ওদের কোথাও যাবার ছিল না
নাকফুল
মানুষটাকে আমরা সবাই চিনি। প্রতিদিনই যিনি পানে চুন খয়ের মিশিয়ে, সুরভী জর্দার মিহি সুরভিত আলো ছড়িয়ে আমাদের পড়ার টেবিলের গলি দিয়ে টুবটুব রসে ভরা গালে সাইকেল চালিয়ে যান, গুনগুন সুর ভাজতে ভাজতে—সেই লোকটি এমনভাবে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন অনির্দিষ্ট সময় ধরে যে, মনে হবে মানুষটি কোনো রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন। ধরা যেতে পারে সময়টা ৮টা থেকে পৌনে ৯টার কোনো একটা সময়ের অফিস ইন্টারসিটি ট্রেন আসবার সময় আর মানুষটা যেন সেই ট্রেনে উঠবে বলেই অপেক্ষারত। রোদ ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে মাথার ওপর উঠে যেতে থাকলেও লোকটির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে। এমন না যে তার দুই মাথা উঁচুতে লাল রঙের ঢেউ টিন বা পুরোনো এস্ফেল্টের রুফ লাগানো আছে আর লম্বা প্ল্যাটফর্মের অন্যদিকে যাত্রী চলাচল কম হওয়ায় গজিয়ে ওঠা লম্বা ঘাসের দল দুলে দুলে সকালের শীতল হাওয়ায় রোদের তেজটাকে ম্রিয়মাণ করে ফেলছে। এখন শীতকাল না যে, গরম বা ঘাম তাকে ছোঁবে না। আষাঢ়ের বাষ্প ওঠা এই ফটকহীন গরমে তার যেন ভাবান্তর নেই কোনো।
লোকটি এক জায়গায় নিথর দাঁড়িয়ে থাকবার কারণেই আমরা তাকে নির্দিষ্ট করে চিনতে পারি। তিনি অস্থির হয়ে হাঁটাচলা করলেও আমরা তাকে চিনতে পারতাম; কেননা, জায়গাটা ছিল জনমানব শূন্য। কিন্তু তার ভেতর, তার মন যেহেতু আমরা পড়তে বা দেখতে পারছিলাম না, তাই বুঝতেও পারছিলাম না তিনি ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে আছেন কি না। তিনি এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন বজ্রাহতের মতো আর এখন পর্যন্ত দুবার মাত্র ঘড়ি দেখেছেন। তা-ও দেখেছেন কি না, আমরা জানি না। এত দূর থেকে মানুষটার হাতে কোনো ঘড়ি আছে কি না, সেটা বোঝা যাচ্ছিল না। তবু আমরা ভেবে নিয়েছিলাম। কারণ, এমন করে শুধু ঘড়িই দেখে সবাই; কিন্তু হলফ করে আমরা বলতে পারি না তিনি ঘড়ি দেখেছেন। তিনি আদতে কিছু দেখছিলেন কি না, সেটাও বলা খুব মুশকিল, যদিও তিনি ডানে-বামে কোন দিকে তাকাননি একবারের জন্যও। সামনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন যেন মাঝে বয়ে যাওয়া রেলস্টেশনের ওপাশের প্ল্যাটফর্মে তার আর কোনো প্রিয়জন আছে যে ভিন্নপথে রওনা হয়ে যাবার আগে তিনি তাকে তার পুরোনো চালশে পড়া চোখে দেখে নিচ্ছেন এক দৃষ্টিতে।
আমরা মানুষটাকে এতটাই কম চিনতাম যে, প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে সুরভী জর্দার সুরভিত গুনগুনানি ছাড়াও যে তার একটা ১৪ বছরের মায়াবতী মেয়ে আছে, লম্বা পানপাতা মুখের শ্যামল মেয়েটি এখনো যে তার মায়ের শাড়ির আঁচলের নিচ দিয়ে, দিনে একবার হলেও তাকে ভয় দেখানোর মতো ছেলেমানুষি করে—সেটা আমাদের জানা ছিল না। জানা ছিল না লোকটি সারা রাত খুঁজে খুঁজে সকালের এই অফিস টাইমটায় জংলামতো উঁচু ঘাসের এই বিরান জায়গায় এসে কতক্ষণ আগে দাঁড়িয়ে আছে, গত সন্ধ্যার কোনো সময় থেকে মেয়েটি আর তার ঘরে ফিরবে না, তা নিশ্চিত হয়ে গেছে।
দুমড়ে-মাড়ানো, ঘাসে জড়িয়ে থাকা এক নারী শরীরের জোড়া পা ‘ব’ আকারে আলগোছে পড়ে ছিল যেমনভাবে মেয়েটি ছুটির দিনের আলস্যে এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে থাকত। মানুষটি থেকে সমান্তরাল দুই রেল দূরে লম্বা ঘাসের বনের ভেতর দিয়ে শুধু নিরাভরণ পা দুটা রোদের আলোয় চমকে উঠেছিল—আমরা একটু সরে দাঁড়ালে দেখতে পাই, যেমনটা ঘাসের ভেতর নাকফুল পড়ে গেলে হয়। আর মানুষটি সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল। যেমন করে আমরা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াই ট্রেনের অপেক্ষায়।
মা মরিয়ম
ওই দূরের পাড় ভেঙে উঁচিয়ে থাকা নদীর কিনারে সে দাঁড়িয়ে ছিল অনড়। তার শীর্ণ দেহটা নিয়ে এমন থির দাঁড়িয়ে থাকায় তার আসবার খবর পেয়ে যারা বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসছিল, তারা অনায়াসে দূর থেকে একটা নতুন খুঁটি বা মার্কা বলে তাকে মনে করতে পারত। এইখানে নদী তার বিশাল বিশাল আগ্রাসী হাতে এমন কামড় বসাচ্ছে যে কার বসতভিটা আর কার ফসলি জমিন, সেটা তার দেখবার সময় নাই। যদিও যারা তাকে দেখতে ছুটে আসছে, তারা একে ঈশ্বরের পরীক্ষা বলে ধারণা করে নিয়েছিল অনেক আগে থেকে—ঈশ্বর যেমন দেন তেমন আবার নিয়েও নেন; তিনি তো শুধু তাঁর মনপসন্দ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ওপরই এমন কঠিন, কষ্টদায়ক পরীক্ষা অবতীর্ণ করেন—তাদের ঈমানের ভিত কতটা মজবুত তা দেখে নিতে। যারা এমন ভেবেছিল, তারা নদীর পাড় দিয়ে আসতে আসতে এত নতুন ভাঙন দেখে যে, মরিয়ম যেই জায়গাটায় অনড় দাঁড়িয়ে ছিল, সেই উঁচিয়ে থাকা বিশাল মাটির চাঙড়কে তারা আর বিশেষ করে লক্ষ করে না।
লক্ষ না করবার আরও হাজারো কারণ আছে। মরিয়ম পাটখড়ি বা কুঞ্চীর মতো শীর্ণ হয়েছে সেটা না, এমন না যে, বৃষ্টি ধোয়া আকাশের নীল আর সূর্যের আলো এই শেষ দুপুরে এত তীব্র ছিল যে, তারা তাকিয়ে দেখতে পারেনি—মরিয়ম অমন বিপজ্জনক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আসলে তাদের ভেতর, মরিয়মের কাছে পৌঁছানোর তাড়াটাই বেশি ছিল। সে এত দিন পর বিদেশ বিভূঁই থেকে দেশে ফিরছে—এত দিন মানে পৌনে পাঁচশো দিন পর, এমন হিসাবও তারা রেখেছিল। কারণ, এই পাঁচ গ্রামের অনেক নারীই তার মতো কাজের আশায় ঘটিবাটি, হালের বলদ, নদীতে না খাওয়া অবশিষ্ট জমি-জিরাত বন্ধক বা বিক্রি করার টাকায় হাজি মনসুর কাদেরীর এজেন্সি আর সরকারি আনুকূল্যের ভিসায় বিদেশ পাড়ি জমিয়েছিল ভাগ্যান্বেষণে। এই যারা নদীর পাড় ঘেঁষে এক পা ফেলা ফিতার মতো আইলে সাবধানে পা ফেলে আসছে তাদের অনেকেরই মা, বইন, বউ, মেয়ে, মেয়ের মেয়ে, ছেলের মেয়ে, এমনকি নাতির ঘরের-পুতের ঘরের মেয়ে বউও মরিয়মের সাথে একত্রে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিল। তাই তারা কাঁটায় কাঁটায় হিসাব রাখতে পারত, তারা ঘরের খুঁটিতে, বেড়ায় ঝোলানো ক্যালেন্ডারে, মনের গায়ে দাগ কেটে কেটে, অপেক্ষার প্রহর গুনে গুনে দাগ কাটতে, হিসাব কষতে শিখে নিয়েছিল। কিন্তু তারা হিসাব করে, সাবধানে আইলের ওপর দিয়ে হাঁটতে শেখেনি। এমনিতে তারা আইলের ওপর দিয়ে হাঁটে যেভাবে গ্রীষ্মে পানিতে টান ধরা প্যাক বোঝাই পুকুরে জাল টানে, পায়ের গিরা পর্যন্ত ডুবিয়ে জমি চষে, ধান কাটার পর ছিটে-ছুটে পড়ে থাকা পাকা ধানের শিষ ঠোঁটে তুলে নেওয়া শালিখের মতো, মেঠো ইঁদুরের মতো, মুষ্কো ষাঁড় বা মহিষের মতো। আজকে তাদের পায়ে রাবারের পাম শু, চামড়ার স্যান্ডেল, রাবারের উঁচা চপ্পল থাকায় তারা আর তেমন করে হাঁটতে পারে না। আইলের দিকে মাথা নামিয়ে সাবধানে হেঁটে আসে বলে অনেকে মরিয়মকে দেখতেও পারে নাই। এদের ভেতর যারা একপলক মাথা তুলে সামনে তাকিয়ে মরিয়মকে দেখে খুঁটি মনে করেছিল, তারা একটু খেয়াল করলেই দেখতে পারত খুঁটির গায়ে এমন করে কাপড় জড়ানো থাকে না। তারা আরও একটু খেয়াল করলে অবশ্য আরও অনেক কিছু দেখে নিতে, বুঝে নিতে পারত।
তারা খেয়াল করে দেখল, সে মরিয়ম কি না, না বুঝেই শীর্ণকায় এক নারীকে শনাক্ত করতে পারত। কারণ, খুঁটির গায়ে নারীদের মতো করে শাড়ি পরানো থাকে না এ দেশে। কাকতাড়ুয়া বানাতে এরা ব্যাটাদের, বাপ-দাদার পুরোনো ছেঁড়া-ভোড়া জামা-পাঞ্জাবি-গ্যঞ্জিতে খড়পুরে বাঁশের খুঁটির মাথায় হাঁড়ি বা মালসা দিয়ে বসিয়ে দেয়। মেয়েদের শাড়িতে কাকতাড়ুয়া বানানো যেহেতু রীতি নাই, তাই তারা হয়তো কৌতূহলী হয়ে উঠতে পারত। তারা ভাবতে পারত, কে আবার এই নতুন রীতি শুরু করল? কেউ কেউ খেপে উঠতে পারত মেয়ে-মানুষের আদলে কাকতাড়ুয়া বানানোয় ঈমান যাবে কি যাবে না ভেবে। অপেক্ষাকৃত তরুণেরা কেউ কেউ হাসাহাসি শুরু করতে পারত নতুন এই তরিকার নারী-কাকতাড়ুয়া দেখে, ভেবে। কিন্তু তারা কেউ সেভাবেই দেখেনি, কাকতাড়ুয়া ভেবে দেখলে তারা অবাক হতে পারত—উদর স্ফীত নারী কাকতাড়ুয়াও আবার হয় নাকি! তখন তারা ভুল ভাবছে বা ভুল দেখছে কি না দেখতে নদীপাড়ের হাওয়া আর আলো আড়াল করে কেউ চোখের ওপর, কপালে হাত তুলে, চোখ ছোট করে তাকালে দেখতে পারত খুঁটির গায়ে কাপড় রেখে কেউ এই শেষ দুপুরে গা জুড়াতে নাইতে নামেনি, বা কেউ নতুন তরিকার নারী কাকতাড়ুয়াও বানায়ে রাখেনি, এই নদীপাড়ে শীর্ণকায় উদর স্ফীত এক নারী সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তারা দেখতে পারত মাথা থেকে আঁচল খুলে পড়া হওয়ায় যার চুলগুলো সবুজ ধানের মতো বাতাসে দুলছে।
দেখতে পেলেই তো সব বুঝে যাওয়া যায় না। মরিয়মই যে ওইখানে দাঁড়িয়ে সেটা বুঝতে না পারলেও, তারা হয়তো এই আলো-হাওয়ার খেলায় আর নিজেদের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে নিত, ভেবে নিত কোনো গর্ভবতী নারী হয়তো নাইওর যাবার নৌকার অপেক্ষায় এমন করে দাঁড়িয়ে আছে বা স্বামী গঞ্জ থেকে মাল জিনিস নিয়ে ফিরবে বলে দাঁড়িয়ে আছে অপেক্ষায়, হতে পারে গঞ্জের হাসপাতালে যাবে বলে ফিরতি ডাকলঞ্চের জন্য এই নারী দাঁড়িয়ে আছে, এমনও হতে পারে গরমে অস্থির হয়ে পোয়াতি মেয়ে মানুষ একা নদীর পাড়ে খোলা হাওয়ায় শরীর জুড়াতে এসেছে…হতে পারে এমন অনেক কিছুই ভেবে তারা নিজেদের ভেতর কথা বলত বা তাদের চিন্তা ঠিক কি না দেখে নিতে, মরিয়মের বাড়ির দিকে যেতে যেতে সামনের বাঁক ঘুরবার আগেই আরেকবার তাকিয়ে বুঝে নিতে চাইত। কিন্তু পেছন দিক থেকে তাদের চেনা মরিয়মকে তারা কি চিনতে পারত? তাদের চেনা মরিয়ম তো ছিল এই নদীর মতো ভরা। খলবলে, ভয়-ডরহীন, খরস্রোতা আর সারাক্ষণ উজানে বয়ে চলা এক নদী জল। এই নারীকে তারা দেখলেও চিনতে পারত না— বরং আবারও ভেবে নিত দূরদেশে থাকা সোয়ামির জন্য মনপোড়া পোয়াতি কোনো এক বউ বোধ হয় মেঘ ডাকছে—মনের ভার হালকা করতে।
কিন্তু, তারা সাবধানে চলার কারণে আর মরিয়মের কাছ থেকে সেই বালুর দেশ কেমন, কী তাদের কাজ, কেমনে থাকে তারা, টাকাপয়সা কেমন কী? তাদের মা, বইন, বউ, মেয়ে, মেয়ের মেয়ে, ছেলের মেয়ে এমনকি নাতির ঘরের-পুতের ঘরের মেয়ে, বউরা কেমন আছে, কবে দেশে ফিরবে, শরিল-স্বাস্থ্য কেমন তাদের, দেখা-সাক্ষাৎ হতো কি না, হলে তাদের কথা কিছু কইতো কি না, তাদের টাকাপয়সা পাঠাইতে এত দেরি হয় কেন, এদিকে কত ঝামেলায় পড়তে হয় তাদের, সেইটা কি তারা বোঝে! সে কেন এত আগে ফিরে এলো, টাকা-পয়সা-সোনা কিছু আনতে পারছে কি না ইত্যাদি ছাড়াও তাদের মাথায় ধরে না এমন সব জিজ্ঞাসার ভাবনা এমন প্যাঁচ কষে বসেছিল যে তারা আর কিছুই দেখেনি, এমনকি নদীপাড়ের মাটি স্রোতের ধাক্কায়, কামড়ে আলগা হয়ে যাচ্ছে, খুলে খুলে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, সেদিকেও কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না তাদের।
কিন্তু তাদের মাথায় ধরে না, এমন জিজ্ঞাসাগুলো আরও জট পাকিয়ে যায় মরিয়মের বাড়িতে গিয়ে তাকে না পেলে। অগত্যা তারা আশপাশের বাড়িতে দুদণ্ড জিরিয়ে নিতে থামে। কেউ কেউ শ্লথগতিতে, ফিরতে ফিরতে চেনা-পরিচিত মানুষের সাথে দু-এক কথা বলতে দাঁড়ায় আর মরিয়মের বাড়ির আশপাশের গুচ্ছের বাঁশের ঝোপ, সুপারি-পাতার বেড়া, নারকেল পাতার ফিসফিসানিতে চিন্তিত হয়ে পড়ে: মরিয়মের বিয়া হয় নাই, বর নাই, এমনকি বালুময় ঐ বিদেশ বিভূঁইয়ে ধনবান বাড়ির শেখ বা শেখের ব্যাটার সাথেও কোনো লটর-পটর সে করে নাই, তবু পেটে বাচ্চা এসে পড়ছে কেমন করে ভেবে! শেখের ব্যাটাদের মতো পরহেজগার, ফেরেশতা সমান সফেদ মানুষ মরিয়মের মতো ময়লা, ধিঙ্গীর পেটে তাদের বাচ্চা দেবে কেন—অসম্ভব এ চিন্তাকে তারা ছুড়ে ফেলে দেয় যেমনভাবে মরিয়মের বাপ আর শেখের পো’রা এই পাপের বোঝা টানতে পারবে না বলে তাকে দেশ থেকে, বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল।
মরিয়ম তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল, স্ফীত উদর ভর্তি মানুষের বাচ্চা নিয়ে।