রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ এবং আহমদ ছফার ‘কবি ও সম্রাট’: তুলনা ও প্রতিতুলনা

 

শিল্প-সাহিত্য হলো বাস্তবের প্রতিরূপায়ণ আর ঘটমান বিশ্বকে জানার উপায়বিশেষ। সত্যানুসন্ধান ও সত্য প্রকাশ করা নিয়েই উৎকৃষ্ট শিল্পকর্মের কারবার। বোধ করি যেকোনো সৃষ্টি তখনই শিল্প হয়, যখন সত্য তার ওপর ভর করে। আমি জ্ঞাতসারেই ভর করা শব্দটি ব্যবহার করছি। এই ভর করাটাই আদতে বুদ্ধত্ব বা জ্ঞানলাভ। লোকে বুদ্ধত্বলাভের আশায় তপস্যা করতেই পারে, তবে সবার কাছে তা ধরা দেয় না। আবার কেউ না চাইতেই সত্য জেনে যায়, সত্য তার ওপর ভর করে। সত্য কিন্তু সাংঘাতিক জিনিস, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে তার। আমরা হয়তো সফোক্লেসের রাজা ইদিপাস নাটকের সত্যানুসন্ধান ও তার পরিণতি সম্পর্কে জ্ঞাত রয়েছি। বলা সম্ভব, ইদিপাস সত্যের তপস্যা করছিলেন কিন্তু সত্য আদতে তার ওপর ভর করেছিল। ওই নাটকের দ্বিতীয় খণ্ড পাঠ করলেই মাত্র ইদিপাসকে প্রকৃতরূপে অনুধাবন করা সহজ হয়। সত্য যে কেবল কষ্টই দেয় তা নয়, মুক্তিও প্রদান করে। কলোনাসে ইদিপাস নাটকটি আমাদের সেই নজির দেখিয়েছে। আমার বর্তমান রচনায় সত্য, শিল্প প্রভৃতি শব্দ ঘুরে ঘুরে আসবে। সেখানে বেদনার সাথে মুক্তির সুবাতাসও বইতে পারে বলে বিশ্বাস করি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ নাটকগুলোর মধ্যে রক্তকরবী আছে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর নাটকটি রচিত। নাটকটি ১৯২৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। নাটকের ঘটনাস্থল যক্ষপুরী নামের একটি নগর। সেই নগরের শ্রমিকেরা মাটির তলা হতে স্বর্ণ উত্তোলনের কাজে নিযুক্ত। যক্ষপুরীর রাজা রয়েছেন একটি অত্যন্ত জটিল আবরণের আড়ালে। সেই জালের আবরণের সম্মুখভাগই নাটকের দৃশ্যপট। অত্যন্ত জটিল আবরণ শব্দখানা রবীন্দ্রনাথের থেকে ধার করা। নাটকটিকে বলা হয় রূপক-সাংকেতিক, তাই ধরে নেওয়া প্রাসঙ্গিক যে নাটকে ব্যবহৃত শব্দগুলোও রূপকাশ্রয়ী বা সাংকেতিক। এই যে জটিল আবরণ, তাকে কালের ভাষায় বলা হয় তন্ত্র, ব্যবস্থা বা সিস্টেম। শব্দটি আমাদের প্রাক্তন প্রভুদের নিকট হতে ধার করা। ধারদেনা দোষের নয়, বরং বিশ্বায়নের যুগেআশীর্বাদস্বরূপ। বর্তমান রচনায় আমি আরও একটি সাহিত্যকর্ম নিয়ে ব্যবচ্ছেদ করব। সেটি মহাত্মা আহমদ ছফার কবি ও সম্রাট। সাহিত্যকর্ম দুটির ভেতরে মজ্জাগত রঞ্জন নামক একটি প্রাণশক্তির সন্ধান করাই আমার মূল কাজ।

রক্তকরবী নাটকটির ঘটনা খুবই সাবলীল। যক্ষপুরীর রাজার নির্দেশে শ্রমিকেরা তাল তাল সোনা আহরণ করে চলেছে। সে কাজ তদারকির জন্য রয়েছে মোড়ল, সর্দার, প্রহরী। বুদ্ধিপরামর্শ দেবার জন্য একজন অধ্যাপক। শ্রমিকেরা সারা দিন খনিতে খননের কাজ করে আর অবসরে মদ্যপান করে সময় কাটায়। এই তাদের রোজকার নিয়ম। অন্যদিকে সুশৃঙ্খল এই নিয়ম পণ্ড করার জন্য রয়েছে এক বিশুপাগল। সে গান গাইতে ভালোবাসে। রয়েছে এক কিশোর যে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখার সাহস করে। বোধ করি কৈশোর তাকে সেই সাহস জোগায়। আর রয়েছেন নন্দিনী। রয়েছে ঠিক নয়, তার আগমন ঘটেছে কিছুদিন আগে।

গল্পটা মূলত যক্ষপুরীর রাজা আর নন্দিনীকে ঘিরেই। নন্দিনী মাঠে পৌষের গান শোনাতে চায়, খনিশ্রমিকদের মুক্তবাতাসে ফিরে যেতে আহ্বান করে। আহ্বান জানায় রাজাকেও। নন্দিনীর দাবি একদিন রঞ্জন আসবে। সে সবাইকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে। রাজাকেও সেই মুক্তির দাওয়াত দেন নন্দিনী। নন্দিনীর মুক্তির বিষ রাজাকেও আক্রমণ করে একসময়। ভেতরে ভেতরে ব্যথিত রাজাও তাই মুক্তির গান গেয়ে ওঠেন।

কিন্তু সমস্যা ঘটে অন্যখানে। ওই যে অত্যন্ত জটিল আবরণ’—যার কথা নাট্যকার সূচনায় বলে দিয়েছিলেনসেই জটিল আবরণ বা সিস্টেম রাজাকে বাধা দেয়। রাজার নিজের গড়ে তোলা নিয়ম তাকে নিয়ম ভাঙতে বাধা দেয়। ওই নিয়ম হত্যা করে নন্দিনীর রঞ্জনকে। সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। শোককে শক্তিতে রূপায়িত করে শৃঙ্খল ভাঙে সকলে। সিস্টেম হটিয়ে দিয়ে রাজা মুক্ত হন অবশেষে। এই ঘটে নাটকটিতে।

নাটকটিতে কিশোর দুরন্ত প্রাণশক্তির প্রতিনিধি, রঞ্জন মুক্তির শক্তি আর নন্দিনী সেই মুক্তির বাহক। মোড়ল-সর্দার-প্রহরীরা ক্ষমতাতন্ত্র বা সিস্টেম এর প্রতিরূপ। রাজা চরিত্রটি একদিকে সিস্টেমের আবিষ্কারক-রক্ষক, অন্যদিকে সিস্টেমের শিকার। তার মাঝে দ্বৈত সত্তা ক্রিয়া করে। মুক্তির আহ্বান তাকে আলোড়িত করে, আবার ক্ষমতা তাকে প্রচলিত কাঠামো জিইয়ে রাখতে উৎসাহীও করে। যদিও শেষমেশ এই দোলাচলের অবসান ঘটে, রাজা মুক্তি লাভ করেন। শুরুতে বলেছিলাম, সত্য মুক্তি প্রদান করে। রাজার মুক্তি হয়েছে কিন্তু সেই মুক্তির বিনিময়ে রাজা কি সয়েছেন? রাজার ওপর সত্য ভর করেছিল মুক্তির আগেই। সত্য তাকে করা আর সয়ে-নেয়ার দোলাচলে নিক্ষেপ করে।

আমরা জানতে পারি, রাজা নন্দিনীর কাছে তার বেদনা বর্ণনা করেন: একদিন দূরদেশে আমারই মতো একটা ক্লান্ত পাহাড় দেখেছিলুম। বাইরে থেকে বুঝতেই পারিনি তার সমস্ত পাথর ভিতরে ভিতরে ব্যথিয়ে উঠেছে। একদিন গভীর রাতে ভীষণ শব্দ শুনলুম, যেন কোনো দৈত্যের দুঃস্বপ্ন গুমরে গুমরে হঠাৎ ভেঙে গেল। সকালে দেখি পাহাড়টা ভূমিকম্পের টানে মাটির নীচে তলিয়ে গেছে। শক্তির ভার নিজের অগোচরে কেমন করে নিজেকে পিষে ফেলে, সেই পাহাড়টাকে দেখে তাই বুঝেছিলুম। [ঠাকুর ১৯৮৫]

এই বোধই হলো সত্য জানার বোধ, সত্য সাজা প্রদান করে। যেমনটা ভোগ করেছিল রাজা ইদিপাস যে নিজের চক্ষু নিজেই উৎপাটন করে। শারীরিক প্রকাশ তো বাহ্য কেবল, ভিতরকার বেদনাটাই মূল। যেখানে রক্তকরবীর রাজা আর সফোক্লেসের রাজা এক হয়ে ওঠেন। সাজার মধ্য দিয়ে মুক্তি প্রদান করে সত্য, ইদিপাস মৃত্যুতুল্য অন্তর্ধানের মধ্য দিয়ে মুক্তি পান আর রাজা মুক্তি পান নিজের ক্ষমতার বিনাশের মধ্য দিয়ে: এই আমার ধ্বজা, আমি ভেঙ্গে ফেলি এর দণ্ড, তুমি ছিঁড়ে ফেল এর কেতন। আমারি হাতের মধ্যে আমার তোমার হাত এসে আমাকে মারুক, মারুক, সম্পূর্ণ মারুক, তাতেই আমার মুক্তি। [ঠাকুর ১৯৮৫]

 

১৯৯৯ ইংরেজি সালে লেনিন ঘুমোবে এবার নামক একটি কাব্যগ্রন্থে আহমদ ছফার কবি ও সম্রাট কবিতাটি প্রকাশিত হয়। উর্দু সাহিত্যের শক্তিমান কবি মীর ত্বকি মীর এবং দিল্লি সালতানাতের অনামা এক সম্রাটের কথোপকথন নিয়ে রচিত কবিতা কবি ও সম্রাট। স্বাধীনচেতা মীর সমাজের প্রচলিত শৃঙ্খলাভঙ্গের ও ক্ষুরধার কবিতা রচনার দায়ে অভিযুক্ত। সম্রাটের নির্দেশে তার রাজদরবারে আগমন। এখান থেকে কবিতার শুরু। নাট্য আঙ্গিকে রচিত মহাত্মা আহমদ ছফার এই কবিতা একটি দৃশ্যপট হিশেবেই ধরা দেয় পাঠকের চোখের সম্মুখে।

মীর ত্বকি মীর অহরহ গাঁজা-চণ্ডু খান, শরাবখানা-রেন্ডিবাড়ি তার নিত্য গতায়ত। সবচেয়ে আপত্তিকর, তিনি প্রত্যহ লাউডগা সাপের মতন অবাধ্য কবিতা ছেড়ে দিচ্ছেন। তার শব্দের বিষ, উপমার ঝঙ্কার কেড়ে নিচ্ছে যুবকের ধর্মকর্মে মতি, নারীরাও ঝুঁকে পড়ছেন এই নিষিদ্ধ চিজের দিকে। মীরের কবিতা আক্রমণ করেছে খোদ সম্রাটের অন্তরকেও। এক মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে মীরের কবিতা হয়েছে সম্রাটের বিনিদ্র রাতের সাথী। মাটিঘেঁষা ভাষা আর মর্মভেদী সুর শিশুকালের সুখ বইয়ে দিয়েছে তার হৃদয়ে। অন্যদিকে ত্বকি মীর নগরে-বন্দরে অশান্ত ঘূর্ণির মতন তীব্র সংবেদন তুলে ছুটে যাচ্ছেন দেশ থেকে দেশান্তরে, যেন এক জ্যান্ত মহামারী তিনি। মীরের কবিতা সম্রাটের মনকে দোলায়িত করে, সম্রাট আর কবি যেন এক আত্মায় লীন। ফলে ত্বকি মীরকে সম্রাট শাস্তিমূলক আমন্ত্রণ করেন স্বীয় রাজসভায়, কিন্তু কবি তা প্রত্যাখ্যান করেন।

মীরের দাবি, তিনি নিজেও নিজের নন, নেপথ্যের কোনো অদৃশ্যশক্তি তাকে চালায়। পাড়াগাঁর শান্তসন্ধ্যা, বিহঙ্গের কাকলি, দেহাতি হালটরেখা, কিষাণের কুঁড়েঘরের উৎসবের ধুম, প্রেয়সীর শাড়ির আঁচলের ন্যায় দোলায়িত পোয়াতি গমের শীষএই সবই মীরের কল্পনার চারণভূমি। প্রসারিত শস্যক্ষেত্র, যমুনার সুবঙ্কিম তীর, নগরের প্রবেশদ্বারে হিজড়ের বাথান, গণিকাপল্লির হল্লা, মাতালের আস্ফালন, আমির খসরুর মাজারে কাওয়ালির রাতজাগা সুরএই সকল স্থানই মীরের কবিতার জন্মভূমি। পিপুলগাছে বসে যে কোকিল গান গায়, যে বুলবুলি লেজ নেড়ে ছোটাছুটি করে, তাদের সাথে জুটি বেঁধে লোকালয়ে গান গেয়ে বেড়ান জীবন কবির। রাজসভার গাম্ভীর্য আর ঐশ্বর্য কবির পক্ষে সংকীর্ণ পিঞ্জরতুল্য। তিনি রাজদরবারের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন।

এই প্রত্যাখ্যানকে উপস্থিত সভাসদগণ বর্ণনা করেন সম্রাটের আজ্ঞালঙ্ঘনরূপে আর সম্রাটও নিজের অন্তর আর শাসনভারের দোটানায় বাঁধা পড়েন। সম্রাটের জবানে বলা চলে:

মীর, তোমার হৃদয় ধর্ম
সম্রাটেরও রাজধর্ম আছে। দুই ধর্ম পরস্পর মুখোমুখি
পথে দাঁড়িয়েছে। সম্রাট হৃদয়ধনে ভাগ্যবান
নন, সম্রাটকে চালায় কানুন।
[ছফা ২০০৮: ৪৪৩]

সম্রাট চান কবি মুক্তভাবে রচনা করে যান বিশুদ্ধ সব কবিতা। অন্যদিকে মীরের শাস্তি বিধান করাও তার কর্তব্য। নচেৎ সিংহাসন হয়ে পড়তে পারে নড়বড়েসমস্যাসংকুল।

 

সম্রাটের অন্তরের দোলাচলের দিকে লক্ষ করুন আর রক্তকরবীর রাজার কথা চিন্তা করুন। উভয় শাসকই যার যার ক্ষমতা ব্যবস্থায় আটকা পড়েছেন। উভয়েরই দুইটি সত্তা সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। প্রথমটি সব ছেড়ে দিয়ে সত্য-সুন্দর সরল পথে পা বাড়ানোর সত্তা, অন্যটি প্রচলিত ব্যবস্থার নিকট নতি স্বীকার করার। এই একটি অবস্থা দুই আখ্যানের দুই শাসককে এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। ফরাসি মনোসমীক্ষক জাক লাকাঁ এই অবস্থাকে বলেছেন রিয়েল অর্ডার। যখন একাধিক সিম্বলিক অর্ডার পরস্পরবিরোধী আচরণ করে এবং একটিকে বেছে নিতে হয়যেটাই বেছে নিন না কেন, বিনিময়ে কিছু ছাড়তে হবেওই অবস্থাকেই বলা হচ্ছে রিয়েল অর্ডার

পাঠকের সুবিধার্থে সিম্বলিক অর্ডার সম্পর্কে একটু বলে নিতে চাই। কোনো প্রতিষ্ঠান, সম্পর্ক, পেশা, লিঙ্গ ইত্যাদি মানুষের যে সাময়িক পরিচয় প্রদান করে, তাই মূলত সিম্বলিক অর্ডার। সাময়িক বলার কারণ এই পরিচয় পূর্ণাঙ্গ সত্য নয়, আপেক্ষিক। লক্ষ করুন, সম্রাট তার সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা। পরিবারে তার অন্য পরিচয় আছে, তিনি কবি মীরের একজন পাঠকও। এই সকল আপাতদৃশ্য পরিচয়ের প্রতিটিই আলাদা আলাদা সিম্বলিক অর্ডার। রাজা এবং সম্রাট উভয়ের পৃথক পৃথক পরিচয় একটা পর্যায়ে এসে একসঙ্গে ক্রিয়া করতে পারছে না। যেকোনো একটিকে তাদের বেছে নিতে হচ্ছে আর বিনিময়ে প্রতিদানও দিতে হচ্ছে অর্থাৎ তারা উভয়েই রিয়েল অর্ডারের মুখোমুখি হয়েছেন।

এক্ষণে নাটক ও কবিতা দুটির ঘটনাস্থলের দিকে লক্ষ করা যাক। রক্তকরবীর ঘটনাস্থল একটি নগর, রাজপ্রাসাদের সম্মুখভাগ। কবি ও সম্রাটের ঘটনাস্থলও রাজপ্রাসাদ। মানুষের তৈরি কৃত্রিম জগৎ এখানে অনেক গতিশীল, যান্ত্রিক নিয়মে বাঁধা। রবীন্দ্রনাথ এক কবিতায় বলেছেন, দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর’—এই কথাখানাই যেন বিবৃত হয়েছে কবি আর নন্দিনীর বয়ানে। চরিত্র দুটি যান্ত্রিক জীবনের বিপরীতে প্রকৃতির উদারপ্রান্তে ফিরে যাবার আকুতি জানায় আমাদের।

ত্বকি মীরের সঙ্গে নন্দিনীর সাদৃশ্য রয়েছেউভয়ই মুক্তির কথা বলেন। দুজনেই প্রকৃতির সৌন্দর্যপিপাসু, একজন পৌষের মাঠে ধানকাটার উৎসবে যোগ দিতে চান, অন্যজন চান গাঁয়ের পথে ঘুরে বেড়াবার এজাজত। উভয়েই অন্তর থেকে মুক্ত, আপোস তাদের স্বভাবে নেই। উভয়েই আহ্বান জানান শৃঙ্খলভাঙার। মনে রাখা জরুরি, সম্রাটের সভার রাজন্যবর্গ রক্তকরবীর মোড়ল-সর্দারদের প্রতিচ্ছবি। এ যেন একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন উপস্থাপন।

শিল্পের বড় একটা সুবিধা এই যে তার নির্দিষ্ট বা স্থির কোনো ব্যাখ্যা হয় না। কেউ দাবি করতে পারেন না যে তার ব্যাখ্যাই সর্বশেষ ব্যাখ্যা। যুগে যুগে উপযুক্ত পাঠকের কল্যাণে শিল্পকর্ম নতুন জীবনপ্রাপ্ত হয়। নতুন ব্যাখ্যা আর বিশ্লেষণে পাঠক বুঝতে চেষ্টা করেন নিজের সময়। সাহিত্যকর্মের প্রতিটি শব্দই স্বাধীনভাবে ব্যাখ্যাত হবার অধিকার রাখেবুদ্ধিমান পাঠক সে সুযোগ হাতছাড়া করতে নারাজ। রক্তকরবী আর কবি ও সম্রাট’—উভয়েরই হাজার বিশ্লেষণ সম্ভব।

 

এত এত মিলের মাঝেও নাটক আর নাট্যকবিতা এই দুটির একটি বড় অমিল আমাদের চোখে পড়ে। আমরা জেনেছি, রক্তকরবীর রাজা মুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু কবি ও সম্রাট কবিতায় সম্রাটের ভাগ্যে তা সম্ভব হয়নি। বিচারে মীরকে দণ্ড দিতে বাধ্য হন সম্রাট। মীরের পরিচিত সকল স্থানে গতায়ত নিষিদ্ধ করা হয়।

নগরের চাঁদনিচকে সংকীর্ণ কুটিরে একলা একাকী
সঙ্গীসাথীহীন, মীরকে কাটাতে হবে জীবনের বাকি দিন।
[ছফা ২০০৮: ৪৪৯-৫০]

এই দণ্ড প্রদান করেন সম্রাট। জ্ঞাতব্য, একলা প্রকোষ্ঠে বন্দি ত্বকি মীর কিংবা বর্শার মুখোমুখি ছুটে যাওয়া নন্দিনীউভয়ই কিন্তু শেষবিচারে গ্রিক উপকথার প্রমিথিউসের মতো মুক্ত। নন্দিনী আর কবির মুক্তি ঘটেছে কিন্তু সম্রাটভাগ্যে কী জুটল? এই প্রশ্নে এসে পৃথক চেহারায় হাজির হন রাজা ও সম্রাট।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজাকে মুক্তি দিয়েছিলেন। সমস্ত বিরুদ্ধশক্তির বিপরীতে মুক্তিকে বেছে নিতে সাহস করেছিলেন তিনি। কিন্তু বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের কবিকবিই তো তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়মহাত্মা ছফা সে সাহস করেননি। কেন করেননি সেটি দেখা খুব জরুরি। রক্তকরবীর প্রস্তাবনায় রবীন্দ্রনাথ রাজার সাথে রামায়ণে বর্ণিত রাক্ষসরাজের তুলনা করে লিখেছিলেন, আধুনিক যুগে [রাজার] একটার বেশি মুণ্ড ও দুটোর বেশি হাত দিতে সাহস হলো না। এ বড় বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে আমাদের কাছে। তবে রাজার মুণ্ড একাধিক থাকলেও আপত্তি উঠত কি না সন্দেহ রয়েছে।

সে ভিন্ন কথা, তবে কবিগুরু রাজার মুক্তি দিতে সাহস করেছেনএটাই মুখ্য বিষয়। এই সাহস দোষের না দ্রোহের, তা খতিয়ে দেখা জরুরি। কবিগুরু চেয়েছেন মানুষকে জাগরণের দীক্ষা দিতে। প্রথম মহাযুদ্ধের বর্বরতা তিনি চাক্ষুষ করেছিলেন, তাই বিজ্ঞানের পতাকাতলে ঘটে চলা কৃত্রিমতা, অমানবিকতাযান্ত্রিকতার বিপরীতেঅকৃত্রিম প্রকৃতির কোলে ঠাঁই নেবার আহ্বান জানাতে চেয়েছেন তিনি। এটি দোষের নয়বরঞ্চ দ্রোহের। ফাউন্টেন পেন, কাগজ আর ছাপাখানার সহায়তা নিয়েই আধুনিকতার ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে লিখে যাওয়া দ্রোহ বটে।

অপরপক্ষে ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রামের গাছবাড়িয়ায় জন্ম নেওয়া আহমদ ছফা প্রত্যক্ষ করেছিলেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধযদিও তাঁর বিচারে এই যুদ্ধ একটি বেহাত বিপ্লব বৈ নয়। তা ছাড়া প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সম্পর্কেও নিশ্চয়ই জ্ঞান ছিল তাঁর। এই মানুষটি ১৯৯৯ সালে লেনিন ঘুমাবে এবার কাব্যগ্রন্থে প্রকাশ করেন কবি ও সম্রাট। উপরোক্ত ঘটনাবলির সুস্পষ্ট প্রভাব পড়েছে তাঁর সম্রাট চরিত্রটির মাঝে। সেই কারণে কবিগুরুর মতো সাহসী হতে পারেননি ছফা। রবীন্দ্রনাথের নন্দিনী মুক্তই থাকে, মুক্তি পান রাজাও, কিন্তু মহাত্মা ছফা সম্রাটকে মুক্তি দেন না। তিনি দেখেন ক্ষমতাযন্ত্রের পেষণে শৃঙ্খলিত সম্রাট যেন ক্ষমতাতন্ত্রের কানের দুল বৈ নন। তন্ত্র যে দিকে হেলে, তার বিপরীতে হেলে পড়ার ক্ষমতা সম্রাটের নেই। এই উদাহরণটি সম্ভবত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি পদবিধারীর অবস্থা বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রিয় পাঠক, ভয়ের কিছু নেই, ‘কবি ও সম্রাট’-এর ঘটনা বহুকাল আগের। সে আমলে ভারতবর্ষে গণতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটেনি।

আমাদের স্মরণ থাকার কথা, রচনার আদিতে আমি ধার করা সিস্টেম পরিভাষার শরণ নিয়েছিলাম। এখন তার সাথে আরেকটি শব্দ যুক্ত করতে বড় ইচ্ছা হয়প্রটোকল। শব্দখানার অর্থ দাঁড়ায় আদব-কায়দা বা আচরণবিধি। ক্যামব্রিজ অভিধান তার ব্যাখ্যা করেছে এই রূপে: the system of rules and acceptable behaviuor used at official ceremonies and occasions অর্থাৎ আমাদের সম্রাট যে আচরণবিধির দরুন তার মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে ব্যর্থ, তার মূলে এই প্রটোকল। আহমদ ছফা জীবৎকালে অভিজ্ঞতা ‍দিয়ে জেনেছিলেন, প্রশাসনযন্ত্রের ভেতরে বিদ্যমান এ জিনিসটি বড়ই শক্তিশালী। এ যুগে জনগণ বা শাসক আর রাজ্য পরিচালনা করেন না। কোনো এক তৃতীয় শক্তি সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। তার বলয় ভেঙে কখনো কখনো শাসকেরাও বেরিয়ে আসতে ব্যর্থ হন।

আহমদ ছফার কবি ও সম্রাট এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তকরবীর প্রধান দুটি চরিত্র আদতে একই চরিত্রের দুই রূপ বৈ নয়। রাজা আর নন্দিনী আপাতদৃষ্টে পৃথকপ্রাণ মনে হলেও আদতে তারা একজন মানুষেরই দুই রূপমাত্র। এই দুই রূপে কবি আর সম্রাট একটি মানুষেরই স্বরূপবিশেষ। প্রতিটি মানুষের মধ্যকার দোলাচল, দোটানা ও বহুরূপী ভাবই প্রকাশ পেয়েছে বিপরীত দুটি চরিত্রের যূথবদ্ধ উপস্থাপনায়। তাই রাজা-নন্দিনী অথবা সম্রাট-কবির মাঝে ঘুরেফিরে একই বোধ খেলা করে। ব্যক্তিমানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা আর বাস্তবতার দোলাচলই দৃশ্যমান হয়েছে কবিতা আর নাটকএই দুটিতে।

পরিশেষে একটি বিন্দুতে এসে আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আহমদ ছফাকে আলাদা করার অবকাশ পাই। কবিগুরু ইচ্ছার শক্তিকে মহান করেছেনফুরসত পেয়েছেন স্বাধীনতারস্বাধীনতার সুখ দিয়েছেন আমাদের হৃদয়েও। অপরপক্ষে ছফা দেখতে চেয়েছেন, কী করে বাস্তবতার কাছে ইচ্ছাশক্তি পরাজিত হয়। জগৎসংসার কী করে নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া। হয়তো তিনি আবুল হাসানের ভাষায় সম্রাটকে বলতে চেয়েছেন:

ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও
ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও।
[হাসান ২০১৮]

হয়তোবা তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন, স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তাটা কোথায়। নৈরাশ্যের নীলে আমাদের ভাসিয়ে নতুন সূর্যোদয়ের দীক্ষা দিতে চেয়েছিলেন তিনি। যেন আমরাই হয়ে উঠতে পারি রঞ্জন।

তথ্যপঞ্জি

১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর. রবীন্দ্র রচনাবলি, ৬ষ্ঠ খণ্ড [কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ১৯৮৫]।
২। আহমদ ছফা, আহমদ ছফা রচনাবলি, ৩য় খণ্ড [ঢাকা: খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি, ২০০৮]।
৩। আবুল হাসান, রচনাসমগ্র [ঢাকা: বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৮]।