সালমান আখতারের তত্ত্ব বিচার

সুস্থতার মুখোমুখি

এ সাদামাটা শিরোনামের খানিকটা প্যাঁচালো ইংরেজি তরজমা হতে পারে: Encountering Sanity, আর তা এ আলোচনার প্রয়োজনে। পৃথিবীতে মানুষকে অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হয়, তবে সবাইকে সব কিছু এনকাউন্টার করতে হয় না, মুখোমুখি হয়েও পাশ কাটিয়ে চলা সম্ভব, চ্যালেঞ্জ করতে হয় না। কিন্তু কিছু মানুষকে করতে হয়, করতে হয় তাদের মানসিক সুস্থতার প্রমাণ হিসেবে। এ বিবেচনায় মানসিকভাবে একজন মানুষকে যদি সুস্থমস্তিষ্ক ও বোধবুদ্ধিসম্পন্ন বিবেচনা করা হয়, তাহলে তাকে যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয় তা সহজ-সরল নয়। নিজের পথকে প্রায় প্রতি নিয়তই তাকে পরিষ্কার করে এগোতে হয়। অনিশ্চয়তা ও অনির্দেশ্যতার ভেতর দিয়ে তাকে চলতে হয়। বিকারগ্রস্ত বা অপ্রকৃতিস্থ বা জড়বুদ্ধির মানুষেরা এ থেকে ব্যতিক্রম; তাদের পথ পরিষ্কারের কাজ করতে হয় না—অবলীলায় চলতে ফিরতে পারে, অসমান পথেও হোঁচট খাওয়ার বিপদ থাকে না। 

বলা প্রয়োজন, সুস্থ মস্তিষ্কওয়ালাদের বিপরীতে যাদের রাখছি তারা আক্ষরিক অর্থে বিকারগ্রস্ত বা অপ্রকৃতিস্থ নন। তবে জড়বুদ্ধির ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেয়া যায় না। দুই দলে মূল তফাত এই—যারা প্রকৃত সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী তাদের একটা বড় কাজ নিজেদের মানসিক সুস্থতাকে [sanity] প্রশ্নবিদ্ধ করা ও জবাব খুঁজে ফেরা। অন্যদিকে যারা অপর দলভুক্ত তাদেরকে এ ঝঞ্ঝাটে যেতে হয় না। ফলে পথঘাট যেমনই হোক, তাদের চলাফেরা বাধা-বিপত্তিহীন। তার মানে সুস্থতার সঙ্গে অনিশ্চয়তার [uncertainty] একটা যোগ রয়েছে যা সুস্থ মস্তিষ্কওয়ালাদেরকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়, বা তারা নিজেরাই স্বেচ্ছায় তেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। কেন?—নিজেদের সুস্থতার পরীক্ষা দিতে। এ পর্যায়ে বিষয়টা কিছুটা ঘোরপ্যাঁচের, বিশেষত সুস্থ কারা, আর কারা নন, এ নিয়ে। সুস্থ বলতে আমরা তাদেরকেই বুঝব যারা নিজেদের বোধবুদ্ধি [rationality] সম্বন্ধে সচেতন। তাই বলে এর অপর দিকে যারা, তাদেরকে কি অসুস্থ, বিকারপ্রবণ বা জড়বুদ্ধিসম্পন্ন বলা সমীচীন? প্রথম দলকে সুস্থ বলতে হচ্ছে তাদের বোধশক্তি ও চিন্তাশীলতার কারণে। তাই বলে অপর পক্ষকে অসুস্থ বলাও সংগত মনে হচ্ছে না। কী বলা যায় তবে? 

প্রখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ সালমান আখতার মানুষের নিরাপত্তা ও অনিরাপত্তাবোধকে বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে : যারা নিজেদের তৈরি নিরাপত্তাবেষ্টনীতে বাস করে অনিশ্চয়তা থেকে নিজেদের নিরাপদ ভাবে তারা এক অর্থে মৌলবাদী। অপর দিকে নিরাপত্তাবেষ্টনীতে থেকে বা না থেকে যাদের অনিশ্চয়তার কথা ভাবতে হয়—প্রায় সব সময়ই, কারণ তারা জানে নিশ্চয়তা বা নিরাপত্তা বিষয়টা খুবই ভঙ্গুর ও আপেক্ষিক—তারা প্রকৃত সুস্থ। সালমান আখতার যেহেতু মনোবিশ্লেষণ দিয়ে মানুষের জীবনযাপনের নানা কার্যকারণ সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন, সে কারণেই সম্ভবত তিনি মানসিক সুস্থতার নিরিখে এ ধরনের ভাগাভাগিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। অন্যথায় সাধারণ বিবেচনায় এই শ্রেণিবিভাগ হতে পারত—প্র্যাকটিকেল ও ইমপ্রেক্টিকেল। কিন্তু এই শ্রেণিবিভাগ দিয়ে আমরা বেশি দূর এগোতে পারব না; অগত্যা সুস্থ ও মৌলবাদী এই নামকরণ দুটি ধার নিতে আপত্তির কারণ দেখছি না—এ আলোচনার প্রেক্ষাপটে।

বলে রাখা প্রয়োজন, এখানে মৌলবাদ বলতে ধর্মকেন্দ্রিক বিষয়আশয় বা ধর্ম বিশ্বাসের গোড়ামিকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। ধর্মীয় মৌলবাদ যেমন রয়েছে, তেমনি সেকুলার মৌলবাদ বলেও কি কিছু নেই? মোদ্দা কথা, মৌলবাদ বলতে সামগ্রিকভাবে এমন এক মানসিক অবস্থাকে বোঝায় যার মূলে রয়েছে এক ধরনের আধিপত্যপ্রবণতা, যা শুধু বিশ্বাসকেন্দ্রিকই নয় বরং কল্পনা, ফ্যান্টাসি, এমনকি মিথ্যাচারকে ঘিরেও বেড়ে ওঠে। এ কথা ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন খাটে, তেমনি গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও। ব্যক্তির ক্ষেত্রে এর প্রকাশ নানা দিকে থেকে হতে পারে। ব্যক্তির নিজের পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারে তার আমিত্ব বা অহং একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এর প্রভাবে তার আচার-আচরণে অনেক বিষয়েই সে কট্টরপন্থা নিতে পারে যাকে ইংরেজিতে ম্যাগালোমেনিয়া বলেও চিহ্নিত করা যেতে পারে। এর প্রতিফলন ঘটতে পারে তার পারিবারিক, সামাজিক বা কর্মক্ষেত্রের নানা কর্মকাণ্ডে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ মনোভাব নানা বিষয়ে তার বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আচার-আচরণ প্রবলভাবে প্রভাবিত করার শক্তি রাখে, যা হতে পারে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ বা ধর্মবিশ্বাস নিয়েও। গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে যা ঘটে তা অবশ্যই বড় আকারে ও আয়োজনে। এখানে সহাবস্থানের পূর্বশর্ত এমন এক একাত্মতার বোধ যা সেই গোষ্ঠীকে কোনো বিশ্বাস বা মতবাদের পক্ষে [বা অন্য এক বা একাধিক মতবাদের বিপক্ষে] ঐক্যবদ্ধ রাখে। এখানে যা না বললেই নয়, গোষ্ঠীর এই যে একাত্মতা তা সেই গোষ্ঠীভুক্তদের জন্য [ব্যক্তি হিসাবে ও গোষ্ঠীর একজন হিসাবেও] নিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তার ধারকও বটে। কথাটা অন্যভাবে বললে— মৌলবাদ ব্যক্তিকে ও গোষ্ঠীকে নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার পথ দেখিয়ে যূথবদ্ধতার শক্তি জোগায়। এ নিরাপত্তা হলো নিরাপত্তাহীন বিশ্বে মানুষের অনিশ্চিত জীবনের নিরাপত্তা। প্রশ্ন উঠতেই পারে কতটা নিরাপদ সে নিরাপত্তা?

মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম শর্ত তার নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা। জন্মাবধি সে অনিরাপত্তা ও অনিশ্চয়তা-তাড়িত। যে-কারণে নিজের চারপাশে যতটা সম্ভব মজবুত নিরাপত্তাবলয় তৈরিতেই তার সকল মনোযোগ ও শ্রম। এ নিরাপত্তাবোধ যেমন তার নিজের স্বার্থে, তেমনি তার পরিবারের সুরক্ষার স্বার্থে। এ জন্য প্রথমেই আসে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিষয়-আশয়। আর এর পিছু পিছু অনেক কিছু—সামাজিক নিরাপত্তা, রাজনৈতিক নিরাপত্তা, রাষ্ট্রক্ষমতার নিরাপত্তা, নৈতিক নিরাপত্তা, সম্ভ্রমের নিরাপত্তা, এমনকি আভিজাত্যের, ক্ষমতার, খ্যাতির নিরাপত্তা ইত্যাদি ইত্যাদিও চলে আসে। মূল কারণ সে অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে চায় না। ফলে এই নিরাপত্তাবোধ সংগত কারণেই তার জন্য স্বস্তিদায়ক। কিন্তু বাস্তবতা তো এই—সে যত সুরক্ষার ব্যবস্থাই করুক, তার সবকিছুই প্রতি মুহূর্তে অনিশ্চয়তার হুমকির মুখে। আচমকা ভূমিকম্পে তার বাড়ি-ঘর ধুলিসাৎ হয়ে যেতে পারে, ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামতে পারে, আর যা না বললেই নয়, যেকোনো সময় মৃত্যু তো হতেই পারে। এ অবস্থা সত্ত্বেও মানুষ কতটা অনিরাপদ—এ প্রশ্নটা কি সবাইকে ভাবিত করে? করলে কে কীভাবে তা মোকাবিলা করে? এখানে এসেই সুস্থ মানুষ ও মৌলবাদী পক্ষ-বিপক্ষ না হয়েও ভাগাভাগি হয়ে যায়। শুধু যে অনিরাপত্তা ও অনিশ্চয়তার কারণেই তারা আলাদা হয় তা নয়, জীবন-যাপনের নানা প্রবাহে ভেসে যেতে যেতে নিজেদের পরিচিতি তারা নিজেরা ধরতে না পারলেও সচেতন তৃতীয় পক্ষের কাছে তা ধরা পড়ে।

সাধারণভাবে এটা ধরে নেওয়া হয়, যারা অনিশ্চয়তায় ভোগে তারা জীবন সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা থেকে বেরোতে পারে না। কী করা উচিত এ নিয়ে নানা সংকটে, সিদ্ধান্তহীনতায় নিজেদের ওপর আস্থা হারিয়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন বিপর্যস্ত করে তোলে। খেয়াল রাখা দরকার, অনিশ্চয়তায় ভোগা ও অনিশ্চয়তা নিয়ে সচেতন থাকা এক জিনিস নয়। আমরা এখানে দ্বিতীয় অবস্থাকে বোঝাতে চাইছি। আর এই সচেতনতাই মানসিক সুস্থতার লক্ষণ। একে বলা যেতে পারে বাস্তবের অনিশ্চয়তা যা অহরহই আমাদের ঘিরে থাকে। একজন সুস্থ মানুষকে প্রথমত এটা মেনে নিতে হবে সে যে-পরিস্থিতিতে বা বাস্তবতায় বাস করছে তা অনিশ্চিত। সে জানে না সামনে কী ঘটবে বা ঘটতে পারে। অন্যদিকে যে তার নিজের ও আশপাশের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে নিরাপত্তাবলয়ে বন্দি সে মৌলবাদী বলেই চিন্তাশূন্য, প্রশ্নরহিত। মনস্তত্ত্ববিদ এ্যাডাম ফিলিপস সুস্থতা ও অনিশ্চয়তা নিয়ে যা বলেন, ‘Sanity, as the project of keeping ourselves recognizably human, therefore has to limit the range of human experience. To keep faith with recognition we have to stay recognizable. Sanity, in other words, becomes a pressing preoccupation as soon as we recognize the importance of recognition. When we define ourselves by what we can recognize, by what we can comprehend—rather than, say, by what we can describe—we are continually under threat from what we are unwilling and/or unable to see.

অর্থাৎ বাস্তবকে খোলা চোখে দেখতে পারা এবং বাস্তবতার আলোকে নিজেকে ও পরিস্থিতিকে যাচাই করার সক্ষমতার নাম সুস্থতা। সুস্থতার প্রকৃতি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে গেলে তা করতে হবে সমাজের প্রেক্ষাপটে। ফলে এর অন্য নাম হতে পারে সামাজিক সুস্থতা। সামাজিক সুস্থতা চায় আমরা যেন আমাদের বাস্তবতাকে ঠিক ঠিক দেখতে ও বুঝতে শিখি, সেই সাথে এও— আমরা কারা, কী ধরনের সামাজিক ব্যবস্থা আমাদের চলার পথকে সুগম করবে বা বিপদসংকুল করবে। 

এ কারণেই সুস্থতা কখনো নির্ভার নয়। অন্যভাবে বললে মৌলবাদ ব্যক্তিকে এমনকি গোষ্ঠীকে নিরাপত্তাবলয়ে রেখে নির্ভার থাকতে সাহায্য করে। অপরদিকে অনিরাপত্তাবোধ সুস্থতাকে করে তোলে বোঝাস্বরূপ। আর এই বোঝা বয়েই ব্যক্তিকে চলতে হয়। সবার পক্ষে সুস্থতার বোঝা বয়ে চলা সম্ভব হয় না, যে-কারণে বোঝা থেকে নিষ্কৃতি পেতে যুগে যুগে মানুষ নানা আশ্রয় খুঁজেছে। মনোরঞ্জক বা পপুলিস্ট চিন্তা-ভাবনা যেমন ব্যক্তি, সমাজ ও সর্বোপরি রাষ্ট্রকে আশ্রয়ের নানা ঠিকানা বাতলে দিচ্ছে, তেমনি বাস্তবকে পাশ কাটানোর নানা ফন্দিফিকিরও প্রায় সবখানেই চোখে পড়ে। সেই সাথে এ কথাও ঠিক, কিছু কিছু বিষয় রয়েছে যা ব্যক্তি ও সমাজকে আশ্বাসের আচ্ছাদনে রাখতে পারে। যেমন—পার্থিব ও পারলৌকিক জীবন, প্রথাসিদ্ধ সামাজিক রীতিনীতির প্রতি অবিচল আস্থা। 
বিষয়টা কি তবে এই:
সুস্থতা=অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা; মৌলবাদ=নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাবোধ? 
অনিশ্চয়তা কি আদৌ নেতিবাচক, যা মানুষের চলার পথকে সমস্যাসংকুল, এমনকি রুদ্ধ করে দেয়? সমস্যাসংকুল অবশ্যই করে, তবে সমস্যা যদি এমন হয় যে মানুষকে এর মুখোমুখি হয়েই পথ খুঁজতে হবে তাহলে এ পথকে সে কী করে এড়িয়ে যাবে? কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়, কোনো কিছুরই স্থিরতা নেই, এ বিশ্বাসই সুস্থতাকে মুমুর্মুহু প্ররোচিত করে ও সচল রাখে। অন্যদিকে নিরাপত্তার আশ্বাসে আশ্বস্ত বলে মৌলবাদ স্থবির ও পরমুখাপেক্ষী। এই যে স্থিরতাহীনতা বা নিরাপত্তাহীনতা যা সুস্থতাকে সচল রাখে, এটাই আসল কথা, যার অন্য নাম হতে পারে মুক্তি। অনিরাপত্তার মধ্যে এক ধরনের মুক্তি [ফ্রিডম] আছে, মৌলবাদীদের মধ্যে রয়েছে fear of freedom যে-কারণে তারা নিরাপত্তাবলয়ের বন্দিত্বে আশ্রয় খোঁজে। 

মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম শর্ত তার নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা। জন্মাবধি সে অনিরাপত্তা ও অনিশ্চয়তা-তাড়িত। যে-কারণে নিজের চারপাশে যতটা সম্ভব মজবুত নিরাপত্তাবলয় তৈরিতেই তার সকল মনোযোগ ও শ্রম। এ নিরাপত্তাবোধ যেমন তার নিজের স্বার্থে, তেমনি তার পরিবারের সুরক্ষার স্বার্থে। এ জন্য প্রথমেই আসে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিষয়-আশয়।

যা দাঁড়াচ্ছে—মানসিক সুস্থতা ও অনিরাপত্তাবোধ অঙ্গাঙ্গি জড়িত। মনস্তত্ত্ববিদ সালমান আখতার এই অনিরাপত্তাবোধের ছয়টি শ্রেণিবিভাগ করে দেখাতে চেয়েছেন ব্যক্তি বা সমষ্টির জীবনে নিরাপত্তাহীনতা প্রধানত কী কী চেহারায় হাজির হতে পারে। তাঁর মতে, এই সমস্যাগুলো মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য-উদ্ভূত, যে-কারণে সবকটাই সুস্থতার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত। মৌলবাদে এই সব সমস্যার অস্তিত্ব নেই, আর যদি কখনো দেখা দেয়, চটজলদি সমাধানও রয়েছে। কারণ মৌলবাদ হচ্ছে এসব বোঝা থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ। সালমান আখতারের ভাষায় : You could say that fundamentalism is the cure for mental health! যে সমস্ত কারণে ব্যক্তির ও সমাজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় বা হতে পারে এ নিয়ে সালমান আখতারের শ্রেণিবিভাগ এ রকম—সত্যনিষ্ঠতার অনিশ্চয়তা [factual ucertainty], ধারণাগত জটিলতা [conceptual complexity], নৈতিক দ্ব্যর্থকতা [moral ambiguity], সাংস্কৃতিক অশুচিতা [cultural impurity], ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ [personal resposibilty], মৃত্যুই শেষকথা [total mortality].

সত্যনিষ্ঠতার অনিশ্চয়তা বলতে সালমান আখতার নতুন কিছু বলেননি—মানুষের, জীবজগতের ও প্রকৃতির সার্বিক অনিশ্চয়তাকেই বুঝিয়েছেন—যখন যেকোনো কিছু ঘটে গিয়ে নিরাপত্তাবোধ প্রবলভাবে নাড়া খেতে পারে। ধারণাগত জটিলতা বলতে নানা মত ও পথের কথা বুঝিয়েছেন। এটা জটিল এবং নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ এ কারণে যে, পৃথিবীতে কোনো কিছুর স্থিরতা যেমন নেই, তেমনি জীবনযাপনে কোনো একটি পথ বা পন্থাই চূড়ান্ত নয়। নৈতিক দ্ব্যর্থকতা সেই মননচর্চা যা চিন্তাশীল প্রাণী হিসেবে মানুষ নিজের স্বাধীন ও স্ব-উদ্ভাবিত মতামত প্রকাশের মাধ্যমে তার নিজস্বতার প্রমাণ রাখে—যা ক্ষেত্রবিশেষে নিরাপত্তাকামী চিন্তাভাবনায় কুঠারাঘাত করতে পারে। আবার নৈতিকতার আপেক্ষিকতাও বিপদের কারণ হতে পারে। আজ এখানে যা নৈতিক বিবেচনায় সঠিক বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে, তা অন্য জায়গায় ভুল প্রমাণিত হতে পারে। কিংবা অতীতে যা সঠিক বলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল তা আজ গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। সাংস্কৃতিক অশুচিতা সম্পর্কিত সালমান আখতারের বক্তব্য: একজন মানসিকভাবে সুস্থ ব্যক্তি কখনোই শুচিতা-অশুচিতা দিয়ে কোনো কিছু বিচার করতে যাবে না। শুচিতা বা শুচিতার তালাশ তার কাছে সত্যের বিপক্ষে যাওয়া যা কখনো কখনো বাস্তবতাবিনাশী। বাস্তবতা সব সময়ই অনেক কিছুর মিশেল [হাইব্রিড], আমারা স্বীকার বা না করি। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ধারণা মৌলবাদী নিরাপত্তা বলয়ের বাসিন্দাদের জন্য অশেষ বিপত্তির কারণ। ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ বলতে বুঝিয়েছেন মানুষ তার সমস্ত কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী এবং সে-কারণে তাকে যেকোনো পরিস্থিতিতে তার নিজের বোধবুদ্ধির ওপর নির্ভর করতে হয়—সমষ্টির চিন্তাভাবনায়  প্ররোচিত না হয়ে। সেই সাথে এও সত্য—personal responsibility involves first and foremost the ownership of the body—its demands, its sensations, its agenda and its use and then the conscious and unconscious fantasies and drives emanating from the body and affecting the body in a dialectical feedback loop. …one has to be responsible for one’s aggression, one’s hostile feelings—expressed, suppressed, conscious and unconscious. One is responsible for one’s life.

এখানেই মানসিকভাবে সুস্থ ব্যক্তি মৌলবাদী থেকে স্বতন্ত্র। কারণ মৌলবাদ যেহেতু সামষ্টিক, যৌথবিশ্বাস তাড়িত তাই একজন মৌলবাদী তার কাজের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়-দায়িত্ব নিতে কখনওই প্রস্তুত থাকে না। ছয়টি শ্রেণিভাগের শেষটিতে সালমান আখতার যেটিকে চিহ্নিত করেছেন সেটি মোটেও নতুন কথা নয়— মৃত্যুই শেষ কথা। মৃত্যুকে নিয়ে মানসিকভাবে সুস্থ ব্যক্তি ও একজন মৌলবাদীর চিন্তায় ফারাক থাকবে জানা কথা। এখানে তিনি অস্তিত্ববাদী দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে মৃত্যুকে মানসিক সুস্থতার আলোকে বিচার করেছেন। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন অন্ধ দেশপ্রেম বা উৎকট স্বাদেশিকতা [dogmatism] ও কট্টরপন্থী চিন্তাভাবনা [Chauvinism] শুধু মৌলবাদের প্রতিনিধিত্বই করে না, জোরালো প্রক্সি হিসাবেও কাজ করে। কট্টর বা গোড়া মনোভাবাপন্ন হওয়ার পেছনে কাজ করে সেইসব ধারণা ও বিশ্বাসের প্রতি অনুগত্য যা সমাজে যুগ যুগ ধরে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়ে টিকে রয়েছে। বিশেষত ধর্মীয় আচার পালনের ক্ষেত্রে এর প্রভাব প্রশ্নাতীত। সুদূর অতীতকাল থেকেই ধর্ম ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সহাবস্থানের মাধ্যমে সমাজ তথা রাষ্ট্রের নাগরিকদের নৈতিকতাসহ সমুদয় সামাজিক লেনদেনের খবরদারি করেছে। পাশ্চত্যে পুঁজিবাদের ক্রমবিকাশে এ যৌথতা ভেঙে পড়লে ধর্মবিচ্ছিন্ন রাজনীতির উদ্ভব ঘটে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। ফলে ধর্ম প্রত্যক্ষভাবে সবখানে রাষ্ট্রের অনুষঙ্গ না হয়েও রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। আমাদের ক্ষেত্রে যেমন।   

বলা নিষ্প্রয়োজন, গোঁড়ামি বা কট্টরপন্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হলো বিচ্ছিন্নতা-আশ্রিত বিশ্বাস বা অবিশ্বাস। সেই সঙ্গে একে যা শক্তি জোগায় তা এক ধরনের অসহিষ্ণু, আধিপত্যপ্রবণ নৈতিকতা। সমাজ মনস্তাত্ত্বিকদের ভাষায় অথোরিটারিয়ান পারসোনেলিটি নামে অভিহিত এ ধরনের আধিপত্যপ্রবণ মানসিকতার মানুষের বৈশিষ্ট্য হলো: এরা সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়-আশয়ে রক্ষণশীল, ধর্মীয় ব্যাপারে ধর্মের চেয়ে ধর্মের আচারই তাদের কাছে গুরুত্বপুর্ণ, ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনার চেয়ে গোষ্ঠীর বা দলের দ্বারাই তারা প্রভাবিত, নিজেরা তাদের কোনো কাজের দায়িত্ব নিতে চায় না বা নিতেও অক্ষম। 

স্বভাবতই এমন নৈতিকতায় যারা বিশ্বাসী তাদের মধ্যে মতভিন্নতার সুযোগ নেই। কিন্তু এখানে এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, গোঁড়ামি ধর্মীয় আচার পালনে বা বিশ্বাসী হওয়ার ক্ষেত্রে পূর্বশর্ত হওয়ার কথা নয়। বরং এটা ব্যক্তির বা একটা গোষ্ঠীর সেই বিশ্বাস বা আচার পালনে প্রশ্নাতীত আনুগত্যপ্রসূত। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেমন রাজনীতিতেও এর নজির ভূরিভূরি। যে-কারণে ডান বা বাম মতাদর্শী ব্যক্তিদেরও দেখা যায় একই প্রবণতার ধ্বজাধারী। ফলে এ কথা বলাই যায়, মৌলবাদ যে-অঙ্গনেই বিচরণ করুক, অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যে অভিন্ন। যে-কারণে সমন্বয়বাদী চিন্তা-ভাবনার [syncretism] সঙ্গে এর দ্বন্দ্বও অনেক পুরনো। সমন্বয়বাদী দর্শনের যারা চর্চা করেন তারা বিশ্বনাগরিকতায় বিশ্বাসী। অন্য দিকে মৌলবাদের মূল কথাই বিভাজন—আমরা ও তারা। এতে তারা নিজেদের মতো করে ‘নিরাপত্তা’ খোঁজেন—বন্দিত্বকে আমল না দিয়ে।  

[প্রখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ সালমান আখতারের The Lure of Fundamentalism বক্তৃতা পাঠের প্ররোচনায়।]

তথ্যসূত্র 
১.    Going Sane: Adam Phillips, harper pernnial, london 2005