দস্তইয়েফস্কি এবং তাঁর অপরাধ ও শাস্তি
দস্তইয়েফস্কি
ফিওদর দস্তইয়েফস্কি সম্পর্কে আমার অবস্থান অদ্ভুত ও জটিল। সব ক্লাসে আমি সাহিত্য নিয়ে কথা বলি একটামাত্র দৃষ্টিকোণ থেকে; সেটা এই যে সাহিত্য একটা দীর্ঘজীবী শিল্প এবং ব্যক্তিগত প্রতিভার বিষয়; সাহিত্যের শুধু এই বৈশিষ্ট্যই আমার আগ্রহের বিষয়।
সাহিত্য একটা দীর্ঘজীবী শিল্প এবং ব্যক্তিগত প্রতিভার বিষয়—এই দৃষ্টিকোণ থেকে দস্তইয়েফস্কি বড় লেখক নন, বরং মাঝারি গোছের একজন। তাঁর মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ চমৎকার হাস্যরসের ঝলক দেখা যায় বটে, কিন্তু হায়, সেসবের মধ্যে থাকে সাহিত্যের মামুলি জিনিসপত্রের পোড়ো জমি।
তাঁর অপরাধ ও শাস্তি উপন্যাসে রাসকোলনিকভ কোনো এক কারণে এক বৃদ্ধা বন্ধক-কারবারি ও তার বোনকে হত্যা করে। নাছোড়বান্দা এক পুলিশ অফিসারের রূপ নিয়ে বিচারব্যবস্থা ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করে; অবশেষে সে প্রকাশ্যে স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য হয় এবং এক অভিজাত বারবনিতার ভালোবাসার মধ্য দিয়ে তাকে আত্মিক পুনর্জন্ম দান করা হয়, যা ১৮৬৬ সালে বইটি লেখার সময়ের পক্ষে অবিশ্বাস্য রকমের গৎবাঁধা মনে হয়; যেমনটি মনে হয় এখনো, যখন অভিজ্ঞ পাঠক অভিজাত পতিতাদের খানিকটা সংশয়ের সঙ্গে দেখেন। কিন্তু আমার সমস্যা হলো, আমি আমার ক্লাসগুলোতে যেসব পাঠকের সঙ্গে কথা বলি, তাঁদের সবাই অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ নন। আমি তো বলব, তাঁদের এক-তৃতীয়াংশই জানেন না প্রকৃত সাহিত্য ও ছদ্ম সাহিত্যের মধ্যে পার্থকী কী; এই ধরনের পাঠকের কাছে আমেরিকান ঐতিহাসিক উপন্যাস, কিংবা ফ্রম হিয়ার টু ইটারনিটি ও এই ধরনের অনর্থক জিনিসের চেয়ে দস্তইয়েফস্কিকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও বেশি শৈল্পিক মনে হতে পারে।
যাহোক, আমি কয়েকজন প্রকৃত বড় শিল্পী সম্পর্কে বিশদভাবে কথা বলব; এমন উচ্চ অবস্থান থেকেই দস্তইয়েফস্কিকে বিচার করা উচিত। আমি একেবারেই একাডেমিক ধরনের অধ্যাপক নই, নিজের অপছন্দের বিষয় পড়াতে পারি না। আমি দস্তইয়েফস্কিকে খোলসমুক্ত করতে ভীষণভাবে চাই, কিন্তু বুঝতে পারছি, যেসব পাঠক বেশি পড়েননি, তাঁরা আমার মূল্যায়নে হতবুদ্ধি হয়ে পড়তে পারেন।
ফিওদর দস্তইয়েফস্কির জন্ম ১৮২১ সালে, বেশ দরিদ্র এক ব্যক্তির পরিবারে। তাঁর বাবা মস্কোর এক সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন; সেই সময়ের রাশিয়ায় সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকের পদ ছিল ছোটখাটো ব্যাপার; দস্তইয়েফস্কি পরিবার বাস করত ওই হাসপাতালের সংকীর্ণ কোয়ার্টারে, এমন পরিবেশে, যেটাকে আর যা-ই হোক, কোনোভাবেই বিলাসী কিছু বলা যায় না।
দস্তইয়েফস্কির বাবা ছিলেন ছোটখাটো একজন স্বৈরাচারী, তিনি রহস্যময় পরিস্থিতিতে খুন হয়েছিলেন। দস্তইয়েফস্কির সাহিত্যকর্ম নিয়ে ফ্রয়েডীয় মানসিকতার অনুসন্ধানকারীদের মধ্যে ব্রাদার্স কারামাজভ উপন্যাসে বাবার হত্যার বিষয়ে ইভান কারামাজভের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি আত্মজৈবনিক দিক খুঁজে পাওয়ার ঝোঁক আছে। তাঁরা মনে করেন, ইভান যদিও প্রকৃত হত্যাকারী ছিল না, তবু তার শিথিল বা অসতর্ক স্বভাবের কারণে, যে হত্যাকাণ্ড সে ঠেকাতে পারত কিন্তু ঠেকায়নি বলে, সে একভাবে পিতৃহত্যার জন্য দায়ী। এই সমালোচকদের মত অনুসারে মনে হয়, দস্তইয়েফস্কির বাবা তাঁর ঘোড়াগাড়ির কোচোয়ানের হাতে খুন হওয়ার পর থেকে দস্তইয়েফস্কি নিজেও সারা জীবন ধরে একই ধরনের পরোক্ষ অপরাধবোধের যন্ত্রণা ভোগ করে গেছেন। কিন্তু যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে দস্তইয়েফস্কির স্নায়বিক সমস্যা ছিল, অল্প বয়স থেকেই তিনি মৃগী নামের এক রহস্যময় ব্যাধির শিকার ছিলেন। মৃগীর আক্রমণ ও সাধারণ স্নায়বিক সমস্যা পরবর্তীকালে তাঁর বাবার দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির প্রভাবে বেশ বেড়ে গিয়েছিল।
দস্তইয়েফস্কি প্রথমে শিক্ষা গ্রহণ করেন মস্কোর এক বোর্ডিং স্কুলে, তারপর পিতেরবুর্গের সামরিক প্রকৌশল বিদ্যালয়ে। সামরিক প্রকৌশলবিদ্যার প্রতি তাঁর বিশেষ কোনো আগ্রহ ছিল না, তাঁকে সেখানে ভর্তি হতে হয়েছিল তাঁর আবার আগ্রহের কারণে। কিন্তু সেখানে তিনি প্রকৌশলবিদ্যার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেছেন সাহিত্য পড়ায়। সামরিক প্রকৌশল বিদ্যালয় থেকে বেরোনোর পর তিনি প্রকৌশল বিভাগে চাকরি করেছেন ঠিক ততটা সময়, যতটা করা ওই শিক্ষা লাভের বিনিময়ে বাধ্যতামূলক ছিল। ১৮৪৪ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর প্রথম বই অভাজন [বেদনিয়ে ল্যুদি, ১৮৪৬] সাহিত্যসমালোচক ও সাধারণ পাঠক মহলে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। এই বইয়ের প্রথম দিকের ইতিহাস নিয়ে নানা রকমের গল্পগুজব চালু আছে। দস্তইয়েফস্কির বন্ধু দিমিত্রি গ্রিগরোভিচ, যিনি নিজেও একজন লেখক ছিলেন, তিনি তাঁকে বইটির পাণ্ডুলিপি নিকোলাই নেক্রাসভকে দেখাতে রাজি করিয়েছিলেন; নেক্রাসভ তখন ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী সাহিত্য পত্রিকা সাভ্রিমেন্নিক-এর [সমসাময়িক] প্রকাশক। তিনি ও তাঁর নারী বন্ধু আভদোতিয়া পানায়েভা পত্রিকাটির দপ্তরে একটি সাহিত্য বাসর পরিচালনা করতেন; সেখানে সেই সময়ের রুশ সাহিত্যের প্রায় সব কৃতী কবি-লেখকের সমাগম ঘটত। তুর্গেনিভ ও পরের দিকে তলস্তয় সে আসরের নিয়মিত সদস্য ছিলেন। বামপন্থী সাহিত্যসমালোচক নিকোলাই চেরনিশেফস্কি এবং নিকোলাই দাব্রোলুবভও সেখানে নিয়মিত যেতেন। নেক্রাসভের ওই পত্রিকায় লেখা ছাপা হওয়া যেকোনো লেখকের সাহিত্যিক খ্যাতি অর্জনের জন্য যথেষ্ট ছিল। সেই নেক্রাসভের কাছে অভাজন-এর পাণ্ডুলিপিটি রেখে এসে দস্তইয়েফস্কি ঘুমাতে যান সম্পূর্ণভাবে ভুল একটা অনুমান নিয়ে: শুয়ে শুয়ে তিনি আপনমনে বলেছিলেন, ‘ওরা আমার অভাজন নিয়ে হাসাহাসি করবে।’
ভোর চারটায় দস্তইয়েফস্কির ঘুম ভেঙে যায় নেক্রাসভ ও গ্রিগরোভিচের ডাকাডাকিতে; তাঁরা তাঁর ফ্ল্যাটে ঢোকেন বিস্ফোরণের মতো, তারপর রুশি কায়দায় তাঁকে চুমুতে ভাসিয়ে দেন। তাঁরা পাণ্ডুলিপিটি পড়া শুরু করেছিলেন আগের দিন সন্ধ্যার পর; পড়া শেষ না করে থামতে পারেননি। লেখাটা তাঁদের এতই পছন্দ হয়েছিল যে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ওই মুহূর্তেই লেখককে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানাবেন। তাঁরা পরস্পরকে বলেছিলেন, ‘সে ঘুমাচ্ছে তো কী হয়েছে? এটা ঘুমের চেয়ে অনেক বড় ব্যাপার।’
তারপর নেক্রাসভ সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে যান বেলিনস্কির কাছে, ঘোষণা করেন যে এক নতুন গোগলের জন্ম হয়েছে। তাঁর কথা শুনে বেলিনস্কি শুকনো কণ্ঠে বলেন, ‘আপনাদের ওখানে তো ব্যাঙের ছাতার মতো গোগলেরা গজাচ্ছে!’ কিন্তু অভাজন পড়ার পর বেলিনস্কির ভালো লাগার সীমা থাকে না; তিনি সঙ্গে সঙ্গে নতুন লেখকটির সঙ্গে পরিচিত হতে চান এবং তাঁকে অনুপ্রেরণামূলক প্রশংসায় ভাসিয়ে দেন। অভাজন নেক্রাসভের পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই সাফল্য বেশি দিন স্থায়ী হয় না। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস বা লম্বা গল্প দ্য ডাবল [দ্ভোইনিক, ১৮৪৬], যা তাঁর সারা জীবনের সমস্ত লেখার মধ্যে সেরা এবং নিঃসন্দেহে অভাজন-এর চেয়ে অনেক উৎকৃষ্ট জিনিস, তা প্রকাশিত হলে কোথাও কোনো সাড়াই পড়ে না, বরং উপন্যাসটি উপেক্ষার শিকার হয়। কিন্তু ইতিমধ্যে দস্তইয়েফস্কির মনে ভীষণ সাহিত্যিক অহমিকা তৈরি হয়, আর তিনি সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন বলে, কেতাদুরস্ত ছিলেন না বলে, নতুন পাওয়া বন্ধুবান্ধব ও ভক্তদের সামনে বোকাটে সাজার কৌশল নিয়ে তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক একদম নষ্ট করে ফেলেন। তুর্গেনিভ তাঁর নাম দেন রুশ সাহিত্যের নাকে এক নতুন ফুসকুড়ি।
তাঁর প্রথম দিকের ঝোঁক ছিল সেই সময়ের র্যাডিক্যালদের পক্ষে: তিনি কমবেশি পাশ্চাত্যপন্থীদের দিকেই ঝুঁকেছিলেন। তরুণদের এক গুপ্তসংঘেও ভিড়েছিলেন [কিন্তু স্পষ্টতই সেটার সদস্য হননি], যাঁরা সাঁ সিমো ও ফুরিয়্যের সমাজতান্ত্রিক তত্ত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ওই তরুণেরা মিখাইল পেত্রাশেফস্কি নামে সরকারের পররাষ্ট্র বিভাগের এক কর্মকর্তার বাড়িতে মিলিত হতেন, ফুরিয়্যের লেখা বইগুলো উচ্চ স্বরে পড়ে পরস্পরকে শোনাতেন, সমাজতন্ত্র নিয়ে আলোচনা করতেন আর সরকারের সমালোচনা করতেন। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে ১৮৪৮ সালের রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের পর রাশিয়ায় প্রতিক্রিয়াশীলতার ঢেউ বয়ে গিয়েছিল; সরকার ভয় পেয়ে গিয়েছিল; সব শ্রেণির ভিন্নমতাবলম্বীর ওপর দমনপীড়ন চালাচ্ছিল। পেত্রাশেফ্স্কি সংঘের সদস্যরা একপর্যায়ে গ্রেপ্তার হয়ে যান [১৮৪৯], তাঁদের মধ্যে দস্তইয়েফস্কিও ছিলেন। তাঁকে ‘ফৌজদারি অপরাধের ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ, অর্থডক্স চার্চ ও রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার বিরুদ্ধে উদ্ধত, অবজ্ঞাপূর্ণ ভাষায় লেখা বেলিনস্কির চিঠি [গোগলকে] বিতরণ এবং একটি বেসরকারি ছাপাখানার সহযোগিতায় সরকারবিরোধী লেখাপত্র প্রচারের উদ্যোগে অন্যদের সঙ্গে অংশ নেওয়ার’ অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। গ্রেপ্তার হয়ে তিনি বিচারের অপেক্ষায় হাজত খাটছিলেন পিটার অ্যান্ড পল দুর্গে [কারাগার], সেটার কমান্ডার ছিলেন জনৈক জেনারেল নাবোকভ, আমার একজন পূর্বপুরুষ [জার সম্রাট প্রথম নিকোলাই ও জেনারেল নাবোকভের মধ্যে তাঁদের এই কয়েদির বিষয়ে যেসব পত্র চালাচালি হয়েছিল, সেগুলো পড়তে বেশ মজার]। দণ্ড হয়েছিল কঠোর—সাইবেরিয়ায় আট বছর সশ্রম কারাদণ্ড [পরে জার দণ্ড কমিয়ে করেছিলেন চার বছর]। কিন্তু আসামিদের সত্যিকারের দণ্ডাদেশটি পড়ে শোনানোর আগে এক ভয়ংকর নিষ্ঠুর কার্যপ্রণালি অনুসরণ করা হয়। তাদের বলা হয় যে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে গুলি করে; সেই কার্য সম্পাদনের জন্য তাদের নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়; তাদের পরনের জামার ওপরের সব পোশাক খুলে নেওয়া হয়; তারপর তাদের নির্দিষ্ট খুঁটিগুলোর সঙ্গে বেঁধে ফেলা হয়। তারপরই শুধু সত্যিকারের দণ্ডাদেশটি তাদের পড়ে শোনানো হয়। সেটা শুনে তাদের একজন উন্মাদ হয়ে যায়। সেদিনের সেই অভিজ্ঞতা দস্তইয়েফস্কির অন্তরে এক গভীর ক্ষত রেখে যায়। তিনি আর কোনো দিন সেই ক্ষত থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাননি।
দস্তইয়েফস্কি চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেন সাইবেরিয়ায়, খুনি আর চোর-ডাকাতদের সঙ্গে; তখন পর্যন্ত সাধারণ অপরাধী ও রাজবন্দীদের মধ্যে কোনো শ্রেণিবিভাজন ছিল না। তিনি সেই চার বছরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন তাঁর মৃত্যুপুরীর কড়চা [জাপিস্কি ইজ মিওর্তাভাভা দোমা/ নোটস ফ্রম ডেড হাউস, ১৮৬২] নামের স্মৃতিচারণমূলক উপন্যাসে। বইটি পড়তে মোটেও প্রীতিকর নয়। চারটি বছর ধরে তিনি যত অপমান আর কষ্ট-দুর্ভোগ সয়েছেন, তার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন বইটিতে, বিশদভাবে লিখেছেন সেই সব অপরাধীর কথাও, যাদের সঙ্গে তিনি সেখানে বাস করেছেন। ওই পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণভাবে পাগল হয়ে যাওয়া এড়াতে দস্তইয়েফস্কিকে কোনো না কোনো ধরনের পলায়ন খুঁজে পেতে হয়েছিল। সেটা তিনি পেয়েছিলেন এক স্নায়ুবৈকল্যপূর্ণ খ্রিস্টবাদিতার মধ্যে, যা তিনি ওই চার বছর ধরে নিজের মধ্যে গড়ে নিয়েছিলেন। এটা একান্তই স্বাভাবিক যে তিনি যেসব দাগি কয়েদির মধ্যে বাস করছিলেন, তাদের নানা ভয়ংকর পাশবিক আচরণের মধ্যেই কখনো কখনো হঠাৎ মানবিক প্রবণতার দেখা পেয়েছেন। তিনি সেসব অভিব্যক্তি সমবেত করে সেগুলোর ভিত্তিতে সহজ-সরল রুশ আমজনতার একধরনের আদর্শায়ন করেছেন, যা খুবই কৃত্রিম ও সম্পূর্ণভাবে ব্যাধিগ্রস্ত। এটা ছিল তাঁর পরবর্তীকালের আত্মিক পথযাত্রার প্রাথমিক ধাপ। ১৮৫৪ সালে যখন তাঁর দণ্ডের মেয়াদ শেষ হয়, তখন সাইবেরিয়ার এক শহরে মোতায়েন একটি ব্যাটালিয়নে তাঁকে একজন সৈনিক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৮৫৫ সালে জার সম্রাট প্রথম নিকোলাইয়ের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র আলেকসান্দর দ্বিতীয় আলেকসান্দর নামে সম্রাটের সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন উনিশ শতকের রুশ শাসকদের মধ্যে সর্বোত্তম। [পরিহাসের বিষয়, তিনিই সেই রুশ জার, যাঁকে বিপ্লবীদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে, পায়ের কাছে তাদের ছোড়া বোমার আঘাতে তাঁর দেহ আক্ষরিক অর্থেই দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল।] তাঁর শাসনামলের শুরুতেই অনেক কয়েদি ক্ষমা লাভ করে। দস্তইয়েফস্কিকে তাঁর অফিসারের পদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। চার বছর পর তিনি পিতেরবুর্গে ফেরার অনুমতি পান।
সাইবেরিয়ায় নির্বাসনদণ্ডের শেষ বছরগুলোতে তিনি সাহিত্যকর্মে ফেরেন স্তেপানচিকোভা গ্রাম [১৮৫৯] ও মৃত্যুপুরীর কড়চা লেখার মধ্য দিয়ে। পিতেরবুর্গে ফেরার পর ঝাঁপিয়ে পড়েন সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডে। একই সঙ্গে বড় ভাই মিখাইলের সঙ্গে মিলে ভ্রেমিয়া [সময়] নামের একটি সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করেন। এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুপুরীর কড়চা এবং বঞ্চিত লাঞ্ছিত [উনিঝিওন্নিয়ে ঈ আসকারব্লিওন্নিয়ে, ১৮৬১] নামের আরেকটি উপন্যাস। যৌবনে বিপ্লববাদিতার দিনগুলোতে সরকারের প্রতি তাঁর যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, ইতিমধ্যে তা সম্পূর্ণভাবে বদলে যায়। ‘গ্রিক-ক্যাথলিক চার্চ, নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র আর রুশ জাতীয়তাবাদের বন্দনা’—প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক স্লাভপন্থার এই তিনটি উপাদান দস্তইয়েফস্কির রাজনৈতিক বিশ্বাসে পরিণত হয়। সমাজতন্ত্র ও পাশ্চাত্য লিবেরালিজমের তত্ত্বগুলো তাঁর কাছে হয়ে ওঠে পশ্চিমা দূষণ ও স্যাটানিক পাপের মূর্তরূপ, যার লক্ষ্য স্লাভ ও গ্রিক-ক্যাথলিক জগতের ধ্বংস সাধন। ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদের মধ্যেও ঠিক এই মনোভঙ্গিরই দেখা মেলে, যার সারকথা সর্বজনীন পরিত্রাণ।
ওই সময় পর্যন্ত দস্তইয়েফস্কির জীবনের আবেগি দিকটি ছিল অসুখী। সাইবেরিয়ায় তিনি বিয়ে করেন, কিন্তু তাঁর এই প্রথম বিয়েটি সুখের হয়নি। ১৮৬২-৬৩ সালের দিকে এক নারী লেখকের সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল; তিনি সেই নারীর সঙ্গে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানি ভ্রমণ করেছিলেন। পরে তিনি এই নারীকে চিত্রায়িত করেছিলেন ‘নারকীয়’ হিসেবে; মনে হয় তিনি ছিলেন এক দুষ্ট চরিত্র। তিনি পরে বিয়ে করেছিলেন রোজানভ নামের এক অসাধারণ লেখককে, যাঁর মধ্যে কখনো কখনো ব্যতিক্রমী প্রতিভা দেখা গেছে, কখনো দেখা গেছে বিস্ময়কর নির্বুদ্ধিতা। [আমি রোজানভকে চিনতাম, অবশ্য তিনি তত দিনে অন্য এক নারীকে বিয়ে করছিলেন] দস্তইয়েফস্কির ওপর এই নারীর বেশ দুর্ভাগ্যজনক প্রভাব ছিল বলে মনে হয়, যা দস্তইয়েফস্কির অস্থির চিত্তকে আরও অস্থির করে তুলেছিল। এই নারীর সঙ্গে প্রথমবার জার্মানি ভ্রমণকালেই দস্তইয়েফস্কির জুয়ার প্রতি আসক্তি প্রথম প্রকাশ পায়। তাঁর এই আসক্তি পরবর্তী সময়ে তাঁর পরিবারের জন্য অনেক দুর্ভোগ বয়ে আনে; বৈষয়িক সচ্ছলতা ও তাঁর নিজের মনে শান্তির পথে অপ্রতিরোধ্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
বড় ভাই মিখাইলের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে দস্তইয়েফস্কি দেউলিয়া হয়ে পড়েন, তা সত্ত্বেও তৎক্ষণাৎ স্বেচ্ছায় ভাইয়ের পরিবারটির দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন। এই সব দুর্বহ বোঝা সামলানোর প্রয়াসে দস্তইয়েফস্কি মরিয়া হয়ে কাজে নেমে পড়েন। অপরাধ ও শাস্তি [১৮৬৬], জুয়াড়ি [১৮৬৭], ইডিয়ট [১৯৬৮], দানবেরা/শয়তানেরা [দ্য পজেসড/ডেমনস/দ্য ডেভিল, ১৮৭২] কারামাজোভ ভাইয়েরা [ব্রাতিয়া কারামাজভি, ১৮৮০]—এই সব সমাদৃত উপন্যাস লেখা হয়েছে বিরামহীন চাপের মধ্যে: নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লেখা জমা দেওয়ার তাগিদে তাঁকে লিখতে হয়েছে তাড়াহুড়ো করে; লেখা শেষ করার পর কিংবা নিরুপায় হয়ে নিয়োগ করা স্টেনোগ্রাফারকে ডিকটেশন দেওয়ার পর কী লেখা হলো, তা একবার পড়ে দেখারও ফুরসত পাননি বললেই চলে। শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর স্টেনোগ্রাফারের মধ্যে এমন এক নারীকে খুঁজে পেয়েছেন, যিনি ছিলেন সম্পূর্ণভাবে নিবেদিতপ্রাণ একজন মানুষ; তাঁর বৈষয়িক বিচারবুদ্ধিও এত ভালো ছিল যে তাঁর সহযোগিতায় দস্তইয়েফস্কি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লেখা জমা দিতে পেরেছিলেন; সেই নারীর সহযোগিতার বলেই তিনি আর্থিক দুর্দশা থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন। ১৮৬৭ সালে তিনি সেই নারীকে বিয়ে করেন। এই বিয়েটি ছিল সামগ্রিকভাবে সুখের। ১৮৬৭ থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত চার বছর ধরে তাঁরা কিছুটা আর্থিক নিরাপত্তা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন এবং ইউরোপ থেকে রাশিয়ায় ফিরে যেতে পেরেছিলেন। সেই সময় থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দস্তইয়েফস্কির জীবন ছিল তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ। দ্য পজেসড বয়ে এনেছিল বিরাট সাফল্য। উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন পরই প্রিন্স মেশচেরস্কি তাঁর অতি প্রতিক্রিয়াশীল সাপ্তাহিক পত্রিকা গ্রাঝদানিন-এর [দ্য সিটিজেন] সম্পাদক পদে যোগ দেওয়ার জন্য দস্তইয়েফস্কিকে প্রস্তাব দেন। শেষ কাজ কারামাজভ ভাইয়েরা দস্তইয়েফস্কিকে তাঁর অন্য সব উপন্যাসের চেয়ে বেশি খ্যাতি এনে দেয়; তিনি শুধু উপন্যাসটির প্রথম খণ্ডই লিখে যেতে পেরেছেন, দ্বিতীয় খণ্ড লেখার সময়ে তাঁর মৃত্যু ঘটে।
তবে তার চেয়েও বেশি খ্যাতি জুটেছিল ১৮৮০ সালে মস্কোতে পুশকিনের স্মারক উন্মোচনের ঘটনায়। সেটা ছিল খুব বড় একটা ঘটনা; পুশকিনের প্রতি রাশিয়ার তীব্র ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছিল ওই ঘটনায়। সেই সময়ের সম্মুখসারির সব লেখক সেখানে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত হয়েছিল দস্তইয়েফস্কির বক্তৃতা। তাঁর বক্তৃতার নির্যাস ছিল এই যে পুশকিন রাশিয়ার জাতীয় চেতনার মূর্তরূপ; যে রাশিয়া সূক্ষ্মভাবে অন্যান্য জাতির আদর্শগুলোও হৃদয়ঙ্গম করে, কিন্তু সেগুলো আত্তীকরণ ও আত্মস্থ করে নিজের আত্মিক গড়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে। এই সক্ষমতার মধ্যে দস্তইয়েফস্কি রুশ জনসাধারণের সর্বগ্রাহী মিশনের প্রমাণ দেখতে পেয়েছিলেন ইত্যাদি। বক্তৃতাটি পড়ার সময় বোঝা যায় না, এটি সেই সময় মানুষ কেন এত পছন্দ করেছিল। কিন্তু আমরা যদি এই সত্য বিবেচনায় নিই যে সেটা ছিল এমন এক সময়, যখন রাশিয়ার শক্তিমত্তা ও প্রভাবের বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছিল পুরো ইউরোপ, তাহলে আমরা ভালোভাবে বুঝতে পারব কেন দস্তইয়েফস্কির ওই বক্তৃতা দেশপ্রেমিক শ্রোতাদের মনে অমন উদ্দীপনা জাগিয়েছিল।
এক বছর পর, ১৮৮১ সালে, জার দ্বিতীয় আলেকসান্দরের হত্যাকান্ডের অল্প সময় আগে দস্তইয়েফস্কির মৃত্যু ঘটে। তাঁর প্রতি সর্বসাধারণের স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধার বিপুল প্রকাশ ঘটেছিল সেই সময়।
অপরাধ ও শাস্তি [প্রিস্তুপ্লেনিয়ে ই নাকাজানিয়ে, ১৯৬৬]
দস্তইয়েফস্কি সাসপেন্স আর ইশারা-ইঙ্গিতে ভরা গল্প বুনতে ওস্তাদ বলে রাশিয়ায় বিদ্যালয়ের বালক-বালিকারা তাঁর উপন্যাসগুলো ভীষণ আগ্রহের সঙ্গে পড়ত; একই সঙ্গে তারা ফেনিমোরি কুপার, ভিক্তর হুগো, চার্লস ডিকেন্স ও তুর্গেনিভও পড়ত। আজ থেকে ৪৫ বছর আগে আমি যখন প্রথমবার অপরাধ ও শাস্তি পড়ি, তখন আমার বয়স নিশ্চয়ই ১২ হয়েছিল; তখন আমার মনে হয়েছিল, এটা একটা চমৎকার শক্তিশালী ও উত্তেজক বই। রাশিয়ার বিভীষিকাপূর্ণ গৃহযুদ্ধের দিনগুলোতে ১৯ বছর বয়সে আবার বইটা পড়ি; এবার আমার মনে হয় এটা ভীষণ প্যাঁচালো একটা, ভীষণভাবে ভাবালুতাপূর্ণ এবং খারাপভাবে লেখা। ২৮ বছর বয়সে নিজের একটা বইয়ে দস্তইয়েফস্কি সম্পর্কে আলোচনা করার সময় আমি আবার এ বইটা পড়ি। তারপর আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাঁর সম্পর্কে বক্তৃতা তৈরি করার সময় এই বস্তু আবারও পড়ি। অতিসম্প্রতিই কেবল আমি উপলব্ধি করি এ বইয়ের গুরুতর ত্রুটিটা কী এবং কোথায়।
ত্রুটিটা, সেই ফাটলটা পাওয়া যাবে বইটার দশম ভাগের চতুর্থ অধ্যায়ে; এ এমন এক ত্রুটি, এমনই এক ফাটল, যা আমার বিবেচনায় নৈতিক ও নান্দনিক দিক থেকে সম্পূর্ণ নির্মাণটির ধসে পড়ার কারণ ঘটায়। সেটা আছে অনুশোচনার দৃশ্যের শুরুতে, যেখানে খুনি রাসকোলনিকভ সোনিয়া নামের মেয়েটির মধ্য দিয়ে বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট আবিষ্কার করে। মেয়েটি তাকে যিশু ও লাজারুসের উত্থানের গল্প পড়ে শোনাচ্ছে। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু তার পরে আসে এই অনন্য বাক্যটা, শুধু নির্বুদ্ধিতার জন্যই বিশ্বসাহিত্যে যার জুড়ি মেলা ভার: ‘দারিদ্র্যপীড়িত ঘরটাতে নিবু নিবু মোমবাতির নিষ্প্রভ আলো উদ্ভাসিত করে তুলেছে খুনি ও পতিতাটিকে, যারা একসঙ্গে পড়ছিল শাশ্বত গ্রন্থ।’ ‘খুনি ও পতিতা’ এবং ‘শাশ্বত গ্রন্থ’—কী ত্রিভুজ! এ এক সাংঘাতিক বাক্য; রীতিমতো দস্তইয়েফ্স্কীয় বাকচতুর মোচড়। কিন্তু এর সাংঘাতিক ভুলটা কী? কেন এটা এত স্থূল ও অশৈল্পিক?
আমি মনে করি না একজন খুনির পাশে এক নিশ্বাসে, মেকি বাগ্মিতার এক উদ্গারে একজন নিরীহ পতিতাকে দাঁড় করিয়ে দেখানো যায় যে তাদের একেবারেই ভিন্ন রকমের দুটি মাথা পবিত্র গ্রন্থের দিকে ঝুঁকে রয়েছে: না কোনো সত্যিকারের শিল্পী, না কোনো সত্যিকারের নীতিবাদী—না কোনো সজ্জন খ্রিস্টান, না কোনো ভালো দার্শনিক—না কোনো কবি, না কোনো সমাজবিজ্ঞানীর এটা করা উচিত। যাঁরা খ্রিস্টীয় ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, তাঁরা সেই ঈশ্বরকে যেভাবে বোঝেন, সে অনুযায়ী সেই ঈশ্বর ১৯০০ বছর আগেই পতিতাকে ক্ষমা করেছেন। কিন্তু খুনি, তাকে তো প্রথমেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাহায্যে পরীক্ষা করে দেখা উচিত। এরা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি স্তর। একটি মেয়ে, যার দেহ বিক্রির মধ্য দিয়ে মানবতার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়, তার দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে রাসকোলনিকভের অমানবিক ও মূঢ়তাপূর্ণ অপরাধের কোনো দূরবর্তী তুলনাও চলে না। খুনি ও পতিতা পাশাপাশি বসে শাশ্বত গ্রন্থ পাঠ করছে—কী ভীষণ অর্থহীন কথা! এক জঘন্য খুনি আর এই হতভাগা মেয়ের মধ্যে কোনো বাক্যালংকারিক যোগসূত্র নেই। আছে শুধু গথিক উপন্যাস আর সেন্টিমেন্টাল উপন্যাসের মধ্যকার সেই প্রথাগত যোগসূত্র। এটা একটা রদ্দিমার্কা সাহিত্যিক চাতুর্যপূর্ণ উপন্যাস, করুণ রস ও ধর্মানুরাগের কোনো মাস্টারপিস নয়। উপরন্তু তাকিয়ে দেখুন এর শৈল্পিক ভারসাম্যের অনুপস্থিতির দিকে। রাসকোলনিকভের অপরাধের সমস্ত নোংরা, শোচনীয় খুঁটিনাটি আমাদের দেখানো হয়েছে, তার এই বাহাদুরির আধা ডজন রকমের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সোনিয়াকে তার পেশার কাজ করতে কখনোই দেখানো হয়নি। পরিস্থিতিটা একটা মহিমান্বিত ক্লিশে। এখানে পতিতার পাপ প্রশ্নাতীত বলে মনে করা হয়েছে। আমি মনে করি প্রকৃত শিল্পী সেই ব্যক্তি, যিনি কোনো কিছুকেই কখনো প্রশ্নাতীত বলে গ্রহণ করেন না।
রাসকোলনিকভ কেন খুন করেছিল? তার প্রণোদনা ভীষণ গোলমেলে।
দস্তইয়েফস্কি আমাদের যা বিশ্বাস করাতে পারবেন বলে আশা করেন, তা যদি আমরা বিশ্বাস করি, তাহলে রাসকোলনিকভ এক ভালোমানুষ যুবক; সে একদিকে নিজের পরিবারের প্রতি, অন্যদিকে উচ্চ আদর্শের প্রতি অনুগত; আত্মত্যাগে সক্ষম, দয়ালু, উদার এবং পরিশ্রমী, যদিও সে নিজের সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করে, এমন মাত্রায় অহংকারী যে অন্যদের সঙ্গে হার্দিক মানবিক সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না, সম্পূর্ণভাবে নিজেকে নিয়েই অন্তর্গত জীবন যাপন করে। এই অতি সজ্জন, উদার ও অহংকারী মানুষটি শোচনীয় রকমের দরিদ্র।
কিন্তু কেন রাসকোলনিকভ বৃদ্ধ কুসিদজীবী নারী ও তার বোনটিকে হত্যা করেছিল? আপাতদৃষ্টে নিজের পরিবারকে দুর্দশা থেকে রক্ষা করতে, নিজের বোনটিকে বাঁচাতে, যে বোন ভাইটির কলেজের পড়াশোনায় সাহায্য করার জন্য এক ধনী কিন্তু বর্বর লোককে বিয়ে করতে যাচ্ছিল।
কিন্তু খুনটা সে করেছিল এই কারণেও যে সে নিজের কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে আর দশজন সাধারণ লোকের মতো নয়, যারা অন্যদের বানানো নৈতিক বিধানগুলো মেনে চলে; বরং সে নিজেই নিজের জন্য বিধান তৈরি করে নিতে পারে এবং দায়িত্ববোধের প্রবল আত্মিক ভার বহনে সক্ষম; সে নিজের বিবেকদংশনের অবসান ঘটাতে এবং অন্তর্গত ভারসাম্য ও শুদ্ধ জীবনের কোনো হানি না ঘটিয়ে এই অশুভ পন্থা [হত্যা] ব্যবহার করে একটি শুভ লক্ষ্যে [নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো এবং বিদ্যা অর্জন, যে বিদ্যা তাকে মানবজাতির কল্যাণ সাধনে সক্ষম করে তুলবে] পৌঁছতে সক্ষম।
সে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এই কারণেও যে দস্তইয়েফস্কির প্রিয় ভাবনাগুলোর একটি ছিল এই যে বস্তুবাদী ভাবধারাগুলোর বিস্তারের ফলে যুবসমাজের নৈতিক আদর্শ ধ্বংস হবে এবং প্রকৃত ভালো ছেলেদেরও খুনি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দেবে; নানা পরিস্থিতির দুর্ভাগ্যজনক সংযোগে যেকোনো ভালো ছেলেকে সহজেই অপরাধ সংঘটনের দিকে ঠেলে দেওয়া যাবে। রাসকোলনিকভের লেখা এক ‘প্রবন্ধে’ তার মধ্যে গড়ে ওঠা কৌতূহলোদ্দীপক ফ্যাসিস্ট ভাবনাগুলো লক্ষ করুন: যেমন মানবজাতির দুটি অংশ—মানবদঙ্গল ও সুপারম্যান; আর সংখ্যাগরিষ্ঠকে প্রতিষ্ঠিত নৈতিক বিধানগুলো অবশ্যই মেনে চলতে হবে, কিন্তু অল্প কিছু লোক, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠের অনেক ওপরে, তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো বিধান তৈরি করে নিতে পারবে। এভাবে রাসকোলনিকভই প্রথম ঘোষণা করে যে নিউটন ও অন্য বড় আবিষ্কারকদের মানবজাতির কল্যাণের জন্য আবিষ্কারের পথে যারা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাঁদের জীবনসহ শত শত মানুষের প্রাণ উৎসর্গে তাঁদের দ্বিধান্বিত হওয়ার কিছু ছিল না। পরে তিনি কীভাবে যেন মানবজাতির এই হিতৈষীদের কথা ভুলে গিয়ে পুরোপুরি ভিন্ন রকমের এক ভাবাদর্শের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। হঠাৎ তাঁর সব উচ্চাকাঙ্ক্ষা কেন্দ্রীভূত হয় নেপোলিয়নের মধ্যে; তিনি নেপোলিয়নের মধ্যে একজন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লৌহমানবের দেখা পান, যে জনতাকে শাসন করে ক্ষমতা তুলে ‘নেওয়ার’ সাহস দেখানোর মধ্য দিয়ে, যে ক্ষমতা সে রকম ‘সাহসী’ কারও অপেক্ষায় পড়ে ছিল। এটা একজন প্রত্যাশী বিশ্বহিতৈষী থেকে আপন ক্ষমতার স্বার্থে একজন প্রত্যাশী স্বৈরশাসকে রূপান্তর। দস্তইয়েফস্কি তাঁর তাড়াহুড়োর মধ্যে এই রূপান্তরের যে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন, তার চেয়ে বেশি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
আমাদের এই লেখকের পরবর্তী প্রিয় ভাবনাটি হলো এই যে, একটি অপরাধ অপরাধকারীকে সেই অন্তর্গত নরক এনে দেয়, যা দুষ্ট লোকদের অনিবার্য নিয়তি। এই একাকী অন্তর্গত যাতনা কিন্তু কোনো এক কারণে অনুশোচনায় পৌঁছে না। অনুশোচনা আনে প্রকাশ্যে গৃহীত দুঃখ-যাতনা, জনসমক্ষে দুর্ভোগ; অন্য মানুষদের সামনে ইচ্ছাকৃত নিজের অবমাননা, অপমান; এটা যাতনাভোগকারীকে এনে দিতে পারে তার অপরাধের মোচন, অনুশোচনা, নতুন জীবন ইত্যাদি। রাসকোলনিকভ যে পথ অনুসরণ করবে, তা আসলে এমনই হওয়া কথা, কিন্তু সে আবার মানুষ খুন করবে কি না, তা বলা সম্ভব নয়।
শেষে আছে স্বাধীন ইচ্ছার সেই ভাবনা; স্রেফ অপরাধ করার জন্যই অপরাধের ভাবনা।
দস্তইয়েফস্কি কি এই সমস্ত কিছু বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পেরেছেন? আমার সন্দেহ আছে।
প্রথমত, রাসকোলনিকভ একজন স্বায়ুবিকারগ্রস্ত লোক; কোনো দর্শন কোনো স্নায়ুবিকারগ্রস্ত লোকের ওপর যে প্রভাব ফেলতে পারে, তা সেই দর্শনের মর্যাদাহানি ঘটাতে সহায়ক হতে পারে না। দস্তইয়েফস্কি যা করতে চেয়েছেন, তা আরও ভালোভাবে করতে পারতেন যদি তিনি রাসকোলনিকভকে এক শক্ত-সমর্থ, রাশভারী, আন্তরিক যুবক হিসেবে দেখাতেন, যে সত্যিই পথভ্রষ্ট হয় এবং অত্যন্ত সরলভাবে বস্তুবাদী ভাবধারাগুলো গ্রহণ করে সমূহ সর্বনাশের শিকার হয়। কিন্তু তিনি নিশ্চয় খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে এটা কখনো কাজ করবে না; বুঝতে পেরেছিলেন যে তেমন কোনো শক্ত-সমর্থ যুবক যদি সেই সব ভাবধারা গ্রহণ করতও, যেগুলো স্নায়ুবিকারগ্রস্ত রাসকোলনিকভের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে, তবু পরিকল্পিতভাবে খুনটি করার আগে একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে সে অবশ্যই দ্বিধান্বিত হতো। কারণ, এটা আকস্মিক কিছু নয় যে দস্তইয়েফস্কির যেসব নায়ক অপরাধ করে [ব্রাদার্স কারামাজভ-এ স্মেরদিকভ, দ্য পজেসড-এ ফেদকা, ইডিয়ট-এ রাগোঝিন], তাদের কেউই মানসিকভাবে মোটেও সুস্থ নয়।
দস্তইয়েফস্কি নিজের অবস্থানের দুর্বলতা অনুভব করে তাঁর রাসকোলনিকভকে হত্যা-প্ররোচনার প্রপাতের দিকে ঠেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সম্ভাব্য সব রকমের মানবিক প্রণোদনা টেনে এনেছেন; আমাদের অনুমান, যেসব জার্মান দর্শন তিনি গ্রহণ করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন সেই সব প্রণোদনা। শোচনীয় দারিদ্র্য, শুধু রাসকোলনিকভের নিজের নয়, তার অতি প্রিয় মা ও বোনেরও; তার বোনের আসন্ন আত্মত্যাগ, উদ্দিষ্ট শিকারের চরম নৈতিক অধঃপতন—ঘটনাক্রমিক এসব কারণের প্রাচুর্য দেখে বোঝা যায়, দস্তইয়েফস্কি নিজেই অনুভব করেছিলেন, তিনি যা বলতে চান, তা সঠিক বলে প্রমাণ করা কত কঠিন। ক্রাপোৎকিন খুব সঠিকভাবেই লক্ষ করেছেন: রাসকোলনিকভের পেছনে দাঁড়িয়ে মনে হয়, সে যে কাজটা করেছে, তা করার জন্য স্বয়ং দস্তইয়েফস্কি বা তাঁর মতো কোনো লোককে আনা যেত কি না, দস্তইয়েফস্কি যেন সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করছেন...কিন্তু লেখকেরা মানুষ খুন করে না।’
আমি ক্রাপোৎকিনের এই বক্তব্যও সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করি: ‘...তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট ও স্ভদ্রিগাইলোভের মতো লোকেরা, যারা অশুভর প্রতিমূর্তি, তারা বিশুদ্ধ রোমান্টিক উদ্ভাবন।’ আমি আরও এগিয়ে গিয়ে রোমান্টিক উদ্ভাবনের তালিকায় সোনিয়াকেও যোগ করব। সোনিয়া সেই সব রোমান্টিক নায়িকাদের এক উত্তম উত্তরসূরি, যারা নিজেদের কোনো দোষত্রুটি ছাড়াই সমাজের প্রতিষ্ঠিত সীমারেখাগুলোর বাইরে বাস করতে বাধ্য হয়েছে এবং সেই একই সমাজ যাদের ও রকম জীবনযাত্রার সকল লজ্জা, গ্লানি ও দুর্ভোগের বোঝা বইতে বাধ্য করেছে। অ্যাবি প্রেভোস্তের [১৬৯৭-১৭৬৩] সুলিখিত ও অনেক বেশি গতিশীল উপন্যাস ম্যানো লেসকৌ-এর [১৭৩১] পর থেকে এই ধরনের নায়িকারা বিশ্বসাহিত্য থেকে আর কখনো বিলুপ্ত হয়নি। দস্তইয়েফস্কির সাহিত্যের শুরু থেকেই অধঃপতন, অপমান ইত্যাদি ভাবনার দেখা পাওয়া যায়; এই অর্থে রাসকোলনিকভের বোন দুনিয়া, রাস্তায় অল্পক্ষণের জন্য দেখা মাতাল মেয়েটি এবং সদ্গুণসম্পন্ন পতিতা সোনিয়া—এরা সবাই দস্তইয়েফস্কির শোচনীয় চরিত্রগুলোর পরিবারে পরস্পরের বোন।
দৈহিক যন্ত্রণা-দুর্ভোগ ও লাঞ্ছনা-অপমানের মধ্য দিয়ে মানুষের আত্মিক উন্নতি ঘটে—এমন ভাবনার প্রতি দস্তইয়েফস্কির তীব্র আকর্ষণের কারণ সম্ভবত তাঁর ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি: তিনি নির্ঘাত অনুভব করছিলেন যে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনদণ্ডে তাঁর মুক্তিকামী, স্বাধীনতাপ্রিয়, বিদ্রোহী, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী সত্তাটি বেশ মার খেয়েছে; তার ফলে আর কোনো ক্ষতি যদি না-ও হয়ে থাকে, অন্ততপক্ষে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততা ক্ষুণ্ন হয়েছে। কিন্তু তাঁর মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে তিনি সেখান থেকে ফিরেছেন আগের চেয়ে ‘শ্রেয় মানুষ’ হয়ে।
নোট
ভ্লাদিমির নাবোকভের লেকচার্স অন রাশান লিটারেচার বইয়ের অন্তর্ভুক্ত ‘দস্তইয়েফস্কি’ শিরোনামের প্রবন্ধের অংশবিশেষের বঙ্গানুবাদ। লেখাটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন কথাসাহিত্যিক মশিউল আলম।