প্রকাশ-অপ্রকাশের আড়ালে মুর্তজা বশীর
নিজের জীবন ও দর্শন বিভিন্ন আঙ্গিকে লিখে গেছেন এমন চিত্রশিল্পী বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। সে বেলায় শিল্পী মুর্তজা বশীর ব্যতিক্রম। ছবি আঁকার পাশাপাশি লেখালেখিতে তাঁর সহজাত প্রতিভা উল্লেখ করবার মতো। ছবি আঁকার পাশাপাশি সাহিত্য ও গবেষণায় মুর্তজা সারা জীবন ছিলেন তুমুল ব্যস্ত। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ ছাড়াও বাংলার হাবশী সুলতান ও টেরাকোটা গবেষণায় মুর্তজা নিজস্বতার ছাপ রেখে গেছেন।
নিজেকে নিয়েও প্রচুর লিখেছেন তিনি। তবে লেখার চেয়ে অনেক বেশি বলেছেন নিজের সময় ও কাজ সম্পর্কে। বিভিন্ন মাধ্যমে অনর্গল বলে যেতেন জন্ম থেকে শুরু করে শৈশবের হারানো স্মৃতি এবং ক্রমান্বয়ে বড় হওয়ার গল্প। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বর্ণনায় নাটুকে-আমুদে মনের পরিচয় দিতেন। সেখানে উঠে আসত দেশ বিভাগের পূর্ব সময়ের অজানা অধ্যায়ের কথা। সেই সাথে অবধারিতভাবে স্মৃতিকথায় জড়িয়ে থাকত পুরান ঢাকার গলিপথ এবং গ্যাস লাইটের মৃদু আলোয় সন্ধ্যারাতের গল্পগুলো। একই গল্প নানাভাবে নতুন ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করতে পারতেন। শোনা কথাগুলোই শ্রোতাদের কাছে মনে হতো, যেন নতুন করে শুনছেন।
নিজের জীবন এবং ঘটনাগুলো বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলতে ও লিখতে মুর্তজার এতটুকু স্মৃতিভ্রম ঘটেনি। বিশেষ করে নিজের জন্মবৃত্তান্ত বলবার ক্ষেত্রে মুর্তজা তাঁর পিতার মেরুন রঙের মরক্কান চামড়ার বাঁধাই করা ডায়েরি কিংবা মায়ের শাসন কোনো কিছুই উহ্য রাখেননি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যেত বিখ্যাত পিতা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র সাথে তাঁর অম্ল-মধুর মিথস্ক্রিয়ার খুঁটিনাটি। পিতার প্রসঙ্গেই আমরা শিল্পী মুর্তজাকে পাই একাধারে অকপট এবং আবেগী।
২০১৪ সালে মুর্তজার বয়স তিরাশি’র কোঠায়। সেই সময় বেঙ্গল ফাউন্ডেশন প্রকাশ করল শিল্পীর জীবনস্মৃতিমূলক গ্রন্থ আমার জীবন ও অন্যান্য। এক মলাটে মুর্তজা বশীরের সন্ধান পেলেন পাঠক ও শিল্পবোদ্ধারা। এটি মূলত শিল্পীর আত্মকথন সংকলন। হলেও বাংলাদেশের শিল্পকলা আন্দোলন ও ইতিহাসের আকর বলে চলে বইটিকে। মোট ৪৮টি অধ্যায়ে মুর্তজার স্মৃতি রোমন্থনে মূলত ছয়টি পর্ব মনোযোগী পাঠক চিহ্নিত করতে পারবেন। ছয় পর্ব হলো—মুর্তজার নিজের কথা, পিতা ও পুত্রের সম্পর্ক, মুর্তজার শিক্ষকগণ, মুর্তজার বন্ধু ও ঘনিষ্ঠজন, একুশে ফেব্রুয়ারি এবং বামপন্থী ভাবধারা আর চিত্রশিল্পী হিসেবে একাডেমিক্যাল আলাপ।
জীবনের গল্পগুলো মনে হয়েছে সেজানের আঁকা একেকটি আপেল। রঙের ঘনত্ব যার বিমূর্তাকে আড়াল করতে পারে না। মুর্তজার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের অবয়বে আছে এই পূর্ণ-অপূর্ণতার স্বাদ। এই অবয়বে তিনি কখনো হয়েছেন কখনো কবি, কখনো বিপ্লবী, কখনো প্রেমিক। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি কিংবা জানি না, মুর্তজা সেই অর্থে শিল্পী হতে চাননি। যে অর্থে পিকাসো, সালভাদর দালি, ভ্যান গঘ কিংবা পল গঁগা শিল্পী হতে চেয়েছিলেন। কিংবা আমাদের দেশের কাইয়ুম-রাজ্জাক-সুলতান প্রমুখ শিল্পী হবার জন্যই কাজ করে গেছেন। মুর্তজা বশীরের শিল্পীজীবনের পথে হাঁটার গল্পটা তাই বাকি সবার থেকে আলাদা।
মুর্তজা বশীর © ছবি: পরিবারের সৌজন্যে
২০১৬ সালে যখন ব্যক্তিগতভাবে মুর্তজা তাঁর বইটি আমাকে উপহার দিলেন, তত দিনে আমি শিল্পীকে নিয়ে নার্সিসাসে প্রজাপতি শিরোনামে জীবনালেখ্য লেখা শুরু করেছি। সেই সূত্রে বইটিতে উল্লিখিত প্রায় প্রতিটি ঘটনা আমার জানা এবং তাঁর কাছ থেকে শোনা। কিছু ঘটনা একাধিকবার শোনা। মুর্তজার সকল ঘনিষ্ঠজনের জন্য এই অভিজ্ঞতা স্বাভাবিক ব্যাপার।
কেন মুর্তজা একই ঘটনা বারবার শোনাতেন কিংবা লেখার ফাঁকে সেই সব বিশেষ ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি করতেন, তা নিয়ে কোনো রহস্য ছিল না। শিল্পী তাঁর শ্রোতাদের পুরোনো স্মৃতি পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে পারতপক্ষে নিজেকে শাণিত রাখতেন, মরচে ধরতে দিতেন না মগজে। আমার জীবন ও অন্যান্য গ্রন্থে একাধিক অধ্যায়ের বর্ণনায় একই প্রসঙ্গ বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। কখনো নিজের জন্মের গল্পে, কখনো পিতার সাথে মিল-অমিলের ঘটনায়।
এ’কথা অনস্বীকার্য—মুর্তজা বশীরে ব্যক্তিজীবন ঘিরে আমার কৌতূহলের সূচনা হয়েছিল তাঁর পিতাকে কেন্দ্র করে একটি লেখার মাধ্যমে। ১৯৬৯ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মৃত্যুর পর ২৭ জুলাই দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আমার বাবা ও আমি’ শিরোনামের কনফেশনটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। পুরোনো পত্রিকায় ছাপা লেখাটি তখন পড়েছিলাম ২০০১ সালে চট্টগ্রামে ‘পূর্বা’ প্রকাশিত মুর্তজা বশীর: মূর্ত ও বিমূর্ত গ্রন্থ সূত্রে।
পিতাকে নিয়ে স্মৃতিকথার শুরুতেই শিল্পী লিখেছিলেন, ‘আজ আমার আর কোনো লজ্জা নেই যদি কেউ আমাকে পরিচয়ের শেষে বলেন, আমি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ছেলে। কিন্তু এককালে করতাম। তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। সেই পরিচয়ে আমি ক্ষুণ্ন হতাম। আমার অহমিকায় বেশ আঘাত লাগত। আমি সব সময় চাইতাম নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে’।
লেখাটির শেষ অংশে লিখেছিলেন, ‘তিনি আজ বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁর পরিচয়ে আমার পরিচয় ক্ষুণ্ণ করত আমাকে। কিন্তু আজ বলতে দ্বিধা নেই—আমি মুর্তজা বশীর, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র পুত্র। কোনো কুণ্ঠা আজ এতে নেই। একথা আর তিনি কোনো দিনও জানতে পারবেন না। শুনবেনও না। আমি চিৎকার করে বললেও সে শব্দ তাঁকে ঘিরে ধরবে না। তাই আজ, চিরদিন এক অপরিসীম বেদনার মহীরুহ আমার হৃদয়ে শুধু যন্ত্রণার অগ্নিবান ছড়াবে। ছায়া দেবে না।’
লেখাটির বাকি অংশজুড়ে আছে ছাত্রাবস্থায় পিতার সাথে দূরত্ব। বিশেষ করে শিল্পী হবার ঘোষণায় পিতার আপত্তি কিন্তু একই সাথে প্রশ্রয়। সেই সাথে পুত্রের প্রবাসজীবনে পুত্রের মদ্যপান নিয়ে উদ্বেগ ও বিদেশিনী বিয়ে করার ব্যাপারে আশঙ্কা্ প্রকাশ ইত্যাদি। লেখাজুড়েই পাওয়া যায় মতান্তর এবং গোপন স্নেহ-ভালোবাসার আবেগী উচ্চারণ। লেখাটি ২১৮ সালের ১৩ জুলাই পরবর্তীকালে প্রথম আলো পত্রিকায় শিল্পসাহিত্য পাতায় প্রকাশিত হলে এই প্রজন্মের পাঠকমহল ‘মুর্তজা বনাম শহীদুল্লাহ্’র মিথস্ক্রিয়া নতুনভাবে জানতে পারেন।
১৯৬৯ সালের পর মুর্তজা ১৯৯৩ সালে লিখলেন পিতাকে নিয়ে পূর্বের লেখার চেয়ে নিয়ন্ত্রিত আবেগে দ্বিতীয় লেখাটি; যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৩ সালের ২৬ জুলাই সংবাদ পত্রিকায়। শিরোনাম ছিল ‘ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং আমি’। লেখাটির শুরুতে আছে মুর্তজার জন্মের মুহূর্তকালের দীর্ঘ বর্ণনা। শিল্পী তখন জাতিস্মরের ভূমিকায়।
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রমনা এলাকায়, বর্তমানে ব্রিটিশ কাউন্সিলের উত্তর দিকে যে বাড়িটির সম্মুখে জোড়া কবর আলুশাহ ও মালুশাহ বলে দু’ভাইর, যে বাড়িটির সেই সময় পরিচয় ছিল ডক্টর হাসানের [পরবর্তীকালে উপাচার্য হন] কুঠি, সেই বাড়িতে ১লা ভাদ্র ১৩৩৯, ১৭ আগস্ট ১৯৩২, ১৪ই রবিউস সানি, বুধবার, বেলা ১২-২৫ মিনিটে কৃষ্ণপক্ষ দ্বিতীয়ায় যে শিশুটি পৃথিবীর আলো দেখেছিল এবং যার জন্মের দু’দিন আগে মাতৃগর্ভ থেকে হাত বাইরে বেরিয়ে এসেছিল, যাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন ডাক্তার বোস প্রসূতির জীবন রক্ষার্থে মেরে ফেলার উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু স্নেহময়ী মা মরগুবা খাতুন দু’রাত দু’দিন না শুয়ে, বসে, ঠায় দাঁড়িয়ে যন্ত্রণা মুখ বুজে সহ্য করে জন্ম দিয়েছিলেন এবং যার নাম আকিকার সময় বড় ভগ্নিপতি ডক্টর সিরাজুল হক নামকরণ করেছিলেন—আবুল খয়র মুর্তজা বশীরুল্লাহ। যা সংক্ষেপে লেখা হতো এ কে এম বশীরুল্লাহ এবং এই এ কে এম বশীরুল্লাহ নামে যে শিশুটি একটি মুসলিম রক্ষণশীল পরিবারে জন্মেছিল, যেখানে পাশ্চাত্য ভাবধারা থাকা সত্ত্বেও পদে পদে ছিল ধর্মীয় অনুশাসন, সেখানে সে কেন এবং কিসের দুর্বার আকর্ষণে মুর্তজা বশীরে রূপান্তরিত হয়েছিল—একথাটি প্রথম জানা দরকার।’
একইভাবে লেখাটি শেষ হয়েছে পিতার প্রতি মুর্তজার আবেগমথিত অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে। ছবি আঁকার ব্যাপারে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ মুর্তজাকে উৎসাহ দিতেন। তার প্রমাণ হলো শহীদুল্লাহ্ তাঁর শিল্পীপুত্রকে কখনো তাঁর প্রতিকৃতি আঁকতে বাধা দেননি। ১৯৫৪ সালে এবং ১৯৬৭ সালে মুর্তজা বেশ কয়েকটি পোর্ট্রেট আঁকেন শহীদুল্লাহ্র। পেশাদার মডেলের মতো পিতা বসে ছিলেন পুত্রের সামনে। সেই স্মৃতি নিয়েই লেখাটি শেষ করেছিলেন মুর্তজা—
‘তখনও কি জানতাম, এই আমার শেষ আঁকা, তাঁকে গভীরভাবে দেখা? তাহলে হয়ত আরো অনেক সময় ধরে আঁকতাম। আঁকতে পারছি না বলে সময় বেশী লাগছে তা নয়। এ দেখা শেষ দেখা। মন ভরে, হৃদয়ের সমস্ত সত্তা দিয়ে প্রাণভরে দেখা।’
এই সূত্রে আমরা আরও জানতে পারি পিতাকে তিনি ‘বাবু’ সম্বোধন করতেন। যিনি কোমরে বাঁধা চওড়া চিটাগাঙের বেল্ট থেকে টাকা বের করে বিপদে-আপদে অভিমানী একগুঁয়ে পুত্রকে অর্থ সাহায্য করতেন। যদিও আমার জীবন ও অন্যান্য গ্রন্থটিতে সংযোজিত লেখাগুলো কখন প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এবং তার সূত্র উল্লেখ করা হয়নি। যার কারণে কোন লেখাটি কোন সময়ে, কোন মেজাজে লেখা হয়েছে, তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাবেন না পাঠক। তার জের ধরে অধ্যায়গুলোতে মুর্তজার জীবনের ধারাবাহিকতা স্পষ্ট হয়নি। ধারে ও ভারে বইটি ঢাউস হলেও মুর্তজার সম্পূর্ণ আত্মজীবনী হয়ে উঠতে পারেনি। বড়জোর আমরা পেয়েছি বিশাল ক্যানভাসের মাঝে জীবনের কোলাজ ছবি। যদি কোনো জীবনীকার লেখাগুলো পর্যায়ক্রমে সাজাতেন, তবে শৈশব থেকে প্রবীণ জীবন অব্দি পথচলাটুকু আরও বোধগম্য হতো।
শিল্পী হিসেবে মুর্তজা পাশ্চাত্য চিত্রকলার কাছে ভীষণভাবে ঋণী। ডাচ শিল্পী রেমব্রান্টের আত্মপ্রতিকৃতি আঁকার কৃৎকৌশল কিংবা পিকাসোর কিউবিজম মুর্তজা আত্মস্থ করেছিলেন ছাত্রজীবনে। ইতালির ফ্লোরেন্সে লেখাপড়ার সুবাদে উফিজি মিউজিয়াম তাঁর চোখে ছিল বিপুল বিস্ময়। ফরাসি ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীরা মুর্তজাকে প্রভাবিত করলেও সেই রীতি এড়িয়ে চলেছেন নিজের ক্যানভাসে। পরবর্তীকালে বিমূর্তের মাঝে মূর্ত এবং ইট্রুসকান [Etruscan] ঘরানার ফিগারেটিভ সৌন্দর্য স্থায়ী হতে দেখি তাঁর ক্যানভাসে। চিত্রকর্মে ব্যবহার করেছেন প্রতীচ্যের উপকরণ। ফিরে গেছেন বেঙ্গল স্কুল, কালীঘাটের, বাংলার টেরাকোটায়। কিন্তু সফল শিল্পী জীবনের শুরুতে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের জীবনসংগ্রাম মুর্তজার রংতুলিকে বদলে দিয়েছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষার নির্যাস ক্রমাগত দিক বদল করেছিল ব্যক্তিজীবনের টানাপোড়েনে।
সেই আলোকে আলোচ্য গ্রন্থটির আত্মজীবনী: তৃষিত নদী অধ্যায় অংশে রক্ত-মাংসের মুর্তজাকে খুঁজে পাওয়া যাবে। পুরান ঢাকার গণ্ডি পেরিয়ে বগুড়ার নবকুমার হাইস্কুল থেকে বামপন্থী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার ইতিহাস, ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হবার পর শিল্পী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবার ব্যর্থতা-সফলতার বয়ান, পড়াশোনার জন্য কলকাতা থেকে ইতালি যাত্রা, বিদেশে প্রেম ও অপ্রেমের অভিজ্ঞতা, করাচি-লাহোর-রাওয়ালপিণ্ডিতে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, বায়ান্নের ভাষা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিজীবনে জহির রায়হান, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, আনিসুজ্জামান, শামসুর রাহমান, আমিনুল ইসলাম, সাঈদ আহমেদ, কাইয়ুম চৌধুরীদের সাথে বন্ধুত্ব, শিক্ষক জয়নুল আবেদিনের সাথে জটিল মনস্তত্ত্ব, স্বাধীন বাংলাদেশে ‘দেয়াল’ ও ‘এপিটাফ’ সিরিজের মাধ্যমে নতুন যুগের শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ইত্যাদি প্রধান ঘটনাগুলো ‘তৃষিত নদী’ অধ্যায়ে মুর্তজা সংক্ষেপে লিখে গেছেন।
আত্মপ্রতিকৃতি © মুর্তজা বশীর
মুর্তজার ‘তৃষিত নদী’ অংশটুকু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞানে অতৃপ্তি বাড়িয়ে দিয়েছিল। জীবনের গল্পগুলো মনে হয়েছে সেজানের আঁকা একেকটি আপেল। রঙের ঘনত্ব যার বিমূর্তাকে আড়াল করতে পারে না। মুর্তজার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের অবয়বে আছে এই পূর্ণ-অপূর্ণতার স্বাদ। এই অবয়বে তিনি কখনো হয়েছেন কখনো কবি, কখনো বিপ্লবী, কখনো প্রেমিক। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি কিংবা জানি না, মুর্তজা সেই অর্থে শিল্পী হতে চাননি। যে অর্থে পিকাসো, সালভাদর দালি, ভ্যান গঘ কিংবা পল গঁগা শিল্পী হতে চেয়েছিলেন। কিংবা আমাদের দেশের কাইয়ুম-রাজ্জাক-সুলতান প্রমুখ শিল্পী হবার জন্যই কাজ করে গেছেন। মুর্তজা বশীরের শিল্পীজীবনের পথে হাঁটার গল্পটা তাই বাকি সবার থেকে আলাদা।
তবে মুর্তজা তাঁর জীবনকে যেভাবেই ধারণ করুন না কেন, তাঁর লেখাগুলো দিন শেষে সময়ের দলিল হিসেবে থেকে যায়। ইতিহাসমনস্কতা তার অন্যতম কারণ। সেই সাথে এটাও সত্য, শিল্পী পরিচয়ের বাইরে মুর্তজা একজন সুলেখক। এই বাড়তি সুবিধাটুকু মুর্তজা বশীরের ছিল। শিল্পী নিজেও চেয়েছিলেন খণ্ডিতভাবে নয়, নিজের আত্মজীবনী নিজেই সুপরিসরে লিখবেন। কিন্তু পারেননি। ৮৮ বছরের জীবন তাঁর কাছে খুবই সংক্ষিপ্ত জীবন মনে হতো। যদিও বাঁচতে চেয়েছিলেন পিকাসোর মতো ৯২ বছর পর্যন্ত।
পল গঁগা তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনী ইন্টিমেট জার্নাল বইয়ের শুরুতে উল্লেখ করেছিলেন, This is not a book. A book, even a bad book, is a serious affair. তাঁর সাথে দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় অন্তরঙ্গতার কারণে প্রায় মনে হতো—মুর্তজা প্রাণ খুলে নিজেকে প্রকাশ করে যেতে পারেননি। নিজের আঁকা শত সেল্ফ পোর্ট্রেট স্কেচের মধ্যে মুর্তজাকে খুঁজে নিতে হয়। তারপরও কলমে-কথনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন তাঁর প্রজন্মের অন্যতম মুক্তকণ্ঠ ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশে ছিলেন সাহসী ও সাবলীল। আমি নিজেও অপেক্ষায় ছিলাম মুর্তজা একক পরিসরে লিখবেন দ্য সিক্রেট লাইফ অব সালভাদর দালি কিংবা দিয়াগো রিভেরার মাই আর্ট, মাই লাইফ ঘরানার আত্মজীবনী।
মুর্তজা বশীর তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, ‘জীবিত অবস্থায় কী পেলাম, এটা বড় কথা নয়। মৃত্যুকে অতিক্রম করে টিকে থাকল কি না, সেটাই বড় কথা। আমার সাধনা হচ্ছে আমি মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরে জীবিত থাকব কি না। আমি একজন তৃষ্ণার্ত মানুষের মতো।’
ঘুরেফিরে একই ভাবনা বিভিন্ন আলাপচারিতায় মুর্তজা বলে গেছেন। এভাবে বলতে পারাটা তাঁকেই মানাত যেন। বিশ্ব চিত্রকলার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখব একজন শিল্পীকে নানাভাবে চর্চা না করলে তাঁর অস্তিত্বে মরচে পড়ে। বিস্মৃতির অতলে তিনি হারিয়ে যান। গাব্রিয়াল গার্সিয়া মার্কেজ বলেছিলেন, প্রত্যেক মানুষের জীবনে তিনটি অধ্যায় আছে—সামাজিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবন এবং গোপনীয় জীবন। আমার জীবন ও অন্যান্য সূত্রে মুর্তজা বশীর তাঁর জীবনের প্রায় প্রতিটি কুঠুরি তাঁর শিল্প-দর্শক ও পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত করে গেছেন। যতটুকু অপ্রকাশিত থেকে গেছে, তার দায় আমাদের।
মিরাজুল ইসলাম সাহেব, আপনর কথ স্যার আমাকে বলতেন । আমি যখন ক্লাস নাইনেপড়ি, তখন থেকে স্যারের লেখা পড়তে শুরু করি । আপনার তথ্যবহুল লেখাটি ভালো লাগল । আমাকে স্যার স্নেহ করতেন তাঁর শেষ জীবনে । আমাকে ভালোবাসতেন । আমাকে বাংলাদেশ আর্টের ওপর অনেক তথ্য দিলেন । অনেক তথ্য উপাত্তের ছবি করে রেখেছি । আমার নাম রফী হক । শিল্পী, সম্পাদক, শিল্পপ্রভা ।
রফী হক
জানুয়ারি ১৬, ২০২২ ২৩:২৫
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
মিরাজুল ইসলাম
নভেম্বর ১৮, ২০২২ ০০:৪৬