ঋতুপর্ণ ঘোষের হারানো সময়কে খুঁজে ফেরা

 

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত মোট ১৩টি উপন্যাসের মধ্যে চোখের বালি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বহুল আলোচিত একটি উপন্যাস। চোখের বালি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালে। ১৯০৪ সালে এই উপন্যাসের নাট্যরূপ দেন অমরেন্দ্রনাথ দত্ত। উপন্যাসের পটভূমি ছিল, দুই জোড়া নরনারীর জটিল মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক ও তৎকালীন সমাজব্যবস্থার নিদারুণ বাস্তবতা নিয়ে। বিনোদিনী নামের এক বিধবাকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের মূল কাহিনি আবর্তিত হয়। তবে তাকে উপজীব্য করে মহেন্দ্র, আশালতা, বিহারীর চরিত্রও পেয়েছে নিজস্ব প্রাণ। চোখের বালি গ্রন্থাকারে প্রকাশ পাওয়ার ঠিক ১০০ বছর পরে ২০০৩ সালে মুক্তি পায় পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচ্চিত্র চোখের বালি। তবে ১৯৩৮ সালে অ্যাসোসিয়েট পিকচার্সের প্রযোজনায় চোখের বালি অবলম্বনে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছিল।

প্রয়াত ঋতুপর্ণ ঘোষ ১৯টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। যার প্রায় সব কটিই জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কারপ্রাপ্ত। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রানুরাগী, যার প্রমাণ মেলে তাঁর নির্মিত সিনেমাগুলো দেখলেই। চোখের বালি ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবি উপন্যাস অবলম্বনেও তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। উপন্যাস প্রকাশের ১০০ বছর পর যখন সেটি চলচ্চিত্রে গতিময়তা পাওয়ার সুযোগ পায়, তা নিঃসন্দেহে সময়ের অনেকটুকু ধারণ করতে সক্ষম হবে, যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর করেননি বা বলা ভালো করতে পারেননি। কবিগুরু যখন উপন্যাসটি প্রকাশ করেন, তখন বিধবা বিবাহ আইন পাস হওয়ার পরও সমাজে বিধবাদের অবস্থান ছিল নিতান্তই করুণ। তিনি সেই সমাজব্যবস্থার বাস্তবতা কিংবা পাঠকসমাজের চাহিদা উপেক্ষা করতে পারেননি বলেই হয়তো, একটা দায়সারা গোছের সিদ্ধান্ত টেনেছিলেন উপন্যাসে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও জীবনের শেষ পর্যায়ে চোখের বালি সমাপ্তি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। চলচ্চিত্রের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি সেখানে দেখানো হয়, যাতে বলা হয়েছে,

চোখের বালি বেরবার অনতিকাল পর থেকেই তার সমাপ্তিটা নিয়ে আমি মনে মনে অনুতাপ করে এসেছি, নিন্দার দ্বারা তার প্রায়শ্চিত্ত হওয়া উচিত। [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২৪ জুন, ১৯৪০]

ঋতুপর্ণ ঘোষ রবিঠাকুরের এই আক্ষেপের সদ্ব্যবহার করেছেন তাঁর পরিচালিত সিনেমায়। শুধু সমাপ্তিতে নয়, শুরু থেকে শেষপুরোটাজুড়েই তিনি রেখে গেছেন তাঁর নিজস্ব নির্মাণশৈলী আর সৃষ্টিশীলতার ছাপ। সিনেমার পুরোটাজুড়েই ছিল বিনোদিনীর একচ্ছত্র আধিপত্য। বিনোদিনীকে তিনি তৈরি করেছেন সমাজের নানাবিধ কুসংস্কারকে বুড়ো আঙুল দেখানো আধুনিকা, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং একই সাথে সাহসী নারী চরিত্র হিসেবে। উপবাস-একাদশীসহ নানাবিধ আচারের দহনে দগ্ধ হয়ে যিনি দমে যান না, বরং সে অনেক বেশি সাবলীল এবং জীবনপিয়াসী। লুকিয়ে চকোলেট খাওয়া থেকে শুরু করে ইংরেজি বলাসবেতেই ছিল তার চরিত্রের উজ্জ্বল স্বাতন্ত্র্য। তবে চলচ্চিত্রের প্রথমাংশে ঋতুপর্ণ বিনোদিনীর বেদনাগুলোকেও ফুটিয়েছেন দর্শকহৃদয়ে। আশালতার বিবাহিত জীবনের নানান আনন্দানুভূতি ও যাবতীয় খুঁটিনাটি তার হৃদয়ে যে গভীর মর্মবেদনা জাগায়, তা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন তিনি। দুজন নারীর একজন আলতা পায়ে লালপেড়ে শাড়ি পরে জীবনকে উপভোগ করছে আর অন্যদিকে সাদা থান জড়ানো নারীটির জীবনে নেই কোনো রঙের ছিটেফোঁটাও। জীবনকে উপভোগ করতে না পারার প্রবল বিষাদই যেন বিনোদিনীকে সংসারের প্রতি প্রচণ্ড রকম আকৃষ্ট করে তোলে। যার ফলস্বরূপ আশালতার স্বামী মহেন্দ্রের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে সে। মহেন্দ্রর সঙ্গে আশালতার সম্পর্ক কেবলই মানসিক নাকি শারীরিকও, সে বিষয়ে রবিঠাকুর তাঁর উপন্যাসে ধোঁয়াশা রাখলেও ঋতুপর্ণ এদিকে ছিলেন একেবারে স্পষ্ট। মহেন্দ্রর সঙ্গে বিনোদিনীর ছিল শারীরিক সম্পর্ক, কিন্তু মনে মনে বিনোদিনী ভালোবাসতেন মহেন্দ্ররই ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিহারীকে। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের লিবিডো ধারণার এক আশ্চর্য উদাহরণ বিনোদিনী। বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেছেন, যৌন ইচ্ছা কোনো পাপের পরিণতি নয় বরং এটি জীবনের স্বাভাবিক সুন্দর বহিঃপ্রকাশ।

বিধবা বিবাহের প্রচলন না থাকলেও রক্ষণশীল সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারগুলোতে সে সময়ে নানা অনাচার ঘটত। বিধবারা কেউ গর্ভবতী হয়ে পড়লে গোপনে তার গর্ভপাত করিয়ে ফেলা, কিংবা দূর কোনো তীর্থস্থানে ফেলে আসা, ক্ষেত্রবিশেষে বিধবা নারীটিকে মেরে ফেলার মতো নৃশংসতাও সে সময়ে কম ঘটত না। সামাজিক পবিত্রতা রক্ষার দায় শুধু নারীর ছিল, পুরুষের জন্য ছিল না কোনো সংস্কারের বেড়াজাল। সিনেমায় দেখানো হয়, বিনোদিনীর হাত কেটে গেলে মহেন্দ্র যখন তাকে নিয়ে রাতে ইংরেজ ডাক্তারের বাড়িতে যায়, তখন পুরুষের সাথে বিধবা নারীকে দেখে ডাক্তার সাথে সাথেই ধারণা করে নেয়, মহেন্দ্র বিনোদিনীর গর্ভপাত করাতে এসেছে। কেননা এমনটিই ঘটে থাকে।

এই উক্তিই যেন প্রমাণ করতে চেয়েছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর বিনোদিনী চরিত্রের মাধ্যমে।

চোখের বালি চলচ্চিত্রে কেবল কাহিনির সফল চিত্রায়ণ নয়, বরং চলচ্চিত্রজুড়ে একটা ফেলে আসা সময়কে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।

তাই স্বদেশি আন্দোলনের মিছিলের শব্দ বন্দে মাতরম থেকে শুরু করে জগদীশচন্দ্র বসুর গাছের প্রাণ আবিষ্কার করা, নারী শিক্ষার প্রচলন কিংবা স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর কথা উপন্যাসের বাইরে থেকে তিনি আলাদাভাবে চলচ্চিত্রে এনেছেন। ঋতুপর্ণের চলচ্চিত্র চোখের বালিতে বিধবাদের দুঃসহ জীবনচিত্র সুনিপুণভাবে উপস্থাপন করেছেন, যেখানে কোনো করুণ সংলাপ ছাড়াই তাদের সাথে সমাজের বাকি মানুষদের জীবনাচরণের পার্থক্যগুলো ফুটে উঠেছে। বিধবার বেদনার অন্য মাত্রাগুলোকেও চলচ্চিত্রে এনেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। যেমনএক আচার পালনের দিনে বিনোদিনীর ঋতুস্রাব হওয়ার মতো সাহসী দৃশ্য দেখানো হয়েছে। তরুণী বিধবার পুরুষের সংস্পর্শে আসা নিষিদ্ধ অথচ সন্তানধারণের সক্ষমতা বহনের চিহ্ন নির্দিষ্ট সময় পরপর কীভাবে তাদেরকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়, সেই বেদনাটুকু দর্শকহৃদয়ে জাগানোর প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয় এই দৃশ্যে।

বিধবা বিবাহের প্রচলন না থাকলেও রক্ষণশীল সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারগুলোতে সে সময়ে নানা অনাচার ঘটত। বিধবারা কেউ গর্ভবতী হয়ে পড়লে গোপনে তার গর্ভপাত করিয়ে ফেলা, কিংবা দূর কোনো তীর্থস্থানে ফেলে আসা, ক্ষেত্রবিশেষে বিধবা নারীটিকে মেরে ফেলার মতো নৃশংসতাও সে সময়ে কম ঘটত না। সামাজিক পবিত্রতা রক্ষার দায় শুধু নারীর ছিল, পুরুষের জন্য ছিল না কোনো সংস্কারের বেড়াজাল। সিনেমায় দেখানো হয়, বিনোদিনীর হাত কেটে গেলে মহেন্দ্র যখন তাকে নিয়ে রাতে ইংরেজ ডাক্তারের বাড়িতে যায়, তখন পুরুষের সাথে বিধবা নারীকে দেখে ডাক্তার সাথে সাথেই ধারণা করে নেয়, মহেন্দ্র বিনোদিনীর গর্ভপাত করাতে এসেছে। কেননা এমনটিই ঘটে থাকে।

বিধবা বিনোদিনীর বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ চিত্রায়ণের মাধ্যমে পুরো বিধবা সমাজের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র ফুটিয়েছেন পরিচালক। যেমনএকটি দৃশ্যে দেখা যায়, আশালতার গর্ভবতী হওয়া উপলক্ষে মাছ ভাজার সময় সেখানে বিধবা রাঁধুনিরা কেবল মাছের গন্ধ নেওয়ার জন্য বসে থাকে পাশে। তাদের মাছ খাওয়ার যে তীব্র ইচ্ছা, তা অত্যন্ত করুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক।

রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি উপন্যাসে মহেন্দ্র-আশালতার ভালোবাসা, মহেন্দ্র-বিহারীর বন্ধুত্ব কিংবা আশালতার প্রতি বিহারীর গভীর অনুভূতি অথবা বিহারীর প্রতি বিনোদিনীর প্রবল আকর্ষণজটিল মনস্তাত্ত্বিক এই সম্পর্কগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপস্থাপন করেছেন সুনিপুণভাবে। কিন্তু ঋতুপর্ণের চোখের বালি ছিল পুরোটাই বিনোদিনীর। বিনোদিনীকে যথাসম্ভব নিরপেক্ষ রেখে চরিত্রায়ণ করার চেষ্টা করা হলেও পরিচালকের এই নারী চরিত্রটিকে মহিমান্বিত করারও মহান বাসনা দেখতে পাই সিনেমার শেষে।

মায়ের মৃত্যু এবং স্ত্রী আশালতার গর্ভধারণের সংবাদ পেয়ে মহেন্দ্র উপন্যাসের মতোই নিজের বাড়িতে ফেরত যায়। বিহারী বিনোদিনীকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে বিনোদিনী তাতে সরাসরি আপত্তি জানায়নি। শুধু বিয়ের দিন সকালে আশালতার উদ্দেশে একটি চিঠি রেখে হারিয়ে যায় বিনোদিনী। চিঠির অংশটুকু উপন্যাসে না থাকলেও চলচ্চিত্রে এর উপস্থাপনের ভঙ্গিমা প্রশংসার দাবি রাখে।

মায়ের মৃত্যু এবং স্ত্রী আশালতার গর্ভধারণের সংবাদ পেয়ে মহেন্দ্র উপন্যাসের মতোই নিজের বাড়িতে ফেরত যায়। বিহারী বিনোদিনীকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে বিনোদিনী তাতে সরাসরি আপত্তি জানায়নি। শুধু বিয়ের দিন সকালে আশালতার উদ্দেশে একটি চিঠি রেখে হারিয়ে যায় বিনোদিনী। চিঠির অংশটুকু উপন্যাসে না থাকলেও চলচ্চিত্রে এর উপস্থাপনের ভঙ্গিমা প্রশংসার দাবি রাখে। চিঠির কিছু অংশ এরূপ,

তাই বলে অন্তরের মিল বলতে সত্যিই কি কিছু ছিল না? ছিল। সংসার করার সাধ; ওই যে বললুম ওই দর্জিপাড়ার স্টেটের অন্তপুরের বাইরে আমরা আর কিচ্ছু দেখি নি। তাই আমাদের দেখা একটা মানুষকে নিয়ে দুজনেই সেই সাধ মেটাতে চেয়েছি। তাতে সাধও মেটেনি, আমাদের ছোট্ট দেশটুকু ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কার্জন সাহেবের আইন সত্যিই যদি ফলে, তবে এখন থেকে তুই আর আমি আলাদা দেশে থাকব। সেই দুই দেশে বসে আমরা যদি নিজে নিজে এত দিনকার অপমান, দুঃখ আর বঞ্চনার কথাই কেবল ভাবি, তাহলে তো আমরা প্রথম থেকেই হার মেনে নিলুম। আসলে দেশ তো মনের মধ্যে বালি।

অর্থাৎ ঘর-দুয়ার ও সংসারের মায়া কাটিয়ে বিনোদিনী পুরো ভারতবর্ষকে আপন করে সাধারণ কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে উঠে সে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে তৃপ্ত হয়েছে। কিন্তু বিনোদিনীর এহেন মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন কি আশ্চর্যজনক নয়? যেখানে বিনোদিনী কাশীতে থাকা অবস্থায় আশালতার গর্ভধারণ করার সংবাদ জেনেও ঈর্ষাবশত মহেন্দ্রকে তা জানায়নি। এমনকি এক রাতে বিনোদিনী বিহারীর ঘরে উপস্থিত হয়ে তাকে গ্রহণ করতে অনুরোধ করে, বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তাতে বিহারী অস্বীকৃতি জানালে ভেঙে পড়ে বিনোদিনী। কয়েক দিনের ব্যবধানে বিনোদিনীর সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী মনোভাব তার পূর্বাপর চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। চরিত্রের এই দ্বৈততা বিনোদিনীর চরিত্রকে মহিমান্বিত করলেও কাহিনিকে একটি স্বাভাবিক সমাপ্তি দিতে পারেনি। তথাকথিত মূল্যবোধ এবং সামাজিক শুদ্ধতা রক্ষার দায়ে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে চোখের বালির সমাপ্তি টেনে ছিলেন, তা ছিল রীতিমতো হাস্যকর ও আরোপিত। গল্পের শেষে মহেন্দ্রের কাকিমা অন্নপূর্ণার সাথে বিনোদিনী কাশীবাসী হওয়ার জন্য তৈরি হয়। তাদের বিদায় নেওয়ার শেষ মুহূর্তটি উপন্যাসের শেষে ঠিক এভাবে বর্ণিত হয়েছে:

মহেন্দ্র আসিয়া প্রণাম করিয়া বলিল, বৌঠান, মাপ করিয়ো। তাহার চোখের প্রান্তে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়াইয়া আসিল।

বিনোদিনী কহিল, তুমিও মাপ করিয়ো ঠাকুরপো, ভগবান তোমাদের চিরসুখী করুন।

অর্থাৎ যে বিনোদিনীর প্রেমে অন্ধ হয়ে সমাজ, সংস্কারের বিরুদ্ধে গিয়ে মহেন্দ্র বাড়িছাড়া হয়েছিল, তাকেই সে প্রণাম করে ক্ষমা চাইলো! আবার অনুশোচনায় চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রুও গড়িয়ে পড়লো। শুধু বর্তমান না, সেই অতীতের প্রেক্ষাপটেও এমন সমাপ্তি বেশ নাটকীয়ই বলা যায়। ঋতুপর্ণ ঘোষের চোখের বালিতে এতটা নাটকীয়ভাবে ইতি না টানলেও বিনোদিনীকে তার সাধের সংসার দিতে পরিচালকের মধ্যেও কার্পণ্য ছিল। তাই তো বিনোদিনীর প্রচণ্ড সংসার করার সাধকে তিনিও মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছেন দেশের কাজে ব্রতী বানিয়ে।

২ ঘণ্টা ৪৭ মিনিটের এই সিনেমায় বিনোদিনী চরিত্রে হাজির হয়েছিলেন বোম্বের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ঐশ্বরিয়া রাই। মহেন্দ্রর চরিত্রে ছিলেন প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি, আশালতার চরিত্রে রাইমা সেন ও বিহারীর চরিত্রে টোটো রায়চৌধুরী। সবাই স্ব স্ব অবস্থানে ভালো অভিনয় করলেও ঐশ্বরিয়া ছিলেন তাঁর ভূমিকায় অনন্য। তা ছাড়া ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচ্চিত্রের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সব সময়ই অনবদ্য ও শ্রুতিমধুর। চলচ্চিত্রের শেষে ওরা সুখের লাগি চাহে প্রেম আর আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে গানের সংযোজন সিনেমাটিকে এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে। ১৯০৩ সালে উপন্যাসটি যখন লেখা হয়, তখন দেশজুড়ে চলছে বঙ্গভঙ্গের মাতম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বঙ্গভঙ্গের প্রবল বিরোধী। তাই গানের সুর, বিনোদিনীর বালিকে লেখা চিঠি আর বিহারীর দেশের কাজের মাধ্যমে সেই উত্তাল সময়কেই ধারণ করেছেন পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। নিষিদ্ধ প্রেম, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা আর হারানো সময়কে নতুন করে দর্শকদের সামনে উপস্থাপনই যেন ঋতুপর্ণ ঘোষের চোখের বালিকে অনন্যতা দিয়েছে, দিয়েছে স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা।

তথ্যসূত্র

চোখের বালি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২ Chokher Bali, Times of India
৩ `Real’; `Imagined’; women: A Feminist Reading of Rituparno Ghosh’s film,  Alison Macdonald