নির্জন প্রান্তরের একাকী পথিক
শাহিদ আনোয়ার একজন আপাদমস্তক কবি। একজন তুখোড় মেধাবী ছাত্র। একজন নিখাদ প্রেমিক। ছিলেন মহাপৃথিবীর অজাতশত্রু পরিব্রাজক। সমাজমনষ্ক পরিবর্তনকামী আধুনিক মানুষ। পেয়েছেন অজস্র মানুষের ভালোবাসা। আরও অনেক ভালোর সাথে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। আমাদের ভালোবাসার মানুষ। আমাদের ভালো লাগা কবিতার স্রষ্টা।
নগরজীবনে পথচলতি কোনো মানুষের দেখা পেলে আপনাআপনি মন ভালো হয়ে যায়, আরও কিছুটা সময় তাঁর সান্নিধ্য পেতে মন চায়—এমন মানুষের সংখ্যা নিশ্চিতভাবে খুব বেশি নয়। এই বিরলপ্রজ মানুষের একজন শাহিদ আনোয়ার। আমরা যখন ছাত্ররাজনীতির চৌকাঠ মাড়ানো শুরু করেছি, তখন তিনি এ পাঠ শেষ করে পুরোদস্তুর কবি। লেখালেখির মনোবাসনা নিয়ে আমরা যখন ছন্দের বারান্দায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছি কিংবা বাম রাজনীতির স্ফুলিঙ্গ বুকে নিয়ে নিকোলাই অস্ত্রভস্কি কিংবা গোর্কিতে ডুব দিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, তখন শাহিদ আনোয়ার লিখছেন,
কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে
ধাত্রী আমায় মুক্ত কখন করবে?
শুনেছিলাম সূর্য দারুণ সুন্দর
শুনেছিলাম রাত্রি দারুণ সুন্দর
শুনেছিলাম তোমার ওমুখ সুন্দর
শুনেছিলাম বিশ্ব দারুণ সুন্দর
বন্ধ চোখের রন্ধ্রে আলো ঝরবে
ধাত্রী আমায় মুক্ত কখন করবে?
এই একটি কবিতা লিখে শাহিদ আনোয়ার যদি আর কোনো কবিতা না-ও লিখতেন, তবু তিনি আমাদের কাছে থেকে যেতেন আশির দশকের অতিপ্রিয় প্রতিভাবান একজন কবি হিসেবে। তদুপরি, যখন আরও এককদম এগিয়ে তিনি লিখে ফেলেন—
শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে
একটি গোলাপ ফোটে
একটি রেনু গর্ভে আমার
একটি রেনু ঠোঁটে।
একটি রেনু যাচ্ছে উড়ে
কালের বাড়ি পার
পানপাত্রে বাচ্চা বিয়োয়
মাতাল অন্ধকার
শুঁড়িখানার সকল রসিকজনের তখন দরাজ গলায় কোরাস ধরতে হ্য়—
শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে
একটি গোলাপ ফোটে
অমৃত দে অমৃত দে
অমৃত দে ঠোঁটে।
শাহিদ আনোয়ারের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি ঘোর তৈরি করেন। তুমুল ঘোর। এই ঘোরের খপ্পরে না পড়লে যে অনেক দেখাই চকিতের দেখা হয়ে যায়, সে কথা রসিকজনকে নিশ্চয়ই আর নতুন করে বলতে হবে না।
বুনো মহিষের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে গেলে লরি
বুকের পিঁজরাসহ কেঁপে ওঠে আমাদের পুরোনো ভবন
কখনো স্বপ্নে দেখি, এ-ভবন ধসে পড়ে ভেঙে চুরমার
কেউ বেঁচে নেই শুধু আমি একা
দু’হাতে সরিয়ে ধস-পানকৌড়ির মতো ঘাড় তুলে চাইছি বেরুতে।
স্বৈরাচারবিরোধী মিছিলের স্লোগান ছাপিয়ে আমরা স্বপ্নে দেখি,
এ-ভবন ধসে পড়ে ভেঙে চুরমার
কেউ বেঁচে নেই শুধু আমি একা
দু’হাত সরিয়ে ধস-পানকৌড়ির মতো ঘাড় তুলে চাইছি বেরুতে…
এসব কবিতা পাঠেই আমাদের বোধে এ কথা গেঁথে যেতে থাকে, পুরোনো ভবন ভেঙে ফেলাটা অতীব জরুরি! তাঁর কবিতাজুড়ে দৃশ্যের পর দৃশ্য চলচ্চিত্রের মতো চিত্রায়িত হতে থাকে। এসব দৃশ্যকল্প-দীর্ঘ মেয়াদে রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করতে চাইলে শাহিদ আনোয়ারীয় ঘোরের প্রয়োজন হয়। কবি যেমন স্বপ্নে দেখেন,
ভবন ধসে পড়ে ভেঙে চুরমার
কেউ বেঁচে নেই শুধু আমি একা…
এমনই আবেশী একাকিত্বময় ঘোলা চোখের নিবিষ্টতা-নিমগ্নতা দাবি করে তাঁর কবিতা। বুনো মহিষের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে লরি বুকের হাড়-পাঁজরা কাঁপিয়ে চলে গেলেও অদ্ভুত মায়াঘোর কাটে না যেন কিছুতেই। তিনি কি শুধুই ঘোরগ্রস্ত করেছেন আমাদের? এর উত্তরে প্রতিবেশিনীর জন্য এলিজি কাবিতাটি একটু পাঠ করা যাক—
যখন বাসায় গেলাম
তুমি তখন হাসপাতালে
যখন সমস্ত কেবিন খুঁজে কর্তব্যরত ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করি—
তুমি পরলোকে।
ফের বাসায় গেলাম
তুমি চিতায়
এবং যখন চিতায় গেলাম
তুমি পুড়তে পুড়তে অঙ্গার।
শুধু দুটি পোড়া পায়ের পাতা
দেখতে পেয়েছি
পরক্ষণে
তুমি পা গুটিয়ে নিয়েছো…।
চিরে ফালা ফালা করে দেওয়া-ভাবনার ঘোরগ্রস্ততাকে কুচি কুচি-আনাচকোটা করে দেওয়া দৃশ্যকাব্য! জীবনানন্দ, শক্তি কিংবা বিনয়দের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে যুগপৎ ছায়া ফেলে, আমাদের চিন্তার বিস্তীর্ণ জমিনজুড়ে। আধুনিকতার গ্লানিকর ধুলোমাখা নগরের পথে প্রান্তরে নিমগ্ন একাকী এক কবিকে আমরা খুঁজে পাই যিনি সকল অর্থহীন কোলাহলকে নির্দ্বিধায় তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে চলতে থাকেন তাঁর নিজস্ব গন্তব্যে। বলা বাহুল্য, আধুনিকতা কিংবা উত্তরাধুনিকতার গজফিতায় তাঁকে আঁটানো যাবে না কিছুতেই। কবির প্রতি কৃতজ্ঞতা এই যে, তিনি তাঁর নিজস্ব ভাবনার মহাসমুদ্রে অবলীলায় পাঠককে ডুব দিতে কিংবা ভাসতে দিয়েছেন! ভাসতে ভাসতে বা ডুবতে ডুবতে একেবারে তলিয়ে যেতেও যেখানে কোনো বাধা নাই যেন!
শাহিদ আনোয়ারকে আমরা কোনো কোলাহলে দেখি না। কোলাহল উপভোগ করতে দেখি। আলবেয়ার কামুর একা মানুষ! শক্তির কবিতার মত একা মানুষ। তিনি যেন সর্বত্র একাকী হাঁটছেন আর বিড়বিড় করে শক্তির কবিতা আওড়াচ্ছেন— ঘর ভর্তি মানুষ, তবু ঘর লাগছে ফাঁকা/ কারণ তুমি নেই/ কিছুদিনের জন্যে শুধু দূরে বেড়াতে গেছো…তুমি আসলে পরে/ দু’চোখ মেলে দু’চোখে চেয়ে থাকবো/ অনর্থক, পূর্ণ ঘরে, একা…
শাহিদ আনোয়ারকে দূর থেকে যখন দেখি একা একা হেঁটে যাচ্ছেন, তাঁর মাথাটা এপাশ ওপাশ দুলছে, জীবনানন্দ দাশের দু’টা লাইন মনের মাঝে দোলা দিয়ে যায়— একটি নক্ষত্র আসে, তারপর একা পায়ে চ’লে/ ঝাউয়ের কিনার ঘেঁষে হেমন্তের তারাভরা রাতে…
তাঁর রাজনীতিমনস্ক কবিতায়ও একাকিত্ব অন্য মাত্রা নিয়ে আসে,
এ টেবিল সে টেবিল সমস্ত টেবিল ফাঁকা
আমি একা
এখনো আসেনি কেউ…
একা মানুষের এই নিদারুণ একাকিত্ব পাঠকের হৃদয়ে তোলে হাহাকার! আর তাই তো সেই তরুণ বয়সে আমরা তাঁর কবিতার কাছে নতজানু হতে থাকি। কবি শাহিদ আনোয়ারের নমরুদ কবিতায়–
আল্লাহ বলেন, তুই
আমাকে মানতি না
ছুঁড়েছিলি দারুণ চ্যালেঞ্জ
তাই এক রঙিন বেশ্যা সেজে
তোকে আমি পাগল করেছি
ছুঁড়ে দিয়ে প্রেমার্দ্র আনার…।
একথাগুলো কবি কি অবলীলায় নিরুত্তাপ গলায় তেলাওয়াত করে যান, নিজস্ব ভঙ্গিমায়! এই কবিতাকে তিনি অন্য মাত্রায় নিয়ে যান শেষ স্তবকে,
নমরুদ শুয়ে থাকে সিজ্জিনে
অনন্ত পাপ শয্যায়
তবুও দুহাতে তার কবিতার নূর ঝলকায়।
আবার কবি যখন মুয়াজ্জিনের সুরে গেয়ে ওঠেন—
আমরা আল্লার রঙে রঞ্জিত হয়েছি
আর কে আছেন এমন সুন্দর?
তখন পাঠককেও গুনগুন করে গেয়ে উঠতে হয়—
সিবাগাতাল্লাহে ওয়ানমান
আহসান মিনল্লাহে সিবগাতান।
…
ওপরের লেখাটুকু কবি শাহিদ আনোয়ারের শ্রেষ্ঠ কবিতা যখন আগামী প্রকাশনী থেকে বের হচ্ছে, তখনকার। তখনো তার সঙ্গে মাঝে মধ্যে দেখা হতো। একটি আত্মভোলা কিশোর যেন নগরের পথে আপনমনে শিস দিয়ে বেড়াচ্ছে। অদ্ভুত সরল চাহনি-নিষ্পাপ হাসিমাখা মুখখানিজুড়ে কী যে মায়া! তখন তাঁর মনোজগতে কিছু কবিতার পঙ্ক্তি ছাড়া আর কিছু ছিল বলে মনে হয় না। জাগতিক সকল হিসাব-নিকাশ একপায়ে ঠেলে রেখে তিনি তখন শুঁড়িখানার এক মাতাল প্রেমিক, নির্জন প্রান্তরের একাকী পথিক! তাঁকে দেখেই আরও গভীরভাবে জেনেছিলাম—প্রেমিক হতে হলে এভাবে একাকী হাঁটতে জানতে হয়!
শাহীদ ভাইকে নিয়ে এ লেখা পড়ে আমাদের কৈশোর যেন ভেসে উঠলো। একেবারে আত্মভোলা এক শিশুতোষ চেহারা ছিল শাহীদ ভাইয়ের। দারুণ লিখলেন খোকন ভাই! কুর্নিশ জানাই শাহীদ ভাইকে, অনন্তলোক থেকে চেয়ে আছেন নির্নিমেষ....তাঁর সাথে মিছিলের পায়ে পায়ে হেঁটে চলা ছাত্র জনতা আজ নিজের নিজের তাল খুঁজতে খুঁজতে ডুবে গেছে আত্মকেন্দ্রিকতার অতল গহ্বরে । তবু কোথাও কোন কালে পাতা উল্টালে শাহীদ আনোয়ার বর্ণে বর্ণে ভেসে উঠে চোখের পাতায়! কুর্নিশ জানাই খোকন ভাই!
Sumi Khan
ডিসেম্বর ০৫, ২০২১ ০৯:৫৭