জয়নুলের রেখা ও স্থানিক আধুনিকতা
ধ্যান, জ্ঞান ও যাপন—এই তিন অধ্যায় একই সূত্রে গেঁথে যিনি শিল্পী পরিচয়ে পরিচিত হয়ে উঠেছেন তিনি জয়নুল আবেদিন। শিল্প-সমালোচক ও ইতিহাসবিদ আবুল মনসুর লিখেছেন: শিল্পাচার্য অভিধা সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে একমাত্র তাঁর জন্য সংরক্ষিত। সময়ের প্রবহমানতায় তাঁর গুণগ্রাহী ও সমালোচক উভয় দলে ভারী হয়েছে, এ দেশের আধুনিক শিল্পচর্চায় তাঁর প্রভাব ক্ষীয়মান হয়েছে, তার অনুশীলন প্রায় নেই বললেই চলে, এতৎসত্ত্বেও বাংলাদেশের শিল্পকলা জগতে তাঁর সর্বোচ্চ আসনটি প্রশ্নাতীতভাবে অটুট রয়েছে। [আবুল মনসুর, জয়নুল আবেদিন: তাঁর শিল্পভুবন, শিল্পকথা শিল্পীকথা, পৃ : ৩৮২]
ওপরের ভিন্ন দুটি প্রস্তাব দিয়ে আজকের আলোচনা শুরু করা যাক। প্রথমটা শিল্পীর সহজাত প্রবণতার সূত্রে মনোজগৎ ও বাস্তব জীবনকে একই ধারায় প্রবাহিত করার ক্ষমতা দিয়ে চিত্রী হয়ে ওঠা-সংক্রান্ত। অন্যদিকে আবুল মনসুরের ভাষ্যে আছে শিল্পীর ঐতিহাসিক মূল্যায়ন—যেখানে তাঁর অবস্থান নিয়ে সর্বজনস্বীকৃত একটি মত পাওয়া গেল, যদিও আধুনিকতায় শিল্পীর অবদান নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেল।
‘মহাকালের কষ্টিপাথরে চিরস্থায়ী আমল’ যে শিল্পী ‘অর্জন’ [আবুল মনসুর, প্রাগুক্ত পৃ: ৩৮৯] করেছেন, সেই পথিকৃৎ কি জাতের শিল্পী—প্রাক-আধুনিক, আধুনিক কিংবা নব্য কোনো ধারার—তা আমাদের আজকের মনোযোগের বিষয়।
জয়নুল প্রতীকবাদী নন, কল্পনাশ্রয়ীও নন, চিত্ররস সৃষ্টিতে চূড়ান্ত কোনো আদর্শ গ্রহণ করে নিয়ে তিনি তাঁর চিত্রভাষায় উপনীত হন নাই। তিনি শিল্পী হিসেবে ছিলেন বাস্তববাদী—অথচ অনুকৃতিধর্মিতার নিরিখে তাঁর শিল্পভাষা বিচার করা সম্ভব হবে না। সৃষ্টির আওতায় যে বাস্তব জগৎ তার প্রক্ষেপণ ও জয়নুলের ভাষার রসদ, কিন্তু বাস্তবের ইল্যুশন সৃষ্টির ভিত্তিতে যে সূক্ষ্ম চারুবৃত্তি, সেই ইয়ুরোপীয় বাস্তবানুগ অঙ্কন পদ্ধতি তিনি অনুসরণ করেন নাই। দৃশ্যমানতার একটি স্বাভাবিক পথ তিনি বেছে নিয়েছিলেন যেখানে রেখার শক্তি আলো-আঁধারের ইল্যুশনের প্রয়োজনীয়তা অনায়াসে নাকচ করে দেয়।
এখানে আবুল মনসুরের ‘রেখাঙ্কন ও জয়নুল আবেদিন’ শীর্ষক ক্ষুদ্রায়তনের একটি লেখার বরাত দেওয়া আবশ্যক [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ৩৯৩] একটি দ্বিমাত্রিক চিত্রের তলের ওপর ত্রিমাত্রিক একটি বস্তুকে ফুটিয়ে তোলার ব্যাপারটা বরাবরই শিল্পী-মানুষকে গুরুতর ঝামেলায় ফেলেছে। একেবারে রেনেসাঁ যুগে এসে পরিপ্রেক্ষিত, অস্থিসংস্থান, আলোছায়া, রং ইত্যাকার ব্যাপারগুলোর বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল রপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সমস্যা বরাবরই পীড়া দিয়েছে—বিশেষ করে পাশ্চাত্য সমাজে, যেখানে চক্ষুষ্মান বাস্তবকে অর্জনের একটি প্রবল আকাঙ্ক্ষা বিরাজিত ছিল।’
আমরা জানি বিলাতের বিখ্যাত শিল্পী ডেভিড হকনি তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে রেনেসাঁর শিল্পীর ক্যামেরা অবসকুরা ব্যবহার করে ইল্যুশন সৃষ্টির তুরীয় মাত্রা অর্জন করেছিলেন। ২০০১ সালে প্রকাশিত ‘Secret knowledge: Recovering the lost technique of the Old Masters’ গ্রন্থে হকনি এই যুগান্তকারী আবিষ্কার তুলে ধরেন, যা প্রমাণ করে যে পাশ্চাত্যের বাস্তবানুগ রীতি বা নেচারালিজম চিত্র রচনার ইতিহাসের অনুসরণ পরম্পরা যেমন বিচার্য, তেমন এটি ক্যামেরা আবিষ্কারের সাথেও জড়িত। অর্থাৎ পাশ্চাত্যের শিল্পীরা চোখের দেখা দুনিয়াকে হুবহু তুলে ধরবার তাগিদে বিজ্ঞানের দ্বারস্থ হয়েছেন। জয়নুল যখন ১৯৩২ সালে কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট ক্রাফ্ট কলেজে ভর্তি হবার সুযোগ পান, তখন তাঁর শিক্ষক মুকুল দে তাঁকে প্রাচ্যকলা বিভাগে পড়বার জন্য সুপারিশ করেন। জয়নুল প্রাচ্যকলা বেছে না নিয়ে পাশ্চাত্য নেচারালিজম আয়ত্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। অঙ্কনের পারদর্শিতার কারণে জয়নুল শিক্ষাজীবনেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যে ‘অসামান্য প্রতিভার পরিচয়’ তিনি তাঁর শিক্ষাকালীন সময়েই তুলে ধরতে পেরেছিলেন, তারই ফলে মুকুল দে ১৯৩৭ সালে জয়নুলকে ‘অস্থায়ী শিক্ষক’ হিসেবে নিয়োগ দেন [সূত্র: নজরুল ইসলাম, জয়নুল আবেদিন: তাঁর কাজ ও কথা, পৃ:২৯], শিল্প ইতিহাস লেখক নজরুল ইসলামের ভাষায় এটি ছিল একটি ‘বিশেষ ব্যবস্থা’। আমরা যোগ করতে পারি যে মুসলমান ঘরের ছেলের জন্য তৎকালীন কলকাতায় এটি একটি বিশেষ অর্জন বটে। তাঁর এই সাফল্যের পেছনে যে শৈল্পিক অর্জন, তা একাডেমিতে চর্চিত বাস্তববাদে সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠা-সংক্রান্ত। অর্থাৎ জয়নুল পাশ্চাত্যের একাডেমিকেন্দ্রিক ন্যাচারালিজম বা বাস্তববাদী ধারাটি আত্মস্থ করেছিলেন। তাঁর শিল্পী হয়ে ওঠার পিছনে এ ধরনের বাস্তববাদ মুখ্য ভূমিকা রেখেছে বললে সত্যের অপলাপ হয় না। কিন্তু জয়নুলের চিত্রভাষার ব্যাখ্যায় এই তথ্য যথেষ্ট নয়। কারণ, টোনের বিবিধতা, আলো-ছায়ার সুনির্দিষ্ট উপস্থাপনা তাঁর শিল্পীজীবনের কাজের চরিত্রের প্রেক্ষাপট নির্মাণে সহায়তা করেছে মাত্র, কিন্তু চিত্রভাষার মৌল চেহারা গড়ে উঠেছে রেখার শক্তির ভিত্তিতে। অর্থাৎ একাডেমির শিক্ষাকে জয়নুল ব্যবহার করেছেন নিজস্ব একটি ভাষা তৈরির তাগিদে। এই ভাষায় মানুষের বাস্তব দুনিয়ার অভিজ্ঞতার বাইরের কোনো অধিবিদ্যা, আধ্যাত্মিক অনুভূতি, কিংবা অস্পষ্ট বা অসংলগ্ন আত্মকথন জায়গা করে নেয় নাই।
জয়নুল প্রতীকবাদী নন, কল্পনাশ্রয়ীও নন, চিত্ররস সৃষ্টিতে চূড়ান্ত কোনো আদর্শ গ্রহণ করে নিয়ে তিনি তাঁর চিত্রভাষায় উপনীত হন নাই। তিনি শিল্পী হিসেবে ছিলেন বাস্তববাদী—অথচ অনুকৃতিধর্মিতার নিরিখে তাঁর শিল্পভাষা বিচার করা সম্ভব হবে না। সৃষ্টির আওতায় যে বাস্তব জগৎ তার প্রক্ষেপণ ও জয়নুলের ভাষার রসদ, কিন্তু বাস্তবের ইল্যুশন সৃষ্টির ভিত্তিতে যে সূক্ষ্ম চারুবৃত্তি, সেই ইয়ুরোপীয় বাস্তবানুগ অঙ্কন পদ্ধতি তিনি অনুসরণ করেন নাই
রবার্ট হিউজেস শিল্পী রেমব্রার ওপর একটি লেখায় এই ওলন্দাজ শিল্পীকে ‘commoisseur of ordinariness’বা ‘সাধারণ ঘটনাপ্রবাহের গ্রাহক’ আখ্যা দিয়েছিলেন। জয়নুলকেও একই আখ্যা দেওয়া চলে। রবার্ট হিউজেস আরও ব্যাখ্যা দিচ্ছেন যে, মানব অবয়ব বা মূর্তি তুলে ধরতে রেমব্রা কোনো প্রকার ‘মহৎ প্রতিকৃতি কিংবা ব্যক্তির মর্যাদা’ প্রকাশ করার চেষ্টা করেন নাই। [R.H. God of realism] জয়নুলও এমত ‘মহৎ’ ও ‘মর্যাদা’ রক্ষার ভাষার বিপরীতে দণ্ডায়মান শিল্পী।
ইউরোপে বারোকধারায় প্রতিকৃতি অঙ্কনের শিল্পী রেমব্রা যদি ছিলেন আদর্শায়িত শিল্প থেকে বাস্তববাদের যাত্রার শ্রেষ্ঠ পূর্বসূরিদের একজন, বাংলাদেশের তথা অবিভক্ত বাংলার শিল্প জয়নুল প্রাচ্যকলার আদর্শ থেকে শুরু করে পাশ্চাত্যের চিত্রকল্পের ‘অরা’ বা ‘আভা’কেন্দ্রিক সৃজনশীলতার বিপরীতে ‘প্রাত্যহিক জীবনের’ শিল্পী হিসেবে আবির্ভূত হন। এর সাথে আরও যে শব্দবন্ধ জড়িত করা সম্ভব, তা রেমব্রার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়—জয়নুল ‘সাধারণের সংগ্রাম’ তুলে ধরবার শিল্পী।
জয়নুল আধুনিক বাস্তববাদী শিল্পী হিসেবেই গ্রামীণ বিষয়কেও ঠিক প্রকৃতিকেন্দ্রিক রোমান্টিকতায় পর্যবসিত হতে দেন নাই। ইয়ুরোপে রোমান্টিকতার সূত্রেই বাস্তববাদের উত্থান, বিলাতি বেনিয়া শাসনের রাজধানী কলকাতায় যে রোমান্টিকতার চর্চা জয়নুল-পূর্ব সময়ে দেখা গেছে, তা যেমন উচ্চ রুচির সাথে সম্পর্কিত ছিল তেমন মার্গীয় চর্চা হিসেবে চর্চিত হয়েছিল। যদিও অবন ঠাকুরের ‘ভারত মাতা’ বঙ্গভঙ্গ রোধ ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মিছিলের প্ল্যাকার্ডে স্থান করে নিয়েছে, তথাপি আধুনিক বাস্তববাদ এমন আদর্শবাদিতার ও রুচির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। জয়নুল তাঁর বাস্তববাদের মধ্য দিয়ে আধুনিকতার সূচনা করে এই স্পষ্ট বিভাজন নির্মাণ করে দিয়েছিলেন বললে সত্যের অপলাপ হয় না।
এ পর্যায়ে আবার প্রথম প্রস্তাবে ফিরে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হলো। যদি শিল্পী জয়নুল আবেদিন অরা বা আভা-পরবর্তী শিল্পী হন—ইংরেজিতে যা pest a uratic শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করা যায়—তবে ধ্যান-জ্ঞান-যাপন—এই তিনকে তিনি একের আওতায় নিয়ে এসেছেন অনায়াসে। যে অগ্রজ শিল্পীরা জয়নুলের আবির্ভাবের আগেই কলকাতায় ‘পবিত্র’ ও ‘মহৎ’ বিষয়ের চর্চায় রত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ‘প্রাচ্যকলাবাদী’ হিসাবে খ্যাত, ‘বেঙ্গল স্কুলের’ প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সুপরিচিত, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শিল্পের আঙ্গিকে বা চিত্রভাষার প্রকাশের সূত্রসমূহে—অর্থাৎ রং, রেখা, অবয়বে উপস্থাপনার রঙ, এবং সর্বোপরি চিত্রভাষার ডৌল—শিল্পীর ধ্যান-জ্ঞান-যাপনের ছাপ পড়ে। আবার আদর্শবাদী চিত্রে এর কোনো রূপ আঁচড়-আকারায়ন লক্ষ করা যায় না। অবনীন্দ্রনাথের কাজ দ্বিতীয়প্রস্থ শিল্পের উচ্চারণ হতে পারে—যেখানে ধ্যান-জ্ঞান বিরাজে, কিন্তু যাপনের চিহ্ন নাই। যাপনের চিহ্ন বলতে এখানে প্রাত্যহিক, বাস্তব জীবনের অভিঘাত ধরে নেওয়া হলো—যার আকারায়ন চিত্রের মোটিফের বা অবয়বের মধ্যে না ফুটলেও রেখা ও রং প্রয়োগের মধ্যে অন্তত ফোটে। উদাহরণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাজ সামনে আনা যায়। যিনি ৬৩ বছর বয়সে ছবি আঁকা শুরু করেন। এবং তাঁর কাব্যকলার আদর্শায়িত পরিসর পেছনে ফেলে নিশ্চেতনার এমন স্তর থেকে তাঁর চিত্রকল্প গড়ে গেছেন, ফলে দিনযাপনের সূত্রে যে নানান মানসিক অভিঘাত মানুষের জীবনে পড়ে তা পাঠ করা যায়।
রবীন্দ্রনাথের অবয়বের পরিশীলন নাই, যেমনটা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরে লক্ষ করা যায়। রবীন্দ্রনাথে লৌকিক-অলৌকিক ও একত্রে উপস্থাপিত, ফলে বিশেষ কোনো পূত-পবিত্র মনোভাব প্রকাশ করবার কামনা ও লক্ষণীয় নয়, যেমনটা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিবের উপস্থাপনা থেকে শুরু করে বঙ্গমাতার মতো আদর্শিক অনুপ্রেরণায় সৃষ্ট মাস্টারপিসে দেখা যায়।
জালাল উদ্দিন আহমেদের ভাষায় জয়নুল তাঁর অগ্রজ ঐতিহ্য সন্ধানীদের ‘serene, soothing paintings’ থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ নতুন এক ‘বাস্তববাদী’ জগৎ তৈরি করেছেন। [Art in Pakistan, Jalal Uddin Ahmed, পৃষ্ঠা: ৬২]
অপরদিকে জয়নুলের সাথে তুলনা করলে রবীন্দ্রনাথের কাজে অভিব্যক্তির আতিশয্য ও বিবিধতা আছে। আরও আছে সাদৃশ্য থেকে ছুটি নিয়ে শিল্পীর হাতে রূপের ভাঙা-গড়া। অর্থাৎ পাশ্চাত্যের আধুনিক শিল্পীদের মতোই রবীন্দ্রনাথ চিত্রজ বিষয়কে বাস্তবে দেখা বিষয় থেকে আলাদা করে দেখেছেন। পাশ্চাত্যের আধুনিকদের সমান্তরালে রবীন্দ্রনাথ আদিম শিল্পের অভাবনীয় উদ্ভাবনী ক্ষমতায় বিশ্বাস এনেছেন, অনেক ক্ষেত্রে শিশুসুলভ প্রগলভতায় কিংবা বিংশ শতকে ঘটে যাওয়া ইয়ুরোপীয় প্রকাশবাদী ধারার অনুপ্রেরণায় নিজস্ব চিত্রকল্প প্রণয়ন করেছেন। রবীন্দ্রনাথের আবিষ্কারের নেশা তাঁকে আভা-গার্দ বা অগ্রগামী শিল্পী হিসেবে চিনতে সাহায্য করে।
জয়নুল এই অগ্রগামিতার বিধান ধর্তব্যে নেন নাই। রবীন্দ্রনাথের চিত্রে ও ‘আভা’র অনুপস্থিতি তাঁর কাজকে রোমান্টিকধারার বিপরীতে নতুন চিত্রভাষা হিসেবে চিনতে শেখায়, অথবা নব্য-রোমান্টিকতাবাদী হিসেবেও তাঁকে ডাকা যায়। কবির শিল্পী হয়ে উঠবার যে স্লোগান তাতে প্রাত্যহিকতা এসেছে মনোজগতের সূত্রে। ফলে পবিত্র প্রতীক না হয়েও চিত্রভাষা হয়েছে দেহাতীত, বা দেহ থেকে দূরের। অন্যদিকে জয়নুল মন-দেহ-চিত্র—এই তিন একই সূত্রে তুলে ধরবার প্রয়াসী ছিলেন। ফলে জয়নুলে দর্শকের আপন চোখের অভিজ্ঞতার সাথে শিল্পীর উপস্থাপিত বিষয়ের মাঝে করণকৌশলের যে চাতুরী, তা কোনো বিভেদ তৈরি করে না। অর্থাৎ, যা সাধারণের চোখে দেখা যায়, শিল্পীর উপস্থাপিত বিষয়ের মধ্যে দিয়ে তা-ই যেন হুবহু ধরা দিয়েছে—এ শিল্পীর কাজে ওমনটাই দৃশ্যমান হয়। জয়নুলের মনোযোগ আপন দেহ থেকে অন্য দেহের প্রতি। নিজের অবস্থান থেকে তাঁর নিকটতম জনের প্রতি। এই নিকটতম ‘অপর’কে তুলে ধরতে জয়নুল রেখাকে যত প্রাধান্য দিয়েছেন, রেখার ললিত রূপকে ততটা নয়, মানব সত্তাকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন মানব অবয়বের উপস্থাপনার কৌশল ও স্বতন্ত্র সৌন্দর্য ততটা না।
জয়নুল আবেদিনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কথাটির ব্যাখ্যা জরুরি হয়ে ওঠে। মানব অবয়ব উপস্থাপনের ক্ষেত্রে গ্রিক-রোমান ধারা, এমনকি রেনেসাঁর উদাহরণ শিল্পীদের আদর্শ শরীরমুখীন হতে অনুপ্রেরণা দেয়। পাশ্চাত্যে রোমান্টিক যুগের আগে কেবল ব্যতিক্রমী কিছু শিল্পীর চিত্রে মানব অবয়বের বাস্তব অবস্থা বা সত্তার উপস্থাপনা দেখা যায়, বারোকধারার শিল্পী রেমব্রার কথা বলা হলো। সেখানেও আকৃতি প্রকাশের সব কটি উপাদান বিদ্যমান ছিল—যেমন রেখা, রং, পরিসর এবং সংগঠন। যা রেমব্রাকে বাস্তবমুখীনতা দিয়েছে তা হলো ‘সাধারণ’ বিষয়কে সাধারণ হিসেবেই তুলে ধরবার প্রয়াস; মানুষকে তার বাস্তবতা থেকে আলাদা করে আদর্শ মোটিফ আকারে না দেখে সত্য অবস্থান থেকে দেখানোর চেষ্টা। জয়নুলেও আমরা এই বাস্তবতা নির্মাণের মধ্যে দিয়ে আদর্শ অবয়ব বিনির্মাণের ফলাফল আরও স্পষ্টতর হতে দেখি—লক্ষ করি, কী করে তিনি মানব অঙ্গের গঠন সৌষ্ঠবের চেয়ে তার বাস্তব অবস্থা জানান দিচ্ছেন। এই সূত্রে আমরা বলতে পারি, সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি, যে শিল্পী জয়নুলের মহত্ব তাঁর অভিজ্ঞতার জগৎকে মনোভঙ্গি বা ভাবনার কিংবা ভাবের জগৎ থেকে মুক্ত করে দেখানোর ক্ষমতানির্ভর। এই শিল্পীর মৌল অর্জন আদর্শ রূপ থেকে বাস্তব রূপে পৌঁছানোর কৌশলের মধ্যে বোঝা যাবে—পাঠ করা যাবে।
অবয়বের পরিবর্তন-পরিবর্ধন এমনকি বিমূর্তায়নের মধ্য দিয়ে যে আধুনিক শিল্পী হয়ে ওঠার তরিকা প্যারিসের শিল্পীদের মধ্যে প্রথম দেখা গেল, যা সারা বিশ্বের আধুনিক শিল্পীদের উদ্বুদ্ধ করল। জয়নুল এমন পথে খুব একটা পা বাড়ান নাই। ১৯৫২ সালে বিলাত থেকে ফিরে তিনি বেশ কিছু ছবিতে জ্যামিতির প্রয়োগে ফর্মের যে সংকোচন ও অবয়বের যেটুকু বিমানবিকীকরণে সম্ভব না, তা পরীক্ষা করে দেখেন। শিল্পী মুর্তজা বশীরের মতে, ‘বিদেশ ঘুরে আসার পর তাঁর চিত্রে দেখি পাশ্চাত্য ও এ দেশের লোকরীতির সমন্বয় ঘটাবার এক প্রয়াস। যা তখন আমাদের সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।’ [জয়নুল আবেদিন: কিছু স্মৃতি, মুর্তজা বশীর: মূর্ত ও বিমূর্ত, পৃ: ৯১২]। মুর্তজা বশীর মৃত্যুর আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, এ সময়ের জ্যামিতিনির্ভর কাজগুলোই তাঁর শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জয়নুল আবেদিনের একমাত্র আধুনিক কাজ। অর্থাৎ মুর্তজা বশীরের ভাষ্য অনুযায়ী জ্যামিতিক নির্ভরতা আধুনিকতার পরিমাপক।
জয়নুল মন-দেহ-চিত্র—এই তিন একই সূত্রে তুলে ধরবার প্রয়াসী ছিলেন। ফলে জয়নুলে দর্শকের আপন চোখের অভিজ্ঞতার সাথে শিল্পীর উপস্থাপিত বিষয়ের মাঝে করণকৌশলের যে চাতুরী, তা কোনো বিভেদ তৈরি করে না। অর্থাৎ, যা সাধারণের চোখে দেখা যায়, শিল্পীর উপস্থাপিত বিষয়ের মধ্যে দিয়ে তা-ই যেন হুবহু ধরা দিয়েছে—এ শিল্পীর কাজে ওমনটাই দৃশ্যমান হয়। জয়নুলের মনোযোগ আপন দেহ থেকে অন্য দেহের প্রতি। নিজের অবস্থান থেকে তাঁর নিকটতম জনের প্রতি
শিল্পী আমিনুল ইসলামের মধ্যেও একই মনোকাঠামোর ছায়া লক্ষ করা যায়। শেষ জীবনের এক সাক্ষাৎকারে তিনিও জ্যামিতিকে আধুনিক চিত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে দেখেছেন [শাওন আখন্দ, ডেপার্ট]।
জ্যামিতির প্রতি অনুরাগ কিউবিজম বা ঘনবাদের সূত্রে ঘটেছে দাবি করা যায়। ইঙ্গিতে বহির্জগৎ ও মনোজগৎ তুলে ধরবার আরও অনেক কৌশল ঘনবাদ শিখিয়েছে। সেগুলোর প্রয়োগের চেয়ে, বাংলাদেশের ‘আধুনিকতা’ নির্মাণে জ্যামিতির ভূমিকা মুখ্য করে তোলা হয়েছে। আলী আহসানের মতে, ‘যেকোনো উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্মের বিষয়ভিত্তিক আবেদন আছে আবার গঠন নির্মিতিগত আবেদন আছে।’ ফলে বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা, এবং তা কী উপায়ে শিল্পী উপস্থিত সত্তা হিসেবে গড়ে তুলছেন—এই দুই জরুরি ভাবনা। অর্থাৎ কন্টেন্ট ও ফর্ম—দুয়ে মিলেই শিল্প।
জয়নুল আবেদিনের ছবিতে ফর্মের সহজতা আছে, এমনকি জ্যামিতি ব্যবহার করেও তিনি চিত্রে মানব-মানবীর উপস্থিতিকেই ধরতে চেয়েছেন বলে মনে হয়। অর্থাৎ ফর্মের কৌশলকে কেবল কৌশল হিসেবেই আয়ত্ত করেছেন। একে শিল্পের চরিত্র [যা জয়নুলের ক্ষেত্রে বাস্তববাদী বা বাস্তবমুখীন] নির্ধারণে ব্যবহার করেন নাই। ঘনবাদের বিমানবিকীকরণ প্রক্রিয়া জয়নুলে লক্ষ করা যায় না। জালাল উদ্দিন আহমেদের বরাত দিয়ে বলা যায় যে, জয়নুলের তরুণ ছাত্ররা ঘনবাদের অনুপ্রাণিত হয়ে আধুনিক জীবনের টানাপোড়েন তুলে ধরতে উদ্যোগী হয়েছিলেন [প্রাগুক্ত, পৃ: ৬২], এই প্রকৃতিতেই জয়নুল প্রবেশ করেন নাই। তবে তাঁকেও কন্টেন্ট বা বিষয়বস্তু ধরবার জন্য ফর্ম গড়ে নিতে হয়েছে—অর্থাৎ তাঁর কৌশলকে কেবল ‘বাস্তববাদ’ বলে আখ্যা দিলে সম্পূর্ণ বলা হয় না।
জয়নুলের বাস্তববাদ রেখার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে—এটি প্রথম প্রস্তাব। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ভাষায়, ‘জয়নুলের পেইন্টিং হচ্ছে আন্তঃসম্পর্কিত ব্রাশস্ট্রোকের কাজ…তাঁর ব্রাশস্ট্রোক অনেকটাই বর্ণনামূলক নয়। সামগ্রিকভাবে তাঁর ব্রাশের দাগ পেইন্টিংয়ের কাঠামো তৈরি করে।’ এই স্তবকের শেষ কথাটি প্রণিধানযোগ্য, ‘…ব্রাশস্ট্রোক তাঁর আবেগ প্রকাশের মাধ্যম।’ [বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, জয়নুল আবেদিনের জিজ্ঞাসা, পৃ: ২০]। অর্থাৎ জয়নুলের আঙ্গিক নির্মাণে যেমন রেখা মুখ্য ভূমিকা রাখছে, তেমন এর চরিত্র—যা সৈয়দ আলী আহসানের ভাষায় ‘রুক্ষ’ এবং ‘মেজাজি’—চিত্রপটের শিল্পীর আবেগকে ধারণ করতে সক্ষম। ফলে জয়নুলের রেখা স্বআবিষ্কৃত, স্বতঃস্ফূর্ত উপায়ে অর্জিত রেখা—একাডেমির বিদ্যায় এর বিপরীতে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিজাত রেখার ব্যবহার লক্ষণীয়। জয়নুলে রেখার সৃষ্টিশীলতায় তাঁর আধুনিকতার প্রথম নমুনা বা আলামত খেয়াল করা জরুরি।
এই রেখার সবচেয়ে সবল প্রয়োগ প্রথম দেখা যায় শিল্পাচার্যের আঁকা তেতাল্লিশের মন্বন্তরের চিত্রমালায়—যেখানে রেখাই একমাত্র বাহন, আবেগের ও বোধের। চিত্রের সার্বিক গুণাগুণ পাশ কাটিয়ে, জমিনকে ফাঁকা করে দিয়ে, বাস্তববাদী রচনাশৈলীর যে উদাহরণ জয়নুল সৃষ্টি করলেন, তা ছিল অভূতপূর্ব ও যুগান্তকারী। এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত থেকেই ময়মনসিংহের কৃষিভিত্তিক সমাজের এক মানবিক প্রতিনিধি কলকাতা শহরের ফুটপাত ও রাস্তায় ঘটে যাওয়া মানব-বিপর্যয়ের দৃশ্য এঁকে বাস্তববাদকে আধুনিক পর্যায়ে উন্নীত করবার প্রয়াস পেলেন।
জয়নুল তাঁর মন্বন্তরের চিত্রে দৃঢ়তায় ও দ্রুততায় ধরে রাখা ক্ষীয়মান, ক্ষুধার্ত মানুষদের এঁকে রেখে কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক দায়িত্ব পালন করলেন কি না, তারও চেয়ে অধিক মনোযোগের সাথে যা বিবেচনা করা জরুরি তা হলো, চিত্র হিসেবে এই বিপর্যয়ের আখ্যান কী করে ‘মানবিক’ মাত্রাটি অর্জন করেছে। শিল্পী প্রচলিত প্লাস্টিক ইকুইভ্যালেন্সি বা সমা-পরিবৃত্তি বর্জন করেছেন। তিনি রেখা, রং, পরিসর এবং সংগঠনের ‘সুষম সংবেদনে সমন্বিত করবার’ আয়োজন থেকে দূরে সরে গেছেন [‘সুষম সংবেদনে সমন্বিত’ ধারণাটি সৈয়দ আলী আহসানের, প্রাগুক্ত পৃ: ১৪]। আধুনিক শিল্পীদের মতোই বাস্তববাদী জয়নুল এখানে সংকোচনবাদী—অর্থাৎ তিনি চিত্রজ বিষয় থেকে বিয়োজনের মধ্যে দিয়ে চিত্র রচনায় ব্রতী। তিনি রং, প্লাস্টিক বা চিত্রজ উপাদানসমূহের উপস্থিতিতে যে অঙ্গসৌষ্ঠব গড়ে ওঠে তা পরিহার করে কেবল দৃঢ় রেখার কাঠামো দিয়ে মানবমূর্তির সূরাহা করলেন। এটি বৈপ্লবিক এক পদক্ষেপ। এ যেন বাস্তব বা সত্যকে তুলে ধরার জন্য গাছকে পাতার সৌন্দর্য ব্যতিরেকে কেবল কান্ড দিয়ে চিহ্নিত করা। এখানে স্টাইল তৈরির বিষয়টি অনুপস্থিত, যদিও রেখার টানে শিল্পীর আপন একটি চরিত্র গড়ে ওঠে। এ কারণেই তাঁর কাজ অঙ্গসৌষ্ঠবের বিপরীতে সত্য-দর্শনের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে। কবি নজরুল ইসলামের মতোই জয়নুল সুন্দরকে সত্যের মধ্যে দেখেছেন—এইখানে তিনি নৈতিকতার রাস্তায় হাঁটছেন। এই একটি কারণেই তাঁর আধুনিকতা সাহিত্য আন্দোলনের নিরিখে প্রকৃতিমুখীন রোমান্টিকতা থেকে বাস্তববাদিতায় পদার্পণের ঐতিহাসিক মুহূর্তের আধুনিকতা বলে আখ্যা দেওয়া চলে। অর্থাৎ জয়নুল বাস্তববাদী আধুনিক। বাস্তববাদী আধুনিকদের কাছে যেমন শ্রেণি ও সমাজ বাস্তবতা বড় হয়ে দেখা দেয়, তেমন তাঁর বিশেষ বিশেষ কাজে এই দুটি বিষয়ের প্রনোদনা লক্ষ করা যায়।
মানব বিপর্যয়ের চিত্রেই জয়নুল সবচেয়ে শক্তিশালী শিল্পী হিসেবে আবির্ভূত। যেমন তাঁর দীর্ঘতম চিত্র ‘মনপুরা’ [১৯৭০] প্রকৃতির আঘাতে কাবু মানুষের বিহ্বল চেহারা তুলে ধরে। সংগ্রামী মানুষ তুলে ধরতেও জয়নুল রেখার সচ্ছলতা এমন এক বাস্তববাদী নান্দনিকতায় ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন, যেন ললিত ভাব প্রকাশ না পেয়ে প্রাত্যহিকতার সৌন্দর্যই প্রাধান্য পায়। মই দেওয়া বা বিদ্রোহ শিরোনামের শক্তি, যা তিনি কয়েকবার এঁকেছেন। শিল্পী গাভিকে শক্তির প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। এমন বাস্তব বিষয়কে প্রতীক হিসেবে হাজির করা বাস্তববাদী আধুনিকতার সেরা উদাহরণ।
রেখার ললিত ব্যবহারের উদাহরণ জয়নুলের সামনে ছিল, কিন্তু রেখার কাব্যময়তা বিসর্জন দিয়ে গদ্যভাব ধারণ করবার সাহস একমাত্র জয়নুলের কাজেই দেখা গেল। মানব বিপর্যয়ের সাক্ষী হিসেবে যে আর কোনো শিল্পী তাঁর পাশে ছিলেন না, এমন নয়। চিত্তপ্রসাদ ছিলেন। এবং সোমনাথ হোরকে বিংশ শতকের পুঁজিবাদের আওতায় সমাজের দ্রুত বিবর্তন ও এর কুফলে চোখ রেখে সারা জীবন ছবি আঁকতে দেখা গেছে। কিন্তু জয়নুলের প্রায় সমবয়সী চিত্তপ্রসাদ এবং অনুজ সোমনাথ হোর দুজনই মানব অবয়বকে খালি চোখে দেখা মূর্তি থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছেন। মনোজগৎ ও ইহজাগতিক গ্লানি তাদের দুজনের কাজে দুই চেহারা পেয়েছে কিন্তু দুজনেরই নিজস্বতা তৈরির আয়োজন আছে। অবশ্যই সোমনাথের কাজে পারি নগরের বৈপ্লবিক আভাগার্দের অ বিভাজনকে ধর্তব্যে নিয়ে আপন ভাষা গড়ে তুলবার আয়োজন আছে।
এদের বিপরীতে জয়নুল সাহিত্যের আধুনিক বাস্তববাদীধারার সাথে অধিক তুলনীয়। কারণ তাঁর কাজে, বিশেষত যে কাজগুলোতে এ আলোচনায় মনোযোগ দেওয়া হলো বাস্তব রূপে দেখার প্রাথমিক কিছু সূত্রের নিশানা আছে। ত্রিমাত্রিক যে ছবি চোখে দেখা যায়, তাকে দ্বিমাত্রিক চিত্রতলে সাজিয়ে তোলা একটি অসম্ভব প্রকল্প। ইউরোপীয় রেনেসাঁর শিল্পীরা এটি অর্জন করতে গিয়ে পরিপ্রেক্ষিতসহ বিজ্ঞানের নানান আবিষ্কারের দ্বারস্থ হয়েছেন। জয়নুল এর বিপরীতে বাস্তববাদী হয়ে উঠতে নেচারালিজম বা অনুকৃতিবাদিতার ধারণা থেকে নিজেকে বিযুক্ত করেছেন; গড়ে তুলেছেন সত্য ধরবার কাঠামো, যার ভিত্তি ঋজু রেখার প্রাঞ্জল ব্যবহার।
পরিশেষে শিল্পাচার্যের বাস্তববাদিতার এই নিরেট ও কঠিন [অর্থাৎ লালিত্যবর্জিত] পন্থা খুঁজে পাবার প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে। কলকাতায় শিল্প-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন জয়নুলের শিক্ষানবিশি পর্ব চলছে, তখন অনুকৃতিবাদের আওতায় কনটুর ড্রয়িং বা রেখার আবর্তে অবয়ব আঁকবার বিদ্যা তিনি অর্জন করেন। কিন্তু শুধু রেখা দিয়ে নগ্ন চিত্রতলে মানুষের উপস্থাপনা যে পূর্ণাঙ্গ চিত্র হতে পারে, তার সূত্রের সন্ধান করতে আমরা দুটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিতে পারি। ১৯৪০ সালে কলকাতায় চীনা শিল্পী সু বেহং-এর আবির্ভাব ঘটে। দুই বছর শান্তিনিকেতনে অবস্থান করে এই শিল্পী কলকাতায় একটি একক প্রদর্শনী করেন যেখানে তাঁর তুলির আঁচড়ে গড়া ঘোড়ার অনেক কয়টি চিত্র দর্শকদের দেখার সৌভাগ্য হয়। বলা বাহুল্য যে, এই শিল্পী ঘোড়া অঙ্কনের জন্য ছিলেন জগদ্বিখ্যাত। [ রিত্বিজ ভৌমিক, সু বেহং এবং ইন্ডিয়া: International Journal of Art, Humanity and Management Studies, Vol: 01, No. 4, April 2015, p. 65) ধারণা করা যায় যে, শিল্পী জয়নুল, যিনি তত দিনে শিল্পশিক্ষা শেষ করে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছেন, এই প্রদর্শনী দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং চৈনিক চিত্রভাষার হাজার বছরের অর্জন সেনসুই-গার ধ্যানি অথচ চরম সংকোচনবাদী তুলি চালনার ফল আপন চোখে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
জয়নুলের চিত্রভাষায় রেখার কঠোরতা ও এর লাগসই ব্যবহারের দিকে নজর দিয়ে আরও একটি দিক বিবেচনায় নেওয়া দরকার। জয়নুল ছাত্র থাকাকালীন থেকেই উপার্জন করবার তাগিদ অনুভব করেন। কারণ, তিনি পূর্ববঙ্গের সাধারণ ঘরের সন্তান। পত্রপত্রিকায় ছবি এঁকে তিনি রোজগারের উপায় বের করেছিলেন। আমরা যাকে বলি ইলাস্ট্রেশন, তা সে সময়ে কাঠের ব্লকে খোদাই করে তারপর ছাপা হতো। ফলে শিল্পীদের সাদা-কালোর কন্ট্রাস্ট বা বৈপরীত্বের ভিত্তিতে চিত্র তৈরি করতে হতো, অথবা রেখাচিত্র জমা দিতে হতো। বাংলাদেশ জাদুঘরে সংরক্ষিত কাজের মধ্যে জয়নুলের এমন পত্রপত্রিকার জন্য আঁকা আলো-ছায়া নির্ভর কিছু কাজ পাওয়া যায়, যা দেখে অনুমান করা যায় যে রেখা অবলম্বনে সিদ্ধহস্ত শিল্পী মিল্লাতের ঈদসংখ্যা বা মুসলিম পাঠকদের জন্য ততকালীন সাময়িকীগুলোতে কাজ করতে গিয়ে সাদা-কালোর শক্তি বিষয়ে সজাগ হয়েছেন। এই দ্বিতীয় সূত্রেও হতে পারে তিনি তাঁর রেখার শক্তি প্রয়োগের সাহস পেয়েছেন।
মনে রাখা জরুরি, জয়নুল রেখা, জলরঙের তুলিতে আঁকা রেখা নয়। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, জয়নুলের রেখা মূলত তেল-রঙের ব্রাশে কালি চুবিয়ে আঁকবার স্বাধীনতাকে নানামাত্রায় ব্যবহার করার ক্ষমতা প্রসূত রেখা। মূর্তজা বশীরের বয়ান অনুসারে শক্ত হয়ে যাওয়া জলরঙের তুলি ব্যবহার উপযোগী করে তুলে জয়নুল দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা এঁকেছেন। এ কারণে এখানেও রেখা ঋজু এবং অললিত অথচ জঙ্গম। এর ব্যতিক্রম শুধু লক্ষ করা আয় তাঁর জ্যামিতির ছক তৈরি করে আঁকা পঞ্চাশ দশকের শুরুর কাজগুলোতে।
উপসংহার
তিন পথিকৃৎ বলে পরিচিত—জয়নুল, কামরুল ও সুলতান—বোরহানউদ্দিন খানের বিচারে ‘দেশজ আধুনিকতার’ প্রবর্তক। তিন শিল্পী তিন উপায়ে সমাজের সাথে চিত্রতলের যোগাযোগ তৈরির পরিপ্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছেন, নিজ নিজ উপায় অবলম্বন করে। এখানে মনোকাঠামো বা শিল্পীর অবস্থানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর মনে করেন, ‘আবেদিনের যাত্রাবিন্দু হচ্ছে শ্রেণি সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের মধ্যকার আন্তসম্পর্ক’, আমরা এর সাথে যোগ করতে পারি যে শিল্পী জয়নুল এ কারণেই যে বিষয়সমূহ থেকে শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত চোখ ফিরিয়ে নিতে চায়, সেই বিষয়ের দিকে একপ্রকার সহজ দৃষ্টিপাতের সূত্রে এই আন্তসম্পর্কের দিকটির সুরাহা করে গেছেন। গ্রাম-বাংলার নারী-পুরুষের জীবনসংগ্রামও একই কারণে তাঁর ছবির বিষয় হয়ে ওঠে। এই শিল্পী যখন সৌন্দর্য তুলে ধরেন, তখনো নিসর্গকে পূজনীয় করে তুলে শহরের মানুষের রোমান্টিকতা জাগানিয়া চিত্র রচনা করেন না। তিনি গোষ্ঠীর একজন হিসেবে আপনকে আপন হিসেবে উপস্থাপন করেন মাত্র। এমন সর্বজনীন দেখার ও দেখাবার ক্ষমতার সূত্রেই জয়নুল মহান শিল্পী।
আধুনিকতার পাশ্চাত্য ধারণা ও রুচিবোধ গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে জয়নুল তাঁর বাস্তববাদিতায় উপনীত হয়েছেন। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ধারণাপ্রসূত যে রাজনীতি ও সমাজবীক্ষণ, তা তাঁকে আন্দোলিত করেছে। কলকাতায় সমাজবিপ্লবের ধারণার প্রভাবে সৃষ্টি হওয়া সাহিত্য, নাটক, কবিতা কিংবা সাংস্কৃতিক আন্দোলন তাঁর চলার পথের পাথেয় হয়েছে। কিন্তু তিনি পূর্ববঙ্গের কৃষিভিত্তিক সমাজের লৌকিকতা ও মানবকেন্দ্রিকতা থেকে কখনোই সরে আসেননি। মুখের জবানেও তিনি তাঁর জন্মস্থান ময়মনসিংহের আঞ্চলিক সুর কখনো ত্যাগ করেননি। জয়নুলের বাস্তববাদী আধুনিকতাকে এ কারণে আঞ্চলিক বা স্থানিক আধুনিকতা হিসেবেও ব্যাখ্যা করা চলে।