত কলসি পানি ঢালতে হবে?
আমি বললাম, এত বড় ক্ষেত, কমসে কম চল্লিশ-পঞ্চাশ কলসি পানি তো লাগবেই।
চল্লিশ-পঞ্চাশ কলসি! উনি এতবার ওই নদী থেকে পানি তুলে আনছেন! এত কষ্ট!
আমি বললাম, তুই এটা ওনার এক বেলার কাজ দেখছিস। সূর্য ওঠার আগে গোয়ালঘর পরিষ্কার করা থেকে তার কাজ শুরু। ওদের চার-পাঁচটা গরু আছে। দুটো দুধেল গাই। গাই ধুইয়ে সকালবেলা আড়ংয়ে নিয়ে দুধ বিক্রি করে। তারপর বাড়ি ফিরে রান্নাবান্না। ছেলেমেয়েদের খাইয়েদাইয়ে স্কুলে পাঠায়। বাড়িতে বারোমাসি অসুস্থ শ্বশুর, তার সেবাযত্ন আছে। হাঁস-মুরগি আছে, সেগুলো দেখতে হয়। আমাদের গ্রামে গ্যাস নেই, মাটির চুলায় রান্না করতে হয়। তার খড়-লাকড়ি জোগাড় করতে হয়। তারপর চাষাবাদের কাজকর্ম সব আবুর মা-ই করে। ধান লাগানো থেকে শাকসবজি চাষ পর্যন্ত।
এত কাজ সে একাই করে! আবুর বাবা বেঁচে নেই?
না, আবুর বাবা তো মারা গেছে বছর পাঁচের আগে নিউমোনিয়ায়। তারপরও আবুর মা হেরে যায়নি, বুঝলি। শক্ত হাতে সংসারটাকে আগলে ধরে আছে। ওই দেখ, তুই আবুর মার চোয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখ, এই নারীকে কে হারাতে পারে বল?
আবুর মা কলসি কাঁখে হেঁটে আসছে। দাঁতে দাঁত চেপে আছে। ছিপছিপে শরীরটা ধুনকের ছিলার মতো টান টান।
২
রাতে খেয়েদেয়ে আমরা হাঁটতে বেরিয়েছি। চারদিকে ঘন কুয়াশা। হাত দশেক দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট করে। কুয়াশার ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অভিক আবৃত্তি করছে,
এখানে চকিত হ’তে হবে নাকো, ত্রস্ত হ’য়ে পড়িবার নাহিকো সময়;
উদ্যমের ব্যথা নাই—এইখানে নাই আর উৎসাহের ভয়;
এইখানে কাজ এসে জমে নাকো হাতে,
মাথায় চিন্তার ব্যথা হয় না জমাতে;
এখানে সৌন্দর্য এসে ধরিবে না হাত আর,
রাখিবে না চোখ আর নয়নের ’পর;
ভালোবাসা আসিবে না—
জীবন্ত কৃমির কাজ এখনে ফুরায়ে গেছে মাথার ভিতর।
আহা! জীবনানন্দ দাশ! কী লিখে গেছেন বস!
আবৃত্তি শেষ করে অভিক জীবনানন্দ দাশের গুনগান গাইতে লাগল।
বুঝলি, জীবননান্দ দাশের সাথে যদি আমার পরিচয় না থাকত, তাহলে আমি এই বাংলাদেশকে চিনতাম না। জানতাম না বাংলাদেশ কত সুন্দর! সেই চোখই আমার ছিল না। আমি যদি ফটোগ্রাফার হয়ে থাকি, তাহলে একজনের জন্যই হয়েছি। জীবনানন্দ দাশের জন্য। খোদার কসম, আমাকে যদি নির্বাসন দেওয়া হয়, একা কোনো এক নির্জন দ্বীপে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, আর কিছু না, আমি সাথে করে নিয়ে যাবো শুধু জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার। দীর্ঘদিন, দীর্ঘ রাত আমি তাঁর কবিতায় হিম হয়ে থেকেছি। তাঁর কবিতা পড়েই আমি প্রথম বুঝতে পেরেছি, নেশা করার জন্য মদগাঁজা না খেয়ে কবিতা পড়লেও চলে। আরেকটা কথা বললে হয়তো একটু বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে, তারপরেও আমি বলি, একবার এক গরমের দিনে বাসায় বিদ্যুৎ ছিল না, ঘরে বসে আমি কুলকুল করে ঘামছিলাম; হাতের কাছে জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভারটা ছিল, কী মনে করে আমি সেটা খুলে পড়তে শুরু করলাম, আশ্চর্য, একটু পরেই টের পেলাম, আমার আর গরম লাগছে না, কেমন শীত শীত লাগছে, শরীরেও আর ঘাম নেই! সেই প্রথম আমি বুঝতে পারলাম, জীবনানন্দ দাশের কবিতা এয়ারকন্ডিশনারের কাজও করে।
ভেবে ভেবে ব্যথা পাবো;- মনে হবে, পৃথিবীর পথে যদি থাকিতার বেঁচে
দেখিতাম সেই লক্ষ্মী পেঁচাটির মুখ যারে কোনো দিন ভালো করে
দেখি নাই আমি—
অভিক গদগদ স্বরে আবার দু লাইন আবৃত্তি করে। আমি শান্ত স্বরে বললাম, এহেন জীবনানন্দ দাশ আত্মহত্যা করেছেন এমন কথা প্রচলিত আছে!
তুই বিশ্বাস করিস যে জীবনানন্দ দাশ আত্মহত্যা করতে পারেন?
হ্যাঁ, সত্যি করে বলতে, আত্মহত্যার কিছু প্রবণতা জীবনানন্দ দাশের কবিতার মধ্যেই ছিল। ‘বোধ’ বা ‘আট বছর আগে একদিন’ পড়লে এ রকমই মনে হয়। আসলে কি মানুষের কাছ থেকে বিমুখ হয়ে প্রকৃতির মধ্যে আশ্রয় খোঁজার একটা ব্যাপার তো জীবনানন্দ দাশের মধ্যে ছিল। আমার মনে হয় কি, প্রকৃতি মানুষকে বাঁচাতে পারে না। মানুষকে বাঁচাতে পারে একমাত্র মানুষ।
৩
ওই দেখ, ওই হচ্ছে মনাডাকাত।
হ্যাঁ, চিনেছি। তুই ছবি দিয়েছিলি ফেসবুকে। লিখেছিলি বিশ বছর আগে ডাকাতি করতে গিয়ে মনাডাকাত ধরা পড়ে। লোকজন তার চোখ উঠিয়ে ফেলে।
হ্যাঁ। তারপর থেকে মনাডাকাত বাড়ির সামনে সারাদিন এভাবে বসে থাকে। আমি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি... আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, মনাডাকাত সারাদিন বসে বসে কী ভাবে!
জিজ্ঞেস করিস নাই কখনো?
হুম, করেছিলাম একদিন।
কী বলল?
গালাগালি করে।
গালাগালি করে!
হুম, তা ছাড়া আর কী করবে! জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা ছাড়া তার আর কী আছে বল?
বোধোদয় হয় না মানুষের?
সবারই কি হয়! চোখ থাকতেই হয় না অনেকের। আর চোখ গেলে তো কথাই নেই। হয়তো ওই গালাগালিরই মধ্যেই লুকিয়ে আছে মনাডাকাতের জীবনদর্শন। গালাগালি তো সে আসলে অন্য কাউকে করে না, নিজেকেই করে।
আহা, কী করুণভাবে বেঁচে আছে মানুষটা, অভিক বলল, একমাত্র মৃত্যু এসেই তাকে এখন মুক্তি দিতে পারে।
মৃত্যুও কারো কারো জন্য আশীর্বাদ হয়, আমি বললাম।
তাহলে সে আত্মহত্যা করে না কেন! অভিক বলল।
আমি বললাম, আত্মহত্যা করার মতোও বোধও হয়তো জাগ্রত হয় না সবার।
অভিক বলল, বোধ জাগ্রত হয়ে আত্মহত্যা করা ভালো, নাকি নির্বোধ হয়ে বেঁচে থাকা ভালো?
কে জানে! তোর এ দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না, অভিক।
৪
খাদেম দাদুকে দেখে অভিক চিনে ফেলল। আমি ছবি দিয়েছিলাম ফেসবুকে। সকালবেলা আড়ংয়ের টংয়ে বসে আমরা চা খাচ্ছিলাম। দাদুকে আসতে দেখে অভিক উঠে দাঁড়াল, আরে খাদেম দাদু না!
দাদু লাঠিতে ভর দিয়ে ঠকঠক করে এসে দাঁড়ালেন টংয়ের সামনে। অভিকই তাকে হাত ধরে বসাল নিজের পাশে। বসেন, দাদু, বসেন।
খাদেম দাদু হাসিখুশি রসিক মানুষ। চশমাটা একটু ওপরে তুলে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, কে তুমি ভাই? তোমাকে তো চিনলাম না।
আমি বললাম, আমার বন্ধু। ঢাকা থেকে এসেছে।
ও আচ্ছা, আচ্ছা। দাদু অভিকের পিঠে একটা হাত রাখলেন। অভিকও তার হাত ধরে রেখে বলল, আমি কিন্তু আপনাকে আগে থেকেই চিনি, দাদু। ও ছবি দিয়েছিল একদিন ফেসবুকে আপনার।
দাদু হাসলেন, আচ্ছা, আচ্ছা। ও ছবি তুলেছিল একদিন। আর ফেসবুক জিনিসটার সাথে আমার সম্প্রতি পরিচয় হয়েছে। আমার নাতিন থাকে ইতালি। মোবাইলে ছবি পাঠায়। দুনিয়া কই চইলা গেল, ভাই। আমার মেজ ছেলে যখন গেছিল সৌদি, ত্রিশ বছর আগে, বছরে বছরে ক্যাসেট পাঠাইত বাড়িতে, রেকর্ডারে ছাইড়া সেই ক্যাসেট শুনতাম উঠানে বইসা, আর এখন, তার ছেলের লগে যেকোনো সময় মোবাইলে কথা বলতে পারি... হা হা... এখন তো কথা কওনের সময় ছবিও দেখা যায় মোবাইলে... দুনিয়া কই গেল গা, হা হা...
খাদেম দাদু হাসছেন। তার হাসি দেখে অন্যরাও হাসছে। খাদেম দাদু যে বেশ আলাপ জমানো মানুষ, তা সবাই জানে। তাই তিনি মুখ খুললেই সবাই উৎকর্ণ হয়ে থাকে কখন কী বলেন শোনার জন্য। দোকানদার চায়ের কাপ ধরিয়ে দিল দাদুর হাতে। চায়ে চুমুক দিয়ে দাদু বলতে লাগলেন, কত কিছু দেখলাম এই জীবনে! ব্রিটিশ পিরিয়ড, পাকিস্তান পিরিয়ড, তারপর এই বাংলাদেশ পিরিয়ডেরই কত পিরিয়ড! আহা, দিনে দিনে দুনিয়াডা কেমন বদলাইয়া গেল! মানুষের পায়ের জুতা দেখলেই তো চোখ কপালে উইঠা যায়।
অভিক অবাক হয়ে বলল, জুতা দেখলে চোখ কপালে উঠে যায় কেন, দাদু?
আরে, জুতা জীবনে চোখে দেখছে নাকি কেউ! আমার দুইটা খড়ম আছিল কাঠের। শ্বশুরবাড়ি না গেলে ওই খড়ম পড়ছি কোনো দিন! আর আছিল টায়ারের সোল। আর এখন দেখ না, একেকজনের পায়ে কী একেক রঙের জুতা!
বলাই বাহুল্য, সবাই তখন চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একেকজনের পায়ের জুতা দেখতে লাগল। অভিকের পায়ে দামি এক জোড়া কেডস। সে পা দুটো বেঞ্চের নিচে গুটিয়ে নিয়ে হেসে বলল, দাদু, আপনার বয়স কত হলো বলুন তো?
তা ধরো আশি-বিরাশি তো হলোই।
এত!
কী বলো! হবে না! দেশভাগের সময় আমি পূর্ণযুবা। তারপরের বছরই তো বিবাহ করলাম। ষাইট-পয়ষট্টি হইয়া গেল আমার বিবাহের বয়স। আমার বড় ছেলের বয়সই তো ষাইটের ওপর। বললাম না, আমার নাতিন থাকে ইতালি...
এখনো কিন্তু আপনি বেশ স্ট্রং আছেন।
সেটা প্রমাণ করতে খাদেম দাদু হা হা করে হেসে উঠলেন। পাশে বসা একজন বয়স্ক মানুষ বললেন, স্ট্রং থাকবো না, চাচারে সেই ছোডবেলা থাইকা দেখতাছি সারাক্ষণ কোনো না কোনো কাজকর্ম নিয়া আছে।
আরেকজন বললেন, আর আজেবাজে কিছু খাইছে নাকি কোনো দিন? জীবনে একটা বিড়ি খায় নাই, সিগারেট খায় নাই। তামুকটাও খায় নাই।
ফরমালিনও খাই নাই, খাদেম দাদু হেসে বললেন, তোরা এহন যাই খাস ফরমালিন খাস।
হ, হ, সবাই সুর তুলল, গাছের টাটকা তরিতরকারি খাইছেন, সার জীবনে দেখছেন চোক্ষে! আর এহন দেহেন না, পুকুরের মাছটা পর্যন্ত সার ছাড়া হয় না।
হ, আমরা আশি বছর বাঁচব ক্যামনে বলেন, বয়স্ক লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন।
অভিক বলল, দীর্ঘকাল বেঁচে থাকাটা তো বড় কথা না, বড় কথা হচ্ছে, আনন্দের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকা। দাদু তো এখনো বেশ আনন্দের মধ্যেই আছেন...
হা হা, দাদু মাথা নাড়িয়ে বললেন, যেদিন এই আনন্দ হারিয়ে ফেলব সেদিনই আমি মরে যেতে চাই। আশা করি শীঘ্রই এই আনন্দ আমি হারাচ্ছি না... হা হা...
না, না, আপনি সেঞ্চুরি করে যাবেন, আমি বললাম।
আরে কী বলিস! টেস্ট ম্যাচ খেলছি না! খালি তো ঠেকিয়ে যাচ্ছি, আউট হতে দেরি আছে। দেখ, ডাবল সেঞ্চুরি না করে ফেলি!
সবাই খুব হাসল। অভিক দাদুর হাতটা চেপে ধরে রেখে বলল, আচ্ছা, দাদু, আপনার এই অপার আনন্দের উৎস কী!
দাদু একটু গম্ভীর হয়ে কথাটার ওজন পরীক্ষা করে ওজনমতোই উত্তর দিলেন, আসলে কি, আনন্দ হচ্ছে নির্মলতা। জীবনে কারো সাথে কোনো অন্যায়-অপরাধ করি নাই। এই যে, এতটা বছর বাঁইচা আছি, কেউ বলতে পারবে না খাদেম আলী কারও বাড়া ভাতে ছাই দিছে কোনো দিন।
না, না, না, অনেকেই হাত তুলে বলল, না, চাচা, আপনেরে আমরা সবাই ফেরেশতার মতো মানুষ জানি।
এই যে, মানুষ আমারে ভালোবাসে, এইটাই আমার জীবনের আনন্দ। আমার একটা সুন্দর পরিবার আছে, পরিবারের মানুষগুলো আমারে রাজার মতো দেখে। এই গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষ আমারে সম্মান করে, দেখলে সালাম দেয়, হাত ধইরা পাশে বসায়, এর চেয়ে আর বেশি কিছু কী চাই রে।
পরিবেশটা হঠাৎ করেই কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। যেন আর চায়ের দোকান নেই এটা। কোনো একটা সাজানো মঞ্চে বসে আছি সবাই। দাদু হচ্ছেন মূল অভিনেতা, আমরা সবাই পার্শ্ব চরিত্র।
অভিক দাদুর হাতটা আরেকটু চেপে ধরে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, দাদু, আপনাকে একটা প্রশ্ন করি, এই যে এতটা বছর ধরে আপনি বেঁচে আছেন, এত বছর বেঁচে থেকে জীবন সম্পর্কে আপনার কী রকম অভিজ্ঞতা হলো? জীবনটা শেষ পর্যন্ত কেমন?
ভালো একটা কথা জিগাইছো ভাই, জীবনটা কেমন! হ্যাঁ, আমিও এইটা নিয়া ভাবছি অনেক সময়। জীবনটা কেমন আসলে...
খাদেম দাদু চুপ হয়ে একবার করে সবার মুখের দিকে তাকালেন। জানি তো দারুণ বক্তা তিনি, সবার অভিব্যক্তি খেয়াল না করে কি আসল কথাটা পারবেন! সবাই তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। যেন আজই সবাই জীবনের আসল উত্তরটা পেয়ে যাবে। আর খাদেম দাদুও এমন খেলাতে পারেন একেকটা কথাকে, আশি বছর ধরে বেঁচে থেকে এ-ই তো শিখেছেন, কথাকে মাছের মতো বড়শিতে গাঁথতে, তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমরা অধৈর্য হয়ে গেলাম, আশি বছর, আশি বছর ধরে বেঁচে থেকে তিনি জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, প্রশ্নটা যেমন, উত্তরটাও তেমনি হবে, এককথাতেই কি আর বলতে পারবেন, নিশ্চয়ই গুছিয়ে নিচ্ছেন মনে মনে ভালো করে, চায়ের কাপটা হাতের মুঠোতে ধরে রেখেছেন শক্ত করে, যেন ওটাই তার জীবন, এক মুহূর্তের অসতর্কতায় ফসকে পড়ে যাবে, হঠাৎ চোখ দুটো কেমন চকচক করে উঠল খাদেম দাদুর, তা দেখে অন্যদের চোখও যেন হেসে উঠল ভোরের আলোয়, খাদেম দাদু আর আমাদের গাঁয়ের সহজ-সরল আলাভোলা মানুষটি রইলেন না, যেন দূরদেশ থেকে আগত কোনো রহস্যময় মানুষ, ভিনদেশি জাদুকর, ঈশ্বরপ্রেরিত মহাপুরুষের মতো তিনি ঘোষণা করলেন, জীবন সৃষ্টিকর্তার একটা নেয়ামত। জন্মের আগে আমরা কেউ জানতাম না যে আমাদেরই জন্ম হবে। হ্যাঁ, একদিন মরে যাব, এ কথা সত্য, তার জন্য দুঃখ হয়। কিন্তু, আমাদের যদি জন্মই না হতো, তাহলে তো জানতামই না জীবন কী! জীবন একটা বিশাল যাত্রা, আমরা কেউ জানি না, এই পথের পরের বাঁকে কী আছে। এইটাই জীবনের জাদু!
৫
দিঘির পাড়ে বাঁশঝাড়ে হোসেনের বউ শুকনো পাতা কুড়াচ্ছে। তার জটার মতো বিশাল খোপা খুলে গিয়ে মেঘের মতো চুলগুলো পিঠে লুটাচ্ছে। দৃশ্যটা দেখে অভিক থমকে দাঁড়িয়ে বলল, কে রে মেয়েটা?
আমাদের পায়ের শব্দ পেয়ে হোসেনের বউ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেখে দ্রুত মাথায় ঘোমটা তুলে দিল। আমি দেখলাম, অভিক কেমন হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। হোসেনের বউ দেখতে এমনই সুন্দর, তাকে দেখে কোনো ছেলের মাথা না ঘুরে পারে না। হোসেনের বউ পাতাভরা ঝুরিটা কোমরে তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল। দিঘির ওই পাড়েই তাদের বাড়ি। অভিক তাকিয়েই আছে নিষ্পলক চোখে। আমি ওর হাত ধরে বললাম, চল।
কে রে মেয়েটা? এত সুন্দর! এত সুন্দর একটা মেয়ে বাঁশঝাড়ে পাতা কুড়াচ্ছে। তুই ওর ছবি দিসনি কেন কোনো দিন?
আয়, এই মেয়েটার একটা গল্প আছে।
কী গল্প?
মেয়েটা আমাদের হোসেনের বউ।
হোসেন কে?
হোসেন রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়েছিল ঢাকায়। যে-বাড়িতে হোসেন কাজ করত, সে-বাড়ির পাশের বাড়িতে ওই মেয়েটা থাকত। মেয়েটা হিন্দু। মেয়েটা হোসেনের সাথে পালিয়ে চলে এসেছে।
তাই নাকি! কবে!
তা হবে বছর দুয়েক। মেয়েটার পরিবার বেশ ভালোই, ঢাকায় নাকি নিজের বাড়িও আছে। লেখাপড়াও করেছে কিছুদূর। ইন্টার পর্যন্ত পড়েছে। হোসেনে দেখতে মোটামুটি হলেও লেখাপড়া তেমন করেনি। সেভেন-এইট পর্যন্ত পড়েছে বোধ হয়।
শিট!
না, তুই এখনই শিট বলিস না, গল্পের আরও বাকি আছে। বছরখানেক আগে এক বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে হোসেন ছাদ থেকে পড়ে পা ভেঙে ফেলেছে। এখন পঙ্গু হয়ে ঘরে পড়ে আছে।
শিট!
না, তোর শিট বলার সময় এখনো আসেনি। মেয়েটা তো তার পরিবারের কাছেও আর যেতে পারে না, পরিবারের লোকজন তাকে পরিত্যাগ করেছে। হোসেনও তো এখন কিছু করতে পারে না, তাহলে তাদের সংসারটা চলে কী করে!
কী করে!
গ্রামের মানুষের ধারণা, রাতবিরাতে খারাপ ছেলেরা যাতায়াত করে হোসেনের বাড়ি।
শিট!
হ্যাঁ, এবার তুই শিট বল।
৬
আজ অভিক চলে যাচ্ছে। আমি যাচ্ছি ওকে ইস্টিশনে এগিয়ে দিতে। রিকশায় যেতে যেতে আমরা দেখি আবুর মা যাচ্ছে দুধের কলসি নিয়ে আড়ংয়ের দিকে। অভিক বলল, এই মহিলাকে একবার পা ছুঁয়ে সালাম করতে ইচ্ছা করছে রে।
কর গিয়ে।
না, ব্যাপারটা নাটকীয় হয়ে যাবে। তবে, মন থেকে তাকে ঠিকই আমি সালাম জানাচ্ছি। কী লড়াই করেই না সে টিকে আছে!
হোসেনের বউ! হোসেনের বউ কি লড়াই করছে না?
ওই মেয়েটাকে ধরে যদি আমি থাবড়াতে পারতাম।
সে কি আর জানত হোসেন ছাদ থেকে পড়ে পঙ্গু হয়ে যাবে! স্বামী যদি সুস্থ থাকত, তাহলে তো তাকে আজ এই জীবন বেছে নিতে হয় না।
সে কেন ওরকম একটা ছেলের সাথে পালিয়ে আসল?
প্রেমের রহস্য কে কবে বের করতে পেরেছে? রাজকন্যাও নাকি প্রেমে পড়ে রাখালের!
আচ্ছা, ওই মেয়েটা আবুর মায়ের মতো লড়াই করে বাঁচতে পারল না!
হয়তো ওটাই ওর কাছে সহজ মনে হয়েছিল। ওর তো শরীরের সৌন্দর্য ছিল, আবুর মায়ের যেটা ছিল না। আবুর মায়ের কিছু জমি ছিল, হোসেনের কোনো জমি নেই। আবার মনাডাকাতকে দেখ, সে শরীরের শক্তিতে, অস্ত্রের শক্তিতে পরের ধন কেড়ে নিয়ে খেয়ে বাঁচতে চেয়েছিল, আজ অন্ধ হয়ে নিজেই নিজের জীবনকে অভিশাপ দিচ্ছে।
কী অদ্ভুত মানুষের এই জীবন!
হ্যাঁ, খাদেম দাদু যেটা বলেছে, আমরা কেউ জানি না, এই পথের পরের বাঁকে কী আছে। এইটাই জীবনের জাদু!