চতুষ্পদ
আজকেও চাওবা স্বপ্নটা দেখল। মাঝরাতে তার ঘুম ভেঙে গেলে সে বিছানায় একা বসে রইল। তার সারা শরীর ঘেমে গেছে। কাউকে ডেকে ঘুম ভাঙাবে কিনা ভাবছে। ডেকেই বা কী লাভ, উল্টো আরও অস্থির করে তুলবে। বৌয়ের মুখ দিয়ে বের হবে যত বাজে ধরণের কথা! ‘নিজে তো মরবে না, আমাদেরকেও শান্তিতে থাকতে দেবে না!’ তারপর সেই পুরাতন গালি—কুষ্ঠিথংপা! অবশ্য গালিটা সে তার মুখের দিকে না তাকিয়েই বলত। যতই হোক, স্বামী তো! মেয়েটা বলবে, বাবা কাল আমার স্কুলের পরীক্ষা। তুমি এরকম করলে নির্ঘাত ফেল করব।
মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানিয়ে চাওবা বলে, না না! তোমরা সবাই পাশ করে যাও, আমিই ফেল করব! আমার আয়ু আর বেশি দিন নাই। এরকম অদ্ভুত স্বপ্ন ইহজীবনে কেউ কি দেখে থাকবে? তোমাদের চোখ-মুখ দেখে আমি তো ভয়ে কিছু বলতেই পারলাম না। শুনলে নিশ্চয় বলবে, মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। ভালো করে কিছু বুঝতেও চাইবে না।
আজ রাতেও চাওবার আর ঘুম আসবে না। কাল ভোরে কাক ডাকার আগে তাকে ঘুম থেকে উঠতে হবে।
আজকাল হাতে কোনো কাজ না থাকাই লুকানোর কুয়া খুঁজে বেড়ায় সে। কাকড়ার মতো লুকিয়ে থাকার জন্য। কুয়া নেই। মাছের কথা কে আর ভাববে! সব নিঃশেষ হয়ে যাক! নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, কুয়া সব। মানুষ বাঁচলেই হল। যেখানে যে জায়গা পাবে দখল করে নাও, ঘর তোলো, বিল্ডিং বানাও!
চাওবার সেরকম কোনো ইচ্ছা নেই। বলতে গেলে কোনো জমিই নেই তার। কেবল নদীপাড়ের বালুচরে খাস শ্মশানে এক টুকরো জমি আছে। সেটা শুধু মৃত্যুর পর তার চিতা পোড়ানোর জন্য।
মনে হয়, মা-মেয়ের সেদিকে কোনো চিন্তাই নেই। সবসময় খোশগল্পে মজে থাকতে পারে তারা। কে জানে—কী আছে তাদের মনে! বৌটা সাংঘাতিক! সকাল হলেই তার চেঁচামেচি শুরু—বেরোও বেরোও, বেরিয়ে পড়ে! তোমার বাপ-দাদারা সব কাজে লেগে গেলে তখন কি আঙুল চুষবে?
এসব কথা শুনলে চাওবার বমি করতে ইচ্ছা করে। ছি! তবুও, স্বপ্নটা নিয়ে তার কিছু ভাবা উচিত। এরকম স্বপ্ন সে কেন দেখছে। এবারেরটা নিয়ে তিন তিনবার দেখা হল স্বপ্নটা।
একবারও কাউকে মুখ খুলে বলতে পারল না ব্যাপারটা। গ্রামের ডাক্তারবাবুটাও আসে না। ঐ যে রামকিশোরের ছেলে। নামটা কী যেন! হ্যা হ্যা, মনে পড়েছে—রতন! একদিন সরাসরি তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে, কী এক সমস্যায় পড়ে গেলাম বাবা! ঘুম থেকে উঠলেই হাতটা শুধু পাছার দিকে চলে যায়। সে কি পাছার কথা মুখে বলবে? না ভঙ্গি দিয়ে বোঝাবে?
এমনিতেই গ্রামে তাকে নিয়ে অনেক দুর্নাম আছে। রাতে পাহারাদারি করতে গিয়ে সে নাকি সবজি চুরি করে। একদিন সোনাইর বৌ প্রকৃতির ডাকে বাইরে বের হলে সে নাকি তার পাশে দাড়িয়ে ছিল। সোনাইর বৌ হঠাৎ তার ছায়া দেখে চিৎকার করলে সে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
কথাগুলো চাওবা শুনলে তার পাছাহাতড়ানোর রোগটা বেড়ে যায়। তার হাত বারবার পিছনে চলে যায়। একদিন শ্যামবাবু মুচকি হেসে বলল, কয়েক বছরের মধ্যেই মানুষের শরীরে এক পরিবর্তন আসবে। কীভাবে ? শেয়াল কুত্তা হতে মানুষকে আলাদা করার মতো কিছুই থাকবে না। সত্যি বলছি! পত্রিকায় লিখেছে, মানুষ একদিন বুঝতে পারবে তাদের মনুষ্যত্ব কিসের উপর টিকে ছিল। সেটা হারিয়ে যাওয়াই মানুষের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকল না।
শ্যামবাবু আরও বলল, এখনো দেশের অনেক মানুষ আমাদেরকে জংলি ভাবে। আমরা নেংটি পড়ে টিলায়, পাহাড়ে থাকি! শ্যামবাবুও তার মতো ওই স্বপ্নটা দ্যাখে কিনা সন্দেহ হয় চাওবার। না, যদি দেখত তাহলে এরকম চাঙ্গা হয়ে থাকতে পারত না। শ্যামবাবু মুচকি হেসে বলে, অনেক সময় এভাবে বলাতে লাভ হয়।
চাওবা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে, কেন?
না হলে আমরা যে সুযোগ-সুবিধা পাই, তা কি পেতাম।
কিসের সুযোগ-সুবিধার কথা চাওবা বুঝে না । কই, সে তো জীবনে কোথা থেকেও কোনো ধরনের সুবিধা পায় নি। তবে সে শুনেছে, এই শ্যামবাবু লোকটা খুব সুবিধার লোক নয়। সমাজ বিক্রি করে নাকি সে চলে। চাওবা অবশ্য এ কথা মেনে নিতে নারাজ। সমাজ আবার বিক্রি করা যায় নাকি? ধ্যাৎ!
চাওবা সরল মানুষ। বড় বড় কথার মারপ্যাচ তার মাথায় ঢোকে না। একদিন সে শ্যামবাবুর ছেলে শ্যামলকে রাস্তায় পেয়ে বিষয়টা জিজ্ঞেস করল। একথা শুনে শ্যামল আশ্চর্য। সে রাগ করল খুব। চাওবা বুঝতে পারল এভাবে জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হয়নি। বাপ সমাজ বিক্রি করে চলে কিনা এরকম প্রশ্ন করা ঠিক নয়। শ্যামল প্রথমদিকে একটু চুপ করে থাকল, কথার মর্ম বোঝার জন্য। পরে জিজ্ঞেস করল, ‘কাকা, এ কথা আপনাকে কে বলল?’ চাওবা কারও নাম বলল না। আড়াল করার চেষ্টা করল। শ্যামল রাগ করেও কিছু না বলে চলে গেল।
একদিন বাবা আর ছেলের মধ্যে বড় ধরণের এক ঝগড়া বেধে যেতে সে দেখল। মানুষের নানান ধরণের কটুক্তি নিয়ে শ্যামল তার বাবাকে প্রশ্ন করায় বাবা জানিয়ে দিল, বাপের হোটেলে বসে যে খায়, তার আবার এত কিসের কথা! শ্যামল নিশ্চুপ থাকে, তার মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বেরোয় না। চাওবা দূর থেকে সব শুনল এবং দেখল। কার ন্যায় বা কার অন্যায় হল, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। শ্যামবাবু বলে, আমি কারো ক্ষতি করেছি নাকি? আমি বিদেশি সংস্থা থেকে ফান্ড এনে প্রজেক্ট চালাই, তাতে কার কী! তখন শ্যামল তার বাবাকে উল্টো প্রশ্ন করে, কী বলে ফান্ড আনছ? আমাদের কিচ্ছু নেই, ধর্ম নেই, ভাষা নেই, আমরা গরিব ভিখারি—এইসব বলে তো? তাদের কথার সবকিছু বুঝে উঠতে না পারলেও সমাজ বিক্রি করার বিষয়টা কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে চাওবা। এই জানার কারণে চাওবার সংশয় আরো বেড়ে যায়। তার মনুষ্য সত্তায় কোনো বিকৃতি হল নাকি। পাছার দিকে কী যেন একটা... বিকৃত কী যেন একটা! হে প্রভু!
এক বছর হলো ঘরে কারেন্ট নেই। কয়েক মাসের বিল বকেয়া থাকায় বিদ্যুতের লাইন কেটে দিয়ে গেছে। কেটে দিক। বাইরের লাইন কেটে দেয় অফিসের মানুষ, আর দেহের ভিতরের লাইন কেটে নিচ্ছে রাক্ষুসে জীবাণু। আমাদের শরীরে নাকি বাহাত্তর হাজার লাইন মানে শিরা-নালি আছে। সেদিন গায়েন কুঞ্জবাবু মনশিক্ষার গানে সে কথাই বলল। এমনভাবে বলল, মনে হয় সে গুনে দেখেছে!
কেরোসিনের অভাবে হারিকেনটা নিভু-নিভু করছে। গভীর রাতেও স্বপ্নটা দেখার আশংকায় না ঘুমিয়ে গালে হাত দিয়ে বিছানায় বসে আছে চাওবা। পাশের বিছানায় মা আর মেয়ে কিছুক্ষণ পরপর এপাশ-ওপাশ করছে। ছেলে আসে নি, তাই স্বপ্নটা দেখলেও একটু শান্তিতে শুতে পারছে। ছেলেটা তার সাথেই ঘুমায়। তারও একটা রোগ আছে। ঘুমাতে পারে না। অবশ্য স্বপ্নটপ্ন দেখে নয়, হঠাৎ করে ঔষুধ খায়, মেয়েদের মতো করে কান্নাকাটি করে। খোকা, কী হয়েছে বলে জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর দেয় না। শুধু কান্নাকাটি করে। পরের দিন আবার হাসিখুশি থাকে।
একটা বিড়ির টান দেবে কিনা ভাবছে। না না! সর্বনাশ হয়ে যাবে। মেয়ে বলে, বাবা বিড়ি খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে। বৌ বলে, কী বিশ্রী গন্ধ! শুনলেই বমি আসে। সে কিচ্ছু বলে না। কেবল এইসব খেয়াল করে। বাঁশঝাড়ের আড়ালে, মাঠে গিয়ে, মূল রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বিড়ির একটান দিলে কার বাপের সাধ্য আছে তাকে ধরার।
একটু নেশাটেশা না করলে কি হয়! সারাদিন গরুর মতো, মোষের মত খেটে এক মুহূর্ত বিশ্রাম নিতে পারে না। এক থালা ভাত নিমেষে সাবার করে দিতে পারে চাওবা। এই কয়দিন ভাত খেতে বসেও শান্তি নেই। একটু ভাত চাইলেই তার বৌ ভাতের হাড়িটা সামনে নিয়ে আসে, আর বলে, এই দেখ, হাড়ি সাফ!
চাওবাও কম নয়। মনে মনে বলে, বেশি কথা বলিস না। তোকেই আস্ত খেয়ে ফেলব!
এসব কথা বাইরে বলা যায় না। বড়ো লজ্জার কথা। মা-মেয়ের অবশ্য ভাত না খেলেও চলে। সন্ধ্যা হলেই কীসব পাতা-টাতা আর জল দিয়ে নামমাত্র কিছু রান্না করে টেলিভিশন দেখার জন্য দৌড় দেবে তাম্ফানুদের বাড়িতে। টিভিতে স্ত্রী নামে একটা সিরিয়াল দেয়। সেটা দেখার পর বাড়িতে এসে মা-মেয়েতে খালি সেই কাহিনির প্যাচাল। তুলকালাম বৃষ্টি হলেও বন্যা এলেও এমনকি গ্রামে মহামারি লাগলেও ওই নাটক তারা ছাড়বে না। কী আছে ওটার মধ্যে—সেটাই দেখার জন্য একদিন লুকিয়ে লুকিয়ে মা-মেয়ের পেছন পেছন গেল চাওবা। দেখল, কী এক ভাষায় কথা হচ্ছে। হিন্দি ভাষা। গ্রামের অন্য মহিলারাও ভাবে-রসে মজে আছে। চাওবা সেই রসের কিচ্ছু বুঝল না।
কাকে কী বলবে! এখন সে পালাগানের সুর আর মনশিক্ষার কথাও কিছু বুঝতে পারে না। সেদিন গায়েন কুঞ্জ গানে গানে দেহের ভিতরের কলকব্জাগুলো বর্ণনা করল। এই মন কিভাবে সেখানে লীলাখেলা করে—তা সে ভালো করে বুঝিয়ে দেয়। চাওবার কানে তা ঢুকেই না। গায়েনের কথার ভিতর সে স্পষ্ট দ্যাখে শরীরের ভিতরে পেট, পেটের ভিতর বিশাল এক গর্ত, কুয়ার মতো। সেই গর্ত কৃমিতে ভরা। থু! থু!
শ্যামবাবু বলেন, এই অকাজের গানগুলোই আমাদেরকে সামনের দিকে এগোতে দেয় না। শরীরের ভিতর আবার কিসের কলকব্জা, কিসের তার? তোমাকে আসল তার দেখাবো চাওবা দাদা। চিন্তা করো না। যে তার দিয়ে গাড়ি চলে। জীবনের উন্নতির ঘোড়া দৌড়ায়।
চাওবা বুঝতে পারে না। উঠানের চেয়ারে বসে শ্যামবাবু এসব কথা বলার সময় ঘরের ভিতর দরজার পাশে লুকিয়ে থাকা চাওবার মেয়ে কেন মুচকি হাসি দিল—আর শ্যামবাবুও কেন তার দিকে তাকিয়ে সেই হাসির বিনিময় করল— তার কারণও বুঝতে পারল না চাওবা । তাদের দুজনের মধ্যে কী এক বোঝাপড়া হল, যেটা বোঝার ক্ষমতা চাওবার নেই।
পরের দিন সে দ্যাখে, শ্যামবাবু তার বোঝা না বোঝার ভঙ্গিটাকে আরো স্পষ্ট করার জন্য চাওবার মেয়ের সাথে ফুসুরফাসুর করছে। চাওবা ঘরে ছিল না। বাড়ির গেটে সে দেখল। ভাবল, আমার মেয়ে এমনই সমঝদার হয়ে গেছে যে শ্যামবাবু আমার সাথে কথা না বলে আমার মেয়ের সাথে কথা বলছে! নিজেকে চাওবার মনুষ্য-ইতর গোছের কিছু মনে হল। মেয়ের কাছেই যেন ছোট হয়ে গেল সে। তার বৌ আবার বলছে, বাপ অক্ষম হলে মেয়েকেই আগ বাড়িয়ে আসার দরকার। অন্যের কাছ থেকে আমার মেয়েটা এক কদম এগিয়েই থাকে।
মায়ের ওই এক কদম এগিয়ে থাকার কাহিনিটাকে অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্য চাওবার মেয়ে আরো সহস্র কদম এগিয়ে থাকার স্বপ্ন দেখে। লন্ডন, আমেরিকা, জার্মানি... এই নামগুলা চাওবা স্পষ্ট করে বলতেও পারে না। তার মেয়ে ওইসব দেশে যাওয়ার স্বপ্ন দ্যাখে! শ্যামবাবু হলেন তার স্বপ্নের মাঝি। না না, মেয়ে বলেছে, সে হবে তার স্বপ্নের উড়োজাহাজের ক্যাপ্টেন। এটা নিয়ে রাস্তাঘাটে মানুষ হাসাহাসি করে। চাওবাকে সবাই আড়চোখে দ্যাখে। পাছে লোকে কী বলে—সব সে জানে। তখন বিশ্রী এবং ভয়ানক সেই স্বপ্নটার কথা তার কাছে আরো বেশি করে মনে পড়ে। তার হাত ঠিক পিছন দিকটায় চলে যায়। সত্যি, সত্যি, পিছন দিক থেকে কিছু একটা বের হচ্ছে নাকি...!
শ্যামবাবু নাকি আবারো কিসের জানি ফান্ড এনেছে। লোকে বেহুশের মত দৌড়ছে। সমাজের উন্নতির জন্য। আমাদের মন্দির মণ্ডপ, গান নৃত্য, কাপড় চোপড়, সোনা দানা সবকিছুর উন্নয়ন ঘটাবে সে। দুই-একজন করে দেশ-বিদেশের মানুর গ্রামে আসা শুরু করল। তাদেরকে দেখে চাওবা নিজেকে জংলি না ভেবে থাকতে পারে না। তার স্বপটা এবার তাকে বাস্তবেই পীড়ন দেয়। দেশবিদেশের মানুষ থাকার জন্য শ্যামবাবু একটা রেস্ট হাউজ না গেস্ট হাউজ —কী একটা তৈরির কথা বলে। চাওবাকে তখন আর গ্রাম পাহারা দেয়া লাগবে না। শ্যামবাবুর হোটেল পাহারা দিলেই চলবে। আর তার মেয়ে হবে ঐ হোটেলের ম্যানেজার।
শ্যামবাবুর ছেলে শ্যামল নাকি ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। বাপের সাথে সে কোনো সম্পর্ক রাখবে না। একদিন, সে চাওবাকে চৌমুহনায় পেয়ে বলে, কাকা, আমাদের নিজেদের বলে একদিন কিচ্ছু থাকবে না। উন্নতির ঘোড়ায় পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা আবার জঙ্গলে গিয়েই পড়ব। মণিকে যত্নে রাখবেন কাকা।
মেয়ের কথা শোনার পর চাওবার মনটা হঠাৎ কেমন জানি করতে লাগল।
আজ আর ঘুম এল না চাওবার। ওই পুরাতন দুঃস্বপ্নের যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারল না সে। আস্তে আস্তে ঘুম থেকে উঠল সে। মা আর মেয়ের দিকে একবার তাকাল। না, তারা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। স্ত্রী সিরিয়ালটা দেখে আসার পর তার পরের পর্বে কী হবে ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে, নিজেরাও জানে না। তোষকের নিচ থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করে দরজা খুলে বাইরে বের হল চাওবা। গ্রামে পাহরা বসেছে। প্রহরীরা খবরদার খবরদার বলে হুশিয়ার করছে। কেন জানি, সে হঠাৎ করে একটা লাফ দিয়ে উঠল। গভীর রাতে বিড়ি টানতে টানতে তার মাথায় এক বুদ্ধি এল। আজ বৃহষ্পতিবার, প্রহরী হিসেবে হরিবাবু, বিদ্যাধন আর ভাড়াটে কাশেম থাকার কথা। এই স্বপ্নের কথা তাদের কাছে গিয়ে বলা যায়। রাত বলে তাকে কেউ উপহাস করবে না। রাত্রে সবার মনে একটা ভয়-ডর কাজ করে। তারা ব্যাপারটাকে আমলে নেবেই। না, কাউকে না বলেও আর উপায় নেই। এভাবে আর কয়দিন থাকা যায়।
আজ চাওবা তাদের কাছে স্বপ্নের কথা খুলে বলল। বলতে বলতে তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেল। বিড়ির টানও শেষ হল। হরিবাবু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, সত্যিই, চিন্তার বিষয় চাওবা। এই রকম স্বপ্ন তো...!
তার কথা শেষ না হতেই বিদ্যাধন বলল, মানুষের লেজ বের হয় বলে জীবনে কখনো শুনিনি। এরকম স্বপ্ন কেউ দেখেও নি। দেখি দেখি চাওবা, কোনদিক দিয়ে লেজটা বের হচ্ছে। বিষয়টা যেহেতু সাংঘাতিক, তাই স্বপ্নের বিষয় হলেও একবার দেখা দরকার।
বন্ধু বলেই ইয়ার্কির মত করে বিদ্যাধন তার দুই হাত দিয়ে চাওবার কাধে ধরে সজোরে চাওবার পিছনদিকটা ঘুরিয়ে নিল। মুচকি হাসি হেসে চাওবার পাছায় সে তার হাত দিয়ে মালিশ করে দেখতে লাগল।
চাওবা লজ্জা পেয়ে ‘আরে, সরো, সরো, কী করছ, ছাড়ো!’ বলে তাকে সরাতে লাগল।
: হৈমা!
: কী হল!!
হঠাৎ করে তারা নিশ্চুপ রাতের মতো থ হয়ে গেল। কোনো কথা নেই। বিদ্যাধনের হাত চাওবার পিছন দিকটায়, নিচের দিকে... দড়ি, সাপ কিংবা লতার মত কী একটা যেন তার হাতে। আরে! আরে! এইখানে টর্চ মারো।
হরি টর্চ মারল।
স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। লম্বা। মোষ বেধে রাখার দড়িও মনে হচ্ছে। কী সেটা!
আরে না! পেচিয়ে পেচিয়ে কিছু লোমও আছে।
: হা প্রভু, কী দেখলাম! এটা তো সত্যিই একটা লেজ!!!
অনুবাদকের নোট
কুষ্ঠিথংপা: কুষ্ঠরোগে ভোগা কেউ। ঘৃণার্থে ব্যবহৃত।
হৈমা: বিস্ময়সূচক শব্দ। বাংলায় এর যথার্থ প্রতিশব্দ পাওয়া মুশকিল।
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষা থেকে অনুবাদ অঞ্জন সিংহ