নিষ্ঠুর সমাজের কথক কায়েস আহমেদ
তাঁকে আমরা চিনি কথাশিল্পী হিসেবে। আসলেই কি তিনি কথাকার? কথাই কি তাঁর রচনার নদীপথ? ছোট ছোট ঢেউ তুলে নদীর পানি যেমন ভেঙে পড়ে বাতাসের সোহাগে, তাঁর কথা-পঙ্ক্তি সে রকম ভাষার ভেতরে ঢেউ তুলে ভাটির দিকে যায়। আমি যে কয়টি গদ্য রচনা পড়েছি, সেগুলোতে যা আমার মধ্যে ঢেউ তুলেছে, তাকে এভাবেই বর্ণনা করতে পারি। কারণ, তাঁর কথাগুলো দিনযাপনের গদ্য নয়, ঠিক প্রবহমান নয় তার ভাষাভঙ্গি, থেমে থেমে, অনেকটাই শব্দচ্ছল নদীর মতো বর্ণনার ঢেউ গুনতে গুনতে যায় ভাটিতে, সেই ভাটিতেও আছে কথার কবজা, যা বেজে চলে এক তারে।
বাগান পেরিয়ে, পুকুর পাড় দিয়ে, বাঁশঝাড়ের নিচে দিয়ে, কবরস্থানের পাশ দিয়ে, বোরজের ধার ঘেঁষে দখিনজলায় নেমে হাঁটতে হাঁটতে বড় আলে উঠে দেখেছিলাম সামনে, কিছু দূরে, ভারী, চওড়া উঁচু রেললাইন একটু বেঁকে ময়াল সাপের মতো শুয়ে আছে, তার পাশে একা একা দাঁড়িয়ে থাকা কতবেলগাছটা—ওখানে দাঁড়িয়ে কাদের ফায়ারম্যানকে কঞ্চি বাড়িয়ে দিতো। ওখানে, নীলমনি ডাক্তারের ছেলে রেলে জান দিয়েছিল। আমি কতবেলতলার দিকে এগুতে লাগলাম।
[নির্বাসিত একজন/ কায়েস আহমেদ সমগ্র: পৃ. ৯৮]
এ রকম থেঁতলানো-প্রায় গদ্য ভাষা তার এবং তাঁর গল্পের কাহিনিও নয় সমতল, ঝরঝরে নয় তার গতি ও বর্ণনা, তবে তাঁর গল্পের বর্ণনায় কোনো বিচ্ছেদ ঘটে না। অনেকটাই কবিতার মতো স্তবকের পর স্তবক সাজানো, ভাষার প্রবাহ খুবই নিরীহ ও অস্বচ্ছ, তবে বিচ্ছিন্ন নয়। জুড়ে নেওয়া যায়। গল্পের ভেতরে যে আবহটি তিনি রচনা করেন, তাকে স্টোরিটেলারদের মতো তরতরে ঝোলে ভাসা নয়, সেখানে অনেকটাই সান্ধ্যাভাস, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের মতোই জাপটানো সব মানুষের মধ্যে লেপ্টে থাকে।
তার কথা শেষ হয় না, নদীর ওপারের অন্ধকার মার মার কাট কাট ওঠে। হরিয়া মুহূর্তে স্থির হয়ে যায়, সঙ্গী তার পাশে এসে দাঁড়ায়। দীপকের পাশে ভূপেন পার্থও দাঁড়িয়ে যায়, বাসু বসে বসেই বলে, থাকবো না, কিচ্ছু থাকবো না। ভূপেন দীপককে জিজ্ঞেস করে, কোনদিকে ক’তো? দীপক অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলে, বুঝতাছি না। হাসনাবাদে ওইতে পারে, মীরের বাগেও ওইতে পারে।
একবার ব্রাশফায়ার হয়ে থেমে গেছে। তবু তিনজনই কান খাড়া করে থাকে। গুলির শব্দে না হোক মানুষের কোলাহলেও তো কিছু আন্দাজ করা যেতে পারে। না; আর কোনো শব্দ শোনা যায় না। তা ছাড়া ঢাকের আওয়াজ, ঢোলের বাড়ি, কাঁসির ঠনঠনে কিছু শোনবার যো আছে!
...
সমাবেশের এইসব কথাবার্তার মধ্যে একজনের চড়া গলা শোনা যায়: কইবেন কি দ্যাশটা দ্যাশ আছে, হালারে ভূতে পাইছে, গেরামের কথা তো কইলামই না, ঢাকা শহরের মেইন রোডের উপরে থেইক্যা দিনে দুফুরে মানুষের জামাকাপড় খুইল্যা লয়া ছাউড়া দ্যায়, ভাবতে পারেন?
চলেন, চলেন—একজন থুতু ফেলে, এইখানে খাড়ায়া কি ওইবো।
তার এই আহ্বানে সমাবেশ নড়ে ওঠে, আইন নাই, বিচার নাই... ...
—আরে ভাই আইন বিচারে কি করবো, আইন বিচারের হাত-পাও বান্ধা, কইবেন কারে, মানলে তাল গাছ না মানলে বালগাছ, বুঝলেন না!
লোকজন চলে যেতে যেতে বক্তার কথায় হেসে ওঠে।
—আরে মিয়া হাসতাছেন, চোর ডাকাত কন, হাইজ্যাকার কন, খুনী কন, পুলিশ ধরবো, লগে লগে অমুক ভাইয়ের, তমুক বাপের ফোন আইবো থানায়: ছাইড়া দাও, আইন বিচারে করবোটা কি?
[জগদ্দল/ পৃষ্ঠা—১০৯-১১০]
‘জগদ্দল’ গল্পের জায়গা ঢাকার হিন্দুদের শ্মশানঘাট, বুড়িগঙ্গার উত্তর পারে, ঢাকার শহরলগ্ন। ওপরে হাসনাবাদ ও মীরের বাগ। সময় সন্ধ্যাকাল অতিক্রান্ত এক ঘনায়মান রাত। খুবই গরিব মানুষের নিত্য যে কাজ, শ্রম বিনিয়োগের পর যা হাতে আসে তাই দিয়ে পেটের খাদ্য সংস্থানের পর তাদের মদ খাওয়ার নেশাটা তাদের ডাকতে থাকে। আর শ্মশানঘাটে যদি মড়া থাকে পোড়ানোর জন্য, তাহলে সেই পরিবেশটা ঢোল-করতাল, কাঁসর ইত্যাদির নৃত্যময় বাজনার তালে তালে নদীর পাড়ও অপরিচিত ও অচেনা লাগে। আর সেই সময় যদি নদীর ওপাওে ব্রাশফায়ারের শব্দ হয়, তাহলে পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জট পাকাবেই, তা বলাই বাহুল্য। কায়েস আহমেদ এই দৃশ্যপটটি এঁকেছেন, মনে হয় ঘটমান বর্তমানের একজন প্রত্যক্ষ দর্শক তিনি। কিন্তু তা সরল কোনো রিপোর্টিং নয়। তিনি সংবাদপত্রে কাজ করেছেন, কিন্তু সেই গুণ তাঁর লেখায় নেই। পৃথিবীর বহু বিখ্যাত ও পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকই আছেন, যাঁরা সাংবাদিকতা করেছেন, কিন্তু সেই চলচ্চিত্রিক ঢঙে লেখার গুণটি তাদের রচনায় নেই। কায়েস আহমেদের মধ্যেও নেই।
তাঁর সাহিত্যিক গদ্য, তাঁর চিন্তাপ্রসূত, বোঝা যায়। কেননা, গল্পের চরিত্রগুলো যেমন স্পষ্ট নয়, তেমনি তাদের রাজনৈতিক চেতনা ও সামাজিক অবস্থানও। কিন্তু তারা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের সামাজিক পরিস্থিতির রাজনৈতিক চরিত্র ঠিকই উঠে আসে। জগদ্দলের গল্প খুব বেশি কোনো শব্দ ব্যয় করেন না কায়েস। তিনি কী বলতে চেয়েছেন, তা-ও স্পষ্ট নয়। কালীমূর্তির সামনে নৃত্যরত পার্থ যে হ্যালোসিনেশনের শিকার তা বোঝা যায়। মনে ভেতরে লুকিয়ে থাকা বা লুকিয়ে রাখা চিন্তার সুতাগুলো পার্থকে উদ্বুদ্ধ করে নাচতে। শ্মশানে, সন্ধ্যাকালে, পূজার আয়োজন, তিনটি মড়া পোড়ানো ও তাদের স্বজনদের উপস্থিতি, গোটা পরিবেশে বেদনার একটি ছায়া—এসবই কায়েস আহমেদ এমন বিচ্ছিন্নভাবে সৃষ্টি করেছেন যে মনে হয় না, কোনোটা কোনোটার সাথে যুক্ত। কিন্তু সমাজ জীবন যেমন তার বন্ধন ছিঁড়তে ছিঁড়তে এমন এক সংকটের ধোঁয়াশায় জড়িয়ে পড়েছে যে, সব কিছুই অস্পষ্ট আজ। সেই আজ গল্প রচনার কালের ‘আজ’। আর সেই চেতনাশাসিত ব্যক্তিজীবন কূলহীন হয়ে পড়ে। নদীর ওপারে ব্রাশফায়ারে মানুষ মারা পড়েছে, এটা বোঝার উপায় নেই। কিন্তু ব্রাশফায়ারের আর কোনো মানে নেই। এপারের সমাবেশের লোকদের আলোচনাই আমাদের বোঝায় সমগ্র রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি কেমন শঙ্কাতুর, যেনো সমাজ-সংসার নির্বোধ এক পঙ্গুত্বে ঠাঁই নিয়েছে। মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই শাসকের কাছে, সমাজের কাছে। কিন্তু আমরা কি বলতে পারি, ওই সময়কালটি কোন দশকের? কোন শতকের কোন দশকের ওই ঘটনাস্রোতে জানা না থাকলেও আমরা বুঝতে পারি, ওই ব্রাশফায়ারের শব্দ আমাদের জীবন থেকে উবে যায়নি আজও। এর পাশাপাশি আরও কিছু উপাদান-উপকরণ যুক্ত হয়েছে। যেমন শাদা পোশাকে, শাদা গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া, গুম করে দেওয়া, কেবল রাজধানীতে সীমাবদ্ধ নয়, এই সন্ত্রাস—এই হত্যা আর রক্তাক্ত রাজনীতি, তা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের গ্রামাঞ্চলের রাজনীতিতেও। হেন কোনো দিন নেই রাজনৈতিক হানাহানি ঘটছে না। অথচ আমাদের ধারণা ও বিশ্বাস ছিল, রাজনৈতিক ওয়াদা ও মেনিফেস্টো ছিল সমতার, গণতন্ত্রের, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের রাজনীতি কেবল দেশ গড়ার হবে, গণমানুষের উন্নয়ন ও উন্নতির মাইলফলকগুলো উড়বে দেশের সর্বত্র, পতপত করে। কিন্তু তা হয়নি।
কায়েস আহমেদের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে। তাঁকে গত শতকের মধ্য-ষাটেই চলে আসতে হয় বাংলাদেশে, তখনো তাঁর যুবকত্ব পুরোপুরি শেষ হয়নি। হয়তো চাকরিজীবী বাবার বদলি সূত্রেই তিনি ঢাকা এসেছিলেন, কিন্তু তার মা-বাবা ফিরে গেলেও কায়েস থেকে যান এখানেই। এ দেশেই তিনি পড়াশোনো করেছেন। সাংবাদিকতা করেছেন গণকণ্ঠ ও সংবাদে, কিন্তু শিক্ষকতাই করেছেন জীবনভর, যত দিন তিনি বেঁচে ছিলেন।
কায়েসের গল্পে কি তারই একটি ‘রাজনৈতিক জগদ্দল’ ছবি আমরা দেখতে পেলাম? ওই জগদ্দল কেবল সাংস্কৃতিক চেতনায় নয়, সামাজিক ও বৌদ্ধিক চেতনায়ও ক্রিয়াশীল। কেবল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অচলায়তনের বেড়ি ভাঙবারই যেন কথা উঠে এসেছে ওই অনামী পুরুষ চরিত্রের সংলাপে। ‘আরে ভাই, আইন বিচারের পাও বান্ধা, কইবেন কারে, মানলে তালগাছ, না মানলে বালগাছ, বুঝলেন না!’ এই লোকবুলিটাই লোকমননের আসল বয়ান মেলে ধরে আমাদের সামনে। শাসকের অবস্থা যে নড়বড়ে, আইনশৃঙ্খলার বালাই নেই, ন্যায় বলে কিছু নেই, কল্যাণ চিন্তা তিরোহিত—ওই বাক্যটিতেই তা প্রকাশ পেয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা মনে পড়লেই বা সেই সময়কার ইতিহাসের পাতা ওল্টালেই উল্লিখিত সংলাপের মর্ম উদ্ধার সহজ হবে।
কায়েস আহমেদ ‘জগদ্দল’ নামটি রেখেছেন বহুমাত্রিক বিষয়কে কেন্দ্র করে। ওটি একটি প্রতীকী শব্দ। আর চরিত্রগুলো মেহনতি জগতের খেটে খাওয়া, হতাশ ও রাজনৈতিকভাবে নিষ্পেষিত, সাংস্কৃতিকভাবে দলিত এবং অবহেলিতদের খণ্ডাংশ। শেষ দৃশ্যে কালির হাতে রক্তাক্ত নরমুণ্ড এবং নৃত্যরত পার্থও ভয়ার্ত ছবি আমাদের বলে দেয় যে, দৃশ্যকল্পটি শাসক ও শাসিতের মধ্যকার রাজনৈতিক দীনতারই প্রকাশ।
আর ‘নির্বাসিত একজন’ এর কাহিনি মূলত দাঙ্গার। অবিভক্ত ভারতে, মুসলমানদের ওপর কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চেনা-জানা ও একই সমাজের, একই গ্রামের, একই স্তরের মানুষেরা হত্যার শিকার হয়। কালে অনেক মুসলমানকে চলে আসতে হয়েছে পাকিস্তানে। যারা পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী ছিলেন তারা পূর্ববঙ্গে চলে আসেন ভয়ে, প্রাণ নিয়ে। গোটা ভারতেই হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দেশভাগের কুফল হিসেবে জাতিগত বা ধর্মগত দাঙ্গা হিসেবে দেখা হয়। মূলত এর দায় পুরোপুরিভাবেই রাজনীতিকদের ব্যর্থতার জন্য ঘটেছে। রাজনীতিকেরাই দাঙ্গা উসকে দিয়েছেন, ইতিহাস তা জানে। এখনো ভারতে হিন্দু উগ্রবাদীরা আক্রমণ করে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর। এই নৃশংসতার সূচনা, প্রকাশ্যে আসে ১৯৪৭-এ। অপ্রকাশ্যে কয়েক শতাব্দী ধরেই চলে আসছে। দুটি ধর্মমতের মানুষ সহাবস্থান করেও তারা নিজেদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে পারেনি। আজও পারছে না। এমনকি পৃথিবীর দেশে দেশে ধর্মের চেয়ে মানুষ বড়, এটা ভাবনার জালে আটকা পড়েনি। আমি হিন্দু, আমি মুসলিম, আমি খ্রিস্টান, আমি বৌদ্ধ ইত্যাকার ধর্মান্ধ জ্ঞানই তীব্রভাবে ক্রিয়াশীল, যা পৃথিবীকে রক্তাক্ত করে রেখেছে, রক্তাক্ত করে চলেছে। আবার এই বোধের সাথে যুক্ত আছে বর্ণবাদিতা। শাদা-কালো বর্ণের মধ্যেই কেবল তা ক্রিয়াশীল নয়, তা একই ধর্মের ভেতরেও তীব্রভাবে আছে। হিন্দুধর্মের কাস্টপ্রথা সেই তথ্যই দেয়। মানুষকে অচ্ছুত করে রেখেছে মানুষ ও মানবতা থেকে।
কায়েস আহমেদের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে। তাঁকে গত শতকের মধ্য-ষাটেই চলে আসতে হয় বাংলাদেশে, তখনো তাঁর যুবকত্ব পুরোপুরি শেষ হয়নি। হয়তো চাকরিজীবী বাবার বদলি সূত্রেই তিনি ঢাকা এসেছিলেন, কিন্তু তার মা-বাবা ফিরে গেলেও কায়েস থেকে যান এখানেই। এ দেশেই তিনি পড়াশোনো করেছেন। সাংবাদিকতা করেছেন গণকণ্ঠ ও সংবাদে, কিন্তু শিক্ষকতাই করেছেন জীবনভর, যত দিন তিনি বেঁচে ছিলেন। অর্থাৎ তাঁর দুটো স্মৃতি-সম্পদ আছে বা ছিল। তাঁর জন্মদেশের ভাষা তিনি উত্তরাধিকার করেছেন। আর এ দেশের আলো-হাওয়ায় যুবক জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শিখেছেন এখানকার ভাষিক-স্পন্দন-সম্পদ। এই দুইটি ডাইলেক্ট ধারা তিনি লালন করেছেন আজীবন। তাঁর গল্পগুলোর মধ্যে সেই ভাষা ভিন্নতা আমরা লক্ষ করব। ‘মহাকালের খাঁড়া’ গল্পের পটভূমি পশ্চিম বাংলা। আর চরিত্রগুলো নক্সালবাড়ি আন্দোলনের কর্মী। ‘গলা কাঁটা চলছে চলবে’ এই স্লোগান লেখা তাদের রাজনৈতিক পোস্টার। গণশত্রু বিবেচনায় তারা তাদেরই সমাজের, নিত্যদিনের মানুষ, সুরেনকে হত্যা করে শ্রেণিশত্রু মনে করে। সুরেন যে কিছু অন্যায়-অবৈধ কাজ করে কিছু মালকড়ির মালিক হয়েছে, সে তা বিলক্ষণ বোঝে, উপলব্ধি করে। কিন্তু সে শ্রেণিশত্রু হবার মতো বিত্তবান নয়। সে মধ্যবিত্তের কোঠায়ও ওঠেনি। তারপরও তার জান গেল তারই প্রতিবেশী, নিত্যদিনের চেনা-জানা ছেলেদের হাতে। এভাবে, কত সাধারণ মানুষ যে এই তথাকথিত রাজনৈতিক বিপ্লবীদের হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে, তা কে বলতে পারে? ভুল রাজনীতি আর ভুল শিক্ষা যে আমাদের সমাজ-সংসারকে হত্যা করে চলেছে প্রতিদিন, সেটা কি আমরা বুঝতে পারছি? না, পারছি না। রাজনৈতিক দলান্ধদের রোষ আমাদের স্বাধীন দেশেও বহুবারই ঘটেছে, আজও তা অব্যাহত। বাংলাদেশে আজও দলান্ধ রাজনীতির কারণে অবিরাম রক্তপাত হচ্ছে। ওই রক্তপাতের জন্য তাদের মনে বিন্দু পরিমাণ শোক বা অনুশোচনা নেই। যদি থাকত, তাহলে একটার পর একটা রাজনৈতিক হত্যা, রাজনৈতিক গুম-খুন হতো না। ক্ষমতা এমনই অন্ধ ও নিষ্ঠুর যে তা মানবতা ও মানবিকতাকে থেঁতলানো মাংসপিণ্ড করে রাস্তার চৌমাথায় ফেলে রেখেছে।
সেকেন্ডখানেক, তারপরই কাত হয়ে পড়ে গেলো রেল লাইনের খোয়ার ওপর। খানিকক্ষণ গোঙানি, পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঝাঁকুনি খেলো কবার, একটা পা খানিকটা ওপরে উঠে মাটিতে আছড়ে পড়লো, কেঁপে কেঁপে উঠলো বার কয়েক, মাথা মুখ খোয়ার ওপর, ঘষা খেলো। মুখ দিয়ে অক করে একটা শব্দ হয়ে একেবারে স্থির হয়ে গেলো। [নির্বাসিত একজন]
এই উদ্ধৃতি দিয়েছি একজন দাঙ্গায় অংশ নেওয়া খুনে মানুষের সীমারি চেতনা দেখানোর জন্য। সে হিন্দু দাঙ্গাবাজদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে তারই সহচর এক হিন্দু নামের মানুষকে হত্যা করে। যখন তাকে ড্যাগার দিয়ে ঘা মারে, তার মনে একবারও এ-কথা জাগেনি যে তার বন্ধু অজিত একজন মানুষ। আবার যারা মুসলমানদের হত্যা করেছে, খোকার মাকে হত্যা করেছে, বোন নূরীকে লুটে নিয়ে গেছে যেসব হিন্দু যুবক, তারাও তাদের মনে এই বোধ জাগাতে পারেনি যে নূরী বা খোকার মা, তারাও মানুষ। তারা মুসলমান না, হিন্দুও না, তারা রক্তমাংসের মানুষ।
কায়েস আহমেদের গল্পের চরিত্রগুলো মূলত রাজনীতিরই শিকার। কায়েসের মনোলিথিক প্যাটার্ন অনেকটাই মরবিডিটিতে পূর্ণ। গল্পের প্রেক্ষাপট ও তার বর্ণনা, তার শব্দচয়ন মনে হয়, সেই অসুস্থ জীবনের শব্দশয্যায় সাজানো, যা সমাজের ভেতরকার ক্ষত। ওই ক্ষত শাদা চোখে দেখা সহজ নয়। এর জন্য বিশেষ চোখ, বিশেষ অনুভব করার ক্ষমতা ও সমাজের ভেতরে চোরাস্রোতে খুঁজে বের করার ক্ষমতা লেখকের থাকতে হয়। কায়েস আহমেদের সেই চোখ ও মন—দুটোই ছিল।
২
তিনি মূলত কবি।
আমি কিছু উপমা সংগ্রহ করেছি ‘নির্বাসিত একজন’ থেকে, সেগুলো আগে তুলে ধরি। তাহলেই বোঝা যাবে, কায়েস আহমেদের রাজনৈতিক চিন্তা ও পোয়েটিক চেতনার মিল-অমিল কতটা আছে বা ছিল।
ক. স্পিডোমিটারের কাঁটার মতো রক্ত ওঠানামা করছে পা থেকে মাথায়।
খ. কাঠের আগুনে বাবাকে দেখাত যেন দুরন্ত একটা ট্যাক্সি অ্যাক্সিডেন্ট করে দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে।
গ. কাঁটারির ঘাঁয়ে ছিটকে পড়া গাঁটগুলো এসে যেন আমার পিঠ ছেঁদা করে বুকের ভেতর বিঁধে যাচ্ছে।
ঘ. উঠোনটাকে মনে হলো রোদে পোড়া বিশাল মাঠ।
ঙ. মাঠটাকে মা’র সেই আনাড়ি হাতে চুল-কাটা মেজ ভাইয়ের মাথার মতো মনে হয়।
চ. বুনো শুয়োরের মতো ছুটে আসা ট্রাক।
ছ. সংসার তখন অভাব আর দেনায় কুঁকড়ে আমসি।
জ. থিঁতনো পুকুরের মতো দুপুর এখন।
ঝ. বুক থেকে একরাশ বল বেয়ারিং গড়িয়ে এসে গলায় আটকে গেল।
ঞ. মাথাটা ভিজে ফুটবলের মতো।
ট. পাকা ধানের মতো অঘ্রাণের দুপুর।
ঠ. চোখে ছানি পড়ার মতো কুয়াশা নামছিল।
ড. আগুনের আঁচে ভাত ফোটার মতো টগবগ করে ফুটছে।
ঢ. চওড়া উঁচু রেললাইন একটু বেঁকে ময়াল সাপের মতো শুয়ে আছে
ন. পায়ের নিচে থেকে ঝাঁ ঝাঁ করে মেইল ট্রেনটা ছুটে এসে মাথার ভেতর ঢুকে গেল।
প. যেন কবজা লাগানো ফোল্ডিং পাল্লা ভাঁজে ভাঁজে মুড়ে দিচ্ছে।
ফ. আমড়ার মতো বড় বড় চোখ দুটো।
ব. কূল কূল কূল কূল করে জ্যোৎস্না ঢুকছিল কবরের ভেতরে।
এই সব উপমা বা সিমিলিই বলে দেয় কায়েস আহমেদের কবিচিত্তের সেই বাঙ্ময় দৃষ্টিভঙি, যা তাঁকে গদ্যকার হিসেবে ভিন্নমাত্রার একজন করে তুলেছে। সাধারণত, গল্পকারেরা তাঁদের গল্পে ভাষায় কাব্যিক স্পর্শের তেমন একটা প্রশ্রয় দেন না। ঋজু গদ্য লেখার তাগিদে, শক্তিশালী গদ্য রচনার নিমিত্তে, তাঁরা তাঁদের ব্যবহৃত ভাষা থেকে নিংড়ে নেন, কাব্যিক সুষমা। না, সবাই নয়, কেউ কেউ এটা করেন। তবে কায়েস আহমেদের ব্যবহৃত ভাষা গদ্যের মিশ্রভাবে রঞ্জিত। পাঠের আনন্দ আমাকে বহুদিন পর জাগিয়ে রাখে টান টান করে। বিশেষ করে, চরিত্রের মুখে কথ্য ভাষার ব্যবহার, চরিত্রের জীবনাচারে যেন লেপ্টে থাকা ঘ্রাণের মতো। কায়েস আহমেদের কৈশোর-যৌবনের নিখিল যে জীবনাচারকে শুষে নিয়েছিলো, যে মানবিক চেতনাশূন্যতা সমাজ-সংসারকে অনেকটাই আলগা করে দিয়েছিল, তিনি সেই সবই রচনায় পোক্ত করে ধরেছেন।