মহাভারতের সঞ্জয় রফিক আজাদ!
দুদিক থেকে তাঁকে চিনি। তিনি কবি। তিনি মুক্তিযোদ্ধা। পারিবারিকভাবেই তিনি আমাদের চেতনায় যুক্ত ছিলেন। কিন্তু খুব যে গেছি তাঁর বাড়িতে/বাসায়, তিনি এসেছেন আমাদের বাড়ি/বাসায়, তা নয়—খুবই কম, কড়ে আঙুলের সব কটি দাগও পুরো হবে না আমাদের যাতায়াতের সংখ্যা। কিন্তু মনের ভেতরে একটি সম্পর্ক-সেতু অনুভব করতাম তাঁর সাথে। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগে আমি তাঁর ক্লাসের ছাত্র ছিলাম। তিনি ছিলেন সরাসরি আমার শিক্ষক/গুরু। মুক্তিযুদ্ধের পর আমি মওলানা মোহম্মদ আলী কলেজ থেকে ঢাকা কলেজে চলে আসি। আর তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন। সেই থেকে তিনি আমাকে ‘বেটা’ ডাকেন। আমি ডাকি ‘গুরু’। এই সম্পর্ক আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে কোনো কাজ করেনি বা সে-রকম কিছু ঘটেনি। তবু গুরু-শিষ্যের মধ্যে যে দূরত্ব, তা কিন্তু ছিল না।
‘আমার পদ্যপ্রবন্ধের মধ্যে যেগুলো ঈষৎ দীর্ঘ এবং যে সকল লেখায় আত্মগত উচ্চারণ অপেক্ষাকৃত কম সেগুলোকে একটি গ্রন্থ-পরিসরে ধ’রে রাখার লক্ষ্যে এই প্রয়াস।’ ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘গদ্যের গহন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া আমি এক দিগভ্রান্ত পথিক’ বইয়ের সূচিপত্রের আগের পাতার নিচের দিকে কয়েকটি বাক্য তিনি জুড়ে দিয়েছেন। ভূমিকা শব্দটি মস্তকে না থাকলেও ধরে নিতে কষ্ট হয় না যে, এটি ভূমিকা। ‘এই বইটির জন্যে সামান্য মুখবন্ধের প্রয়োজনে এই গদ্য।’—বলেছেন তিনি। গদ্য লিখতে অনীহ ছিলেন তিনি। সে আমরা বুঝতে পারি যখন দীর্ঘ শিরোনামের এই কবিতা সংকলনে তিনি কমা-সেমিকোলন সহযোগে মোট পাঁচটি বাক্য লিখেছেন। এই পাঁচ বাক্যেই তিনি নিজের কথাগুলো বলেছেন। যে-সব শব্দ তিনি বলেননি, তা-ও যেন অন্তরে ঝিলিক দিয়ে উঠেছে। ‘দীর্ঘ রচনার জন্যে আমি দেহ-মনে এখনো তৈরি হইনি; স্থূল দেহে উচাটন মন দীর্ঘ শিল্পকর্মের পরিপন্থী। যদি কখনো, কোনোদিন, সুঠাম সুদেহী হই এবং অচঞ্চল ও অকাতর মনের অধিকারী হ’তে পারি তবেই চেষ্টা ক’রে দেখবো।’
না, তিনি তাঁর উচাটন মন অচঞ্চল করতে পারেননি, তাই দীর্ঘ রচনাও তিনি নির্মাণ করতে পারেননি। তাতে কি কোনো ক্ষতি হয়েছে? এর উত্তর তাঁর পাঠকেরাই বুঝে নেবেন।
মোট ২৮টি কবিতা গ্রন্থিত হয়েছে এ-বইয়ে। তাঁর কথার বিপরীতে আমার উপলব্ধি লিখতে চাই। ৭৬ পৃষ্ঠার বইয়ে ২৮টি কবিতা দেখলেই আমরা বুঝে নিতে পারি রফিক আজাদের উচাটন মনের অচঞ্চলতা কতটা। এবং যে-সব কবিতায় তাঁর ‘আত্মগত উচ্চারণ অপেক্ষাকৃত কম’ সেগুলোই তিনি এ-বইয়ে স্থান দিয়েছেন। কিন্তু আমি বইটির ‘পদ্যপ্রবন্ধ’গুলো পাঠ করতে গিয়ে অনুভব ও উপলব্ধি করলাম, কবি তাঁর আত্মগত কথাই নির্মাণ করেছেন এ-সব কবিতায়।
‘পরিকীর্ণ পানশালা আমার স্বদেশ’ শিরোনামের প্রথম কবিতাটিকে মনে হতে পারে এটি ‘একটি পানশালার গল্প’। হ্যাঁ, অনেকটা তাই। তিনি এ-কবিতায় সেই পানশালার চিত্রই এঁকেছেন নানা বর্ণিল শব্দের সহযোগে। তিনি পরিকীর্ণ পানশালাকে তাঁর স্বদেশের সাথে তুলনা করেছেন। কিন্তু আমরা কি গোটা দেশটিকে ‘পানশালা’ ভাবতে পারি? দেশের মানুষেরা কি মাতাল হয় প্রতিদিন? না, এমনটা সত্যও নয়, বাস্তবও নয়। তাহলে রফিক আজাদ কেন পানশালাটিকে তাঁর ‘স্বদেশ’ বললেন? এই শিরোনাম আমাদের মনের ভেতরে আন্দোলন সৃষ্টি করে। একজন মুক্তিযোদ্ধা, দেশের স্বাধীনতার জন্য যিনি আত্মত্যাগ করেছেন, তিনি কেন তাঁর স্বদেশকে একটি মাতাল পানশালা হিসেবে বর্ণনা করবেন? আমরা কি তাহলে ধরে নেব, কোনো কারণে তিনি স্বদেশকে পানশালার সাথে উপমিত করেছেন? স্বদেশকে প্রতীকায়িত করেছেন পানশালার সঙ্গে? কেন?
এই ‘কেন’র উত্তর পেতে হলে এই কবিতার সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত, রাজনৈতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ব্যক্তির অনিশ্চিত জীবনের বিষয়টি মনে রাখতে হবে। ব্যক্তি মানুষ তার সমাজকাঠামোর অন্তর্গত, তার ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতরে তার বাস। রফিক আজাদ তার বাইরে নন, ছিলেন না। আমরা পড়ে দেখি তিনি কীভাবে শুরু করেছেন কবিতা।
এ-কবিতায় উদ্ধৃত হয়েছে জর্জ হাবাশের একটি পঙ্ক্তি, ‘নো বডি ইজ ইনোসেন্ট, নো বডি ক্যান বি নিউট্রাল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড অব টুডে’। এই কথাগুলোর মানে হচ্ছে, কোনো মানুষই নির্দোষ নয় এই পৃথিবীর। সবাই কম-বেশি দোষী। পৃথিবীতে কেউ-ই নিরপেক্ষ নয়। সবাই কোনো না কোনো পক্ষের মানুষ। তার মানে সেই মানুষ কোনো রাজনৈতিক পক্ষের না হয়েও তিনি তাঁর নিজেরই অলক্ষ্যে কারও না কারও, কোনো না কোনো রাজনৈতিক পক্ষের লোক। আমাদের প্রচলিত সমাজকাঠামো ও রাষ্ট্রযন্ত্র সেই অবকাঠামোই নির্মাণ করেছে। সেই কাঠামোর ভেতরে ব্যক্তি-মানুষ বাস করে। ওই কাঠামোর ভেতরেই সাধারণের কাজ-কর্ম ও জীবনের কল্যাণ ও ভালো-মন্দ বিষয়ে চিন্তার রূপ ভাবনায় রূপ পায়। মানে ব্যক্তিকে সেই সামাজিক কাঠামোর ভেতরে বন্দি করে রাখে। তার চিন্তাশীলতাও সেই আকারেরই অধীন। এটা সাধারণ মানুষ তেমনভাবে উপলব্ধি করতে পারে না। কারণ, তার চিন্তাশীলতাও ওই অদৃশ্যপ্রায় কাঠামোর অন্তর্গত। আর ব্যবস্থাটি এমন কাঠামোর মধ্যে নিহিত যে তার রূপ আমাদের মনে কোনো প্রশ্ন তুলতে দেয় না। সামাজিক ও রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে বাস বলে এ-দুই কাঠামোর যে দগদগে ঘা, চিড়-ধরা ফাটল, অনৈক্য ও অসততা, সাংস্কৃতিক বিভেদ ও বিভাজন, জাতিসত্তাগত বিরোধ ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের ঘেরাটোপের ফলে জনমনে নিহিত অসন্তোষ—ইত্যাদি শাদা চোখে দেখা যায় না। আবার সে-সবের কিছুটা অনুভব করা গেলেও তাকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অপকর্ম বলে মনে করার মধ্যেও নিহিত থাকে সেই ভয় ও ভীতির, যা সাধারণত কেউই উসকে দিতে চায় না। কিন্তু ব্যক্তির চেতনা তো কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে বন্দি নয়। সে স্বাধীন। কিন্তু সেই ব্যক্তি যদি সাহস নিয়ে কথা বলেন, তাহলে নতুন যে পরিস্থিতির জন্ম হয়, তার নমুনাও আমরা দেখেছি। আবার সেই ব্যক্তি যদি হন কবি, তাহলে তার স্বাধীনতায় কেউই হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কবি লিখে চলেন তাঁর মনের কথাগুলো তাঁর প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য প্রতীকী উচ্চারণে—
চাঁদরাতে উপচে-পড়া পানশালা গুঞ্জনে মুখর
চাঁদরাত মানে রমজান বা রমাদান মাসের শেষের সন্ধ্যায় যে নতুন চাঁদ ওঠে—সেই রাতটি চাঁদরাত। এই চাঁদরাতেই মহানগর ঢাকার একটি পানশালা গুঞ্জনে মুখরিত। পরিবেশ যে মদ আর রাজনৈতিক আড্ডার কেন্দ্র, তা বোঝাতেই গুঞ্জনের সাথে মুখর শব্দ প্রয়োগ করেছেন কবি রফিক আজাদ।
পাঁচদিন আগে বহু প্রতীক্ষিত পঞ্চম সন্তান
মায়ের শ্যামল কোল আলো ক’রে ভূমিষ্ঠ হয়েছে;
তোমরা কেউ ভিন্ন নও, অভিন্ন হে পুত্রকন্যাগণ,
কারো প্রতি বিন্দুমাত্র কম আবেগ আমার নেই,
আমি পিতা; তোমরা আমার প্রিয় সন্তানেরা
ভিন্ন দুই ঠিকানায়, আপাতত, এখন রয়েছো;
প্রত্যেকের প্রতি আছে রক্তের উচ্ছ্বাসময় এক
অভিন্ন আবেগ:
সম্পূর্ণ পৃথক দুই মাতৃগর্ভে তোমরা জন্মেছো,
তবু একই রক্ত প্রবাহিত সকলের ধমনিতে,
শিরা-উপশিরা ব্যেপে একই তো আবেগ…
একজন পিতা হিসেবে তিনি সন্তানদের প্রতি তাঁর অকপট ভালোবাসার কথাই বলেছেন এখানে। তিনি বলেছেন, তোমরা অভিন্ন; কারণ, একই রক্তধারা বইছে তোমাদের রক্তপ্রবাহে। যদিও দুই মায়ের গর্ভে জন্মেছে তারা, তবু সবকিছু সমান। পিতার প্রেম-ভালোবাসা, আবেগ কারও জন্য কম-বেশি নেই। কেন তিনি এ-কথা বললেন? কারণ, কি তাঁর সন্তানেরা পিতার ভালোবাসা, আবেগের ঊনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল কী? পঞ্চম সন্তান জন্ম নিয়েছে পাঁচ দিন আগে। সেটা তথ্যই কেবল নয়, হয়তো তারও রয়েছে এক পারিবারিক স্তরের কারণ।
এর পরে রফিক আজাদ নির্মাণ করেছেন পানশালায় আগত পৌঢ় মাতোয়ালদের কথোপকথনের যথার্থ সামাজিক বর্ণনা। পৌঢ়রা সব সময় বিগত যৌবনের গল্প আর রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ নিয়ে মেতে থাকে। সেই সাথে থাকে যৌনতার রেশ...ভিসিআর, নীলছবি, উত্তেজক শিকড়ের কথা। এই পরিকীর্ণ পানশালার উড়ে আসা কথামালার এক ফাঁকে রফিক আজাদ নিজের দিকে ফেরেন।
নিজেরই ভেতরে বসে প্রশ্ন করে অপর পুরুষ:
‘তুমি কি কেবলই বেহেড মাতাল এক, নাকি পিতা?’
পিতা আমি অবশ্যই বটে,...এদেশে, রোরুদ্যমান
এই ভিখিরির দেশে পাঁচ/ পাঁচটি সন্তানের আমি
গর্বিত জনক...
এই ব্যক্তিগত বর্ণনার পর রফিক আজাদ পাশের টেবিলের ক’জনের কথা বলেন, যারা সিগনিফিকেন্টলি
‘বাম দিকে’ বসে আছে।
তারা খুবই মূল্যবান মতামত রাখে:
‘এই দেশ ক্রমশই বিদেশি ঋণের বেড়াজালে
জড়াচ্ছে নিজেকে...পরনির্ভরতা ছাড়া
যেন কোনো পথ নেই! এদেশের ভবিষ্যৎ খুব
গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা’...
অর্থনীতি বিষয়ে অনেক কিছু তারা বলে থাকে, এবং তা যথার্থই বলে...
‘দু/একটি টেবিলে অবশ্যই কিছু কিছু লোক শুনি
বাজেটের পক্ষে খুব বক্তব্যে সোচ্চার!
এরাই পরান্নভোজী,
সত্যিকার মধ্যবিত্ত, বিশ্বাসঘাতক!
এখানে তিনি স্পষ্ট এবং অকপট। বাজেটের পর সাধারণ মানুষও তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। আর পানশালার লোকেরা তো আর রাস্তার লোক নন, একেবারে প্রজ্ঞাহীন নন, তাদের বিচার ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আছে এবং পানশালার আবহ ও মদের ক্রিয়ায় তারা অকপটে তাদের হৃদয় নিংড়ানো কথা বলে থাকেন। আর আমরা এটা জানি যে সমালোচকগণের শ্রেণি মূলত নিজেদের স্বার্থটাই বেশি দেখেন। জনগণের নামে তারা সোচ্চার হন, তাদের জন্য আর্ত-হৃদয়ে চারপাশে ঢেউ তোলেন কথার, প্রতিবাদী কথার, রাজনৈতিক সরকারের সমালোচনায় মুখর হন। এরাই দেশের তথাকথিত মধ্যবিত্ত এবং এই সুবিধাবাদীরা চরিত্রগতভাবে ‘বিশ্বাসঘাতক’।
কেন রফিক আজাদ যথার্থ বলেছেন? কারণ, আমরা যদি দেশের রাজনৈতিক সমাজের, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্যাটার্ন দেখি, তাহলে এদের ৮০ শতাংশই এসেছে উচ্চাভিলাষী মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে। যদিও আমাদের দেশে প্রকৃত প্রস্তাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেনি কখনোই, নানা রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিবেশ ও অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার কারণে। তার একটি হচ্ছে শিল্প তথা ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প স্থাপন করে যারা নিজেদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তারা ধীরে ধীরে, পরিশ্রমের ভেতর দিয়ে নিজেদের উন্নতির ওই স্তরে নিয়ে আসেনি। যে স্ট্রাগল ও শ্রম বিনিয়োগের পর সামাজিক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে ওই শ্রেণিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কথা, তা হয়নি। হয় তারা শিল্প সেক্টরে ‘বামন’-পতি হয়ে আছেন, নয়তো রাতারাতি প্রচুর বিত্তের অধিকারী হয়ে উঠেছেন। ফলে এদের কারোরই সামাজিকভাবে মধ্যবিত্তবান ও উচ্চবিত্তবান হয়ে ওই স্তরে আসতে হয়নি। আমাদের সমাজটি তাই ‘দলকচড়া’ হয়ে আছে। এদেরকে আবার ‘ত্রিশঙ্কু’ শ্রেণি হিসেবেও বর্ণনা করা যায়। তাঁরা সত্যিকার অর্থে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের সাংস্কৃতিক চেতনায় ও মননশীলতায় পৌঁছাতে পারেননি, আবার মধ্যবিত্তের চারিত্র্যধর্মও ছাড়তে পারেননি তাঁরা। এ-জন্য দেখা যায়, ওই ব্যবসা-শিল্পপতি শ্রেণি রাজনৈতিক দল বদলের ক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতা করতে দ্বিধান্বিত হয় না। হতদরিদ্রদের সম্পদ লুটে নিতে তাদের হৃদয়ে কণা পরিমাণ দ্বিধাও জন্মে না। আমাদের সমাজে, এ-রকম বহু উদাহরণ আছে। আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিএনপি ও জাতীয় পার্টিতে যাঁরা দলবদল করেছেন, তাঁরা বিশ্বাসঘাতকতাই করেছেন নিজের সাথে, সমাজের শ্রেণির সাথে এবং জাতির আকাঙ্ক্ষার সাথে। এ-কারণেই রফিক আজাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে মধ্যবিত্তকে মার্ক দেওয়াটা যথার্থ বলেই আমি মনে করি।
আমার দুঃখটি খুব ব্যক্তিগত এবং পবিত্র,
…
আমার বৈভব নেই, কিংবা এমন যোগ্যতা নেই
কোনো বহুজাতিক সংস্থার জৈষ্ঠ্য কর্মকর্তা হয়ে
দেশী কর্ণধারদের বিলাসোপকরণ যুগিয়ে
আমিও গোছাতে পারবো নিজের আখের!
কেনই বা করবো তা, আমি মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক—
আমার শিরায় আছে বিদ্রোহের প্রজ্ঞা ও সাহস।
সত্য সব সময়ই নির্মম হয়। রফিক আজাদ সেই সত্যই নির্মাণ করেছেন তাঁর এই কবিতায়। এ-দেশে সত্য উচ্চারণ বড়ই কঠিন। সাহস ছাড়া, দ্রোহী প্রজ্ঞা ছাড়া সত্য বলা ও সত্য লেখা বা উচ্চারণ করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের নিম্নবিত্তের সমাজ, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তবানদের সমাজকাঠামোতে কোনো উদার মানবিকতার স্থান নেই। জবাবদিহির কোনো আবহ ও চেতনা নেই। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা বা ভিন্নমতকে গ্রহণ করার মতো সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও স্পেস নেই তাদের মননে ও মানসে। ফলে, সামাজিকভাবে আমরা টাইরান্ট-মননের, মানসিকভাবে আমরা কর্তৃত্বপরায়ণ। সামাজিক চেতনায়, প্রশাসনিক কর্ম-সম্পাদনায় কিংবা সাংস্কৃতিক চৈতন্যে আমরা মানসিকভাবে দুর্নীতিপরায়ণ। কোনো যুক্তিই আমাদের রাজনৈতিক মত ও আচরণকে পরিশীলিত করতে পারেনি। প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও অর্থনৈতিক গোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো।
রফিক আজাদ যে অহংকারের কথা বলেছেন, সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও এখন দলান্ধ করে ফেলা হয়েছে যার যার রাজনৈতিক চেতনার মিথ্যাচারিতার পরিপ্রেক্ষিত থেকে। তার নিজের লাভ বা তার দলের লাভই তাদের লক্ষ্য। ফলে অনন্যসাধারণ এক গৌরবের ইতিহাসটি এখন ভিন্ন ভিন্ন খন্ডিত ও বিকৃত ইতিহাসের দখলে চলে গেছে। তারপরও এটাই সত্য যে—
আমি মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক—আমার চেতনা জুড়ে
স্বাধীনতা, স্বাধীনতা।
আমার চিন্তার ক্ষেত্রে, অবচেতনেও, অর্থ-
নৈতিক মুক্তির স্বাদ লেগে থাকে।
আমার সন্তান কেউ সামরিক পোশাক পরবে না,
দরকার হলে তারা, অবশ্যই, পিতার মতন
জলপাই রঙ মুক্তিযুদ্ধের পোশাক তুলে নেবে
প্রথম পছন্দ বলে—
রফিক আজাদ তাঁর চেতনায় বিশ্বাস আর সন্তানদের কাছে তাঁর চাওয়া বা প্রত্যাশিত বিষয় নিয়ে ভেবেছেন। তারই বর্ণনা আমরা পাই উল্লিখিত পঙ্ক্তিগুলোয়। এর পরের স্তবকটি দীর্ঘ। এই স্তবকে তিনি বর্ণনা করেছেন টেবিলে টেবিলে বসে থাকা মাতালদের ব্যক্তিগত বিষয়। ‘এই রাতে দূরাগত শব্দে জেগে ওঠে প্রত্যেকের/ মনের ভেতরে এক সমুদ্রপুরুষ—/ কোলাহল করে ওঠে প্রত্যেকের মধ্যে আস্ত এক বঙ্গোপসাগর;/ সমুদ্রের নীল জলরাশি আজ এই অবাস্তব/নগরে ঢুকেছে—/ মানুষের ভিতর মহলে, গহন গহ্বরে, জাগে/ দুঃখ ও দুঃখের খুব নিবিড় অসুখ,/ এইখানে সমবেত প্রতিটি মানুষ বেশ কটি/ পেগ ও ক্যানের পর/ নিজেদের ভেতরের সব খোলস ছাড়াতে থাকে—/…প্রত্যেকে ভেতরে দুঃখী,/ দুঃখের উত্থান মাপে ব্যক্তিগত নেশার নিক্তিতে,/... আমারও ভেতরে এক খুব দুঃখী নাবিক রয়েছে—
এই বর্ণনার যেন শেষ নেই। এরপরের স্তবকের পর একটি হ্রস্য স্তবক আছে এবং তারপরই এ-কবিতার প্রথমাংশ শেষ হয়। আমি শেষ স্তবকে চারটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে দেখাতে চাই যে রফিক আজাদের এই বর্ণনাত্মক কবিতার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য কোথায় লুকিয়ে আছে।
তবে কি সঞ্জয় নই?—দিব্যদৃষ্টিহীন
জন্মান্ধ জনক এক ধৃতরাষ্ট্র আমি,
স্বাদেশিক কুরুক্ষেত্রে
অশ্রুত, অনবহিত—জন্মান্ধ জনক?
এই চারটি পঙ্ক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ-কারণে যে এতে নিহিত আছে কবির অভীপ্সার সংগুপ্ত সংশয়। তিনি ভাবতেন, তিনি সঞ্জয়। সঞ্জয় মহাভারতের এক চরিত্র, যিনি দিব্যদৃষ্টির অধিকারী, ব্যাসদেবের দিব্যচক্ষু লাভ করেন। তিনি অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সারথী। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বর্ণনা করেন তিনি দিব্যচোখে দেখে অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে।
রফিক আজাদ সেই মহাভারতের সঞ্জয় মনে করেছিলেন নিজেকে। কিন্তু তিনি যে সঞ্জয় নন, সেটা তিনি জেনেছেন। এবং তিনি ‘দিব্যদৃষ্টিহীন/ জন্মান্ধ জনক এক ধৃতরাষ্ট্র, আমি,/ স্বাদেশিক কুরুক্ষেত্রে/ অশ্রুত, অনবহিত—জন্মান্ধ জনক? এটাই কি সত্য?
সংসারের এবং পরিবারের বা স্বদেশের ‘কুরুক্ষেত্রে’র তিনি শ্রোতাও নন, তাঁর নেই কোনো সঞ্জয়, যিনি বর্ণনা করবেন স্বদেশে চলমান ‘কুরুক্ষেত্রের’ বর্ণনা, যুদ্ধের চিত্র। অর্থাৎ তিনি চলমান রাজনৈতিক ও হানাহানির গোপন সামরিক তৎপরতার কিছুই উপলব্ধি করতে পারবেন না। গোটা দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পরিবেশের ক্ষতাক্ত অবস্থা তিনি অনুধাবন করতে পারছেন না। অথচ ‘কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলমান’। ভ্রাতৃহননের নিষ্ঠুর যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধরত দুই পক্ষই যে মানবিকতাশূন্য হয়ে পড়েছে এবং তারা ক্ষমতার লোভে নগ্ন-লালসায় উন্মত্ত, তারই রক্তাক্ত স্টেজ পারফরম্যান্স যেন চলছে দেশের সর্বত্র।
এ-কবিতার দ্বিতীয় পর্য়ায়ের সূচনাও হয়েছে প্রথম স্তবকের মতোই চাঁদরাতের আবহে।
কাল ঈদ। আজ এই চাঁদ-রাতে দেখি
পোশাকের ক্লেদ ঝেড়ে ফেলে
কেউ-কেউ এখানে এসেছে—
তাদেরও থাকতে পারে
একান্তই ব্যক্তিগত ব্যথা ও বেদনা
ক্রীতদাসত্বের শক্ত নিগড় গুঁড়িয়ে
কেউ কেউ এইখানে, মাঝে-মধ্যে আসে।
এ-ভাবেই কবি রফিক আজাদ তাঁর পরিপার্শ্বস্থ মাতোয়ালদের বর্ণনা দেন। তাদের মধ্যে সমাজের কেষ্টবিষ্টুরাও আছেন। আসেন তাদের মধ্যে শাসক ও শাসিত, বেষ্টি ও সমষ্টির বেড়া ডিঙিয়ে। তিনি বলেছেন এখানে বিশিষ্ট কেউ নন, সবাই নির্বিশেষ।
অজগর আর নধর ছাগলছানা উভয়েই এইখানে
সমান মর্যাদাবান।
এখানে এসেছে দ্যাখো প্রতিক্রিয়াশীল বাজেটের
ভুক্তভোগী আর অন্ধ বাজেট প্রণেতা—
একটি পর্যায়ে দেখি প্রতিটি টেবিল হয় ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপ—
প্রত্যেক টেবিলে, বলা যায়, দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে
শ্রুতির মধুর গাঢ় গন্ডোলায় যোগাযোগ চলে।
একে অপরের কথা শোনে: ঘৃণিত ও ঘৃণাকারীর ভিতরে
মত বিনিময় চলে।
রফিক আজাদের এ-সব পঙ্ক্তির প্রচলিত বা সারফেস স্ট্রাকচারের অর্থ আমরা জানি বা উপলব্ধি করতে পারি। কিন্তু এ-সব পঙ্ক্তির ডিপ স্ট্রাকচারে রয়েছে যে গূঢ়ার্থ, তা কি খুব সহজে উপলব্ধি করতে পারি? না, পারি না। কারণ, গূঢ়ার্থ নানামাত্রিক অর্থ জারি করে। তার অভ্যন্তরে ঢুকতে হলে প্রয়োজন গভীর অভিনিবেশ ও অনুসন্ধিৎসু মন। আমি সে বিষয়ে আলোচনায় যাব, তবে তার আগে সারফেস স্ট্যাকচারের অর্থ চেখে দেখা যাক।
পানশালায়, ছোট বড় বা ভক্ষক ও ভক্ষিত সমান মর্যাদাবান বলেছেন রফিক আজাদ। আমরাও সেটা জানি ও বিশ্বাস করি। পানশালায় যে সামাজিকতা তাই দেখছেন রফিক আজাদ। কারণ চাঁদরাতে, পানশালায় প্রতিক্রিয়াশীল বাজেটপ্রণেতা ও ভুক্তভোগী প্রতিবাদী সাধারণ মানুষ উপস্থিত হলেও কোনো রকম বিবাদ বাধে না; বরং প্রতিটি টেবিল যখন একেকটি দ্বীপে পরিণত হয়, তখন ‘শ্রুতির গাঢ় গন্ডোলায় যোগাযোগ হয়। এটাই আমাদের মতো সমাজ-সংসারের প্রকৃত সত্য। এ-দেশে ধনী ও গরিবের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবধান আকাশ-পাতাল, এখানে শাসক ও শাসিতের ব্যবধানও বিপুল, কিন্তু যেকোনো পরিস্থিতিতে এই উভয়ই একই জায়গায় এসে মিলিত হয়। ওই মিলন বাস্তবতা নয়, ওটা নানা ঘটনার অনুক্রমে ঘটে থাকে।
২
এ-কবিতার দ্বিতীয় অংশ অঙ্কের ২ দিয়ে পৃথক করা হয়েছে। কিন্তু ‘৩’ চিহ্নিত অংশটির সূচনা চাঁদরাত দিয়ে হয়নি। এই অংশে আত্মগত বর্ণনা কবিকেই উপস্থাপন করেছে।
এইখানে কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ
পড়ে থাকে—কবিতারা উধাও হয়েছে।
কবির জীবন ছিলো নিরুদ্দিষ্ট কবিতার পাতায় পাতায়:
ছিন্নভিন্ন, ছেঁড়াখোঁড়া, দীর্ঘশ্বাসে-দীর্ঘশ্বাসে খুব
দীর্ণ ও উবুড়।
…
অতএব, কুম্ভের জাতক এই ব্যর্থ পিতা—শব্দের মাতাল—
একদিন রেখে যাবে শূন্য হাতে অগণন শূন্যের গহ্বর।
পানশালায় কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ রয়ে গেছে, কবিতাগুলো নিরুদ্দিষ্ট বলেছেন কবি। যে-সব কবিতা হারিয়ে গেছে, সেগুলোতেই ছিল কবির দুঃখ-বেদনার রূপারূপ। তিনি সারা জীবনের অর্জিত ‘দুঃখের আরক’ নিজের হাতে ঢেলে দিয়েছেন। এই যে দুঃখ আমরা জানি, তার উৎস তারই পরিবার, তারই সন্তান এবং সামাজিক ভুলের জারকে ঠাসা।
শেষ দুটি পঙ্ক্তিতে রফিক আজাদ বলে দিয়েছেন তিনি ‘শব্দের মাতাল’, তিনি পানশালার মাতাল নন। তিনি রেখে যাবেন অগণন শূন্যের গহ্বর।
শূন্যের নানান মাত্রা আছে। নীল রঙের আকাশ হচ্ছে শূন্যেরই দৃশ্যমান কিন্তু শেপলেস/ ফর্মলেস ব্যাসার্ধ। আবার ওই শূন্য, ব্যাসার্ধহীন শূন্যকে নিরাকার বা আকারহীন এক মহাক্ষমতাবানের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
শূন্য শব্দটি সামাজিক, কিন্তু এর গূঢ়ার্থ রয়েছে। আর সেই গূঢ়ার্থই রফিক আজাদের কবিতায় যেন উঠে এসেছে এই ব্যক্তিগত চেতনায়।
৩
‘রফিক আজাদ’ নামের কবিতাটিকে তিনি বেছে নিয়েছেন এ-বইয়ের দ্বিতীয় কবিতা হিসেবে। ‘পরিকীর্ণ পানশালা আমার স্বদেশ’-এর পর রফিক আজাদ নিজের নামের কবিতাটি বেছে নেওয়ায় তাঁর মানসিক প্যাটার্নটি চেনা ও বোঝা সহজ হয়েছে। কারণ, এই ক্লিন্ন কবির চেতনার সাথে এ-কবিতা মনোবাস্তবে সন্নিহিত। আত্মগত কথামালায় সজ্জিত এ-কবিতা। তিনি নিজের কথাই বলেছেন এখানে।
অত্যন্ত অপরিচিত লাগে এই নাম,
বাবা-মা’র নাম ফেলে
নিজেকে নতুন করে
তৈরি করতে গিয়ে
কী করে যে কবে বেছে নিলাম স্বেচ্ছায়
দুঃখময়, ক্লিন্ন এই উদ্বিগ্ন জীবন!
কী করে কখন যেন অসামান্য তৃষ্ণা জেগে গ্যালো
হৃদয়ের নিভৃতে, গোপনে—অতিশয় সাধারণ
হাবাগোবা কদাকার বালকের বুকে…
এ-এক রকম স্বীকারোক্তি নিজের চিন্তা, নিজের শারীরিক, মানসিক এবং তার ভাষায় ‘ক্লিন্ন এই উদ্বিগ্ন জীবন’ সম্পর্কে। এই স্বীকারোক্তি অবশ্যই পরিকীর্ণ পানশালা আমার স্বদেশ-এর সাথে সমন্বিত করা যায়। যেহেতু ওই কবিতাটি একান্তই ব্যক্তিগত ও সামাজিকতা পূর্ণতায় ঋদ্ধ, তেমনি রফিক আজাদ কবিতাটিও শুরু হয়েছে আত্মগত সংকটের উৎস উল্লেখ করে। মা-বাবার নাম ফেলে দিয়ে তিনি নিজেই নিজের নাম রেখেছেন, কিন্তু আজ তাঁর মনে হচ্ছে এ-নামটি অত্যন্ত অপরিচিত লাগছে। নিজেকে তিনি এ-নামে যেন চিনতে পারছেন না।
তিনি ফিরে যেতে চান তাঁর বাবা-মা’র দেওয়া নামে। কেননা, সেই নামেই যেন সুখ লেখা আছে। এই কবিতায় তিনি বাবা ও মায়ের কাছে তাঁর কথাগুলো বলেছেন। ‘বাবা, তুমি কি আমাকে কোনো শাপ দিয়েছিলে?/ মা, তোমার মনের গভীরে কোনো ক্ষোভ ছিলো,’— এই রকম আকুতিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েই তিনি রচনা করেছেন তাঁর এ-কবিতা। সাধারণভাবে আমরা ধরে নিই যে প্রায় নিরেটগদ্যে লেখা তাঁর কবিতাগুলো কেবল বক্তব্যপ্রধান এবং খানিকটা রসহীন। কিন্তু যে আকুল আকুতি আমরা লক্ষ করেছি পরিকীর্ণ পানশালা আমার স্বদেশ-এ, তার নবরূপায়ণ যেন পাই ‘রফিক আজাদ’-এ।
তাঁর মনে শান্তি ও স্বস্তি নেই আর রফিক আজাদ নামে। তিনি পিতামাতার দেওয়া নামে ফিরে যেতে চান। সে-কথাই উঠে এসেছে শেষ ক’লাইনে।
হে আমার পরিপার্শ্ব, আজ থেকে আবার আমাকে
বাবা-মা’র-দেয়া নামে ফিরে যাবার সুযোগ দাও না…
খুব ভালো হয় সেটা,
নির্ভার আনন্দে পুনর্বার জীবনটা শুরু করা যায়।।
এই দাবি বা এই প্রত্যাশার পেছনে আত্মপরিচয়ের বিষয়টি লুকিয়ে আছে। কেননা, তিনি নতুন নামে নিজেকে সাজালেও তা যেন রুটলেস হয়েছে। যেন সে নাম, রফিক আজাদ এই নামটি শিকড় গাড়তে পারেনি তারই সংসার জীবনে, তারই সাংস্কৃতিক জীবনে, তার যাপিত ও চর্চিত জীবনের ভেতর মহলে। তাই তিনি পুনরায় নতুন জীবন গড়ে তুলতে চান বাবা-মা’র নাম নিয়ে। এই চাওয়ায় কোনো খাদ নেই।
আমরা রফিক আজাদের এই চাওয়াটিকে প্রতীকী উচ্চারণ হিসেবেও দেখতে পারি। একে আমরা তাঁর সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ‘অস্তিত্বহীনতা’র পরিপ্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করতে পারি। অন্য বিবেচনাটি হতে পারে তাঁর সৃজনী প্রেক্ষিত থেকে। রফিকুল ইসলাম খান থেকে রফিক আজাদ হওয়ার এক আনন্দ ছিল এককালে। ওই চেতনার পশ্চিমা সাংস্কৃতিক প্রবাহের ঢেউটি আজ স্তিমিত হয়ে গেছে। এখন আত্মপরিচয়ের নামটিই প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। তাই তিনি ফিরে যেতে চান। আর দ্বিতীয় প্রেক্ষাপট থেকে বলা যায়, তিনি তাঁর নামের মতোই তাঁর সৃষ্টিশীলতাও গ্রহণ করেছেন ভিন্ন প্রেক্ষাপটের আধার থেকে। তিরিশি কবিদের হাত ধরে যে ইউরো কবিতার বীজ রোপিত হয়েছিল বাংলা কবিতার মাটিতে, রফিক আজাদ সেই সৃষ্টিবেদনারই সমর্থক ছিলেন এবং আজও তা বহন করছেন। সেই ইউরো-ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে তারই পুরোনো সাংস্কৃতিক-মনোত্বাত্ত্বিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসতে চান। এই প্রত্যাবর্তন, আমাদের বিবেচনায় যথার্থ, কিন্তু এটা পরখ করে দেখতে হবে যে তিনি সেই প্রত্যাবর্তনের কী ফল সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ এই কবিতা রচনার পর তাঁর রচনায় কি বাংলাদেশের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক উপকরণ-উপাদানের ব্যবহার নতুন মাত্রায় শুরু হয়েছে? সে-বিষয়টি পরখ করা উচিত। তবে তার আগে রফিক আজাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার খোলনলচে দেশের জন্য, মাটির জন্য, মানুষের জন্য কেমন, তা-ও আমরা দেখে নিতে পারি। কারণ, আমার ধারণা ও বিশ্বাস প্রকৃত কবি, আজন্ম দ্রোহী। তাঁর সেই দ্রোহ প্রকাশের ভাষা হতে পারে অত্যন্ত নিম্নকণ্ঠ, প্রায় মিনমিনে গলায়, কিন্তু তার ওজন লক্ষ-কোটি টনেরও সমান। হতে পারে তার উচ্চারিত কথাগুলো বিদ্রূপাত্মক, ব্যঙ্গ-তরঙ্গায়িত ও শ্লেষের তীক্ষ্ণ কণায় গাঁথা। দেখা যাক, রফিক আজাদ নামক এক বিপ্লবী চেতনার, মুক্তিযোদ্ধার কলম ও মনন কী কী ধারণ করে আছে।
‘আমার বন্ধু বাবাটুন্ডে’ পাঠ করলেই বোঝা যায় রফিক আজাদের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক চেতনার রূপ। এই কবিতায় তিনি বাবাটুন্ডেকে একেঁছেন একজন প্রতিবাদী, স্বাধীন সত্তার মানুষ হিসেবে। স্বাধীন’ এই শব্দটি এমন এক দ্যুতিময় যে তাকে পাওয়ার জন্য কবিতার মানুষেরা, সৃষ্টিশীল মানুষেরা এবং প্রতিবাদী মানুষেরা জীবনপাত করে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে।
আমার বন্ধু স্যামুয়েল বাবাটুন্ডে
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী...
সে একজন কৃষ্ণকায় আফ্রিকান,
তার গায়ের মসৃণ কালো রঙ থেকে নিরন্তর
রূপসী রাত্রির উজ্জ্বলতা ঝ’রে পড়ে।
যেখানে বৈষম্য সেখানেই তার ক্ষীপ্র শরীর
নৃত্যপর প্রতিবাদ,
(তার প্রধান শিল্প মাধ্যম হলো: নৃত্য)
সে একজন প্রতিবাদী নৃত্যশিল্পী,
শরীরকে ব্যবহার করে সে বহুমাত্রিকতায়,
শাদাদের ভুল সভ্যতার বিরুদ্ধে সে
বুক চিতিয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো দাঁড়ায়;
কালো মানুষের প্রতি যে ঘৃণা শাদা চামড়ার মানুষদের, তারই প্রতিবাদে বাবাটুন্ডের প্রতিবাদ এক প্রশ্নবোধক হয়ে উঠেছে রফিক আজাদের এ-কবিতায়। এ-কবিতায় বাবাটুন্ডে অঙ্কিত হলেও আসলে কথাগুলোর মালিক রফিক আজাদ। রফিক আজাদের মনের ভেতরে ওই চেতনারই বীজ উপ্ত হয়ে আছে। বাবাটুন্ডে একবার তিন ঘণ্টার এক নৃত্যানুষ্ঠানে ফুটিয়ে তুলেছিলেন নামিবিয়াকে, শিকল ভাঙার গান বেজে উঠেছিল, সেই দিন। রফিক আজাদও কি সেই রকম সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শিকল ভাঙার চেষ্টা করছেন? না হলে বাবাটুন্ডেকে উপস্থাপন করবেন কেন? বাবাটুন্ডে কোনো বাস্তবের নামিবিয়ান মানুষ কি না, তা জানার চেয়েও এই সত্য আমরা জেনেছি যে, রফিক আজাদ ওই নামের গুণের বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন তাঁর রাজনৈতিক, মানসিক ও শৃঙ্খলমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে। আমাদের সমাজের যে কাঠামো, বাবাটুন্ডের নামিবিয়ার কাঠামোর মধ্যে কোনো ফাঁক নেই। উপনিবেশ-উত্তর নামিবিয়ার এবং বাংলাদেশের সমাজ-সংসারে যে ঔপনিবেশিক ‘হ্যাঙওভার’ [অপ্রীতিকর পরিণাম] ও কালচারাল হেগেমনি’র [সাংস্কৃতিক আধিপত্য] অন্তর নিয়ে চলছে, রফিক আজাদ সেটাই দেখাতে চেয়েছেন। এবং তিনি চান ওই আধিপত্য ভেঙে দিতে প্রতিবাদী, দ্রোহী হয়ে। তিনি চান যে সমাজে প্রচলিত অপ্রীতিকর পরিবেশ জন্মেছে এবং জমা হচ্ছে মানুষের মনে, তাদের সেই ক্ষুব্ধ তাড়নার ভেতরে যে বাংলাদেশ তার প্রকৃত মুক্তি খুঁজে পায়।
এ-বইয়ে বেশ কিছু কবিতা আছে, যা রফিক আজাদের বহুপঠিত কবিতা। যাঁরা তাঁর ‘সিগনেচার পোয়েম’ খোঁজেন, তাঁদের কাছে ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’, ‘চলে যাবো সুতোর ওপারে’, ‘নেবে স্বাধীনতা?’,’হাতুড়ির নিচে জীব’, ‘নত হও, নত হতে শেখো’ ‘পরিকীর্ণ পানশালা আমার স্বদেশ’, এবং ‘গদ্যের গহন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া আমি এক দিগভ্রান্ত পথিক’—এসব কবিতা রফিক আজাদের রাজনৈতিক মননের চিহ্ন মেলে ধরেছে। তিনি সারা জীবন কি চেয়েছেন, কোন তরক্কির মানুষ তিনি, কাদের পক্ষের চিন্তক তিনি বোঝা ও চেনা যায়। তিনি যে গণমানুষের কথাই নানান প্রতীকে, চিত্রকল্পের ব্যবহারে, অ্যালেগরিক্যাল বাঙ্ময়তায় ফুটে উঠেছে এবং তাঁর অপরাপর কবিতা এ-বইয়ের, অবশ্যই ভালো মানের বলেই মনে করি আমি।